#উষসী_হাসবে_বলে (৩৯)
লিখা- Sidratul Muntaz
হঠাৎ তৃষাণের কথা মনে পড়ল উষ্ণতার। সে এসে এইভাবে তাদের কাছাকাছি দেখলে কি ভাববে? বহুদিন পর ইয়ামিনের সাথে দেখা হওয়ায় উষ্ণতা একটু সৌজন্যবোধ দেখাচ্ছিল। কিন্তু এতোকিছু মাথায় আসেনি তার।
ইয়ামিন ভাবছে অন্য কথা। সে একবার উষ্ণতার কাছে প্রতিজ্ঞ হয়েছিল যে কখনও তার সামনে আসবে না! সেটাও তৃষাণের কারণেই। প্রথম থেকেই তৃষাণ উষ্ণতার ব্যাপারে খুব পজিসিভ ছিল। অন্যদিকে ইয়ামিন তখন মাত্র কিশোর। তার হৃদয়ের প্রথম প্রেমের কলি প্রস্ফুটিত হয়েছিল উষ্ণতার মাধ্যমে। না চাইতেও বার-বার উষ্ণতার কাছেই ছুটে আসতো সে। এভাবেই একদিন তৃষাণ আর উষ্ণতার মাঝে তাকে নিয়ে তুমুল ঝগড়া হয়। তখনি উষ্ণতা বলেছিল আর কখনও যেন সে সামনে না আসে।
ইয়ামিনও উষ্ণতার মন রাখতে প্রতিজ্ঞা করেছিল। কিন্তু এখন আর সেই প্রতিজ্ঞা রাখার প্রয়োজন নেই৷ কারণ ইয়ামিন এখন আর আগের মতো উষ্ণতার প্রতি অনুভূতি পোষণ করে না। তাদের সম্পর্কের সমীকরণ অনেক বদলে গেছে। সময়ের সাথে সাথে সব স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। যেমনটা হওয়ার কথা ছিল।
উষ্ণতারও মনে হচ্ছে সে তার এক ছোটভাইকে দেখছে। যাকে একসময় সে স্নেহ করতো। অপ্রীতিকর মুহূর্তগুলো ভেবে মন খারাপ হচ্ছে না একটুও। যেন তাদের মধ্যে কখনও জটিলতার সম্পর্ক ছিলই না!
উষ্ণতা তবু বলল,” শোনো ইয়ামিন, আমার মনে হয় তোমার এখান থেকে চলে যাওয়া উচিৎ। কারণ..”
উষ্ণতা থামল। সে কারণটা বলতে চাইছে না। ইয়ামিনও তাকে বলার সুযোগ দিল না। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,” হুম, ঠিকাছে। কিন্তু আপনি একা যেতে পারবেন?”
” নিশ্চয়ই পারব।”
পেছন থেকে নার্স এসে বলল,” ম্যাডাম, আপনি এখনও যাননি? বাথরুম খুঁজে পাচ্ছেন না?”
উষ্ণতা এবার ইয়ামিনের দিকে চেয়ে হাসল৷ ইয়ামিন নার্সের উদ্দেশ্যে বলল,” ম্যাডামকে সাবধানে নিয়ে যাও।”
নার্স কয়েক মুহূর্ত বড় বড় চোখে ইয়ামিনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর প্রায় আৎকে ওঠা স্বরে বলল,” আরে… আপনি তো সেই সিংগার মানে ইয়ামিন ইব্রাহীম তাই না?”
ইয়ামিনের মনে পড়ে গেল তার মুখে এই মুহূর্তে মাস্ক নেই। ভুলেই গেছিল সে। মাস্ক ছাড়া পাবলিক প্লেসে ঘুরে বেড়ানো বিপদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। সে ঝড়ের গতিতে নিজের পকেট থেকে মাস্ক বের করে পরে নিল মুখে। তারপর উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করল। এদিকে নার্স এখনও স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
উষ্ণতা বলল,” এক্সকিউজ মি, সিস্টার। আমরা কি যাবো না?”
নার্স কোনমতে ঢোক গিলে বলল,” ম্যাম প্লিজ… আমি আসলে উনার বিরাট বড় ফ্যান। প্লিজ আমাকে উনার সাথে একটা ছবি তুলতে দিন? আমি পাঁচমিনিটে চলে আসবো।”
উষ্ণতা হেসে ফেলে বলল,” আমি আপনাকে বাঁধা দিবো না। আপনি চাইলে যেতেই পারেন। তবে যেভাবে ও পালিয়ে গেল তাতে মনে হয় না এখন ফ্যানদের সাথে ছবি তুলতে ইচ্ছুক! তাই আমার পরামর্শ থাকবে না যাওয়ার।”
নার্সের খুশিতে ভাঁটা পড়ল। মুখ ভোঁতা করে দাঁড়িয়ে রইল সে। ভীষণ আশাহত লাগছে। হঠাৎ লটারী পেয়ে যাওয়ার পর হাতছাড়া হয়ে গেলে যেমন লাগে, তেমন! সে কিছুক্ষণ নিজের উত্তেজনা সামাল দিয়ে বলল,” তাহলে আর কি করা! চলুন ম্যাডাম, যাওয়া যাক।” উষ্ণতা হেসে নার্সের হাত ধরল।
সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি উষসীর। সারাদিন নানান ঘটনায় গলা দিয়ে পানি অবধি নামেনি। এই মুহূর্তে গ্যাস্ট্রিকে বুকের পাশটা খুব ব্যথা করছে। বমি বমি লাগছে। না খেয়ে থাকলেই এই সমস্যাটা তার হয়। উষ্ণতার ডেলিভারীর দিনেও একই কান্ড হয়েছিল। উষসী বাথরুমের দিকে যেতে লাগল। তখনি ধাক্কা খেল ইয়ামিনের সঙ্গে।
” আরে উষু, কি হয়েছে? ঠিকাছো তুমি?”
উষসী মুখে হাত ঠেঁকিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল,” বমি বমি লাগছে। ওয়াশরুমে যেতে হবে।”
” চলো আমি নিয়ে যাচ্ছি।”
” তুমি লেডিস ওয়াশরুমে ঢুকবে?”
” বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব না হয়। চলোতো এবার!”
বিয়ের পর থেকে উষসী ইয়ামিনকে ‘তুমি’ করে বলতে শুরু করেছে। ইয়ামিনের কাছে ব্যাপারটা চমৎকার লাগছে। মনে হচ্ছে তাদের বুঝি দশ-বারো বছরের সংসার! উষসীকে ধরে ওয়াশরুমের কাছে আনল ইয়ামিন। উষসী বেসিনের কাছে গেল আর হরহর করে বমি ছেড়ে দিল। সকালে দু’টো রুটি খেয়েছিল। সেগুলোই বের হয়ে গেছে। কি আশ্চর্য, তার কি হজমে সমস্যা? এতো অদ্ভুত লাগছে কেন? মাথা ঘুরে আসছে!
ইয়ামিন কাছে এসে দুইহাতে উষসীকে আগলে ধরল। খুব বিচলিত হয়ে বলল,” কি হয়েছে তোমার? কেন এমন করছো হঠাৎ? ”
উষসী দূর্বল গলায় বলল,” দুপুর থেকে কিছু খাইনি। তাই মনে হয়!”
ইয়ামিন কাতর গলায় বলল,” চলো তাহলে ক্যান্টিনে৷ খেয়ে নাও কিছু।”
” এই মুহূর্তে আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে না ইয়ামিন!”
ইয়ামিন চোখ-মুখ শক্ত করে তাকাল। শাসনের স্বরে বলল,” তোমাকে আসতে বলেছি।”
উষসীও কম জেদি না। দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বলল,” যদি না যাই? কি করবে তুমি? বললাম তো এখন আমার খেতে ইচ্ছে করছে না!”
ইয়ামিন ক্ষণকাল তাকিয়ে থেকে তাকে কোলে তুলে বলল,” এইভাবে নিয়ে যাবো।”
উষসী বিস্ময় আর লজ্জায় স্তব্ধীভূত। আশেপাশের সবার নজর এখন তাদের দিকে। উষ্ণতা ঠিক পেছনে দাঁড়িয়েই কিছুটা দূর থেকে পুরো ব্যাপারটা দেখছিল। নার্স ঝুমুর এসে বলল,” ম্যাম, সামনের একটা টয়লেট খালি আছে। আপনি ওখানে চলে যান।”
উষ্ণতা মিষ্টি করে হেসে বলল,” যাচ্ছি।”
ফারদিন অনেকক্ষণ ধরে উশখুশ করছে। প্রিয়ন্তি তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,” কিছু বলবে?”
ফারদিন প্রথমে ঠোঁট ভাজ করল। একটু পর গাল চুলকে চিন্তিত গলায় বলল,” একটা ঘটনা ঘটেছে।”
” কি ঘটনা?”
” কাজী সাহেব বিরিয়ানি খেতে চাইছেন।”
” মানে?” প্রিয়ন্তি এহেন কথা শুনে চেহারা কুঁচকে ফেলল।
ফারদিন অপ্রতিভ স্বরে বলল,” মানে.. উনাকে তো উনার টাকা দেওয়া হয়েছে। আমি উনাকে বুঝিয়ে বলেছি যে আমাদের হসপিটালে যেতে হবে, ইমারজেন্সী! উনি যাতে চলে যান। কিন্তু উনি না গিয়ে উল্টা আমাদের ফলো করে হাসপাতালে চলে এসেছেন। বলছেন আমরা যখন বাড়ি যাবো উনিও আমাদের সাথে যাবেন। রাতের খাবার খাবেন। বিরিয়ানি না হলে ডালভাত হলেও খাবেন!”
প্রিয়ন্তি মৃদু হাঁ করে তাকিয়ে রইল৷ আশ্চর্য বিরক্তিকর ব্যাপার তো! ফারদিন পকেট থেকে মোবাইল বের করে বলল,”এইযে, আবার ফোন দিচ্ছেন।”
প্রিয়ন্তি ক্রোধান্ধ হয়ে বলল,” এবার আমাকে দাও।হ্যালো।”
ওই পাশ থেকে কাজী সাহেব বললেন,” আব্বাজান, স্যরি… আম্মাজান আসসালামু আলাইকুম। ”
প্রিয়ন্তি বিদ্বিষ্ট স্বরে সালামের উত্তর নিয়ে বলল,” কি চান আপনি? টাকা পেয়েছেন না?”
” আম্মাজান, টাকাটাই কি বড় বিষয়? আন্তরিকতার একটা ব্যাপার আছে না? নতুন দম্পত্তি বিয়ে করেছে। একটু খানা-দানার আয়োজন না করলে ব্যাপারটা কেমন দেখায়? ঝাল খাওয়া হবে, মিষ্টি খাওয়া হবে তারপর তাদের জন্য মোনাজাত ধরে আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে হবে। তবেই না তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে সুখ আর সমৃদ্ধি আসবে! তাই না আম্মা?”
ফারদিন চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে। এতোক্ষণ ধরে কাজী সাহেব কি হাব-জাব বলছেন? প্রিয়ন্তি কিটমিট করল,” শুনুন, তাদের জীবনের সুখ-শান্তি তারা বুঝে নিবে। এমনিই অশান্তির শেষ নেই৷ তার উপর আপনি ভেজাল করবেন না প্লিজ। আমরা যথেষ্ট ঝামেলায় আছি।”
” তাহলে তো আম্মা একটা মিলাদ খুবই দরকার। আগে বিয়ের খানা-দানাটা হয়ে যাক, দোয়া হোক। তারপর আমি মিলাদের ব্যবস্থাও করব ইনশাআল্লাহ! আপনারা বিপদে আছেন তা আমি বুঝতে পারছি আর সেজন্যই বার বার দোয়ার কথা বলতেছি। দোয়া ছাড়া ভাগ্য পরিবর্তনের ক্ষমতা কারো নাই। আল্লাহর দরবারে যদি দোয়া কবুল…”
“উফ… আপনি চুপ করুন। আমি নিচে আসছি।”
অতিষ্ট হয়ে ফোন রাখল প্রিয়ন্তি৷ তৃষাণ স্টিলের চেয়ারে বসে একটু পানি খাচ্ছিল। সে অবাক হয়ে বলল,” কোনো সমস্যা?”
প্রিয়ন্তি নিজেকে ধাতস্থ করল। সে ঠিক এই ভ’য়টাই পাচ্ছিল৷ তৃষাণ যদি কাজী সাহেবকে দেখে ফেলে তাহলে কি হবে? এই মুহূর্তে কিছুতেই উষসী আর ইয়ামিনের বিয়ের খবর ফাঁস করা যাবে না। তৃষাণের মন-মেজাজ এমনিতেও ভালো নেই!
প্রিয়ন্তি হাসার ভাণ করে বলল,” তেমন কিছু না ভাইয়া। আমি ফারদিনকে নিয়ে একটু নিচে যাচ্ছি।”
ফারদিন বিনয়ী ভঙ্গিতে বলল,” আমাদের একটা স্পেশাল গেস্ট এসেছে..”
প্রিয়ন্তি কটমট করে তাকাল। ফারদিন দ্রুত চুপ হয়ে গেল। তৃষাণ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” কে গেস্ট? এখানে চলে আসতে বলো।”
প্রিয়ন্তি চোখের ইশারায় ইচ্ছেমতো ফারদিনকে তুলোধুনো করছে। ফারদিন ভ’য়ে চুপসে আছে। আর কোনো কথাই বলল না সে। প্রিয়ন্তি বলল,” নিচে গিয়ে দেখে আসি আগে ভাইয়া। উনি মনে হয় বেশিক্ষণ বসবে না। ফারদিনের বন্ধু হয়। খুব ব্যস্ত মানুষ।”
” ও আচ্ছা। ঠিকাছে যা তোরা। আমার সমস্যা নেই।”
প্রিয়ন্তি এক ছুটে ফারদিনকে নিয়ে লিফটের কাছে এলো। লিফটে উঠেই ইচ্ছে মতো ঘুষি মা’রতে লাগল তার বাহুতে,”মুখ এতো চলে কেন তোমার? গেস্টের কথা বলার কি প্রয়োজন ছিল? ভাইয়া যদি এখন দেখা করতে চাইতো?”
ফারদিন কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল,” উষ্ণতা ভাবীর এই অবস্থায় ভাইয়া আমাদের গেস্টের সাথে দেখা করতে চাইবে এটা আমার মাথাতেও আসেনি।”
” তোমার এই মোটা মাথায় কিছু আসবেও না। নিজে তো এক সাইকো, কাজীও ধরে এনেছো আরেক সাইকো। বিরিয়ানি খাওয়ার জন্য ম’রে যাচ্ছে বেটা। আজ তাকে আমি জন্মের বিরিয়ানি খাওয়াবো, দাঁড়াও না!”
” প্লিজ, বেশি সিন ক্রিয়েট কোর না। মৌলবি মানুষ! ”
” চুপ!”
প্রিয়ন্তির ধমকে ফারদিনের কলিজা ছ্যাঁত করে ওঠে। আদরের বউয়ের মুখে কথায় কথায় ধমক শুনতে কার ভালো লাগে? অবশ্য সেও তো কম বোকামি করে না! আর প্রিয়ন্তি যেহেতু বয়সে বড়, একটু শাসন করবেই৷ এটা সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছু নেই। পরে আবার সে-ই তো আদর করবে! এসব ভেবে ফারদিন নিজেকে মনে মনে সান্ত্বনা দেয় আর কি!
গ্রাউন্ড ফ্লোরের লবিতে আয়েশ করে সোফায় বসে আছেন কাজী সাহেব। বহুদিন পর এমন দামী হাসপাতালে ঢোকার সৌভাগ্য হয়েছে তার। এরা এতো বড়লোক, অথচ তাকে সামান্য মোরগ-পোলাও খাওয়াতে পারছে না? অথচ গরীবের বাড়িতে যত্ন করে বসিয়ে কতই আদর-আপ্যায়ন করে! বড়লোকের পয়সা থাকলে কি হবে? মন নেই। তিনি বড়ই হতাশ!
প্রিয়ন্তি কাছে এসে বলল,” এই উঠুন।”
কাজী সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। গায়ের আল্লাখাল্লা ঠিক করতে করতে বললেন,” আম্মাজান, কে অসুস্থ? আমাকে বলেন। আমি কি তাকে একটু পানি পড়া দিবো? আল্লাহর কালাম হইছে বড় চিকিৎসা। আল্লাহ না বাঁচাইলে পৃথিবীর যত বড় ডাক্তারই আসুক কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না।”
প্রিয়ন্তি রুঢ় গলায় বলল,” কেউ ম’রছে না আমাদের। সামান্য অসুস্থতা। আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না!”
” তাহলে তো আম্মা শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। খানা-পিনার পর সবাই মিলে দুই রাকাত শোকরানার নামায আদায় করলে…”
প্রিয়ন্তি আঙুল উঠিয়ে বলল,” আপনি কিন্তু একটু বেশিই কথা বলছেন। আমাদের ফলো করতে করতে হাসপাতালে চলে আসার মানে কি হুম? খাওয়া? মানে আপনি শুধু খেতে চান তো?”
” আম্মা, ভুল বুঝবেন না। আগেও বলছি খাওয়া বড় কথা না…”
প্রিয়ন্তি ফারদিনের দিকে ঘুরে বলল,” উনাকে নিয়ে ক্যান্টিনে চলে যাও। যা খেতে চায়, খাইয়ে বিদায় করো। প্লিজ!”
কথাটা বলে শেষ করতে না করতেই সে দেখল তৃষাণ উষ্ণতাকে নিয়ে লিফট থেকে বের হচ্ছে। আতঙ্কের স্রোত প্রবাহিত হলো প্রিয়ন্তির শরীরে। ফারদিন বলল,” কি হয়েছে?”
প্রিয়ন্তি বলল,” যাও, দ্রুত যাও।”
প্রিয়ন্তির দৃষ্টিকে অনুসরণ করে সামনে তাকিয়ে ফারদিনও আৎকে উঠল। তারপর কাজী সাহেবকে নিয়ে দ্রুত কেটে পড়তে চাইল।
ফারদিন কাজী সাহেবের হাত ধরে তুমুল গতিতে ক্যান্টিনের দিকে যাচ্ছিল। তখনি তৃষাণ তাকে দেখে ফেলল এবং ডাকল,” ফারদিন!”
ফারদিন শুনেও না শোনার ভাণ করে দ্রুত চলে যাচ্ছে। তৃষাণ তার সামনে গিয়ে তাকে থামিয়ে বলল,” দৌড়াচ্ছো কেন? আমি যে ডাকছি শুনছো না?”
ফারদিন ভয়ে চুপসে গেছে। প্রিয়ন্তিও থতমত খেয়ে কোনমতে নখ কামড়াতে লাগল৷ উষ্ণতা তার পাশে এসে দাঁড়াল,” কি হয়েছে প্রিয়? তোমরা এখানে কি করছিলে?”
প্রিয়ন্তি হাসার চেষ্টা করল। প্রসঙ্গ বদলানোর উদ্দেশ্য বলল,” কেমন আছো উষ্ণতা ভাবি? কতদিন পর তোমার সাথে দেখা! কিন্তু এইভাবে দেখা হবে স্বপ্নেও ভাবিনি।”
এই বলে সে উষ্ণতাকে একটা হাগ দিল। তৃষাণের অবশ্য এদিকে মনোযোগ নেই। সে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কাজী সাহেবের দিকে। তিনি দূরে দাঁড়িয়ে হাসছেন। তাদের কথোপকথন শুনছেন না৷
ফারদিন কিছু না পেয়ে বলল,” আমার বন্ধু। উনিই স্পেশাল গেস্ট আমাদের। ক্যান্টিনে নিয়ে যাচ্ছিলাম। অনেকদিন পর দেখা তো, ভাবলাম একসাথে খাওয়া-দাওয়া করি দু’জন!”
তৃষাণ আপত্তি ভরা কণ্ঠে বলল,” উনি তোমার বন্ধু?”
ফারদিন একবার কাজী সাহেবের মুখের দিকে চাইল। মুহূর্তেই নিজের গালে চ’ড় মারতে মন চাইল তার। চল্লিশোর্ধ্ব পুরুষ তার বন্ধু হবে কেমন করে? তাছাড়া সে বড় হয়েছে ইউরোপে। আর এই ভদ্রলোক একজন মৌলবী। কোনোদিক দিয়েই কানেকশন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তৃষাণ যেন ব্যাপারটা মানতেই পারছে না এমনভাবে তাকিয়ে আছে।
ফারদিন বলল,” ও দাখিলে ভর্তি হয়েছিল। সেজন্য আমরা আলাদা হয়ে গেছিলাম। আজ এতোদিন পর আবার দেখা। আমরা সেই স্কুলবেলার বন্ধু! ও আসলে অনেকবার ফেইল করে স্কুলে ভর্তি হয়েছিল তো তাই আমার থেকে বয়সে বড়। হাহাহা!”
তৃষাণ কোনমতে বলল,” ওহ।”
তারপর সে চলেই যাচ্ছিল। তখনি কাজী সাহেব এগিয়ে এসে বললেন,” আসসালামু আলাইকুম আব্বাজান, ভালো আছেন? উনি কি আপনার বিবিজান? শরীর সুস্থ আছে তো উনার?”
তৃষাণ চোখ বড় করে অদ্ভুত দৃৃষ্টিতে তাকাল। ফারদিনের বন্ধু তাকে ‘আব্বাজান’ বলে ডাকছে, ব্যাপারটা যেন ঠিক হজম হলো না! ফারদিনের তখন মন চাইছে দৌড়ে পালিয়ে যেতে। তৃষাণ এবার তাকে প্রশ্ন করলে সে আর উত্তর দিতে পারবে না! যথেষ্ট মিথ্যা বলা হয়ে গেছে আজ।
প্রিয়ন্তি রাগে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। তার এই কাজী সাহেবের উপর বেজায় মেজাজ খারাপ হচ্ছে। তৃষাণ সবার মুখের দিকে চেয়ে অদ্ভুতভাবে একটু হাসল। কাজী সাহেব বললেন,” আর কেউ আছে বিবাহযোগ্য?”
” মানে?” তৃষাণ কৌতুহল নিয়ে তাকাল।
প্রিয়ন্তির মন চাইল কাজীর মুখটা গিয়ে চেপে ধরে। ফারদিন কি করবে বুঝতে পারছে না। সে কি পেছন থেকে একটা লাঠি নিয়ে কাজী সাহেবের মাথা ফা*টিয়ে দিবে?
যেখানেই বাঘ আসে সেখানেই সন্ধ্যা হয় এমন একটা প্রবাদ আছে না? সেটাই সত্যি হলো এবার। ঠিক এমন মুহূর্তেই দেখা মিলল ইয়ামিন আর উষসীর৷ তারা দু’জনেই ক্যান্টিন থেকে বের হচ্ছে। ইয়ামিনের হাতে জুস। উষসীর হাতে স্যান্ডউইচ। তারা একে-অন্যকে খাইয়ে দিচ্ছে আর হাসি-খুশি গল্প করতে করতে লিফটের দিকে যাচ্ছে। পৃথিবীর কোথাও কোনো খেয়াল নেই তাদের। যেন তারাই একে-অন্যের পৃথিবী! কাজী সাহেব সেদিকে চেয়ে থেকে বললেন,” আহা, কি মিল! কি মোহব্বত! মাশআল্লাহ, মাশআল্লাহ!”
তৃষাণ রুক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে তাদের। কাজী তৃষাণের দিকে ফিরে উৎসাহী কণ্ঠে বললেন,” আমি এই পর্যন্ত যত জনের বিয়ে পড়িয়েছি.. তারা সবাই আল্লাহর অশেষ রহমতে সুখী হয়েছেন। এরাও…”
ফারদিন আর পারল না। কাজী সাহেবকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,” অনেক হয়েছে। এবার চলুন। খেয়ে বিদায় হবেন। আর আমাদেরও নিস্তার দিবেন।”
তৃষাণ তখনও লিফটের দিকে তাকানো। ইয়ামিন আর উষসী লিফটে উঠে উপরে চলে গেল। তাদের একসাথে দেখে তৃষাণের ব্রক্ষতালু এমনভাবে জ্বলে উঠেছে যে কাজী সাহেবের কথা খেয়ালই করল না। তবে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল। এই মুহূর্তে কিছুই বলতে গেল না সে। তবে এইটুকু বুঝে নিল যে প্রিয়ন্তি আর ফারদিনও তাদের সাহায্য করছে! তৃষাণ পরবর্তীতে সবাইকে দেখে নিবে। তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরী উষ্ণতা। তাই সে উষ্ণতার কাছে গেল। তার প্রেসক্রিপশনটা হাতে নিল। জরুরী কিছু ঔষধ কিনে নিতে হবে। তৃষাণকে নিশ্চিন্তে ফার্মেসীর দিকে যেতে দেখে প্রিয়ন্তি যেন এবার হাঁফ ছেড়ে খুব বাঁচা বাঁচল!
ঠিক সেই মুহূর্তে উষ্ণতা প্রশ্ন করল,” প্রিয়ন্তি আপু…কি চলছে বলোতো আমাকে?”
প্রিয়ন্তি চমকে তাকাল। উষ্ণতার ঠোঁটে চাপা হাসি!
চলবে