#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-১১
এই মুহূর্তে ফুয়াদকে স্বার্থপর ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না এশার। বিয়ের পর থেকে দেখে আসছে সে সব ব্যাপারে ওকে সামনে ঠেলে দিয়ে নিজে গা বাঁচিয়ে চলছে। বাসার অন্য সকলের মত পলি বেগমের প্রতি ভয় ফুয়াদের নেই। এ কয়দিনে এশা তা অনুমান করতে পারছে। ফুয়াদ মোটেও ভীতু কিংবা সাহসহীন গোছের মানুষ নয়। সে ভীষণই চতুর, বুদ্ধিমান, সাহসী। তাহলে সে পলি বেগমের মুখোমুখি না হয়ে এশাকেই কেন বার বার তোপের মুখে ফেলতে চায়? ফুয়াদ পলি বেগমকে মন থেকে মান্য করে না আবার তার বাড়াবাড়ির বিপক্ষে কথাও বলে না। কেন এত ভনিতা? অন্য কোনো ব্যাপারে তো সে এরকম ভনিতা না।
ফুয়াদকে বইয়ের নাম ম্যাসেজ করে দিয়ে এশা কিছুক্ষণ গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর এক প্রকার প্রাণের মায়া ভুলে বাসার ভিতরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা ফেলে। ভয়ে ওর পা দুইটা যেন দুর্বল হয়ে আসছে। এত আতঙ্কিত ও বোধ হয় জীবনে আর কখনো হয়নি। সকাল বেলার এই ঠাণ্ডা আবহাওয়ায়ও ঘেমে যাচ্ছে।
বাসায় ঢোকার মূল দরজা ভিড়ানো। এশা চোরের মত নিঃশব্দে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো। সকালের নাস্তা সেরে সবাই যার যার রুমে। কথার আওয়াজ পাওয়া গেলেও এই মুহূর্তে রুমের বাইরে কেউ নেই। এশা সামান্য স্বস্তি পেল। ও পা টিপে টিপে নিজের রুমের দিকে হাঁটতে লাগলো। সিঁড়িতে ছুটা বুয়া নার্গিসের সামনে পড়লো। সে কি এক্ষুণি গিয়ে ওর আসার খবর পলি বেগমকে দিবে?
রুমের দরজা বন্ধ করে লম্বা একটা দম ফেলে এশা। ওর হৃদযন্ত্রটা এমন ভাবে লাফাচ্ছে! ও নিজেকে স্থির করতে চেয়ারের উপর বসলো। যে কোনো মুহূর্তে পলি বেগমের তাণ্ডব শুরু হবে!
__
শম্পা নিজের রুম থেকে বের হয়ে মারুফার রুমের দিকে গেল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
–ভাবী কি করছো?
–কিছু করছি না। আসো ভিতরে আসো।
শম্পা ভিতরে ঢুকে খাটের উপর বসলো।
–তোমার শাশুড়ির ছোট ছেলে আর ছেলের বউয়ের খোঁজ পেলে?
মারুফা একটু হেসে বলল,
–আমার শাশুড়ি তোমার কে হয়? যাও দরজা লাগিয়ে দিয়ে এসে এসব কথা বলো। শাশুড়ি মা কোনো ভাবে শুনতে পেলে..।
শম্পা দরজায় ছিটকিনি আটকে দিলো। এরপর মারুফাকে বলল,
–ফুয়াদের বউ কাল এসে আজ এসব তালবাহানা করছে! আর সব নিয়ম-কানুন আমাদের বেলায়। আমি রাহাতকে পরিষ্কার বলে দিয়েছি ফুয়াদের বউ যদি নিজের ইচ্ছা মত চলে, আমিও আমার ইচ্ছা মত চলব।
–তারপর রাহাত কি বলল?
–কি বলবে! কিছুই বলেনি। সত্যি দেখো এবার। বিয়ে হলো কত বছর! নিজের পছন্দ মত কিছু রান্না করে খেতে গেলেও কত কাহিনী!
মারুফা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–তুমি তাও রাহাতকে এসব কথা বলতে পারো! আমি যদি এসব বলতে যাই ফয়সাল আমার মুখের উপর দিবে। সে খাঁটি মা ভক্ত ছেলে। আমার জীবনটা এভাবেই কাটবে শম্পা। আফসোস করে কোনো লাভ নেই।
–আমারও বা কী লাভ বলো? রাহাতকে এসব বলে কি কোনো ফয়দা হবে। সে কি মায়ের অবাধ্য হবে? সবই টাকা আর সম্পত্তির খেলা ভাবী। অবাধ্য হওয়ার সুযোগ নেই।
–কিন্ত আমার তো মনে হয় মায়ের জায়গা সম্পত্তি কিছু না থাকলেও ফয়সাল এরকমই মা ভক্ত হতো।
শম্পা আফসোসের স্বরে বলল,
–আশেপাশে দেখো মানুষ বিয়ের দুইদিনের মাথায় স্বামী নিয়ে আলাদা সংসার পাতে! আর আমাদের কি কপাল!
–আমি শুধু এশার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি। আমার তো মনে হচ্ছে ওকে তলে তলে ফুয়াদ আশকারা দিচ্ছে। নয়ত এত সাহস পায় কোথায়!
শম্পা তেজি গলায় বলল,
–সে যাই হোক ভাবী। দেখি কয়টা দিন। এশা এভাবে চলতে থাকলে আমরাও নিজেদের খুশি মত চলতে শুরু করবো।
মারুফা কিছু বলল না। শম্পাকে ওর জানা আছে। তার দৌড় এই মুখে বলা পর্যন্তই। পলি বেগমের একটা ধমক খেলে বাপের নামও ভুলে যাবে।
শম্পা মারুফার রুম থেকে বের হয়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচ তলায় যাওয়ার সময় হঠাৎ দেখলো ফুয়াদের রুমের দরজা ভিতর থেকে আটকানো। দরজা তো দুইদিন ধরে বাহির থেকে আটকানো ছিলো। ওরা কি বাসায় ফিরেছে? নিশ্চয়ই ফিরেছে! নয়ত দরজা ভিতর থেকে আটকাবে কে!
ওরা বাসায় ফিরলে বাসার ভিতর লয় প্রলয় হওয়ার কথা। অথচ তেমন কোনো সাড়াশব্দই নেই। কী অদ্ভুত ব্যাপার! কেউ কি জানে না?
শম্পা আবার মারুফার রুমে ছুটে গেল। মারুফা বলল,
–দেখো কি সাহস! যাও মায়ের কাছে বলে আসো।
শম্পা হন্তদন্ত হয়ে গিয়ে এই অতি গুরুত্বপূর্ণ খবরটা পলি বেগমের কানে দিলো। তিনি বেশ শান্ত গলায় বলল,
–ঠিক আছো। তুমি যাও। আমি দেখছি।
পলি বেগম এমন প্রতিক্রিয়া করছেন যেন এটি খুব সাধারণ বিষয়! কী আশ্চর্য ব্যাপার! শম্পা তীব্র আশাহত হলো।
–আজকে দুপুরে একটু ভালো আয়োজন করো।
শম্পা চলে আসার সময় পলি বেগম ডেকে বললেন। উত্তরে ও হ্যাঁ সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো।
এত সহজে এশা পার পেয়ে যাবে! ওর কোনো শাস্তি হবে না! ভালো ব্যাপার তো! এরকম হলে ও আর মারুফাও তো যা খুশি করতে পারে।
__
পলি বেগম বাসার সামনে শখ করে করা সবজি বাগানে পানি দিচ্ছিলেন এমন সময় শম্পা এসে খবরটা জানালো। তিনি ধীরস্থির ভাবে নিজের কাজ শেষ করে ফ্রেশ হয়ে নেয়। এরপর বাগানের সামনে চেয়ারে বসেই এক কাপ কফি খান।
এশা আতঙ্কিত মনে এখনো রুমে চুপচাপ বসে আছে। হঠাৎ ওর দরজায় কেউ কড়া নাড়লো। ও দরজা খুলে। পলি বেগম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে এক নজর তাকিয়ে দ্বিতীয় বার তাকানোর সাহস হলো না।
পলি বেগম ঠাণ্ডা মেজাজে নিতান্তই স্বাভাবিক ভাবে জানতে চাইলেন,
–কোথায় ছিলে গত দুই দিন? ফুয়াদও তোমায় আনতে গিয়ে নিখোঁজ হলো। কয়েকশ কল দিয়েছি, ধরেনি।
পলি বেগম এত ঠাণ্ডা গলায় কথা বলছেন! এশা বিস্ময়ে বিহ্বল হলো। নিচু গলায় বলল,
–এক রাত হাসপাতালে ছিলাম।
–পরের রাত?
–আপনার ছেলে ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিলো।
–বাহ! ভীষণ ভালো ব্যাপার।
এশার বিস্ময় আরো বাড়লো। পলি বেগম কী এই ব্যবহার মন থেকে করছেন? অসম্ভব ব্যাপার! তাহলে তিনি কি অন্য কোনো কৌশলে শাস্তি ঠিক করেছেন? পলি বেগমের ব্যবহারে স্বস্তি পাওয়ার বদলে আরো আশঙ্কিত হয় এশা।
–আজকে অনেক রান্না। রুমে বসে না থেকে যাও গিয়ে রান্না শুরু করো।
এই বলে পলি বেগম চলে গেলেন। এশা দুশ্চিন্তায় পড়ে। তিনি এমন রহস্যময় আচরণ করছে কেন?
__
ফুয়াদ দুপুরের দিকে বাসায় ফিরলো। এশার জন্য বই নিয়ে এসেছে। সেগুলো টেবিলের উপর রাখলো। এরপর রুম থেকে বের হয়ে বাসার পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলো।
বাসায় ফিরে যুদ্ধবিগ্রহ দেখতে পাবে ভেবেছিল। কিন্তু বাসার পরিবেশ স্বাভাবিক। এশা রান্নাঘরে রান্না করছে। মারুফা ভাবী সেখানে থাকায় তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ হলো না।
এশা রান্না শেষ করে রুমে আসলে ফুয়াদ খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো,
–ব্যাপারটা কি বলো তো? বাসার পরিবেশ এত শান্ত কেন!
এশা সংক্ষেপে বলল,
–জানি না।
–তোমার বই এনেছি। দেখো তো ঠিক আছে কিনা!
ফুয়াদ ভেবেছিল এশা খুব খুশি হয়ে আগ্রহ নিয়ে দেখবে। কিন্তু ও দেখলো না।
–বই কেন এনেছেন?
ফুয়াদ ভ্রু কুঁচকে বলল,
–বই কেন এনেছি মানে?
–মানে কি সেটা আপনি জানেন।
ফুয়াদ বিরক্ত গলায় বলল,
–কি বলতে চাও পরিষ্কার করে বলো।
–আমি অনার্স শেষ করবো এটা নিশ্চয়ই আপনার উদ্দেশ্য না।
ফুয়াদের বিরক্তি বাড়ে,
–তো আমি কি উদ্দেশ্যে বই এনেছি?
–এনেছেন যাতে বাসায় আরেকটা ঝামেলা হয়। আপনি যদি আমাকে সত্যি পড়াশোনা করাতে চান তাহলে এ কথা বাসার সবার সামনে বলবেন। নয়ত আমার পড়াশোনা করার দরকার নেই। আমি এভাবেই জীবন কাটিয়ে দিবো।
ফুয়াদ থেমে থেকে কিছুক্ষণ পর বলল,
–ওহ এই ব্যাপার! তুমি তো জেনেশুনেই এই পরিবারে এসেছো। তোমার জন্য আমি কারো সাথে ফাইট করতে পারবো না। নিজের ভালো একটা ক্যারিয়ারের জন্য আমি কত বছর ধরে স্ট্রাগল করে যাচ্ছি! নিজের বাঁচা নিজে বাঁচতে শিখো। তোমার স্ট্রাগল কেউ তোমাকে করে দিবে না।
এ বাসার নিয়ম হলো দুপুরে রান্নাবান্না শেষে আগে বাসার পুরুষ সদস্যরা খাবে। তারপর মহিলারা। ফুয়াদকে খাবার রুম থেকে ডাকলো। ও খেতে চলে গেল।
পলি বেগম সেখানে উপস্থিত। কিন্তু তিনি ফুয়াদকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। কেউই ওকে কোনো প্রশ্ন করলো না।
__
এশা সকাল থেকে কিছু খায়নি। ক্ষুধায় ওর পেট মোচড়াচ্ছে। পুরুষদের মারুফা খাবার বেড়ে দিয়েছে। তাদের খাওয়া শেষ হলে পলি বেগম মারুফাকে বললেন,
–আজকে তোমাদের আমি বেড়ে খাওয়াবো।
ছেলের বউদের নিয়ে পলি বেগম খেতে বসেছেন। তিনি আদেশ করলেন,
–তোমরা ভাত যা খাবে প্লেটে নাও। আমি তরকারি দিয়ে দিচ্ছি।
ওরা যার যার প্লেটে ভাত নিলো। পলি বেগম মারুফা আর শম্পার প্লেটে তরকারি বেড়ে দিলেন। এরপর নিজে নিয়ে খাওয়া শুরু করলেন। এশা বোকার মত বসে আছে। পলি বেগম কি ওকে তরকারি দিতে ভুলে গেছে?
পলি বেগম খাবার মুখে তুলতে তুলতে এশার দিকে তাকিয়ে বলল,
–তুমি তরকারি ছাড়াই খাও। আমার অনুমতি ছাড়া এ বাসায় সামান্য তরকারি খাওয়াও সম্ভব না।
এশা হতভম্ব হয়ে গেল। নির্দয় অপমানে ও স্তব্ধ হয়ে রইল।
(চলবে)
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-১২
এশা খাটের উপর শক্ত হয়ে বসে আছে। অনেকক্ষণ যাবৎ ওর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ছে। তরকারি ছাড়া ভাত দুই লোকমা মুখে তুলে ও ভেজা চোখে টেবিল ছেড়ে উঠে এসেছে। সেই কান্না এখনো থামেনি।
ওর জীবনটা কখনোই সহজ ছিলো না। ছোটবেলা থেকেই অনেক সংগ্রাম করে বেড়ে উঠেছে। কণ্টকাকীর্ণ এই জীবনে কত জায়গায় কত ভাবে অপমানিত হয়েছে, আঘাত পেয়েছে! কিন্তু আজকের মত এমন আঘাত কখনো পায়নি। ওর বুকের ভিতরটায় ভয়ানক জখম হয়েছে। তীব্র দাবানলে দগ্ধ হওয়ার মত।
ফুয়াদ ব্যালকনিতে রাখা আরামকেদারায় চোখ বুঁজে বসে আছে। তার আঙুলের ফাঁকে একটি জ্বলন্ত সিগারেট। সিগারেটটা অনাদৃত ভাবে পুড়ে যাচ্ছে। সেটিটে ফুঁ দেওয়ার মত মেজাজ হলো না। এই মুহূর্তে ওর মেজাজ ভীষণ বিক্ষিপ্ত। দারুণ ক্রোধে মস্তিষ্ক ফুটন্ত গরম পানির মত টগবগ করছে যেন।
পলি বেগম এই বাড়ির সর্বেসর্বা, প্রধান হর্তাকর্তা। তার অনুমতি ছাড়া এখানে একটি পাতাও নড়ে না। তাই বলে খাবার নিয়ে এমন নিচু ধরণের ছোটলোকি তিনি করবেন! এর চেয়ে বিচ্ছিরি কাণ্ড পৃথিবীতে আর কিছু হতে পারে না! কাউকে খাবার খেতে বসিয়ে তার প্লেটে তরকারি না দেওয়া! কিরকম কুৎসিত ব্যাপার। এই দৃশ্য ফুয়াদ কল্পনাও করতে পারছে না। এশা মেয়েটার প্রতি ওর তেমন ভালোবাসা নেই। কিন্তু আজ সে কতটা দুঃখ পেয়েছে সেটা উপলব্ধি করতে পারছে।
ফুয়াদ চেয়ার ছেড়ে উঠে। পলি বেগমের মুখোমুখি হওয়ার এটি সঠিক সময় নয় ওর জন্য। তবুও আজ ভীষণ ভাবে বাধ্য হচ্ছে। ব্যাপারটা ওকে এতটা মর্মাহত করেছে!
–তোমার জায়গা, সম্পত্তি, অর্থ-বিত্ত, দম্ভ যত বেশি তোমার জ্ঞান যেন ঠিক ততটাই কম মা। পৃথিবীর সবচেয়ে ছোটলোকি কাজ বোধ হয় তুমি আজ করে ফেলেছো। আমার লজ্জা করছে তোমার কাণ্ডে.. এশার সামনে যেতেও লজ্জা করছে। তোমাদের নিয়ে আমি সারাজীবন সব জায়গায় শুধু লজ্জাই পেয়ে গেছি।
ফুয়াদ থামে। নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করে। না.. এটা সঠিক সময় নয়।
পলি বেগম ছেলের দিকে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। পলি বেগমের জন্য ফুয়াদকে তার পছন্দের মেয়েটি ছেড়ে চলে গেছে। কই সেদিনও তো সে এত রাগ, ক্ষোভ দেখানোর সাহস পায়নি। আজ হঠাৎ এমন আচরণ করার দুঃসাহস কোথায় পেল!
ছেলের আচরণে পলি বেগম যেন বাক্য হারা হয়ে গেল। আগেও তো তার নিয়মেই এই সংসারে সব চলেছে। তিনি ঘোর অন্যায় করলেও কেউ টু শব্দ করার সাহস করেনি। কিন্তু এশাকে বউ করে আনার পর থেকেই একটার পর একটা অস্থিরতা, ঝামেলা যেন বেড়েই চলেছে। ওই মেয়েটাই সবকিছু মূলে। এই কয়দিনেই ফুয়াদের মাথাটাও খেয়েছে।
এই মুহূর্তে পলি বেগমের ইচ্ছে হলো ফুয়াদের গালে কষিয়ে একটা চড় দিতে। কিন্তু তিনি সেটি না করে ঠাণ্ডা গলায় বলার চেষ্টা করলেন,
–তোমার হঠাৎ মনে হলো আমার জ্ঞান কম! সেটি তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে গলা উঁচু করে বলছো। তোমার আচরণে আমি এতটা হতবাক হয়েছি যে এই মূহুর্তে তোমাকে দেওয়ার মত যথাযথ জবাব খুঁজে পাচ্ছি না। তোমার বউকে বাড়ির নিয়ম-কানুন মেনে চলতে বলো। যাও তুমি আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও।
ফুয়াদ চলে আসলো। পলি বেগমের সমস্ত ক্রোধ, আক্রোশ আবার এশার উপর জমা হলো। মনে হচ্ছে এই মেয়েটি বাড়ির ভিতর ভালোই ঝামেলা পাকাবে। তার আগেই ওর যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। পলি বেগম ক্রূর বিদ্রুপ করে সামান্য হাসলেন একা একা।
__
ফুয়াদ এসে এশার সামনে বসলো। এশার কান্না থেমেছে। তবে তার চোখ-মুখ ফুলে লাল হয়ে আছে।
–বাইরে খেতে যাবে নাকি খাবার আনিয়ে দিবো?
ফুয়াদ জিজ্ঞাসা করল। এশা মুখ তুলে তাকালো। ওর চেহারার দুঃখ, কষ্ট সব ক্ষোভে পরিণত হলো যেন। ফুয়াদের উপর ক্রোধে ফেটে পড়ে বলল,
–আপনি দয়া করে কোনো আদিখ্যেতা করতে আসবেন না। মারুফা আর শম্পা ভাবী যেভাবে চলে আমিও এখন থেকে সেভাবে চলবো। খেয়ে পরে কোনোভাবে জীবন কাটলেই হবে আমার।
ফুয়াদ এশার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এ কেমন জেদ!
–আমি তো ভেবেছিলাম এই ঘটনার পর তোমার এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার জেদ হবে। পড়াশোনা করে স্বাধীন ভাবে বাঁচতে চাইবে। কিন্তু এ তো দেখছি উল্টো জেদ।
এশা আবার চোখ মুছে বলল,
–এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার মত জায়গা আমার নেই। যার কোথায়ও যাওয়ার জায়গা নেই তার অত আত্মসম্মান নেই, জেদও নেই। আপনি আর কোনো নিয়মের বাইরে আমাকে ঠেলে দিবেন না। আপনার মায়ের সাথে আপনার কোনো ব্যক্তিগত আক্রোশ যদি থেকে থাকে সেটা নিজে মেটান। আমাকে দয়া করে আর ঢাল বানাবেন না।
এশা একটু দম ফেলে ফের বলল,
–আমি শুধু খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্যই বিয়ে করেছি। আপনার তো আর আমাকে পছন্দ নয়। বিয়ে করে মায়ের মন রক্ষা করেছেন। যেকোন মূহুর্তে দেশের বাইরে চলে যাবেন। এরপর আমি এ বাড়িতে কাজের মানুষের মত পড়ে থাকবো। আপনার মায়ের চেয়ে আপনিও আমার সঙ্গে কম নিষ্ঠুরতা করছেন না!
ফুয়াদ এসব কথার কোনো জবাব না দিয়ে বলল,
–আমি তোমার জন্য খাবার কিনে আনছি।
–আমি খাবো না।
ফুয়াদ এশার না শুনলো না। সে গিয়ে খাবার নিয়ে আসলো। রুমের দরজা বন্ধ করে একটা প্লেটে খাবার বেড়ে এশার সামনে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
–তুমি খাবে নাকি আমি খাইয়ে দিবো?
এশা কোনো কথা না বলে মুখ শক্ত করে রাখলো।
–এভাবে শক্ত হয়ে আছো কেন? মুখে খুলো। আমাকে অফিসে যেতে হবে। পাঁচটার দিকে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে একটা। আমি ব্যবসায় একটার পর একটা লস করেই যাচ্ছি। এরকম চলতে থাকলে মা আমাকে ব্যবসা থেকে আউট করে দিবে। এই মুহূর্তে সেটা করলে আমি ঝামেলায় পড়ে যাবো।
এশা মুখ খুললো না। ফুয়াদ এত অনুরোধ করলো! প্রথমে ভালো করে বলেছে, পরে রাগও হয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হলো না। এই মেয়ে এত একগুঁয়ে ওর জানা ছিলো না! তাছাড়া ফুয়াদের সঙ্গে এই প্রথম সে রাগ দেখিয়ে কথা বলেছে। এর আগে যতকিছু হয়েছে এরকম আচরণ করার সাহস করেনি। আজ হয়ত একটু বেশি কষ্ট পেয়েছে। সেজন্য রাগ দেখিয়ে ফেলেছে–ফুয়াদ এমন যুক্তিই দাঁড় করালো।
ফুয়াদ ওকে সাহসী হতে বলেছে। সেই সাহস কি এশা ওর সাথেই দেখাচ্ছে? মিটিং এর সময় হয়ে যাচ্ছে। এসব ভাবনা ঝেড়ে ফুয়াদ তৈরি হয়ে নিলো। প্লেটের খাবার অবহেলায় পড়ে আছে। এখন আর ওকে তোষামোদ করার সময় নেই। ফুয়াদ দ্রুত স্যুট বুট পরে গায়ে পারফিউম মেখে বের হওয়ার আগে আরেকবার বলল,
–ইচ্ছে হলে খেয়ে নিও।
__
ফুয়াদ অফিস থেকে ফিরে দেখে খাবার যেরকম রেখে গেছে সেরকমই পড়ে আছে। এশা বিছানার উপর জড়সড় হয়ে ঘুমাচ্ছে। আশ্চর্য মেয়ে তো! ফুয়াদের এত রাগ হচ্ছে!
ও প্রথমে হাতের ঘড়িটা খুলে ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখলো। অফিসের ফরমাল পোশাক বদলে ট্রাউজার আর টি-শার্ট পড়ে নিলো। এরপর বিরক্ত মেজাজে এশার কাঁধে মৃদু ধাক্কা দিলো। এই মেয়ে ওর কথা শুনছে না কেন? ও বাইরে থেকে খাবার এনে দিয়েছে।
বার বার করে খেতে বলে গিয়েছে। কিন্তু সেই কথা অমান্য করলো। একটু লাই পেয়ে কী মাথায় চেপে বসেছে!
ফুয়াদের ধাক্কায় এশা ঘুম জড়ানো চোখে তাকিয়ে বলল,
–আমি খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছি। আমার ঘুম ভাঙাবেন না প্লিজ।
ফুয়াদ আর ওকে ডাকলো না। না খেলে না খাক! ওর কী তাতে। ও খাবার এনে দিয়েছে। নিজের কর্তব্য পালন করেছে। খালি পেটে শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখুক।
এশার ঘুম ভাঙলো মাঝ রাতে। ফুয়াদ তখনো সজাগ। ঘুম ভাঙার পর ও প্রথমে ফুয়াদকে প্রশ্ন করল,
–আজকে কী জ্যোৎস্না রাত?
–জ্যোৎস্না অমাবস্যার খবর আমি রাখি না।
ফুয়াদ বিরক্ত গলায় উত্তর দিলো। এশা উঠে বসে হাত-মুখ না ধুয়েই প্লেটের খাবার খেয়ে নিলো। এরপর জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখলো উজ্জ্বল চাঁদের আলো।
–আমি কী স্বপ্ন দেখেছি জানেন?
–না জানি না।
–দেখেছি এরকম একটা জ্যোৎস্না রাতে নদীর পাড়ে বসে আছি। জ্যোৎস্নার আলোয় চারদিক এত সুন্দর দেখাচ্ছিলো!
ফুয়াদ ল্যাপটপ বন্ধ করে এশার দিকে তাকায়,
–চলো তাহলে নদীর পাড়ে বসে জ্যোৎস্না দেখতে।
ফুয়াদ ওর সাথে বিদ্রুপ করছে? কিন্তু না.. পরে বোঝা গেল সে সত্যি সত্যি ওকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। এশা ভয় পেয়ে বলল,
–না, না। আপনাদের বাড়ির নিয়মের বাইরে হয়ে যায় যদি!
ফুয়াদ চোখ রাঙিয়ে তাকালো। ঝাঁঝালো গলায় বলল,
–আমার কথা অমান্য করো কোন দুঃসাহসে? দুপুরে কিছু বলিনি। এখন একদম জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিবো তোমাকে।
অগত্যা এশাকে ফুয়াদের সঙ্গে বের হতে হলো নদীর পাড়ে বসে জ্যোৎস্না দেখতে।
(চলবে)
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা