উষ্ণ আচেঁ ভালোবাসা পর্ব-১০

0
2

#উষ্ণ_আচেঁ_ভালোবাসা (১০)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

সমস্ত কঠোরতা রূপ নেয় বিষাদে। তবে পিয়ার ধারনাই সত্যি হলো। এভাবে ঠকালো মানুষটা? দুঃখরা স্পর্শ করে আসমান। ফুঁপিয়ে ওঠে সে। বিষাদের নোনাজল স্পর্শ করে চিবুক। নিরব কান্নার মাত্রা বাড়ে। অন্যহাতে শক্ত করে ধরে বারান্দার গ্রিল। কষ্ট হচ্ছে তার। ভীষণ রকম যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ বুকের উপর পাথর চাপা দিয়েছে। নিঃশ্বাস আটকে আসছে। কথা বলার শক্তি পায় না সে। আর না ফোনের ওপাশের মানুষটার সাথে কথা বাড়াতে চাইছে সে। কান থেকে মোবাইল নামাতে যাবে তার আগেই শুনতে পেল,

‘এটাই শুনতে চেয়েছিলে তুমি?’

প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে গেল পিয়া। অচেতন মনেই পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘মানে?’ হেঁচকি তখনও থামেনি।

শহর থেকে খানিক দূরেই ছিল তানভীর। অফিসের নতুন প্রজেক্টের জন্য। একের পর এক কল করেও যখন পিয়াকে পাওয়া যাচ্ছিল না। ভয়ে টেনশনে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে তানভীরের। এক মুহুর্তও দেরি করেনি সে। রাতের গভীরতা না দেখেই বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। মন বলছিল কোনো বিপদ হয়েছে। তার এক্ষুনি যাওয়া প্রয়োজন। নয়তো কোনো অঘটন ঘটে যাবে।

মাঝরাস্তায় এসে অস্থিরতা কেবল বাড়তে থাকে বুকের ভেতর। সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিল না। হাত কাঁপছিল। বুক ধড়ফড় করছিল। তাই বাইক থামিয়ে শেষ চেষ্টা করে অশান্ত মনকে একটু শান্ত করতে চেয়েছিল। বার বার আল্লাহ কে ডাকছিল। যেন এবার কলটা রিসিভ হয়। মেয়েটার যেন কিছু না হয়। তার ধারণা যেন ভুল হয়। আল্লাহ তার ডাক শুনেছে। একটু পাগলামি করছে তাতে কি? সুস্থ তো আছে। কোনো বিপদ তো হয়নি।

রাস্তার দুইপাশে অনাবাদি জমি। তার উপরে খোলা আকাশ। সেই আকাশপানে চেয়ে ধ্যানমগ্ন হয়ে পিয়ার নিরব কান্না উপভোগ করছে তানভীর। কান্না উপভোগ করার বিষয় নয়। তারপরও নিজের প্রিয়তমার কান্নার নিনাদ তার হৃদয়কে পুলকিত করছে। ফুঁপিয়ে ওঠা কানে আসলেই শিহরণ বয়ে যাচ্ছে সারা দেহে। কারো কান্নাও মানুষকে এতোটা সুখ দেয়? এতোটা শান্তি দেয়? কারো কান্নার শব্দে কি বক্ষপটে অনুভূতির তুমুল বর্ষণ হয়? জানা ছিল তানভীরের। কান্নার প্রতিটা নিস্বন জানান দিচ্ছে ফোনের ওপাশের মেয়েটা তাকে ভালোবাসে। অসম্ভব রকমের ভালোবাসে। তার প্রণয়ের বাহুডোরে আটকা পড়েছে। তাই তো এতো মান অভিমান। তাই তো এতো হারিয়ে ফেলার ভয়।

প্রকৃতির স্নিগ্ধ পবন টেনে নেয় সে। শীতল করে অশান্ত হয়ে থাকা বুকের ভেতরটা। তার অস্থিরতা কমেছে। সুখের ঢেউ খেলে যাচ্ছে সর্বাঙ্গে। তানভীর পুনরায় জিজ্ঞেস করে,

‘এটাই তো শুনতে চেয়েছিলে তো তুমি?’

পিয়া নিরুত্তর। তবে ক্ষণে ক্ষণে হেঁচকি দিয়েই যাচ্ছে। তানভীর আবারও বলল,

‘তুমি যে কাঁদছো আমার সুখ সুখ অনুভূতি হচ্ছে। এমন সুখের সন্ধান আমি বিগত সাতাশ বছরেও পাইনি।’

নাক টেনে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কেঁদে দিলো পিয়া। লোকটা কত অবলীলায় কথাগুলো বলছে। সে কি বুঝতে পারছে না পিয়ার মনের অবস্থা? হারিয়ে ফেলার প্রকাণ্ড ভয় গ্রাস করছে তার অন্তঃস্থল।

তানভীর শব্দযোগে হাসে। নিস্তব্ধ পরিবেশে প্রতিধ্বনিত হয় সেই হাসির নিঃস্বন।

‘তোমরা মেয়েরা এতো বোকা কেন? কোনো কিছু দেখলে যাচাই বাছাই না করে বিশ্বাস করে ফেলো। অনেক কিছু ভেবেও নাও। ইভেন ওভার থিংক করতে করতে অসুস্থ পর্যন্ত হয়ে যাও। একটাবার ভাবো না চোখের সামনে যা দেখছো তা ভুলও হতে পারে। এর আড়ালেও থাকতে পারে অনেককিছু।’

পিয়ার টনক নড়ে। মস্তিষ্কে কিছু একটা ঢেউ খেলে যায়। সমস্ত অভিমান, পাগলামি একপাশে রেখে ভাবনায় মগ্ন হয় সে। মনে মনে ভাবে, ‘আসলেই তো।’

পুনরায় নাক টানে পিয়া। ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কেঁদে দিয়ে শিশুসুলভ স্বরে বলে উঠল, ‘আপনি আমাকে ভালোবাসেন না।’

তানভীর নিরবে হাসে। চোখ বুঁজে নিল আবেশে। চক্ষুপটে ভেসে উঠল বছর চারেক আগের এক দৃশ্য। ঠোঁট জোড়া প্রসারিত হয় আরো একটুখানি।

‘জীবনের তেইশটা বসন্ত প্রেমহীন থাকলেও চব্বিশ তম বসন্তে এসে আর পারলাম না। প্রেমহীন, বিরস মনে অনুভূতি উঁকি দিল এক স্কুল পড়ুয়া মেয়েকে দেখে। বড্ড ক্লান্ত ছিল মেয়েটা। পরনে স্কুল ড্রেস। কিন্তু ওই ক্লান্ত মুখশ্রীতে ছিল স্নিগ্ধতা। যা আমাকে ঘুমোতে দেয়নি বহুদিন। বলতে পারো ওই মায়াবী চেহেরার মেয়েটি আমার নিদ্রা কেড়ে নিয়েছিল।’

পিয়ার কান্না থেমেছে। সাথে থেমেছে হেঁচকিও।মনোযোগ দিয়ে শুনছে তানভীরের কথা। তানভীর থেমে যেতেই প্রশ্ন করল, ‘তারপর?’

তানভীর ফের বলতে লাগল,

‘বন্ধুদের সমুদ্র দেখতে গিয়েছিলাম। মেয়েটিও বোধহয় স্কুল থেকে শিক্ষাসফরে এসেছিল। কোন স্কুল থেকে শিক্ষাসফরে এসেছে জানতে পারলেও পরবর্তীতে সেই স্কুল গিয়ে আর তার খোঁজ পাইনি। শতশত ছাত্রছাত্রীর মধ্যে একজনকে খুঁজে বের করা বলতে গেলে কঠিনই ছিল। আমি তো জানতাম না তার নাম কি বা সে কোন ক্লাসে পড়ে। গ্রাজুয়েশন শেষ হলো। নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে শুরু হলো ব্যস্ততা। শত ব্যস্ততার মাঝেও সেই স্নিগ্ধ চেহারা আমি ভুলতে পারিনি। কত যে সেই স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। যদি একটা বার একটু দেখা পাই। পাইনি আমি দেখা। বিশ্বাস করো দেখা পেলেই আমি সাথে সাথে মনের কথা জানিয়ে দিতাম।’

‘পরে দেখা পেয়েছিলেন?’

‘আমি আশা হারাইনি। অপেক্ষা করেছি। মনে মনে চাইতাম একটা মিরাকেল হউক। একটা বার একটু দেখা হউক। আর হারাতে দিবো না।’

পিয়া নিরেট গলায় জানতে চায়, ‘পেয়েছেন তার দেখা?’

লম্বা শ্বাস টেনে নেয় তানভীর।

‘হুম।’

চোখ টলমল করে পিয়ার। ফুঁপাতে থাকে সে। থেমে থাকা কান্না আবার উপচে পড়ে চোখে। কাঁপা গলায় বলল,

‘তবে কি আজকের মেয়েটাই সে?’

তানভীর চুপ। তানভীরের এই নিস্তব্ধতায় বুক ভেঙে আসে পিয়ার। ঠোঁট কামড়ে ধরে সে। পিয়ার কান্না ভারি হয়। নিরবতার অবসান ঘটায় তানভীর।

‘আমার জীবনের প্রথম প্রেমকে একমাত্র প্রেম করতে চেয়েছিলাম।’

‘আপনার প্রথম প্রেমের দেখা পেয়েছেন বলে এখন আমাকে ছেড়ে দিবেন?’

পিয়ার বোকা বোকা কথায় মজা পায় তানভীর। ভাবে মেয়েটা ঠিক কতটা গভীর ভাবে তার প্রেমে পড়েছে। আরো একটু ভয় দেখানোর জন্য বলে,

‘গেস হোয়াট?

পিয়া উল্টো হাতে চোখের পানি মুছে নাক টেনে বলে, ‘হোয়াট?’

তানভীর পুনরায় চুপ হয়ে যায় পিয়ার রিয়াকশন দেখার জন্য। কয়েক মুহুর্ত কে’টে যাওয়ার পরও যখম তানভীরের সাড়াশব্দ পাচ্ছিল না অস্থিরতা বাড়ে পিয়ার। ভীত সন্ত্রস্ত গলায় জানতে চায়,

‘কি হলো কথা বলছেন না কেন? কি গেস করবো আমি? আপনি শুনতে পারছেন আমার কথা?’

তানভীর ফিস ফিস করে বলে,

‘আমার প্রথম প্রেমই একমাত্র প্রেম হিসেবে ধরা দিয়েছে স্ত্রী নামক প্রেমিকা রূপে।’

হতভম্ব হয়ে যায় পিয়া। ইঙ্গিত টা তাকেই দেওয়া হয়েছে বুঝেও যেন বুঝতে পারছে না সে। সবটা কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এলোমেলো লাগছে নিজেকে।

‘মানে?’

‘যে ক্লান্ত, স্নিগ্ধ, মায়াবী চেহেরার অধিকারিনীকে দেখে প্রেম নামক বসন্তের হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলাম সে আর কেউ নয় আমার বিবাহিতা স্ত্রী। আমার রাজমহিষী।’

গা হাত-পা ছেড়ে দেয় পিয়ার। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পায় না। হাঁটু কাঁপছে তার। একটু আগে শোনা কথাটা কেমন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে তার। মাত্র একবার দেখায় এতটা ভালোবাসা যায়? ঠিক কতটা ভালোবাসলে এক পলকের একটু দেখায় নিজের অনুভূতিকে বক্ষপটে যত্ন করে রাখা যায়? প্রতিনিয়ত অপেক্ষা করা যায় আবার একটু সাক্ষাৎ এর। চাইলেই তো এতোগুলো বছরে নিজের জীবনের সাথে অন্য একজনকে জড়িয়ে নিতে পারতো। আর ভাবতে পারে না সে। মাথাটা ঝিম ধরে আসে। বুক ধড়ফড় করছে। এলোমেলো লাগছে তার নিজেকে।

তানভীর ফের বলল,

‘অদৃশ্যভাবে তুমি আমার মনে এমনভাবে নিজের বসতি স্থাপন করেছিলে আমি যেখানেই যেতাম আমার দৃষ্টি কেবল তোমাকেই খুঁজতো। খুব করে চাইতাম একটা মিরাকেল হউক । তোমার সাথে আমার আর একটাবার দেখা যেন হয়। একদম সারাজীবনের জন্য নিজের করে নিবো।’

‘আমাদের কি দেখা হয়েছিল?’

পিয়ার বোকা বোকা প্রশ্ন হাসে তানভীর।

‘দেখা হয়েছে বলেই তো সারাজীবনের জন্য তুমি কেবল আমার। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছাড়ছি না তোমায়।’

#চলবে