উষসী_হাসবে_বলে পর্ব-৫+৬

0
291

#উষসী_হাসবে_বলে (৫)
লিখা- Sidratul Muntaz

সকালের নরম রোদ সাদা পর্দা গলে উঁকি দিয়েছে। ঘরের ডিম লাইটটা তখনও জ্বলছে। ঘড়িতে সাড়ে সাতটা বাজে। উষ্ণতা ঘরে ঢুকেই দেখল উষসী এখনও ঘুমে বিভোর। অথচ প্রতিদিন এই সময় সে গোসলে ঢুকে যায়। ভার্সিটি যাওয়ার জন্য তৈরী হতে থাকে। আজ তো তার ক্লাসও আছে। তাহলে এখনও বিছানায় লেপ্টে কেন?

উষ্ণতা জানালার কাছে গিয়ে পর্দা সরিয়ে দিতেই স্বচ্ছ কাঁচ ভেদ করে হুড়মুড়িয়ে অতি বেগুণী রশ্মি ছড়িয়ে পড়ল ঘরময়। রোদের তীব্র উত্তাপ উষসীর মুখশ্রী স্পর্শ করতেই চোখ-মুখ কুঁচকে অন্যদিকে ফিরল সে। উষ্ণতা ডিম লাইট নিভিয়ে বলল,” উঠে পড় লক্ষীটি। ভার্সিটি যেতে হবে না? এখনও ঘুমিয়ে আছিস যে?”

উষসী বিড়বিড় করে বলল,”যাবো না আমি ভার্সিটি।”

বোনের উত্তর শুনে অবাক হলো উষ্ণতা। গতকালও সে এক কথা বলেছে। দুইদিন ধরে মেয়েটার কি যেন হয়েছে। সারাক্ষণ ভূতের মতো থম মেরে থাকে। তাকে কোনো প্রশ্ন করলেও জবাব দেয় না। মিনিট দুয়েক পর থতমত খেয়ে তাকায়। যেন সে এই জগৎ-এ নেই। হারিয়ে গেছে ভিন্ন দুনিয়ায়। উষ্ণতা বোনের মতি-গতি কিছুই বুঝতে পারছে না।

ডাইনিং-এ গিয়ে দেখল বাবা-ছেলে ব্রেকফাস্ট করতে বসে গেছে। তৃষাণ যত্নের সাথে ছেলেকে খাইয়ে দিচ্ছে আবার নিজেও খাচ্ছে। মিনমিন করে বলছে,” এতোবড় ছেলে এখনও গুছিয়ে খাওয়াটা শিখল না।”

উষ্ণতা চোখ-মুখ গম্ভীর করে রান্নাঘরে ঢুকল। তৃষাণ বলল,” আজকে আমাকে একটু আগে বের হতে হবে। তুমি ওকে স্কুলে নিয়ে যেতে পারবে না?”

উষ্ণতা কথার জবাব দিল না। রাতে তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছিল। সেটাও তৃষ্ণাকে নিয়ে। আজ-কাল তৃষ্ণার অবাধ্যতা অনেক বেড়ে গেছে। তৃষাণ প্রায় একমাসের মতো বিদেশ ছিল। গতকালই সে ফিরেছে। আর ছেলের ঔদ্ধত্য আচরণ দেখে ক্ষীপ্ত হয়েছে। পড়াশুনা বাদ দিয়ে সারাক্ষণ মোবাইলে ভিডিও গেইম খেলা তৃষ্ণার কাছে নেশার মতো। রাতে তৃষাণ তাকে বলেছে ফোন রেখে ঘুমাতে যেতে।

তৃষ্ণা মুখ শক্ত করে বলেছে,” যাবো না।”

রেগে তৃষাণ ছেলেকে এমন এক থাপ্পড় দিয়েছে যে মুখ থেকে র-ক্ত বের হয়ে গেছে। উষ্ণতা খুবই রেগে আছে ব্যাপারটা নিয়ে। এখন পর্যন্ত সে তৃষাণের সাথে একটা কথাও বলেনি। তৃষাণ যে কথা বলার চেষ্টা করেনি তা নয়, নানান বাহানায় সে কথা বলতে চাইছে কিন্তু উষ্ণতা পাত্তা দিচ্ছে না।

উষসী চোখ কচলে বিছানা থেকে নামল। আর ঘুমিয়ে কাজ নেই৷ সবার দেহেই একটা নির্দিষ্ট বায়োলজিক্যাল ক্লক কাজ করে। যেই সময়ে প্রতিদিন ঘুম ভেঙে যায় চেষ্টা করলেও সেই সময়ের পর আর ঘুমানো সম্ভব হয় না। উষসী বাথরুমে গিয়ে মুখে পানির ঝাপটা দিল৷ তারপর ব্রেকফাস্ট করতে ডাইনিং-এ এলো৷ তৃষাণ তখন বের হচ্ছিল।

উষসী হাসি মুখে বলল,” গুড মর্ণিং ভাইয়া।”

তৃষাণ বলল,” গুড মর্নিং। ভালো হয়েছে তোমার সাথে দেখা হলো। তুমি কখন বের হবে উষু?”

উষসী ভেবেছিল আজ ইউনিভার্সিটি যাবে না। হঠাৎ মেজাজ পরিবর্তন হয়েছে। বলল,” এইতো, একটু পর।”

” ঠিকাছে। এই টাকাটা রাখো।”

তৃষাণ কয়েকটা একহাজার টাকার নোট বাড়িয়ে দিল৷ উষসী অবাক হয়ে বলল,” কিসের জন্য?”

” তোমার আপু বলেছিল তোমার নাকি দরকার?”

উষসী উষ্ণতার দিকে চাইল। উষ্ণতা নিজের কাজে ব্যস্ত থাকার ভাণ করে আছে। এদিকে সে তাকাচ্ছে না। অর্থাৎ তৃষাণের সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই। উষসী টাকাটা হাতে নিয়ে বলল,” থ্যাংক্স।”

তৃষাণ বলল,” শুনলাম তুমি নাকি গাড়ি নিয়ে একা বের হও? ব্যাপারটা কিন্তু ঠিক না। ড্রাইভিংটা তোমাকে শিখিয়েছিলাম সেফটির জন্য। তার মানে এই না যে একা একা চলা-ফেরা করবে। ভার্সিটি পর্যন্ত ঠিকাছে… কিন্তু দূরে কোথাও গেলে অবশ্যই আহমেদকে সাথে নিয়ে যেও।”

উষসী মৃদু হেসে বলল,” ঠিকাছে।”

তৃষাণ ছেলের কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” বাবা, আসি।”

তৃষ্ণা আইসক্রিম বারে কামড় দিয়ে আনন্দিত গলায় বলল,” ওকে।”

রাতে মা-র খাওয়া নিয়ে বাবার সাথে অভিমানের কথা আইসক্রিম পেতেই বেমালুম ভুলে গেছে সে। আইসক্রিম দিয়ে ছেলেকে সামলানো গেলেও ছেলের মাকে এখনও সামলানো যায়নি। সে এটম বোমের মতো ফুলে আছে। তৃষাণ যাওয়ার আগে নরম গলায় বলল,” বায়।”

উষ্ণতা তাকালও না। উষসী নিজের ঘরে এসে তৈরী হয়ে নিল৷ হাতের টাকাগুলো গুণে দেখল সাতহাজার আছে। অথচ সে চেয়েছিল মাত্র চারহাজার। হ্যাঁ এটা ঠিক যে উষসী কখনও অপ্রয়োজনীয় খরচ করে না। কিন্তু তৃষাণ তাকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশিই হাতখরচ দিয়ে রাখে। মুখ ফুটে কিছু চাওয়ার আগেই সামনে এনে হাজির করে। কসমেটিক্স, মেকাপ, জামা-কাপড়… এক কথায় তার কখন কি লাগবে সবই তৃষাণের মুখস্ত।

গত জন্মদিনেই উষসীকে একটা লেটেস্ট মডেলের আইফোন কিনে দিয়েছে সে। মাত্র আটবছর বয়সে বাবা হারিয়েছে উষসী। কিন্তু কখনও বাবার অভাব উপলব্ধি করেনি। মাথার উপর বিশাল বটবৃক্ষের ছায়া হয়ে তৃষাণ দাঁড়িয়ে ছিল সবসময়। বলতে কি, উষসী নিজের আপনবোনের থেকেও দুলাভাইকে বেশি ভালোবাসে। তার আফসোস হয় মাঝে মাঝে। এই মানুষটা কেন তার আপন ভাই হলো না? অবশ্য আপন ভাই না হয়েও সে যা করেছে, কোনো ভাইও তা করে না।

গাড়ি নিয়ে আজও উষসী একাই বের হয়েছে। প্রথমে ভার্সিটির পথে এগোলেও হঠাৎ করে মন বদলে গেল। গাড়ি ঘুরিয়ে যেতে লাগল গাজীপুরের দিকে।

_________________
মিসেস শিমলা খুবই আশাহত বোধ করছেন। আর কিছুদিন পর তার একমাত্র ছেলে ভিনদেশে পাড়ি জমাবে আবারও। অথচ তিনি চাইছেন ছেলেকে নিজের কাছে রাখতে। সেজন্যই বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন।প্রথমে তো সব ঠিকই ছিল। মানতাশাও ইয়ামিন বলতে পাগল। তাহলে হঠাৎ করে কি এমন হলো যে সে কান্নাকাটি করে বিয়ে ভেঙে দিল?

সে বলছিল ইয়ামিনের নাকি গার্লফ্রেন্ড আছে। সেই মেয়েকে নাকি তার চোখের সামনেই ইয়ামিন চুমু দিয়েছে। ব্যাপারটা ইয়ামিনকে জিজ্ঞেস করতেই সে পুরোপুরি অস্বীকার করল। তাছাড়া এমন কিছু হলে কি মিসেস শিমলা নিজে জানতেন না? কই, ইয়ামিন তো তাঁকে কখনও কিছু বলেনি! মানতাশা তাহলে মিথ্যা অভিযোগ কেন দিচ্ছে তাঁর ছেলের নামে?

তবে যা হয় ভালোর জন্যই হয়। বিয়ের পাত্রী হচ্ছে পাবলিক বাসের মতো। প্রথমটা গেলে পরেরটা আসবে। শিমলা দ্বিতীয় আরেকজনকেও ঠিক করে ফেলেছেন। মানতাশার থেকে দশগুণ সুন্দরী। ইয়ামিনের যোগ্য পাত্রী, উঁচু বংশীয়। শিক্ষিতা, সর্বগুণে গুণান্বিতা! কিন্তু দুশ্চিন্তা একটাই, ইয়ামিন এবার রাজি হবে তো? শিমলা খুব ভয়ে ভয়ে পাত্রীর ছবি নিয়ে ছেলের ঘরে ঢুকলেন।

নিঝুম নীড়ের কাছাকাছি এসেই গাড়ি থামায় উষসী৷ এই জায়গায় সে কেন এসেছে তার উত্তর নিজেও জানে না। তার খুব ছটফট লাগছিল। এইখানে আসার পর মন শান্ত হয়েছে। আরও শান্তি লাগতো যদি ওই সিংগার বেটার গালে দু’টো চড় মা-রা যেতো৷ বেটা আস্তো একটা বদ! দুইদিন ধরে উষসীর মাথায় একদম জেঁকে বসে আছে। কারণে-অকারণে উষসী বিরক্ত হচ্ছে। সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না কথাগুলো। কানের কাছে দ্রিম দ্রিম করে বেজে যাচ্ছে,” কারণ ভালোবাসি৷ তুমি আমার রঙতুলির একমাত্র চিত্ররূপসী।”

উফ, উষসী নিজের কান চেপে ধরে। সে আর ভাবতে চায় না।রাতে সে ঘুমাতেও পারছে না। দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ব্যাপারটা কারো সাথে শেয়ার করা যাচ্ছে না। কেউ বিশ্বাসই করবে না! যুঁথি তো হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল। উষসী নিজের গালে হাত রেখে স্বগতোক্তি করে,” আই হেইট ইউ, ইয়ামিন ইব্রাহীম৷ আমার সাথে অস*ভ্যতামির শাস্তি আপনাকে পেতে হবে। মাইন্ড ইট।”

ইয়ামিন ঠোঁট উল্টে ছবিটির দিকে চেয়ে থাকে কতক্ষণ। চশমা পরিহিত একটি মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। গায়ের রঙ ধবধবে ফরসা হওয়ায় চোখের নিচের কালো দাগ নজরে পড়ছে। ইয়ামিনের সুন্দরী নারীমুখের লোভ নেই। সে মায়ের ভদ্র ছেলে। মা যদি তার জন্য রূপকথার রাক্ষসীকেও তুলে আনে তাও সে অনায়াসে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাবে। কারণ মাকে সে কষ্ট দিতে চায় না।

ছোট থেকে এই পর্যন্ত সে কখনও মায়ের কথা শোনেনি। সবসময় নিজের মর্জিমতো চলেছে। কাউকে তোয়াজ করেনি। শিমলাও ছেলেকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। এছাড়া উপায়ও ছিল না। কিন্তু ইয়ামিন এখন বুঝতে পারে মা তার জন্য জীবনে কত ইম্পর্ট্যান্ট। সে শপথ নিয়েছে আর মায়ের অবাধ্য হবে না।

শিমলা আগ্রহ নিয়ে বললেন,” বাবা বিশ্বাস কর, এই মেয়েটাই তোর জন্য পারফেক্ট। ডাক্তারি পড়ছে। এমবিবিএস দিয়েছে। রেজাল্ট আউট হলেই এমডিতে ভর্তি হয়ে যাবে। উফ… আমার তো ভাবতেই খুশি লাগছে যে ডাক্তার বউমা পাবো।”

ইয়ামিন মায়ের পাগলামি দেখে হাসল। একহাতে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” তোমার খুশিতেই আমার খুশি মা।”

ছেলের সম্মতি পেয়ে মিসেস শিমলার আনন্দ যেন আর ধরে না। তিনি আপ্লুত গলায় বললেন,” আমার লক্ষীসোনা। আজকেই আমি তোদের এপয়েন্টমেন্ট ফিক্সড করছি দাঁড়া। মেয়ে তো পড়াশুনা নিয়ে খুব ব্যস্ত। বাসায় মনে হয় আসতে চাইবে না। রেস্টুরেন্টে দেখা কর।”

” এই না বললে এমবিবিএস পাশ করেছে? পরীক্ষার পরেও আবার পড়াশুনা নিয়ে কিসের ব্যস্ততা?”

” আরে ডাক্তারদের কি পড়াশুনার কোনো শেষ আছে? দাঁড়া আমি ফোন করে দেখছি।”

মেয়েটির নাম ফাবিয়াহ। ফাবিয়াহর সাথে ইয়ামিনের এপয়েন্টমেন্ট ফিক্সড হয় লাঞ্চ আওয়ারে। সে দুপুর একটায় বাড়ি থেকে বের হয়৷ অনমকে বলেছিল গাড়ি বের করে রাখতে। অনম জানায় নিচে সে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে।

ইয়ামিন মোবাইল স্ক্রল করতে করতে মেইন গেইট পার হয়ে সামনে যেই গাড়ি পায় সেটাতেই উঠে পড়ে। সাথে সাথে উষসী তার শিরদাঁড়ায় শীতল স্রোত অনুভব করল। আয়েশী চালে সিটের সাথে হেলে বসেছিল সে। কফি রঙের শার্ট, কালো জিন্স, চোখে সানগ্লাস, হাতে ব্র্যান্ডের ঘড়ি আর গায়ে পারফিউমের সুবাস মাখা ইয়ামিনকে দেখেই মেরুদন্ড সটান হয়ে যায় তার।

ইয়ামিন নির্বিকার চিত্তে বলল,” এখান থেকে উত্তরা যেতে কতক্ষণ সময় লাগবে?”

প্রশ্নটা করে সামনে তাকাতেই সে হকচকিয়ে যায়। সামনের আয়নায় দেখতে পায় একটা কোমল মুখশ্রী। বড় বড় দু’টি কাজল কালো চোখ তার দিকে নির্ণিমেষ চেয়ে আছে। উষসীর গায়ে হলুদ চুরিদার। খোলা চুল পিঠময় ছড়ানো। কানে ঝুমকো। মুখে হালকা সাজ। কপালে ছোট্ট টিপ। তাকে দেখতে বরাবরের মতোই খুব এস্থেটিক লাগছে। ইয়ামিনের কথা বন্ধ হয়ে যায়। চোখের পলক থেমে যায়। কিছুসময়ের নীরবতা বয়ে যায়। হঠাৎ ইয়ামিন হতভম্ব স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়ল,” আপনি এখানে কি করছেন?”

উষসী বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে আয়নার দিকে চেয়ে স্পষ্ট গলায় বলল,”এই প্রশ্নটা তো আমার করার কথা। আপনি আমার গাড়িতে কি করছেন?”

ইয়ামিন এদিক-ওদিক তাকিয়ে বুঝতে পারল গাড়িটা তার নয়। একটু অপ্রস্তত হয়ে বলল,” ওহ…স্যরি।” পরমুহূর্তেই আবার বিস্ময় নিয়ে শুধাল,” কিন্তু আপনি আমার বাড়ির সামনে কি করছেন?”

উষসী পর্যদুস্ত। আমতা-আমতা করে বলল,” এখান দিয়েই যাচ্ছিলাম আমি। আমার একটা আত্মীয়ের বাসা এদিকে।”

ইয়ামিন তার বিব্রত মুখ পরখ করে ভ্রু নাচিয়ে বলল,” কিন্তু আপনি তো থেমে ছিলেন। তাও একদম আমার বাড়ির গেইটের সামনে! ”

উষসী আয়না থেকে চোখ সরিয়ে নিল। ইয়ামিনের তীক্ষ্ণ প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে বলল,”আমার কপাল এতোই খারাপ যে এই জায়গাতে এসেই ব্রেকটা থেমেছে। কি করব?”

” তাই নাকি? দেখি তাহলে!”

এই কথা বলেই ইয়ামিন গাড়ি থেকে নেমে সামনে এলো। উষসীর দিকে ঝুঁকে তাকে সরতে ইশারা করল। সে আগেই অনেকটা সরে গেছিল। এবার আরেকটু সরতেই ইয়ামিন ফট করে তার ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ল। উষসী বিমূঢ় হয়ে বলল,” আরে, কি করছেন?”

” দেখছি… আপনার ব্রেকে কি সমস্যা!”

এই কথা বলেই গাড়ি স্টার্ট দিতে লাগল সে। উষসী তেজ নিয়ে বলল,” দেখতে হবে না। আপনি কি মেকানিক নাকি?”

” মেকানিক না হলেও এটলিস্ট ব্যাসিকটা তো বুঝব….”

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই গাড়ি পূর্ণ গতিতে চলতে শুরু করল। উষসীর মুখ ফ্যাকাশে রূপ ধারণ করল। ইয়ামিন দুই চোখ বড় করে অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলল,” আরে বাহ… গাড়ি তো ফুলস্পিডে চলছে। আমি হাত লাগাতেই সেড়ে গেল নাকি?”

উষসী তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। ইয়ামিন স্টেয়ারিং ঘুরিয়ে ড্রাইভিং শুরু করেছে। হঠাৎ সে খেঁকিয়ে উঠল,” কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? আমার গাড়ি থেকে নামুন।”

ইয়ামিনের ফোন বেজে উঠল। সে উষসীর কথার জবাব না দিয়ে ফোন রিসিভ করল,” হ্যালো।”

ওইপাশ থেকে অনম বলল,” স্যার… আমি নিচে দাঁড়িয়ে আছি। আপনি কখন নামবেন?”

” তোমার আর দাঁড়ানোর প্রয়োজন নেই৷ চলে যাও অনম। আমি বেরিয়ে গেছি।”

” কিন্তু কখন স্যার? আমি তো দেখলাম না…”

ইয়ামিন ফোন রেখে দিল। উষসী রাগে তীব্র আওয়াজে বলল,” আপনি কি আমার সাথে মজা নিচ্ছেন? এখনি গাড়ি থামান নাহলে কিন্তু আমি চিৎকার করব। আপনাকে পুলিশে দিবো।”

ইয়ামিন তার শার্টের বোতাম খুলে বলল,” দেখুন, কি অবস্থা করেছেন আমার। পুলিশে তো আপনাকে দেওয়া উচিৎ। ”

উষসী দেখল উজ্জ্বল ত্বকে কালচে দাগ গাঢ় হয়ে ফুটে আছে। গরম কফি ছুঁড়ে মারার ফল! সে রোষ নিয়ে বলল,” এটা তো খুবই সামান্য৷ আপনি আমার সাথে যেটা করেছেন সেজন্য যে আমি এখনও আপনাকে খু*ন করে ফেলিনি সেটাই আপনার ভাগ্য।”

” কেন? আমি কি অপ’রাধ করেছি? ভালোবাসার কথা বলা নিশ্চয়ই অপ’রাধ না। আপনি কি কখনও কাউকে ভালোবাসেননি মিস…এখনও আপনার নামটাই জানা হলো না।”

উষসী চমকে তাকাল। ‘ভালোবাসা’ শব্দটা শুনেই পুনরায় চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার। চোখেমুখে র-ক্তিম আভা৷ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলে উঠল,” লামিয়া ইমরোজ।”

” বাহ, সুন্দর নাম। ইমরোজ…ছোট্ট করে কি ডাকা যায়? রোজ! অবশ্য আপনি রোজের মতোই বিউটিফুল। ”

আপাদমস্তক জ্বলে উঠল উষসীর। রাগে কটমটে দৃষ্টিতে বলল,” লজ্জা করে না ফ্লার্ট করতে? আপনার মতো একজন গ্রেইট সিংগার রেন্ডমলি মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করে বেড়ায়… ব্যাপারটা কত লজ্জাজনক বুঝতে পারছেন? ছি!”

ইয়ামিন বিনয়ী ভঙ্গিতে বলল,”দেখুন আপনি আমার উপর রেগে আছেন সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি মোটেও ইনটেনশনালি আপনার সাথে ওইদিন মিসবিহেভটা করিনি।”

” তাহলে কেন করেছেন? আমাকে আপনার কি মনে হয়? ইন ফ্যাক্ট নিজেকে আপনি কি মনে করেন? যখন যা খুশি করবেন আর কেউ আপনাকে কিচ্ছু বলবে না?সবাইকে কি নিজের কেনা সম্পত্তি মনে করেন নাকি? শুনুন, আপনার জন্য হাজারটা মেয়ে পাগল হতে পারে কিন্তু আমি অন্যদের মতো না।”

ইয়ামিন দীর্ঘ শ্বাস টেনে বলল,” কাম ডাউন। আস্তে কথা বললেও আমি শুনতে পাই। তাছাড়া ননস্টপ এতো জোরে কথা বলতে বলতে তো আপনি হাঁপিয়ে যাচ্ছেন।”

প্রচন্ড ক্রোধে উষসীর মাথা ভনভন করতে লাগল। সে কণ্ঠে ঝাঁঝ নিয়ে বলল,” আমার গাড়ি থেকে বের হোন, নয়তো খুব খারাপ হবে।”

ইয়ামিন দৃঢ় গলায় বলল,” আমার একটা খুব জরুরী এপয়েন্টমেন্ট আছে। সেখানে আমাকে ড্রপ করে দিন, আমি চলে যাবো। কিন্তু এতোটুকু সময় আমাকে সহ্য করুন, প্লিজ।”

” আপনাকে আমার গাড়িতেই কেন যেতে হবে? পৃথিবীতে অসংখ্য গাড়ি আছে।”

” যে কারণে অসংখ্য জায়গা থাকতেও আমার বাড়ির সামনেই আপনার ব্রেক থামে… সেই একই কারণে পৃথিবীতে অসংখ্য গাড়ি থাকলেও আপনার গাড়িতেই আমাকে যেতে হবে।”

” মানে?”

উষসী দূর্বোধ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইয়ামিন বলল,” আপনি কি এক্সপ্লানেশন চান না রোজ? সেদিনের কথাগুলো আদৌ সত্যি নাকি মিথ্যা তা জানতে চান না?”

উষসী অস্বস্তি নিয়ে বলল,” আমাকে রোজ ডাকবেন না। আর আপনার কথা সত্যি হোক কি মিথ্যা তাতে আমার কিছুই যায়-আসে না।”

” তবুও আমি বলতে চাইছি।”

” আমি শুনতে চাই না।” উষসী নিজের কান চেপে ধরল। ইয়ামিন তোয়াক্কা না করেই বলতে লাগল মানতাশার ঘটনা। উষসী সবকিছু শোনার পর চোখ ছোট করে শুধাল,” আমি কেন এসব বিশ্বাস করব? এগুলো যে সত্যি তার প্রমাণ কি?”

” তাহলে আপনি কি বিশ্বাস করতে চাইছেন? এগুলো সব মিথ্যা আর আমি আপনাকে ভালোবাসি এটাই সত্যি?”

উষসী থতমত খেল। ইয়ামিন হেসে ফেলল,” আ’ম স্যরি… কিন্তু এটাই সত্যি৷ এন্ড থ্যাংক গড যে আপনি সেদিন এসেছিলেন। নয়তো আমি অনেক বড় বিপদে পড়তে যাচ্ছিলাম। আর মায়ের কথা অগ্রাহ্য করাও সম্ভব ছিল না।”

উষসী তাচ্ছিল্য স্বরে বলল,” আপনাকে দেখে একদম বোঝা যায় না যে আপনি এমন মামা’স বয় টাইপ ছেলে!”

তারপর একটু থেমে পুনরায় বলল,” কিন্তু আপনি আমার পেইন্টিং কেন এঁকেছেন? সেটার এক্সপ্লানেশন এখনও দিতে পারেননি।”

ইয়ামিন ভ্রু কুঁচকে বলল,” ওটা আপনার পেইন্টিং কেন হতে যাবে? নিজেকে এতো প্রিসিয়াস কেন ভাবছেন?”

উষসী হতবিহ্বল হলো। লোকটা কি তাকে কোনোভাবে অপমান করার চেষ্টা করছে? হঠাৎ গাড়ি থামল একটা উঁচু ভবনের সামনে৷ ইয়ামিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” ওটা আপনি ছিলেন না। আমার কল্পনার কেউ ছিল। যার বাস্তবে আসলে কোনো অস্তিত্বই নেই… আর যদি কোনোভাবে আপনার সাথে মিলে যায় তাহলে পুরো ব্যাপারটাই কো-ইন্সিডেন্ট৷ সেজন্য আমি স্যরি। যাইহোক আমার গন্তব্য এসে গেছে। থ্যাংকস ফোর লিফট।”

ইয়ামিন নেমে যাওয়ার সময় দেখল গাড়ির কাঁচের সামনে ছোট্ট ট্রি প্লান্টে উষসীর আইডি কার্ড ঝুলছে।লামিয়া ইমরোজ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট। ইয়ামিন কিছুক্ষণ কার্ডের দিকে চেয়ে থেকে বলল,” আসছি। বায়।”

উষসী কোনো কথা বলে না। ইয়ামিন গাড়ি থেকে নেমে যায়। বিশাল বড় একটা রেস্টুরেন্ট সামনে। খুব নিরিবিলি ধরণের। এমন জায়গায় কিসের জরুরী এপয়েন্টমেন্ট? কোনো সেলিব্রিটি আসেনি তো? কৌতুহল দমাতে না পেরে উষসীও নামে। একটু সাত-পাঁচ ভেবে ভেতরে ঢোকে। কয়েকজন ওয়েটার তাকে ওয়েলকাম জানায়। বসার জন্য সুন্দর জায়গা দেখিয়ে দেয়। কিন্তু উষসী বসে না। সে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দোতলায় চলে যায়।

ইয়ামিনকে সেখানেই পাওয়া যায়। কোণার একটা সোফায় আয়েশী ভঙ্গিতে বসে আছে। মুখে মাস্ক, চোখে সানগ্লাস। এসব নিশ্চয়ই নিরাপত্তার জন্য। নয়তো ভক্তরা এসে ঘিরে ধরবে। তার সাথে একটা মেয়েকেও দেখা যায়। মেয়েটির গায়ে নীল কূর্তি, গলায় সাদা স্কার্ফ। চোখে চশমা। বেশ স্মার্ট দেখতে। দু’জন দূরত্ব বজায় রেখে বসে আছে। কিন্তু মেয়েটার মুখ দেখে মনে হলো একটু লজ্জা পাচ্ছে।

উষসীর বুঝতে বেশি সময় লাগে না। ইয়ামিন ইব্রাহীম ডেটিং-এ এসেছেন! ও মাই গড! ব্যাপারটা যদি কোনোভাবে ফাঁস করা যায় তাহলে কেমন হবে? লুকিয়ে লুকিয়ে ডেইট করছেন ইয়ামিন ইব্রাহীম। সেই রকম রসালো সংবাদ। সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় করার জন্য যথেষ্ট। উষসী লুকিয়ে ঝটপট কয়েকটা ছবি তুলে নেয়। তার মধ্যে অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করছে। এবার সে প্রতিশোধ নিতে পারবে। কিন্তু উষসী জানে না, মজার ছলে সে যে কাজটি করতে যাচ্ছে তার জন্যই একদিন বিরাট আফসোস করতে হবে তাকে!

চলবে

#উষসী_হাসবে_বলে (৬)
লিখা- Sidratul Muntaz

কোলাহলপূর্ণ দুপুরবেলা। রোদের উত্তাপে খরখরে হয়ে আছে পিচঢালা কংক্রিটের রাস্তা। ইয়ামিন একটা রেকর্ডিং শেষ করে বাড়ি ফিরছিল। সামনে বেজায় ভীড় মানুষের। আশেপাশে কোনো উৎসব চলছে নাকি? বেশিরভাগ রমণীদের শাড়ি পরে হাঁটতে দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ একটা জায়গায় নজর আটকে যায়। ইয়ামিন ড্রাইভারের উদ্দেশ্য বলল,” গাড়ি থামাও।”

হৈচৈয়ের মধ্যে গাড়ি থামতেই ইয়ামিন মুখে মাস্ক লাগিয়ে দ্রুত বের হয়। উদগ্রীব চোখে এদিক-সেদিক খুঁজতে থাকে কাঙ্ক্ষিত মুখটি৷ তাকে খুব বিচলিত দেখায়। এদিকে মুখে মাস্ক থাকা সত্ত্বেও মানুষ তাকে চিনে ফেলেছে। একজন চিৎকার করে উঠল,” ইয়ামিন ইব্রাহীম, ইয়ামিন ইব্রাহীম।”

নিমেষেই ভীড় জমে যায় রাস্তায়।অনম একা হাতে সামলাতে পারে না পাবলিককে। বাধ্য হয়ে কয়েকজনকে সেলফি আর অটোগ্রাফ দিতেই হয়৷ তারপর গাড়িতে উঠে রীতিমতো পালিয়ে আসে তারা। অনম ধকল সামলে প্রশ্ন করল,” স্যার আপনি এমন ক্রাউডের মধ্যে কেন নামতে গেলেন?”

ইয়ামিন বলতে পারে না। সিটে মাথা এলিয়ে চুপ করে থাকে। তার মনে হয়েছিল সে উষসীকে দেখেছে। কিন্তু তাকে খুঁজে না পেয়ে হতাশ লাগছে। কেন লাগছে? নিঝুম নীড়ে গাড়ি প্রবেশ করতেই দারোয়ান গেইট খুলে দেয়। লম্বা করে সালাম দেয়। ইয়ামিন কালো কাঁচ নামিয়ে ইশারায় তাকে ডাকে। কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে এগিয়ে আসে দারোয়ান।

” আজ কি কেউ এসেছিল?”

দারোয়ান কিছু বুঝতে না পেরে পাল্টা প্রশ্ন করল,” কে আসবে স্যার?”

ইয়ামিন ইতস্তত মুখে জানতে চাইল,” কোনো মেয়ে…”

দারোয়ান একটু অবাক হয়। ভেবে-চিন্তে উত্তর দেয়,” স্যার বুঝতে পারছি না৷ কোন মেয়ে?”

” ওইতো… দুইবার যে এসেছিল!”

দারোয়ান বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। অনম তাদের মাঝে বাঁ হাত ঢুকিয়ে বলল,” পেইন্টিং এর ওই ম্যাডামের কথা বলছেন নাকি স্যার?”

ইয়ামিন চোখ ছোট করে তাকাল,” পেইন্টিং এর ম্যাডাম মানে?”

অনম একটু লাজুক হেসে হাত দিয়ে স্কয়ার শেপ দেখিয়ে বলল,” যার পেইন্টিং এঁকে আপনি দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছেন। সিলেটের সেই ম্যাডাম।”

ইয়ামিনের দৃষ্টি গরম হয়ে আসে। অনম থেমে যায়। মলিন মুখে বলে,” স্যরি স্যার।”

পার্কিং এর কাছে গাড়ি থামে। ইয়ামিন ভেতরে ঢুকে যায়। ঘরে গিয়ে এসিটা ছেড়ে একটু বসতেই শিমলা কফি নিয়ে হাজির হোন। ইয়ামিন মৃদু হেসে বলল,”মা, এসো।”

শিমলা স্নেহমাখা কণ্ঠে বললেন,” তোর জন্য আজকে মালাই কোফতা রান্না করেছি। সাথে নারকেলি পোলাও।”

ইয়ামিন অভিযোগের স্বরে বলল,” প্রতিদিনই রিচফুড খাওয়াচ্ছো মা। এসব কি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো? ”

” মায়ের আদরের কথা না ভেবে তুই স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা করছিস? কি হবে এতো ফিট থেকে? তাছাড়া একটু স্বাস্থ্য না হলে ভালোও লাগে না। একে তো লম্বা তার উপর এমন রোগা হয়েছিস যে দেখতে বাঁশের মতো লাগে। তোর বয়সী ছেলেরা কত নাদুসনুদুস হয়।”

ইয়ামিন হেসে বলল,” তুমি কি আমাকে ভুঁড়ি বানানোর পরমর্শ দিচ্ছো মা?”

শিমলা দম্ভপূর্ণ কণ্ঠে বললেন,”আমার ছেলেকে ভুঁড়িসহও হ্যান্ডসাম লাগবে। কফিটা নে।”

ইয়ামিন কফিতে চুমুক দিতেই শিমলা আগ্রহ করে বললেন,” ফায়া ফোন করেছিল। ও বাড়িতে আসতে চায়। তুই কখন ফ্রী আছিস? সময় বুঝে ওকে আসতে বলব।”

ইয়ামিন অবাক হয়ে বলল,” ফায়া কে?”

” ফাবিয়াহ। ওর ডাকনাম ফায়া।”

ইয়ামিন আরও বিভ্রান্ত হয়ে বলল,” ফাবিয়াহটাই বা কে?”

শিমলার মুখ অন্ধকার হয়ে যায়। আশ্চর্য কণ্ঠে বললেন,” ওমা, ফাবিয়াহ কে চিনতে পারছিস না? সেদিন যে দেখা করতে গেলি ওই মেয়েটা।”

ইয়ামিনের মাত্র মনে পড়ে। সাথে সাথেই একটা অস্বচ্ছন্দ্যময় অনুভূতি ভেতর থেকে জাপটে ধরে তাকে। মেয়েটির কথা সে বেমালুম ভুলে বসেছিল। শিমলা ছেলের পরিবর্তন লক্ষ্য করে শুধালেন,” ফায়াকে তোর কেমন লেগেছে বাবা? কিছুই তো বললি না সেদিন।”

ইয়ামিন ঠোঁট উল্টে বলল,” নাথিং স্পেশাল। মেয়েটা কথা খুব কম বলে।”

শিমলা অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন,” মানতাশা কথা বেশি বলতো সেটা না হয় বুঝলাম। তুই নীরবতা পছন্দ করিস।তাই ওকে পছন্দ করিসনি। কিন্তু ফায়ার মধ্যে সমস্যা কি? এতো খুঁতখুঁত করলে তোর জন্য মেয়ে কিভাবে খুঁজব আমি? সবার মধ্যেই কিছু না কিছু দোষ বের করে ফেলছিস। একেবারে নিখুঁত তো কোনো মেয়ে হয় না।”

‘নিখুঁত’ শব্দটা কর্ণগোচর হতেই ইয়ামিনের মনের দর্পণে ভেসে ওঠে উষসীর চমৎকার মুখ। পরপর পেইন্টিং-এর দিকে নজর যায়। হঠাৎ সে খেয়াল করে, চিত্ররূপসীর সাথে ওই মেয়েটির অস্বাভাবিক মিল। মেয়েটি মিথ্যা বলেনি তবে। তাহলে কি তার নিজেরই কোথাও ভুল হচ্ছে? সে বিভ্রান্তবোধ করে। শিমলা আবার প্রশ্ন করলেন,” ফায়াকে আসতে বলব বাবা?”

ইয়ামিন অন্যমনস্ক গলায় বলল,” তোমার ইচ্ছা হলে বলো।”

শিমলা ভীষণ খুশি হয়ে গেলেন। রুম থেকে বের হওয়ার আগে বললেন,” ওহ, একটা কথা বলতেই ভুলে গেছি। প্রিয়ন্তী ফোন করেছিল। তার বিয়ের দাওয়াত করল আমাদের। নেক্সট মান্থেই সুইজারল্যান্ডে যাচ্ছি আমরা। তুই শিডিউল ফিক্সড করে রাখ। আমি কিন্তু কোনো বাহানা শুনব না।”

ইয়ামিন হাসি মুখে বলল,” প্রিয়ন্তী আপু বিয়ে করছে তাহলে! ছেলে কি করে?”

” তোর ছোটভাই। মানে মিউজিশিয়ান। বয়সে প্রিয়র থেকে দুইবছরের জুনিয়র। তাও ভালো। মনের মতো ছেলে যে পেয়েছে এটাই বড় কথা। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।”

শিমলা বের হতেই ইয়ামিনের মাথায় অন্য চিন্তা ভর করে। প্রিয়ন্তীর বিয়ে মানে তো সেখানে উষ্ণতা মিস আর তৃষাণও থাকবে। যেহেতু প্রিয়ন্তী সম্পর্কে তৃষাণের সৎবোন। আর তাদের মধ্যে সম্পর্কও বেশ ভালো। তাহলে তো বিরাট সমস্যা হয়ে যায়। নয়বছর আগে ইয়ামিন উষ্ণতাকে কথা দিয়েছিল, যতদিন বেঁচে থাকবে জীবনে কখনও তার মুখোমুখি হবে না। সে নিজের কথা রাখবে। তাই সুইজারল্যান্ড সে যাবে না।

সন্ধ্যা থেকেই টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টি শীত নামানোর বৃষ্টি। দুপুরের উত্তপ্ত পরিবেশ সন্ধ্যে ঘনাতেই হিমরূপ ধারণ করেছে। তৃষাণ অফিস থেকে ফিরেছে বড় লাল গোলাপের বুকেট নিয়ে। সাথে কিছু চকলেট। ফুল মায়ের জন্য, চকলেট ছেলের জন্য। উষ্ণতা সারাদিন ফোন ধরেনি৷ ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে লাল গোলাপের তোড়া দেখেই তার রাগ কমে যাওয়ার কথা। তৃষাণ এর মধ্যে একটা ছোট নোটও লিখেছে। যা খুবই ব্যক্তিগত। কালো রঙের কাগজে সাদা কালিতে লেখা,” আর হবে না জান।”

যুঁথি জানালায় হেলান দিয়ে বৃষ্টি দেখছে। উষসীর ঘরের জানালাটা বেশ বড়। বাইরে তাকালেই খোলা আকাশ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য নজরে পড়ে। বৃষ্টির কারণে একটা স্নিগ্ধ গন্ধ ছড়িয়ে আছে পরিবেশে। যা মন ভালো করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু যুঁথির মন ভালো নেই। তার রাগে রীতিমতো কান্না পাচ্ছে। উষসী সেদিকে চেয়ে মহাবিরক্তি নিয়ে বলল,” আচ্ছা তোর সমস্যাটা কোথায় যুঁথি? এই রকম সিলি ম্যাটার নিয়ে তুই ড্রামা করছিস?”

প্রীতি বলল,” বিরহে শুকিয়ে যাচ্ছে বেচারি।”

যুঁথি মুখ গোমরা করে বলল,” এইটা কোনো কথা হলো? রাজপুত্রের মতো ছেলেটা। সে কি-না ডেইট করছে এক চুন্নির সাথে!”

উষসী হেসে ফেলল এবার। চোখ বড় করে বলল,” ইয়ামিন ইব্রাহীম যদি মিস ওয়ার্ল্ডের সাথেও ডেইট করে তবুও তোর কাছে তাকে চুন্নির মতো লাগবে।”

যুঁথি ঠোঁট উল্টে বলল,” ঠিকই বলেছিস। তার পাশে আমি কাউকে সহ্য করতে পারব না, নেভার! আর এই মেয়েটাকে তো একদমই না।”

উষসীর মোবাইলে ইতোমধ্যে সবাই ছবিগুলো দেখে নিয়েছে। ইয়ামিনের মুখ তেমন স্পষ্ট নয়। তবে তার শারীরিক গঠন আর চোখ দু’টো দেখে নিঃসন্দেহে চিনে ফেলা যায়। ফাবিয়াহর মুখ পুরোপুরি স্পষ্ট। যদিও যুঁথির ভাষায় সে চুন্নি কিন্তু প্রীতি বলল,” মেয়েটা ভালোই দেখতে।”

শম্পা দ্বিমত পোষণ করল,” উহুঁ, এতোটাও ভালো না যে ইয়ামিন ইব্রাহীমের গার্লফ্রেন্ড হিসেবে মেনে নেওয়া যায়।উষু আমার মনে হয় এখানে কোনো ঘাপলা আছে। ওরা এতো দূরে বসে আছে কেনো? প্রেম করলে তো মানুষ ক্লোজলি বসে তাই না।”

যুঁথি উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,” এক্সাক্টলি। তার মানে এটা ওর প্রেমিকা নয়। আল্লাহ বাঁচিয়েছে।”

উষসী ধমক মেরে বলল,” চুপ কর। ওরা কি পাবলিক রেস্টুরেন্টেও সাপটা-সাপটি করবে নাকি? আমি নিশ্চিত ওরা ডেইট করছে। মেয়েটার মুখের হাসি দেখেছিস?”

যুঁথি আক্ষেপ নিয়ে বলল,” হাসবেই তো। হাজারও মেয়ের ক্রাশকে পটিয়ে প্রেম করছে। এখন তো তারই হাসার সময়।”

উষসী ফিসফিস করে বলল,” আমি একটা ট্রাস্টেড সোর্স খুঁজছি। যে এই ব্যাপারটা নিয়ে নিউজ করতে পারবে। আমি চাই নিউজটা রাতারাতি ভাইরাল হোক। এই শম্পা, তোর আপুর দুলাভাই না সাংবাদিক?”

শম্পা রেগে বলল,” আপুর দুলাভাই না, আমার দুলাভাই। আপুর হাসব্যান্ড।”

উপস্থিত সবাই হেসে ফেলল। উষসী বলল,” মাই মিস্টেক। তোর দুলাভাই! তিনি কি এই ছবিগুলো নিয়ে নিউজ করতে পারবে?”

” আমি কথা বলে দেখব। তুই ছবিগুলো আমাকে দিয়ে রাখ।”

যুঁথি মনখারাপ করে বলল,” কাজটা কি ঠিক হচ্ছে উষু? ইয়ামিন ইব্রাহীম তোকে বিশ্বাস করেছিল বলেই তোর গাড়িতে উঠেছে। আর তুই এভাবে পেছন থেকে বেচারার পিঠে ছু’রি বসাবি?”

” লোকটা আমাদের কিভাবে অপমান করল ভুলে গেছিস? প্রথমে আমাদের বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি। দ্বিতীয়বার অস*ভ্যের মতো আমাকে কিস করেছে।”

যুঁথি মুখ গোঁজ করে বলল,” সবকিছুর পেছনেই তো লজিক ছিল। তুই কি অপরিচিত কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দিবি? আর সেকেন্ড কাজটা উনি করেছিলেন মাকে কষ্ট না দিয়ে বিয়ে ভাঙার জন্য৷ অবশ্য তোর জায়গায় যদি উনি আমাকে ভালোবাসি বলে কিস করতেন, আমি তো খুশিতে হার্ট এটাক করতাম।”

” এজন্যই তোকে করেনি।” প্রীতি টিপ্পনী কাটল। উষসী হেসে বলল,” এই ঘটনা ভাইরাল হলে ইয়ামিন ইব্রাহীমের তেমন ক্ষতি হবে না। বরং আমি একটু শান্তি পাবো। প্লিজ আমাকে এই শান্তিটা পেতে দে।”

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল তৃষ্ণা। মিষ্টি গলায় ডাকল,” এন্টস!”

প্রীতি নাক কুঁচকে শুধাল,” এন্টস জিনিসটা কি?”

উষসী বলল,” আমি শিখিয়েছি। খালামণি ডাকলে কেমন জানি বুড়ি বুড়ি লাগে নিজেকে। আর আন্টি ডাকটাও ঠিক পছন্দ নয় আমার। তাই স্মার্টলি এন্টস। এদিকে আয় বাবা। আমার কাছে বোস।”

তৃষ্ণা একদম উষসীর কোলের উপর উঠে বসল। উষসী বলল,” কিরে পোটলা তোকে চকলেট কে দিয়েছে?”

” পাপা। আমি পাপা-মাম্মামের ঘরে কি দেখেছি জানো?”

যুঁথি গালে হাত রেখে আদুরে গলায় বলল,” কি দেখেছো তুমি?”

তৃষ্ণার চোখে দুষ্টমি। ঠোঁট টিপে হেসে বলল,” পাপা মাম্মামকে পাপ্পি দিচ্ছিল। আমাকে দেখে পাপা ধমক দিয়ে বলেছে, এখানে কি? যাও! আমি চলে আসার ভাণ করে আবার উঁকি দিয়েছি। তখন দেখি পাপা মাম্মামকে জড়িয়ে ধরেছে আর.. ”

উষসী এই পর্যায় তৃষ্ণার মুখ চেপে ধরল। শম্পা উচ্চ গলায় বলল,” ওরে বিচ্ছুরে!”

” আর বলিস না৷ পাকনা হচ্ছে দিন দিন।”

তৃষ্ণা নিজের মুখ থেকে উষসীর হাত সরিয়ে বলল,” পাপা আমাকে বলেছে নক করে ঘরে ঢুকতে। আমি নক না করেই ঢুকেছিলাম।”

” কেন ঢুকেছিস? তোকে তো মা*রা উচিৎ। এজন্যই আপু এতো জলদি তোর রুম আলাদা করেছে। এখন বুঝলাম আমি।”

প্রীতি জিজ্ঞেস করল,” আচ্ছা তোদের না বিয়ের প্রোগ্রামে সুইজারল্যান্ড যাওয়ার কথা? কবে যাচ্ছিস?”

উষসীর উজ্জ্বল মুখ ম্লান হয়ে যায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,” যাওয়া হচ্ছে নারে।”

যুঁথি জানতে চায়,” কার বিয়ে?”

উষসী জবাব দেয়,” তৃষাণ ভাইয়ের সৎবোন, প্রিয়ন্তী আপু।”

যুঁথি বলল,” ও, উনার সাথে তো তোদের বেশ ভালো সম্পর্ক নারে। এই প্রথম আমি কোনো সৎ ভাই-বোনের মধ্যে এতো সুন্দর সম্পর্ক দেখেছি। ব্যাপারটা দারুণ! ”

উষসী গর্ব করে বলল,” আমার প্রিয়ন্তী আপু আর তৃষাণ ভাইয়া দু’জনেই খুব ভালো। তাদের মধ্যে মধুর সম্পর্ক থাকবে এটাই স্বাভাবিক।”

শম্পা বলল,” আচ্ছা তাহলে যাওয়া হচ্ছে না কেন? তুই না কত এক্সাইটেড ছিলি! শপিং-টপিং করলি।”

উষসী দুঃখ ভারাক্রান্ত গলায় বলল,”উষ্ণতা আপু প্রেগন্যান্ট। মায়ের শরীর ভালো নেই। তারা না গেলে আমি কিভাবে যাবো?”

মাঝখান থেকে তৃষ্ণা বলে উঠল,” দাদুন আর আহমেদ আঙ্কেল তো যাচ্ছে!”

” তোর দাদুন যাচ্ছে?”উষসী বেশ অবাক হলো।

” হুম। দাদুন তো ফুপসের মা। ফুপস কি নিজের মাকে ছাড়া বিয়ে করবে? তুমি কি নানুকে ছাড়া বিয়ে করবে?”

এই কথা উষসীর মাথায় আগে আসেনি। আর কেউ না গেলেও ডোনা অবশ্যই যাবেন। আর প্রিয়ন্তী যেমন মা ভক্ত মেয়ে… সে নিশ্চয়ই মাকে ছাড়া বিয়ে করবে না।

প্রীতি চোখ কুঁচকে বলল,” এই ফুপসটা কি জিনিস?”

তৃষ্ণা বলল,” প্রিয়ন্তী ফুপিকে আমি ফুপস ডাকি৷ এটা আমার এন্টস, ওটা আমার ফুপস।”

তার বলার ধর‍ণ দেখে সবাই হেসে ফেলল। উষসী রেগে বলল,” তাহলে আমি কি দোষ করেছি? আমিও যেতে চাই।”

তৃষ্ণা গম্ভীরমুখে বলল,” তুমি যেতে পারবে না। পাপা বলেছে, সুন্দরী মেয়েদের গার্ডিয়ান ছাড়া বিদেশ-বিভুঁইয়ে পাঠাতে হয় না। ”

সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। যুঁথি আদর করে তার গাল টিপে বলল,” গাব্বু একটা!”

এতে তৃষ্ণা এমনভাবে তাকাল যেন খুব বিরক্ত হয়েছে। উষসী আকুতি নিয়ে বলল,” প্লিজ, আমার লক্ষী পোটলাটা, তোর পাপাকে রাজি করা। যাতে আমাকেও যেতে দেয়।”

তৃষ্ণা এতোক্ষণ উষসীর কোলে শুয়েছিল। এবার উঠে হাত ভাঁজ করে বলল,” ওকে। কিন্তু কাজটা করলে আমি কি পাবো?”

যুঁথি চোখ বড় করে বলল,” বাপরে! এতো দেখছি পুরাই চালবাজ। আগেই নিজের হিসাব ক্লিয়ার করে নিচ্ছে।”

উষসী মুচকি হেসে বলল,”যদি তোর পাপাকে রাজি করাতে পারিস তাহলে আমার ফোনে দুইঘণ্টা গেইমস খেলতে দিবো।”

তৃষ্ণা ঠোঁট উল্টে বলল,” মাত্র দুইঘণ্টা?”

উষসী তার গাল টিপে বলল,” ঠিকাছে তিনঘণ্টা খেলিস টাব্বু।”

“শুধু গেইমস খেলতে দিলে হবে না। আমাকেও সুইজারল্যান্ড নিতে হবে।”

উষসীর পিলে চমকে উঠল,” পাগল! এতোদূর তোর মা তোকে যেতে দিবে?”

” দিবে না কারণ আমাকে ওখানে দেখার কেউ নেই। আমার তিনবেলা খাবার খেতে মনে থাকে না। কেউ গল্প না শুনালে ঘুম আসে না। মাম্মাম না থাকলে এসব কে করবে?”

” সেটাই তো। কে করবে?”

” তুমি। তুমি যদি বলো এইসব তুমি করবে তাহলে পাপাও তোমাকে যেতে দিবে। মানে আমি না গেলে তোমারও যাওয়া হচ্ছে না। যদি আমি যাই… তাহলে আমাকে দেখে রাখার জন্য আয়া হিসেবে তুমিও যেতে পারবে। পাপাকে রাজি করানো ইজি হবে। বলো, ডিল ফাইনাল?”

তৃষ্ণা হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। তার ভাব দেখে মনে হলো কোনো অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী গাম্ভীর্য নিয়ে ক্লায়েন্টের সাথে লেনদেন করছে। উষসী তার যুক্তি শুনে নির্বাক হয়ে বলল,” বাপের মতো বিজনেস শিখেছিস তাই না? প্রফিট ছাড়া কিচ্ছু বুঝিস না। পোটলা একটা!”

” ডিল তাহলে ফাইনাল।”

এই কথা বলেই তৃষ্ণা চকলেট খেতে খেতে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। এইটুকু ছেলের এটিটিউড দেখে সবাই হতবাক হয়ে হাসতে থাকে। বোঝাই যায়, উষসীর বান্ধবীরা তৃষ্ণার কথা-বার্তায় বেশ মজা পেয়েছে।

আহমেদ তৃষাণের খুব বিশ্বস্ত সহচর। সে প্রায় দশবছর ধরে তৃষাণের সঙ্গে আছে। ব্যবসার কাজে বিদেশ গেলে তৃষাণ প্রায়ই আহমেদের কাছে পরিবারের দায়িত্ব দিয়ে যায়। সে আহমেদকে পুরোপুরি ভরসা করে। তাই নিজের মাকে তার সঙ্গে পাঠাতেও দ্বিধান্বিত হয়নি। এদিকে তৃষ্ণা বায়না করছে সেও যাবে৷ এই কথা শুনে তৃষাণ প্রথমেই ছেলেকে একটা ধমক দিল।

তৃষ্ণা এই নিয়ে মনখারাপ করে বসে আছে। উষ্ণতাও রেগে গেছে। অবশেষে হার মেনে তৃষাণ ছেলেকে বোঝাতে এলো,” বাবা, তুমি এতোদূর মাম্মামকে ছাড়া কিভাবে থাকবে? দাদুনের বয়স হয়েছে। সে কি তোমার পেছনে দৌড়াতে পারবে? জার্নি করেই তো টায়ার্ড হয়ে যাবে। এবার দাদুন একা যাক। আমরা গতবারের মতো নেক্সট টাইম সবাই একসাথে ট্যুরে যাবো।”

তৃষ্ণা নরম গলায় বলল,” তাহলে আমার সাথে এন্টসকেও যেতে বলো।”

” এন্টস কেন যাবে?”

” আমাকে দেখে রাখার জন্য যাবে।”

তৃষাণ রেগে যেতে নিচ্ছিল৷ কিন্তু উষ্ণতার ছেলের বুদ্ধি খুব পছন্দ হলো। সে বলল,” এটা ভালো আইডিয়া। উষু তো যাওয়ার জন্য কত শপিং-টপিং করল। মাঝখান থেকে যেতে পারবে না বলে মেয়েটার মনখারাপ। কাউকে বলতেও পারছে না।”

তৃষাণ রুক্ষ গলায় বলল,” আমি গেলেও একটা কথা ছিল। আহমেদের সাথে ওকে কিভাবে পাঠাই?”

” তোমার মা যেতে পারলে আমার বোনের যেতে অসুবিধা কোথায়? ফ্লাইটের টিকিট নিয়ে ভয় পাচ্ছো নাকি? সমস্যা নেই। টিকিটের টাকা আমি দিবো।”

এইবার তৃষাণ পর্যদুস্ত। সে সব সহ্য করতে পারবে কিন্তু কৃপণতার তকমা সহ্য করতে পারবে না। নিমরাজি হয়ে বলল,” সবার টিকিটের টাকা আমিই দিবো৷ উষু যেতে চাইলে যাবে। কিন্তু ছেলের কিছু হলে পরে আমাকে দোষ দিতে পারবে না।”

” আমার ছেলের কিছুই হবে না। সবাই ওকে দেখে রাখবে। তাছাড়া আমার লায়ন একাই একশো। তাই না বাবা?”

তৃষ্ণা খুশি হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” ইউ আর দ্যা বেস্ট মাম্মাম।”

ফাবিয়াহ, মেয়েটা শান্ত হলেও বেশ গুছিয়ে কথা বলে। বুদ্ধিমতীও বটে। তবুও ইয়ামিন তার প্রতি আগ্রহ অনুভব করছে না। মেয়েটিকে জানার বা চেনার কোনো উৎসাহও তার মধ্যে নেই। ফাবিয়াহ দেয়ালের দিকে চেয়ে বলল,” দারুণ একটা পেইন্টিং। আচ্ছা, আপনি কি মানুষকে সামনে বসিয়ে তার পোর্ট্রেট আঁকেন?”

ইয়ামিন একটু অপ্রস্তুত হলো। সে ‘হ্যাঁ’ বললে যদি ফাবিয়াহ নিজের পোর্ট্রেট এঁকে দেওয়ার অনুরোধ করে? আপাতত সেই ইচ্ছা তার নেই। তাই বলল,” না, এখনও এতোটা দক্ষ হইনি।”

ফাবিয়াহ ইয়ামিনের কথা শুনে অবাক হয়। যে এতো সুন্দর পেইন্টিং আঁকতে পারে সে দক্ষ নয়? এটা কেমন কথা? ইয়ামিন যে মিথ্যে বলছে তা চট করেই বুঝে যায় ফাবিয়াহ। কিন্তু সে মিথ্যা কেন বলছে সেটা বুঝতে পারে না৷ ছেলেটার মধ্যে রহস্য আছে। তাকে পুরোপুরি বুঝতে হয়তো সময় লাগবে খুব।

ফাবিয়াহ বলল,” কখনও ভাবিনি আপনাকে সামনা-সামনি দেখব। আপনার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হবে… পুরো ব্যাপারটাই স্বপ্নের মতো লাগছে।”

ইয়ামিন মৃদু হাসল। ফাবিয়াহ ভায়োলিনের দিকে চেয়ে বলল,” আপনি ভায়োলিনটা খুব চমৎকার বাজান৷ একটু শোনাবেন, প্লিজ! আমার শুনতে ইচ্ছে করছে।”

ইয়ামিন ভদ্রতার খাতিরে ভায়োলিন হাতে নিল। ইচ্ছে নেই তবুও বিরস মুখে বাজাতে লাগল। ফাবিয়াহ মুগ্ধ চোখে দেখছে৷ ভায়োলিনের সুরের চেয়েও সে বেশি বিমোহিত হচ্ছে ইয়ামিনে। মানুষ এতো সুন্দর হয়? মিসেস শিমলা ঘরে ঢুকলেন। তাঁর হাতে মোবাইল। তিনি ফায়ার দিকে চেয়ে বললেন,” তোমার জন্য ডেজার্ট করেছি। এসো খাবে।”

ফায়া ইয়ামিনের দিকে চেয়ে বলল,” বাকিটা পরে শুনব।”

ইয়ামিন আন্তরিক হেসে সম্মতি জানাল। মেয়েটা বের হতেই শিমলা মোবাইল এগিয়ে দিয়ে বললেন,” প্রিয় লাইনে আছে। কথা বল।”

” আরে, মা…”

ছেলেকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কেটে পড়লেন শিমলা। বাধ্য হয়ে ইয়ামিনকে ফোন কানে নিতে হলো,” হ্যালো, আপু!”

ওইপাশ থেকে প্রিয়ন্তী চেঁচিয়ে উঠল,” তোর আপু ম-রে গেছে, ইডিয়েট! চাচীর কাছে এসব কি শুনলাম? তুই নাকি আমার বিয়েতে আসবি না? এটা কেমন কথা? তুই না এলে তো বিয়েই হবে না! গান কে গাইবে শুনি? ভায়োলিন কে বাজাবে?”

ইয়ামিন মনমরা কণ্ঠে বলল,” শুনেছি তোমার ফিয়্যান্সে মিউজিশিয়ান। সে না হয় ভায়োলিন বাজাবে।”

” একটা চড় দিবো৷ আমার বর যতই মিউজিশিয়ান হোক। সে নিজের বিয়েতে বসে ভায়োলিন বাজাবে নাকি, ছাগল! আমি শ্বশুরবাড়িতে কত বড়মুখ করে তোর প্রশংসা করেছি। তুই না এলে আমার মান-সম্মান কিছু থাকবে? দ্যাখ তুই আসবি ব্যস। আমি কোনো এক্সকিউজ শুনতে চাই না।”

ইয়ামিন ভাবলেশহীন গলায় বলল,” আমি আসতে পারব না আপু। প্লিজ ডন্ট ইনসিস্ট। তাছাড়া নেক্সট মান্থ আমার শিডিউল অনেক বিজি।”

” খুব বিজি হয়েছিস তাই না? আমাকে ব্যস্ততা দেখাস? তোর বিজি শিডিউল দিয়ে আমি কি করব? আর এতোবড় সিংগার হয়ে নাম কামিয়ে লাভটা কি যদি নিজের কাজিনের বিয়েতেই গান গাইতে না পারিস?”

ইয়ামিন দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। সে তার সমস্যাটা প্রিয়ন্তীকে বোঝাতে পারছে না। প্রিয়ন্তীই হঠাৎ গলা নরম করে বলল,” তুই কি উষ্ণতার জন্য আসতে চাইছিস না?”

বিব্রত হলো ইয়ামিন। অস্বস্তি নিয়ে বলল,” সেরকম কিছু না।”

প্রিয়ন্তী শান্ত গলায় বলল,” উষ্ণতা আসছে না প্রোগ্রামে। সে অসুস্থ। তৃষাণও আসছে না। তুই নিশ্চিন্তে চলে আয়।”

ইয়ামিন চুপ রইল। এই কথার পর সাথে সাথে রাজি হওয়া যায় না। তাহলে প্রিয়ন্তী বুঝে ফেলবে যে আসল সমস্যা এটাই ছিল।

” কিরে, আসবি তো?”

ইয়ামিন ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,” দেখি…”

” দেখি না। তোকে আসতেই হবে। তুই হচ্ছিস চীফ গেস্ট। তোকে ছাড়া প্রোগ্রাম জমবেই না!”

চলবে