উষসী হাসবে বলে পর্ব-৯+১০

0
298

#উষসী_হাসবে_বলে (৯)
লিখা- Sidratul Muntaz

উষসীর প্যারিস যাওয়ার কথা শুনে রিয়াসাত ক্ষেপে গেল। ব্যাপারটা উষসী আগেই আঁচ করেছিল। কিন্তু এজন্য যে সে এমন অপ্রত্যাশিত কাজ করবে তা ভাবনার বাইরে। উষসী ব্যাগ গোছাচ্ছিল নিজের ঘরে। রিয়াসাত ঢুকেই দরজা আটকে দিল।

উষসীর ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠল অপরিমিত রোষে। চোখ বড় করে ধমক দিল,” তোমার সাহস কিভাবে হয়?”

এই কথা বলে দরজা খোলার জন্য এগোতে নিলেই তীব্রভাবে তার হাতের বাহু চেপে ধরল রিয়াসাত। ব্যথায় আর রাগে উষসীর নাক লালচে হয়ে গেল। রিয়াসাত তেজভরা গলায় বলল,” কোথাও যাচ্ছো না তুমি।”

উষসী উত্তপ্ত চোখে তাকাল। রিয়াসাত কাঠ কাঠ গলায় বলল,” এখনি বাইরে গিয়ে সবাইকে নিষেধ করে দিবে। বলবে তুমি অসুস্থ। তাই যাবে না কোথাও৷ গট ইট?”

কথা শেষ করে রিয়াসাত ঝাঁকি মেরে তার হাত ছাড়ল। ব্যথায় হাতের বাহু অবশ হওয়ার যোগাড়। দরজা খুলে বের হয়ে যায় রিয়াসাত। উষসী ধপ বিছানায় বসে। এর দুইমিনিট পরেই ঘরে ঢোকেন মিসেস শিমলা। তিনি সবকিছু দেখতে পেয়েছেন।

উষসীর কাছে এসে কোমল গলায় জানতে চাইলেন,” কি হয়েছে মা? রিয়াসাত কি তোমাকে বিরক্ত করছে? তাহলে নির্দ্বিধায় বলতে পারো। ও আমার ননদের ছেলে। সেই ছোট্টবেলা থেকে ওকে দেখে আসছি। ওর স্বভাব-চরিত্রের ব্যাপারে সবকিছু জানি আমি। তুমি শুধু একবার আমার সাথে প্রবলেমটা শেয়ার করে দেখো, আমি সব ঠিক করে দিবো।”

উষসীর চোখে তখন অশ্রু টলমল। অসহায়ত্বে নয়, সে নিজের বোকামির উপর ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে কাঁদছে। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে নিজের উপর। ইচ্ছে করছে সপাটে কয়েকটা চড় মেরে বসতে নিজের গালেই। কেন এতোটা বোকামি করেছিল সে? তার বোকামির মাশুল এখন সারাজীবন দিতে হবে।

শিমলা উষুর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললেন,” আমাকে বিশ্বাস করো। তোমার ভ-য় নেই। আমি কাউকে কিচ্ছু বলব না।”

উষসী যেহেতু কেঁদে ফেলেছে আর সেই চোখের পানিও শিমলা আন্টি দেখে নিয়েছেন, তাই আর লুকিয়ে কাজ নেই। উষসী সত্যিটাই বলবে ঠিক করল৷ তবে সবকিছু বলল না। আংশিক গোপন রাখল।

” দুইবছর আগে যখন সুইজারল্যান্ড এসেছিলাম তখন রিয়াসাত ভাই আমাকে পছন্দ করেন আর প্রেমের প্রস্তাব দেন। আমি রাজি হইনি। উনি আমার পেছনে আঠার মতো লেগে ছিলেন। তারপর বাংলাদেশে ফেরার পর আমি রাজি হই। সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের কথা-বার্তা চলতে থাকে। একসময় তার দোষেই আমি ব্রেকাপ করেছিলাম। ব্যাপারটা সে মানতে পারেনি। এখন সে আমাকে থ্রেট করছে যে আমার পারসোনাল চ্যাটের স্ক্রিনশট আমার আপু অথবা তৃষাণ ভাইয়ার কাছে মেইল করবে।”

শিমলা খুবই হতাশা ভরা চোখে তাকালেন। তিনি এমন কিছুই চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু উষসীর মতো বুদ্ধিমতী আর সুন্দরী মেয়ে কিভাবে রিয়াসাতের মতো বাটপারের পাল্লায় পড়ল তা তিনি ভেবে পেলেন না। তাকে নিয়ে পরিবারে অনেক আজে-বাজে রেকর্ড আছে। লোক ঠকানো তার স্বভাব। সে ভালো মিমিক্রি জানে। তাই বিভিন্ন মানুষকে ফাঁদে ফেলে দেয় সহজেই। উষসীও হয়তো তার কৌশলের স্বীকার হয়েছে।

একটা ছোট্ট নিশ্বাস ত্যাগ করে শিমলা বললেন,” তুমি কিচ্ছু চিন্তা কোর না। আমি রিয়াসাতকে দেখব।”

উষসী করুণ গলায় অনুরোধ করল,” আন্টি প্লিজ, আমাদের মধ্যে যা কথা হয়েছে তা যেন কেউ জানতে না পারে। বিশেষ করে ডোনা আন্টি কিংবা প্রিয়ন্তী আপু। আসলে এই ব্যাপারটা বাসায় জানাজানি হলে আমার সমস্যা হবে।”

” তোমাকে এই ব্যাপারে চিন্তা করতে নিষেধ করেছি আমি। রিয়াসাত আর তোমার কিচ্ছু করতে পারবে না৷ ওর মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থা আমার কাছে আছে।”

মিসেস শিমলা কি করেছিলেন তা আর জানল না উষসী। কিন্তু এরপর রিয়াসাত আর একবারও তার মুখোমুখি হয়নি। প্যারিস যাওয়ার সময়ও কোনোরূপ সিন ক্রিয়েট ঘটানোর চেষ্টা করেনি। হঠাৎ তার এমন নির্লিপ্ততায় উষসী বিস্মিত হয়। তবে মনে মনে শিমলা আন্টির প্রতি কৃতজ্ঞতাও অনুভব করে। তাদের প্যারিস পৌঁছাতে পাঁচটা বেজে গেল।

প্রাকৃতিক সম্পদের অতুলনীয় সৌন্দর্য্যমন্ডিত স্থান প্যারিস। স্থাপত্য, ভাস্কর্য্যের কারখানা এখানে। প্রাচীন রাজপ্রাসাদ এবং অট্টালিকা, গির্জা, জাদুঘর, গ্যালারিতে টইটম্বুর। ফ্রান্সের রাজধানী হিসেবে সৌন্দর্য্যের আরেক নাম প্যারিস। শহরের সৌন্দর্য্য যেমন পর্যটকদের মহিমান্বিত করে তেমনি সাবেকিয়ানা যেন নস্টালজিয়া জাগায়!

শহরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলেই মন- প্রাণ শান্তিতে ভরে ওঠে। ঝাঁ চকচকে কংক্রিট এবং পাথরের রাস্তা। অপূর্ব সুন্দর বাগান, আকাশের নীচে খোলা রেস্তোরাঁ যে কাউকে মুগ্ধ করবে। কে না জানে প্যারিসের বিখ্যাত আইফেল টাওয়ারের কথা? এছাড়াও নোত্রে ডেম ক্যাথিড্রাল, মিউসি ডু লাভার, পালাইস গার্নার, অপেরা ন্যাশনাল ডি প্যারিস, সেইন নদীর নৌবিহার, লাক্সেমবার্গের বাগান ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতাই অন্যরকম।শহরের আনাচকানাচে আর্ট গ্যালারি রয়েছে। সহজেই উপলব্ধি হয় স্টাইল এবং ফ্যাশনের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ এই প্যারিস শহর।

তাছাড়াও বিশ্বের সেরা রোম্যান্টিক ডেস্টিনেশন হিসেবে গণ্য করা হয় প্যারিসকে। তবে বরফে আবৃত শুভ্র প্যারিস শহর যেন সৌন্দর্য্যে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে।

গাড়ি থেকে নামার পর জানা গেল ইয়ামিন নাকি হোটেল ভাড়াই করেনি। সবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ফারদিন জিজ্ঞেস করল,” হোটেল না বুক করলে আমরা এখন যাবো কোথায় ইয়ামিন ভাই?”

ইয়ামিন সরল গলায় বলল,” আমার সাথে রেডিসনে যাবেন!”

বিস্ময়ে চমকে উঠল সবাই। প্রিয়ন্তী হতবাক চিত্তে বলল,” এতো এতো তারকাদের মাঝখানে আমরা থাকব? ব্যাপারটা কি ঠিক হবে?”

” কেন ঠিক হবে না? মনে হয় দুই রুম আমাদের জন্য এনাফ। শুধু শুধু হোটেল ভাড়া করার দরকার নেই। এখানে থাকাই ভালো। সবার সাথে দেখা হবে। আমাদের গেস্ট হিসেবে তোমাদের যত্নের কমতি হবে না।”

ইয়ামিন তার কথা শেষ করে মৃদু হাসল। তৃষ্ণা চোখ বড় করে রেডিসনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে এটা কোনো রাজপ্রাসাদের থেকে কম নয়৷ আর বাইরে এতো-শত গার্ড যেন সত্যিই ভেতরে রাজা-মহারাজারা আছেন। রাতে তাদের ইউভান শেখের সাথে ডিনার৷ এই কথা শুনে প্রিয়ন্তী ভীষণ উত্তেজিত হয়ে গেল। সে ইউভান শেখের বিরাট ফ্যান। তার সঙ্গে এক টেবিলে বসে খাওয়া- দাওয়া করবে ব্যাপারটা চিন্তা করেও দম বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা।

ফারদিন তার আচরণ দেখে বলে বসল,” আমাদের বিয়ে নিয়েও মনে হয় তুমি এতো এক্সাইটেড না যতটা আজকের ডিনার নিয়ে এক্সাইটেড।”

প্রিয়ন্তী আপ্লুত গলায় বলল,” এক্সাইটেড হবো না মানে? তুমি চিন্তা করতে পারছো… এতোবড় একজন সুপারস্টার আমাদের সঙ্গে ডিনার করবেন! ওই মাই গড! আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। আচ্ছা, আমি কোন ড্রেসটা পরব? উষু একটু আইডিয়া দে না। কিরকম ড্রেসআপ করা উচিৎ? ”

” ডিনারের এখনও অনেক সময় বাকি আছে প্রিয়।” ফারদিন যেন বিরক্ত। প্রিয়ন্তী বলল,” উফ তুমি বুঝতে পারছো না। আজকের ডিনারটা আমার জন্য কত স্পেশাল!”

ফারদিন উপহাস করে বলল,” তাহলে একেবারে বিয়ের লেহেঙ্গাই পরে ফেলো না! এতো যখন স্পেশাল!”

উষসী তাদের কথায় ঠোঁট চেপে হাসছে৷ ফারদিন যে ঈর্ষায় মরে যাচ্ছে এটা তার কথাতেই স্পষ্ট। তাছাড়া প্রিয়ন্তী মনে হয় ফারদিনের পজিসিভনেসের ব্যাপারটা উপভোগ করছে। সেজন্য ইচ্ছে করেই আরও নাটক করছে। মেয়েরা তাদের প্রিয় পুরুষের বুকে আগুন জ্বালাতে ভালোবাসে।

ডিনারে সবাই একত্রে বসে আছে। ইয়ামিনও উপস্থিত। কিন্তু ইউভান শেখ এখনও আসেননি। অবশ্য এটা জানাই ছিল। সুপারস্টার বলে কথা। নিজের মূল্য বোঝাতে একটু-আধটু অপেক্ষা তো করাবেনই। তৃষ্ণার পেটে নাকি ইঁদুর রেস লাগিয়েছে। তাই ইয়ামিন তার জন্য একটা বড় সাইজের চিকেন অর্ডার করে দিল।বাচ্চা মানুষ খাওয়া শুরু করুক। উষসী তাকে পরম যত্নে চিকেনটা খাইয়ে দিচ্ছে।

প্রিয়ন্তী জমকালো সাজে এসেছে। তবে উষসীর সাজ খুব হালকা। তা দেখে ফারদিন বলল,” তোমার থেকে উষুকেই দেখতে বেটার লাগছে। দেখো, কি সিম্পল লুক! অথচ তোমাকে দেখাচ্ছে আলিফ লায়লার ভূতের মতো। ”

প্রিয়ন্তী কটমটে চোখে তাকাল। বিড়বিড় করে বলল,” ছেলে মানুষের পেটে এতো হিংসা!”

একটু পর জানা গেল ইউভান শেখের সাথে তার কো-স্টার অলিভিয়া প্যাটেলও আসবেন। সেজন্যই তাদের এতো দেরি হচ্ছে। ফারদিন বলে উঠল,” ধ্যাত, অলিভিয়া আসছে জানলে আরেকটু ফিটফাট হয়ে আসতাম।”

প্রিয়ন্তী তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল,” অলিভিয়া প্যাটেলের নাম শুনেই মনে লাড্ডু ফুটছে তাই না?”

ফারদিন শান্ত গলায় বলল,” নাউ ইউ ক্যান ফীল মি।”

তাদের কথোপকথন শুনে উষসী হাসছে। ইয়ামিনের অবশ্য এদিকে মনোযোগ নেই। সে তার স্ক্রিপ্ট নিয়ে ব্যস্ত। একটু পরেই ইউভান শেখ হাজির হলেন। খুবই ক্যাজুয়াল পোশাকে এসেছেন৷ ধূসর টি-শার্ট, চেক ট্রাউজার, এলোমেলো চুল৷ ঠোঁটে আন্তরিক হাসি। কে বলবে এই লোকের বয়স চল্লিশ? দেখে মনে হচ্ছে ত্রিশ বছরের যুবক। তিনি এসেই ইয়ামিনকে জড়িয়ে ধরলেন। তাদের সম্পর্ক বেশ গভীর সেটা বোঝা গেল। ইয়ামিন সবার সাথে পরিচয় করাল। তিনি একে একে করমোর্দন করলেন। তৃষ্ণা অবাক হয়ে বলল,” আরে, এটা তো টিভির ওই ডিসুম ডিসুম আঙ্কেলটা।”

তার অবাক হওয়া দৃষ্টির দিকে চেয়ে হেসে ফেললেন ইউভান। আদর করে তার গাল টিপে দিয়ে বললেন,” সুইট বয়।”

অভিনেত্রী অলিভিয়া প্যাটেলও কম নয়। মেকাপ ছাড়াও এতো সুন্দর দেখতে তিনি ব্যাপারটা না দেখলে কেউ বিশ্বাসই করবে না। উষসী অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। সেলিব্রিটি হিসেবে এতোটুকু অহংকার নেই তাদের মধ্যে। বেশ হাম্বল দু’জনেই। তবে কথা-বার্তায় যেন ব্যক্তিত্ব ঝরে পড়ছে।

অলিভিয়া একেবারে ইয়ামিন পাশের চেয়ারেই বসেছে। তার প্রতিটি কথায় ইয়ামিন হাসছে। যা দেখতে উষসীর ভালো লাগছিল না। ওই রকম বড়-সড় গ্ল্যামারাস স্টারের সামনে বসে নিজেকে বড় নগণ্য আর ক্ষুদ্রবোধ হলো প্রথমবারের মতো। ইয়ামিন এতো সুন্দরী নায়িকাদের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে রেখেছে, সে কি-না আঁকবে উষসীর মতো সাধারণ মেয়ের পেইন্টিং? এটা তো অসম্ভব! উষসী আসলেই নিজেকে অতি মূল্যবান ভেবে নিয়েছিল। তার একটু মনখারাপ হলো বৈকি!

ডিনারের পর প্রিয়ন্তী আর ফারদিন বের হলো রাতের শহর ভ্রমণে। উষসীর শরীর বেশ ক্লান্ত। গতরাতেও ঘুম হয়নি। হাজারও দুশ্চিন্তায় মাথা ঝিমঝিম করছিল। আপাতত রিয়াসাতের চিন্তা ঘাড় থেকে নেমেছে। তবুও কেন যেন শান্তি আসছে না মনে।

কিছুক্ষণ ভিডিওকলে উষ্ণতা আর মায়ের সাথে কথা বলে নিল। তৃষ্ণাও প্রিয়ন্তীদের সাথে বের হয়েছে৷ উষসীর এতো ক্লান্ত লাগছিল যে সে হোটেলেই থেকে গেছে। ফোন রেখে সে গভীর হামি তুলল। এখন একটু ঘুমোবে এটাই পরিকল্পনা। গরম পানিতে গোসল সেড়ে নিয়েছে। তাই শরীর অনেকটা হালকা লাগছে।

তার রুমটা বেশ বড়। সবকিছু সাদা রঙের। বিছানার সামনে বিরাট জানালা। কাঁচে শিশির জমে ঝাপসা দেখাচ্ছে। বরফের গাঢ় পারদে ঢেকে আছে কার্নিশ। সেদিকে অপলক চেয়ে থাকতে থাকতে উষসী অচিরেই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেল।

আচমকা দরজায় ধুপধাপ করাঘাত শুরু হয়। উষসী ধাম করে শোয়া থেকে উঠল। বুকের ভেতর ধুকপুক করে। কে এসেছে? এমন অধৈর্য্যের মতো কেন কড়া নাড়ছে? উষসী সাত-পাঁচ ভেবে বিছানা ছাড়ে। দরজা খুলেই বিমূঢ় হয়। ইয়ামিন দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে নেভি ব্লু জ্যাকেট। মাথায় সাদা-কালো চেক টুপি। চুলগুলো পেছন থেকে উঁচু হয়ে আছে। পুরোপুরি শ্যুটিং-এর গেটাপে সে। দেখতে ভীষণ ড্যাশিং লাগছে। সবকিছু ছাপিয়ে উষসী লক্ষ্য করল তার মুখভঙ্গি। অত্যন্ত কঠিন। কিছু মাত্র বলার সুযোগ না দিয়ে ধাম করে ঘরে ঢুকে যায় সে। উষসী কিঞ্চিৎ অবাক স্বরে বলল,” কি হয়েছে? আপনি না শ্যুটিং-এ ছিলেন?”

” শ্যুটিং প্যাকাপ করে এসেছি।” খুব শান্ত গলায় উত্তরটি দিয়ে বিছানায় বসে পড়ে।

” কেন? কিছু কি হয়েছে?” উষসী কৌতুহল প্রকাশ করে।

চারপাশে নজর বুলিয়ে দড় গলায় প্রশ্ন করল,” রিয়াসাত কয়দিন ধরে তোমাকে থ্রেট করছে? কিভাবে শুরু হয়েছিল এসব? আমাকে সব বলো।”

উষসীর মুখ ছাইবর্ণ ধারণ করে। ঝুপ করে নেমে আসে একটা দীর্ঘশ্বাস।

” শিমলা আন্টি তাহলে আপনাকে সব বলেছেন?” আক্ষেপ ঝরা কণ্ঠে শুধাল।

ইয়ামিন রাগত স্বরে জানতে চাইল,” এটা কি কোনো সিকরেট ছিল? কেন এতোদিনেও কাউকে কিছু বলোনি তুমি?”

” ব্যাপারটা আমি পারসোনালি হ্যান্ডেল করতে চেয়েছিলাম।”

” নিজেকে বেশি পন্ডিত ভাবো নাকি? পারসোনালি কিভাবে হ্যান্ডেল করতে? ট্রেনে ঘুরতে যাওয়া, মাঝরাতে ঘনিষ্ট হয়ে রাস্তায় হাঁটা, ওর সমস্ত ডিজায়ার পূরণ করা.. এভাবে হ্যান্ডেল করছিলে?”

উষসীর কান গরম হয়ে যায়। খুব লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। ইয়ামিন উঠে তার সামনে দাঁড়ায়। ক্রোধ নিয়ে বলল,” আমার কথার উত্তর দাও উষসী। কি এমন হয়েছে যে তুমি এভাবে ওর গোলামি করছ? শুধুমাত্র তোমাদের রিলেশনের ব্যাপার যেন কেউ না জানে? এইটা তো এভাবে গোপন করার বিষয় না। এই ঘটনা লুকানোর জন্য তুমি এতোকিছু করবে সেটাও বিশ্বাসযোগ্য না। সত্যি কথা বলো আমাকে। ”

উষসী অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলল,” ওর কাছে আমার কিছু প্রাইভেট ছবি আছে।”

ইয়ামিনের মুখের রঙ পাল্টে গেল। আরও বেশি উগ্র হয়ে উঠল সে। হঠাৎ উষসীর হাত চেপে বলল,” চলো আমার সাথে।”

” কোথায়?”

” যেতে যেতে বলব।”

উষসী বেশি প্রশ্ন করার সুযোগ পেল না। শুধু নিজের হ্যান্ডব্যাগ, মাফলার আর ডার্ক রেড রঙের একটা ওভারকোট গায়ে জড়ানোর ফুরসত পেল। তারপর ইয়ামিন ঝড়ের গতিতে তার হাত ধরে তাকে নিয়ে রেডিসন থেকে বের হলো।

তখন করিডোরে অনেক ভীর। জায়গায় জায়গায় বিভিন্ন তারকারা ছড়িয়ে আছে। প্রত্যেকে অবাক দৃষ্টিতে দেখছে। ফিসফিসিয়ে গসিপ করছে। ইয়ামিন ইব্রাহীম একটি মেয়ের হাত ধরে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে রেডিসন থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন। ব্যাপারটা সবার কাছেই তুমুল আগ্রহজনক ঘটনা। এতোজন সেলিব্রিটির মাঝে উষসীর নিজেকেই তখন সবচেয়ে বড় সেলিব্রিটি মনে হচ্ছিল। কারণ সকলের আকর্ষণ আর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু এখন সে। আজকের এই দিনটি তার সারাজীবন মনে থাকবে। কখনও কোনো মনখারাপের রাতে অন্তত এই ঘটনাটি ভেবে তার ভীষণ হাসি পাবে!

উষসী গাড়িতে উঠে জানতে চাইল,” কোথায় যাচ্ছি অন্তত এটা বলুন!”

ইয়ামিন অতি ঠান্ডা গলায় জবাব দিল,”সুইজারল্যান্ডে।”

ভয়ে শিউরে উঠল উষসী। অনুরোধ করে বলল,” প্লিজ এমন করবেন না। ভয়ংকর কেলেংকারি হয়ে যাবে তাহলে।”

ইয়ামিন তার কথা মোটেও পাত্তা দিল না। সর্বোচ্চ গতিতে ড্রাইভিং শুরু করল। রাতের রাস্তা অনেকটাই ফাঁকা। তবে হাড়ভাংগা শীত চারদিকে। গাড়ির ভেতর হিটারের ব্যবস্থা থাকায় তাদের খুব বেশি শীত লাগছে না। উষসী খুব ভয়ে আছে। তার চোখে বিন্দু বিন্দু অশ্রু।

ইয়ামিন ব্যাপারটা খেয়াল করেই বলল,” তুমি যে এতো বোকা সেটা তোমাকে দেখলে মনে হয় না৷ কি বুঝে একটা অল্প পরিচিত ছেলেকে ছবি দিলে? এতো প্রেম!”

উষসী অমত্ত কণ্ঠে বলল,” আমাকে এতো চীপ মনে হয় আপনার? আমি কোনো ছবি দেইনি।”

ইয়ামিন দাঁতে দাঁত পিষে বলল,” তাহলে ওর কাছে ছবি গেল কিভাবে?”

উষসী মাথা নিচু করে বলল,” ও আমার সাধারণ ছবি দিয়ে ন্যুড ফটো এডিট করেছে।”

” এডিটেড ছবি নিয়ে তুমি এতো ভয় পাচ্ছো? আশ্চর্য মেয়ে তো!”

উষসী অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,” কেন ভয় পাচ্ছি সেটা মেয়ে হলে বুঝতেন।”

ইয়ামিন কথা বলল না আর। কি এমন ব্যাপার যা বোঝার জন্য মেয়ে হতে হবে?

চলবে

#উষসী_হাসবে_বলে (১০)
লিখা- Sidratul Muntaz

ফোনের যান্ত্রিক টুংটুং শব্দে ঘর আলোড়িত হয়৷ মেসেজটি পড়েই শোয়া থেকে তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে যায় রিয়াসাত। এখন গভীর রাত। মেসেজ এসেছে উষসীর আইডি থেকে। সে রিয়াসাতকে নিচে নামার জন্য অনুরোধ করছে। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে কয়েক মুহূর্ত ফোনের স্ক্রিনে চেয়ে থাকে সে। কৌতুহল দমাতে ফোন করে ফেলে তৎক্ষণাৎ।

” হ্যালো, উষু!”

ওই পাশ থেকে উষসী নরম স্বরে শুধাল,” আসবে না?”

রিয়াসাতের ঠোঁটে ফাঁক সৃষ্ট হয়। বিস্ময়ে বিমূর্ত হয়ে বলল,” তুমি কি সত্যিই লুটারব্রুনেন এসেছো?”

” হুম। নিচে নামলেই একটা সাদা টয়োটা দেখতে পাবে। ভেতরে আমি আছি।”

রিয়াসাতের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ সৃষ্টি হয়। সন্দেহের অবকাশে চোখে-মুখে আঁধার নামে। একটু ঢোক গিলে নিজেকে ধাতস্থ করে। স্বপ্ন দেখছে নাকি? উষসী তার সঙ্গে দেখা করতে লুটারব্রুনেন চলে এসেছে তাও রাতের বেলা, নিজে ড্রাইভ করে!ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।

রিয়াসাত সাথে সাথে ভিডিওকল দেয়। উষসী ভড়কে যায়। সে থমথমে গলায় বলল,” ক্যামেরা অন করো উষু, আমি দেখব তুমি কোথায়।”

তার কৌশল দেখে ইয়ামিন চমকিত কণ্ঠে বলল,” শিট, হি ইজ ভেরি ক্লেভার। আমি গাড়ি থেকে নামছি… তুমি ফোন রিসিভ করো।”

উষসী ব্যস্ত হয়ে বলল,” নামবেন না প্লিজ। ও যদি বাইরে এসে তারপর কল দিয়ে থাকে?”

ইয়ামিন দ্বিধায় পড়ে যায়। কিছু এটি ভেবে নিয়ে দ্রুত পেছনের সিটে গিয়ে সটান হয়ে বসে। যেন ক্যামেরায় তাকে দেখা না যায়। উষসী এবার ফোন রিসিভ করল। ব্যাক ক্যামেরা দিয়ে আশেপাশটা দেখাল। প্রিয়ন্তীর খামারবাড়ির সামনে ক্যামেরা তাঁক করে বলল,” এবার বিশ্বাস হয়েছে?”

রিয়াসাত সন্দেহঘন কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল,” তুমি এখানে কেন এসেছো?”

” তোমার সাথে আমার কথা আছে। নিচে এসো তারপর বলছি।”

” ড্যাংড্যাং করে সবার সাথে প্যারিস কেন গিয়েছিলে? শিমলা আন্টিকে সত্যিটা কেন জানিয়েছো? তিনি তো শুধু আংশিক জানেন। তুমি কি চাও আমি পুরোটা বলি…”

ক্রোধে ফেটে পড়ছে রিয়াসাত। সকালে যেই ঝাল মেটাতে পারেনি সেটা এখন উগড়ে দিচ্ছে। উষসী বিব্রত স্বরে বলল,” তুমি নিচে এসো তারপর কথা হবে। রাখছি।”

চটজলদি ফোন নামিয়ে রাখে উষু। পেছন থেকে ইয়ামিন জানতে চাইল তখনি,”পুরো সত্যিটা কি?”

” ছবির ব্যাপারটা মিন করেছে হয়তো।”

উষসী ঢোক গিলে নেয়। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে ইয়ামিন। কিঞ্চিৎ সন্দেহ হয়, উষসী এখনও কিছু লুকাচ্ছে। কিন্তু কেন? সে তো সাহায্যই করতে চায়৷ তার থেকে লুকিয়ে লাভ কি?মেয়ে মানুষের জটিল মন। বোঝা বড় দায়। ইয়ামিন দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলল,” তুমি বাইরে গিয়ে দাঁড়াও। ও এলে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ভেতরে নিয়ে আসবে!”

” কিন্তু ও যদি ভেতরে আসতে না চায়?”

” চাইবে। ওকে ভেতরে আনার জন্য যা করতে হয় সব তুমি করবে। তারপর তো আমি আছিই।”

উষসী মাথা নেড়ে বাইরে যায়। ক্ষণকাল পরেই গায়ে কালো জ্যাকেট, মাথায় সাদা কান টুপি আর মাফলার জড়িয়ে নামতে দেখা যায় রিয়াসাতকে। লিভিংরুমে ডোনা আর শিমলা বসে আছেন। দুই জন গল্প করতে করতে টিভি দেখছেন সানন্দে। আহমেদের কাজ সারাক্ষণ ঘুমানো। কুম্ভকর্ণের মতো এখানে আসার পর থেকে খালি ঘুমাচ্ছেই সে। ঠোঁটে প্রচ্ছন্ন হাসি নিয়ে রিয়াসাত নামল। তাকে দেখেই ডোনা প্রশ্ন করলেন,” কোথাও যাচ্ছো নাকি বাবা?”

” ঘুম আসছে না আন্টি। তাই একটু বাইরে হেঁটে আসছি।”

” এতো ঠান্ডার মধ্যে যাবে?”

” সমস্যা নেই।”

শিমলা একটা কথাও বললেন না। একবার চোখ তুলে চাইলেনও না। রিয়াসাত চলে যেতেই ডোনা বললেন,” সবাই হৈহৈ করে প্যারিস চলে গেল। ছেলেটা একা এখানে কি করবে আমাদের সাথে? তাকেও নিয়ে যেতো!”

শিমলা ভ্রু কুঁচকে বললেন,”প্রিয় তো নিতেই চেয়েছিল। ওর নাকি এখানে কি কাজ আছে… সেজন্য যায়নি।”

” তাই নাকি?”

আসল কথা হচ্ছে মিসেস শিমলা তাকে যেতে নিষেধ করেছেন৷ তার বিরুদ্ধে এমন কিছু প্রমাণ আছে যা পুলিশ পর্যন্ত পৌঁছালে তার পাসপোর্ট সিজ করা হবে। ভিসা ব্লকড হবে। সেই ভয়েই রিয়াসাত চুপসে আছে। শিমলা যা বলছেন তাই মানছে।

‘ হাই।”

রিয়াসাতকে দেখেই ঠোঁটে কোমল হাসি মিশিয়ে বলল উষসী।এখনও একটু ভ্রান্তির মধ্যে আছে রিয়াসাত। উষসীর হঠাৎ আগমন তার কাছে অদ্ভুত ঠেঁকছে। এতো সহজে ভয় পাওয়ার মেয়ে সে না! তাহলে কেন এলো?

” কি ব্যাপার? নতুন কোনো গেইম খেলার চেষ্টা করছো নাকি আমার সাথে?”

” তুমি ভালো করেই জানো আমি ওসব গেইম-টেইম খেলি না। এগুলো তোমার কাজ। আমি সবসময় স্ট্রেইট ফরয়ার্ড। তাই সোজাসুজি কথা বলতে এসেছি রিয়াসাত।”

” বুঝলাম। কিন্তু এই রাতের বেলা কেন? একা ড্রাইভ করে যে এতোদূর চলে এসেছো কেউ দেখেনি তোমাকে? প্রিয়ন্তী আপু, ইয়ামিন ভাই,কেউ আটকায়নি? আর এই গাড়ি কোথায় পেয়েছো? কার গাড়ি এটা?”

একসাথে এতোগুলো প্রশ্নের তোপে পড়ে উষসী ঘাবড়ে যায়। প্রসঙ্গ এড়াতে বলল,” এসব কোনো ম্যাটার করে না৷ আমি কেন এতো রিস্ক নিয়ে এসেছি সেটাই ম্যাটার করে।”

” হ্যাঁ তাইতো। কেন এসেছো রিস্ক নিয়ে? তাও আমার কাছে!”

এগিয়ে আসে রিয়াসাত। উষসী একটু পিছিয়ে বলল,” আমি তোমার সাথে একটা ডিল করতে চাই।”

” সেটা তো আমিও চাই। দুইবছর ধরে তো এই একটা ব্যাপারই বোঝাতে চাইছি তোমাকে। লেটস মেইক আ ডিল। এতোদিন পর এসেছো লাইনে?”

উষসী খুব ভদ্রভাবে বলল,” আমি তোমাকে পাঁচহাজার ডলার দিবো। তুমি আমার সব ছবি, চ্যাটের স্ক্রিনশট আর আমাদের সব সিকরেট দাফন করবে।”

হাসতে লাগল রিয়াসাত। খুব আফসোস নিয়ে বলল,” এই বেহুদা কথা বলার জন্য তুমি রাত করে এখানে এসেছো? এতো বোকা তুমি না। সত্যি করে বলো কি চলছে? ভেতরে কি আর কেউ আছে?”

ঘাড় বাঁকিয়ে ভেতরে ঝোঁকার জন্য উদ্যত হলো সে। উষসী বাঁধা দিয়ে বলল,” ঠিকাছে বলো তুমি কি চাও?”

ঠোঁট কামড়ে হাসল রিয়াসাত। সফলতার দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ল চোখেমুখে,” শিউর?”

উষসী ততটাই অন্ধকারাচ্ছন্ন মুখে মাথা নাড়ল। রিয়াসাত অমত্ত কণ্ঠে বলল,” আমাকে বিয়ে করতে হবে।”

চমকায় উষসী। ভেতর থেকে ইয়ামিন শুনে আশ্চর্য হয়। চোয়াল শক্ত হয়ে যায় অচিরেই। উষসী অবাক হওয়া কণ্ঠে বলল,” বিয়ে?”

” হুম। আগেও বলেছি আমি শুধু তোমাকে চাই। আমাকে বিয়ে করলে তুমি হবে আমার ওয়াইফ! তখন তোমার সিকরেট মানে আমারও সিকরেট।”

” কিন্তু আমার ফ্যামিলি থেকে তো মানবে না রিয়াসাত!”

রিয়াসাত একটু চিন্তায় পড়ে। তারপর মুখ গোঁজ করে বলল,” ঠিকাছে, সমস্যা নেই। এতো দ্রুত বিয়ে মানাটাও স্বাভাবিক না। তুমি মাত্র নাইন্টিন। এক কাজ করো বরং… স্কলারশিপের জন্য এপ্লাই করে কানাডায় চলে আসো। আমি হেল্প করব। পড়াশুনার জন্য নিশ্চয়ই কেউ নিষেধ করবে না। আমিও সেখানেই আছি৷ আমরা একসাথে থাকব৷ তারপর সময় যখন হবে… তখন না হয় তোমার ফ্যামিলিকে মানিয়ে বিয়ে করব।”

” একসাথে থাকব বলতে? লীভ-ইন!”

” কাইন্ড অফ।”

উষসী একটা চাপা শ্বাস ছাড়ে। এইতো, এবার আসল রূপ দেখানো শুরু করেছে রিয়াসাত। তার ভালো মানুষীর মুখোশ খসে পড়ছে ধীরে ধীরে। উষসী ম্লান হেসে বলল,” তারপর কি হবে? যদি ফ্যামিলি থেকে না মানে?”

রিয়াসাত কোমল গলায় আশ্বস্ত করল,” মানবে। যতদিন তুমি আমার সাথে থাকবে… সেইফ থাকবে। আই প্রমিস ইউ। কিন্তু আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বললেই বিপদ হবে তোমার।”

উষসী নিরুপায় হয়ে বলল,” এটা ছাড়া কি আর কোনো অপশন নেই?”

রিয়াসাত গভীর স্পর্শে তার গালে হাত রেখে বলল,” আনফোরচুনেটলি না ডার্লিং৷ এটা ছাড়া কোনো অপশন নেই। ইউ ড্রাইভ মি ম্যাড। আমি নীড ইউ সো সো সো মাচ। যে কোনো মূল্যে তোমাকে চাই আমার। তুমি আমার। সবসময় শুধু আমার।”

কণ্ঠে ঘোর, রিয়াসাত তার নেশাভরা দৃষ্টি নিয়ে খুব কাছে এগিয়ে আসে। তার লক্ষ্য উষসীর মসৃণ ঠোঁটজোড়া। ঝঁটিতে মুখ সরিয়ে নেয় উষসী। রিয়াসাত হতাশ হয়, খানিক রুষ্টতা নিয়ে বলল,” তুমি কি ডিল করতে রাজি না?”

” আমার সময় দরকার ভাবার জন্য।” উষসী চাপা কণ্ঠে আওড়ায়।

” ঠিকাছে তাহলে ভাবো। ফ্যামিলির কাছে নিজের সম্মান বাঁচাবে নাকি আমাকে সারাজীবনের জন্য মেনে নিবে। নিশ্চয়ই ভাবা উচিৎ তোমার। জীবনের অনেক বড় ফয়সালা এটা।”

ভেতর থেকে সবকিছু দেখে ইয়ামিন ততক্ষণে সিটের ফোম আঁকড়ে ধরেছে। একটুর জন্য ফোম ছিঁড়ে যাচ্ছে না।উষসী মাথা হেলিয়ে বলল,” ঠিকাছে ভেতরে চলো।”

” ভেতরে মানে?”

” মানে গাড়ির ভেতরে।”

” কেন?” সন্দেহ হয় রিয়াসাতের।

” আমার উত্তর জানতে চাও না তুমি?”

হালকা করে লাজুক হাসে উষসী৷ তার ইঙ্গিত বুঝতেই রিয়াসাত বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যায়। কিন্তু তার সন্দেহ কাটে না৷ তবুও সাবধানে সে ভেতরে প্রবেশ করে। উষসী ড্রাইভিং সিটে বসলে রিয়াসাত বসে তার পাশে। তখনও হাসছে উষসী৷ রিয়াসাতও মৃদু হাসে। মনে শঙ্কা থাকলেও তা ঝেড়ে ফেলে। উষসীকে কাছে পাওয়ার তুমুল তৃষ্ণা-আকাঙ্ক্ষা তাকে বেসামাল করে তুলেছে। সে হাত ধরে উষসীকে নিজের দিকে ফেরায়। পেছন থেকে কেউ শিষ বাজাতেই থতমত খায় রিয়াসাত।

ভিউ মিররে কালো অবয়ব দেখে আৎকে উঠে ফটাফট গাড়ি থেকে নেমে যেতে নেয়। ঝড়ের গতি চালিয়েও লাভ হয় না। পেছন থেকে বাতাসের গতিতে ইয়ামিন তার ঘাড় আঁকড়ে ধরে। উষসী কাঁপা হাতে ড্রাইভিং শুরু করে।

একহাতে রিয়াসাতের মুখ, অন্যহাতে তার দুইহাত চেপে ধরে রাখে ইয়ামিন। এতোটুকু নড়াচড়ার জো পায় না সে। পা দিয়ে ধাক্কাতে থাকলে ইয়ামিন তাকে প্রতিহত করতে জোরে ঘুঁষি মারে। সে চোখে সরষে ফুল দেখতে পায়।

খুব নিরিবিলি শান্ত জায়গা দেখে উষসী ব্রেক থামায়। ইয়ামিন পেছন থেকে তার হাত দু’টো ছেড়ে দিতেই সামনে থেকে চেপে ধরে উষসী। কিন্তু সামলাতে পারল না। আচমকা রিয়াসাত তাকে আঘাত করে। উষসী ছিটকে স্টেয়ারিং-এর সাথে গিয়ে নাকে-মুখে বারি খায়।

এবার রিয়াসাত হাত ছাড়া পেয়ে পেছন থেকে ইয়ামিনকে আক্রমণের জন্য আঘাত করে। ইয়ামিনের মনোযোগ উষুর দিকে তখন। আহত উষসীকে দুইহাতে আগলে নেয় সে। তাই প্রতিরোধ করতে পারে না। প্রচন্ড জোরে নাকে-মুখে ঘুঁষি খেয়ে র*ক্ত বের হয়ে যায় তার।

উষসী নিজেকে সামলে ইয়ামিনের নাক চেপে ধরে। ব্যগ্র হয়ে বলে,” আপনি ঠিকাছেন?”

পরমুহূর্তেই রিয়াসাত পালাতে নেয় কিন্তু সফল হতে পারে না। ইয়ামিন পা দিয়ে তাকে ল্যাং মেরে ফেলে দেয়। পরপর তাকে তুলে মাথায় কনুই দিয়ে ঘুঁষি মারে। দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যায় রিয়াসাতের। শ্বাস আটকে যায়। ইয়ামিন ক্রুদ্ধ হয়ে একই জায়গায় পরপর কয়েকবার আঘাত করে। তার মুখ এতোবেশি র*ক্তাক্ত হয়ে যায় যা দেখে উষসী ভয়ে মুখ ঢেকে ফেলে। তাই দেখে ইয়ামিন থেমে যায়। নয়তো রিয়াসাতের আরও মা’র খাওয়ার কথা ছিল।

তাকে গাড়ি থেকে টেনে-হিঁচরে বাইরে আনা হয়। রাস্তায় ফেলে সর্বোচ্চ শক্তিতে তার চোয়াল চেপে ধরে বলল,” বিয়ে করবি? জোর করে থ্রেট দিয়ে, ব্ল্যাক মেইল করে বিয়ে করবি একটা মেয়েকে? লীভ-ইন করতে বাধ্য করবি? কোথায় ওর ছবি? ওর এগেন্সটে যত ডকুমেন্ট আছে সব দে নাহলে জীবিত ছাড়া পাবি না এখান থেকে!”

ভয়া’বহ হুম’কি শুনে রিয়াসাত দিশেহারা হয়ে পড়ে। কোনমতে বলল,” ফোনে আছে সব। আমি ডিলিট করে দিবো। কথা দিলাম ভাই। আমাকে ছেড়ে দাও।”

ইয়ামিন তার দুইহাত পেছনে এনে মাফলার দিয়ে বেঁধে ফেলে। গুরুতরভাবে আহত রিয়াসাতের বাঁধা দেওয়ার শক্তি থাকে না। উষসী নিজেকে সামলে নিয়েছে। ইয়ামিন তাকে আদেশ করল,” তোমার যতক্ষণ ইচ্ছা হয় ওকে মারো উষসী।”

উষসীর সাহসে কুলায় না। বীভৎস রক্তা-ক্ত চেহারাটা দেখেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। ইয়ামিন দাঁত খিটমিট করে বলল,” আমি জানি ওর প্রতি তোমার অনেক রাগ জমে আছে। আজকে সব উগড়ে দাও। ওকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আর কিচ্ছু করতে পারবে না ও। ওর ফোনটা আমি…”

ইয়ামিন পুরো কথা শেষ না করে রিয়াসাতের জ্যাকেট থেকে ফোন বের করে নেয়। রিয়াসাত ছটফটিয়ে অনুরোধ করে বলল,” ভাই প্লিজ… আমার ফোনে অনেক ইম্পোর্ট্যান্ট জিনিস আছে। আমি কথা দিলাম তো সব ডিলিট করব। ফোনটা ছাড় ভাই।”

কথা কানেও তোলে না ইয়ামিন। ফোনের অবস্থা দফা-রফা করে ক্ষান্ত হয়।

” নাও, এবার ও চাইলেও তোমার ক্ষতি করতে পারবে না। তুমি যা চাও তাই হবে। যদি ওকে মেরে ফেলতে বলো তাহলে এখনি হাত বাঁধা অবস্থায় পানিতে ফেলে দিবো।”

এই কথা শুনে রিয়াসাতের চোখ বড় হয়ে যায়। ভয়ে কাতরাতে শুরু করে। আতঙ্কে চেহারা করুণ দেখায়। সেই অসহায় দৃষ্টি নিয়ে উষসীর দিকে চায় সে। কিন্তু উষসী এতোটুকু দয়া অনুভব করল না। একে একে পুরনো কথাগুলো মনে পড়তে থাকে তার। সেই রাতটা ছিল জীবনের কঠিনতম রাত যখন রিয়াসাত এডিট করা নোংরা ছবিগুলো পাঠায়। উষসী সতেরো বছরের কিশোরী তখন৷ উপরে যতই শক্ত খোলস দেখানোর চেষ্টা করুক, ভেতরে সে প্রচন্ড নরম। সোশ্যাল মিডিয়ায় একবার কিছু ভাইরাল হলে সারাজীবনের জন্য গায়ে কালি লেগে যাবে। উষসী তা প্রতিরোধ করতে রিয়াসাতকে মিনতি করে।

তখন তো রিয়াসাত তাকে এতোটুকু দয়া করেনি। শর্ত দেয় প্রতিরাতে তার সাথে চ্যাট করতে হবে। উষসীকে বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হয়। দুইদিন যেতেই সে বুঝতে পারে তার দ্বারা এই বিশ্রী কাজ সম্ভব না৷ সে আত্মহত্যার হু*মকি দিলে রিয়াসাত কিছুটা নরম হয়। কিন্তু সেই এডাল্ট চ্যাটের স্ক্রিনশট গুলো সুরক্ষিত রেখে দেয়। যা দিয়ে এখনও সে ব্ল্যাক মেইল করে আসছে উষসীকে।

উষসী আর চুপ করে বসে থাকতে পারে না। তার মাথায় হঠাৎই খু*ন চেপে যায়। এতোদিনের সব ভয়-ডর ভেঙে যায়। প্রচন্ড আক্রোশে রিয়াসাতকে গুণে গুণে দশটা চ-ড় মারে। খামচে ধরে তার মুখ। কতরাত নির্ঘুম কাটিয়েছে, দুশ্চিন্তায়, অপমানে কেঁদেছে। কাউকে বলতে পারেনি মনের কষ্ট। তাও ভেঙে পড়েনি, শক্ত থেকেছে। রিয়াসাতের কাছে নত করেনি। এই মুহূর্তে ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার। এতোদিনের সব ক্রোধ এক নিমেষে প্রকাশ করে ফেলে। রিয়াসাতকে মারতে মারতে সে ক্লান্ত হয়ে যায়। পেছন থেকে ইয়ামিন তাকে আগলে ধরে বলল,” হয়েছে এবার থামো।”

উষসী ধপ করে নিচে বসে পড়ে। কাঁদতে থাকে অসহায়ের মতো। এতোদিন সব কান্নারা জমাট বেঁধে আটকে ছিল গলার কাছে। আজ বের হচ্ছে সব। ইয়ামিন তাকায় রিয়াসাতের দিকে। ওই লোমহর্ষক দৃষ্টি দেখে ভেতর থেকে শিউরে ওঠে রিয়াসাত। সে কাছে আসতেই থরথর করে কাঁপতে শুরু করে।

ইয়ামিন তার দিকে ঝুঁকে বলল,” আর কখনও যদি ওর দিকে চোখ তুলে তাকাতেও দেখি তাহলে তোকে আমি জানে মারব না, এমন অবস্থা করব যে পৃথিবীতে জন্মানোর দিনটির জন্য তুই আফসোস করবি। হেল করে দিবো তোর পুরো লাইফ!”

রিয়াসাত কোনমতে মাথা ঝাঁকায়। ইয়ামিন ধীরে-সুস্থে বলল,”মোবাইলের টাকা পেয়ে যাবি। ল্যাপটপ, কম্পিউটারেও যদি কিছু থেকে থাকে বাসায় গিয়ে তোর প্রথম কাজ হলো ডিলিট করা। ”

রিয়াসাত উন্মাদের ন্যায় মাথা নাড়তেই থাকে। ইয়ামিন আরও কাছে এসে বলল,” উষুর কাছে মাফ চা। বল, এখন থেকে তুমি আমার বোন। আমাকে মাফ করো বোন।”

রিয়াসাত জবাব দেয় না। ইয়ামিন শক্ত গলায় বলল,” বেগ টু হার!”

এবার তড়িঘড়ি করে উষসীর দিকে চেয়ে বলল,” এখন থেকে তুমি আমার বোন। আমাকে মাফ করো বোন।”

উষসী তিক্ত গলায় বলল,” আমি ওর বোনও হতে চাই না।”

ইয়ামিন হাত বাড়িয়ে দিতেই সে উঠে দাঁড়ায়। এখনও রক্ত জমাট বেঁধে আছে ইয়ামিনের নাকে। উষসী নিজের গলার মাফলারটা খোলে। তারপর তার নাকের র-ক্ত মুছে দেয় সযত্নে।
_________________
সাদা বরফের উপর সোনালী আলোর নরম আভা,ধীরে ধীরে একটা মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি। উঁচু উঁচু আলপসের কোল ঘেঁষে সূর্য্যিমামার জেগে ওঠা। সে এক নৈসর্গিক দৃশ্য! তারা গাড়ি থেকে বের হয়ে বসে আছে এক জায়গায়। উষু খুব নিশ্চুপ, শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে প্রকৃতির সৌন্দর্য্য। আর ইয়ামিন দেখছে তাকে। উষসীর মুগ্ধ চোখের দিকে চেয়ে একটা সম্মোহন তৈরী হয়েছে তার মনে। মাথায় ঘুরছে চমৎকার একটা ছবির থিম।

জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স এবং অস্ট্রিয়া দ্বারা বেষ্টিত আল্পস পর্বতমালার দেশ সুইজারল্যান্ডে বসে থেকেও উষসী মিস করছে নিজের জন্মভূমি। গতবার যখন আসা হয়েছিল, সুইজারল্যান্ডে তখন গ্রীষ্মকাল চলে। তখনকার একরকম সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়েছিল। এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হচ্ছে। এতো শীতল, শুভ্র মোহনীয়তা চারপাশে… তবুও উষসীর মনে পড়ছে নিজস্ব দেশের সবুজাভ প্রকৃতি, কুয়াশা, শিশির ভেজা ঘাস, বৃষ্টির ছন্দ, সোদা গন্ধ… সবকিছু!

ইয়ামিন বলল,” ভয়ের কিছু নেই। রিয়াসাত এরপর আর রিস্ক নিবে বলে মনে হয় না। ”

” আমি ভয়ও পাচ্ছি না ওকে।” উষসী প্রাঞ্জল হাসল। বহুদিন পর তার হালকা লাগছে খুব।

ইয়ামিন তাকিয়ে রইল ওই হাসির দিকে। বুক চিনচিন করছে তার। চিত্ররূপসীর সাথে উষসীর এতো মিল কেন? পরমুহূর্তেই সে ভাবল, ছোটবেলায় উষ্ণতার অনেক ছবি এঁকেছিল সে। তাই বোধ হয় কল্পনার রমণীর সাথে উষ্ণতার মুখের আদল মিলে গেছে। আর উষসী যেহেতু উষ্ণতারই বোন, তাই তার সাথেও ছবিটির মিল মনে হচ্ছে।

নিজের মনের এই অকাট্য যুক্তি কতটা গ্রহণযোগ্য তা ইয়ামিন জানে না। কিন্তু উষসীকে নিয়ে অন্যকিছু কল্পনা করাও সম্ভব নয়। সে যখন জীবনের প্রথম প্রেম হারিয়ে দিশেহারা, উষসী তখন নিতান্ত বাচ্চা একটা মেয়ে। তাকে দেখলেই ছোটবেলার বাচ্চা বাচ্চা মুখটি ভেসে ওঠে স্মৃতিপটে। সে নিশ্চয়ই উষসীর প্রেমে পড়তে পারে না। তার রূপে পাগল হয়ে তাকে নিয়ে পেইন্টিং-ও এঁকে ফেলতে পারে না! ধূর, ইয়ামিন এসব চিন্তাই বা করছে কেন? আসলেই তো এটা কখনও সম্ভব না।

” কি ভাবছেন?”

উষসীর প্রশ্নে ইয়ামিন ভ্যাবাচেকা খেল।

” কিছু না।” তারপর নিজের মনের অযাচিত ভাবনা আর প্রসঙ্গ এড়াতে বলল,” আচ্ছা, আমি এখনও বুঝতে পারছি না। তুমি রিয়াসাতকে পছন্দ করেছিলে কি বুঝে? ওর মধ্যে কি এমন স্পেশালিটি ছিল?”

” আমি ওকে পছন্দ করিনি তো!”

ইয়ামিন ভ্রু কুঁচকাল,” করোনি? তাহলে তোমাদের রিলেশন কিভাবে হলো?”

” ওর সাথে আমার রিলেশন হয়নি। অন্যকারো সাথে হয়েছিল৷ মানে আমি সেটা ভেবেছিলাম। কিন্তু আড়ালে যে ও ছিল সেটা কিভাবে বুঝব?”

ইয়ামিন কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে বলল,” মানে তুমি অন্যকাউকে ভেবে ওর সাথে প্রেম করেছিলে। কিন্তু জানতেই না যে এটা ও?”

উষসী হালকা অপ্রস্তুত হয়। মাথা নেড়ে বলল,” হুম।”

রিয়াসাত মিমিক্রি জানে!ইয়ামিনের হঠাৎ করেই মনে আসে ব্যাপারটা। সে তাহলে ওভাবেই উষুকে ঠকিয়েছে! মনের ধারণা থেকেই আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ল,” কার মিমিক্রি করে তোমাকে পটিয়েছিল শুনি?”

প্রশ্নটা করেই হালকা হাসল সে। লজ্জায় উষসীর মুখটা একদম ছোট হয়ে যায়। সে এই কথা কখনও ইয়ামিনকে জানতে দিবে না৷ তার চেয়ে মৃ’ত্যু শ্রেয়। একটু আমতা-আমতা করে মুখে যা এলো তাই বলল,” ইউভান শেখ।”

” কিহ!”

ইয়ামিন হাসবে নাকি অবাক হবে ভেবে পেল না। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,” তুমি এতো বোকা? মানে সে গলা নকল করে বলেছে আমি ইউভান শেখ। আর তুমিও সেটা বিশ্বাস করেছো? সিরিয়াসলি!”

উষসী একটাও কথা খুঁজে পায় না। বোকার মতো বলে ফেলেছে ইউভান শেখ। কিন্তু তৎক্ষণাৎ অন্যকারো নাম মাথায়ও আসেনি৷ ইয়ামিন হাস্যমুখে বলল,” তারপর? কয়দিন চলল ইউভান শেখের সাথে প্রেম?”

উষসী অস্বস্তিতে মুখ গুঁটিয়ে ফেলে। ইয়ামিন এখনি এতো খোঁচাচ্ছে তাহলে সত্যিটা জানলে কি করতো আল্লাহ মালুম! সেই কথা চিন্তা করেও তার গা কাটা দেয়। অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” এবার মনে হয় আমাদের যাওয়া উচিৎ।”

” এতো তাড়া কিসের? ইউভান শেখের জন্য?”

আবারও টিপ্পনি কাটল সে। উষসী হেসে ফেলে। ইয়ামিন পরে উঠলেও তার আগে এগিয়ে যায়। তার পিছু যেতে যেতে উষসী মনে মনে বলল,”কিসের ইউভান শেখ? ওটা তো আপনি ছিলেন। আমি কিন্তু আপনার প্রেমে পড়িনি। আপনার নকল গলা শুনে বিমোহিতও হইনি। তবে আপনার ভায়োলিনের সুরে আমার অষ্টাদশী অবুঝ মন তাল হারিয়ে ছিল ঠিকই। সেই অদ্ভুত অনুভূতিকেই প্রেমে পড়া বলে কি-না আমার জানা নেই মিস্টার সিংগার!”

চলবে

#উষসী_হাসবে_বলে (১০)
#অতিরিক্ত_অংশ
লিখা- Sidratul Muntaz

প্রিয়ন্তী বার বার ফোন দিচ্ছে। রেডিসনে ফিরে উষসীকে না দেখে সে দিশাহীন, অস্থির। একবার উষসী ফোন রিসিভ করে বলেছিল,” আমরা বাইরে আছি আপু।”

” তোরা মানে? তুই আর কে?”

“আমি আর ইয়ামিন ইব্রাহীম।”

” এক চড় দেব। নাম ধরে ডাকছিস কেন? তোর কতবড় হয় জানিস? ভাইয়া বল! আর তোরা বাইরে কি করছিস?”

ধমক খেয়ে উষসী কাঁচুমাচু হয়,” ভাইয়ার সাথে শ্যুটিং দেখতে এসেছিলাম। এখানে আটকে গেছি৷ রাতে মনে হয় এখানেই থাকতে হতে পারে। স্নোফলের জন্য গাড়ি নিয়ে বের হওয়া যাচ্ছে না।”

প্রিয়ন্তী কথাটা বিশ্বাস করেছে কি-না বোঝা যায়নি। কিন্তু সারারাত উষুর চিন্তায় সে নিজেও ঘুমায়নি। ভোর হতেই আবার ফোন করেছে। উষসী গাড়িতে উঠতে উঠতে জিজ্ঞাসা করল,” প্রিয়ন্তী আপু ফোন করছে আবার। কি বলব?”

ইয়ামিন বলল,” আমাকে দাও।”

উষসী দিয়ে দিল। ইয়ামিন ঠান্ডা মাথায় বোঝালো তাদের ফিরতে তিনঘণ্টার মতো সময় লাগবে। প্রিয়ন্তী রেগে খ্যাচখ্যাচ শুরু করল,” তুই কোন সেন্সে ওকে নিয়ে বের হলি? একটু আগে মা ফোন করেছিল। আমাকে মার সাথে মিথ্যা বলতে হয়েছে। ফোনও ধরছিস না তোরা৷ টেনশন হয় না আমার? ”

ইয়ামিন বিদ্বিষ্ট হয়ে বলল,” আশ্চর্য! এতো টেনশনের কি আছে? ওকে তো আমি খেয়ে ফেলব না। বললাম আসছি, অপেক্ষা করো।”

উষসী বিব্রত হয়ে তাকাল। প্রিয়ন্তী কেন এতো রাগ দেখাচ্ছে? ইয়ামিনও মনে হয় এজন্য বিরক্ত হচ্ছে। ওই পাশ থেকে প্রিয়ন্তী বলল,” আরে, আমি তো তোকে ভরসা করিই। কিন্তু ওখানে সব অপরিচিত মানুষের মধ্যে ও একা আছে তাই একটু চিন্তা হচ্ছিল। তৃষাণ জানতে পারলে আমার খবর আছে। সে তো উষুর দায়িত্ব আমার উপর দিয়েই পাঠিয়েছিল তাই না?”

প্রিয়ন্তী নিজের হয়ে সাফাই গাইতে থাকে। তৃষাণ ফোন করলে কি বলবে সেই চিন্তায় তটস্থ সে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে উষসীকে একা রেখে আর জীবনেও বের হবে না। এবার সে ভালোয় ভালোয় ফিরে আসলেই হয়!

ইয়ামিন বলল,” রাখি।”

প্রিয়ন্তী তড়িঘড়ি করে বলল,” আরে শোন, আরেকটা দূর্ঘটনা ঘটেছে তো৷ তোকে এজন্যই আমি ফোন করব ভাবছিলাম।”

” আবার কি?”

” রিয়াসাত। তাকে কারা যেন রাস্তায় ফেলে জঘন্যভাবে পিটিয়েছে।”

ইয়ামিন চুপ করে থাকে। প্রিয়ন্তী বলে যায়,” মাঝরাতে বাসা থেকে হুট করে বের হয়েছিল তারপর ফিরেছে র-ক্তাক্ত অবস্থায়। গ্যালন গ্যালন র*ক্ত বের হচ্ছে শরীর থেকে।”

“এখন কি তাহলে র*ক্ত লাগবে ওর? কয়ব্যাগ লাগবে?”

প্রিয়ন্তী বিস্মিত হয়ে বলল,” তুই কি ফাজলামি করছিস নাকি?”

” না, ফাজলামি কেন করব! ” ইয়ামিন নির্বিকার।

প্রিয়ন্তী উদগ্রীব হয়ে বলতে লাগল,” মা আমাকে ফোন করে একটু আগে জানিয়েছে। আমার হাত-পা কাঁপছে। সুইজারল্যান্ডে এমন কাহিনী আমি জীবনে দেখিনি। পুলিশরা কি ঘাস খায়? আমি তাকে মামলা করতে বললাম। কিন্তু রিয়াসাত বলল ওদের ধরে লাভ নেই। আমার তো মনে হয় এখানে ওরই কোনো দোষ আছে। তাই নিজেই ভ*য় পাচ্ছে।”

ইয়ামিন শান্ত গলায় বলল,” হতেই পারে। তোমার ভাই তো আর ভালো মানুষ না।”

” এমনভাবে বলছিস যেন তোর কেউ না! শুধু আমারই ভাই?”

ইয়ামিন জবাব দেয় না। প্রিয়ন্তী বলল,” যাইহোক, সাবধানে আসিস তোরা। রাখি।”

ফোন স্পিকারে থাকায় উষসী এতোক্ষণ সবই শুনছিল। মুখ টিপে বসেছিল চুপচাপ। ফোন রাখতেই সে হাসতে শুরু করল। ইয়ামিন অবাক হয়ে তাকাল। মুখে হাত চেপে অন্যহাত অনবরত নেড়ে হেসেই যাচ্ছে উষসী। দেখতে ভালো লাগছে!

” রিয়াসাতের ভালো শিক্ষা হয়েছে। আমার এতোদিন পর খুব শান্তি লাগছে জানেন… আপনাকে কিভাবে থ্যাংকস দেওয়া যায় বলুন তো? আপনি আমার এতোবড় ফেভার করলেন, এবার আমিও আপনার ফেভার করতে চাই।”

উষসীর চোখ ঝলমল। মুখে উজ্জ্বল দীপ্তি, কথায় চঞ্চলতা। ইয়ামিন ক্লান্ত হাসল৷ ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে বলল,” আপাতত আমি ভীষণ টায়ার্ড। চোখ ভেঙে ঘুম আসছে। আমার ঘুমের ব্যবস্থা করে দিতে পারলেই ফেভার করা হবে। পারবে?”

উষসী মাথা নেড়ে বলল,” অবশ্যই পারব। আপনি তাহলে ঘুমান। আমি ড্রাইভ করছি?”

ইয়ামিন অবাক হয়ে ভ্রু উঁচু করল,”তুমি করবে ড্রাইভ?”

” কেন? সন্দেহ আছে? আমি কি ড্রাইভ করতে পারি না?”

” এখানে পারবে না৷ খুব আঁকাবাঁকা রাস্তা। ড্রাইভ করাটাই একটা চ্যালেঞ্জিং বিষয়।”

” চ্যালেঞ্জ কি শুধু আপনিই নিতে জানেন? আমি জানি না?”

” দরকার নেই। আমি এতো দ্রুত মরতে চাই না। এখনও বিয়েও হয়নি আমার।”

উষসী এই কথায় হেসে ফেলল। লজ্জাও পেল। কেন লজ্জা পেল তা সে জানে না। সে আবদার করে বলল,” ঠিকাছে, তাহলে আপনি ঘুমান। আমরা এখানে আরও কিছুক্ষণ বসে থাকি। আপনার রেস্টও হয়ে গেল…”

কণ্ঠ থেমে যায় উষসীর। ইয়ামিন হাত ভাঁজ করে সিটে মাথা ঠেঁকিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। সে কি ঘুমিয়ে গেল নাকি? ব্যাপারটা বোঝার জন্য উষসী তার মুখের কাছে হাত রাখল। সত্যিই মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে লোকটা। আশ্চর্য ব্যাপার!

সে বোকার মতো তাকিয়ে রইল। অচিরেই অদ্ভুত এক সম্মোহনী শক্তি তাকে গ্রাস করে ফেলল পুরোপুরি। ইয়ামিনের ঘুমন্ত মুখ দেখে বুকে কেমন একটা হাহাকার সৃষ্টি হলো। উষসী জানে না এই হাহাকারের উৎস কি! শুধু জানে, তার খুব বিষণ্ণ লাগছে।

ইয়ামিনের এতো সুন্দর হওয়ার ব্যাপারটা যেন মনখারাপ করে দেওয়ার মতো ঘটনা। আচ্ছা, একটা ছেলে মানুষ এতো সুন্দর কেন হবে? উষসী একবার নিজের হাতটা ইয়ামিনের হাতের সাথে রাখল। কি আশ্চর্য, ইয়ামিন তার চেয়েও দ্বিগুণ ফরসা৷ এতোদিন নিজেকে সুন্দরী জেনে আসা মেয়েটি বুঝল সামনে বসে থাকা মানবটির অলীক সৌন্দর্য্যের কাছে তার সৌন্দর্য্য অতি তুচ্ছ, নগন্য! সে কি ইয়ামিনকে ঈর্ষা করছে? নাকি ইয়ামিনকে যে পাবে তাকে ঈর্ষা করছে?

উষসী গাড়ির সিটে মাথা এলিয়ে দিল৷ অতীত খুব মনে পড়ছে তার। গতবার যখন সুইজারল্যান্ড এসেছিল তখন রিয়াসাতের সাথে প্রথম দেখা। সে উষসীকে প্রথম দেখাতেই পছন্দ করে ফেলে। সারাক্ষণ তার দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে থাকে। উষসী যেখানেই যায় সেখানেই রিয়াসাত কিভাবে যেন উপস্থিত হয়। বেড়াতে আসার পর থেকে ছেলেটির অতি যত্ন, মনোযোগ, উদ্ভট হাসি দেখে উষসীও সহজে বুঝে নেয় সবটা। আর তখনি সে এড়িয়ে চলা শুরু করে। তার মনোযোগ পাওয়ার লক্ষ্যে রিয়াসাত বিভিন্ন কান্ড করতে থাকে। সবার মধ্যে ফট করে হাসির কথা বলে, নিজেকে নিয়ে গুণগান গায়, তার জন্য কত মেয়ে পাগল, সে কত বুদ্ধিমান, ট্যালেন্টেড কৌশলে এসব গল্প করে উষসীর মনোযোগ কাঁড়তে চায়। কিন্তু উষসী বরাবরই দায়সারা। সে পাত্তাও দেয় না।

প্রিয়ন্তীর কাজিন বলে হেসে দু’টো কথা বলে। এছাড়া ছেলেটার উপস্থিতিতে সে বিরক্ত। ভদ্রতার খাতিরে তাকে ফেসবুকে এড করেছিল। ভেবেছিল দেশে ফিরলেই ব্লক করে দিবে। কিন্তু নিউজফিড স্ক্রল করতে গিয়ে একবার উষসী দেখতে পায় রিয়াসাতের অনেক সেলিব্রিটির সাথে ছবি। যেহেতু প্রিয়ন্তীর কাজিন ইয়ামিন, তাহলে তার সাথেও নিশ্চয়ই যোগসূত্র আছে। ছোট থেকেই উষুর ইয়ামিনের প্রতি বেজায় কৌতুহল। একসময় তার আপুর স্টুডেন্ট ছিল কি-না! তাই একবার রিয়াসাতকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে উষসী।

” আপনি ইয়ামিন ইব্রাহীমকে চেনেন?”

” অবশ্যই চিনি। আমার আপন ফুপাতো ভাই। কেন? তুমি কি তার ফ্যান নাকি?”

প্রশ্নটা করেই কেমন ফিচেল হাসে রিয়াসাত। তার ওই হাসি উষসীর অসহ্য লাগে। তবুও সহ্য করে বলল,” ফ্যান না। জাস্ট উনার ভায়োলিন শুনতে ভালো লাগে। মাঝে মাঝে মনখারাপ হলে আমি দুয়েকটা টিউন শুনি। মন ভালো হয়ে যায়। অদ্ভুত সুন্দর বাজান উনি।”

রিয়াসাতের ঠোঁটে তখনও হাসি। এমনভাবে মাথা নাড়তে থাকে যেন কতকিছু বুঝে ফেলেছে। খুব গোপন কথা জেনে ফেলেছে! উষুর গা-পিত্তি জ্বলতে থাকে। এই নিয়ে আর কথা বাড়াতে চায় না সে। কিন্তু রিয়াসাত তো পেছনে লেগেই আছে। উষুর সাথে ভাব জমানোর একটা পায়তারা তার চাই। সে একদিন বলে বসল,” ইয়ামিন ইব্রাহীমের সাথে কথা বলবে উষু?”

উষসী অবাক হয়ে বলল,” আমি উনার সাথে কি কথা বলব?”

” মিউজিক নিয়ে কথা বলবে। তার ভায়োলিন তোমার পছন্দ না? তুমি ওর ফ্যান না?ভাইয়াকে তো আমি তোমার ছবি দেখালাম। খুব প্রশংসা করেছে তোমার। বলেছে তুমি খুব মিষ্টি।”

উষসী হতবাক হয়ে যায়। এতোবড় একজন সেলিব্রিটি তার প্রশংসা করবে, ভাবা যায়? সে ব্যাপারটাকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। কথা বলার কোনো ইচ্ছে প্রকাশ করে না। কিন্তু রিয়াসাত কাঁঠালের আঠার মতো লেগেই থাকে। একদিন তো উষসীর সামনে ফোন এনে বলল,” দেখো, ভাইয়া ভিডিওকলে আছে। ব্যাক ক্যামেরায় তোমাকে দেখাচ্ছি। হাই দাও।”

উষসী ‘হাই’ দিল না। ওরনায় মুখ ঢেকে চলে গেল। ফিসফিসিয়ে বলল,” যা-তা একদম!”

রিয়াসাত এমন জোরে হাসতে লাগল যেন কত মহান কাজ করে ফেলেছে! বাংলাদেশে ফেরার পর ঘটে সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনা। উষসীর সতেরোতম জন্মদিনে ঠিক রাত বারোটায় অচেনা এক নাম্বার থেকে ফোন আসে। সে তখন জেগেই ছিল। কারণ একটু পরেই তৃষাণ ভাই আর উষ্ণতা আপু কেক নিয়ে ঘরে এসে তাকে সারপ্রাইজ দিবে। প্রত্যেক বছর এটাই হয়। সেদিন ফোন রিসিভ করে উষসী তাজ্জব বনে যায়। ইয়ামিন ইব্রাহীম ফোন করেছে তাকে!

ওই পাশ থেকে ভরাট সুন্দর গলায় শব্দ এলো,” হ্যাপি বার্থডে উষুমনি। তোমার জন্মদিনের প্রতিটা দিন সুন্দর হোক। ঠিক তোমার চেহারার মতোই মিষ্টি হোক। শুভকামনা।”

উষসীর শিরদাঁড়ায় কেমন স্রোত প্রবাহিত হয়। সে তো প্রথমে বিশ্বাসও করতে পারে না৷ ধীরে-ধীরে নিজেকে ধাতস্থ করে।

” আপনি সত্যিই ইয়ামিন ইব্রাহীম বলছেন?”

” কোনো সন্দেহ আছে? রিয়াসাত আমাকে তোমার কথা অনেক বলেছে। সে খুব ভালো ছেলে। কাজিনদের মধ্যে সবচেয়ে চটপটে, বুদ্ধিমান…”

উষসীর ভ্রু কুঁচকে আসে। ইয়ামিন ইব্রাহীম হঠাৎ রিয়াসাতের মতো পারভার্টের প্রশংসায় কেন পঞ্চমুখ হলেন বুঝতে পারে না সে। একটু পর তার দরজায় শব্দ হলে সে তড়িঘড়ি করে বলল,” পরে কথা বলব। আমার আপু আর ভাইয়া এসেছে আমার বার্থডে সারপ্রাইজ দিতে।”

ওই পাশ থেকে ইয়ামিন হাসল। কি অদ্ভুত সেই হাসির শব্দ! চমৎকার করে বলল,” ঠিকাছে উষসী। গুডবায়।”

উষসী হাঁফ ছাড়ল৷ এতোবড় একজন সেলিব্রিটির সাথে সে তিনমিনিট ধরে কথা বলছিল, ব্যাপারটা বিশ্বাসই হয় না!

ঘটনা শুধু সেখানেই থেমে নেই। এরপর প্রায় মাঝে মাঝেই সেই নাম্বার থেকে ফোন আসতো। ইয়ামিন নানান ধরণের মজার কথা বলতো। যেন উষসীর সাথে কথা বলতে সে ভীষণ আগ্রহী। সেই কথা শুনে উষসীর ভালো লাগতো নাকি খারাপ লাগতো তা সে জানে না। তবে নর্ভাসনেস কাজ করতো ভীষণ। ইয়ামিন ফোন রাখার পর প্লে প্লিস্টে ঢুকে ভায়োলিনের সুর শুনলেই এক অদ্ভুত আবেশে তার মন নরম হয়ে যেতো৷ ধীরে ধীরে কি তার কিশোরী মন প্রেমে নিমজ্জিত হচ্ছিল নাকি সাময়িক মোহ ছিল সেটা? জানে না উষসী!

একদিন তো আরও অদ্ভুত ব্যাপার হলো। লাইভে ইয়ামিনের একটা ইন্টারভিউ চলছে। উষসী আগ্রহ নিয়ে দেখতে বসেছে টিভির সামনে। সাথে পপকর্ণ আর কোল্ড্রিংক। তাদের ফোনালাপ শুরু হওয়ার পর থেকে উষসী সবসময় ইয়ামিনকে ফলো করে। তার একটা আপডেটও মিস করে না। তো সেদিন ঠিক লাইভের সময়ই ফোনটা এলো। উষসী হতভম্ব! লাইভে থাকা অবস্থায়ও তিনি কিভাবে ফোন করছেন?

উষসী ফোন কানে তুলতেই ইয়ামিন বলল,” কেমন আছো মিষ্টি মেয়ে… গুড মর্নিং!”

উষসী বিভ্রান্তি নিয়ে বলল,” মর্নিং… কিন্তু আমাকে কেন ফোন করলেন?”

ইয়ামিন একটু মনখারাপ করে বলল,” ঠিকাছে… তুমি না চাইলে আর করব না ফোন। রেখে দিচ্ছি বরং।”

উষসী বিস্মিত হয়। এতোবড় একজন সেলিব্রিটি হয়ে সেন্টি খাচ্ছেন, আহ্লাদ দেখাচ্ছেন! সেরকম সম্পর্ক কি তাদের মধ্যে হয়েছে যে কথায় কথায় অভিমান প্রকাশ করবেন? অদ্ভুত মানুষ!সে একটু নরম গলায় বলল,”কিন্তু আপনার তো এখন ‘স্টার আড্ডা’ চ্যানেলে লাইভ চলছে। ”

ইয়ামিন একটু সময় চুপ থেকে বলল,” এখন ব্রেক টাইম চলছে। সেজন্যই তোমাকে ফোন করেছি। কারণ তোমার কণ্ঠ মিস করছিলাম। তুমি জানো… তোমার মিষ্টি হাসি আমাকে কত কন্ডিডেন্স দেয়? একবার মিষ্টি করে হাসোতো!”

উষসীর বিষম খাওয়ার উপক্রম হলো। সে কোনমতে বলল,” কিন্তু লাইভে আপনি এখনও কথা বলছেন… আবার ফোনে আমার সাথেও কথা বলছেন! এটা কিভাবে সম্ভব?”

ইয়ামিন বিরক্তি নিয়ে বলল,” আহা, ওটা রেকর্ডেড লাইভ। ব্রেক এই মাত্র দিয়েছে।”

উষসী আগ্রহ নিয়ে বলল,” তাহলে ব্রেক শেষ হলে আমার পছন্দের একটা গান করবেন, প্লিজ?”

ইয়ামিন এবার উত্তর দেয় না। উষসী হ্যালো হ্যালো করতে থাকে। একটু পর ইয়ামিন বলল,” কি গান শুনতে চাও বলো? এখনি শোনাচ্ছি।”

” এভাবে না। লাইভে শোনাতে হবে। আমার নাম নিয়ে।”

ইয়ামিন রুক্ষ গলায় বলল,” তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করছো না? তাই লাইভে তোমার নাম বলিয়ে পরীক্ষা করে দেখবে আমি রিয়েল কি-না?”

উষসী থতমত খেয়ে বলল,” দেখুন… সেরকম কিছু না৷ এটা জাস্ট আমার শখ।”

” তোমার এতো শখ হলে আমি সামনে বসিয়ে তোমার শখ পূরণ করব। আসছি আমি বাংলাদেশে। দেখা করো তুমি আমার সাথে। তারপর যত ইচ্ছে গান শুনবে। আমি সামনে বসে থেকে শোনাবো। কিন্তু লাইভে তোমার নাম নিতে পারব না৷ কারণ তুমি আমার কাছে খুব ব্যক্তিগত একটা ইস্যু।”

উষসীর মন গলতে শুরু করে। এতোটা বোকা ছিল সে যে অনায়াসে কথাগুলো বিশ্বাস করে নেয়। ধীরে ধীরে তার বিশ্বাসের পারদ মজবুত হতে থাকে। কথা-বার্তা বেড়ে যায়। তারপর একদিন হুট করেই প্রিয়ন্তীর কাছে সে শোনে রিয়াসাত নাকি কোন একটা অনুষ্ঠানে মিমিক্রির জন্য প্রাইজ পেয়েছে। তার দুনিয়া ঘুরে ওঠে। সেদিন ইয়ামিন ইব্রাহীমের সাথে কথা বলার সময় উষু ইচ্ছে করেই ‘রিয়াসাত’ বলে সম্বোধন করে তাকে। আর রিয়াসাতও জবাব দিয়ে ফেলে। ব্যস, আর কোনো সন্দেহ থাকে না। উষু ফোন কেটে দেয়। ওদিকে রিয়াসাত ওরফে নকল ইয়ামিন ইব্রাহীম ফোন দিতে থাকে অনবরত। উষসী তাকে শর্ত দেয় ভিডিওকলে না এলে আর কথা বলবে না। বাধ্য হয়ে রিয়াসাত ভিডিওকলে আসে এবং তাদের লুকোচুরি খেলার সমাপ্তি ঘটে।

রাগটা শুধু রিয়াসাতের উপরেই দেখানোর কথা ছিল। কিন্তু উষসীর মন কেন যেন সূক্ষ্ম অভিমান করে বসে ইয়ামিনের উপর। এরপর থেকে সে আর কখনও ইয়ামিনের গান শোনে না। ভায়োলিন শোনে না। তাকে দেখলেও টিভির চ্যানেল পাল্টে দেয়। সে নিউজফিডে এলেও ব্লক করে দেয় সেই পেইজ। কে জানে? হয়তো নিজের পোড়া মনের দহন কমাতে এই কাজ করতো!

তারপরের ঘটনাগুলো অতি জঘন্য। রিয়াসাত উষসীর পাত্তা না পেয়ে দিশেহারা হয়ে যায়। নোংরামির চূড়ান্ত করে। অবশেষে উষসী সেই বিভীষিকা থেকে মুক্তি পেয়েছে আজ। অতীত থেকে বর্তমানে ফেরে সে। পাশে বসে ফোমের সিটে আরাম করে মাথা হেলিয়ে থাকা আশ্চর্য সুন্দর যুবা পুরুষটির দিকে তাকায়।

কোনো ভাণ নেই, উনিই বাস্তবের ইয়ামিন ইব্রাহীম! এখন উষসীর পাশে, খুব কাছে বসে আছেন। উষসীর বিশ্বাস করতে এখনও কিছুটা কষ্ট হয়৷ হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে মন চায়। তারপর বহু কষ্টে নিজেকে সংযত করে।

বিমোহিত হয়ে দেখতে থাকে ইয়ামিনের মুখটা। এলোমেলো মাথা ভরা চুলগুলো কুচকুচে কালো। ঘন ভ্রু, উঁচু নাক, ভীষণ ফরসা আর নিখুঁত মুখ। এতোটুকু দাগ নেই ওই মুখে। যেন নিখুঁত কোনো শিল্পকর্ম! আচ্ছা উনি যে এতো সুন্দর ছবি আঁকে… নিজের ছবি কখনও এঁকে দেখেছেন? পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর পেইন্টিং হয়ে যেতো সেটা। ধূর, উষসী এসব কি ভাবছে? নিজের উপর লজ্জা হয়। ঘুমন্ত একটা মানুষের অচেতনতার সুযোগ নিয়ে তাকে এভাবে খুঁটিয়ে দেখাটা কি অন্যায় নয়?

চলবে