#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-১৯
দুপুরের কড়া রোদ মাথায় নিয়ে পিচঢালা রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলেন মিনারা বেগম। তিনি এখনো এশার হাত ধরে আছেন। কিছুদূর হেঁটে রিক্সা ডাকলেন। এশা রিক্সায় না উঠে উদভ্রান্তের মত দাঁড়িয়ে রইল। ওর কান্না ক্রমশ বাড়ছে। কেন পলি বেগমের মুখের উপর উত্তর দিতে গেল! উত্তর না দিলে ঝামেলা এতদূর গড়াতো না বোধ হয়! কিন্তু ওর ও তো রক্ত, মাংসের শরীর। রাগ, জেদ আছে। পলি বেগমের অসহ্য রকমের বাড়াবাড়িতে আজ চূড়ান্ত পর্যায়ের অতিষ্ঠ হয়ে মেজাজ হারিয়েছে।
মাকে নিশ্চিন্ত, খুশি রাখার জন্য শ্বশুর বাড়িতে ভীষণ ভালো আছে বলে নাটকটা আর করতে হবে না। মানুষটা ওর জন্য দুশ্চিন্তায় এখন থেকে বোধ হয় আবার রাতে ঘুমাতে পারবে না। তাকে এই দুশ্চিন্তায় এশা কিছুতেই ফেলতে চায়নি। সেজন্যই সব কিছু মুখ বুঁজে সহ্য করেছে।
চোখের সামনে মেয়ের গায়ে হাত তোলার দৃশ্য দেখে মিনারা বেগমের ভেতরটা ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে সাত-পাঁচ না ভেবে এশাকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছে। যদি কোথায়ও ঠাঁই না হয় দরকার হলে ট্রেনের নিচে পড়ে ম*র*বে! তবুও ওই নরকে এশাকে কীভাবে রেখে আসবে।
সূর্যের তাপ সরাসরি এসে মুখে লাগছে। চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। রিক্সা দ্রুত গতিতে চলছে। এশা চোখ মুছে জিজ্ঞেস করল,
-কোথায় যাচ্ছি আমরা?
-মেজো ভাইজানের বাসায়।
-মামার বাসায় এভাবে যাওয়া ভালো দেখাচ্ছে না। আর তুমি যে আমাকে এভাবে নিয়ে আসলে মামার বাসায় আমাদের কতদিন রাখবে!
-একটা ব্যবস্থা হবেই।
-না মা, হবে না।
মিনারা বেগম উত্তর দিলো না। তার চোখ জোড়া ছলছল করছে। চেহারা বিমর্ষ দেখাচ্ছে। এশার এই মুহুর্তে নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে। যদিও এর পিছনে ওর কোনো অপরাধ নেই, দায় নেই।
চৌধুরী নিবাসের সামনে রিক্সা থামে। এই বাসায় এশার মেজো মামা ভাড়া থাকেন। মিনারা বেগম রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটায়। এশা এক কাপড়ে বেড়িয়ে এসেছে। ওর কাছে চার আনাও নেই। হাতে করে শুধু মোবাইলটা এনেছে।
-কি হলো? দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আয়।
কয়েক পা সামনে এগিয়ে পিছনে ফিরে এশাকে ডাকলো মিনারা বেগম।
এই অবস্থায় মামার বাসায় যেতে ওর অস্বস্তি হচ্ছে। মামারা ওদের প্রতি তেমন আন্তরিক না। ওকে দেখলে মামী নিশ্চিত বিরক্ত হবে। সেজন্যই অস্বস্তিটা বেশি লাগছে। মিনারা বেগম তো নিরুপায় হয়ে এখানে পড়ে আছে।
এশা চোখ-মুখ মুছে চেহারা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। এরপর গেটের ভিতরে পা বাড়ায়। মিনারা বেগম থেমে থেমে কয়েকবার কলিংবেল বাজালো। হাজেরা খাতুন দুপুরের খাওয়া-দাওয়া করে একটু ঘুমিয়েছিল। তিনি বিরক্ত মুখে দরজা খুললেন।
মিনারা বেগমের সাথে এশাকে দেখে তিনি অবাক হলেন। মেয়ে দেখতে গিয়ে আবার মেয়েকে সাথে করে নিয়ে এসেছে! এ বাড়িতে কি তিনি ভাতের হোটেল খুলে বসেছে? একে তো নিজে মাসের পর মাস পড়ে আছে।
-এশা কেমন আছো আম্মু? অনেকদিন পর দেখলাম তোমাকে। বড়লোক বাড়িতে বিয়ে হয়েছে, চেহারা ঝলমল করবে। এ তো আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। শুকিয়ে গেছো, কালো হয়ে গেছো।
এশা শুকনো মুখে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল,
-জি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন মামী?
-এই আছি! আল্লাহ রাখছে। বসো তুমি।
এশা সোফায় বসলো। মিনারা বেগমও ওর পাশে বসে। তাদের চেহারা অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে। কেমন থমথমে! হাজেরা খাতুনের একটু সন্দেহ হলো। কোনো ঝামেলা হয়েছে নাকি? এশার সাজপোশাকও কেমন ঘরোয়া। বাসা থেকে এক কাপড়ে বেড়িয়ে এসেছে এমন মনে হচ্ছে।
-ভাবী ভাইজান কি বাসায় আছে?
মিনারা বেগম জিজ্ঞেস করলেন।
-না সে কি এই সময়ে বাসায় থাকে নাকি!
হাজেরা খাতুন থেমে আবার জিজ্ঞেস করলেন,
-কি ব্যাপার বলো তো! কিছু হয়েছে নাকি? তোমাদের মা-মেয়ের চেহারা এমন দেখাচ্ছে কেন?
মিনারা বেগম আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি ঝরঝর করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
-এশাকে আমি ওই বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছি ভাবী! আমার সামনে বসে ওর শাশুড়ি ওর গায়ে হাত তুলেছে। এরকম নির্দয় আচরণ কোনো মানুষ করতে পারে না! আমার মেয়েটাকে ওরা মেরেও ফেলতে পারবে।
হাজেরা খাতুনের সহানুভূতি হলো না। উল্টো তিনি বিরক্ত মুখে বললেন,
-শ্বশুর বাড়িতে টুকটাক ঝামেলা হয়ই। আবার মিটেও যায়। সেজন্য তুমি ওকে নিয়ে আসবে! তোমার কি কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই মিনারা? তুমি নিজে পড়ে আছো এখানে! আবার তেজ দেখিয়ে মেয়েকে নিয়ে এসেছো। ওকে আমি কয়দিন রাখবো? আমার কি কতগুলো আর্থিক আছে? আর একটা মানুষকে মেরে ফেলা কি মুখের কথা।
-আপনার চোখের সামনে মৌলির গায়ে ওর শ্বশুর বাড়ির কেউ হাত তুললে আপনি সহ্য করতে পারতেন?
হাজের খাতুন মেজাজ দেখিয়ে বলল,
-না, পারতাম না। বাসায় এনে খুঁটি দিতাম। তুমিও এখন খুঁটি দাও। তোমার তো আবার খুঁটি দেওয়ার মত বাসাও নেই। যা ইচ্ছা করো।
হাজেরা খাতুন ওখান থেকে উঠে চলে গেলেন। এশা মাথা নিচু করে বসে আছে। এই মুহূর্তে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায়, অনাদৃত মানুষ মনে হচ্ছে ওর। ইচ্ছে করছে গ*লা*য় ফাঁ*স দিয়ে মরে যেতে।
-তুই চিন্তা করিস না। একটা ব্যবস্থা করবোই আমি। আগে দেখি ফুয়াদ কি করে!
এশা কোনো প্রত্যুত্তর করলো না। ফুয়াদ আর কি করবে! ও চলে আসাতে তারই সবচেয়ে লাভ হয়েছে। এশার প্রতি তার কোনো ভালোবাসা নেই। এশা তার জীবনের সমস্ত পরিকল্পনার বাইরে। এই বিয়েও তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বহীন ব্যাপার। বড় বাঁচা বেঁচেছে সে।
__
ফুয়াদ বাসায় ফিরেছে রাতে। আজ বাড়ির পরিবেশ অন্যরকম। বাসায় ঢুকেই দেখলো সবাই এক জায়গায় জটলা পাকিয়ে কি যে আলোচনা করছে। ও সবাইকে এড়িয়ে রুমের দিকে যাওয়ার সময় শফিক আহমেদ গম্ভীর স্বরে ডেকে বলল,
-এদিকে আসো।
ফুয়াদ তাকিয়ে দেখল এশা ব্যতীত এই পারিবারিক মজলিসে সবাই উপস্থিত। আজ এশার মা আসার কথা ছিলো। তাই নিয়ে কোনো ঝামেলা হলো নাকি!
ফুয়াদ এগিয়ে যেতেই ফয়সাল বসতে আদেশ করলো। ও বসে প্রশ্ন করল,
-কি ব্যাপার? কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি?
শফিক আহমেদ বললেন,
-মারুফা আর সম্পাকে তুমি অনেক বছর ধরে দেখে আসছো না? তাদের কখনো তোমার মায়ের কথার অবাধ্য হতে দেখেছো? এশা যে বিয়ের পর থেকেই তোমার মায়ের কথার বাইরে চলছে, তার সাথে বেয়াদবি করছে সেসব কি তোমার চোখে পড়েনি? এশার কথা বাদ দেই। তুমি নিজেও তো কারো কাছে কিছু জিজ্ঞেস না করে এশাকে নিয়ে হাসপাতালে চলে গেছো সামান্য জ্বরের চিকিৎসা করাতে!
ফুয়াদ গা ছাড়া ভাবে বলল,
-আসল কথা বলো।
ছেলের কথার ঢং দেখে শফিক আহমেদের রাগ বাড়ে। তিনি ফের কিছু বলার আগেই ফুয়াদ বলল,
-এশার ব্যাপারে আমাকে বলে কী লাভ! ওকে কি আমি পছন্দ করে বিয়ে করেছি নাকি! ওকে তোমরা পছন্দ করেছো.. মা পছন্দ করেছে। দেখো আমি যদি সুস্মিতাকে বিয়ে করতাম তাহলে ও কি করছে, না করছে সেই দায়ভার নিতাম।
পলি বেগম নীরবতা ভেঙে ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন,
-সুস্মিতাকে আমরা পছন্দ করি নাই। সেজন্য তুমি আমাদের পছন্দে বিয়ে করে, তোমার বউকে আমাদের বিপক্ষে উসকে দিচ্ছো? এই সংসারের সুখ-শান্তি নষ্ট করতে উঠে পড়ে লেগেছো?
-তোমরা অনেক বেশি ভেবে ফেলছো। আমি উঠি। এশার ব্যাপারে আমাকে কিছু বলে লাভ নেই।
পলি বেগম ইস্পাতের মত কঠিন গলায় বলল,
-বসো তুমি। কথা শেষ হয়নি।
ফুয়াদ অনাগ্রহী ভাবে বলল,
-বলো।
-এশাকে ওর মা নিয়ে গেছে। তাতে আমরা খুব খুশি হয়েছি। ওকে আর এই বাড়িতে ফিরিয়ে আনবো না। তুমি ওকে ডিভোর্স দিবে।
ফুয়াদ কোনো প্রতিক্রিয়া না করে স্বাভাবিক মুখে এক বাক্যে বলল,
-ঠিক আছে। দিবো।
এই বলে ও ওখান থেকে উঠে চলে গেল। ফুয়াদের এই অদ্ভুত আচরণ কারোই বোধগম্য হলো না। ওর মনে চলছেটা কি? পলি বেগম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকলেন।
__
ফুয়াদ ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ওর সবচেয়ে পছন্দের শার্টটি গায়ে দিলো। ওর ধারণা এই শার্টটায় ওকে সবচেয়ে ভালো দেখায়। গায়ে হালকা ঘ্রাণের একটা পারফিউম মেখে নেয়। খালি পেটে কড়া ঘ্রাণের পারফিউমে পেট মোচড়াবে।
হাতের কব্জিতে ঘড়ি বাঁধতে বাঁধতে দেখলো সাড়ে আটটা বাজে। ফুয়াদ গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। ওর গন্তব্য এশার মামার বাসা।
এশার মামাতো বোন মৌলি দরজা খুলে দরজার সামনে অপরিচিত কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল,
-কে আপনি? কাকে চাই?
-আমি ফুয়াদ। এশা আছে?
-আপনি..!
-এশার হাজবেন্ড।
এশার বর? বাহ্! নায়কদের মত দেখতে।
-ওহ আচ্ছা, আচ্ছা। ভিতরে আসুন।
এশা কাল রাতে কেঁদে কেঁদে বলেছিল ওর প্রতি নাকি ওর বরের কোনো ভালোবাসা, টান নেই। ও চলে আসাতে সে নাকি সবচেয়ে খুশি হবে। কিন্তু এ বান্দা তো দেখছি সকাল হওয়ার সাথে সাথে হাজির! মেয়েটা সারা রাত এক ফোঁটাও ঘুমায়নি। কেঁদে কেঁদে চোখ-মুখের অবস্থা খারাপ করেছে। ওর জন্য মৌলিও ঠিকমত ঘুমাতে পারেনি।
মৌলি ফুয়াদকে বসতে বলে এশাকে ডাকতে গেল। ফুয়াদকে দেখে এশা কোনো কথা না বলে কেমন উদভ্রান্তের মত তাকিয়ে রইল।
-কালকে কি হয়েছিল বাসায়? চলে এসেছো কেন?
এশার এই মুহুর্তে আকাশ-পাতাল ফাটিয়ে চিৎকার দিতে ইচ্ছে করলো ক্ষোভে। ওর এই অবস্থার জন্য পলি বেগমের চেয়ে এই মানুষটা বেশি দোষী। তীব্র অসহ্য লাগছে ওর! সবকিছু ভেঙেচুরে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করে এশা বলল,
-আপনার পরিকল্পনা সফল হয়েছে। সেজন্য চলে এসেছি।
-মানে?
-আপনাকে তো আমি একবারও বলি নাই আমার মাকে আপনাদের বাড়িতে ডাকতে। আপনি ডেকেছেন। যাতে ঝামেলা হয়। বিয়ের পর থেকেই আপনি আমাকে ব্যবহার করে শুধু ঝামেলাই করতে চেয়েছেন। তার জন্য আমার কতটা ভোগতে হয়েছে সেটা নিয়ে আপনার কোনো মাথা ব্যথা ছিলো না।
এশা থেমে আবার বলল,
-আমার মাকে ওই বাড়িতে ডেকে আপনি দুপুরে বাসায়ই ফিরলেন না। নিজে সেইফ থেকেছেন।
ফুয়াদ শান্ত মেজাজে কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,
-এশা রিল্যাক্স! তুমিই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তোমার মায়ের কথা বলেছো বার বার। আমি তখন তোমাকে জিজ্ঞেস করছিলাম, তাকে আসতে বলবো কিনা বাসায়। তুমি হ্যাঁ বলেছো। আই থিংক তুমি জ্বরের ঘোরে বলেছো সেজন্য তোমার মনে নেই।
ফুয়াদ বলল,
-দুপুরে ক্লায়েন্টদের সঙ্গে লাঞ্চ করতে হয়েছে। সেজন্য বাসায় ফিরতে পারিনি। তুমি একটু বেশি ভেবে ফেলেছো। চলো বাসায় চলো।
এশা কোনো প্রত্যুত্তর না করে যন্ত্রের মত অনুভুতিহীন চেহারায় বসে থাকলো। ফুয়াদ এবার এশার হাত ধরে বলল,
-আমি আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছি। দেশের বাইরে যাবো না। আর তোমার পড়ালেখা শেষ হলে বাচ্চাকাচ্চা নিবো। চলো আমার সঙ্গে।
(চলবে)
#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-২০
ফুয়াদের আসার খবর শুনে মিনারা বেগম বসার ঘরে আসলেন। তার দুর্দশার কথা চিন্তা করে ফুয়াদ একটু তোষামোদ করলেই হয়ত এশা যেতে রাজি হয়ে যাবে। কিন্তু মেয়েকে ওখানে পাঠানোর কথা মনে আনতে পারেন না মিনারা বেগম। তার কলিজায় মোচড় দেয়। তবে এশার থেকে ফুয়াদের ব্যাপারে যতটুকু শুনেছে তাতে তাকে খুব একটা খারাপ বলে মনে হয়নি। এশা হয়ত সব বলেনি। সব বললে তার মনে আরো উদ্বেগ তৈরি হবে এই ভাবনা থেকে। এতদিন সব গোপন করলেও এখন যেহেতু মিনারা বেগম জেনে ফেলেছেন তাই কিছুটা বলেছে। ।
মিনারা বেগমকে দেখে ফুয়াদ সালাম দিয়ে বসতে অনুরোধ করলো। তিনি বসলেন। ফুয়াদ ভীষণ দুঃখ প্রকাশ করে বলল,
-আমাদের বাসায় আপনাকে অপমানিত হতে হয়েছে তার জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি। ওই ঘটনার জন্য আমি ভীষণ লজ্জিত।
মিনারা বেগম এমনিতে খুব নরম ধাঁচের মহিলা। কিন্তু মেয়ের এরকম পরিস্থিতিতে সে হঠাৎ কঠোর হয়ে গেল। ফুয়াকে বলল,
-দেখো বাবা বিয়ের আগেই আমাদের ব্যাপারে সবকিছু জেনেশুনেই এগিয়েছো তোমরা। বিয়ের পর আমার মেয়েকে আমি নাইওরও করতে পারিনি। আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই না। আমাদের জীবনটা পরগাছার মত।
মিনারা বেগম একটু থেমে বললেন,
-আমার মেয়ের চারকুলে কেউ নেই বলে তোমরা যা খুশি তাই করবে? ওর কেউ নেই কিন্তু আমি তো আছি। আমার বোকা মেয়ে আমার দুঃখ হবে ভেবে সব লুকিয়ে গেছে এতদিন।
ফুয়াদ মাথা নিচু করে বসে আছে। মিনারা বেগমের কণ্ঠ ভীষণ তেজ! এত তেজ ও আশা করেনি। আর তিনি যে এশাকে নিয়ে ওভাবে বাসা থেকে চলে আসবেন সেটাও ভাবতে পারিনি। নিরুপায় মানুষকে সব মুখ বুঁজে সহ্য করতে হয়। ভদ্রমহিলা নিজের ব্যাপারে সব সহ্য করলেও মেয়ের ব্যাপারেও বোধ হয় পারছেন না।
মিনারা বেগম গলায় চাপা ক্রোধ নিয়ে বলল,
-আজকাল অশিক্ষিত, গরীব, দিন আনে দিন খায় এমন পরিবারেও কোনো শাশুড়ি বোধ হয় বউয়ের গায়ে হাত তোলেনা। তোমরা তো শিক্ষিত, ধনী, অভিজাত পরিবার।
মিনারা বেগমের কথার মাঝে বাঁধা দিয়ে এশা বলল,
-মা, থাক… ।
মিনারা বেগম থামলেন না,
-তুমি দুঃখ প্রকাশ করলে কিংবা লজ্জিত হলেই সব পরিবর্তন হয়ে যাবে না। এশার প্রতি তোমার বাড়ির মানুষের আচরণ নিশ্চয়ই পরিবর্তন হবে না। ওরকম পরিবেশে কোনো মা তার মেয়েকে দেওয়ার সাহস করবে?
এমন তোপের মুখে পড়ার জন্য ফুয়াদ যেন একবারেই প্রস্তুত ছিলো না। তাকে অপ্রস্তুত দেখাচ্ছে।
মিনারা বেগম এবার ফুয়াদকে জিজ্ঞেস করল,
-তুমি কি এশাকে নিতে এসেছো?
ফুয়াদ গম্ভীর মুখে বলল,
-হ্যাঁ।
-তুমি যদি এশাকে নিয়ে আলাদা থাকতে পারো তাহলে ওকে তোমার সাথে দিবো। তোমরা ভেবেছো এশার যাওয়ার কোথায়ও নেই! ওর সাথে যা-ই করো ওর তোমাদের বাড়িতেই থাকবে হবে! দরকার হলে আমার মেয়েকে নিয়ে আমি রাস্তায় থাকবো তবুও তোমাদের বাড়িতে দিবো না।
এশা ভাবলো, আসলেই কি রাস্তায় থাকতে পারবে ওরা? মেয়ের গায়ে হাত তুলতে দেখে মিনারা বেগম মেজাজ হারিয়ে যা পারবেন না তাও বলছেন শক্ত মুখে।
ফুয়াদ কিছুক্ষণ পর এক বাক্যে মিনারা বেগমের কথার প্রত্যুত্তর করল,
-আলাদা বাসা নেওয়া এই মুহুর্তে সম্ভব না।
এরপর সে এশার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো,
-তুমি কি যাবে এখন আমার সঙ্গে?
এশা এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকলো। হঠাৎ করে সত্যিই কি ফুয়াদের মন এতটা পরিবর্তন হয়েছে যে সে বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলছে, বাচ্চা নেওয়ার ব্যাপারেও মত পরিবর্তন করেছেন?
রাতারাতি এত পরিবর্তনের কোনো কারণ এশা দেখছে না। ওকে এক রাত না দেখে সে কি উতলা হয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে? অযৌক্তিক ব্যাপার! এশার প্রতি তার অমন কোনো ব্যাকুলতা নেই, একবারেই নেই। তাহলে এশাকে বাড়ি ফিরিয়ে নেওয়ার জন্যই হয়ত মিথ্যা বলছে। সে হয়ত বাড়িতে আরো ঝামেলা চায়, অশান্তি চায়। তার জন্য এশাকে প্রয়োজন।
-যেতে চাচ্ছো না তুমি?
ফুয়াদ আবার জিজ্ঞেস করলো। এশা ফ্যাকাশে মুখে বলল,
-মায়ের সাথে কথা বলে তারপর জানাবো আপনাকে।
এই মুহূর্তে অপমানিত বোধ করছে ফুয়াদ। বিদেশ যাবে না বলেছে, বাচ্চা নেওয়ার ব্যাপারেও হ্যাঁ বলেছে, এমনকি ক্ষমাও চেয়েছে। তাও ওর সঙ্গে যেতে মায়ের সাথে কথা বলতে হবে!
আর কোনো কথা না বলে ফুয়াদ উঠে চলে গেল। তার চোখে-মুখে কিছুটা রাগ ফুটে উঠেছে।
__
হাজেরা খাতুন নাস্তা খেতে ডাকছে। এশার খেতে ইচ্ছে করলো না। ও চিন্তিত মুখে বসে আছে। মৌলি ওকে জোর করে খেতে বসালো।
খাবার টেবিলে বসে হঠাৎ হাজেরা খাতুন মিনারা বেগমকে বললেন,
-তোমার স্বামীর বাড়িতে কি তোমার কোনো অধিকার নেই? তুমি বোকার মত ওখানে থেকে চলে আসলে কেন? মেয়েকে নিয়ে গিয়ে আবার ওখানে উঠে যাও। নিজের অধিকার নিজে বুঝে নাও।
খাওয়া থামিয়ে মিনারা বেগম বললেন,
-ওখানে আমার অধিকার আছে। এশার তো নেই। আর শুধু থাকার জায়গা হলে কি হবে ভাবী? ওরা তো আমাকে খাওয়াতে চায় না। নাদিমের বউ খাবার-দাবার সব আটকে রাখে। আপনার চেয়েও দুর্ব্যবহার করে।
-তাহলে ও বাড়িতে তুমি যেটুকু পাবে বিক্রি করে দাও।
মিনারা বেগম কিছু বলল না।
-এশার বর ওকে নিতে আসলো, যেতে দিলে না কেন? এত তেজ কই থেকে যে আসে তোমার বুঝি না! কি করতে চাও তুমি বলো তো? একটা কথা বলি কষ্ট পেয়ো না। আমাদের পক্ষে তো এভাবে সম্ভব না। আমাদের অত আয় রোজগার নেই। এসব বাদ দিয়ে জামাইকে ফোন দিয়ে আসতে বলো। এশাকে দিয়ে দাও।
এশা মাথা নিচু করে খাবার প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর গলা দিয়ে খাবার নামছে না। এখানে এসেছে দুইদিনও তো হয়নি। মামীর আচরণে মনে হয় মাস দুয়েক হয়ে গেছে।
__
নাস্তা কোনো রকম শেষ করে মিনারা বেগম এশাকে বলল,
-আমি একটু বের হচ্ছি। তুই থাক। তোর সাথে এসে কথা বলবো।
এশা ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-কোথায় যাচ্ছো বলে যাও?
মিনারা বেগম বললেন না। সে হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে পড়লেন। এশা সেদিকে তাকিয়ে থাকলো।
-এশা এদিকে আসো।
রুম থেকে মৌলি ডাকলো। সে এশার তিন ক্লাস বড়ো। মাস্টার্স শেষের দিকে।
এশা সেদিকে গেল। মৌলি বলল,
-বসো। ফুফু কোথায় বের হলো?
এশা বসে বলল,
-জানি না। জিজ্ঞেস করলাম। বলেনি।
মৌলি খাটের পাশে চেয়ার টেনে বসলো। এরপর এশাকে জিজ্ঞেস করলো,
-কি করতে চাচ্ছো তুমি?
ও বিষণ্ণ মুখে বলল,
-মাকে নিয়ে খেয়ে-পরে একটু ভালো থাকার মত একটা চাকরি পেতাম যদি।
-বাস্তবতা বোঝার চেষ্টা করো এশা। ইন্টার পাশে এই বাজারে তুমি এমন কোনো চাকরি পাবে না যেটা দিয়ে দুইজন মানুষের ভালো ভাবে চলবে। তোমার যদি অনার্সটা শেষ হতো তাও ভালো চাকরির জন্য চেষ্টা করতে পারতে। যদিও তাতেও যাদের মামার জোর আছে তারা এগিয়ে। অনার্স পাশের পর টুকটাক চাকরির খোঁজ করে ভয়াবহ বাস্তবতা দেখেছি। তুমি এখন বড়জোর সেলসগার্লের চাকরি পেতে পারো। কিন্তু তাতে বেতন তেমন না।
এশা ভেজা চোখে বলল,
-মাকে নিয়ে একটু ভালোভাবে বাঁচতে পারলেই হতো মৌলি আপা। জীবনে এর চেয়ে বেশি কিছু চাই না। এভাবে আর কতকাল পরগাছার মত বাঁচবো!
-তোমার বরকে তো ভালোই মনে হলো। বেশি সমস্যা নাকি তোমার শাশুড়িকে নিয়ে!
ফুয়াদের ব্যাপারে কোনো দুর্নাম না করে এশা মাথা নাড়িয়ে বলল,
-হু।
-তোমার গায়ে হাত তোলার ব্যাপাটায় ফুফু আঘাত পেয়েছে। মায়ের মন তো! তাই সে কোনো কিছু চিন্তা না করে তোমাকে নিয়ে এসেছে। কিন্তু দেখো তোমাদের থাকা-খাওয়ারও জায়গা নেই।
-হু।
-ফুফু কষ্টে, দুঃখে বাস্তবতাকে অবজ্ঞা করছে! কিন্ত তুমি তো বুঝতে পারছো! বাস্তবতা ভীষণ কঠিন ব্যাপার! ফুপু কিংবা তুমি এমন কোনো ব্যবস্থা করতে পারবে না যাতে দুইজন মিলে ভালো থাকতে পারবে। তুমি ফুয়াদের সাথে ফিরে যাওনি কেন?
এশার চোখ টলমল করছে। একটু পরেই জল গড়িয়ে পড়বে যেন।
-ও বাড়িতে যেতে আমার খুব ভয় করছে।
-তুমি এই ভয় কাটিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচো এশা। বাঁচলে বাঁচার মত বাঁচো। একবার সাহসী হয়ে দেখো। ওই বাড়িতে যেতে তুমি ভয় কেন পাবে?
এশা কিছু বলল না। মৌলি বলল,
-তোমার বর নাকি বলেছে তোমাকে লেখাপড়া শেষ করাবে! ওখানে গিয়ে লেখাপড়া শেষ করো। এরপর চাকরি করো। তাহলেই মাকে ভালো রাখতে পারবে।
-এত সহজ না আপা।
-কিন্তু এখন তুমি যে পরিস্থিতিতে আছো, এরকম ভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। আমি তোমাকে মরার জন্য বলছি না। তবে একটু সাহস নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে তো দেখো।
-সব জায়গায় সাহস খাটে না!
-তুমি সাহস করে দেখেছো? একটা কথা বোঝার চেষ্টা করো, তোমার ওই বাড়িতে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই আপাতত। ওখানেই লড়াই করে থাকার চেষ্টা করো। মানুষ শক্তের ভক্ত, নরমের যম। শক্ত হও। সাহস করে প্রতিবাদ করো, দেখবে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে যাবে।
এশা কোনো প্রত্যুত্তর করলো না। ও চুপচাপ বসে রইল অন্যমনস্ক হয়ে। মৌলির টিউশনের সময় হয়ে গেছে। সে আর ওকে না ঘাঁটিয়ে বেড়িয়ে পড়লো।
__
মিনারা বেগম এসেছে নাদিমের বাসায়। সে ওখানে গিয়েই কোনো ভনিতা না করে সোজাসুজি বলল,
-এটা আমার স্বামীর বাড়ি। এখানে আমার অধিকার আছে, ভাগ আছে। আমার ভাগের টুকু আমি বিক্রি করতে চাই।
নাদিম যেন আকাশ থেকে পড়লো।
-মানে কি এসবের! আপনার অধিকার আছে তো আপনি এখানে এসে থাকেন। বিক্রি করতে তো পারবেন না।
-কেন পারবো না? অবশ্যই পারবো। আমি আজ তোমাকে জানিয়ে গেলাম। কাজ আছে। উঠি।
মিনারা বেগম ওখান থেকে বেড়িয়ে তার বড় ভাইয়ের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। মিনারা বেগমেরা দুই বোন, চার ভাই। তার বাপ-মা মারা গেছে ছোট বেলায়। জায়গা জমি সামান্য যা ছিলো সব ভাইদের দখলে। সেগুলো তারা ভাগবাটোয়ারা করতে অনিচ্ছুক। শুধু মেজো ভাই জানের একটু ইচ্ছা আছে।
আজ মিনারা বেগম নিজের ভাগের সম্পত্তি চাইবেন। আগে জমির তেমন মূ্ল্য ছিলো না। কিন্তু আজকের বাজারে এক কাঠা জমিরও অনেক মূল্য।
(চলবে)
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা