উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন পর্ব-২০+২১

0
5

#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব২০
#আফিয়া_আফরোজ_আহি

ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছি। একটু পর পর মন মাতানো দমকা হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে নীরবে। প্রতিদিন এই স্নিদ্ধ হাওয়ায় মন ভালো হলেও আজকে ঘটনা যেন তার বিপরীত। মন মেজাজ একটুও ভালো নেই। ব্যালকনি জুড়ে বেলি ফুলের সুবাস ছড়িয়ে আছে। তবে আমার এতে একটুও আগ্রহ নেই। মনের মধ্যে চলছে অস্থিরতা। তখনকার ঘটনা মনে পড়ে গেল।

বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে আছি গেট দিয়ে প্রবেশ করা যুবকটির পানে। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। ব্লু শার্ট কালো প্যান্ট পরিহিত যুবকটা অর কেউ নয় স্বয়ং ইভান নামক মানুষটা। ইভান ভাই এগিয়ে আসছে বাড়ির ভিতরে। তিনি যতো এগিয়ে আসছে ততো ভয় হচ্ছে। মানুষটা কেন এলো? ভোলোই তো নিজেকে, নিজের জীবনটাকে গুছিয়ে নিয়েছিলাম। মুহূর্তেই উৎসব মুখর পরিবেশ শান্ত হয়ে গেল। বিগত চার বছর পর ছেলেকে দেখে বড় আম্মু তাকে জড়িয়ে নিলেন। ইভান ভাই যতই খারাপ হোক ছেলে তো তাই মান অভিমান ভুলে গেলেন। বড় আব্বু মুখ ফিরিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেলেন। একে একে সবাই ইভান ভাইয়ের সাথে কথা বলছে। আমি তাকে দেখে পিছিয়ে যাচ্ছি। আমি এই নিকৃষ্ট মানুষটার সামনাসামনি হতে চাইনা। পিছাতে পিছাতে এক সময় কারো বলিষ্ঠ বুকের সাথে পিঠে ধাক্কা লাগলো। মানুষটা আমায় আগলে নিলেন। এই সময় পিছু ঘুরে দেখার প্রয়োজন মনে হলো না। মনে হচ্ছে আমি কোনো এক ঘোরের মাঝে ডুবে গিয়েছি। পিছনে থাকা মানুষটা আমায় তার দিকে ঘুরিয়ে নিলেন। গালে হাত রেখে ব্যাকুল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হয়েছে? এরকম উদভ্রান্তের ন্যায় পিছনে যাচ্ছিলি কেন? পড়ে গেলে কি হতো সে খেয়াল আছে?”

আমি আদ্র ভাইয়ের প্রশ্নের জবাব দেয়ার মত অবস্থায় নেই। ক্যাবলার মতো আদ্র ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। আদ্র ভাই পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে রোদ সোনা কথা বলছিস না কেন?”

আমি আদ্র ভাইকে ইশারা করলাম। আদ্র ভাই সেদিকে তাকিয়ে ইভান ভাইকে দেখে আমায় তার সাথে আগলে নিলেন। আমার মাথা তার বুকে চেপে ধরলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
“আমার রৌদ্রময়ী তো এতটা ভীতু না। সে তো অনেক স্ট্রং মেয়ে। তাহলে তুই ভেঙ্গে পড়ছিস কেন? অতীত মনে করতে নেই। অতীতে যা হয়েছে তা হয়েছে কিন্ত বর্তমানে তোর পাশে আদ্র আছে। তোর কোনো ভয় নেই। আমি তোর গাঁয়ে একটা আঁচড়ও কাউকে দিতে দিবো না”

আদ্র ভাই আমাকে বুঝাচ্ছেন। ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নিলাম। সত্যিই তো আমি তো এখন আগের রোদ নেই যে ভীতু, এখনকার রোদ আঘাত দিলে পাল্টা আঘাত হানতে জানে। বড় বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে হাল্কা করলাম। ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। আদ্র ভাই আমাকে তার থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“ঠিক আছিস?”

আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম। আদ্র ভাইয়ের কাছ থেকে চলে আসতে নিলে উনি হাত ধরে আটকে দিলেন।
“কোথায় যাচ্ছিস?”

“রুমে যাচ্ছি। এখানে দমবন্ধ হয়ে আসছে”

“ঠিক আছে যা”

সেই যে ঘরে এসে দরজার বন্ধ করেছি আর বের হয়নি। সবাই এসে অনেকবার ডেকে গেছে কিন্তু আমি মাথা ব্যাথার বাহানা দিয়ে তাঁদের পাঠিয়ে দিয়েছি। ইভা অনেক বার এসে ডেকে গেছে ওরা সবাই মিলে মেহেদী পড়ছে আমাকেও ডেকেছে তবে আমি মানা করে দিয়েছি। এখন নিচে গেলেই ইভান নামক মানুষটার মুখোমুখি হতে হবে। আমি চাইনা তার মুখোমুখি হতে। একটু আগে রাতে খাবার খাওয়ার জন্য আম্মু ডাকতে এলে খাবো না বলে দিয়েছি। আমি কোনো মতেই নিচে নামবো না। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় দরজার কেউ কড়া নাড়ছে। রুমে এসে ভিতর থেকেই জিজ্ঞেস করলাম,
“কে?”

“আমি”

আদ্র ভাইয়ের গলার স্বর শুনে দরজা খুলে দিলাম। এই মুহূর্তে এই মানুষটাকে আমার বড্ড প্রয়োজন।কারণ সে যে আমার মন খারাপের মেডিসিন। তাকে ছাড়া ইদানিং কিছুই ভালো লাগে না। আদ্র ভাইয়ের হাতে ট্রে। ট্রে তে খাবার দেখে অবাক হলাম। আদ্র ভাই খাবারটা টেবিলে রেখে সোফায় বসলেন। আমি তার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
“খাবার কার জন্য?”

“আমার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে তার জন্য”

“আমি খাবো না, এগুলো নিয়ে যাও”

“মাইর খাওয়ার আগে পাশে এসে বস”

কি আর করার ভদ্র মেয়ের মতো তার পাশে গিয়ে বসে পড়লাম। আদ্র ভাই প্লেট হাতে নিয়ে খাবার মাখানো শুরু করলো।
“আমাকে দাও আমি খেয়ে নিচ্ছি”

“কথা না বলে মুখ খোল”

আদ্র ভাই খুব যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছেন। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি। মানুষ এতটা যত্ন করে কাউকে ভালোবাসতে পারে? অবশ্যই পারে। আদ্র ভাই তার বড় প্রমান। আদ্র ভাই খাওয়ানো শেষ করে যত্নের সহিত মুখ মুছিয়ে দিলেন। হাত ধুয়ে পাশে বসলেন।
“হাত দে”

“হাত দিয়ে তুমি কি করবে?”

“তোর ভবিষ্যত বাণী করবো। কথা না বলে হাত দে”

হাত বাড়িয়ে দিলাম তার দিকে। আদ্র ভাই হাত উল্টো পালটে দেখলেন। অতঃপর হাক ছেড়ে ইভা কে ডাকলেন। ইভা এসে বলল,
“ভাইয়া ডাকছিলে?”

“হ্যাঁ। একটা মেহেদির কোণ নিয়ে আয় তো”

ইভা দৌড়ে যেয়ে নিয়ে এলো। আদ্র ভাইয়ের হাতে মেহেদীর কোনটা দিয়ে চলে গেল। আমি আদ্র ভাইয়ের দিকে তাকিয়ের তার মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছি। উনি মেহেদির কোণ ঘুরিয়ের ফিরিয়ে দেখছেন।
“মেহেদী দিয়ে তুমি কি করবে?”

“দেখতে থাক”

আদ্র ভাই আমার হাত কুশনের ওপর রেখে মনোযোগ দিয়ে কি যেন করছে। ভালো মতো খেয়াল করে দেখলাম উনি হাতে মেহেদী পড়াচ্ছেন। কিন্তু অবাক করা কান্ড হলো আদ্র ভাই ছেলে হয়েও যথেষ্ট ভালো করে মেহেদী দিচ্ছেন। উনার প্রতিভা দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি। দীর্ঘ সময় নিয়ে উনি মেহেদী পড়ানো শেষ করলেন। এক পাশে ছোট্ট করে তার নামের প্রথম অক্ষর লিখে দিলেন। চোখে চোখ রেখে বললেন,
“সবার হাত মেহেদীর রঙে রাঙা থাকবে আর আমার রৌদ্রময়ীর হাত ফেকাশে থাকবে এটা কখনোই হতে পারে না। রৌদ্রময়ীর হাত রাঙা হবে আমার ভালোবাসার ছোঁয়ায়”

আমি মুগ্ধ চোখে মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছি। একজন মানুষের ভালোবাসা না পেয়ে নিজেকে অনেক অভাগিনী মনে হয়েছিলো। কিন্তু এখন নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। কারন আদ্র ভাইয়ের মতো একজন মানুষ যে আমায় তার সকল সত্ত্বা উজার্ করে ভালোবাসে। তার ভালোবাসার কাছে পৃথিবীর সকল কিছু তুচ্ছ। হটাৎ মাথায় দুস্টু বুদ্ধি এলো। আদ্র ভাইকে একটু জ্বালাবো। উনার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
“এর আগে কতজনকে এভাবে মেহেদী পড়িয়েছো শুনি?”

“তুই প্রথম তুই’ই শেষে”

“তাহলেই এতো সুন্দর করে দিলে কিভাবে?”

“একটু আগে পাক্কা এক ঘন্টা বসে মেহেদির ভিডিও দেখে শিখেছি। তারপর তোর ওপর এপ্লাই করতে এসেছি। কেমন হয়েছে বলতো? পছন্দ হয়েছে?”

আমি আদ্র ভাইয়ের দিকে মুখ বেজার করে তাকালাম। আমার মুখের এক্সপ্রেশন দেখে তার মুখে আঁধার নেমে এলো।
“পছন্দ হয়নি? তাহলে ধুয়ে ফেল। আমি আবার দিয়ে দিবো। তাও মন খারাপ করিস না প্লিজ”

আদ্র ভাইয়ের অবস্থা দেখে হাসি পাচ্ছে। উনাকে দেখে মনে হচ্ছে উনি মারাত্মক কোনো ভুল করে ফেলেছেন। আদ্র ভাইয়ের করুণ অবস্থা দেখে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না। ফিক করে হেসে দিলাম।
“সত্যি বলতে তোমার মেহেদী দেওয়া অনেক সুন্দর হয়েছে”

“সত্যি বলছিস? নাকি আমার মন রক্ষার জন্য বলছিস”

“সত্যি বলছি”

আদ্র ভাই পাশে বসতে বসতে বলল,
“আমার কষ্ট সার্থক হলো”

আদ্র ভাইয়ের মুখে ফুটে আছে মুচকি হাসি। সেই হাসিতেই আটকে গেল আমার নয়ন জোড়া। এতটা স্নিগ্ধ সেই হাসি যার মায়ায় পড়ে যাচ্ছি আমি বারংবার। আদ্র ভাই শুরু করলেন তার গল্পের সমাহার। আদ্র ভাই আমার মন ভালো করার জন্য এটা সেটা বলে আমাকে হাসাচ্ছেন। আমিও খিলখিল করে তার কথায় হাসছি। হাসি যেন থামছেই না। আদ্র ভাই মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছেন আমার হাসির দিকে। আমিতো আমার মতো হেসেই যাচ্ছি। আদ্র ভাই হুট্ করে গাল টেনে দিয়ে বলল,
“এভাবেই হাসি খুশি থাকবি সবসময়”

আরো কিছুক্ষণ গল্প চলল। গল্প শেষে আদ্র ভাই চলে গেলেন। মনটা এখন ফুরফুরে। নিজেকে হাল্কা লাগছে। মাথা থেকে সকল চিন্তা বাদ দিয়ে ঘুমতে চেষ্টা করলাম। মুহূর্তের মাঝে ঘুমের দেশে হারিয়ে গেলাম।
—–

সকালের ফুরফুরে হাওয়া। রোদের আলো মুখে পড়তেই ঘুমটা হাল্কা হয়ে গেল। পিটপিট করে তাকাতেই নিজরে এলো স্নিগ্ধ সকাল। ব্যালকনিতে যেয়ে দাঁড়াতেই হিমেল হাওয়া মন ছুঁয়ে গেল। বাগানে সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটে আছে। দেখেই লোভ লেগে গেল। ইচ্ছে করছে ফুলগুলো ছুঁয়ে দেই। যেই ভাবা সেই কাজ। বাগানে চলে এলাম। খুব সকাল হওয়ায় এখনো সবাই উঠেনি। বাগানে ঘুরে ঘুরে ফুলগুলো ছুঁয়ে দিচ্ছি। পুরো বাগান জুড়ে বিচরণ হচ্ছে আমার। হটাৎ কেউ সামনে এসে দাঁড়ালো। মুখ তুলে দেখলাম আদ্র ভাই।
“এতো সকালে এখানে কি করছসি?”

“ঘুমভেঙ্গে গেছে তাই ব্যালকনিতে এলাম। ব্যালকনি থেকে ফুলগুলো দেখে লোভ লেগে গেল। তাই ছুঁয়ে দিতে এলাম”

আদ্র ভাই আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। পাশে থাকা গোলাপ গাছ থেকে একটা গোলাপ ছিঁড়ে নিয়ে আমার কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে ফিসফিস করে বললেন,
“আমার ফুলেররানী”

#চলবে?

#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব২১
#আফিয়া_আফরোজ_আহি

পুরো বাড়ি জুড়ে কোলাহল। মানুষ গিজগিজ করছে। বাচ্চারা পুরো বাড়ি জুড়ে ছুটোছুটি করছে। আমাদের বাগান বড় হওয়ায় সেখানেই বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। ভাইয়ারা সবাই বাগানে কাজে ব্যস্ত। একেক জন একেক দায়িত্বে আছে। আদ্র ভাই যেখানে খাবার রান্না হচ্ছে সেই দায়িত্বে আছে। ব্যালকনি থেকে তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। গাঁয়ের টিশার্ট ভিজে শরীরে সাথে মিশে রয়েছে। তবুও যেন তাকে সুন্দর লাগছে। এক ধ্যানে কতক্ষন যে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম সে খেয়াল নেই। হুস ফিরল রোশনির ডাকে।
“আপু তুমি এখনো রেডি হওনি? একটু পড়েই তো বরযাত্রী চলে আসবে”

রোশনির কথা শুনে তৈরি হতে গেলাম। ঈশিতা আপুর রুমে সবার ভীড় লেগেছে। আমি, ইভা, রোশনি আরো অনেকে মিলে সাজুগুজু করছি। একটু পর পর এক একজন এসে আপুকে দেখে যাচ্ছে। ঈশিতা আপুকে মেকআপ আর্টিস্ট সাজাচ্ছে। আপুর একটাই কথা তার বিয়েতে তার চেয়ে বেশি সুন্দর যেন কাউকে না লাগে। আমরা আমাদের মতো সাজগোজ করছি। এমন সময় নিচ থেকে শোনা গেল,
“বর এসেছে, বর এসেছে”

সাজগোজ বাদ দিয়ে সবাই ছুটছে সেদিকে। আমিও নিজেকে শেষে বারের মতো আয়নায় দেখে নিলাম। অতঃপর লেহেঙ্গা দুহাতে তুলে দৌড় লাগলাম। সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে নিবো এমন সময় কেউ হাত টেনে ধরলো। ভারী লেহেঙ্গা আর নিজেকে একসাথে সামলাতে না পেরে সামনের মানুষটার বুকে আছড়ে পড়লাম। আদ্র ভাই আমায় ঠিকঠাক ভাবে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললেন,
“নিজেকে সামলাতে পারে না, মেয়ে আসছে ভারী লেহেঙ্গা পড়তে”

তার কথা শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আমি কি সাধে এরকম ভারী লেহেঙ্গা পড়েছি নাকি সে কিনে দিয়েছে বলে পড়েছি। তার চেয়ে বড় কথা উনি আচমকা টান না দিলে এভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়তাম না। কোমরে হাত গুঁজে বললাম,
“লেহেঙ্গা কি আমি কিনেছি? নাকি তুমি কিনে দিয়েছো?”

“আমি কিনে দিয়েছি? তাহলে ঠিক আছে। এখন বলে এতো হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যাচ্ছিলি?”

“বর এসেছে তাই গেট ধরতে যাচ্ছিলাম”

“কোনো দরকার নেই”

“কেন?”

“সেখানে অনেক ছেলে থাকবে। ওখানে যেয়ে তোর কাজ নেই। তুই আমার সাথে চল। দেখে বলবি ডেকোরেশন কেমন হয়েছে?”

আদ্র ভাই আমার হাত ধরে তার সাথে নিয়ে যেতে লাগলেন। গেটে দুপক্ষের তুমুল ঝগড়া হচ্ছে। ইভারা যেই এমাউন্ট চেয়েছে ছেলে পক্ষ সেই এমাউন্ট দিবে না। এই নিয়ে দুই পক্ষ তর্কাতর্কি করছে। এক পর্যায়ে শিহাব ভাইয়ার এক ফ্রেন্ড বলল,
“আপনারা যেহুতু আমাদের ঢুকতেই দিবেন না। তাহলে আর কি করার, এই সবাই চলো আমরা চলে যাই”

সবাই তার সাথে সহমত পোষণ করলেন। কিন্তু শিহাব ভাইয়া তাকে টেনে কানে কানে বললেন,
“ভাই যা চাচ্ছে দিয়ে দে না। বউটা আমার সেই কখন থেকে আমার জন্য বসে আছে। তাকে দেখার জন্য তর সইছে না”

শিহাব ভাইয়ার ফ্রেন্ড তাকে বকা দিয়ে বলল,
“শা*লা বউ পা*গল”

আদ্র ভাই আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন। দেখানো শেষে জিজ্ঞেস করলো,
“সাজানো কেমন হয়েছে?”

“একদম জঘন্য। কে সাজিয়েছে বলো তো?”

আদ্র ভাইয়ের হাসি হাসি মুখটা মুহূর্তেই কালো মেঘে ছেয়ে গেল। করুণ ভাবে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“সত্যিই জঘন্য হয়েছে?”

আদ্র ভাইয়ের মুখের এক্সপ্রেশন দেখে হাসি পাচ্ছে। বেচারার করুণ অবস্থা। হাসি এটাকাতে না পেরে ফিক করে হেসে দিলাম।
“বোকা ছেলে সাজানোটা সুন্দর হয়েছে। আমি এমনি মজা করছিলাম”

“তবে রে”

আমাকে আর পায় কে। আদ্র ভাই আমার পিছু আসতে গিয়েও আটকে গেলেন। তাকে কে যেন ডাকছে। বিয়ে বাড়িতে ইভা, রোশনির সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কিন্তু বিরক্তির বিষয় হচ্ছে সেই কখন থেকে একটা ছেলে আমাদের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। ইচ্ছে করছে উস্টা দিয়ে দূরে পাঠিয়ে দেই। কিন্তু সেটা করা যাবে না। কারণ ছেলেটা শিহাব ভাইয়ের কাজিন। কি আর করার মেজাজ খারাপ নিয়েই দাঁড়িয়ে আছি। একটু পর কোথা থেকে আদ্র ভাই এসে হাত ধরে বলল,
“আমার সাথে চল”

আদ্র ভাই আমাকে সেখান থেকে নিয়ে আসতে আসতে বিরবির করে বলল,
“পুরান পা*গলের ভাত নেই নতুন পা*গলের আমদানি”

উনি বিরবির করে বললেও কথাটা আমার কানে এলো। উনার কান্ড দেখে মিটিমিটি হাসছি। আমাকে ঈশিতা আপুর কাছে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“এখানেই থাকবি। কোথাও যাবি না”

আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম। ঈশিতা আপু আর আমি গল্প করছি এমন সময় মেঝ আম্মুর আগমন ঘটলো। মেঝ আম্মুর চোখে পানি চিকচিক করছে। একমাত্র মেয়ের বিয়ের দিনে কষ্ট তো হবে। ঈশিতা আপু আমাদের পরিবারের বড় মেয়ে হওয়ার তাকে সবাই অনেক বেশিই ভালোবাসে। মেঝ আম্মু আর ঈশিতা আপু দুজন দুজনকে জড়িয়ে কান্না করছে। অজান্তে কখন আমার চোখও ভিজে গেল নিজেও জানি না। মেয়েদের জীবনটা এমন কেন? ভালোবাসার মানুষটার সাথে থাকার জন্য নিজের পরিবারকে ছেড়ে যেতে হয়। আচ্ছা আমার সাথে যখন আদ্র ভাইয়ের বিয়ে হবে তখন কি আমাকেও আমার পরিবার ছেড়ে যেতে হবে? এর মাঝেই ঈশিতা আপুকে নিচে নিয়ে যাওয়ার জন্য ডাক পড়লো। ইভা, রোশনি আপুর কাজিনরা মিলে ওকে নিয়ে গেল। আমি এখনো ভাবানায় বসে আছি। এমন সময় পাশ থেকে কারো ধাক্কায় ধ্যান ভাঙলো।
“কিরে ভাবনার রানী এখানে বসে কি ভাবছিস?”

আমার কি হলো জানি না ঘোরের মাঝে আদ্র ভাইকে জিজ্ঞেস করে বসলাম,
“আচ্ছা আদ্র ভাই আমাদের বিয়ের পর কি আমাকেও এভাব সবাইকে ছেড়ে যেতে হবে?”

“পাগলী মেয়ে আমাদের বাড়ি আর তোদের বাড়ি ১০-১৫ মিনিটের রাস্তা যখন ইচ্ছে হবে তখন চলে আসবি”

আদ্র ভাইয়ের কথা শুনে ঘোর কাটলো। কাকে কি বলে ফেলেছি এখন বুঝতে পারছি। ছি! কি লজ্জার বিষয়টা এখন আদ্র ভাইয়ের দিকে মুখ তুলে তাকাবো কিভাবে? লজ্জা লাগবে যে। আদ্র ভাই নিশ্চই ভাবছে আমি তাকে নিয়ে সারাক্ষন এসব আবোল তাবোল ভাবি। লজ্জায় মাথায় কাঁটা যাচ্ছে আমার। আদ্র ভাই আমার অবস্থা দেখে উচ্চস্বরে হেসে দিলো। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম।
“কি হয়েছে এমন হাসছো কেন?”

“একটা কথা ভেবে হাসছি”

“কি?”

আদ্র ভাই কাছে এসে চোখে চোখ রেখে বলল,
“এইযে রৌদ্রময়ী পুরোপুরি আমার ভাবনায় ডুবে যাচ্ছে। তার ভাবনার শহরে আমার বিচরণ হতে শুরু করছে। তার সত্ত্বায় আমার অস্তিত্ব অনুভব করছি”

আদ্র ভাইয়ের কথায় মাথা নিচু করে নিলাম। দুজনের মাঝে নীরবতা। আদ্র ভাই কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। অতঃপর যেতে যেতে বললেন,
“এখন বিয়ে পড়ানো হবে। দেখলে তাড়াতাড়ি আয়”
——–

মাঝে কেটে গেছে কয়েকটা দিন। আপু আর শিহাব ভাই বিয়ের পর এসে দেখা করে গেছে। ইভান ভাই সেই যে এসেছে এর মাঝে আমার সাথে তার কোনো কথা হয়নি। কথা হয়নি বলতে আমিই তাকে এড়িয়ে গিয়েছি যথাসম্ভব। তিনি অনেক বার কথা বলতে চাইলেও আমি তাকে সেই সুযোগ দেই নি। বিকেলে পড়তে বসলে টেবিলে চিরকুট দেখে অবাক হয়েছিলাম। সেখানে লিখা ছিলো,
“আমি জানি আমি তোর কাছে অপরাধী। আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি। আমায় কি একবার ক্ষমার চাওয়ার সুযোগ দেওয়ার যায়না রোদ। একটা বার ক্ষমা চাইতে দে তোর কাছে। যদি তোর ইচ্ছে হয়ে সন্ধ্যা বেলা ছাদে আসিস, অপেক্ষায় থাকবো তোর”

লিখাটা পড়ে বুঝতে দেরি হলো না মানুষটা কে। কিন্তু এখন আমার কি করা উচিত? তার সামনাসামনি যাওয়া। মানুষ ভুল করতেই পারে তাকে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ করে দিতে হয়। আর এখন এমনিও তার প্রতি আমার কোনো অনুভূতি নেই। তাই যাওয়াই যায়।

সন্ধ্যার সময় সূর্য অস্ত যাচ্ছে। চারদিক আঁধারে ছেয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। ছাদে উঠতেই নজরে এলো ইভান ভাইকে। তিনি উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি নিঃশব্দে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
“এসেছিস? সময় হলো তাহলে। কেমন আছিস?”

“সময় তো সবার জন্য থাকে না। আলহামদুলিল্লাহ যথেষ্ট ভালো আছি”

“আমাকে তো জিজ্ঞাসা করলি না কেমন আছি”

“ভালো থাকার জন্যই তো আমার জীবনটা নষ্ট করেছেন”

“আমি ভালো নেই রোদ, একটুও ভালো নেই। তুই ঠিকই বলেছিলি যার জন্য এত কিছু করলাম সেই আমায় ছেড়ে গেছে। ভালোবাসেনি আমায়,আমি শান্তিতে নেই রোদ। তোর সাথে অন্যায় করে আমি সেই শাস্তি পাচ্ছি। প্লীজ আমাকে ক্ষমা করে দে। আমি ভালবাসায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম,উন্মাদ হয়ে তোকে যে শাস্তি দিয়েছি সেগুলো ভাবলে আমার বুকে ব্যাথা করে”

“আপনাকে অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি। কিন্তু আপনার প্রতি ঘৃণা আর শাস্তি থেকে পাওয়া শিক্ষা কখনো ভুলবো না। জানেন ইভান ভাই আমরা মানুষ বড়ই স্বার্থপর নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করি আবার ছুড়ে ফেলে দেই। যে মানুষটাকে হাজারো কথা শুনিয়ে অপমান করছেন আজকে সেই মানুষটার কাছে এসে নিজেকে নত করছেন বিষয়টা হাস্যকর তাই না”

“ভুল বুঝতে পেরেছি একটাবার সুযোগ দে তোকে আগলে রাখার বিশ্বাস কর দ্বিতীয়বার আর চোখের জল ফেলতে দেবো না কথা দিচ্ছি”

“মানুষ অজান্তে যেটা করে সেটা ভুল আর আপনি তো সবটা জেনে বুঝে করেছেন এটাকে ভুল বলে না অন্যায় বলে। সুযোগ আপনি একবার পেয়েছিলেন ধরে রাখতে পারেন নি। ভালো আমি অন্য কাউকে বাসি। ভালো কাউকে খুঁজে নিন ভালো থাকবেন। এবার তো বুঝেছেন কাছের মানুষ আঘাত করলে কেমন লাগে, বলেছিলাম না আল্লাহ ছাড় দেয় তবে ছেড়ে দেয় না”

“একবার খারাপ হয়েছি ভুল মানুষকে ভালোবেসে। আবারো খারাপ হব কিন্তু সঠিক মানুষকে জীবনে ফিরে পেতে। তুই যতই চেষ্টা কর আমার তো তোকেই লাগবে আর তুই তো আমারই হবি, দেখতে থাক কি হয়’

“স্বপ্ন দেখা ভালো তবে দুঃস্বপ্ন নয়। আগে দূর্বল ছিলাম। ফ্যামিলিকে ভালবাসতাম যেটার মধ্যে আপনিও ছিলেন। কিন্তু যখন জীবনটা নরক করে দিয়েছন তখন দ্বিতীয়বার ফিরে আসলে আর সহ্য করবো না। আমি আগের রোদ নেই,পাল্টা আঘাত পাবেন। তাই পারলে চলে যান কখনো আমার সামনে আসবেন না আশা করি”

“তুই যাকেই ভালোবাস তোকে আমার হতেই হবে।সেটা তোকে সোজা ভাবে রাজি করাতে হলে করবো নয়তো উল্টা রাস্তা ধরবো। আমি দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছি। এতদিন আসিনি তোকে সময় দিয়েছি নয়তো তোর ওপর নজর আগে থেকেই আছে”

“বললাম তো আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি, নিঃশ্বাস থাকতে আপনার মতো অমানুষ কে আমি কখনও মেনে নিবো না। নিঃশ্বাস থাকতে আমি আপনার হবো না। কখনো না ,মনে রাখবেন”

“কিন্তু আমার তোকেই লাগবে”

“যেখানে আমার প্রতিটা নিঃশ্বাসে অন্য কারো বসবাস সেইখানে আপনাকে কি করে দেবো ঠাঁই দিবো ইভান ভাই? এটা নিছক স্বপ্ন আপনার”

“তোর এক তরফা ভালোবাসার যন্ত্রণার সাথে আমারও পরিচয় হয়ে গেলো রোদপাখি”

“তাহলে বইতে দিন সেই কষ্টের স্রোত। এটা আপনার প্রাপ্য”

“কিন্তু তোর মত সহ্য ক্ষমতা আমার নেই রোদ পাখি। আমি শেষ হয়ে যাবো তোকে ছাড়া। সেটা বুঝে গেছি এই ৪ বছরে”

“আমি অনেক আগেই মারা গিয়েছি ভেতর থেকে তবে কেউ একজন যত্ন করে বাঁচতে শিখিয়েছে। আপনিও নতুন করে বাঁচতে শিখুন ইভান ভাই।আপনার দ্বারা সম্ভব হবে না এক তরফা ভালোবাসার কষ্ট সহ্য করার”

“তোকে লাগবে আমার রোদ পাখি”

“আপনার মুখে এটা মানায় না ইভান ভাই।সব স্বপ্ন পূরণ হয়না । আর যার কাছ থেকে আপনি আমায় কেড়ে নিতে চাইছেন সে আমি ছাড়া নিঃস্ব । আমিও তাকে ছাড়া নিঃস্ব। আসি, নিজের খেয়াল রাখবেন”

আমি চলে আসতে নিলে ইভান ভাই বহু ধরে আমায় আটকে দিলেন।
“আমি অপেক্ষা করব। আমি চেষ্টা করবো সব দিক থেকে, তোকে আমার হতেই হবে। তুই শুধু আমার হবি, অন্য কারো না”

ইভান ভাই আমার খুবই কাছে। ছাদের দরজার সামনে কিছুর শব্দ পেলাম। চোখ ঘুরিয়ে সেদিকে তাকাতেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। আদ্র ভাই দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।

#চলবে?