#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-২৫
ফুয়াদ হন্তদন্ত হয়ে নিজের ফ্ল্যাটে আসে। এখানে তো আলমারি, ওয়ারড্রব, ড্রয়ার কিছুই নেই। এনআইডি কার্ড এখানে এনে থাকলে কোথায় রেখেছে? ও বিছানার জাজিমের নিচে উল্টে পাল্টে খুঁজলো। পেল না। বাসায় তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে, পায়নি। আর এখানে আনলে বিছানার নিচে ছাড়া নিশ্চয়ই অন্য কোথায়ও রাখেনি। দ্বিতীয় দফায় বিছানা থেকে চাদর, বালিশ, জাজিম সমস্ত কিছু একে একে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলল।
এনআইডি কার্ডটা টুপ করে মেঝেতে পড়লো হঠাৎ। ফুয়াদ সেটি হাতে নিয়ে লম্বা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। বড় দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলো। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বাড়িওয়ালার ফ্ল্যাটে গিয়ে বাসা ভাড়াটা দিয়ে আসলো।
এরপর পার্থকে ফোন করে বলল,
-ফ্ল্যাটে আছি। আয়।
পার্থ ওর বন্ধু। খুব সাধারণ পরিবারের ছেলে। ওর বাপ-মা ভীষণ কষ্ট করে পড়াশোনা করিয়েছে ওকে। মধ্যবিত্ত বাপ-মা ওর কোনো স্বপ্ন অপূর্ণ রাখেনি। পার্থ এখন লন্ডন থাকে। ছুটিতে দেশে এসেছে। বিয়ে করেছে এক বিদেশি মেয়েকে। তাও ওর বাপ-মা হাসিমুখে মেনে নিয়েছে।
নিজের কপালের কথা ভেবে আফসোস হয় ফুয়াদের। জন্মেছে এক মেরুদণ্ডহীন ঘর জামাইয়ের ঘরে। সুপুরুষ হলে ভিক্ষা করে খেলেও ঘর জামাই থাকতো না! অর্থবিত্তের মোহে পড়ে বিয়ে করেছে এক পাগল মহিলাকে। যে ওর জীবনের প্রতিটি স্বপ্ন ভেঙেছে। সন্তানের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভালোলাগা, মন্দলাগা কোনো কিছুর দাম নেই তার কাছে। কখনো ছিলোও না।
পার্থ এসেছে। কলিংবেল বাজছে। ফুয়াদ দরজা খুলল।
-বিয়ে করেই বউ নিয়ে আলাদা ফ্ল্যাট নিয়েছিস? তোর পরিবার এটা এলাউ করলো কীভাবে?
ওরা স্কুলের বন্ধু। এক এলাকায় বড় হয়েছে। তাই ফুয়াদের পরিবারের ব্যাপারে জানে।
-এখানে বউ নিয়ে থাকি না। মাঝে মাঝে আমি এসে থাকি।
পার্থ ভিতরে ঢুকে বসে জিজ্ঞেস করল,
-তুই লন্ডন যাবি তোর পরিবার জানে?
-না।
-তোর বউ জানে?
-সেভাবে বলা হয়নি।
-তোর বউকে না বলে যাবি?
-আরে না, বলেই যাবো।
-তো যাবিই যখন তোর পরিবারকে বলে যেতে কি সমস্যা?
-বললে দেখা গেল আমার মা থানায় মামলা করে দিলো আমার নামে যে, আমি তার ব্যবসা থেকে টাকা মেরে বিদেশ চলে যাচ্ছি। কিংবা এয়ারপোর্টে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে।
পার্থ হেসে জিজ্ঞেস করল,
-সিরিয়াসলি এসব করবে?
-জানি না। ধারণা করে বললাম। তবে কিছু একটা তো করবেই। আমার জীবনের কোনো স্বপ্ন পূরণ হতে দেখেছিস কখনো? হতে দেয়নি!
-আরে এত আফসোস করিস না। জীবন শেষ হয়ে যায়নি। সবে শুরু।
-দেখি।
-শুনেছি সুস্মিতাও নাকি লন্ডন স্থায়ী হবে। তুই কি সেই কারণেই লন্ডন যাচ্ছিস?
ফুয়াদ যেন আকাশ থেকে পড়ল,
-ভাই এসব ইনফরমেশন আমার কাছে নেই। আমি তোদের বন্ধু হিসেবে যতটা ভালো ছিলাম। স্বামী হিসেবে ততটা ভালো না। ততটা কি মোটেও ভালো না। তবে পরকীয়া করার মত এত খারাপও হয়ে যাইনি।
এশা ফোন দিচ্ছে। তার বোধ হয় ক্লাস শেষ। নিশ্চয়ই ফুয়াদকে আনতে যেতে বলবে। এবং ভীষণ জোর গলায় বলবে। ফুয়াদ ফোন কেটে দিলো। পার্থর সঙ্গে লন্ডন যাওয়ার ব্যাপারে একটু কথা বলবে। সেজন্যই ওকে ডেকেছে।
__
এশা ক্লাস শেষে একা একা বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। ফুয়াদ ফোন ধরছে না। মনে একটু ভয় ভয় করছে ওর। একেবারে অকুতোভয় তো আর হয়ে যায়নি। দেয়ালে পিঠ ঠেকায় বাধ্য হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। হয়ত বাঁচবে নয়ত মরবে, এমন বেপরোয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে চলছে।
বাসায় ফেরার পথে মিনারা বেগম ওকে ফোন দিয়ে জানালো,
-আমি আগামী শুক্রবারই তোর মামা-মামীদের বিরুদ্ধে সালিশ বসাবো।
এশা বিস্মিত হয়ে ব্যগ্র গলায় জিজ্ঞেস করল,
-কি হয়েছে মা? কিছু হয়েছে?
-হয়েছে অনেক কিছুই। তোর মেজো মামা আমাকে সব বলেছে।
-কি বলেছে?
-তারা আমার থেকে ছয় মাসের সময় নিয়েছে, কারণ এর ভিতর তুই নিশ্চয়ই তোর শ্বশুর বাড়ি চলে যাবি। তাহলে আমার আর টাকার দরকার পড়বে না। আমি তাদের কাছ থেকে জমিজমার ভাগও চাইবো না। তারা আসলে আমাকে জমি না দেওয়ার ফন্দি করেছে।
-তুমি এসব কার থেকে শুনেছে?
এশা অবাক হয়নি। কারণ এমন কিছু ও আগে থেকেই আন্দাজ করেছিলো।
-তোর মেজো মামা আমাকে বলে দিয়েছে সব। সে তো আর ওদের মত হারামী না। আল্লাহ খোদাকে ভয় করে চলে। শরিক ঠকালে জাহান্নামী হবে। সে ই আমাকে সালিশ ডাকার ব্যবস্থা করে দিবে। তবে গোপনে। এতে কাজ না হলে মামলা করারও ব্যবস্থা করে দিবে।
এশা কিছুক্ষণ থেমে থেকে বলল,
-তোমার অন্য ভাইয়েরা কিন্তু খুব বেশি সুবিধার না মা। চিন্তা হচ্ছে আমার।
-কি চিন্তা হচ্ছে তোর? আমাকে খুন করে ফেলবে?
-অসম্ভব কিছু না মা। দুনিয়াতে মানুষ স্বার্থের জন্য সব করতে পারে।
-আমি এবার কাউকে ছাড়বো না।
দৃঢ় গলায় বললেন মিনারা বেগম। এশা আর তাকে নিষেধ করলো না। মানুষটা সারাজীবন পর তার অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করতে চাচ্ছেন। তাকে নিরুৎসাহিত করা কি ঠিক হবে! কিন্তু মামাদের তো জানে ও। তাই মায়ের জন্য ভয় লাগছে।
__
বাসায় ঢুকতেই এশা প্রথমে সম্পা ভাবীর প্রেগন্যান্সির খবর পেল। তবে এতে নাকি পলি বেগম অখুশি হয়েছেন। তিনি বেজার মুখে বলেছেন, আমার মেয়েটা এখানে এসেছে একটু আরামের জন্য। বাচ্চা নেওয়ার আর সময় পায়নি! মারুফা তুমিও একটা নিয়ে ফেল। সবাই পেট হওয়াইয়া বসে থাকো।
এই কথা রাহাত নিজে কানে শুনেছে। সে ভীষণ দুঃখ পেয়েছে। জীবনে প্রথমবারের আজ ও মতো বাবা হওয়ার খবর পেয়েছে। এটা যে কতটা আনন্দের খবর আজকের আগে ওর জানা ছিলো না।
মা তো সব ব্যাপারেই যা ইচ্ছে তাই। সেজন্য ওর জীবনের এত বড় একটা আনন্দের ব্যাপারকে এভাবে তুচ্ছ করতে পারলো!
এশার ক্লাসে যাওয়া নিয়ে বাসায় কি হয়েছে তো এখনো ও জানতে পারেনি। ও এসেই রুমে ঢুকেছে।
হঠাৎ রুম থেকে কান্নার আওয়াজ পাচ্ছে। কেউ একজন গলা ছেড়ে কাঁদছে। কার গলার আওয়াজ এটা? এশা দরজা খুলতেই পরিষ্কার শুনতে পেল মারুফা ভাবী গলা ছেড়ে কাঁদছে। কি হয়েছে তার? কোনো দূর্ঘটনা হলো নাকি?
ও রুম থেকে বের হয়ে কয়েক পা আগাতেই শুনতে পেল মারুফা ভাবী কান্না জড়ানো গলায় বলছেন,
-আমি কি এই বাড়ির কাজের মানুষ? রাহাতের বউ সারাক্ষণ শুয়ে বসে থাকছে। ফুয়াদ বউ পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। আর সব কাজ আমার মাথায়! এ বাড়ির বউয়েরা বিয়ের পর পড়াশোনা করতে পারে না। এখন কোথায় সেই নিয়ম?
ফয়সাল মারুফাকে থামানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। অথচ এই মারুফা এর আগে কখনো তার মুখের উপর কথা বলার সাহস করেনি। আর কথার অবাধ্য হয়নি। পলি বেগমকে জমের মত ভয় পেয়েছে। এই প্রথম..বাড়ির কাউকে পরোয়া না করে সে চিৎকার, চেঁচামেচি করে যাচ্ছে।
হিংসা মানুষকে কতটা বেপরোয়া করে দেয়! ফয়সাল এই মুহূর্তে সেটা নিজের চোখে দেখছে। সম্পা আর এশা যেভাবে চলছে তাতে তো হিংসা হওয়া স্বাভাবিকই।
পলি বেগম স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। তিনি মারুফার চিৎকার শুনছেন না। তিনি শুনছেন অন্য কিছু। তার সংসার, তার রাজত্ব, তার আধিপত্য সবকিছু ভেঙে যাওয়ার বিকট আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন তিনি। তবে তা কি এত সহজ?
__
বাড়ির এই ভয়াবহ অস্থিরতা মধ্যেই ফুয়াদ বাড়িতে ঢুকলো। মারুফার কান্না তখন থেমেছে।
পলি বেগম তার নীরবতা ভেঙে প্রথম সর্ব প্রথম ফুয়াদকে ডাকলো,
-এই ছেলে এদিকে আয়!
মায়ের এই ডাক খুব অপরিচিত মনে হলো। ফুয়াদ এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-কিছু বলবে?
-না বললে তোকে ডেকেছি কেন?
ফুয়াদ কথা না বাড়িয়ে বসলো।
-কি চাস তুই আমাকে পরিষ্কার করে বল।
-কি চাইবো?
-সেটা আমি তোকে প্রশ্ন করেছি। তুই উত্তর দে।
-কি হয়েছে মা? এভাবে কথা বলছো কেন?
-আজ আর চালাকি করার চেষ্টা করিস না। তুই কিছু না বললে আমি বলছি।
ফুয়াদ শান্ত মুখে বলল,
-ঠিক আছে বলো।
-তুই এই সংসারে অশান্তি চেয়েছিলি, তোর সেই পরিকল্পনা সফল হয়েছে। তোকে আমি আমার সব সহায়-সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করলাম। তুই আর আমার অফিসে যাবি না। দুই ঘন্টার মধ্যে এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবি বউ নিয়ে।
-মা!
-তোকে আরেকটি অপশন দেই। হয় তোর বউ আর তুই সম্পূর্ণ আমার ইচ্ছামত চলবি। তোর বউয়ের বই খাতা সব এই মুহূর্তে পুড়িয়ে দিবি। নয়ত আমি যা বলেছি তা। কোনটা চাস তুই?
(চলবে)
#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-২৬
ফুয়াদ পলি বেগমের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নত মুখে বসে রইলো। তার চেহারা গম্ভীর, শান্ত।
এই সংসারে কেমন এলোমেলো বাতাস বইছে। তীব্র অস্থিরতা বিরাজ করছে। মারুফার উচ্চস্বরে কান্নাকাটি, সংসারের কোনো কাজ না করে সম্পার শুয়ে থাকা। তাদের গা ছাড়া, উদাসীন ভাব যেন পলি বেগমকে কর্তৃত্ব অস্বীকার করারই ইঙ্গিত দেয়। আর এশা তো চূড়ান্ত দুঃসাহস দেখাচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে পলি বেগমের মস্তিষ্ক এই মুহূর্তে ফুটন্ত গরম পানির মত টগবগ করছে।
তার উপর ফুয়াদের এই নীরবতা তার কাছে ভয়াবহ অসহনীয়, অসহ্য ঠেকছে। তিনি সমস্ত শক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন,
-কথা বলছিস না কেন? কি চাস তুই? আমার টাকা-পয়সা ছাড়া না আছে তোর বাপের এক পা চলার মুরোদ, না তোদের। আমার বাড়ি-গাড়ি, ব্যবসা, সম্পত্তি দিয়ে চলিস তোরা। এরপরও আমার মতের বিরুদ্ধে কাজ করার দুঃসাহস করিস কিভাবে?
ফুয়াদ এবার নীরবতা ভেঙে ঠাণ্ডা গলায় বলল,
-আমি কি চাই? আমি তো চেয়েছি চাকরি করতে। দেশের বাইরে যেতে। সুস্মিতাকে বিয়ে করতে।
-তোর কাছে আমি এসব শুনতে চেয়েছি?
-তুমি যা শুনতে চাও শুধু তাই বলতে হবে? আমার বাপের তোমাকে ছাড়া এক পা চলার মুরোদ নেই, আমাদেরও নেই! কিন্তু বাপের রেখে যাওয়া এই অর্থবিত্ত ছাড়া তোমার কি মুরোদ আছে? মেয়ে হয়ে সামান্য শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার মুরোদও তো তোমার ছিলো না। তুমি এমন স্বভাবের মেয়ে ছিলে যার জন্য ঘরজামাই রাখতে হয়েছে। তুমি ছাপোষা একজন ঘরজামাই পেলে আর আমার বাপ পেল অর্থবিত্ত। শোধ বোধ, কাটাকাটি। এর জন্য আবার খোঁটা দাও কেন?
পলি বেগম রাগে কাঁপছে। তার ছেলে তাকে এসব কি বলছে! এ কেমন সাহস, ধৃষ্টতা, স্পর্ধা! সারাজীবনে কেউ তো তাকে এই কদর্য সত্যি বলার দুঃসাহস করেননি। আজ তার ছেলে, তার নিজের গর্ভের সন্তান তাকে এসব বলছে!
ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য পলি বেগম ফুয়াদের গালে কষিয়ে চড় মেরে বসলেন।
-তুই এই মুহূর্তে বেড়িয়ে যাবি আমার বাড়ি থেকে। আমি তোকে ত্যাজ্য পুত্র করে দিবো। আজই।
পলি বেগমের শ্বাস আটকে আসছে আক্রোশে।
চড় খেয়েও ফুয়াদের অভিব্যক্তির পরিবর্তন হলো না। ও আগের মতই বলে চলল,
-তুমি চড় দিলে, চিৎকার চেঁচামেচি করলেই কি সত্যি মিথ্যা হয়ে যাবে? তুমি না ভালো মানুষ, না ভালো মা, না ভালো স্ত্রী, না ভালো শাশুড়ি। একজন স্বার্থপর, অহংকারী, পাষণ্ড, হৃদয়হীন, বিবেকহীন মহিলা তুমি।
চূড়ান্ত রাগে, ক্রোধে, আক্রোশে পলি বেগম কথা বলতে পারছে না। তার মাথার ভিতর চক্কর দিচ্ছে।
ফুয়াদ একটু থেমে বলল,
-এই বাড়ি, গাড়ি সব তোমার। সেজন্য তুমি নিজের স্বামী, সন্তানদের আশ্রিতর চোখে দেখো। তারা তোমার মেজাজ মত চলতে বাধ্য। আর ছেলের বউয়েরা তো তোমার কাছে ক্রীতদাসী। তাদের নিজের পছন্দ মত চলার অধিকার নেই, খাওয়ার অধিকার নেই, আর পড়াশোনা তো তাদের জন্য পাপ! তুমি ছেলে বিয়ে করিয়ে বউ আনো না। দাসী আনো।
পলি বেগম কাচের একটা ফুলদানি মেঝেতে ছুঁড়ে মেরে কাঁপা কাঁপা গলায় শফিক আহমেদকে বলল,
-ওকে এখান থেকে যেতে বলো। নয়ত আমি ওকে খু*ন করে ফেলবো।
বাসার সকলে ততক্ষণে ওখানে উপস্থিত হয়েছে। শুধু এশা বাদে। ও নিজের রুমের কাছে দাঁড়িয়ে দেখছে। এই মা-ছেলের হুড়োহুড়ির মধ্যে পলি বেগম যদি আবার ওর মাথায় কাচের ফুলদানি ছুঁড়ে মারে! সেজন্য দূরে দাঁড়িয়েই দেখছে।
শফিক আহমেদ রাগী, কর্কশ গলায় বলল,
-ফুয়াদ রুমে যাও। আর একটা কথা বলবে না তুমি।
ফুয়াদ কারো নিষেধ মানলো না। পলি বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,
-তুমি কথায় কথায় আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি দাও। ব্যবসা থেকে বের করে করে দেওয়ার হুমকি দাও। একজন মানুষ খারাপ, নিকৃষ্ট হতেই পারে। কিন্তু একজন মা তোমার মত কি করে হয়! যার কাছে সন্তানের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, চাওয়া-পাওয়া, স্বপ্ন, পছন্দ-অপছন্দের কোনো মূল্য নেই। আমাদের তো তুমি সন্তানের চোখে দেখো না। আমরা তো হলাম ঘরজামাইর বাচ্চা।
পলি বেগম গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল,
-তোমরা কেউ ওকে থামাবে? আমি কিন্তু ওকে আজ শেষ করে দিবো। ওকে আমি ত্যাজ্য পুত্র করে দিবো।
ফয়সাল এগিয়ে এসে ফুয়াদের হাত চেপে ধরে বলল,
-যা এখান থেকে!
ফুয়াদ এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। শফিক আহমেদ ফুয়াদকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
-যেতে বলছি তোমাকে!
ফুয়াদ বিদ্রুপের চোখে তাকালো শফিক আহমেদের দিকে,
-তোমার কথা আমি কেন শুনবো? কে তুমি? বলো! কে? একজন মেরুদণ্ডহীন ঘর জামাই! নিজের সন্তানদের জন্য মাথা গোঁজার মত একটা স্থান করতে পারোনি সারাজীবনে। তোমাকে জেলে দেওয়া উচিত। সন্তান জন্ম দিয়ে কোনো দায়িত্ব পালন না করার অপরাধে।
শফিক আহমেদ আর কিছু বললেন না। তার লজ্জা লাগছে। অস্বস্তি হচ্ছে।
ফুয়াদ এবার আশেপাশে তাকিয়ে একটা ধারালো ছু*রি খু্ঁজে বের করলো। কি করতে চাচ্ছে ইনি? এশার এবার ছুটে এসে ওকে ধরলো।
ক্ষিপ্ত ফুয়াদ এশাকেও এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বলল,
-তোমার এখানে কি কাজ? যাও রুমে যাও। যাচ্ছো না কেন? এখনো দাঁড়িয়ে আছো!
এশা নিজের রুমে চলে আসে। ওখানে আর এক সেকেণ্ড দাঁড়ালে বোধ হয় ফুয়াদ ওর গলায়ই ছু*রি চালাতো।
ফুয়াদের এই উন্মাদনা কেউ থামাতে পারলো না। সে ছু*রি হাতে পলি বেগমের দিকে এগিয়ে গেল। ছু*রিটা তাকে দিয়ে বলল,
-শেষ করে দিবে আমাকে! খুন করবে? করো। শুধু আমাকে কেন! নিজের কর্তৃত্ব, রাগ, জেদ, অহংকার বজায় রাখতে তুমি একসাথে বাড়ির সবাইকে খুন করতে পারবে।
শফিক আহমেদ সেদিকে তাকিয়ে করুণ মুখে বলল,
-পলি সব ব্যাপারে ক্রোধ খাটানো যায় না। তুমি ছুরি রাখো। ওর গায়ে তুমি সামান্য আঘাতও যদি করো তোমার সাথে আমি কোনো সম্পর্ক রাখবো না।
পলি বেগম ছু*রিটা দূরে ছুঁড়ে মারলেন। সেটা গিয়ে পড়লো সম্পার পায়ের কাছে। এরপর তিনি ধীরে ধীরে গিয়ে সোফায় বসে চোখ বুঁজলেন।
কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে ফয়সালের দিকে তাকিয়ে বলল,
-ফুয়াদ আর ওর বউকে এই মুহূর্তে বাসা থেকে চলে যেতে বল। আমি ওর মুখ দেখতে চাই না। কখনো, কোনোদিনও না।
-বাসা থেকে চলে যাবো? ব্যবসা থেকে বের হয়ে যাবো? আমি তো আগেই যেতে চেয়েছি। তুমি আমাকে চাকরি করতে দিলে না। দেশের বাইরে যেতে দিলে না। আমার সব স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছো! তখন কেন যেতে দাওনি?
পলি বেগম দাঁতে দাঁত চেপে আবার বলল,
-ওকে এখান থেকে চলে যেতে বল ফয়সাল।
ফুয়াদ সজোরে দেয়ালে লাথি মেরে বলল,
-চলে তো যাবোই। সবকিছু তছনছ করে দিয়ে যাবো।
এরপর আর ওকে কেউ থামাতে পারলো না। বাড়ির প্রতিটি কাচের জিনিসপত্র ভেঙেচুরে চূর্ণ বিচূর্ণ করে ফেললো।
পলি বেগম বাকরুদ্ধ হয়ে সোফায় বসে আছে! তার নিজের ছেলে আজ সকলের সামনে তার মুখ ছোট করে দিয়েছে। তাকে অপমানে জর্জরিত করেছে। তাকে আজ অসহায়, দুর্বল প্রমাণ করেছে! কি করবেন তিনি? কীভাবে নিজের রাগ, জেদ, অহংকার বজায় রাখবেন? ছেলের শরীরে ছু*রি চালাবে? ফুয়াদের ভাষ্যমতে তিনি পাষণ্ড, হদয়হীন মহিলা। খারাপ, নিকৃষ্ট মা। বাড়ির সবাইকে নাকি এক সাথে খুন করতে পারবে। তাহলে ওর গায়ে ছু*রি দিয়ে আঘাত করতে পারলো না কেন?
বাসার সকলে তীব্র হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কারো মুখে কোনো কথা নেই। এই পরিস্থিতিতে বলার মত উপযুক্ত কিছু কেউ খুঁজে পেল না। এই বাড়িতে কখনো এমন দৃশ্য দেখবে বলে কেউ কল্পনাও করেনি।
ফুয়াদের কাণ্ডে স্তব্ধ এশা রুমে চুপচাপ বসে আছে। মনে হচ্ছে এই বাসায় বড়সড় কোনো অঘটন ঘটবে। দুই-একটা লা*শও পড়তে পারে। সব তো ভাঙচুর করা শেষ। ফুয়াদ এবার কি করবে?
এই মানুষটা তো ওকে সব সময় পলি বেগমের তোপের মুখে ফেলতো। নিজে গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করতো। আজকে সেই খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে আসলো কেন?
ফুয়াদের ক্রোধ কমেছে। পুরো বাসায় ভাঙচুর করে সে শান্ত হয়েছে কিছুটা।
এই পর্যায়ে মালা মুখ খুলল,
-আর কি করতে চাস তুই? কর। থামলি কেন?
ফুয়াদ কোনো প্রত্যুত্তর না করে বাসার দরজার দিকে পা বাড়ায়। সবাই ভাবলো ও বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু এশাকে ফেলে?
নিচতলার গ্যারেজ থেকে পলি বেগমের গাড়িটা বের করে ফুয়াদ। সেটা বাড়ির আঙিনায় এনে দাঁড় করায়।
অসহ্য ক্রোধে অস্থির পলি বেগম বললেন,
-ও আমার গাড়ি বের করেছে কেন? ও ওর বউকে নিয়ে যাচ্ছে না কেন? কি করতে চাচ্ছে ও? কেউ বলো আমাকে। নাকি তোমাদের সবার ওর কাণ্ড ভালো লাগছে? মন মতো হচ্ছে তোমাদের?
বাড়ির আঙিনা থেকে ভাঙচুরের শব্দ ভেসে আসছে। ফুয়াদ ভারী রড দিয়ে গাড়ি ভাঙছে। সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো। পলি বেগমও।
গাড়ি ভাঙচুর করতে করতে ফুয়াদ চিৎকার করলো,
-বাড়ি থেকে বের করে দিবে! ত্যাজ্য পুত্র করে দিবে! মেরে ফেলবে! আর কি করবে করো। আমি সব তছনছ করে দিয়ে এখান থেকে যাবো। এই বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে যাবো।
(চলবে)