এই জোছনা ধারায় পর্ব-০৮

0
71

#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-৮

এশা হাসপাতালের সামনে অনেকক্ষণ যাবৎ দাঁড়িয়ে আছে। বাসায় ফিরবে বলে মনস্থির করলেই পলি বেগমের ভয়ঙ্কর চেহারা চোখে ভেসে উঠে। সেই ভীতি, আতঙ্ক কাটিয়ে আর সামনে পা ফেলার সাহস হয় না। ওদিকে ফুয়াদ ও বাসায় নেই। সে কোন মেয়েকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

এরচেয়ে মেজো মামা না সাধলেও তার বাসায় যাওয়া ভালো ছিলো। কিন্তু এখন যেতে বিব্রত বোধ হচ্ছে। তাছাড়া ও এখন এভাবে গেলে মিনারা বেগম দুশ্চিন্তায় পড়বেন। এমনিতেই তিনি অসুস্থ। শ্বশুর বাড়িতে ও ভালো নেই—এ কথা তো মিনারা বেগমকে জানায়নি। মানুষটা সারাজীবন চেয়েছে এশার ভালো পরিবারে বিয়ে হবে, ও রাজরানীর মত থাকবে। ফুয়াদের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর তিনি ভেবেছিলেন সত্যি তার মেয়ের জীবনে রাজপুত্র এসেছে। নিজে ভাইয়ের বাসায় উটকো ঝামেলার মত থাকলেও, তার মেয়েটা ভালো আছে এই ভেবে আনন্দ পান। এশা তার সেই আনন্দ নষ্ট করতে চাইছে না।

শেষমেশ এশা বাসায় ফেরার সাহস সঞ্চয় করতে না পেরে সিদ্ধান্ত নিলো নাদিমের বাসায় যাবে আপাতত। এরপর কি হবে জানে না। কিন্তু এই মুহুর্তে পলি বেগমের মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে এটা সহজ মনে হচ্ছে।

নাদিমের বাসা এখান থেকে কাছেই। ও সূবর্ণার পছন্দের এক বক্স আইসক্রিম কিনে রিক্সায় চেপে বসলো। ওর এখন গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।

দরজা খুলে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে এশাকে দেখে অবাক হলো সূবর্ণা।

–আল্লাহ! বড়লোকের বউ আমার বাসায় আসছে।

এশা কোনো প্রত্যুত্তর না করে জোর করে একটু হেসে ভিতরে ঢুকলো। সূবর্ণা আবার বলল,

–বড়লোকের বউ শুধু আমার জন্য আইসক্রিম নিয়ে আসছে।

–আসার কোনো প্ল্যান ছিলো না ভাবী। এখানে একটা কাজে আসছিলাম তাই ভাবলাম তোমাদের একটু দেখে যাই।

–ভালো করেছো। কিন্তু আজ যেতে পারবে না। ফুয়াদকেও ফোন করে আসতে বলো।

–সে ব্যবসার কাজে অনেক ব্যস্ত।

এশা ভেবেছিলো সূবর্ণা ওকে দেখে বিরক্ত হবে। মনে মনে হয়েছে কিনা জানে না তবে তার চেহারা প্রফুল্ল ই দেখাচ্ছে। এশা একটু স্বস্তি পেল।

–আমি তাহলে তোমার জন্য রান্না বসালাম। আজ কিছুতেই যেতে পারবে না।

সূবর্ণা না সাধলেও এশা থাকতো। সেধেছে সেটা তো ওর প্রত্যাশার অতিরিক্ত।

ওর সাথে এত ভালো আচরণ আগে কখনো করেনি সূবর্ণা। যতই শত্রুতা থাক, মানুষ দূরে গেলে নাকি মায়া বাড়ে। সূবর্ণারও কি মায়া বেড়েছে নাকি ওর ধনী পরিবারে বিয়ে হয়েছে বলে খাতির করছে? কই মিনারা বেগমের প্রতি তো সূবর্ণার কোনো মায়া হয়নি।

সূবর্ণা এশার জন্য খুব আগ্রহ করে রান্না বসালো। এশা ফ্রেশ হয়ে অনেকদিন পর নিজের চিরচেনা রুমটাতে ঢুকলো। এটাকে কি নিজের রুম বলা সাজে? তবুও কেন জানি বলতে ইচ্ছে করে। রুমের দেয়ালে এখনো ওর আর মিনারা বেগমের একটা ছবি টানানো। এশার বুকের ভিতর হাহাকার করে উঠে। মনে হয় এটা ওর বাপের বাড়ি। এই জৌলুসহীন, সাদামাটা রুমটা ওর এত প্রিয়! রুমটাতে ভালো একটা ফার্নিচারও নেই! এশা নিজের পরিচিত বিছানায় একটু আরাম করে শুয়ে চোখ বুঁজলো।

এই বাসায় না হয় একদিন থাকলো। তারপর কি করবে? এশা ভেবে পেল না। আল্লাহ নিশ্চয়ই কোনো একটা ব্যবস্থা করবেন—এই বলে ও নিজের মনকে প্রবোধ দিলো।
__

এশা একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল। এর ভিতর ওর ফোন বেজে উঠলো। ফুয়াদ ফোন করেছে! সে তো বলেছিল তার ফোন দুইদিন বন্ধ থাকবে। যে মানুষটা ওকে চড় মেরেছে, অন্য আরেকটি মেয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার ফোন কেন ও এত ব্যগ্র হয়ে ধরলো কে জানে!

—এশা কোথায় তুমি?

ও আস্তে করে বলল,

–নাদিম ভাইয়ার বাসায়।

এরপর ফুয়াদ আর কিছু না বলে লাইন কেটে দিলো। শুধু এইটুকু জিজ্ঞেস করার জন্য ফোন করেছে সে? বাড়িতে নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে! সেটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

ফুয়াদ ঠিক করেছিল দুইদিন পর বাসায় ফিরবে। কিন্তু একদিন পার হতেই ওর হঠাৎ বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করলো। এমন ইচ্ছে আগে কখনো হয়নি।

ও বাসায় ফিরে দেখলো পলি বেগম লঙ্কাকাণ্ড করছেন এশার কাণ্ড নিয়ে। ফুয়াদ শুনে খুশি হলেও মুখে প্রকাশ করলো না। যাক মেয়েটার শরীরে একটু সাহস হয়েছে!
__

ফুয়াদ ফোন করার কিছুক্ষণ পরই এশা রুমের বাইরে ফুয়াদের গলা শুনতে পেল। প্রথমে ভাবলো মনের ভুল। সে এখানে আসবে কি করতে?

এর ভিতর সূবর্ণা রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এশাকে বলল,

–ফুয়াদ এসেছে। আর তুমি রুমে বসে আছো!

এশা বিস্মিত মুখে রুম থেকে বের হলো। ফুয়াদ সোফায় বসে আছে। সূবর্ণা বলল,

–তোমরা থাকো। আমার রান্না চুলায়। ফুয়াদ এসে ভালো করেছে। দুইজনেই আজ থেকে যাবে।

এশা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। সূবর্ণা এরকম একটু ভালো আচরণ যদি মিনারা বেগমের সঙ্গে করতেন তাহলে তাকে অন্যের বাড়িতে পড়ে থাকতো হতো না।

সূবর্ণা রান্না ঘরে যাওয়ার পর ফুয়াদ এশাকে জিজ্ঞেস করল,

–বাসায় না গিয়ে এখানে আসছো কেন?

এশা সহজ ভাবে উত্তর দিলো,

–ভয় করছে যেতে।

ফুয়াদ হেসে বলল,

–এত ভয় পাওয়ার কি আছে? মানুষ কী মানুষকে গিলে খেয়ে ফেলতে পারে? বড়জোর চিৎকার, চেঁচামেচি করবে।

–গায়েও হাত তুলতে পারে।

ফুয়াদ এবার কিছুক্ষণ চুপ থেকে এশার হাত ধরে বলল,

–দুঃখিত! তোমাকে চড় মেরেছি। আমি মাঝে মাঝে অনেক বেশি ফ্রাস্টেটেড হয়ে যাই। তখন কী যে করে বসি।

এশা রাগ, অভিমান কোনো কিছু না করেই বলল,

–ফ্রাস্টেটেড হয়ে তো অন্য কাউকে চড় দেননি। আমাকে দিয়েছেন। কারণ আপনি জানেন আমাকে চড় দিলে কিছুই হবে না।

–দুঃখিত! এখন আমার সঙ্গে চলো।

–অবশ্যই যাবো। যাদের অর্থবিত্ত নেই তাদের আত্মসম্মানও নেই। চড় দিলেও যেতে হবে। অন্য মেয়েকে নিয়ে বাইকে করে ঘুরে বেড়ালেও যেতে হবে।

ফুয়াদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

–কে বাইকে করে মেয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়? আমাকে বললে?

এশা উত্তর দিলো না। ফুয়াদ এ্যানিকে নিয়ে ঘুরেছিল। এশা কি সেটা দেখেছে? এ্যানি তো স্রেফ ওর বন্ধু।

–কি হলো কথা বলছো না কেন?

এশা এবারও কিছু না বলে ওখান থেকে উঠে আসলো। সূবর্ণা একা একা রান্না করছে। তাকে সহযোগিতা করা উচিত। নিশ্চয়ই সে এতক্ষণ একা কাজ করতে করতে ওকে মনে মনে ভয়াবহ বকাঝকা করেছে।
__

সূবর্ণা ওদের যত্ন আত্তি করে খাওয়ালো। নাদিম বাসায় নেই। সে অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে গেছে।

খাওয়া শেষে ফুয়াদ বলল,

–আমরা আজ থাকতে পারবো না। অন্যদিন আসবো। জরুরি কাজ আছে একটু।

এই বলে ওরা নাদিমের বাসা থেকে বের হলো। গেটের সামনে এসে এশা দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল,

–বাসায় ফিরতে আমার সত্যি ভীষণ ভয় করছে।

ফুয়াদ বাইক নিয়ে এসেছে। সে বাইকে স্টার্ট দিয়ে বলল,

–ভয় পেতে হবে না। তুমি বাইকে উঠো। আমরা বাসায় যাবো না।

–তাহলে কোথায় যাবো?

ফুয়াদ এই প্রশ্নের উত্তর দিলো না। এশা ফের জিজ্ঞেস না করে বাইকে উঠে বসলো। এখন ওর স্মৃতিতে একটা দৃশ্যই ভাসছে! ফুয়াদ এই বাইকে করেই অন্য আরেকটা মেয়েকে নিয়ে ঘুরেছে।

–আমি খুব স্পীডে বাইক চালাই। ভালো করে ধরে বসো।

এশা একদম জড়সড় হয়ে ফুয়াদকে না ধরেই বসেছিল। ফুয়াদ বলার পর ধরে বসলো। কিন্তু সে খুব বেশি গতিতে বাইক চালাচ্ছে না! শুধু শুধু মিথ্যা বলেছে!

বাইক একটা বাসার সামনে থামলো। ফুয়াদ ওকে কোথায় নিয়ে এসেছে? এশা আশেপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

–আমরা এখানে এসেছি কেন?

–এখানে আমরা আজকে থাকবো। আসো আমার সাথে।

–এটা কার বাসা?

–এত প্রশ্ন করো না তো। আমার সাথে আসো।

এশা একটু সংশয় নিয়ে আশেপাশে তাকাতে তাকাতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। ফুয়াদ ওর আগে আগে। সে পিছনে তাকিয়ে বলল,

–লিফট নষ্ট হয়েছে গতকাল। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে তোমার কষ্ট হচ্ছে? আট তলায় উঠতে হবে।

এশা মাথা নাড়িয়ে না বলল। ফুয়াদ আট তলার একটা ফ্ল্যাটের দরজা খুলে এশাকে বলল,

–আসো। এটা আমার বাসা।
(চলবে)

#ইসরাত_জাহান_তানজিলা