#উষ্ণ_আঁচে_ভালোবাসা (১১)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
তাহমিনা হকের জরুরি তলবে ছুটে এসেছে পিয়া। কি জন্য ডেকেছে কেন ডেকেছে কিছুই এখনো জানতে পারেনি সে। সেই কখন থেকে ভদ্রমহিলা তার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। পলক অব্দি ফেলছেন না। অস্বস্তি হচ্ছে পিয়ার। কিঞ্চিৎ ভয়ও হচ্ছে। সে কি কোনো ভুল করছে? তার কি রোজ রোজ ফোন করে ভদ্রমহিলার খোঁজ খবর নেওয়ার দরকার ছিল? জড়োসড়ো হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার দৃষ্টি নামিয়ে নিচ্ছে। মনে মনে পণ করল এবার থেকে তিন চার দিন পর পর না প্রতিদিন একবার হলেও কল দিবে। সময় গড়ায়! এক মিনিট! দুই মিনিট!
আকস্মিক পিয়ার হাতটা মুঠোবন্দি করে নিলেন তিনি। আমতা আমতা করে বলেন,
‘তোমাকে আমার কিছু বলার আছে। কিন্তু কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না। আর তুমিও হয়তো ব্যাপারটা সহজভাবে নিবে না।’
পিয়ার জড়তা কাটে। তাহমিনা হককে আশ্বস্ত করে বলে,
‘এতো ভাবছেন কেন আ,,,’
আন্টি বলতে গিয়ে থেমে যায় পিয়া। তাহমিনা হক যেন ব্যাপারটা বুঝতে পারেন। ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে রইলেন পিয়ার দিকে। পিয়া ভ্যাবলাকান্তের মতো হেসে ফের বলে,
‘আপনি বলুন। কোনো সমস্যা হয়েছে কি?’
তাহমিনা হক দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। হতাশ হয়ে বলেন,
‘বিরাট সমস্যা। কিন্তু সেই সমস্যার সমাধান তোমার হাতে।’
পিয়া বিস্মিত হয়। চোখ বড় বড় করে অবাক স্বরে জানতে চায়,
‘সমস্যার সমাধান আমার হাতে?’
‘হুম তোমার হাতে।’
পিয়া চোখের পলক ফেলে আশ্বস্ত করতেই তাহমিনা হক বলেন,
‘এহতেশাম তোমাকে পছন্দ করে না।’
পিয়া প্রশ্নসূচক চাহনিতে চাইতে তিনি আবার বলেন,
‘এহতেশাম মানে তোমার শ্বশুর। তানভীরের বাবা। তোমাকে পছন্দ করে না এমন না। ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিতে পারছে না এই আর কি।”
পিলে চমকে উঠে পিয়ার। পছন্দ করে না শুনতেই মুখটা মলিন হয়ে গেলো তার। ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিতে পারছে এটা ভাবতেই বুক ভেঙে আসে। তবে কি শ্বশুরের স্নেহ সে কখনো পাবে না?
‘কি ভাবছো?’
তাহমিনা হক প্রশ্নটা করতেই বেদনার্ত মুখে ফিচেল হাসল সে।
‘কিছু না।’
‘আমরা সবাই কিন্তু পছন্দ করি তোমাকে। ভালোও বাসি।
পিয়া হাসতে চেয়েও পারল না। মনখারাপের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে গেলো সেই হাসি। মুখ জুড়ে দুঃখের ছাপ। আমরা মানুষ হয়তো এমনই। পুরো পৃথিবীর মানুষ আমাদের ভালো বাসলেও পৃথিবীর কোণায় থাকা কেউ একজন যদি আমাদের পছন্দ না করে সেই দুঃখ আমাদের আজন্ম থেকে যায়। বার বার মনে প্রশ্ন জাগে কেন পছন্দ করে না। একটু পছন্দ করলে কি হতো?
‘একজন পছন্দ করে না শুনে মুখটা গম্ভীর করে ফেললে আর আমরা এতোগুলো মানুষ যে তোমাকে ভালোবাসি পছন্দ করি সেটা কিছু না? হিসেব মতো তো এটা শোনার পরে তোমার লাফিয়ে লাফিয়ে হাসার কথা। কারণ আমরা সংখ্যায় বেশি।’
ভদ্রমহিলা যে বেশ রসিক তা আর বুঝতে বাকি নেই পিয়ার।
তাহমিনা হক বিপরীত পাশ থেকে উঠে পিয়ার গা ঘেঁষে বসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দেন সস্নেহে। আদুরে গলায় বলেন,
‘মন খারাপ হচ্ছে?’
পিয়া এপাশ ওপাশ মাথা দুলায়।
‘উহ্! মন খারাপ হচ্ছে আমি জানি। সব মেয়েই চায় তার শ্বশুরবাড়ির সবাই তাকে পছন্দ করুক ভালোবাসুক।’
চেপে রাখা মন খারাপেরা দলবেঁধে নোনাজল হয়ে হানা দেয় চোখে। পলক ফেললেই স্পর্শ করবে চিবুক। অশ্রুসিক্ত চোখে তাহমিনা হকের দিকে তাকাতেই তিনি পরম মমতায় জড়িয়ে নিলেন বুকে।
‘বোকা মেয়ে কাঁদতে হয় না। কাঁদলে কোনোকিছুরই সমাধান হয় না। পুরুষ ঘটিত ব্যাপারগুলো হ্যান্ডেল করতে হয় স্মার্টলি। যেন সাপও মরে আর লাঠিও না ভাঙ্গে।’
দুজন নড়েচড়ে বসে। তাহমিনা হক পিয়ার গালে আলতো করে হাত রেখে পুনরায় বলেন,
‘দেখো এগুলো আমি তোমাকে না বললেও পারতাম। আমি চাই তুমি মানুষটার মন জয় করো। আমি এটাও চাই আমার ছেলে যাকে ভালোবাসে সে আমার ছেলের বাবার স্নেহের মানুষ হউক। তার মনে তোমার জন্য মায়া তৈরি করো। কি জানো তো মায়া শত্রুর ক্রোধানলকেও প্রশমিত করে। আবার এটা ভেবো না তোমার শ্বশুর বদমেজাজি মানুষ। চিল্লাচিল্লি করবে, বকাঝকা করবে বা তেড়ে আসবে মারতে। মানুষটা ভালো, সহজ আর সরল। তবে একরোখা। নিজে যা ভাবে মনে করে তাই ঠিক।’
পিয়া উল্টো হাতে চোখের পানি মুছে নিলো। নাক টেনে প্রশ্ন করে, ‘কিভাবে?’
তাহমিনা হক বাঁকা হাসলেন।
‘পুরুষ মানুষকে হাতের মুঠোয় রাখতে হয় ভালোবাসা দিয়ে আর নয়তো চ্যালা কাঠ দিয়ে পিঠের ছাল তুলে। আজ থেকে তুমি তাই করবে যা আমি বলবো।’
___________________
কোম্পানির বার্ষিক হিসাবে গড়মিল। কোনোভাবেই টাকার অংক মিলছে না। কয়েক কোটি টাকার হিসাব উল্লেখ নেই ফাইলে। বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়েছে এখনো গোলাম মোস্তফা অফিসে এসে পৌঁছায়নি। জামাল এহতেশাম বার কয়েক ফোন করেছেন। ব্যস্ত শোনাচ্ছে। বিরক্ত হচ্ছেন তিনি। এতোটা খামখেয়ালি হলে চলে? কপালে হাত ঠেকিয়ে চেয়ারে হেলান দিলেন তিনি। গোলাম মোস্তফা আসা অব্দি কোনো কিছুরই সুরাহা হবে না।
জামাল এহতেশামের ফোন বাজতে থাকে। ফোনের শব্দ কান অব্দি পৌঁছাচ্ছে না উনার। একবার! দুইবার! তিনবার! চতুর্থ বার রিং হওয়ার সাথে সাথে হুড়মুড়িয়ে উঠেন তিনি। গা কাঁপছে উনার। কখন যে চোখ লেগে গিয়েছেন টেরই পাননি তিনি। সামনে থাকা পানির গ্লাস কয়েক সেকেন্ড খালি করে ফেলেন। ফোন রিসিভ করতেই কানে ঠেকে কর্কশ শব্দ।
‘এই কার সঙ্গে কথা বলো তুমি? একবার বলে ওয়েটিং আবার কল রিসিভ করো না। নতুন সংসার পেতেছো? বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়েছে?’
বিরক্তিতে কপাল কুঁচকান জামাল এহতেশাম। নাক উঁচিয়ে চাপা স্বরে বলেন, ‘উফ থামবে তুমি? কিসব আবোলতাবোল বলে যাচ্ছো?’
তেঁতে উঠেন তাহমিনা হক। দাঁত কিড়মিড় করেন তিনি। ‘আমি আবোলতাবোল বলছি? তাহলে এতক্ষণ কার সঙ্গে কথা বলছিলে? এরপরই বা কল রিসিভ করলে না কেন? আমি না বলেছি দুনিয়া উল্টে গেলেও ঝুলতে ঝুলতে তুমি আমার কল রিসিভ করবে।’
তপ্ত শ্বাস ফেলেন ভদ্রলোক। এই করে করে এতোগুলো বছর কাটিয়ে দিলেন তিনি। পর্যাপ্ত সময় না দেওয়ার কারণে তাহমিনা হক এমন হুটহাট রেগে যান। জামাল এহতেশাম জানেন উনার স্ত্রী উনাকে প্রচন্ড রকমের ভালোবাসেন। ভালোবাসার টানেই এতোগুলো বছর একসাথে সংসার করে গিয়েছেন দু’জন। কি সুন্দর একা হাতে একটা সংসার সামলে দু’টো ছেলে মেয়েকে বড় করেছেন। তিনি তো কেবল টাকা ঢেলেছেন। আর এইখানটায় দূর্বল তিনি। সবার সাথে নিজের রাগ জাহির করতে পারলেও নিজের স্ত্রীর সাথে কখনো পারেন না। স্ত্রী রেগে গেলে তিনি চুপ হয়ে যান।
‘ছেলেমানুষী বন্ধ করো মিনা। এমনিতেই টেনশনে আছি।’
‘টেনশনে? সেখানে আবার কখন গেলে? আমাকে তো বললে না।’ রগড় গলায় বললেন তাহমিনা হক। বলেই ঠোঁট চেপে হাসলেন। মাঝে মাঝে মানুষটাকে জ্বালাতে উনার ভীষণ মজা লাগে।
জামাল এহতেশাম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, ‘মজা করা শেষ হয়েছে? কি জন্য ফোন করেছো সেটা বলো। এমনিতেই অফিসে অনেক ঝামেলায় আছি।’
নড়েচড়ে বসলেন তাহমিনা হক কাঠ কাঠ গলায় বলেন, ‘সে তুমি ঝামেলায় থাকো আর মুসিবতে থাকো আমার কিছু যায় আসে না। তোমার সাথে একজন দেখা করতে যাবে।’
ভ্রু কুঁচকান জামাল এহতেশাম। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বলেন, ‘এই অসময় কে আসবে?’
‘সে যখন আসবেক্ষন তখন দেখে নিও।’
‘এখন অফিসে কারো আসার দরকার নেই। ঝামেলা আছে। মানা করে দাও।’ গম্ভীর কণ্ঠে বলেন জামাল এহতেশাম।
তেঁতে উঠেন তাহমিনা হক। কটমট করে বলেন,
‘আমি যখন বলেছি সে যাবে মানে যাবেই। তুমি উল্টোসিধা কিছু করলেই তার ব্যবস্থা আমি নিবো।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি। চুপ করে রইলেন। তাহমিনা হক পুনরায় বলেন, ‘এখনি আসবে তোমার কেবিনে।’
জামাল এহতেশামের কপালে ভাঁজ পড়ল।
‘সোজা আমার কেবিনে আসবে মানে?’
‘আমি ব্যবস্থা করেছি। তোমার বউ হিসেবে অফিসে আমারও একটু আধটু পাওয়ার আছে।’
তাহমিনা হকের কথার মাঝেই দরজার ওপাশ থেকে ভেসে এলো এক মেয়েলি কন্ঠস্বর, ‘আসবো?’
#চলবে
#উষ্ণ_আঁচে_ভালোবাসা (১২)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
অপরিচিত গলার আওয়াজে কপালে ভাঁজ পড়ে জামাল এহতেশামের।
‘কোনো মেয়েকে কি পাঠিয়েছো তুমি?’
‘হুম।’
‘কাকে পাঠিয়েছো মিনা?’ সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করেন জামাল এহতেশাম।
তাহমিনা হক স্বাভাবিক কন্ঠে জবাব দেন, ‘নিজেই দেখে নাও। আমি রাখছি এখন।’
চট করে কল কে’টে দিলেন তাহমিনা হক। জামাল এহতেশাম গলার টাই ঠিক করে নড়েচড়ে বসলেন। গম্ভীর স্বরে জবাব দিলেন, ‘কাম ইন।’
মেয়েটিকে দেখার জন্য তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছেন জামাল এহতেশাম । যেই না দরজা ঠেলে মেয়েটি ভেতরে পা দিল চোখের তীক্ষ্ণতা রূপ নেয় বিস্ময়ে। চমকে উঠলেন তিনি। মুহুর্তে সামলে নিলেন নিজেকে। পাছে মেয়েটি বুঝে যায় মুখ ডুবালেন আবারও সেই ফাইলে।
‘আসসালামু আলাইকুম।’
দৃষ্টি স্থির হয়ে যায় জামাল এহতেশামের। না চাইতেও মেয়েটির মুখের দিকে তাকালেন তিনি। রাশভারী গলায় আস্তে করে জবাব দিলেন, ‘ওয়ালাইকুমুস সালাম।’ ফের মুখ ডুবালেন নীল রঙের সেই ফাইলের পাতায়। চোখ বুলিয়ে উল্টাতে লাগলেন একের পর পাতা।
মেয়েটি এখনো আগের জায়গায় দাঁড়ানো। আচমকাই বলে বসল, ‘কেমন আছেন বাবা?’
থমকালেন জামাল এহতেশাম। থেমে যায় হাত। আকাশ সমান বিস্ময় নিয়ে পুনরায় তাকালেন তিনি। চোখে মুখে কোনো জড়তা নেই। আর না আছে গলার স্বরে। কি নিঃসঙ্কোচ জিজ্ঞাসা। যেন মেয়ে তার বাবাকে ভালোমন্দের খবর জিজ্ঞেস করছে। মায়াবি গড়নের মুখটার দিকে চেয়ে রইলেন নিষ্পলক।
‘বসতে বলবেন না?’
সম্বিত ফিরে পান তিনি। প্রশ্ন শুনে ভরকে গেলেন খানিকটা। তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। গম্ভীর স্বরে বলেন, ‘ বসো।’
এক গাল হেসে চেয়ার টেনে বসল সে।
‘বললেন না তো কেমন আছেন।’
জামাল এহতেশাম না চাইতেও জবাব দেন, ‘ভালো।’
কক্ষ জুড়ে পিনপতন নীরবতা। এসির ঠান্ডা বাতাসে শিরশিরিয়ে ওঠে পিয়ার শরীর। ওড়না ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নেয় সে। ব্যস্ততার মিছে অভিনয় করেন জামাল এহতেশাম। আর আড়চোখে বার কয়েক পরখ করেন পিয়াকে।
পিয়া এদিক ওদিক নজর বুলিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পুরো কক্ষ দেখছে। দেখা শেষ হতেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করে সামনে। পলকহীন চোখে পর্যবেক্ষণ করছে জামাল এহতেশামকে।
আঁড়চোখে পিয়ার দিকে আরো একবার তাকাতে চোখাচোখি হয় দু’জনে। চোখাচোখি হতেই বিব্রত হন তিনি। তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি নামিয়ে নিলেন।
পিয়া প্রখর চোখে চেয়ে থেকে নৈঃশব্দ্যে হাসে।
‘আপনার নাকি পায়েস ভীষণ পছন্দ?’
আঁতকে উঠলেন জামাল এহতেশাম। পায়েসের নাম নিতেই থম মেরে গেলেন তিনি। বুকের ভেতরটায় হাহাকার করে উঠে। পিয়া প্রশ্নের জবাব দিলেন না।
‘দাদির হাতের পায়েস নাকি আপনি একটু বেশি ভালোবাসতেন? মা বলছিল সেদিন।’
জামাল এহতেশাম চোখ বুঁজে রইলেন। মুহুর্তেই দৃশ্যপটে ভাসমান হয় সোনালি অতীত। কিশোর জামাল এহতেশামের সামনে বসা মাঝবয়েসী এক নারী। আটপৌড়ে শাড়ি পরে এক বাটি পায়েস হাতে নিয়ে একটু একটু করে মুখে তুলে দিচ্ছে উনার। বড়ই তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছেন তিনি।
ফেলে আসা দিন। যা আর চাইলেই ফিরে পাওয়া যাবে না। বুক ভেঙে আসে উনার। হাহাকার করে উঠে মন। কতদিন হয়ে গেলো মাকে দেখেন না তিনি। উহ্! কতদিন না কত বছর হয়ে গেলো মাকে দেখেন না তিনি। মায়ের সেই হাসিমাখা মুখ! উফ! আর ভাবতে পারছেন না। মায়ের জন্য বুকটা জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে।
পিয়া ব্যাগ থেকে ছোট সাইজের দুইটা বক্স বের করে। একটাতে পায়েস আরেকটাতে কুচি করে রাখা বাদাম আর খেঁজুর।
পিয়া পায়েসের উপর বাদাম কুচি আর খেঁজুর দিয়ে আরো আকর্ষণীয় করে তোলে। পায়েসের বক্সটা জামাল এহতেশামের দিকে এগিয়ে দিয়ে আপন মনে বলতে থাকে,
‘আপনার এক মা আল্লাহর মেহমান হয়ে গিয়েছে তো কি হয়েছে? আল্লাহই আবার আরেকটা মাকে পাঠিয়েছে। এখন খেয়ে বলুন কেমন হয়েছে।’
স্তব্ধ, হতভম্ব জামাল এহতেশাম। চমকে উঠেন তিনি। বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটার চোখ জোড়ায় এক আকাশসম বিস্ময়। পলক অব্দি ফেলছেন না।
অতিবাহিত হয় কয়েক মিনিট। জামাল এহতেশাম খাচ্ছে না বলে পিয়া পুনরায় বলে, ‘ জানি আপনার মায়ের হাতের পায়েসের মতো স্বাদ হবে না। তবে আমি আমার বেস্ট টা দিয়ে চেষ্টা করেছি।’
জামাল এহতেশাম অনুভূতিহীন। শেষ কবে তিনি পায়েস খেয়েছেন ঠিক মনে করতে পড়ছেন না তিনি। মায়ের মৃত্যুর পর তেমন একটা খেতেন না। আর ডায়াবেটিস হওয়ার পর তো একেবারে ছেড়েই দিয়েছেন। পুরোনো স্মৃতিগুলো মানসপটে ভাসছে বারংবার। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি। অস্পষ্ট বলে উঠেন, ‘কেন যে বড় হতে চাইতাম। সময় ওখানেই থেমে যেত। আমিও মায়ের সেই আদুরে খোকাটি রইতাম।’
পায়েস তখনো মুখে তোলেননি জামাল এহতেশাম। পিয়ার মুখটা মলিন হয়ে যায় মুহুর্তেই। কতটা সাহস সঞ্চার করে শ্বশুরের সামনে সাবলীলভাবে কথা বলছে কেবল ওই জানে। সমস্ত আশার আলো নিভে গেলো। মনোবল হয়ে গেলো দূর্বল। ফিচেল হাসলো সে। ঝাপসা হয় চোখ। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে উঠলো,
‘আমি না হয় আপনার অপছন্দের হতে পারি পায়েস তো কোনো দোষ করেনি। ভয় পাবেন না। কোনো কিছু মেশাইনি। তবে চিনি দিয়েছি অল্প পরিমাণে। আপনার ডায়াবেটিস কিনা।’
পিলে চমকে উঠে জামাল এহতেশাম। অপছন্দের কথাটা শুনে ‘থ’ হয়ে গেলেন তিনি। স্তম্ভিত লোচনে চেয়ে রইলেন পিয়ার মলিন মুখটার দিকে।
‘একটু চেখে দেখবেন না?’
কি নিদারুন অনুরোধ। ফেলতে পারলেন না তিনি। তপ্ত শ্বাস এক চামচ পায়েস মুখে পুরে নিলেন। পরক্ষণেই বুঝতে পারলেন আসলেই চিনি কম দিয়েছে। মায়ের হাতের সেই স্বাদ পাওয়া না গেলেও মন্দও হয়নি। আনাড়ি হাত যেদিন পাকা হবে হয়তো সেদিন সেই স্বাদ পাওয়া যাবে।
জামাল এহতেশাম খাওয়া বড্ড তৃপ্তি নিয়ে দেখল পিয়া। খাওয়া শেষ হতেই বিশ্বজয়ের হাসি হাসল সে। মিশনের প্রথম ধাপ সাকসেসফুলি কমপ্লিট। খালি বক্স মুখ আটকে ব্যাগে নিয়ে নিল সে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ছেলের বউ হিসেবে না হয় আমাকে মেনে নাই নিলেন মা হিসেবে কি ফেলে দিতে পারবেন? আমি না হয় মায়ের দাবি নিয়ে মাঝে সাঝে আসলাম আপনার কাছে। ছেলের বউ হওয়ার পরীক্ষায় পাশ হওয়ার আগে না হয় আগে আপনার মা হয়ে উঠলাম।’
বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন তিনি। আশ্চর্যান্বিত চোখে দেখলেন পিয়া চলে যাওয়া। বিড়বিড় করে আওড়ালেন, ‘ঘরে জায়গা করে নেওয়ার জন্য মনের দূর্বল জায়গাটায় করাঘাত করলে তুমি। দেখি মন গলানোর জন্য কি কি করতে পারো।’
তাহমিনা হক ভয়ে চিন্তায় কোনো কাজে হাত দিতে পারছেন না। রুম জুড়ে পায়চারি করছেন সেই কখন থেকে। মেয়েটা ঠিকঠাক কথা বলতে পারল কিনা। নাকি এহতেশাম দেখেই রাগারাগি করছে। ভাবতেই হাত পা ঠান্ডা আসে উনার। তখন কল না কেটে হোল্ডে থাকতেন ভালো হতো৷ এতো টেনশন করার প্রয়োজন হতো না। কে কি বলেছে না বলেছে সবই শুনতে পেতেন। এখন আর ভেবে কাজ নেই। এখন কেবল অপেক্ষা করছেন পিয়ার একটা কলের। ওখানে কি হয়েছে না হয়েছে যতক্ষণ না জানতে পারছেন ততক্ষণ পর্যন্ত শান্তি পাবেন না তিনি। মোবাইলে টুং করে আওয়াজ হতেই হুড়মুড় করে লুটিয়ে পড়েন তিনি। মেসেজ অপশনে ক্লিক করতেই নজরে এলো পরপর দু’টি মেসেজ।
‘মিশনের প্রথম ধাপ কমপ্লিট মা। বাঘের গুহা থেকে মাত্রই বের হলাম।’
‘ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিতে পারিনি এটা মেয়েটাকে না বললেই পারতে মিনা। হয়তো মেনে নিতে পারিনি কিন্তু অস্বীকারও তো করতে পারবো না। খুব খারাপ কাজ করেছো।’
মেসেজ দু’টি পড়ে মিটি মিটি হাসেন তিনি। আর বিড়বিড় করে আওড়ালেন, ‘শিকার টুপ গিলে নিয়েছে। এবার শুধু একটু একটু করে বাগে নিয়ে আসার পালা।’
_________________
আজ বহুদিন পর মুখোমুখি হয়েছে পিয়া আর তানভীর। মোবাইলে প্রণয়ালাপ হলেও সামনাসামনি দেখা হয় না বেশ অনেকদিন হয়।
ক্লান্ত তানভীর। অফিসের কাজ শেষ হতেই ছুটে এসেছে প্রিয়তমাকে একটা পলক দেখার জন্য। অতৃপ্ত মনকে তৃপ্ত করতে। এলোমেলো হয়ে থাকা মনমস্তিষ্ককে একটু স্বস্তি দিতে।
তানভীর কফির কাপে চুমুক দিয়ে চোখ বুঁজে রইলো। তার পরিশ্রান্ত কন্ঠ দিয়ে নিঃসৃত হয়, ‘ কফিতে চুমুক নিবন্ত শরীর তৃপ্ত। সামনে বসা রমনীকে দেখে পল্লবিত চোখ শান্ত।’
চোখ মেলে তাকায় পিয়ার দিকে। ভ্রু নাচিয়ে রগড় গলায় জানতে চায়, ‘কি হালচাল ম্যাম? দিনকাল কেমন যাচ্ছে?’
অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে পিয়া। দাঁত কিড়মিড় করে ফিরতি প্রশ্ন করে,
‘আপনি সেদিন বলেছিলেন যেদিন আমাদের সামনাসামনি দেখা হবে তখন ওই মেয়ের সম্পর্কে বলবেন। আমি এখন জানতে চাই ওই মেয়ে কে? সে আপনার হাত এভাবে জড়িয়ে ধরার এতবড় সাহস কোথায় পেল?’
তানভীর আবারও কফির কাপে চুমুক দিল। শান্ত, স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিল, ‘আমার ফিয়েন্সে।’
#চলবে