#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব১৬
#আফিয়া_আফরোজ_আহি
নিকষ কালো আঁধারের চাঁদরে ঢাকা পৃথিবী। ছাদের এক কোণে নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে আছি। রাতের নিস্তব্ধতায় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে হাজারো প্রশ্নের মেলা। তবে কি আদ্র ভাই আমাকে ভালোবাসতো? চোখের সামনে একটা মানুষ গোপনে আমায় এতটা ভালোবেসে গেল আমি বুঝতেও পারলাম না। মানুষটা সত্যিই খুব বিচিত্র। তখন তার ডায়েরিতে নিজের ছবি দেখে বুঝতে একটুও দেরি হলো না যে আদ্র ভাইয়ের রৌদ্রময়ী আর কেউ নয় স্বয়ং আমি। তার অনুভূতি সম্পর্কে জেনে অনেকটা সময় ‘থ’ মেরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মনের মাঝে কোনো অনুভূতি ছিলো না। মনে হচ্ছিলো আমি একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম। ঘোর ভাঙলো আরুর চিৎকারে।
ছাদে দাঁড়িয়ে রাতের শহর দেখছি আর হিমেল হাওয়া উপভোগ করছি। হটাৎ একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। ইভান ভাই যাওয়ার পড়ে এমনই একদিন এক আকাশ মন খারাপ নিয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে এক মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘনিশ্বাস। ধীর পায়ে পাশে এসে দাঁড়ালো আদ্র ভাই। মানুষটা আমাকে একটু মুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল হতে দেয় না। সব সময় চোখে চোখে রাখে। আকাশের দিকে মুখ করে পাশে থাকা আদ্র ভাইকে বলল,
“আদ্র ভাই সে আমাকে কেন ভলোবাসলো না? আমি কি দেখতে খারাপ নাকি আমাকে ভালোবাসা যায় না। কেউ আমাকে ভালোবাসেনি, কেউ না”
আদ্র ভাই তখন বিরবির করে বলেছিলো,
“তুমি যদি জানতে রৌদ্রময়ী আমি তোমাকে কতটা চাই বা ভালোবাসি, তবে তুমি চোখ বন্ধ করে বলতে, আমি এই দুনিয়ার সবচাইতে সৌভাগ্যবতী নারী”
সেদিন আদ্র ভাইয়ের কথা গুলো নিয়ে মাথা না ঘামালেও এখন সেগুলো মনে পড়ছে। আমাকে এতটা নিঃস্বার্থ ভাবে কেউ ভালোবাসতে পারে আমি সেটা কখনোই ভাবিনি। বরাবরই আদ্র ভাইকে ভাই হিসেবে দেখে এসেছি যদিও এই কয়েক দিনে সে ভাই থেকে বন্ধুর স্থানটা দখল করে নিয়েছে। শুধু বন্ধু না খুব ভালো বন্ধু। যাকে নির্দ্বিধায় সব কিছু বলা যায়। আদ্র ভাইকে নিয়ে ভাবছি এমন সময় কারো আগমনের শব্দ ভেসে আসছে কানে। মানুষটা আর কেউ নয় আদ্র ভাই। আদ্র ভাই এসে খানিকটা দুরুত্ব নিয়ে আমার পাশে দাঁড়ালেন। ঘুরে আদ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। মানুষটাকে কখনো সেভাবে পরখ করা হয়নি। তার মাঝে যে এক প্রেমিক সত্ত্বা বিদ্যমান সেটা ভাবিনি। অ্যাশ কালার শার্ট কালো রঙের প্যান্ট পরিহিত আদ্র ভাইকে দেখতে একদম সুপুরুষ লাগছে। ইভান ভাইয়ের মতো ধবধবে ফর্সা না হলেও তিনি যথেষ্ট সুদর্শন একজন পুরুষ। তাকে দেখে যেকোনো মেয়ে মুহূর্তেই প্রেমে পড়ে যাবে। তার কেয়ার, তার কথা বলার ধরণ, সব সময় সবাইকে মাতিয়ে রাখা একটা মেয়েকে তার প্রতি দুর্বল করতে সক্ষম। তবে চোখের সামনে থাকা মানুষটাকে কখনো সেভাবে দেখা হয়নি। আজ যেন মানুষটাকে নতুন রূপে দেখছি মনে হচ্ছে। আদ্র ভাই আমাকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? নজর সামলা নাহয় প্রেমে পড়ে যাবি”
আদ্র ভাইয়ের কথা শুনে একটু লজ্জা পেলাম। তবে নিজেকে সামলে গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করলাম। আদ্র ভাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম,
“ভালোবাসো আমায়?”
আদ্র ভাই চমকে আমার দিকে তাকালেন। উনি হয়তো কখনো আশা করেননি আমি উনাকে এরকম প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবো। আদ্র ভাই অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
“কি হলো বলো?”
আদ্র ভাই নিজেকে সামলে নিয়ে বুকে দুহাত গুঁজে দাঁড়ালেন।
“কোনটা বলবো? সত্যি নাকি মিথ্যা?”
“সত্যি”
“আমি আমার রৌদ্রময়ী কে ভালোবাসি”
“রৌদ্রময়ী টা কে?”
“তুই”
“তাহলে?”
“তাহলে আর কি, ভালোবাসি তোকে”
আদ্র ভাইয়ের মুখে ভালোবাসি শব্দটা শুনে মনের মাঝে অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে। এই অনুভূতি যেন নতুন এক অনুভূতি। যার সাথে আগে আমার পরিচয় হয়নি। দুজনের মাঝে নীরবতা। কি বলবো বুঝতে পারছি না। আমি তাকিয়ে আছি আকাশ পানে। আদ্র ভাইয়ের দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছি উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার তাকানোতে কেমন লজ্জা লাগছে।
“রৌদ্রময়ী কি আমায় ভালোবাসে?”
আদ্র ভাইয়ের প্রশ্নে তার দিকে ফিরে তাকালাম। কি বলবো বুঝতে পারছি না। সত্যি বলতে তার প্রতি আমার কোনো অনুভূতি নেই। আদ্র ভাই কাতর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“আমায় কি ভালোবাসা যায় না, রৌদ্রময়ী?”
আদ্র ভাইয়ের কাতর কণ্ঠে কি যেন ছিলো। তার কথাটা মনের কোথাও গিয়ে আঘাত হেনেছে। মনের মাঝে চিনচিন অনুভূতি হচ্ছে। সত্যিই তো মানুষটাকে কি ভালোবাসা যায় না? যায়। ফের দুজনের মাঝে নীরবতা। এভাবেই নীরবে কেটে গেল অনেকক্ষন। আজকে আদ্র ভাই কোনো কথা বলেন না। বাকিটা সময় নীরব রইলেন। অতঃপর মুখ খুলে বলেন,
“রাত অনেক হয়েছে ঘুমাতে যা”
আদ্র ভাইয়ের কথায় সায় জানিয়ে চলে এলাম। রুমে এসে মাথায় শুধু আদ্র ভাইয়ের কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে। তার কাতর কণ্ঠ। করুণ চাহনি। মনের মাঝে উথাল পাথাল করছে। বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছি কিন্তু তার চিন্তা যেন মাথা থেকে যাচ্ছে না। এক সময় তলিয়ে গেলাম গভীর ঘুমে।
—–
সময়ের স্রোতে দিন গুলো কেমন চোখের নিমিষেই কেটে যাচ্ছে। আদ্র ভাইদের বাসা থেকে এসেছি সপ্তাহ খানেক হয়ে গেছে। মেডিকেল পড়াশোনা সব কিছু নিয়ে প্রেসারে আছি। তবে আদ্র ভাই মানুষ টা প্রতিদিন সময় করে আমার খোঁজ নেয়। তার সাথে কথা বলতে ভালোই লাগে। উনার সাথে কথা বলার সময় মনে এক অন্য রকম অনুভূতি জাগে। যা আগে কোনো দিন হয়নি।
মেডিকেল থেকে বাসায় এসে উঁকি দিলাম ঈশিতা আপুর রুমে। তাকে ইদানিং আড্ডায় পাওয়া যায় না। সারাদিন তাকে ফোন নিয়ে থাকতে দেখা যায়। ঈশিতা আপুর রুমে ঢুকে দেখলাম সে কার সাথে যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। কাছে যেয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“আপু কার সাথে কথা বলছো? দুলাভাই নাকি আমাদের?”
ঈশিতা আপু আমার কথা খেয়াল না করে আনমনে জবাব দিলো,
“হ্যাঁ”
“কি! সত্যি?”
ঈশিতা আপুর এবার ধ্যান ভাঙলো। আমাকে তার পাশে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেল। ফোনে ওপাশের ব্যক্তিতে,
“এখন রাখছি। পড়ে কথা হবে”
বলে রেখে দিলো। আমার দিকে ঘুরে কান মুচড়ে ধরে বলল,
“বড় বোনের ওপর নজরদারি করা হচ্ছে?”
“নজর না রাখলে হয়। এখন বলো অফিসিয়ালি দুলাভাই কবে পাচ্ছি?”
“কয়েক দিনের মাঝেই বাড়িতে প্রস্তাব পাঠাবে”
“তাহলে খুব শীঘ্রই তোমার সানাই বাজলো বলে”
ঈশিতা আপু লজ্জা পেয়ে গেল। লজ্জায় তার গাল গুলো লাল হয়ে যাচ্ছে। ঈশিতা আপুকে কিছুক্ষণ টিজ করে রুমে চলে এলাম। রুমে আসতেই কানে এলো ফোনের শব্দ। দৌড়ে দিয়ে ফোন হাতে নিতে সামনে ভেসে উঠলো আদ্র ভাইয়ের নাম। কি সুন্দর গোটা গোটা অক্ষরে লিখা,
“আদীব চৌধুরী আদ্র”
তার নাম দেখে মনের মাঝে অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে। হাত কেমন কাঁপছে। হৃদয়স্পন্দন বেড়ে গিয়েছে। দেখতে দেখতে কলটা কেটে গেল। সস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বিছানায় বসতেই যাবো এমন সময় হাতের ফোন পুনরায় বেজে উঠলো। রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে আদ্র ভাইয়ের গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো,
“ফোন ধরছিলি না কেন? কোন রাজকার্য করছিলি শুনি? এই নিয়ে কয়বার ফোন দিয়েছি খেয়াল আছে?”
“সরি! আমি ঈশিতা আপুর রুমে ছিলাম আর ফোন ছিলো রুমে তাই রিসিভ করতে পারিনি”
আদ্র ভাই যেন কোমল হলেন। কোমল স্বরে বললেন,
“সেকি জানে তার কণ্ঠ শোনার জন্য আমি কেমন চাতক পাখির ন্যায় বসে থাকি। তাকে একটি বার দেখার জন্য আমার শহরে হাহাকার নামে। মনে এক আকাশ সম ইচ্ছে হয় তাকে চোখের সমানে বসিয়ে রাখি। সারাদিন বসে বসে তাকে দেখলেও আমার এ জীবনে তাকে দেখার তৃষ্ণা মিটবে না”
আমি চুপচাপ আদ্র ভাইয়ের কথা গুলো শুনছি। তার অনুভূতি গুলো অনুভব করার চেষ্টা করছি। আমার কি হলো জানি না আদ্র ভাইকে বললাম,
“এতই দেখার ইচ্ছে হলে বাসায় চলে এসো। নয়ন ভরে দেখে যেও তোমার রৌদ্রময়ীকে”
আদ্র ভাই ফট করে বলেন,
“সত্যি বলছিস, আসবো?”
আদ্র ভাইয়ের লজ্জা পেয়ে গেলাম। মুখে বললাম,
“জানি না”
কল কেটে দিলাম। লজ্জা লাগছে। ফোনটা রেখে কোলবালিশ জড়িয়ে শুয়ে পড়লাম।
—–
রাতের খাবার খেয়ে ড্রয়িং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছি এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো। রোশনিকে পাঠিয়ে দিলাম দরজা খোলার জন্য। কে এসেছে দেখার জন্য উঁকি দিতেই চোখ আটকে গেল কালো শার্ট কালো প্যান্ট পরিহিত ফর্মাল লুকে আদ্র ভাইকে। এলোমেলো চুল, কুঁচকে যাওয়া শার্ট সব মিলিয়ে মানুটাকে অন্য রকম লাগছে। আদ্র ভাইকে দেখে আম্মু এগিয়ে গেল।
“আদ্র বাবা তুই এতো রাতে?”
“একটা কাজে এদিকে এসেছিলাম। এখন বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না তাই তোমাদের বাড়ি চলে এলাম”
বলে আমার দিকে তাকালেন। উনি যে এখানে কেন এসেছে সেটা আর কেউ না জানলেও আমি তো জানি। আম্মু আদ্র ভাইকে ফ্রেশ হতে পাঠিয়ে দিলেন। আম্মু আদ্র ভাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছেন এমন সময় আব্বুর ডাক।
“রোদ এদিকে আয় তো”
উঠে গিয়ে আম্মুর সামনে যেতেই বললেন,
“আমাকে তোর আব্বু ডাকছে আমি যাচ্ছি। তুই দেখ আদ্রর কিছু লাগে কি না”
আম্মু চলে গেল। আমি টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। আদ্র ভাই চোখের ইশারায় পাশের চেয়ারে বসতে বলল। আমি না বসে জিজ্ঞেস করলাম,
“তোমার কিছু লাগবে? লাগলে বলো নাহয় আমি গেলাম”
“তোকে লাগবে”
আদ্র ভাইয়ের কথায় থমকে গেলাম । আদ্র ভাই পুনরায় চোখের ইশারা তার পাশে বসতে বললেন। কিছু না ভেবে বসে পড়লাম। আদ্র ভাই খাওয়ার মাঝে আড় চোখে তাকাচ্ছে। তার তাকানোতে আমার লজ্জা লাগছে। আদ্র ভাই খাওয়া শেষে উঠে আমার ওড়নার কোণা টেনে হাত মুছতে মুছতে ফিসফিস করে বলেন,
“ছাদে আয়, কথা আছে”
—–
আদ্র ভাইয়ের সমানে দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষন। উনি সেই কখন থেকে গালে হাত দিয়ে এক ধ্যানে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তাকে এভাবে তাকাতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম,
“কি দেখছো?”
“ভাবছি?”
আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
“কি?”
“আমার রৌদ্রময়ীর এক জোড়া চোখের বর্ণনায় গোটা একটা উপন্যাস লেখা সম্ভব”
#চলবে?
#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব১৭
#আফিয়া_আফরোজ_আহি
মেডিকেলে ক্লাস শেষ করে শুভ ভাইয়ের জন্য দাঁড়িয়ে আছি আমি আর ইভা। কথা ছিলো তিনজন একসাথে বাড়ি যাবো। আমরা সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি তবে তার দেখা নেই। অগত্যা ইভাকে রেখে শুভ ভাইয়ের কেবিনের দিকে হাঁটা দিলাম। শুভ ভাইয়ের কেবিনের সামনে যেতেই ভিতর থেকে কোনো মেয়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। দরজা হাল্কা ফাঁকা করে দেখলাম শুভ ভাই চেয়ারে বসে আছে আর সামনে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার মুখ ঠিক মতো দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটা ঘুরতেই দেখলাম এতো ফাইনাল ইয়ারে তিথি আপু। মেয়েটার মাঝে কেমন গুন্ডি গুন্ডি ভাব আছে। তিথি আপুকে দেখে শুভ ভাই উঠে দাঁড়ালেন। তিথি আপু এগোতে এগোতে জিজ্ঞেস করছে,
“মেয়েটা কে যার সাথে সকাল বেলা হাত ধরে আশা হচ্ছিলো? সাথে মুখে লেগে ছিলো চব্বিশ ক্যারেট গোল্ডের হাসি। ক্লাসে তো সব সময় গোমড়া মুখে দেখা যায়। আর মেয়েটাকে দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠলো? আবার ঢং করে পাখি ডাকা হচ্ছিলো, ভালোবাসা যেন উতলে উতলে পড়ছে। মেয়েটা কে?”
তিথি আপু এগিয়ে যাচ্ছে আর ভাইয়া পিছিয়ে যাচ্ছে। শুভ ভাইয়ের মুখে ভয়ের রেখা দেখা যাচ্ছে। ভাইয়া সাবধান করে বলল,
“সামনে এগোবে না মেয়ে”
“এগোলে কি করবেন?”
“আমি তোমার টিচার”
“টিচারের গুল্লি মারি। আপনি আগে বলেন মেয়েটা কে?”
শুভ ভাইয়া তড়িঘড়ি করে বলল,
“বোন! বোন হয় আমার”
“বোন? কেমন বোন? কোন জনমের বোন?”
“কাজিন হয় আমার”
“মানুষ কাজিনকে পাখি বলে সম্মোধন করে আমার জানা ছিলো না তো”
“ও আমার কাজিন হলেও আমি ওকে আমার বোনের চোখে দেখি। আর বোনকে আদর করে পাখি ডাকাই যায়”
তিথি আপু এগিয়ে গিয়ে শুভ ভাইয়ের কলার ঠিক করে দিতে দিতে বলল,
“তাহলে ঠিক আছে”
তিথি আপু ভাইয়ার থেকে দূরে সরে এলো। এতক্ষনে শুভ ভাই সস্থির নিঃশ্বাস ফেলল। আমার গম্ভীর, শান্তশিষ্ট, পড়ুয়া ভাই যে তিথি আপুর জালে ফেঁসে গেছে সেটা আমি হারে হারে টের পাচ্ছি। তবে দুজনের জুটিটা অনেক সুন্দর হবে। একজন চুপচাপ শান্ত আরেক দুরন্ত। দুজনের জুটি জমবে বেশ। আমি কাশি দিয়ে উঠলাম। আমার শব্দ পেয়ে দুজনে সরে দাঁড়ালো। শুভ ভাই বলল,
“পাখি তুই এখানে? কোনো দরকার?”
“তুমি না বলেছিলে একসাথে বাড়ি যাবে। সেই কখন থেকে তোমার অপেক্ষা করছি কিন্তু তোমার তো আসার নামই নেই”
“সরি পাখি খেয়াল ছিলো না”
শুভ ভাইয়া পকেট হাতড়ে কিছু একটা খুঁজছেন। তিথি আপু যাওয়ার আগে আমার গাল টেনে আদর করে দিয়ে বললেন,
“মাশাআল্লাহ তুমি অনেক কিউট। ননদ হিসেবে একদম পারফেক্ট। আজ থেকে আমিও তোমাকে পাখি বলে ডাকবো। তোমার কোনো সমস্যা আছে?”
আমি মাথা নেড়ে না বললাম। আপু যেতে যেতে বলল,
“কিউট গার্ল”
শুভ ভাই পকেট হাতড়ে গাড়ির চাবি বের করে হাতে দিয়ে বললেন,
“তোরা গাড়িতে গিয়ে বস। আমি ২ মিনিটের মাঝেই আসছি”
ক্লান্ত শরীরে বাড়িতে ঢুকছি। ইভা আর শুভ ভাই তাঁদের রুমে চলে গেছে। রুমে ঢুকে ব্যাগটা রেখে পিছনে ফিরতেই অবাক হয়ে গেলাম। আদ্র ভাই আমার বিছানায় টান টান হয়ে শুয়ে আছে। উনি কখন এলেন? তাকে দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এই মানুষটাই যে এখন আমার মন খারাপের মেডিসিন। সে এসে পাশে থাকলে মন খারাপেরা কোথায় যেন পালিয়ে যায়।
“তুমি? তুমি কখন এলে?”
“রৌদ্রময়ী তো আমায় পাত্তাই দিচ্ছে না তাই ভাবলাম আমিই তার সাথে দেখা করতে চলে আসি। রৌদ্রময়ী কঠোর মনের মানুষ, আমি তো আর তার বেলায় কঠোর হতে পারিনা”
“নাটক কম করো পিও”
আমার কোথায় আদ্র ভাইয়া ফিক করে হেসে দিলেন। উঠে এসে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বলল,
“সত্যিই কি আমি তোর প্ৰিয়?”
“অপ্রিয় হওয়ার তো কোনো কারণ দেখছি না”
“তাহলে বলে ফেল”
“কি?”
আদ্র ভাই চোখে চোখ রেখে বললেন,
“ভালোবাসি”
“সঠিক সময় হলে বলবো”
“অপেক্ষায় রইলাম”
আদ্র ভাই চলে গেলেন। আমি তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলাম।
—–
বাড়িতে আয়োজন চলছে। ঈশিতা আপুকে দেখতে আসবে। আমি, ইভা, রোশনি আপুর রুমে বসে আছি। আপু এক মনে সেজে চলেছে। মুখে লেগে আছে মিষ্টি হাসি। হাসি থাকবেনাই বা কেন? তার ভালোবাসার মানুষটি যে আসছে। তৎক্ষণাৎ মাথায় এলো আদ্র ভাই যদি কখনো আমায় এভাবে দেখতে আসে তখন কি হবে? আমি তো লজ্জায় লাল হয়ে যাবো। এতদিন যাকে ভাই হিসেবে দেখে আসছি ভবিষ্যতে তাকে জামাই হিসেবে দেখতে হবে। ভাবতেই কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে। পাশ থেকে ইভা খোঁচা দিয়ে বলল,
“আপুকে দেখতে আসছে কিন্তু তুই এমন লজ্জায় লাল হচ্ছিস কেন?”
ইভার কথায় নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম। নিজেকে স্বাভাবিক করে বললাম,
“তোর চোখে ছানি পড়েছে ডাক্তার দেখা। নাহয় ভবিষ্যতে জামাই পাবি না”
ইভা মুখ ভেংচি দিলো। আপু এখনো সেজেই চলেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে আজকে তার বিয়ে।
“আপু একটু কম করে সাজো নাহয় হবু দুলাভাই তোমাকে দেখে ফিট খাবে”
“তুই চুপ থাক তো। আমাকে সাজতে দে”
ভদ্র মেয়ের মতো চুপ করে গেলাম। কিছুক্ষন পর আদ্র ভাই এসে বলল আপুকে নিচে নিয়ে যেতে। আমি আর ইভা মিলে আপুকে নিয়ে যেতে লাগলাম। দরজার সামনে আসতেই আদ্র ভাই ডেকে উঠলো। আপুর সাথে রোশনিকে পাঠিয়ে দিয়ে আমি আদ্র ভাইয়ের কাছে গেলাম।
“বলো”
“তুই ওদের সামনে যাবি না”
“কেন?”
“পড়ে যদি তোকে দেখে পাত্রপক্ষ পছন্দ করে বসে তখন? আমি কোনো রিস্ক নিতে চাইনা”
“আমি এতটাও সুন্দর নই যে আমাকে দেখে পছন্দ করে ফেলবে”
“তুই যদি আমার চোখ দিয়ে নিজেকে দেখিস তাহলে দেখবি চোখের সমানে পৃথিবী সবচেয়ে সুন্দর রমণী। যার সৌন্দর্যের কোনো তুলনা হয়না। যার সামনে বিশ্ব সুন্দরীও কম পড়ে যাবে”
আদ্র ভাইয়ের কথায় লজ্জা পেলাম। লজ্জায় মুখ নামিয়ে ফেললাম। এই লোকটার প্রেমিক সত্ত্বা বড্ড ভয়ংকর। উনি যেন সব সময় আমায় লজ্জা দেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকেন। আদ্র ভাই আমার থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে তুলে ধরলেন। তার চোখের দিকে তাকাতেই এক রাশ লজ্জারা আমায় ঘিরে ধরলো। চোখ নামিয়ে নিলাম।
“আমার রৌদ্রময়ী লাজুকলতা হলো কবে থেকে? সেকি জানে তার লজ্জা রাঙা মুখশ্রী আমায় তার প্রেমে পড়তে বাধ্য করে। তার প্রেমে আমি এতটা বাজে ভাবে পড়ছি যে এখন কোনো কুল কিনারাই খুঁজে পাচ্ছি না। রৌদ্রময়ী কি আমায় এই অতল গভীর সমুদ্র থেকে টেনে তুলবে?”
“আমার সময় নেই”
“এতটা নির্দয় হোস না। আমি যে মাঝ সমুদ্রে ভেসে যাবো”
“ভেসে গেলে জাল দিয়ে টেনে তুলবো”
নিচে শুভ ভাই আদ্র ভাইকে ডাকছে। আদ্র ভাই বিরবির করে বলল,
“একটু প্রেমআলাপ করবো কিন্তু এই শা*লা নামক জ্বালাদের জন্য সেটাও পারছি না”
আদ্র ভাই যাওয়ার আগে ফের বলে গেলেন,
“তোকে যেন আশেপাশেও না দেখি”
কি আর করার ওপরে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে নিচে কি হচ্ছে তাই দেখার চেষ্টা করছি। ঈশিতা আপুর হবু বরের নাম শিহাব। শিহাব ভাইয়া আপুর দিকে তাকিয়ে আছে। আর এদিকে আপু লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। তবুও একটু পর পর আড়চোখে তাকাচ্ছে। শিহাব ভাই সবার অগোচরে আপুকে চোখ টিপ দিলো। আপু লজ্জায় মরি মরি অবস্থায়। ওদের কাহিনী দেখে আমার নিজেরই লজ্জা লাগছে।
—–
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছি। সারা ব্যালকনি জুড়ে রজনীগন্ধার সুবাসে ছড়াছড়ি। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে উপভোগ করছি। এমন সময় ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হলো। এই বৃষ্টির সাথে গরম ধোয়া উঠা চা হলে জমে যেত। কিন্ত আলসেমি লাগছে। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁয়ে দিচ্ছি। এমন সময় ব্যালকনিতে কারো প্রবেশ ঘটলো। আদ্র ভাই আমার দিকে একটা কাপ এগিয়ে দিলো। কাপ হাতে নিয়ে দেখি চা। আদ্র ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“তুমি বুঝলে কিভাবে এখন আমার চা খেতে ইচ্ছে করছে?”
“রৌদ্রময়ী যে চা খেতে খেতে বৃষ্টি দেখতে পছন্দ করে সেটা আমার বরাবরই জানা”
“এতটা জানো?”
“সন্দেহ আছে?”
“একটুও না”
দুজনের মাঝে নীরবতা। চায়ে চুমুক দিচ্ছি আর আর বৃষ্টি দেখছি। আদ্র ভাই চা টা দুর্দান্ত বানায়। আমি নিজেও হয়তো এতো ভালো চা বানাতে পারবো না। আদ্র ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম,
“কোন ললনার জন্য চা বানানো শিখেছিলে শুনি?”
“যেই ললনা এখন চা খাচ্ছে তার জন্য। ইচ্ছে ছিলো সে বৃষ্টি উপভোগ করবে আর আমি তার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আসবো। অতঃপর দুজন মিলে ধোয়া ওঠা চায়ের সাথে বৃষ্টিবিলাস করবো”
কথার পৃষ্ঠে কি বলবো খুঁজে পাচ্ছি না। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় মানুষটার ভালোবাসার সমুদ্রে অতল গহীনে হারিয়ে যাই। ডুবে যাই তার প্রেম সাগরে। তখনই ভেসে উঠে অতীত। অতীতেও তো কাউকে ভালোবাসতে চেয়েছিলাম। আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলাম তাকে। কিন্তু সে চায়নি। মাথায় এটা প্রশ্ন আসলো।
“আদ্র ভাই মানুষ কখনো দ্বিতীয় বার কারো প্রেমে পড়তে পারে?”
“অবশ্যই পারে। মানুষ তখন দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়ে যখন প্রথম মানুষটা ভুল হয়”
চুপ করে রইলাম। আদ্র ভাই ফের বললেন,
“এইযে আমায় দেখ আমি প্রতিনিয়ত নতুন করে তোর প্রেমে পড়ছি। নতুন ভাবে ভালোবাসতে শিখছি। তুই আমার সঠিক মানুষ তাই আমি বারেবারে তোর প্রেমেই পড়ি”
এই মানুষটা বরাবরই আমায় অবাক করে। তাকে ভালোবাসতে বাধ্য করে। একটা মানুষ কাউকে এতটা ভালোবাসতে পারে এটা আদ্র ভাইকে না দেখলে জানতেই পারতাম না। আদ্র ভাইয়ের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম। তার চোখের দিকে তাকাতেই মনে হলো আমি হারিয়ে যাচ্ছি। একটু একটু করে তার ভালোবাসার অতল গভীরে হারিয়ে যাচ্ছি। যেখানে কোনো কুল কিনারা নেই। আছে আঁকড়ে ধরার মতো আদ্র নামের একজন মানুষ। যাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই পুরোটা জীবন।
#চলবে?