#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব১৯
#আফিয়া_আফরোজ_আহি
রৌদ্রজ্জ্বল দিনে আকাশে স্বল্প মেঘের আনাগোনা। বইছে হিলেম হাওয়া। বাগানে ডেকোরেশন এর কাজ চলছে। একটু পড়েই ঈশিতা আপুর হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হাতে কফি নিয়ে একটু পর পর কফিতে চুমুক বসাচ্ছি এর ডেকোরেশন এর কাজ দেখছি। একটু পড়েই সেখানে আগমন ঘটলো আদ্র ভাইয়ের। বেচারা ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। বিয়ের সকল দায়িত্ব ভাইয়াদের ওপর। আদ্র ভাইয়ের গাঁয়ে কালো টিশার্ট, কালো প্যান্ট, হাতে কালো রঙের ঘড়ি। ঘামে টিশার্ট ভিজে গাঁয়ের সাথে লেগে রয়েছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের অস্তিত্ব। চুল গুলোও এলোমেলো। মানুষটাকে দেখে মায়া লাগছে। ইচ্ছে করছে সযত্নে তার এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দেই। কফি শেষ করে ঝটপট নিচে নেমে গেলাম। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি আর লেবু বের করলাম। বড় আম্মু দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“এগুলো দিয়ে কি করবি?”
“শরবত বানাবো”
“কাদের জন্য?”
“ভাইয়াদের জন্য। বেচারাদের রোদে ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা”
“ভালোই করেছিস। আর আদ্র কে ডেকে বলিস খাবার খেয়ে যেতে। ছেলেটা সেই সকাল থেকে কাজ করছে। কাজের ধান্দায় খাবারও খায়নি”
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এই লোকটা সব সময় আমাকে খাবার নিয়ে জ্ঞান দেয় এখন তার খাওয়ার খবর নেই। তাড়াতাড়ি করে শরবত বানিয়ে ট্রে তে করে নিয়ে হাঁটা দিলাম। শুভ ভাই, রুদ্র ভাই, রোশন কে দিয়ে আদ্র ভাইকে খুঁজছি। তিনি বাগানের এক কোনায় দাঁড়িয়ে কারো সাথে কথা বলছেন। আমি তার পিছনে যেয়ে দাঁড়ালাম। আদ্র ভাই আমাকে দেখে ওপর পাশের ব্যক্তিতে বলল,
“এখন রাখছি। পড়ে কথা বলবো”
ফোন পকেটে পুড়ে আমার দিকে ফিরলো। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তুই এখানে কি করছিস? এই রোদের মাঝে বাড়ির ভিতরে যা”
“তোমার জন্য শরবত এনেছি”
“মনে হচ্ছে আমার প্রতি ভালোবাসা উতলে পড়ছে”
“আমাকে কি তোমার মতো মনে হয়? আমি অনেক দয়ালু মেয়ে ভাবলাম বেচারা আদ্র ভাই এতো কষ্ট করছে তার জন্য নাহয় একটু শরবত বানিয়ে নিয়ে গেলাম। এখন দেখছি ভালো মানুষের দাম নেই”
আদ্র ভাইয়া শরবতের গ্লাস নিয়ে ঢক ঢক করে খেয়ে শেষে করে রেখে দিলেন।
“এখন বাড়ির ভিতরে যা”
আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। নড়চড় করলাম না।। আদ্র ভাই আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হলো যাচ্ছিস না কেন?”
“আমার সাথে তুমিও চলো”
“কোন আনন্দে?”
“যেতে বলছি যাবে”
“বায়না করে না রোদ। এখানে অনেক কাজ, একটু পড়েই হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে। এখন যাওয়া যাবে না”
কোমরে হাত রেখে বললাম,
“সকাল থেকে যে কিছু খাওয়ানি সে খেয়াল আছে? না খেয়ে অসুস্থ হলে তখন কি হবে?”
আদ্র ভাই চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সেবা করার জন্য তো তুই আছিস”
আমি তার কথা শুনলাম না। খপ করে তার হাতে ধরে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। আদ্র ভাইও কোনো কথা বললেন না। ভদ্র ছেলের মতো আমার পিছু পিছু এলেন। তাকে টেবিলে বসিয়ে দিয়ে আম্মুকে ডাকা শুরু করলাম।
“মামীকে ডাকছিস কেন?”
“তোমাকে খাবার দেওয়ার জন্য”
“তুই দিলে দে, নাহয় আমি গেলাম”
অগত্যা নিজেই তাকে খাবার বেড়ে দিলাম উঠে যাবো এমন সময় তার কণ্ঠ,
“আমার যতক্ষণ খাবার না শেষ হয় ততক্ষন এখানে বসে থাকবি”
কি আর করার বসে রইলাম আদ্র ভাইয়ের পাশে। ঈশিতা আপুকে মেকআপ আর্টিস্ট সাজাচ্ছে। ইভা আর রোশনি আয়নার সামনে ধাক্কা ধাক্কি করছে। ইভা বলছে,
“সর আমি আইলাইনার পড়বো”
রোশনি বলছে,
“তুমি সরো আমি লিপস্টিক পড়বো”
এদের সাজগোজর মাঝে আমি এক এতিম ব্যক্তি। এদের ঠেলাঠেলিতে জায়গাই পাচ্ছি না। শাড়ি পড়ে মুখ ফুলিয়ে বসে আছি। এর মাঝেই ঈশিতা আপুর সাজ শেষে হয়ে গেল। আপু উঠে বলল,
“তুই এখানে বস। আপু তোকেও সাজিয়ে দিবে নাহয় ওরা দুজন যা শুরু করেছে এতে আজকে তুই সাজতে পারবি কিনা সন্দেহ আছে”
আপুর কথা মতো বসে পড়লাম। মেকআপ আর্টিস্ট কে বললাম সিম্পল ভাবে সাজিয়ে দিতে। এই কথা শুনে ঈশিতা আপু রেগে গেল।
“আমার বিয়েতেও তুই ঠিক করে সাজবি না?”
“তুমি তো জানো আমার ভারী সাজ পছন্দ না”
“তোর যা ইচ্ছে কর”
ঈশিতা আপুকে স্টেজে বসানো হয়েছে। এখনো শিহাব ভাইয়ের বাড়ি থেকে হলুদ আসেনি। আমি রোশনি, ইভা এক পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছি। একটু পর শিহাব ভাইয়ের বাড়ি থেকে তার বন্ধু এবং কাজিনরা হলুদ নিয়ে এলো। শুরু হয়ে গেল আমাদের হলুদের অনুষ্ঠান। বড়রা আগে ঈশিতা আপুকে হলুদ লাগলো। এখন আমাদের পালা। ঈশিতা আপু হুমকি দিয়ে বলল,
“আমাকে একদম ভুত বানাবি না। তাহলে কিন্তু খবর আছে”
আদ্র ভাই এক খবলা হলুদ নিয়ে ঈশিতা আপুর পুরো মুখে মেখে দিলো। ঈশিতা যাওয়া চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
“আদ্রর বাচ্চা”
“আমি এখনো সিঙ্গেল। বাচ্চা আসবে কোথা থেকে?”
আদ্র ভাই আর ঈশিতা আপুর কাণ্ডে আমরা সবাই হাসছি। একে একে আমরা সবাই আপুকে হলুদ লাগাচ্ছি। আপুকে দেখে মনে হচ্ছে হলুদ ভুত। মাঝ থেকে কে যেনো বলে উঠলো,
“বিয়ের কোণের হলুদ লাগালে তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়”
কথাটা শুনে ইভা আর রোশনি আমার দিকে তাকালো। এদের তাকানো সুবিধার লাগছে না। এরা নিশ্চই কোনো কু বুদ্ধি আটছে। ইভা আর রোশনি হাতে হলুদ লাগিয়ে আমার দিকে আসছে। ওদের নিজের দিকে এগোতে দেখে দিলাম এক দৌড়। আমাকে আর পায় কে। পুরো বাগান জুড়ে দৌড়াচ্ছি। আমি আগে ওরা আমার পিছনে। পিছনে ফিরে ওদের দিকে তাকাতেই কারো সাথে ধাক্কা খেলাম। পড়ে যাবো তার আগেই কেউ তার বলিষ্ঠ বাহুতে আমাকে আগলে নিল। ভেবেছিলাম এইবার বুঝি সাধের কোমর আমার ভেঙেই গেল। কিন্তু একটুর জন্য বেঁচে গেলাম। পিটপিট করে চোখ খুলতেই আদ্র ভাইয়ের মুখটা সামনে ভেসে উঠলো। আদ্র ভাই আমার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। ওদের সামনে আদ্র ভাই এভাবেই ধরে আছে বিষয়টা অস্বস্তিকর। আদ্র ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললাম,
“আদ্র ভাই ছাড়ুন, এখানে অনেক মানুষ আছে”
উনি আমার কথা শুনে হুসে ফিরলেন। আমায় ঠিক করে দাঁড় করিয়ে নিজেও ঠিক হয়ে দাঁড়ালেন।পূর্ণ চোখে আদ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। তার পরনে সাদা রঙের পাঞ্জাবি, তার ওপরে হলুদ রঙের কোটি। হাতে ঘড়ি, চুলগুলো গুছিয়ে রাখা। সব মিলিয়ে আদ্র ভাইকে অনেক সুন্দর লাগছে। আমি আদ্র ভাইকে দেখছি এমন সময় উনি আমাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“এতো দৌড়া দৌড়ি কিসের?”
“ওরা আমাকে হলুদ দেওয়ার জন্য পিছনে ছুটছে”
“হলুদ দেওয়ার জন্য ছুটছে মানে?”
ইভা বলল,
“একটু আগে একজন বলেছে বিয়ের কোণের হলুদ যার গাঁয়ে লাগানো হবে তার তাড়াতাড়ি বিয়ে হবে। তাই আমরা রোদের পিছনে ছুটছি”
আদ্র ভাই বলল,
“তাই নাকি?”
“হ্যাঁ”
আদ্র ভাই হুট করে তার হাতে লাগে থাকা হলুদ গুলো আমার গালে মেখে দিলো। আমি তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছি। আমার কি হলো জানি না। আমিও তার দুইগালে হলুদ লাগিয়ে দিলাম। আদ্র ভাইও যেন বোকা বোনে গেল। আদ্র ভাই কেমন করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এখানে থাকা ঠিক হবে না। তাই দৌড়ে লাগলাম।আদ্র ভাই পিছন থেকে বলে উঠলো,
“সাবধানে যা, নাহয় পড়ে যাবি”
আদ্র ভাইয়ের কাছ থেকে দূরে চলে এলাম। ছবি তোলার জন্য ফোন খুঁজছি। কিন্তু হাতে নেই। মনে পড়লো ফোন তো রুমে রেখে এসেছি। রুমে ঢুকে ফোন খুঁজছি। ফোন পেয়ে রুম থেকে বের হবো এমন সময় কেউ হাত টেনে ধরলো। আচমকা হাতে টান পড়ায় সামনের মানুষটার বুকে যেয়ে পড়লাম। সামনে আদ্র ভাইকে দেখে সস্থির নিঃশ্বাস ফেললাম। আদ্র ভাই আমার মুখের ওপরে আশা চুলগুলো সযত্নে সরিয়ে দিলেন। আদ্র ভাইকে এতটা কাছে দেখে হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে হৃদপিন্ড এই বুঝি বেরিয়ে আসবে। হাত পা কেমন কাঁপছে। আদ্র ভাই আমার হলুদে রাঙা গালের সাথে তার গাল ঘষে দিলেন। গাঁ শিউরে উঠলো। শিরদাড়া বেয়ে এক অজানা শিহরণ ছেয়ে গেল। আদ্র ভাই গাল থেকে কিছুটা হলুদ নিয়ে নাকে ছুঁইয়ে দিলেন। ফিসফিস করে বলল,
“আমার হলুদপরী”
আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। আদ্র ভাই পুনরায় বলল,
“তোর গায়েও কোণের ছোঁয়া হলুদ আমায় গায়েও একই হলুদ। মানে কি বুঝেছিস?”
আমি অবুঝ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছি। সত্যি বলতে আমি তার কথার মানে কিছুই বুঝিনি? মাথা নেড়ে না জানালাম।
“এর মানে হচ্ছে খুব শীঘ্রই আমাদের সানাই বাজতে চলেছে। অবশেষে এতো প্রতীক্ষার অবসান হবে”
আদ্র ভাইয়ের কথায় লজ্জা পেয়ে গেলাম। লজ্জারা যেন ঘিরে ধরলো আমায়। লজ্জায় মাথায় নামিয়ে নিলাম। আদ্র ভাই থুতনিতে ধরে মুখটা ওপরে তুললেন। লজ্জায় তার চোখের দিকে তাকাতে পারছি না। আদ্র ভাই মোহনীয় কণ্ঠে বললেন,
“তাকা আমার দিকে”
লজ্জা ফেলে তার চোখে তাকালাম। তার চোখে এক সমুদ্র ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছি। লজ্জায় আদ্র ভাইয়ের থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। এমন সময় নিচ থেকে ডাক এলো। আদ্র ভাই এখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মিহি স্বরে আদ্র ভাইকে বললাম,
“আদ্র ভাই ইভা ডাকছে”
আদ্র ভাই ঘোর থেকে বেরিয়ে এলো।
“কিছু বললি?”
“ইভা ডাকছে”
“তো যা। তোকে কে ধরে রেখেছে?”
ইশারা করলাম হাতের দিকে। আমার হাত এখনো আদ্র ভাইয়ের হাতের মুঠোয়। আদ্র ভাই বিষয়টা বুঝতে পারে হাত ছেড়ে দিলো। আমি তাড়াহুড়া করে সেখান থেকে চলে এলাম। ইভার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলাম,
“ডাকছিলিস কেন?”
“ছবি তোলার জন্য”
ইভা,আমি, রোশনি সবাই মিলে অনেক গুলো ছবি তুললাম। ছবি তুলা শেষে সবাই যার যার মতো গল্প করছি। হটাৎ গেটের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলাম। গেট দিয়ে ব্লু শার্ট, কালো প্যান্ট পরিহিত একজন যুবক ঢুকছে। চোখে তার সানগ্লাস, হাতে বড় সড় আকারের একটা লাগেজ। বিরবির করে উচ্চারণ করলাম,
“ইভান ভাই”
#চলবে?