এই জোছনা ধারায় পর্ব-১০

0
63

#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-১০

ফুয়াদ চলে যাওয়ার পর এশা দীর্ঘ সময় ধরে বিমর্ষ মুখে বসে রইল। ভালোবাসা, মায়া-টান কোনো কিছু না করলেও হঠাৎ করে সে এশাকে রেখে নিজের মর্জি মত দেশের বাইরে চলে যেতে পারে? বিয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক তার কাছে এত তুচ্ছ, অবজ্ঞার! তাহলে শুধু শুধু বিয়েটা করেছে কেন? সত্যি যদি ফুয়াদ এরকম পরিকল্পনা করে রাখে তাহলে ওর জীবনটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে!

আর কারো প্রতি মায়া-টান কি বলে বলে হয়? ব্যাপারটা কি এমন যে হতে বললে হবে আর নিষেধ করলে হবে না? বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আপনাআপনিই ভালোবাসা, মায়া-টান হয়ে যায়। ফুয়াদের হয়ত হয়নি। কারণ সে বিয়েটা মন থেকে করেনি। কিন্তু এশার তো হয়েছে। ও ফুয়াদের ভালবাসা প্রত্যাশী!

মাছ, মাংস ধুয়ে রান্নার জন্য প্রস্তুত করে রাখা। কিন্তু এই মুহূর্তে আর রান্না করতে ইচ্ছে করছে না এশার। ও একবার মনস্থির করলো রান্না করবে না। পরে আবার ভাবলো ফুয়াদ এসে খাবার না পেলে ব্যাপারটা ভালো দেখাবে না।

এশা রান্না করলো। গরুর মাংস, বাসমতি চালের ভাত, বড় কাতলা মাছ আর সালাদ। ফুয়াদ রান্নার জন্য আরো কিছু আনাতে চেয়েছিলে। এশা নিষেধ করেছে। দুই জন মানুষের জন্য এত আয়োজনের কি দরকার!

কাতলা মাছ রান্নার সময় এশার বুকের মধ্যে হু হু করে উঠলো। মিনারা বেগম বড় কাতলা পছন্দ করেন। মেজো মামার বাসায় কি হালে যে আছে মানুষটা! এশার তো সারা জীবনে একটাই ইচ্ছে ছিলো। লেখাপড়া করে একটা চাকরি নিয়ে মাকে ভালো রাখবে। এরচেয়ে বড় কোনো স্বপ্ন ও দেখেনি। ওর এই ছোট স্বপ্নটাও বড় অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে।

রান্নাবান্না শেষ করে এশা ফ্রেশ হয়ে নেয়। এই মুহূর্তে হাতের কাছে শাড়ি, গহনা কিছু থাকলে ও সেগুলো পরে সেজেগুজে ফুয়াদের জন্য অপেক্ষা করতো। ফুয়াদ এই সম্পর্কটা নিয়ে যতই উদাসীন হোক কিন্তু এশার মন চাচ্ছে। মনে চাওয়ার ব্যাপারে তেমন কোনো যুক্তি খাটে না।

এগারোটার কাছাকাছি বাজে। ফুয়াদ এখনো ফিরেনি। একবার ফোন দিয়ে দেখবে কিনা এশা চিন্তা করলো। পরে আবার কি ভেবে দিলো না। সংকোচ হলো। বন্ধুদের সঙ্গে আছে সে, ফোন দিয়ে বিরক্ত করবে! হয়ত দেরি করে ফিরবে।
__

আড্ডার শেষ দিকে ফুয়াদ একটা সিগারেট ধরালো। সিগারেটটা শেষ করেই বাইকে উঠবে বাসার উদ্দেশ্যে। কিন্তু এমন সময় নাফিস সবাইকে বলল,

–চল আমরা মাওয়া ঘাটে গিয়ে ইলিশ খেয়ে আসি।

অন্যদিন হলে ফুয়াদ সবার আগে সম্মতি দিতো। কিন্তু আজ মাথায় একটু এশার চিন্তা আসলো। মেয়েটা নতুন জায়গায় সম্পূর্ণ একা। নিশ্চয়ই ওর জন্য অপেক্ষা করছে।

ফুয়াদ প্রথমে বলল,

–তোরা যা। আমি যাবো না।

কিন্তু সবাই মিলে ওকে এমন ভাবে চেপে ধরলো!

–যাবি না মানে? কেন যাবি না?

বউয়ের জন্য বাসায় ফিরতে হবে এটা বন্ধু সমাজে বলে নিজের পৌরুষ কমাতে চাইলো না ফুয়াদ। এছাড়া অন্য কোনো কারণও ধোপে টিকলো না। শেষমেশ ওকে যেতে হলো।

অপেক্ষা করতে করতে বারোটা পার। এশা এবার ফোন করলো ফুয়াদকে। বাইকের গতি কমিয়ে ফুয়াদ ফোন ধরলো।

এশা কিছু বলার আগেই সে বলল,

–আমি মাওয়া যাচ্ছি। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। বাসা হাই সিকিউরড। কোনো সমস্যা হবে না। ভয় পেয়ো না।

এশা মন খারাপ চাপিয়ে আস্তে করে বলল,

–ঠিক আছে।

–রান্না শেষ? খলিল চাচা সজাগ থাকলে তাকে খাবার দিও।

–তাকে এখন আমি পাবো কোথায়?

–আছে গেটেই। ফোন নম্বর দিচ্ছি তোমাকে ম্যাসেজ করে।

–আচ্ছা।

এশা একটু থেমে জিজ্ঞেস করল,

–আপনি সারা রাত বাইরে থাকবেন?

–শেষ রাতের দিকে ফিরবো। তুমি দরজা আটকে ঘুমিয়ে পড়ো।

–আপনি তাহলে বাসায় ঢুকবেন কীভাবে?

–পারবো ঢুকতে।

এই বলে ফুয়াদ ফোন রেখে দিলো। ওর বন্ধুরা বেশ দূরে চলে গেছে। ও বেপরোয়া গতিতে ছুটে ওদের ধরার চেষ্টা করলো।

এশা ঝিম ধরে খাবার টেবিলে বসে রইল। ওকে নতুন একটা বাসায় একা রেখে সে মাওয়া যাচ্ছে! আর সেটা ওকে ফোন দিয়েও জানানোর মত সামান্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করলো না। উল্টো ওর ফোন করে জানতে হলো।

একা বাসায় ওর ভয় করছে না। কিন্তু এত
আগ্রহ করে রান্না করলো। এরপর ফুয়াদের সঙ্গে খাবে বলে খাবার বেড়ে বসে ছিলো। এসব কিছুরই যেন দাম নেই। তার গলায় সামান্য অনুশোচনাও নেই।

এশা খলিল চাচাকে ফোন করে ডেকে খাবার দিলো। এরপর বিষণ্ণ মুখে নিজে খেয়ে নিলো। খাওয়া শেষে ও পুরো বাসাটা ভালো করে একবার পর্যবেক্ষণ করলো। এখানে কোনো মেয়ে মানুষের যাতায়াত আছে কিনা ধরার চেষ্টা করলো! না, সেরকম কিছুই পেল না।

সব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে এশা বিছানায় শুয়ে চোখ বুঁজলো। কিন্তু ওর মাথায় কেবল ফুয়াদের চিন্তাই আসছে। মানুষটার প্রতি ও এত আকর্ষণ বোধ করছে কেন! সে তো বলেই দিয়েছে তার প্রতি মায়া-টান না করতে।
__

ফুয়াদ শেষ রাতের দিকে বাসায় ফিরে। রুমের আলো জ্বালানো। এশা আলো না নিভিয়েই ঘুমিয়েছে। উজ্জ্বল লাইটের আলোতে ওর ঘুমন্ত চেহারা অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে। ফুয়াদ এক নজর সেদিকে তাকিয়ে বাথরুমে ঢুকে ফ্রেশ হতে।

এশার পরনে গাঢ় সবুজ সালোয়ার-কামিজ। ওড়নাটা বালিশের পাশে রাখে। বুকের কাছটা অনেকখানি উন্মুক্ত। সালোয়ার গুটিয়ে উপরে উঠে ধবধবে ফর্সা পা বের হয়ে আছে। লম্বা চুলগুলো বিছানা জুড়ে ছড়ানো। অত্যন্ত রূপসী, চিত্তাকর্ষক কোনো অপ্সরা ঘুমিয়ে আছে যেন!

এই মেয়েটাকে হঠাৎ এত সুন্দর, আকর্ষণীয় লাগছে কেন? নাকি আগেও লাগতো কিন্তু ও খেয়াল করেনি! ফুয়াদ ওর মাথার কাছে বসে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে গভীর মনোযোগে। ওর মুখে পড়া বিরক্তিকর চুল গুলো সরিয়ে দেয়।

অনেকক্ষণ বসে থাকার পর লাইট বন্ধ করে এশার পাশে শুয়ে পড়ে ফুয়াদ। মিষ্টি একটা ঘ্রাণ আসছে। এতদিনও আসতো নিশ্চয়ই। ও সেভাবে খেয়াল করার চেষ্টা করেনি। ফুয়াদ আস্তে আস্তে এশার চুলে নাক ডুবালো। কী ব্যবহার করে ও চুলে? চমৎকার ঘ্রাণ তো!

ও এবার এশাকে নিজের ডান বাহুতে টেনে নেয়। মেয়েটার ঘুম খুব ভার। এই শেষ রাতে ঘুম ভাঙিয়ে ওকে বিরক্ত করতে চাইলো না। ফুয়াদ নিজের বাহুডোরে এশাকে গভীর ভাবে আবদ্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লো।
__

সকাল বেলা এশার অনুভব হলো কেউ ওকে অক্টোপাসের মত পেঁচিয়ে ধরে আছে। ও নড়তে পারছে না। হতচকিত হয়ে চোখ খুলে ফুয়াদের আলিঙ্গনে নিজেকে আবিষ্কার করলো। ও আরো বিস্মিত হয়। এই লোকটা এভাবে ওকে নিজের বাহুডোরে আটকে রেখেছে!

এশার নড়াচড়ায় ফুয়াদের ঘুম ভেঙে যায়। সে বিরক্ত হয়ে চোখ খুলে ঘুম জড়ানো গলায় বলল,

–নড়ো না। চুপচাপ শুয়ে থাকো এভাবে।

অগত্যা এশাকে ওভাবেই শুয়ে থাকতে হলো। ফুয়াদের এত ভীষণ কাছে ও! ওর শ্বাস ভারী হয়। হৃৎস্পন্দন বাড়ে। ও পলকহীন ভাবে তাকিয়ে থাকে। ফুয়াদকে মুগ্ধ চোখে দেখে। ফুয়াদের প্রেমে পড়ে। তার প্রতি সেই নিষিদ্ধ ভালোবাসা, মায়া-টান অনুভব করে। এশা ফুয়াদের বুকে মুখ ডুবালো। ওর মনে তীক্ষ্ণ ধারালো শীতল অনুভূতি হয়। গভীর প্রেম জাগে। সেই প্রেমাতুর হৃদয় নিয়ে ও আবার ঘুমিয়ে পড়লো।
__

–এশা দ্রুত উঠো দ্রুত। বাসায় ফিরতে হবে। মা কয়েকশ কল দিয়েছে।

ফুয়াদের গলায় অতি ব্যস্ততা। এশা ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে বসে। ফুয়াদ বলল,

–বাসায় কিছু না বলে নিখোঁজ হয়ে আছি। কী হবে ভাবতে পারছো! মায়ের ফোনও ধরিনি।

এশা দ্রুত ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে নিলো।

–আমি তোমাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিবো। তুমি একা বাসায় যাবে। আমি পরে যাবো।

ফুয়াদ বলল। এশা ভীতু গলায় জিজ্ঞেস করল,

–বাসায় ফিরে আমি কি বলবো? কোথায় ছিলাম! আমাকে নিতে এসে আপনিও ফিরলেন না। তাছাড়া আমি মায়ের অনুমতি ছাড়া বেড়িয়ে এসেছি।

ফ্ল্যাটের দরজা লক করতে করতে ফুয়াদ বলল,

–সাহসী হও। আমি সাহসী, বুদ্ধিমতি মেয়ে পছন্দ করি। আজ দেখবো তোমার বুদ্ধি কতটুকু। তুমি এই পরিস্থিতি কীভাবে সামলাও।

এশা মোটেও বোকা না। কিন্তু পলি বেগমের সামনে ওর বুদ্ধি কী কাজে আসবে? সে কি ওর কোনো যুক্তি শুনতে বসে আছে?

ফুয়াদ এশাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিলো। এশার হাত-পা ঈষৎ কাঁপছে আতঙ্কে। ফুয়াদ বলল,

–তুমি থার্ড ইয়ারের বইপত্র কিছু কিনোনি? রুমে তো দেখলাম না। না কিনলে তালিকা দাও আমি নিয়ে আসবো।

এশার গলা শুকিয়ে আছে এই মুহূর্তে। ও বলল,

–কিছু কিনেছি। বাকী গুলোর নাম এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না।

–তুমি ভয়ে এরকম করছো কেন! কি আশ্চর্য! বইয়ের নাম এক্ষুণি আমার ফোনে টেক্সট করে দিয়ে ভিতরে যাও।

এশা মাথা নাড়িয়ে যন্ত্রের মত হ্যাঁ বললো কেবল। ফুয়াদ চলে গেল।
(চলবে)

#ইসরাত_জাহান_তানজিলা