এই জোছনা ধারায় পর্ব-০১

0
96

#গল্পঃ_এই_জোছনা_ধারায়
#সূচনা_পর্ব |০১|
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা

একটু পর পাত্রপক্ষ আসবে এশাকে দেখতে। ও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তাড়াহুড়ো করে চোখে আইলাইনার দিতে গিয়ে লেপ্টে ফেলল। বাসায় একটাই ড্রেসিং টেবিল। সেটিও আবার ভাবীর রুমে। ভাবীর সঙ্গে ওর সম্পর্ক ভালো নয়। এশা খাতির রাখতে চাইলেও ভাবী এশাকে দুই চোখের বিষ মনে করেন।

– ‘অনুমতি ছাড়া তুমি আমার রুমে কেন আসলে এশা? এটা তো অভদ্রতা।’

সুবর্ণা রুমে ঢুকেই বিরক্ত মেজাজে জিজ্ঞেস করলো। এশাকে অপ্রস্তুত দেখালো। এজন্যই তাড়াহুড়ো করছিলো।

– ‘দুঃখিত ভাবী।’

এশা দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ও যদি এখন উচিত জবাব দিতে যায় তাহলেই লঙ্কাকাণ্ড বাঁধবে। ড্রেসিং টেবিলটা তো মিনারা বেগম এশার জন্যই বানিয়েছিল। সুবর্ণা সেটাকে নিজের রুমে ঢুকিয়েছে।

.

এশা আজ হলদে রঙের একটা শাড়ি পরেছে। কি যে মিষ্টি লাগছে ওকে দেখতে! ওর ফর্সা শরীরে খুব ভালো মানিয়েছে। মিনারা বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তার এই দেখতে সুন্দর মেয়েটি জন্ম থেকেই দুর্ভাগা।

এশার জন্মের দুই দিনের মাথায়ই ওর বাপটা অকালে মারা গেল। এরপর তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে মিনারা বেগমের দ্বিতীয় বিয়ে হলো রুহুল আমিনের সঙ্গে। রুহুল আমিন ছিলেন অত্যন্ত চমৎকার মনের মানুষ। এশাকে নিজের মেয়ের মত ভালোবাসতেন। রুহুল আমিনেরও এটি দ্বিতীয় বিয়ে ছিলো। তারও আগে পক্ষের এক ছেলে আছে। রুহুল আমিন, মিনারা বেগম, এশা আর নাদিম.. রুহুল আমিনের আগের পক্ষের ছেলে। চার সদস্যের হাসিখুশি সংসার। কোনো দুঃখ, টানাপোড়েন কিছু ছিলো না।

কিন্তু এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে রুহুল আমিনের মত অমন ঝলমলে, শক্তসমর্থ মানুষটা হঠাৎ করে মারা গেলেন। এরপর দেখতে অসম্ভব রূপবতী মিনারা বেগমকে কতজন বিয়ে করতে চাইলেন। কিন্তু তিনি আর বিয়ের কথা চিন্তা করলেন না। এশা আর নাদিমকে লেখাপড়া শিখালেন। নাদিম এশার চেয়ে বয়সে সাত বছরের বড়। তার লেখাপড়া শেষ। এখন চাকরি পেয়ে বিয়ে করেছে সুবর্ণাকে। প্রেমের বিয়ে। আর এশা পড়ছে অনার্সে। এবার তৃতীয় বর্ষে উঠবে।

এশা তো নাদিমের কেউ হয় না। সে কেন এই বাসায় থাকবে? মিনারা বেগমও নাদিমের কেউ না। তাদের নিয়ে সুবর্ণা কেন সংসার করবে? বাড়তি, উটকো ঝামেলা মনে হয় সুবর্ণার। কবে এই ফাও যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাবে!

***

এশাকে দেখতে কেবল পাত্রের মা আসলেন। মিনারা বেগম ধারণা করেছিলেন কম হলেও তিন-চার জন আসবেন। তিনি সামান্য অবাক হলেন।

ভদ্রমহিলার গা ভরতি চকচকে স্বর্ণের গহনা। পরনে দামি জামদানি শাড়ি। চাল-চলন, বেশভূষায় আভিজাত্য নজরে পড়ে। তাকে দেখেই মিনারা বেগমের মনে হলো, সবকিছু জেনে তিনি এশাকে পছন্দ করবেন তো? ইশ্ যদি করত! এশা তাহলে একটা ভালো ঘরের বউ হতো। মেয়েটার জীবনের দুঃখ ঘুচতো।

পাত্রের মা পলি বেগম শরবত হাতে নিয়ে গর্ব করে বললেন,

– ‘আমার পরিবারে আমার কথা ই শেষ কথা। যেকোন বিষয়ে আমার একার সিদ্ধান্ত ই যথেষ্ট।’

এশা ধীর পায়ে হেঁটে এসে পলি বেগমের মুখোমুখি সোফাটায় বসলো। পলি বেগম প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন,

– ‘কোন ক্লাসে পড়ছো তুমি?’

এশা নিচু গলায় উত্তর দিলো,
– ‘এবার অনার্স তৃতীয় বর্ষে।’

– ‘বাহ! অনেক লেখাপড়া করেছো।’

পলি বেগম এক পিস আপেলে কামড় বসালেন। পুরোটা এক সঙ্গে খেলেন না। এশা খেয়াল করলো ভদ্রমহিলার খাওয়ার কায়দাও আলাদা।

– ‘তুমি কি বিয়ের পর আরো লেখাপড়া করতে চাও? বিয়ের পরে লেখাপড়া আমার বাড়িতে অ্যালাউ করি না।’

এশা প্রত্যুত্তর না করে মিনারা বেগমের দিকে তাকালেন। আর দুইটা বছরই তো! এতদূর এসে লেখাপড়া কেউ ছাড়ে!

.

পলি বেগম বাসায় ফিরে জানালেন মেয়ে তার পছন্দ হয়েছে। তবে বিয়ের পর লেখাপড়াটা আর করতে পারবে না।

মিনারা বেগম দুশ্চিন্তায় পড়লেন। মেয়েটার একটা গতি করতে পারলেই তিনি বাঁচে। সুবর্ণার এত দুর্ব্যবহারের পরও মাটি কামড়ে এই বাসায় পড়ে আছে কোথায়ও যাওয়ার নেই বলে। তবে বেশিদিন আর থাকা সম্ভব হবে না বোধ হয়। এর আগেই যদি এশার বিয়েটা দিতে পারতো! সুবর্ণা দিন দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। নাদিমও কোনো প্রতিবাদ করছে না।

নাদিমের সাথে তাদের কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। সুবর্ণার সংসারে তারা বাড়তি ঝামেলা– এ কথা তো মিথ্যা নয়।

মিনারা বেগম এশাকে জিজ্ঞেস করল,
– ‘কি বলবো উনাদের?’

এশা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
– ‘এত কষ্ট করে লেখাপড়া করে এই পর্যায়ে ছেড়ে দিবো?’

– ‘লেখাপড়া করলেই কি তুই চাকরি পেয়ে যাবি? চাকরি পাওয়া তো এত সহজ না।’

এশা কিছু বলল না। মিনারা বেগম বললেন,
– ‘কত ভালো সম্বন্ধ! উনারা ধনী পরিবার। নিজেদের বিরাট ব্যবসা আছে। ছেলেও শিক্ষিত। বিয়েতেও আমাদের থেকে কিছু নিবে না। এর চেয়ে ভালো সম্বন্ধ তোর জন্য আর পাবো? আমাদের তো কিছুই নেই। কয়দিন পর বোধ হয় মাথা গোঁজার জায়গাও থাকবে না।’

মিনারা বেগমের চোখ ছলছল করছে। তিনি একটু পরই বোধ হয় কেঁদে ফেলবেন। এশা তার হাত ধরে সান্তনা দিয়ে বলল,

– ‘মন খারাপ করো না। আমি একটা ছোটখাটো চাকরি খুঁজছি। তাও মিলাতে পারছি না।’

– ‘সুবর্ণা আজ সকালে কি কাণ্ড করেছে জানিস! ওরা দুইজনে চারটা পরোটা বানিয়ে খেয়ে ফ্রিজটা লক করে বাইরে চলে গেছে। রান্নাঘরে গিয়ে দেখি সেখানেও সবকিছু আটকানো। ময়দাটা পর্যন্তও। আমি সকাল থেকে শুধু পানি খেয়েছি।’

এশা ওর ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা পাউরুটির প্যাকেট বের করলো। অর্ধেকটা খাওয়া।

– ‘এটা খেয়ে নাও। ভাবী এখনও আসেনি?’

– ‘না আসেনি।’

– ‘কোথায় গিয়েছে?’

– ‘তা তো বলে যায়নি।’

এশা অনেকক্ষণ বিমর্ষ মুখে বসে রইল।

– ‘আচ্ছা আমি যদি লেখাপড়া ছেড়ে বিয়েটা করে নিই তাতে কি তোমার দুঃখ ঘুচবে?’

– ‘মেজো ভাইজান বলেছে তোকে বিয়ে দিয়ে তার বাসায় চলে যেতে। দুঃখ তো কোনো কালেই ঘুচে নাই রে মা।’

এশা বিয়েতে রাজি হলো। পলি বেগম জানতেন রাজি হবে। মেয়েটার নেই কোনো ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড! সৎ বাপের আগের পক্ষের ছেলের সংসারে কোনো রকম খেয়ে পরে আছে। এত ভালো প্রস্তাব তারা পায়ে ঠেলবে কেমনে!

পলি বেগম ছেলের বউ হিসেবে ছোট ঘরের সুন্দরী মেয়েই পছন্দ করেন। মাথা নিচু করে চলে তার সামনে। তার বড় দুই ছেলের বউও ছোট ঘরের। এত বছরেও তার মুখের উপর একটি কথা বলার দুঃসাহস করেনি।

বিয়েতে ছেলের শ্বশুর বাড়ি থেকে এক পয়সার সুতাও নেননা পলি বেগম। এই সংসারের সমস্ত কিছু তার নিজের থাকবে। ছেলের শ্বশুর বাড়ি থেকে এটা সেটা এনে বউদের দাপট বাড়ানোর মত বোকা সে নয়!

***

এশা ক্লান্ত চেহারায় টিউশন থেকে ফিরেছে। হাত ব্যাগটা বিছানার উপর রেখে বারান্দায় গিয়ে বসে রইল।

– ‘এশা কই তুই?’

মিনারা বেগমের গলা পাওয়া যাচ্ছে। এশা উত্তর দিলো না। এই মুহুর্তে ওর গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।

– ‘এখানে বসে আছিস তুই? ওই ছেলেটা নাকি তোর সাথে একটু দেখা করবে।’

এশা মিনারা বেগমের তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
– ‘কোন ছেলে?’

– ‘যার সাথে তোর বিয়ের কথা চলছে। কি যেন নাম বলল ছেলেটার! ভুলে গেলাম।’

এশা শুনেছে ছেলেটার নাম ফুয়াদ। তার ছবি টবি দেখেনি এখনো।

– ‘উনার মায়ের সিদ্ধান্ত ই নাকি সব। তাহলে উনার আবার আমাকে আলাদা করে দেখার কি আছে?’

– ‘এত কথা বলিস না। তাড়াতাড়ি তৈরি হ। কোন জামাটা পরবি?’

মিনারা বেগম আলমারি খুলে এশার সবচেয়ে সুন্দর জামাটা বের করলো। যদিও ওর তেমন বেশি সাজপোশাক নেই। গাঢ় সবুজ রঙের সালোয়ার-কামিজে এশাকে দেখতে অপূর্ব সুন্দর লাগছে। এশার মন টানছে না। তবুও পা বাড়ালো গেটের দিকে। এটা বিয়ে নাকি একটু খেয়ে পরে বেঁচে থাকার চেষ্টা?

(চলবে)…