উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন পর্ব-৩২+৩৩

0
5

#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব৩২
#আফিয়া_আফরোজ_আহি

রাতের আঁধারে ঢাকা চাদর সরিয়ে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে চারদিকে। সূর্যের আলোয় আলোকিত ধরিত্রী। মুখে এসে আলো পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। পিটপিট করে চোখ খুলে নিজেকে কারো বাহুডোরে আবিষ্কার করলাম। মানুষটা আমায় আবেশে আগলে রেখেছে নিজের হৃদয় মাঝারে। তার উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে রেখেছে আমায়। আদ্র ভাই দোলনার সাইডে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে আর আমি তার বুকের মাঝে। রাতে দুজনে গল্প করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছি সে খেয়াল নেই। মুখ তুলে চাইতেই আদ্র ভাইয়ের ঘুমন্ত মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। কি সুন্দর লাগছে মানুষটাকে। উনাকে এতো সুন্দর হতে হবে কেন? এইযে উনি এতটা সুন্দর না হলে আমি বেহায়ার মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম না। আদ্র ভাইয়ের হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে উঠে বসলাম। আদ্র ভাইয়ের মুখের ওপর এক গোছা চুল এসেছে পড়েছে। আলতো হাতের সেগুলো সরিয়ে দিলাম। ইচ্ছে করছে ওনার চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে। যেই ভাবা সেই কাজ। হাত বাড়িয়ে আদ্র ভাইয়ের চুল গুলো এলোমেলো করে দিলাম। এখন ওনাকে পুরো কিউট বাচ্চা বাচ্চা লাগছে। উনার এমন অবস্থা দেখে খিলখিল করে হাসতে গিয়েও হাসি আটকে নিলাম। এখন হাসা মানেই বিপদ। আমার হাসির শব্দ শুনে ওনার ঘুম ভেঙ্গে গেলে আমাকেই লজ্জায় পড়তে হবে। তাই হাসি আসলেও নিজেকে সামলে নিলাম। আদ্র ভাইয়ের নাক টেনে দিলাম। মাথায় ঘুরছে ওনাকে জ্বালানোর উল্টোপাল্টা বুদ্ধি। বুদ্ধি গুলো ধামা চাপা দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। এখন সকাল কেউ ছাদে আসেনি। কেউ ছাদে এসে আমাদের এই অবস্থায় দেখলে কেলেঙ্কারি লেগে যাবে। তাই এখন চলে যাওয়া টাই ভালো। আদ্র ভাইকে ডাকবো কি ডাকবো না করেই দেখেই ফেললাম।
“আদ্র ভাই, এই আদ্র ভাই। ওঠো, সকাল হয়ে গেছে”

আদ্র ভাই পিটপিট করে চোখ মেলে চাইলো। ভ্রু কুঁচকে বোঝালো,
“কি হয়েছে?”

“ওঠো, রুমে গিয়ে ঘুমাও”

উনাকে বলে আমি চলে আসলাম। সকাল সকাল মনটা যেন ফুরফুরে হয়ে গেল। প্ৰিয় মানুষটার বুকে মাথা রেখে তার মুখ দেখে সকাল হলে কার না আনন্দে মন নেচে উঠবো। রুমে এসে বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিতেই ঘুম পেয়ে গেল। রাত জেগে গল্প করায় ঘুম হয়নি ঠিক মতো। চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে দশটা বেজে দশ মিনিট। আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসলাম। উঠে চলে গেলাম ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে ড্রয়িং রুমে নজর বুলালাম। সোফায় বসে মহাশয় রোশনি, রৌশন এর সাথে দুস্টুমি করছে। তার এই দুস্টু মিষ্টি স্বভাব আমার বড্ড ভালো লাগে। এইযে নিমিষেই কারো সাথে মিশে যেতে পারে। উনার থেকেই চোখ সরিয়ে টেবিলে বসালাম। বড় আম্মু খাবার বেড়ে দিতে দিতে বলল,
“কিরে আজ এতো দেরি করে উঠলি যে?”

বড় আম্মুর কথা শুনে আদ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। তাকাতেই চোখে চোখি হলো। আদ্র ভাই টুপ করে চোখ মেরে দিলেন। টাস্কি খেয়ে গেলাম। নিজেকে সামলে উনার থেকে চোখ সরিয়ে বড় আম্মুকে বললাম,
“আরে বলো না আজকে ছুটির দিন তাই উঠতে দেরি হয়ে গেছে”

“ঠিক আছে খেয়ে নে। তোদের নিয়ে আর পারিনা। একেক জন একেক দিকে যাস। এই দেখ কাল থেকে ইভানের দেখা নেই। ছেলেটাকে এতো করে ফোন দিলাম ধরলো না। পরে শুভ বলল ও নাকি কোন ফ্রেন্ড এর বাড়ি গিয়েছে। কয়েকদিন সেখানেই থাকবে। যাবি ভালো কথা বলে যাবি না? মায়ের মন তো ছেলে মেয়ের জন্য সব সময় চিন্তা হয়। কিন্তু ওরা বুঝলে তো”

বড় আম্মু বিরবির করতে করতে চলে গেল। আমি তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বড় আম্মু যদি জানতে পারে তার ছেলের কর্মকান্ড তাহলে কতোটাই না কষ্ট পাবে। বড় আম্মু আমাকে তার মেয়ের মতোই আদর করে। মাঝে মাঝে তো এমনও হয়েছে ইভা আর আমার ঝগড়া লাগলে বড় আম্মু ইভাকে বকে দিয়েছে। তাও আমায় কিছু বলেনি উল্টো আমায় আদর করে দিয়েছে। সে যদি জানতে পারে তার ছেলে আমার সাথে কি করতে চেয়েছিলো তবে বড় আম্মুও ইভান ভাইয়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতো। তবে ভালো হয়েছে শুভ ভাই সব সামলে নিয়েছেন। ভাবনা বাদ দিয়ে খাওয়ায় মন দিলাম। খেয়ে উঠে সোফায় বসতে নিয়েও বসালাম না। এখন আদ্র ভাইয়ের সামনে বসলেই আমায় লজ্জা পেতে হবে। একবার ওনার দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিবো এর আগেই আদ্র ভাই আমার দিকে ফ্লাইং কিস ছুড়ে দিলেন। আমি চোখ রাঙিয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে আছি। পাশে বসা রৌশন, রোশনি গল্পে মশগুল। বাই এনি চান্স ওরা দেখে নিলে কি হতো? এই লোকটা ইদানিং কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। আগের আদ্র ভাই এখন আর নেই,তার মাঝে ভর করছে বেশরম এক সত্ত্বা। এইযে হুটহাট চুমু দিচ্ছে, চোখ টিপ দিচ্ছে। আদ্র ভাইয়ের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে ধূপধাপ পা ফেলে রুমে চলে এলাম। নাহয় ওখানে থাকলে আমায় আরো লজ্জা পেতে হতো।
——-

শুক্রবার দিন হওয়ার সবাই বাড়িতে আছে। কিছুক্ষন ব্যালকনিতে থাকা গাছগুলোর পরিচর্যা করে গোসলে ঢুকলাম। একটা নীল রঙের থ্রিপিস পড়ে বের হলাম। চুল থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে পানি পড়ছে। জামার পিছন দিকে অনেক টা জায়গা ভিজে গিয়েছে। এমন সময় রুমে প্রবেশ করলো আম্মু। ঢুকেই তার বকাবকি শুরু হয়ে গেল। আমার হাত থেকে টাওয়াল নিয়ে চুলগুলো মুছে দিতে দিতে বলল,
“এতো বড় মেয়ে হয়েছে এখনো চুল ঠিক করে মুছতে পারে না। দুদিন পড়ে শশুর বাড়ি যেয়ে কি করবি? তখনও কি এভাবেই বেখেয়ালি হয়ে ঘুরে বেড়াবি? এমন বেখেয়ালি ভাবে ঘুরলে এক দরজা দিয়ে নিয়ে যাবে অন্য দরজা দিয়ে ফিরত দিয়ে যাবে”

আম্মুর কথা শুনে খিলখিল করে হেসে দিলাম। আম্মুর এই শাসন গুলো আমার বড্ড আদুরে লাগে। এই শাসনের মাঝেও আমি এক রাশ ভালোবাসা খুঁজে পাই। আমি চাইলেই চুলগুলো সুন্দর করে মুছতে পারি কিন্তু মুছিনি কারণ শুক্রবার আমি বাসায় থাকলে আম্মু এই সময় আমার রুমে আসবে। তাই আম্মুর শাসন নামক আদর পাওয়ার জন্য আমি ইচ্ছে করেই চুলগুলো ঠিক মতো মুছিনি। আম্মু চুল মুছে দিয়ে ঘর গুছাতে গুছাতে আমার চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করা শুরু করলো। আমি হাসতে হাসতে রুমে থেকে বেরিয়ে এলাম। নিচে নেমে দেখি রৌশন, রোশনি, ইভা বসে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আমিও ওদের সাথে বসে পড়লাম। ভাবি আর বড় আম্মু মিলে টেবিলে খাবার এনে রাখছে। শুক্রবার দিনটা আমাদের বাসায় প্রায় পিকনিক টাইপ হয়। শুক্রবার সবাই একসাথে বসে দুপুরের খাবার খাওয়া হয়। এমনি দিন তো আব্বুরা অফিসে থাকে, আমরা ছোটরা যার যার স্কুল, কলেজে থাকি। এই শুক্রবার দিনটাই সবার একসাথে কাটানো হয়।

আড্ডা দিচ্ছি এমন সময় দরজা দিয়ে কারো আগমনের শব্দে সেদিকে তাকালাম। একে একে বড় আব্বু, আব্বু, অভ্র ভাই, শুভ ভাই ঢুকছে। সবার শেষে আসলেন আদ্র ভাই। ওনার পরনে নীল পাঞ্জাবী, সাদা পায়জামা। পাঞ্জাবীর হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো, বাম হতে ঘড়ি। চুল গুলো গুছিয়ে রাখা। তাকে দেখে একদফা প্রেমে পড়ে গেলাম। কেমন বেহায়ার মতো উনার দিকে তাকিয়ের থাকতে ইচ্ছে করছে। ভাবতেই অবাক লাগে এই সুদর্শন মানুষটা আমার বর। শুধুই আমার। অবাক করা বিষয় হলো আমাদের দুজনের পরণেই নীল রং। দুজনের মনের সাথে কাপড়ের রংও মিলে গিয়েছে। ওনার থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। একে একে সবাই এসে পুরো সোফা জুড়ে বসে পড়লো। একটু পড়েই সবার ডাক পড়লো খাওয়ার জন্য। সবাই যার যার মতো বসেছে। আমার জন্য খালি আছে একটা চেয়ার। সেটা আদ্র ভাইয়ের বরাবর। কোনো কিছু না ভেবে বসে পড়লাম। নিচের দিকে তাকিয়ে খাবার খাচ্ছি এমন সময় পায়ে কারো ছোঁয়া অনুভব করলাম। তবে আমলে না নিয়ে খাওয়ায় মন দিলাম। হয়তো ভুলে কারো পা লেগেছে। তবে ক্রমশ পায়ের বিচরণ বেড়ে চলেছে। ছোঁয়া পায়ের পাতা ছাড়িয়ে ওপরে উঠতেই কাশি উঠে গেল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বড় আম্মু পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“কি হলো? মাথায় উঠেছে?”

পাশের চেয়ারে বসা ইভা পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিল।ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। বড় আম্মু ফের জিজ্ঞেস করলো,
“ঠিক হয়েছে?”

“হ্যাঁ”

আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। ফের একই অত্যাচার। চোখ তুলে সামনে তাকিয়ে দেখলাম আদ্র ভাই মন দিয়ে খাচ্ছে। একপাশে ইভা আরেক পাশে শুভ ভাই। শুভ ভাই এমনটা করবে না এটা শিওর। ইভার দিকে তাকিয়ে দেখি ওর পা ঠিকঠাকই আছে। সন্দেহ হলো। টেবিলের নিচে উঁকি দিয়ে দেখলাম এগুলো আদ্র ভাইয়ের কান্ড। উনি ওনার পা দিয়ে আমার পায়ে স্লাইড করছিলো। কি ব*জ্জাত লোক ভাবা যায়? মুখ দেখে মনে হয় কিছু বোঝেনা। চোখ রাঙিয়ে ওনার দিকে তাকালাম। মিস্টারের সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। উনি এক মনে খেয়ে চলেছে। তাকে পাত্তা না দিয়ে খাওয়ায় মন দিলাম। কোনো মতে খেয়ে উঠে যেতে নিবো এমন সময় উনার দুই পা দিয়ে আমার পা চেপে ধরলেন। পড়লাম ফাঁসাদে। নড়তেও পারছি না চড়তে পারছি না। কি এক অবস্থা। একে একে সবাই খেয়ে উঠে যাচ্ছে। আমি অসহায়ের মতো বসে আছি। ইভা উঠে যেতে যেতে বলল,
“কিরে উঠছিস না কেন? এখানে বসে আছিস”

“উঠছি”

আদ্র ভাইয়ের খাওয়া শেষ হতেই পা ছেড়ে দিলেন। দম ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম ওনার জন্য আমায় এতক্ষন বসে থাকতে হয়েছে। ইচ্ছে করছে ওনাকে..! না কিছু করা যাবেনা। আমার একমাত্র বর বলে কথা। নিজের রুমে চলে এলাম। বিছানায় বসে বসে ফোন চালাচ্ছি। আচমকা ধপাস করে কেউ বিছানায় শুয়ে পড়লো। তাকিয়ে দেখলাম আদ্র ভাই চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ছেন। ওনাকে দেখে রাগ হলো। এতক্ষন জ্বালিয়েও শান্তি হয়নি? এখন আবার জ্বালাতে এসে পড়েছে। রাগী চোখে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে।
“কিরে এমন লাল লঙ্কার মতো মুখ করে আছিস যে? কোনো সমস্যা?”

“তুমি জানো না কেন মুখ এমন করে আছি?”

“জানলে তোকে জিজ্ঞেস করতাম নাকি?”

দেখে মনে হচ্ছে মহাশয় কিচ্ছু বোঝে না। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
“নিচে খাওয়ার সময় পায়ের ওপর সুড়সুড়ি দিচ্ছিলে কেন? পা দিয়ে পা আটকে রেখেছিলে কেন?”

“বউ হয়ে তুই জামাইয়ের কথা ভুলে বসেছিলি তাই তোকে মনে করিয়ে দিলাম তোর একটা জামাই আছে। তার খাওয়া না হওয়া পর্যন্ত তুই টেবিল থেকেই উঠতে পারবি না। আর আমি বা তোকে এতো কিছু বলছি কেন? আমার বউ আমি যা ইচ্ছে তাই করবো, তোর কি?”

“আমার কি তাইনা? দাড়াও দেখাচ্ছি মজা”

আদ্র ভাইয়ের চুল টেনে ধরলাম। উনি চিৎকার করে বলে উঠলেন,
“আরে কি করছিস? চুল ছাড় ব্যাথা পাচ্ছি তো”

“আমার জামাইয়ের চুল আমি ধরেছি, তোমার কি?”

“বাহ্ আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছিস?”

“এবার বুঝো মজা কাকে বলে”

আদ্র ভাইয়ের চুল ছেড়ে দিলাম। উনি চুল ঠিককরতে করতে বলল,
“জ*ল্লাদ বউ একটা”

#চলবে?

#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব৩৩
#আফিয়া_আফরোজ_আহি

সময়টা বর্ষা কাল। চারদিকে নদী নালা পানিতে থৈ থৈ করছে। গাছে গাছে কদম ফুল ফুটেছে। বাতাসের সাথে ফুলের মিষ্টি ঘ্রান ভেসে আসছে। তার সাথে হুটহাট ঝুম বৃষ্টি । সব মিলিয়ে খুব সুন্দর একটা সময়। সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। বয়ে চলে স্রোতের গতিতে। মাঝে কেটে গেছে অনেক গুলো দিন। সকাল সকাল চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছি। আজকে সরকারি ছুটি তাই ক্লাস নেই । সেজন্য এখনো ঘুমিয়ে আছি। কিন্তু আমার সাধের ঘুম যেন কারো সহ্য হলো না। পাশে রাখা ফোনটা বিকট শব্দে বেজে উঠলো। ঘুমের ঘোরে কল কল কেটে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু সেটা হতে দিলো না বজ্জাত মার্কা ফোনটা। আবার বেজে উঠলো। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এমনি দিন তো ঘুমাতে পারিনা। আজকে একটু ঘুমাবো সেটাও কারো সহ্য হচ্ছে না । ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনে না তাকিয়ে ঘুম ঘুম চোখে রাগী কণ্ঠে বলে উঠলাম,
“কি সমস্যা? কে আপনি ভাই ? সকাল সকাল ফোন করে ডিসটার্ব করছেন?”

ওপর পাশ থেকে শান্ত কণ্ঠে ভেসে এলো,
“ঘুমের ঘোরে কি সব ভুলেছিস? সকাল সকাল বিয়ে করা জামাই কে জিজ্ঞেস করছিস কে আপনি ভাই? আমি তোর কোন জন্মের ভাই লাগি? সারাদিন ভাই ভাই ডেকে নিজের ভবিষ্যত বাচ্চার মামা বানাতে চাইছিস?”

শেষের কথা গুলো কিছুটা ঝাঁঝালো সুরে ছিলো। চোখ থেকে ঘুম নিমিষেই উধাও হয়ে গেছে। কান থেকে ফোন সরিয়ে চোখের সামনে ধরতেই দেখলাম স্ক্রিনে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা ‘আদীব চৌধুরী আদ্র’। সাথে সাথে জিভ কাটলাম। বিয়ে করা জামাই কে ভাই ডাকলে খাপবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখন তো নিজের ভুল সস্বীকার করা যাবে না। তাই কিছুটা তেজি সুরেই বলে উঠলাম,
“এতো সকাল বেলা মানুষ কোন আক্কেলে ফোন দেয় শুনি?”

“আমি দেই। আমার কবুল পড়া বউ যখন ইচ্ছে তখন ফোন দিবো এতে তোর কি?”

বিড়বিড় করে বলে উঠলাম,
“আমাকেই ফোন দিবে আবার আমাকেই বলবে তোর কি? কি সুন্দর কথা”

“কি বিড়বিড় করছিস?”

“কিছু না। তুমি বলো তুমি কেন ফোন দিয়েছো?”

“ঝটপট উঠে রেডি হয়ে নে। আমি আসছি”

“রেডি হবো কেন? কোথায় যাবো আমরা?”

“এখন এতো কথা বলার সময় নেই। তাড়াতাড়ি রেডি হো আমি আসছি। আর শোন আমার দেওয়া শাড়ি টা পড়বি”

ফট করে কল কেটে দিলো। এই মহাশয়ের আবার কি হলো? এই সকাল সকাল শাড়ি পড়ে রেডি হতে বলছে? কি জানি উনার মনে কি চলছে? উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম।

আলমারি খুলে আদ্র ভাইয়ের দেওয়া শাড়িটা বের করলাম। লাল পাড়ের সাদা শাড়ি। শাড়িতে হাত বুলিয়ে দিলাম। বিয়ের পড় ওনার দেওয়া প্রথম শাড়ি এটা। যদিও উনি এর আগে আমাকে শাড়ি কিনে দিয়েছে তবে সেটা বিয়ের আগে। মনে পড়ে গেল সেদিনের কথা। সেদিন দুজনের সেকি মারামারি। আমি আদ্র ভাইয়ের চুল ছেড়ে দিতেই উনি আমার পিছু নিলেন। পুরো ঘর জুড়ে দুজন দৌড়া দৌড়ি করছি। আমি বিছানায় উঠছি তো আদ্র ভাই নিচে আর আমি নিচে নামলে উনি বিছানায়। এভাবেই কিছুক্ষণ ছুটোছুটি হলো আমাদের। হটাৎ বিছানায় রাখা বালিশ আদ্র ভাইয়ের দিকে ছুড়ে দিলাম। উনি সরে গেলেন। আমার রুমে রাখা সিঙ্গেল সোফার কুশন নিয়ে ছুড়ে দিলেন আমার দিকে। শুরু হয়ে গেল আমাদের মারামারি। আমি উনার গাঁয়ে বালিশ ছুড়ছি উনি কুশন ছুঁড়ছে। আমাদের দেখে নিঃঘাত কেউ বাচ্চা ভেবে বসবে। দেখে মনে হচ্ছে পাঁচ ছয় বছরের বাচ্চারা মারামারি করছে। কে বলবে আমার হাজবেন্ড এন্ড ওয়াইফ? কাজিন থাকা অবস্থায় আমরা এতটা দুস্টুমি মারামারি করিনি যা এখন বর বউ হওয়ার পর করছি। এক সময় হাপিয়ে গেলাম। ধুপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। হাপানো কণ্ঠে বলে উঠলাম,
“আদ্র ভাই আমি আর পারবো না, হাপিয়ে গেছি”

উনিও ধপাস করে আমার পাশে শুয়ে বলল,
“আমিও”

দুজন বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে আছি। আচমকা আদ্র ভাই উঠে বসলেন।
“কি হলো? উঠলে কেন?”

উনি বিছানা থেকে নেমে রুমের বাহিরে যেতে যেতে বলল,
“আসছি, ওয়েট”

কিছুক্ষন পড় হাতে একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে ফিরে এলেন। আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“এটা তোর জন্য”

“কি আছে ভিতরে?”

“খুলে দেখেনে”

ব্যাগ খুলতেই বেরিয়ে এলো শাড়ি। শাড়ি দেখে মুহূর্তেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো। খুলে দেখা শুরু করলাম। শাড়ির সাথে কিছু জুয়েলারিও ছিলো।
“পছন্দ হয়েছে?”

উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে উঠলাম,
“ভীষন পছন্দ হয়েছে। বলতে হবে তোমার পছন্দ অনেক সুন্দর”

“তুই মানুষটাও তো আমারই পছন্দের”

উনার কথায় লজ্জা পেয়ে গেলাম। এই মানুষটা একেক সময় একেক রকম। এইযে একটু আগে মারামারি করছিলো, এখন রোমান্টিক মুডে আছে, আবার কেয়ারিং মুডে চলে যায়। আদ্র ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম,
“হটাৎ শাড়ি দিলে যে? কোনো কারণ আছে?”

“হুট্ করে বিয়ে হয়ে গেল তোকে কিছু দিতে পারিনি। কালকে একটা কাজে বাহিরে গিয়েছিলাম শাড়িটা দেখতেই চোখে লাগলো। কল্পনায় ভেসে উঠলো তোর মুখটা। এই শাড়িটা আমার রৌদ্রময়ীর জন্যই তৈরি হয়েছে। তাকে এই শাড়িতে পুরো অপরূপা লাগবে। তাই নিয়ে এলাম”
——

ভাবনার শহরে বিচরণ করছি এমন সময় ফোনের ম্যাসেজ টোন ভবেজে উঠলো। শাড়ি আর জুয়েলারি বের করে রেখে ফোন হাতে নিলাম। মহাশয়ের ম্যাসেজ উনি চলে এসেছেন। তাড়াতাড়ি করে শাড়ি পড়তে শুরু করে দিলাম। শাড়ি পড়া শেষে আয়নার সামনে বসে অল্প বিস্তার সেজে নিলাম। শাড়ির সাথে সাজ ছাড়া মানাবে না। হাতে পড়লাম লাল রঙের রেশমি চুরি। কানে ম্যাচিং ঝুমকো। চোখে গাঢ় কাজল। সাজ শেষ করে আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিলাম। অতঃপর সাইড ব্যাগ নিয়ে নেমে এলাম। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দেখলাম মহাশয় এক মনে ফোন চালাচ্ছে। নেমে ওনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তার এদিকে খেয়াল থাকলে তো? হাত ঝাড়া দিলাম। সাথে সাথে চুরির রিনঝিন শব্দ হলো। আদ্র ভাই মুখ তুলে তাকালেন। মুহূর্তের ব্যবধানে যেন থমকে গেলেন। ওনার চোখ আটকে গেল আমার মুখশ্রীতে। কেটে গেল কিছু প্রহর। তবুও উনি একই ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। উনাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে লজ্জা পেলাম।
“উহুম, উহুম”

আদ্র ভাই ধ্যান থেকে বেরিয়ে এলেন। বড় আম্মু রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। আমাদের তাড়া দিয়ে বললেন,
“দুজন টেবিলে বস, তাড়াতাড়ি খেয়ে নে”

“বড় মা এখন খেতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। আমরা যাওয়ার পথে খেয়ে নিবো। আর তোমাকে তো বললাম আমাদের অনেক দূর যেতে হবে”

“ঠিক আছে সাবধানে যা”

বড় আম্মু এগিয়ে এসে আমার কপালে চুমু একে দিয়ে বলে উঠলো,
“মাশাআল্লাহ। আমার রোদ সোনাকে অনেক সুন্দর লাগছে। কারো নজর না লাগুক। আদ্র সাথে যাচ্ছিস সাবধানে থাকবি আর ওর ওপর আমার ভরসা আছে”

আদ্র ভাই তাড়া দিয়ে বলল,
“চল দেরি হয়ে যাচ্ছে। বড় মা এলাম”

আদ্র ভাই আমার হাত ধরে বাহিরে নিয়ে এলেন। গ্যারেজে এসে গাড়ির দরজা খুলে আমায় বসিয়ে নিজে পাশে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লেন। গাড়ি স্টার্ট দিতেই জিজ্ঞেস করে বসলাম,
“আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

“গেলেই দেখতে পাবি”

আর কথা বললাম না। গাড়ি চলছে তার আপন গতিতে। বাহিরে তাকিয়ে বাহিরের দৃশ্য দেখছি। হটাৎ মাথায় প্রশ্ন এলো। ফট করে আদ্র ভাইকে জিজ্ঞেস করে বসলাম,
“তুমি বড় মাকে কি বলেছো?”

“বলেছি বন্ধুর বিয়ে সেখানে যেতে হবে। ওরা তোকেও নিয়ে যেতে বলেছে তাই নিয়ে যাচ্ছি”

“মিথ্যা বললে কেন?”

“এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার”

মুখ ভেংচি কেটে বাহিরের দৃশ্য দেখতে শুরু করলাম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি সে খেয়াল নেই। রাতে পড়া কমপ্লিট করতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। তাই ঘুমাতে দেরি হয়ে গিয়েছে। তারওপর সকাল সকাল ওঠায় ঘুমিয়ে গিয়েছি। আদ্র ভাই আমার মাথায় নিয়ে উনার কাঁধের রাখলেন। কারো আধো আধো কণ্ঠে কারো ডাক শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল।
“রোদ! এই রোদ! ওঠ। আমরা এসে পড়েছি”

পিটপিট করে চোখ খুলে সামনে আদ্র ভাইকে আবিষ্কার করলাম। আমায় তাকাতে দেখে বলে উঠলো,
“আমরা আমাদের গন্তব্যে এসে পড়েছি। এখন উঠ”

আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম গ্রাম্য এলাকা। দেখে মনে হচ্ছে শহর থেকে অনেকটা দূরে। আদ্র ভাই নিজে বের হয়ে আমার পাশের দরজাও খুলে দিলেন। দুজনে হেটে সামনে যাবো এমন সময় উনি বলে উঠলেন,
“সিট্! আমি তো মেইন জিনিস টাই ভুলে বসেছি”

“কি ভুলে গেছো? আর এটা কোথায়? দেখে তো কোনো বিয়ে বাড়ি মনে হচ্ছে না”

“একটু ধর্য্য ধরুন মিসেস সব দেখতে পাবেন”

উনি আমায় নিয়ে গাড়ির পিছনের সিটে বসিয়ে দিলেন। নিজে পাশে বসলেন। সামনে রাখা একটা ব্যাগ কাছে নিয়ে বসে বলেন,
“পা তুলে বস”

“কেন?”

“এতো কথা না বলে যেটা বলছি সেটা কর”

পা তুলে বসলাম। আদ্র ভাই শাড়ি একটু ওপরে তুলে দিয়ে বলল,
“শাড়ি ধরে রাখ”

আমি শাড়ি ধরে বসলাম। উনি ব্যাগ থেকে আলতা বের করলেন। খুব সাবধানতার সহিত পায়ে আলতা পড়িয়ে দিচ্ছেন। আলতা পড়ানো শেষে নুপুর খুলতে নিলেই বাঁধা দিয়ে উঠলাম।
“নুপুর খুলছো কেন? এগুলো আমার অনেক প্ৰিয়”

উনি কোনো উত্তর দিলেন না। আগের নুপুর খুলে ব্যাগ থেকে নতুন নুপুর বের করে পড়িয়ে দিলেন। আলতা পায়ে নুপুর বড্ড সুন্দর লাগছে।
“এবার হাত দে দেখি”

কোনো কথা না বলে হাত বাড়িয়ে দিলেন। হাতেও সুন্দর করে আলতা পড়িয়ে দিলেন। আমি মুগ্ধ চোখে ওনার দিকে তাকিয়ে আছি। প্রেমিক পুরুষ আসলেই বড্ড সুন্দর। আদ্র ভাই আলতা পড়ানো শেষে বলে উঠলো,
“ডান। এখন চল”

দুজন বেরিয়ে হাঁটা দিলাম। কিছুটা হেটে যেতেই সমনে এক ঘাট পড়লো। আদ্র ভাই মাঝিদের সাথে কথা বলে নৌকা নিলেন। উনি উঠে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমার ভয় করছে। আদ্র ভাই নেমে হুট্ করে কোলে তুলে নিলেন। এতো গুলো মানুষের সামনে এভাবে কোলে নেওয়ায় লজ্জা পেয়ে গেলাম। ফিসফিস কণ্ঠে বলে উঠলাম,
“সবার সামনে কোলে তুললে কেন? নামও, আমার লজ্জা লাগছে?”

“আমার বউ আমি কোলে তুলেছি এতে কার কি?”

এই লোককে বলে লাভ নেই। আদ্র ভাই আমায় নৌকায় নিয়ে নামিয়ে দিলেন। নৌকার একপাশে মাঝি ওপর পাশে আমি আর আদ্র ভাই। নৌকা চলা শুরু করলো। আমি এখনো জানি না কোথায় যাচ্ছি। নৌকা কিছুটা এগোতেই দেখলাম আশেপাশে লাল শাপলায় ভরপুর। শাপলা দেখতেই মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। ইচ্ছে করছে ছুঁয়ে দিতে। কিন্ত শাপলা গুলো অনেকটা দূরে। আরেকটু ভিতরে যেতেই শাপলা গুলো হাতের নাগালে চলে এলো। আদ্র ভাই কয়েকটা শাপলা তুলে আমার হাতে দিলেন। শাপলা গুলো ছুঁয়ে দেখছি। আদ্র ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম,
“হটাৎ শাপলা বিলে নিয়ে এলে যে?”

“কেউ একজন দুবছর আগে শাপলা বিলের একটা ভিডিওতে কমেন্ট করছিলো ‘আজকে একটা জামাই নাই বলে শাপলা বিলে যেতে পারিনা’। সেদিন ভেবে নিয়েছিলাম রৌদ্রময়ী আমার হলে তাকে নিয়ে পুরো শাপলা বিলের আনাচে কানাচে ঘুরবো। একে একে তার সকল ইচ্ছে পূরণ করবো”

আমি এক নজর সামনে বসা মানুষটার দিকে তাকালাম। এই মানুষটাকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পেয়ে আমি ভাগ্যবতী। উনাকে জীবনে না পেলে হয়তো জীবনটাই অপূর্ণ থেকে যেত। শাপালে গুলো নেড়ে চেড়ে দেখছি। আরো কিছুদূর যেতেই নৌকা থামিয়ে দিলেন । আদ্র ভাই পায়জামা কিছুটা তুলে পানিতে পা ভিজিয়ে বসলেন। ওনার দেখাদেখি আমিও পা ভিজি বসলাম। পানির মাঝে পা নাড়িয়ে দুস্টুমি করছি। পানিতে ছল ছল শব্দ হচ্ছে। হটাৎ মাথায় দুস্টু বুদ্ধি চেপে বসলো। কিছুটা পানি হাতে নিয়ে আদ্র ভাইয়ের দিকে ছুড়ে দিলাম। উনিও আমার দিকে ছুঁড়ে দিলো। পানি নিয়ে দুজন কিছুক্ষন দুস্টুমি করলাম। মাঝে নৌকার মাঝি ভাই শাপালে দিয়ে একটা মুকুট বানিয়ে দিলেন। আদ্র ভাই সেটা হাতে নিয়ে সুন্দর করে মাথায় পড়িয়ে দিলেন। আমার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললো,
“আমার শাপলার রানী”

#চলবে?