উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন পর্ব-৪১+৪২

0
3

#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব৪১
#আফিয়া_আফরোজ_আহি

“রৌদ্রময়ীর আধিপত্যের এই শহরে অন্য কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ”

“মানে? কি বলছেন এসব?”

“মানে আমি বিবাহিত। আমার বউ আছে। আর আমি আমার বউকে অসম্ভব ভালোবাসি। আপনি এখন আসতে পারেন”

আদ্র আমায় নিজের সাথে জড়িয়ে কথাগুলো বলে উঠলো এক অতি আধুনিক রমনীকে। সামনে দাঁড়ানো রমণীর যেন সেই কথা গুলো বিশ্বাস হলো না। তিনি এখনো কেমন অবিশ্বাস্য নজরে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। বলে উঠলো,
“আমি বিশ্বাস করি না মেয়েটা আপনার বউ। বাই এনি চান্স আপনি কি আমার থেকে পিছা ছুটানোর জন্য এমন করছেন?”

“আপনার বিশ্বাস অবিশ্বাসে আমার কিছু যায় আসে না। আপনি বিশ্বাস না করলেই কি আমার জীবনের আসল সত্যিই বদলে যাবে? আর না আমার ঠেকা পড়েছে আপনাকে বিশ্বাস করানোর”

আদ্র আমার হাত নিজের হাতের মাঝে নিয়ে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। অতঃপর সেখান থেকে নিয়ে এলো আমায়। এতক্ষন কি হলো কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমি ঘটনা বুঝতে না পেরে আদ্রর দিকে তাকিয়ে আছি। আদ্র হয়তো সেটা বুঝতে পারলো। আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু বুঝিসনি?”

আমি মাথা নাড়িয়ে ‘না’ জানালাম। উনি আমার নাক টেনে দিয়ে বললাম,
“আমার বোকা রানী রৌদ্রময়ী”

আমি বায়না করে বললাম,
“বলো না কি হয়েছে?”

“তোর ছোটো মাথায় এতো কিছু ঢুকাতে হবে না। তুই শুধু আমায় নিয়ে ভাব তাহলেই হবে”

আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,
“তুমি বলবে নাকি বলবে না?”

আদ্র আমার গাল টিপে দিয়ে বলল,
“গাল ফুলালে কিন্তু তোকে কিউট লাগে। বিয়ের পড় তুই সারাদিন গাল ফুলিয়ে থাকবি আর আমি টুপ্ করে চুমু খেয়ে নিবো। বেপারটা ইন্টারেস্টিং না?”

“ইন্টারেস্টিং না ছাই”

আদ্র আমার কথা শুনে ফিক করে হেসে দিলো।
“আচ্ছা শোন বলছি, মেয়েটা মেন্টাল বুঝলি? আমি তোর জন্য শাড়ি দেখছিলাম তখন আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করছিলো। আমি প্রথমেই মেয়েটার মতলব বুঝে গেছিলাম। একটু পরে বাহানায় কথা বলতে এলে বললাম আমি বিবাহিত। কিন্তু বিশ্বাস করলো না তাই তোকে ডেকে নিয়ে এলাম”

“তাও তো বিশ্বাস করলো না”

“তাতে আমার কি? করলে করুক না করলে নাই আমার ঢেকা পড়ছে নাকি ওই মেন্টাল মেয়েকে বোঝানোর”

“তাই বলে মেন্টাল বানিয়ে দিবে?”

আদ্র থুতনিতে হাত রেখে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
“আমি একটা কথা ভাবছি?”

“কি?”

“আমি জানি আমি হ্যান্ডসাম তাই বলে সব মেয়েকে আমার প্রেমে পড়তে হবে? আমি চাই আমার বউ আমার প্রেমে পড়ুক, একেবারে পা পিছলে টাইপ কিন্তু বউ তো পাত্তাই দেয় না আর এদিকে মেয়েরা আমার পিছু ছাড়ে না। এখনকার যুগের মেয়েগুলো ভালো না। কেমন ছেচড়া টাইপ। শোন রৌদ্রময়ী এখনো সময় আছে তোকে বলি কি জামাইকে শক্ত করে বেঁধে রাখ নাহলে কেউ নিয়ে যাবে”

আদ্রর কথা শুনে ফিক করে হেসে দিলাম। উনার বাহু শক্ত করে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“এভাবে হলে হবে?”

“এটা কোনো শক্ত বাঁধন হলো? বাড়ি চল দেখিয়ে দিবো। এটা পাবলিক প্লেস এখানে দেখানো যাবে না”

আদ্রর কথায় হেসে দিলাম। এই লোক পারেও বটে। পিছু ফিরে দেখলাম মেয়েটা এখনো আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে দিলাম। মেয়েটার কতো শখ আসছে আমার জামাইয়ের দিকে নজর দিতে। আমার জামাইয়ের সাথে লাইন মারতে। আগে জানলে মেয়েটার খবর ছিলো।

বিয়ের আর বেশিদিন নেই। হাতে গোনা সপ্তাহ খানেক। দুই বাড়িতে প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। আজকে সবাই মিলে শপিংয়ে এসেছি বিয়ের কেনাকাটা করতে। আমি আম্মুদের সাথে শাড়ি দেখছিলাম নরমালি পড়ার জন্য। এদিকে আদ্র যে কখন আমার পাশ থেকে এদিকে সরে এসেছে খেয়ালই করিনি। এখন আর জামাইকে একা ছাড়া যাবে না। আশেপাশে সব শা*কচুন্নিদের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। বলা যায়না কখন আমার জামাইয়ের দিকে নজর দেয়। তাই জামাইকে সাথে সাথে নিয়ে ঘুরতে হবে। আমি কি উনাকে আটকে রাখবো উনি আমাকে ছাড়লে তো? আমার হাত নিজের হাতের মাঝে এমন ভাবে আটকে রেখেছে দেখে মনে হচ্ছে আমি ছোটো বাচ্চা হাত একটু আলগা হয়ে গেলেই হারিয়ে যাবো। বসে বসে শাড়ি দেখছি। আশেপাশে শাড়ির ছড়াছড়ি। যে যেটা পারছে আমার গাঁয়ে দিয়ে দেখছে কেমন লাগে। নিজেকে কেমন মডেল মডেল লাগছে। অবশেষে সবার শাড়ি কেনা শেষে বিয়ের মেইন শপিং বিয়ের লেহেঙ্গা কেনার পালা। পুরো সপ ঘুরে ঘুরেও একটা মনের মতো লেহেঙ্গা পাচ্ছি না। ডিজাইন পছন্দ হলে কালার পছন্দ হয়না আর কালার পছন্দ হলে ডিজাইন পছন্দ হয়না। পড়েছি এক মুশকিলে। আমি চাচ্ছি টকটকে লাল রঙের লেহেঙ্গা যেন বিয়ের দিন আমায় লাল টুকটুকে বউ লাগে। কিন্তু এমন একটাও পাচ্ছি না। ইভা বিরক্ত হয়ে বলল,
“এখানে এতো এতো ডিজাইন তোর একটাও পছন্দ হচ্ছে না?”

আমি মুখটা ইনোসেন্ট করে বললাম,
“না তো?”

“ভাই তোর পছন্দ নাকি আলাদিনের চেরাগ? এতো সুন্দর সুন্দর লেহেঙ্গার মাঝেও কোনটা তোর পছন্দ হচ্ছে না?”

“বিকজ আমার চয়েস ইউনিক তাই”

দুজন কথা বলছি এমন সময় আদ্র এলো হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে। আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“এটা ট্রাই করে দেখা পছন্দ হয় নাকি? ঐদিকে ট্রায়াল রুম আছে ট্রাই করে আয়”

ব্যাগটা হাতে নিয়ে ট্রায়াল রুমে চলে গেলাম। ব্যাগটা খুলতেই মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। আমি যেরকম চাচ্ছিলাম সেম সেরকম লেহেঙ্গা। তাড়াতাড়ি করে লেহেঙ্গাটা পরে বাইরে বেরিয়ে এলাম। ট্রায়াল রুমের সামনে আগে থেকেই আদ্র দাঁড়িয়ে আছে। খুশিতে লাফ দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরলাম। আদ্র আমার খুশি দেখে মুচকি হাসলো। ঠোঁটের কোণে হাসি বজায় রেখে বলল,
“পছন্দ হয়েছে?”

“একদম আমার মনের মতো”

আদ্র কোমর জড়িয়ে আমার নিজের কাছে নিয়ে সুধালো,
“এবার খুশি?”

“এত্ত এত্ত খুশি। কিন্তু তুমি জানলে কিভাবে আমি এরকম টাই খুজছিলাম?”

“যদি রৌদ্রময়ীর মনই পড়তে না পারি তবে তাকে ভালোবাসলাম কিভাবে বল? রৌদ্রময়ীর সকল কিছু আমার নখোদর্পনে। তাকে আমার চেয়ে বেশি কেউ জানতে পারবে না”

“এই জন্যই তো তোমায় এত্ত ভালোবাসি”

আদ্র অবাক চোখে তাকালো আমার দিকে। তড়িৎ গতিতে বলে উঠলো,
“কি বললি?”

“কিছু না। তুমি দাড়াও আমি চেঞ্জ করে আসি”

আদ্রর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে চলে এলাম। মনে মনে বলে উঠলাম,
“তোমায় আমি ভালোবাসি আদ্র, অনেক বেশিই ভালোবাসি। কিন্তু আমি যে ভালোবাসা প্রকাশ করতে ভয় পাই, যদি তুমিও হারিয়ে যাও। তোমায় আমি হারাতে চাইনা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সাথে কাটাতে চাই। আমি জানি তুমি হারাবে না। ভালোবাসি তোমায় আমি বলবো তবে সেটা আয়োজন করে। এভাবে সাদামাটা ভাবে না”

কথা গুলো মনে মনে বলতে বলতে চেঞ্জ করে বেরিয়ে এলাম। শপিং করতে করতে সবাই কাল্ন্ত হয়ে গেছে। পা আর চলছে না। এখনো কতো কিছু কেনা বাকি। দোকানে রাখা টুলে বসে পড়লাম।
“আমি আর হাঁটতে পারবো না। আমার পা ব্যথা করছে। তোমার যাও যা কিনার কিনো”

ভাবি বলল,
“এই টুকুতেই এতটা ফাপিয়ে গেলে হবে ননদিনী? এখনো তো কতো কিছু কিনা বাকি”

“আমি আর হাঁটতে পারব না তোমারা যাও”

আমার দেখাদেখি ইভা, আরু,রোশনিও বসে পড়লো। সবার অবস্থাই নাজেহাল। আদ্র আমাদের অবস্থা দেখে বলল,
“আজকের মতো তাহলে এখানেই শেষ করো। পড়ে একদিন নাহয় এসো”

শপিং মল থেকে বেরিয়ে সবাই রেস্টুরেন্টে ঢুকালাম। যে যার মতো অর্ডার করছে। আমি বসে আছি এক কোণে। আমার হয়ে আদ্রই অর্ডার করে দিলো। খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই বাড়ি চলে এলাম। আদ্র সবাইকে নামিয়ে দিয়ে গেছে। ক্লান্ত থাকায় বেশি কথা হয়নি আমাদের। রুমে এসে ধপ করে বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিলাম।
——

রাতের আকাশ পানে এক মনে তাকিয়ে আছি। কি সুন্দর অপরূপ দৃশ্য। চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। হাতে রাখা গরম কফি এতক্ষনে ঠান্ডা হয়ে গেছে। আমার দিকে খেয়াল নেই। কফির কাপটা পাশে রাখা টেবিলে রেখে দিলাম। দিন গুলো কেমন চোখের পলকে চলে গেল। বিয়ের আর দুদিন আছে। এতদিন মনের মাঝে উচ্ছাস কাজ করলেও এখন মনটা খারাপ লাগছে। চেনা এই বাড়ি ঘর ছেড়ে আমায় চলে যেতে হবে। যেই বাড়িতে বেড়ে ওঠা, ভাই বোনদের সাথে খুনসুটি, ভালোবাসা সব কিছু ছেড়ে যেতে হবে। নিজের রুমের দেয়াল গুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছি। এই রুমটার প্রতিটা কণা আমার নিজের হাতে সাজানো। কতো যত্নে রেখেছিলাম জিনিস গুলো। ব্যালকনিতে রাখা ফুলগাছ গুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছি। কিছু গাছে ফুল ফুটেছে, আর কয়েকটায় কলি ফুটে আছে। হয়তো বা খুব শীঘ্রই ফুটে যাবে। তবে তখন হয়তো আমি থাকবো না। মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে গেছে। মন খারাপ নিয়েই ফুলগুলো ছুঁয়ে দিলাম। উঠে গিয়ে বসলাম দোলনায়। দোলনার সাথে মাথা ঢেকিয়ে দোল খাচ্ছি। এই সময় বিকট শব্দে ফোনটা বেজে উঠলো। রাতের এই নিস্তব্ধ পরিবেশে আচমকা এমন শব্দে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। নিজেকে সামলে ফোনটা চোখের সামনে ধরলাম। স্ক্রিনে আদ্রর নামটা জ্বলজ্বল করছে। ফোন ধরতে ইচ্ছে করছে না। এখন কথা বললেই উনি বুঝে যাবে আমার মন খারাপ। তখন উনার মনও খারাপ হয়ে যাবে। বিয়ে নিয়ে উনার অনেক উৎসাহ। আমি চাইনা ওনার মন খারাপ হোক। মানুষটার আনন্দ মাটি হোক। কল বাজতে বাজতে কেটে গেল। হাফ ছেড়ে বাচলাম। কিন্তু উনি থামলে তো? পরপর ফোন দিয়েই যাচ্ছে। অতঃপর টিকতে না পেরে রিসিভ করলাম। নিজেকে যথা সাধ্য স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম।আদ্র ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলে,
“কি এমন রাজকার্য করছিলি শুনি? ফোন ধরতে এতো সময় লাগলো কেন? কোথায় ছিলি?”

জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললাম,
“ফোন সাইলেন্ট ছিলো তাই খেয়াল করিনি। তুমি বাড়ি এলে কখন?”

“এইতো একটু আগেই এসেছি। অফিসে অনেক কাজের চাপ ছিলো। বিয়ে উপলক্ষে ছুটি কাটাবোতাই কাজগুলো গুছিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। সব শেষ করে বাড়ি এলাম”

“ও আচ্ছা। খেয়েছো?”

আদ্র জবাব দিলো না। একটু থেমে শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“তোর কি মন খারাপ রৌদ্রময়ী?”

মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম,
“না তো! তোমার এমনটা কেন মনে হলো?”

“তুই সবার থেকে লুকতে পারলেও আমার থেকে পারবি না। তোর চোখের চাওনি দেখলেই আমি বুঝে যাই তোর মন ভালো নাকি খারাপ। বুঝলি? এখন বল মন খারাপ কেন?”

কাচুমাচু করে বললাম
“দুদিন পর তো এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। বড় আব্ব-আম্মু, আব্বু-আম্মু, ইভা, রোশনি, ইভা, রোশান সবাইকে অনেক মিস করবো। বাড়ির দিকে তাকালেই কেমন কান্না কান্না পায়। মন খারাপ লাগে। আমমি বিয়ে করবো না আদ্র ভাই”

“বোকা মেয়ে আমি তোকে দূরে নিয়ে যাচ্ছি নাকি? আমাদের বাড়ি থেকে তোদের বাড়ি ৫মিনিটের রাস্তা। যখন ইচ্ছে হবে চলে যাবি। আমি তোকে নিয়ে যাবো। আর তুই কি পরের ঘরে যাবি নাকি আসবি তো আমার বাড়ি। তোর ফুপ্পির বাড়ি”

“তাও আমার কেমন কান্না কান্না পায়”

“তাহলে কি আমি বিয়ে টা ক্যানসেল করে দিবো? তোর জন্য আমি বিয়ে ক্যানসেল করতেও রাজি আছি। কিন্তু তোর মন খারাপ হোক, কান্না পাক তার কারণ হতে আমি চাই না”

আদ্রর কণ্ঠ কেমন নিশ্চল শোনাচ্ছে। তাই মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম,
“ওই তোমার কাছে শখ তো কম না। আমার কতো ইচ্ছে লাল লেহেঙ্গা পড়ে লাল টুকটুকে বউ সাজবো। তুমি সেগুলো ক্যানসেল করত চাচ্ছ? বিয়ে হবে”

“ঠিক আছে। এখন হাসি দে দেখি। তোর হাসি দেখে প্রাণটা জুড়াই”

আদ্রর কথা শুনে খিলখিল করে হেসে দিলাম। আদ্র নেশাতুর চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বুকে হাত রেখে বলে উঠলো,
“হায় মে মা*র জাভা”

#চলবে?

#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব৪২
#আফিয়া_আফরোজ_আহি

হলুদের সমারোহে সেজে উঠেছে আমার প্ৰিয় বাগানের একপাশ। সেখানে গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। স্টেজে দুইপাশে আলাদা আলাদা করে সাজানো হয়েছে। একপাশে আমার জন্য অন্য পাশে আদ্রর জন্য। উনাদের বাড়িতে হলুদের আয়োজন করতে চাইলেও হয়নি। কারণ আদ্রর বাবারা এক ভাই এক বোন। আদ্রর ফুপ্পি দেশের বাহিরে থাকে। আত্মীয় বলতে আমাদের সবাই। আয়োজনে আমরা আমরাই। দুই জায়গায় আলাদা করে আয়োজন করলে অনেক বেশি ঝামেলা হবে তাই একসাথেই আয়োজন করা। স্টেজ এখনো পুরোপুরি তৈরী হয়নি কিছু কাজ বাকি রয়ে গেছে। তাজা ফুল দিয়ে স্টেজ সাজানো হচ্ছে। আমি হাতে এক কাপ কফি নিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিচের আয়োজন দেখছি। দুপুরের দিকে হলুদের অনুষ্ঠান আর রাতে মেহেন্দি। সবে সকাল দশটা বাজে। অবশেষে সবার অনুমতি নিয়ে আমাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেতে যাচ্ছে। যদিও বিয়ে তো আমাদের সেই কবেই হয়ে গেছে। তবে এবারের টা ভিন্ন আয়োজন, হইহুল্লোড়, আত্মীয়-স্বজন সব মিলিয়ে একদম পরিপূর্ণ। আদ্রর কথা উনি উনার বিয়েতে কোনো কমতি দেখতে চান না। একা একা নিজ মনে কথা বলছি পাশ থেকে কেউ ধাক্কা দিলো। তার দিকে তাকাতেই ঈশিতা আপু বলে উঠলো,
“তুই কিরে রোদ? সারাজীবন সব অনুষ্ঠানে সবার শেষে সাজতে বসতি। কোনোরকম সেজে সবার আগে উঠে যেতি। আজকেও কি সেই প্ল্যান করছিস নাকি? তুই যে ব্রাইড সে খবর তোর আছে?”

“ব্রাইড হয়েছি তো কি হয়েছে? ব্রাইড হলে একঘন্টা সময় নিয়ে বসে বসে সাজতে হবে? আমি বাপু তা পারবো না। টুক করে বসে পাঁচ মিনিটে সেজে উঠবো আমি”

“আজকে সেটা হবে না। সময় নিয়ে সুন্দর করে সেজেগুঁজে আমার ভাইয়ের পাশে বসতে হবে। নাহয় তোকে আদ্রর পাশে বসতে দিবো না”

“বাই এনি চান্স তুমি কি আমার কালা বললে? তোমার ভাইয়ের পাশে আমায় মানাবে না সেটাই বুঝালে? বাহ্ কি সুন্দর? শেষ মেষ কন্যা পক্ষ থেকে বর পক্ষ হয়ে গেলে? ঠিক আছে শিহাব ভাইয়া আমাদের দলে”

“দল ভাগাভাগি পড়ে করিস এখন সাজতে চল”

হাত ধরে টেনে নিয়ে বসিয়ে দিলো আয়নার সামনে। অতঃপর শুরু হলো মেকআপ নামক অত্যাচার। মনে হচ্ছে মুখের ওপর এক পাল্লা আটা ময়দা লেপে দিচ্ছে। বিরক্ত লাগছে আমার। যেই আমি দুদন্ড এক এক জায়গায় বসার মেয়ে না সেই আমাকে এভাবে বসিয়ে রেখেছে ভাবা যায়? আমি একটু পর পর জিজ্ঞেস করছি,
“হলো?”

মেকআপ আর্টিস্ট আমার কথায় বিরক্ত হচ্ছে সেটা তার মুখের এক্সপ্রেশন আর কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে। তিনি বারবার বলছে,
“আপু একটু কম নড়াচড়া করেন। চুপচাপ বসেন এইযে হয়ে গেছে”

কিন্তু আমি শুনলে তো? হয়ে গেছে ডায়লগ টা শুনতে শুনতে প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গেছে। বিরক্ত হয়ে বলে উঠলাম,
“আর কতো? আমি আর বসে থাকতে পারবো না”

ঈশিতা আপু ধমক দিয়ে বলল,
“আর একটা কথা বললে তোর মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে দিবো। চুপচাপ বসে থাক যতক্ষণ না মেকআপ ডান হয়”

আপুর ধমক শুনে বসে আছি। একটু পর ইভা, রোশনি আর আরু এলো। তারাও সাজুগুজু করবে। ঈশিতা আপু ইভা আর রোশনিকে সাজিয়ে দিচ্ছে। আর এদিকে আমি সংয়ের মতো বসে আছি। অবশেষে মেকআপ নামক অত্যাচার শেষ হলো। উঠে মাজা টান করে দাঁড়ালাম। মনে হচ্ছে এতক্ষন একাধারে বসে থাকায় কোমর ধরে গিয়েছে। হাত পা ঝাড়া দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। নিজেকে নিজেই চিনতে পারছি না। গাঁয়ে গোলাপি পাড়ের হলুদ শাড়ি আটপৌর ভাবে পড়া। কোমরে ফুল দিয়ে তৈরি করা কোমর বন্ধনী। পুরো গাঁ মুড়িয়ে আছে তাজা ফুলে। গাঁয়ের গহনা সব তাজা ফুলের। গাঁ থেকে ফুলের মিষ্টি ঘ্রান ভেসে আসছে। আশেপাশ ফুলের ঘ্রানে মো মো করছে। ইভা এসে কাঁধে হাত দিয়ে হেলান দিয়ে বলল,
“বনু তোকে তো পুরো ফুলকুমারী লাগছে। মাশাআল্লাহ কারো নজর না লাগুক। আজকে নিঃঘাত আদ্র ভাই তোকে দেখে হার্ট ফেল করবে”

আদ্রর কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। স্মরণ হলো গতকাল রাতের ঘটনা। ভিডিও কলে দুজন কথা বলছি। মন খারাপ থাকলেও আদ্রর সাথে কথা বলে মনটা ফুরফুরে হয়ে গিয়েছিলো। আদ্রর সাথে কথা বলছি আর খিলখিল করে হাসছি। আদ্র এক ধ্যানে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। উনার এমন চাহনি দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। উনার চোখের চাহনি কেমন নেশালো। মনে হচ্ছে উনি কোনো নেশায় বুদ হয়ে আছেন। আদ্রর নাম ধরে আসতে করে ডাক দিলাম। কোনো উত্তর এলো না। গলা ঝাড়া দিলাম,তাতেও ওনার হুস নেই। এবার একটু জোরেই ডাক দিলাম। আদ্র ধ্যান ভেঙ্গে ভ্রু কুঁচকে চাইলো।
“কোন ধ্যানে পড়েছো শুনি? এতো করে ডাকছি শুনতেই পাচ্ছ না”

“রৌদ্রময়ীর ধ্যান”

তড়াক করে বলে উঠলাম,
“কি বললে? শুনতে পাইনি আবার বলো”

আদ্র দুস্টু হাসলো। ঠোঁটের কোণে হাসি বজায় রেখে বলল,
“ভাবছিলাম তোকে বুকে জড়িয়ে টুপ্ করে তোর গোলাপ রঙা ওষ্ঠে অধর ছুঁয়ে দিবো। তুই লজ্জায় রাঙা হয়ে মুখ লুকাবি আমার বুকের মাঝে। ভাবনা টা সুন্দর না?”

“সুন্দর না কঁচু। সব আমায় লজ্জা দেওয়ার ধান্দা, বদ লোক একটা”

“কিরে! কি বিড়বিড় করছিস? জোরে বল আমিও একটু শুনি”

“ঘুম পাচ্ছে ঘুমাবো”

“আজ কেটে পড়লেও দুদিন বাদে পার পারবি না বলে দিলাম”

“মানে? কেন?”

“দুদিন পড় তো আমাদের বা..”

আমি তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলাম,
“এই তুমি থামবে? বললাম না ঘুমাবো। ভালো থেকো। আল্লাহ হাফেজ”

ফট করে কল কেটে দিলাম। নাহয় এই লোক আমায় লজ্জায় চুবিয়ে মারতো। এটা আমি শিওর। ফোনটা পাশে রেখে আদ্রর একটু আগে বলা কথাগুলো ভাবতেই লজ্জায় গালে লালিমা ছড়িয়ে গেল।

ইভার মুখে আদ্রর নাম শুনে স্মৃতিচারণ করতে ব্যাস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ইভা আমায় ধাক্কা দিয়ে বলল,
“কি বনু? তার নাম শুনেই ব্লাস করছিস? সামনে এলে না জানি কি করবি”

“উস্টা খাবি বলে দিলাম”

“সত্যি কথা বললে এমনই হয়। আর সত্যি বলমু না”

আসলেই তো সকালের দিকে ফুপ্পিরা চলে এসেছে। আরু এসে দেখা করে গেছে। কিন্তু আদ্র? মহাশয়কে তো একবারও দেখলাম না। কি এমন কাজে ব্যাস্ত তিনি? এই তার ভালোবাসা? কোথায় এসে বলবে বউ আমি এসে গেছি, তা না করে উনি কোনো রাজ কার্য করছে কে জানে? গাল ফুলালাম। কথা বলবো না উনার সাথে। এমন সময় ডাক পড়লো নিচে যাওয়ার। আয়োজন শেষ এখন আমাদের যাওয়ার পালা।

স্টেজে বসে আছি। পাশের জায়গাটা এখনো ফাঁকা। আদ্র মহাশয় এখনো আসেনি। আমার ভাবনার মাঝেই আগমন ঘটলো তার। সাদা পাঞ্জাবীর ওপর হলুদ রঙের কোটি। হাতে ঘড়ি, চুল গুলো সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা। উনার এই লুকেই আমি ফিদা। মানুষটা এতো সুন্দর কেন? উনাকে কেন এতো সুন্দর হতে হবে? এইযে আশেপাশের কতো গুলো মেয়ে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। ইচ্ছে করছে মেয়ে গুলোর চোখ ফুটো করে দেই। এদের সাহস কতো আমার জামাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে? অ*সভ্য মেয়ে কোথাকার! ওদের বকতে ব্যাস্ত আমি আর এদিকে কখন যে আদ্র সাহেব আমার পাশে এসে বসেছে সে খেয়াল আমার নেই। ধ্যান থেকে বেরিয়ে এলাম আদ্র ধাক্কায়।
“ভাবনার রানী কি ভাবছিস?”

“এই তুমি আমায় সব নামের সাথে রানী ডাকো কেন?”

“তুই তো আমার রানী। আমার মন মহলের সিংহাসনের একমাত্র রানী”

উনার এই কথার বিপরীতে কি বলা যায় সেটা আমার জানা নেই। উনার কথার বিপরীতে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। বলার মতো কিছু খুঁজে পাইনা। ঈশিতা আপু এসে বলল,
“গল্প করার জন্য সারাজীবন পাবি এখন আমাদের হলুদ লাগাতে দে”

ঈশিতা আপুর কথায় আদ্রর থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। একে একে বড়রা সবাই হলুদ দিয়ে চলে গেল বাড়ির ভিতরে। বাগানে শুধু আমরা ছোটোরা। আমাদের বিয়ে উপলক্ষে সবাই বাড়ি এসেছে। ইয়াদ ভাই, ইফাজ ভাই, রুদ্র ভাইয়া, রিসাব ভাইয়া সবাই। ইয়াদ আর ইফাজ ভাইয়ার মেঝ আব্বুর কাজের সূত্রে সেখানেই তাঁদের সাথে থাকতো। রিসাব ভাইয়া হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতো। রিসাব ভাইয়া আমার আপন ভাই হলেও রুদ্র ভাইয়ের সাথে যেমন খুনসুটি ময় সম্পর্ক তেমন না। ভাইয়া আমায় অনেক ভালোবাসে তবে তার সাথে খুনসুটি হয় না। রুদ্র ভাই কয়েকদিন আগে পড়াশোনা শেষ করে কাজের জন্য অন্য জায়গায় থাকতো। আজকে আমাদের বিয়ে উপলক্ষে পুরো বাড়ি জমজমাট। সবাই একসাথে। সবার মাঝেও একটা মানুষ অনুপস্থিত। সে আর কে নয় ইভান ভাই। সবাইকে একসাথে দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল। একে একে সবাই হলুদ মাখিয়ে যাচ্ছে। নিজেকে কেমন হোলদিয়াপাখি মনে হচ্ছে। পুরো হাতে, পায়ে, মুখে হলুদের ছড়াছড়ি।

হটাৎ খেয়াল করলাম এক কোণে শুভ ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। কোথাথেকে হুট্ করে তিথি আপু এসে ভাইয়ার পুরো গালে হলুদ লেপ্টে দিলো। শুভ ভাইয়া গম্ভীর মুখে তিথি আপুর দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ভয়ে আছি কখন যেন শুভ ভাইয়া আপুকে দেয় এক ধমক। তবে সেটা হলো না। ভাইয়া আপুকে কিছু না বলে এসে হলুদের বাটি থেকে এক খাবলা হলুদ নিয়ে তিথি আপুর পুরো মুখে লেপ্টে দিলো। আপু বেক্কলের মতো ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। শুভ ভাই পাত্তা না দিয়ে ওখান থেকে চলে গেল। আমি ভাইয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি।

ঈশিতা আপু এলো সবার শেষে। আমার আর আদ্রর পুরো মুখ হলুদ দিয়ে ভুত বানিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার বিয়েতে তোরা আমায় ভুত বানিয়েছিলি আজ আমি তোদের ভুত বানালাম। হিসাব বরাবর”

আদ্র কিছু বলল না পকেট হাতড়ে কিছু খুঁজছে। অবশেষে খুঁজে পেয়ে আলতো হাতে রুমাল দিয়ে আমার মুখের অতিরক্ত হলুদ গুলো মুছে দিতে লাগলো। খুব সতর্কতার সহিত কাজ করছে। উনার সম্পূর্ণ মনোযোগ আমার মুখে। যেন হলুদ উঠাতে গিয়ে আমি ব্যাথা না পাই। ইভা এসে বলল,
“আহা কি ভালুপাসা?”

আদ্র জবাব দিলো না। ওনার সমস্ত মনোযোগ আমার মুখশ্রী তে। হলুদ দেওয়া শেষে সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছি। একেক জন একেক কথা বলছে আর আমরা হাসছি। সব ভাই বোন একসাথে হলে যা হয় আরকি। সবার মাঝে শুভ ভাই চুপচাপ বসে আছে আর তিথি আপু ভাইয়া কে একটু পড় পড় খোঁচাচ্ছে। বেঁচেরা শুভ ভাইয়েরা অবস্থা দেখে আমার মায়া হচ্ছে। আমার শান্তশিষ্ঠ ভাইয়ের কপালে কিনা শেষমেষ তিথি আপুর মতো দুস্টু মেয়ে জুটলো? আমি ওদের দিকে তাকিয়ে আছি এমন সময় গালে কারো হাতের স্পর্শ পেলাম। মনে হচ্ছে গালে কেউ হলুদ ছুঁইয়ে দিয়েছে। কিছুটা শীতল অনুভব হচ্ছে। ফিরে তাকালাম মানুষটার দিকে। মানুষটার দিকে তাকাতেই অনেকটা অবাক হলাম। অনেক দিন পড় মানুষটা আমার সামনে। তাকে দেখে কিছুটা ভয় হচ্ছে। আবার আগেই শেষ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে নাতো? আচ্ছা এতদিন মানুষটা কোথায় ছিলো? সামনের মানুষটা আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে কানে কানে বলে উঠলো,
“বিয়ের জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা রোদপাখি”

আমার মুখ দিয়ে অস্ফুস্ট স্বরে বেরিয়ে এলো,
“ইভান ভাই আপনি?”

#চলবে?