উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন পর্ব-২৭

0
175

#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব২৭
#আফিয়া_আফরোজ_আহি

ড্রয়িং রুম জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কুশন । ইভা আমার পিছু ছুটছে তবে নাগাল পাচ্ছে না। ইভা সোফার সামনে আমি পিছনে। ইভা আমার নাগাল না পেয়ে সোফার কুশন ছুড়ে মারছে তাও আমি ক্যাচ করে নিচ্ছি। বেচারি না পারছে ধরতে না পারছে কিছু করতে। ইভা আবার ছুট লাগলো আমার পিছু। দুজন ছুটোছুটি করছি এমন সময় সামনে পড়লো প্রিয়ম ভাবি। ভাবির হাতে বাটিতে কি যেন পড়তে পড়তেও বেঁচে গেল।
“কি নিয়ে দুজন এমন বাচ্চাদের মতো ছুটোছুটি করছো শুনি? আরেকটু হলেই আমার হাতের বাটিটা পরে যেত”

“আরে ভাবি বলো না ইভা রানীর হতে হতে যাওয়া প্রেম টা হওয়ার আগে ব্রেকাপ হয়েছে গেছে বলে ও আমায় তাড়া করছে”

ভাবি কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো,
“মানে? কি বলছো বুঝিয়ে বলো”

ইভা আমায় চোখ রাঙিয়ে বলল,
“আরে ভাবি কিছু না। ওর কথা বাদ দেও তো জানোই তো ও একটা পা*গল”

বলেই ইভা দৌড়ে লাগলো। ওকে আর পায় কে। পিছন থেকে চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,
“কি বললি আমি পা*গল? দাঁড়া আসছি”

এতক্ষন ইভা আমার পিছু ছুটলেও এখন আমি ওর পিছু ছুটছি। দুজন দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে ছাদে এসে থামলাম। এখন আর যাওয়ার জায়গা নাই। দুজন হাপিয়ে গিয়েছি। ইভা হাত জোর করে বলল,
“মাফ করে বইন আর দৌঁড়াতে পারবো না”

দুজনেই ধপ করে দোলনায় বসে পড়লাম। একজন আরেকজনের পিঠে পিঠ লাগিয়ে বসে বড় বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। ইভা বলল,
“তোর মতো হা*রামি মার্কা বোন থাকালে আমায় চিরজীবন সিঙ্গেলই থাকতে হবে”

“তুই হা*রামি। তোর সাহস তো কম না তুই আমায় না জানিয়ে প্রেম করতে চাস? তাই প্রেম হওয়ার আগেই ব্রেকাপ করিয়ে দিলাম”

ইভার মনটা খারাপ হয়ে গেল। মুখ গোমড়া করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
“বনু তুই সিরিয়াস?”

“তোর কি মনে হয়?”

ভাবনায় পরে গেলাম। ইভা সব সময় ফাইজলামি করলেও এখন চুপ মেরে আছে। তারমানে কি ও সত্যিই পিয়াস কে পছন্দ করে? ইভার দিকে ফিরে বললাম,
“বনু সরি! আমি কালকে পিয়াসকে বুঝিয়ে বলবো তুই প্লিজ রাগ করিস না”

“ইটস ওকে সমস্যা নেই”

ইভার মুড অফ ভালো লাগছে না। আমরা দুজন কাজিন কম বন্ধু বেশি। নিজে থেকে কথা শুরু করলাম। একসময় ইভাও আগের রূপে ফিরে এলো
গল্প করতে করতে দুজন হাসিতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা। আমরা দুজন এমনই যখন আমরা আমাদের মুডে থাকি আশেপাশে খেয়াল করার সময় নেই। আগে হেসে নেই। ইভার সাথে আড্ডা দিতে দিতে সময় যে কন দিক দিয়ে চলে গেল তার ঠিক নেই।
——

মেডিকেলে ক্লাস শেষ হতেই উঁকি দিলাম শুভ ভাইয়ের কেবিনে। উঁকি দিতেই দেখতে পেলাম শুভ ভাইয়ের সামনে তিথি আপু দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে রণচন্ডি রূপ ধারণ করছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে আজকে শুভ ভাইয়ের কপালে শনি আছে। তিথি আপু একটু একটু করে এগিয়ে আসছে আর শুভ ভাই পিছিয়ে যাচ্ছে।আপু রাগে গর্জে উঠে বলল,
“ওই মুন্নি নাকি চু*ন্নি ওর সাথে আপনার এতো কিসের আলাপ? এতো কি কথা দুজনের মাঝে? একেবারে গাঁয়ে গাঁ গেসে দাঁড়িয়ে ছিলেন দুজন। দেখে মনে হচ্ছে কাপল। ও আপনার আশেপাশে কি করে?”

“মুন্নি পড়া বুঝতে এসেছিলো। একটা টপিক বুঝতে পারেনি তাই”

“পড়া বুঝতে না পারলে ক্লাসে বলবে। ক্লাসের বাহিরে আপনার সাথে কোনো মেয়ে কথা বলতে পারবে না”

“তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছ ও আমার স্টুডেন্ট। পড়া বিষয়ক কোনো সমস্যা হলে আমার দায়িত্ব ওকে বুঝিয়ে দেওয়া”

“পড়া বুঝার দরকার পড়লে ক্লাসে বুঝবে। বাহিরে আপনার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে না”

“এইযে তুমি এখন আমার এতটা কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলছো এটা?”

“আমার বেপার আলাদা”

“তুমি আলাদা কেন?”

“জানি না”

এরপর দুজনের মাঝে নীরবতা। শুভ ভাই পিছাতে পিছাতে আটকে গেল টেবিলে। তিথি আপু শুভ ভাইয়ের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে চোখে চোখে রেখে বলল,
“এরপর যদি আপনার আশেপাশে কোনো মেয়েকে আমি দেখেছি মিস্টার শুভ তাহলে আপনার খবর আছে। আমি কিন্তু ভালো মেয়ে নই যে আমার ভালোবাসার মানুষের পাশে অন্য কাউকে দেখে চুপচাপ থাকবো। খু*ন করে ফেলবো তাকে”

“এই পর্যন্ত কতো গুলো খু*ন করেছো?”

“একটাও করিনি। তবে প্রয়োজন পড়লে আপনার জন্য আমি খু*নি হবো। তাও আপনার পাশে অন্য কাউকে সহ্য করতে পারবো না”

শুভ ভাই তিথি আপুর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এতো ভালোবাসো মেয়ে?”

“সন্দেহ আছে?”

“মাঝ সমুদ্রে ঝাঁপ দিচ্ছ মেয়ে। শেষে দেখা যাবে কুল কিনারা খুঁজে পাবে না”

“কুল কিনারা লাগাবে না। আমার আপনাকে পেলেই চলবে। আর আপনার ভালোবাসার অতল গহীন সমুদ্রে আমি ডুবে ম*রতেও রাজি আছি”

শুভ ভাই চুপ করে গেলেন। হয়তো কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। তাই তিথি আপুকে বললেন,
“আমার কাজ আছে তুমি এখন যাও তো”

তিথি আপু যাওয়ার আগে ফের বলে গেলেন,
“লাস্ট বার বলছি অন্য কোনো মেয়েকে আপনার আশেপাশে দেখলাম খবর আছে বলে দিলাম”

তিথি আপুকের বের হতে দেখে সাইডে চলে গেলাম। আপু বেরিয়ে চলে গেল। সত্যি বলতে ভালোবাসা দেখতেও সুন্দর লাগে। এইযে আমার কাঠখোট্টা, গম্ভীর, কম কথা বলা, শান্তশিষ্ট ভাইটা তিথির আপুর সামনে কেমন ভিজে বেড়াল হয়ে গেল। ভাবি হিসেবে তিথি আপুকে আমার ভালোই লাগে। শুভ ভাইয়ের রুমে ঢুকে জিজ্ঞেস করলাম,
“ভাইয়া বাসায় যাবে না?”

“না আমার একটা অপারেশন আছে। তুই আর ইভা চলে যা”

শুভ ভাইয়ের কেবিন থেকে বেরিয়ে ইভাকে নিয়ে বাড়ি চলে এলাম।

——-

শুক্রবারের দিন হওয়ায় প্রায় সবাই বাসায় আছে। আজকে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছে। উঠে কোনো রকম ফ্রেশ হয়ে চোখ ডলে ডলে নিচে নামছি। ড্রয়িং রুমের সোফায় বড় আব্বু, আব্বু, অভ্র ভাই, আদ্র ভাই আর শুভ ভাই মিলে কিছু নিয়ে আলোচনা করছেন। আমার ভাইটাকে ইদানিং কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় যে ভাই আমার হারিয়ে গেছে বুঝতেও পারছি না। ভাইয়ের আফসোস বাদ দিয়ে খেতে বসালাম। খাবার খাচ্ছি এমন সময় পাশ বসে আদ্র ভাই বলল,
“আমায় একটু দে”

ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
“কেন? তুমি খাও নি?”

“খেয়েছি তো। কিন্তু তোকে খেতে দেখে লোভ লাগছে”

“নিজে নিয়ে খাও”

“আগেই ভালো ছিলো অসুস্থ ছিলাম কি সুন্দর করে নিজ হাতে খাইয়ে দিতি আর এখন নিষ্ঠুর রমণী হয়ে গিয়েছিস”

“হলে হয়েছি, এখন সরো তো”

“আরে বেশি খাবো না একটু দে”

“ওখানে আব্বু আর বড় আব্বু বসা এদের সামনে আমি তোমায় খাইয়ে দিতে পারবো না”

“আরে ওরা দেখবে না। আর দেখলেও বা কি আমি আমার বউয়ের হাত থেকেই খাবো এতে কার কি?”

আমি চকিতে উনার দিকে তাকালাম। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“বউ?”

“ভবিষ্যত বউ আর বউ একটা হলেই হলো। বউ তো তুই আমারই হবি তাই না?”

“জেগে জেগে স্বপ্ন দেখো”

“স্বপ্ন তো আমি তোকে নিয়ে সারাদিনই দেখি এখন ঝটপট একটু খাইয়ে দে”

আমি তাকে পাত্তা না দিয়ে পরোটা নিজের মুখে দিতে নিলাম। আদ্র ভাই টুপ করে আমার হাত থেকে খেয়ে নিলো। পাশ থেকে উঠে যেতে যেতে চোখ টিপ দিলো। আমি ভেবেচেঁকা খেয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি। আদ্র ভাই এখন আলহামদুলিল্লাহ প্রায় সুস্থ হয়ে গেছেন। তার মাথার ব্যান্ডেজও খোলা হয়ে গিয়েছে। মন থেকে অনেক বড় একটা পাথর নেমে গেছে। মানুষটা সুস্থ আছে এতে আল্লাহর কাছে অনেক অনেক শুকরিয়া।

বিকেলে সব ভাই বোন মিলে আড্ডা বসেছে। অনেক দিন পরে সবাই একসাথে হয়েছি। যদিও বাকি রয়ে গেছে অনেকে। আড্ডায় আমি, ইভা, রোশনি, প্রিয়ম ভাবি, আদ্র ভাই, শুভ ভাই, অভ্র ভাই, রুদ্র ভাই সবাই সোফা দখল করে বসেছি। তবে ঈশিতা আপুকে মিস করছি। আপু থাকলে আড্ডার মাঝে বিভিন্ন আবদার করা যায়। ঈশিতা আপুর জন্য একটু মন খারাপ হলেও সেটা সাইডে রেখে আড্ডায় মন দিলাম।

গোধূলি লগ্নে এলোকেশে ছাদে দাঁড়িয়ে আছি। একটু পর পরে দমকা হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে আবেশে। গোছানো কেশগুচ্ছ নিমিষেই এলোমেলো করে দিচ্ছে। তবে আমার মাঝে এলোমেলো চুল ঠিক করার প্রবনতা নেই। স্নিগ্ধ বাতাস বড্ড ভালো লাগছে। এক নিমিষেই মন ভালো হয়ে যাচ্ছে। ছাদের রেলিংয়ে ভর করে নিচের দৃশ্য দেখছি। পাশের মাঠে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে। ক্রিকেট নিয়ে তাঁদের মাঝে কি উত্তেজনা। এমন সময় পাশে এসে দাঁড়ালো কেউ। তাকিয়ে দেখি আদ্র ভাই। উনাকে দেখে মুচকি হাসি দিলাম। আদ্র ভাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
“চুরি করা শিখলি কবে থেকে?”

অবাক চাহনি দিয়ে আদ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। আমি আবার কখন তার কি চুরি করলাম। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
“মানে? আমি কার কি চুরি করলাম?”

আদ্র ভাই বুকে হাত গুঁজে দাঁড়ালেন। ভাব নিয়ে বললেন,
“এইযে আমার সহজ সরল মনটা চুরি করে নিলি”

হাফ ছেড়ে বাঁচালাম। এই লোকটা মাঝে মাঝে এমন ভয় পাইয়ে দেয় যে কি বলবো। আমিও তার মতো ভাব নিয়ে বললাম,
“এখন কি আমার নামে মামলা দিবে? পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে আমায়? অতঃপর আটকে রাখবে জেল খানায়?”

“আটকে তো রাখা হবে তবে জেল খানায় না আমার হৃদয়কুঠুরিতে। যেখান থেকে তোর মুক্তি নেই”

“আমি সেই কুঠুরিতে বন্ধি হয়ে থাকতে চাই আজীবন”

আদ্র ভাই এগিয়ে গেলেন। ছাদের একপাশে রাখা গোপাল ফুল গাছ থেকে গোলাপ ছিঁড়ে নিয়ে এলেন। সযত্নে তা গুঁজে দিলেন আমার কানে। এমন সময় চোখ পরলো ইভান ভাইয়ের দিকে। তিনি ছাদের দরজার দাঁড়িয়ে আছেন। কানে ফোন ধরে রাখা। হয়তো কারো সাথে কথা বলছিলেন। আমাদের দেখে সেখানেই থমকে গেলেন। আদ্র ভাই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“চোখে কাজল পড়েছিস কেন? আমায় তোর ওই ঝিল আঁখিতে ডুবিয়ে মারতে চাইছিস? তবে শুনে রাখ তোর ওই আঁখিতে আমি বরং বার এমনি ডুবে যাই তার জন্য কাজল লাগবে না”

আদ্র ভাইয়ের প্রতিটা কথা মন ছুঁয়ে যায়। ইভান ভাই এখনো আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। হাত বাড়িয়ে আদ্র ভাইয়ের গোছানো চুল গুলো এলোমেলো করে দিলাম। আদ্র ভাই আমার কাণ্ডে মুচকি হেসে দিলেন। আমি তাকিয়ে আছি তার ওই হাসির দিকে। কি মোহনীয় আর স্নিগ্ধ সেই হাসি। এই হাসিতেই যে আমি প্রতিবার ফেঁসে যাই। ইভান ভাই রক্তিম চোখে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। তিনি হাত মুষ্ঠীবদ্ধ করে রাগ সামলানোর চেষ্টা করছেন। রাগ সামলাতে না পেরে গটগট পায়ে সেখান থেকে চলে গেলেন। মনে মনে হেসে বলে উঠলাম,
“সবে তো শুরু মিস্টার ইভান। দেখবেন, জ্বলবেন আর লুচির মতো ফুলবেন”

আদ্র ভাইয়ের সাথে মন খুলে আড্ড দিচ্ছি। উনি আবার সেই আগের মতো ফানি ফানি কথা বলছে আর আমি তার কথায় হেসে কুপোকাত। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাচ্ছে। দুজন একসাথে হাসছি। হাসতে হাসতে খেয়াল করলাম আদ্র ভাই আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। আমার অবস্থান ছাদের রেলিংয়ের সাথে পিছিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এক সময় আদ্র ভাই খুব কাছে এসে দাঁড়ালেন। একজন অপর জনের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পারছি। আদ্র ভাই আমার দিকে ঝুঁকলেন। আমি ভয়ে চোখ বুজে নিলাম। আদ্র ভাইয়ের নিঃশ্বাস আমার মুখের ওপর আছড়ে পড়ছে। কিছুক্ষণ পর কোনো কিছু অনুভব করতে না পেরে চোখ খুলে নিলাম। দেখলাম আদ্র ভাই আমার থেকেই কিছুটা দূরে অবস্থান করছে।
“তুই কি ভেবেছিস আমি তোর কাছে যাবো? উহু কখনোই না। আমার রৌদ্রময়ী শুভ্র, পবিত্র আমি চাইনা তার গায়ে কোনো কলঙ্ক লাগুক। তুই আমার হালাল ভালোবাসা, তোকে আমি হারাম ভাবে স্পর্শ করতে চাই না। তোকে হালাল ভাবে নিজের করে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে দিবো”

#চলবে?