এই জোছনা ধারায় পর্ব-৩৩+৩৪

0
334

#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-৩৩

জ্ঞান ফেরার পর পলি বেগম আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ একা আবিষ্কার করলেন। আবার কিরকম একটা ধাক্কার মত লাগলো তার বুকে! তার স্বামী, চার ছেলে-মেয়ে, ছেলের বউয়েরা, মেয়ের জামাই, নাতি নাতনি.. সেই ঘর ভরা মানুষ। চোখ খুলে একজনকেও দেখতে পেলেন না! এই প্রথম একাকিত্বকে অস্বীকার করে তিনি নিজেকে সর্বেসর্বা ভাবতে পারলেন না। তার কাউকে প্রয়োজন নেই এ কথাটা যেন আজ তাকে ক্রূর বিদ্রুপ করছেন। তার মৃত্যু ভয় করছে। আতঙ্কে পলি বেগমকে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে।

তাকে হাসপাতালে কে নিয়ে আসলো? মালা কোথায়? ছেলেদের না হয় বউয়েরা যাদু মন্ত্র করে তার থেকে দূরে নিয়ে গেছে। কিন্তু তার মেয়েটাও তার পাশে নেই কেন? পলি বেগম হু হু করে কেঁদে উঠলেন।

বাসা একেবারে ফাঁকা। দারোয়ান আর নাজমা তাই মালা আসার পরই চলে গেছে। সুমি কেবিনের বাইরে রাঈদকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মালা ডাক্তারের সাথে কথা বলছে।

কান্নার আওয়াজ পেয়ে সুমি আর রাঈদ কেবিনের ভিতরে ঢুকে। নানুকে এভাবে কাঁদতে দেখে রাঈদ বিষণ্ণ মুখে জিজ্ঞেস করল,

-নানু তুমি কাঁদছো কেন? তুমি মারা গিয়েছিলে কেন?

পাশে থেকে সুমি ফিক করে হেসে বলল,

-মরছিলো না তোমার নানু। জ্ঞান হারাই গেছিলো।

মালা আসে। পলি বেগমের জ্ঞান ফিরেছে দেখে ও চোখ মুছে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তার পাশে বসে।

-কাঁদছো কেন তুমি এখন? তোমার নাকি কাউকে প্রয়োজন নেই। তুমি একাই একশ। পৃথিবীতে টাকা দিয়ে সব হয় না মা। টাকার চেয়ে পরিবার পরিজন বড় বিষয়।

এর ভিতর ফয়সাল আর রাহাত হন্তদন্ত হয়ে কেবিনের ভিতর ঢুকলো। মারুফা আর সম্পাও এসেছে। শফিক আহমেদ গ্রামের বাড়ি থেকে রওয়ানা দিয়েছে আসতে একটু সময় লাগবে। এশা সবাইকে ফোন করে জানিয়েছে। কিন্তু ও আসেনি। ওর কি কাজ এখানে! ওকে দেখলে পলি বেগম নিশ্চয়ই আরো বেশি অসুস্থ বোধ করবেন।

ওদের দেখে পলি বেগমের কান্না আরো বেড়ে গেল। তিনি কান্না জড়ানো ক্ষিপ্ত গলায় বললেন,

-তোরা এখন কেন এসেছিস পাষাণের দল? বড় পাষাণটা তো আসেনি। তোদের কাউকে আমার প্রয়োজন নেই। আমি আমার সব সম্পত্তি মালার নামে লিখে দিবো।

মালা রেগেমেগে আগুন হয়ে গেল,

-তোমার সম্পত্তি নিয়ে তুমি কবরে যাও। তুমি আসলে জীবনে শুধরাবে না। একা বাসায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলে। সুমি, নাজমা আর দারোয়ান চাচা তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসছে। তাও বলছো তোমার কাউকে প্রয়োজন নেই।

ফয়সাল গম্ভীর মুখে বলল,

-আমরা এখানে সম্পত্তির জন্য আসিনি । আমাদের আসার জন্য খবর দেওয়া হয়েছে তাই এসেছি।

পলি বেগম এই প্রসঙ্গে কথা না বলে বিলাপের স্বরে বলে উঠলো,

-ফুয়াদ কোথায়? আমার ছেলেটার কোনো খোঁজ নেই। আমি মরলেও ও জানতে পারবে না। তোরা ওকে একটু খুঁজে বের কর।

পাগলের মত বিলাপ করতে লাগলেন পলি বেগম।

-এশাও আমাকে একটু দেখতে আসলো না। আর শফিক তো মনে হয় গ্রামে আবার বিয়ে করেছে। আমার কথা ভুলে গেছে।

ফয়সাল আর রাহাতকে আড়ালে ডেকে মালা বিচলিত মুখে বলল,

-হঠাৎ করে এত ঝামেলা হলো। তোমরা সবাই বাসা থেকে বের হয়ে এসেছো। সব মিলিয়ে মা খুব ধাক্কা খেয়েছে। একা হয়ে পড়েছে। তার মানসিক সমস্যা হচ্ছে। ডাক্তার বলেছে তাকে পারিবারিক সান্নিধ্যে রাখতে।

রাহাত বলল,

-আমরা চলে এসেছি দেখে ধাক্কা খেয়েছে নাকি তাকে ছাড়া সবাই চলতে পারছে তা দেখে ধাক্কা খেয়েছে?

ফয়সাল বিরক্ত মুখে বলল,

-এখন এসব কথা বাদ দে। কিন্তু মা তো আমাদের বাসায় সাধছে না। উল্টো আবার সেই সম্পত্তির কাহিনী তুলেছে।

-ভাইয়া মা তো এরকমই। তার জন্য এই অবস্থায় তাকে তোমরা একা রাখবা?

-একা কোথায়? তুই আছিস। কাজের মেয়ে রেখেছে দুইজন। সে যদি তার ওই অযাচিত কতৃর্ত্ব ফলানোর অভ্যাস পরিবর্তন করে আমাদের ডাকে, আমরা অবশ্যই যাবো।

-সে তার অহংকার ভেঙে তোমাদের ডাকবে?

-তাহলে থাকুক সে তার অহংকার নিয়ে। আমরা যাবো না।

ওরা সত্যি গেল না। শফিক আহমেদও হাসপাতালে এসে তাকে একবার দেখে গ্রামে চলে গেলেন। দুই দিন পর পলি বেগমের অবস্থার উন্নতি হলে ফয়সাল আর রাহাত তাকে বাসায় রেখে আসলো।
__

এর ভিতর এশা একদিন দুপুরে ক্লাস শেষে সম্পার বাসায় হাজির হলো। সম্পা এর আগে কত করে আসার জন্য বলেছে ওকে। আসেনি। আজ হঠাৎ আসায় ভারি অবাক হলো।

এশার চেহারা ক্লান্ত, দুর্বল দেখালো। যে মেয়ের স্বামী এভাবে লাপাত্তা হয়ে গেছে তার চেহারা তো ঝলমলে দেখাবে না।

-আগে খাওয়া-দাওয়া করো। তারপর গল্প করবো। আজ তোমাকে যেতে দিবো না। আমার সাথে থাকবে। দরকার হলে রাহাত অন্য রুমে ঘুমাবে।

এশা তেমন কোনো কথা না বলে খেতে বসলো। খাওয়ার পরই বেসিনের দিকে ছুটে গেল। গলগল করে বমি করে সব খাবার ফেলে দিলো।

সম্পা একটু অন্য রকম স্বরে জিজ্ঞেস করল,

-কি ব্যাপার এশা?

এশা হাত মুখ ধুতে ধুতে বলল,

-তেমন কোনো ব্যাপার নেই ভাবী। আমার শরীর একটু অসুস্থ। এ্যাসিডিটি বেড়েছে।

-এত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলছো অন্য কোনো ব্যাপার নেই! তুমি আর ফুয়াদ কি আলাদা ঘুমাতে নাকি? একজন খাটে, একজন মেঝেতে এমন কিছু? তোমাদের ভিতর কিছু হয়নি?

-হবে না কেন! পুরুষ মানুষ এক যুগের প্রেম রেখে বাধ্য হয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করলেও রাত হলে শরীর হাতাবেই।

-তুমি প্রেগন্যান্সি টেস্ট করেছো এশা?

-আপনার দেবর বিয়ের পরই বলে দিয়েছে সে বাচ্চা কাচ্চা পছন্দ করে না। বাচ্চা কাচ্চা জন্ম দিয়ে এই ছোট জীবনে অত বাড়তি ঝামেলা, দায়িত্ব তিনি নিতে পারবেন না।

-আমার দেবর এটা বলে দিয়েছে দেখে কি বাচ্চা হতে পারে না? পৃথিবীতে সবাই পরিকল্পনা করে বাবা-মা হয়? অপরিকল্পিত ভাবেও হয় এশা। তুমি টেস্ট করে দেখো। আমার কাছে একটা কিট আছে। চাইলে এক্ষুণি করতে পারো। আচ্ছা ভালো কথা, তোমার এই মাসের পিরিয়ড…।

-হয়েছে।

সম্পা হতাশ মুখে বলল,

-এটা আগে বললেই তো হতো। আমি শুধু শুধু এতক্ষণ ধরে ভাষণ দিয়ে যাচ্ছি।

-আচ্ছা ভাবী আমি এখন উঠি তাহলে। আমার টিউশন আছে।

-বসো। তোমার সাথে আরো কথা আছে আমার।

সম্পা এশাকে হাত ধরে আবার বসিয়ে একটু হেসে জিজ্ঞেস করল,

-তুমি ফুয়াদের ব্যাপারে এত হেইট স্পিচ দাও কেন এশা? ও কি তোমাকে খুব অত্যাচার করতো?

-না।

সম্পা একটু থেমে থেকে বলল,

-ফুয়াদ খুব দায়িত্বশীল মানুষ। খুব ভালো ও। তুমি বোধ হয় ওকে চিনতে পারোনি।

-যথেষ্ট চিনেছি।

-মোটেও না। তুমি আসল ফুয়াদকে দেখোইনি। খুব অস্থির সময়ে তুমি ওর জীবনে এসেছো।

-দায়িত্বশীল মানুষ এভাবে চলে যায়?

-কীভাবে চলে গেছে? ও তো তোমাকে থাকার জায়গা, টাকা সবই দিয়ে গেছে।

-থাকার জায়গা আর টাকাই কি সব?

-বিয়ের পর থেকে আমি ফুয়াদকে দেখে আসছি। আমরা এক বাড়িতে থেকেছি। ও চলে আসবে এশা। তুমি ভাবছো ও তোমাকে ফেলে একেবারে চলে গেছে! এরকম অন্যায় করার মানুষ ও না। একেবারে চলে যাওয়ার হলে ও সব সম্পর্ক চুকিয়েই যেত। ও এবার সমস্ত অস্থিরতা দূর করেই ফিরে আসবে। এরপর তুমি দেখো ও কেমন মানুষ!

-আমার আর কিছু দেখার দরকার নেই।

-নিজের শরীরের যত্ন নাও। চেহারার এই হাল করেছো কেন! টাকা, ফ্ল্যাটের চাবি সব দিয়ে এসেছো। ফুয়াদ এসে এসব শুনলে তোমাকে যে কি করবে!

-কিছু করার সুযোগ নেই। আমি তাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবো।

সম্পা হেসে বলল,

-ঠিক আছে। দেখা যাবে।

-ভাবী আমি এখন তাহলে উঠি।

-আমার কথা শেষ হয়নি। আজকে টিউশনে যেতে হবে না। বসো। ফুয়াদ তোমাকে টাকা দিয়ে গেছে। ঠিক ভাবে পড়াশোনা করতে বলেছে। আর তুমি এই অসুস্থ শরীরে টিউশন করে বেড়াচ্ছো। এই পাকনামির জন্য কত যে ধমক খাবে।

-আপনি এসব কথা বলার জন্য আমাকে বসিয়ে রেখেছেন?

-ঠিক আছে অন্য কথা বলি। শুনো। আমি বিয়ের পরই ওই বাড়িতে গিয়ে দেখি তুমুল ঝামেলা চলছে। বাড়ির ছোট ছেলে মায়ের কথা শুনছে না। মা চাচ্ছে ছেলে বিবিএ পড়ুক। ছেলে পড়বে ইঞ্জিনিয়ারিং। কি যে কঠিন ঝামেলা হলো! শেষ পর্যন্ত মায়ের কথার অবাধ্য হয়ে ছেলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে ভর্তি হলো। মা ক্ষিপ্ত হয়ে লেখাপড়ার খরচ দেওয়া বন্ধ করে দিলো। এরপর ফুয়াদ টিউশন করে খরচ চালিয়েছে। খুব কষ্ট হয়েছে ওর। এরকম আরো অনেক ঘটনা আছে। সেগুলো তেমন বড়ো না। ছোট ছোট। পড়াশোনা শেষে ফুয়াদ যখন আবার দেশের বাইরে চলে যেতে চাইলো তখন আবার বড়ো ঝামেলা হলো। মা চাচ্ছিলো ও ব্যবসায় থাকুক। সেজন্য টাকা দিলো না। ওদিকে ওর নাকি সারাজীবনের স্বপ্ন ছিলো দেশের বাইরে যাওয়ার। কয়েক লাখ টাকার প্রয়োজন। শেষ পর্যন্ত যেতে পারলো না। খুব ভেঙে পড়েছিলো। এরপর তো সুস্মিতার ব্যাপার তুমি তো জানোই। সুস্মিতার পরিবার ফুয়াদকে যে কি অপমান করেছে! করবেই বা না কেন? মা সুস্মিতাদের বাসায় গিয়ে উল্টাপাল্টা আচরণ করেছে। এরকম ফ্যামিলিতে তারা মেয়েই দিতেই রাজি হলো না। সুস্মিতাও শেষমেষ ওকে ছেড়ে চলে গেল।

সম্পা থেমে একটা দম ফেলে বলল,

-এরপর ও সব ভুলে চুপচাপ ব্যবসায় থাকলো। তোমাকে বিয়ে করলো। ব্যবসায় থেকেছে হয়ত দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য টাকা জমাতে। আর বিয়ের করে ও নিজের রাগ, জেদ থেকে তোমাকে ব্যবহার করে পরিবারের অশান্তি সৃষ্টি করতে থাকলো একের পর এক। এসব এখন সবার কাছেই পরিষ্কার। ফ্যামিলিটা ওর কাছে একটা বিরক্তির জায়গা হয়ে উঠেছিল। ও এই বিরক্তিকর পরিবারটা ভাঙতে চেয়েছে। শেষ পর্যন্ত ভেঙেছেও। তাতে কিন্তু খুব ভালো হয়েছে। পরিবারের এই অশান্তির কারণে ও সব সময় দূরে চলে যেতে চাইতো। ও আসলে ফয়সাল ভাইয়া আর রাহাতের মত সবকিছু মেনে নেওয়ার মানুষ না। ও একটু অন্য ধাঁচের।

সম্পা আবার বলল,

-এখন তুমি বলো ও কি কোনো যন্ত্র? মানুষের মন ঠিক হতেও তো একটু সময় লাগে এশা। ও তো আর সেরকম সময় পায়নি। এর আগেই তোমাদের বিয়েটা হয়ে গেল। এমন না যে বিয়ের পর ও সুস্মিতার সাথে যোগাযোগ রেখেছে। সুস্মিতা বাসায় এসেছিলো, দেখোনি ও কীভাবে এড়িয়ে গেছে? ও দূরে গেছে ভালো হয়েছে। সব তিক্ততা, বিরক্তি ধীরে ধীরে ধুয়ে মুছে যাবে। মন মেজাজ স্থির হবে।

ফুয়াদের মন মেজাজ স্থির হবে কিনা এশার জানা নেই। তবে ও খুব অস্থির মুখে সম্পা ভাবীর বাসা থেকে বেড়িয়ে আসে। বাসায় ফেরার পরে ফার্মাসি থেকে একটা প্রেগন্যান্সি কিট কিনে এনে টেস্ট করলো।

অদৃষ্টের এ কি পরিহাস! এশার দুর্বল শরীরটা আরো নিস্তেজ হয়ে আসলো। ও ধীরে ধীরে মেঝেতে বসে পড়লো। ওর হাউমাউ করে গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ও বার বার কিটটার দিকে তাকাচ্ছে স্তব্ধ চেহারায়!

মিনারা বেগম রান্নাঘর থেকে ডাকলেন,

-এশা এদিকে আয়। শুনে যা একটু।

ও বেহুঁশের মত উঠে সেদিকে গেল।

মিনারা বেগম পেঁয়াজ কাটতে কাটতে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,

-আগেই যদি সাহস করে এই সম্পত্তি বিক্রি করে তোকে তাড়াহুড়ো করে বিয়ে সাদি না দিয়ে পড়াশোনা করাতাম! তখন এত সাহস হয়নি। এখন দেয়ালে পুরোপুরি পিঠ ঠেকেছে তো!

এশা কোনো কথা না বলে কেমন গা ছাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

মিনারা বেগম আবার বললেন,

-টাকা এভাবে ঘরে বসিয়ে রাখার চেয়ে আমরা যদি ওই মোড়ে একটা দোকান ভাড়া করে মেয়েদের জামা পোশাক তুলি কেমন হবে বল তো? ওখানে স্কুল, কলেজ আছে। আরো দুইটা মহিলার দোকান আছে দেখেছিস? ভালোই চলে।

এবারও এশা কিছু বলল না। মিনারা বেগম তাকিয়ে দেখলেন ওকে কেমন অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে। তিনি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই এশা তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
__

রাত আটটার কাছকাছি। ফুয়াদ একটা পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে। একটা সিগারেট ধরিয়ে অর্ধেক টেনে ফেলে দিলো। মাঝে কয়েক মাস একেবারে চেইন স্মোকার হয়ে গিয়েছিল। এখন আর তেমন ভালো লাগছে না।

আজকে জ্যোৎস্না রাত। একদম ঝকঝকে চাঁদের আলো। এশা আবার জ্যোৎস্না দেখার পাগল। মেয়েদের জ্যোৎস্না দেখা, বৃষ্টিতে ভেজা এসব নিয়ে আলাদা আহ্লাদ থাকে। ফুয়াদের নেই। এশা কি বৃষ্টিতে ভিজতেও পছন্দ করে? ওর জানা নেই।

আজকে রাত পাহাড়েই তাঁবু টানিয়ে কাটাবে।
ওর সঙ্গে আরো কয়েকজন আছে। কাল দুপুরের বাসে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। ওর লন্ডন যাওয়ার তারিখ পড়েছে।
(চলবে)

#ইসরাত_জাহান_তানজিলা

#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-৩৪

এশা বিকালে কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে এখন হাঁটুতে মুখ গুঁজে খাটের উপর বসে আছে। বসার ভঙ্গি অত্যন্ত বিষণ্ণ। একটা মানুষ টানা পাঁচ-সাত ঘন্টা একই ভঙ্গিতে বসে আছে। কি আশ্চর্য কারবার! সামান্য নড়াচড়া করছে না। যেন একটা কংক্রিটের মূর্তি।

মিনারা বেগম ওর কাঁধে মৃদু ঝাঁকি দিয়ে বললেন,

-বাচ্চা হওয়া এমন কোনো দুঃখের ব্যাপার না যে এভাবে বসে থাকতে হবে।

এশা আগের মতই নীরব। ও চোখের পলকও ফেলছে অনেকক্ষণ পর পর।

-বেয়াদবের বাচ্চা। জীবনে নাকি বাপ হইতে চায় না। তার বউ আবার বিয়ের পরই প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়। বেয়াদবির ফল এগুলো।

মিনারা বেগম কিছুক্ষণ ফুয়াদকে বকাঝকা করলেন। এরপর এশাকে বললেন,

-পৃথিবীতে যে আসে সে তার রিজিক নিয়েই আসে। তোর তো চারকুলে কেউ ছিলো না। আল্লাহ আমাদের বাঁচিয়ে রাখেনি?

-আমার জীবনটাও এখন তোমার মত অমন দুর্দশায় কাটবে? আমার সন্তানেরও আমার মত জলে ভাসা জীবন হবে!

নিদারুণ হাহাকার ভরা গলায় বলল এশা।

মিনারা বেগম একটু হেসে বললেন,

-তা হবে কেন মা! তোর সন্তান কি আর যেমন তেমন ব্যাপার! সে হলো পলি বেগমের নাতি। রাজকন্যা-রাজপুত্রের মত জীবন হবে তার।

-মা তুমি হাসছো! বাপ ছাড়া কারো রাজকন্যা-রাজপুত্রের মত জীবন হয় না। আমার মত জীবন হয়।

-তোর সন্তানের বাপ ছাড়া জীবন হবে কেন রে! বাপ-মা, দাদা-দাদী, চাচা-ফুফু.. সবাইকে নিয়ে খুশির সম্রাজ্য হবে ওর। তোর তো একটা বদমাইশ রাজা বর আছে। তুই হবি ওই সম্রাজ্যের সবার প্রিয় সম্রাজ্ঞী।

এশা এবার হাঁটু থেকে মুখ তুলে বলল,

-এসব মিথ্যা সান্ত্বনা দিতে হবে না! আমি এখন আর ছোট এশা নেই যে তুমি এসব হাবিজাবি রাজা-রানীর কেচ্ছা বলে আমার মন ভালো করবে।

মিনারা বেগম মিষ্টি নিয়ে আসেন। এশার মুখের সামনে ধরে বললেন,

-নে মিষ্টি মুখ কর। তোকে মিথ্যা সান্তনা দিবো কেন? সত্যি রাজা-রানীর হাবিজাবির কেচ্ছার মতই রূপকথার জীবন হবে তোর।

এশা অসহায় মুখে তাকালো সেদিকে,

-তুমি মিষ্টি এনেছো! এসব কি তামাশা শুরু করলে!

মিনারা বেগম জোর করে ওর মুখে মিষ্টি ঢুকিয়ে দিলো। ও ভোঁতা চেহারায় সেটুকু বাধ্য হয়ে গিললো।
__

পলি বেগম রুম পরিবর্তন করে মালার রুমে উঠেছে। ইদানিং রাতে একা রুমে তার ভীষণ আতঙ্ক লাগে। মনে হয় ওইদিনের মত আবার জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকবে। এরপর হাসপাতালের বিছানায় চোখ খুলে পাশে কাউকে দেখবে না।

বিছানার উপর ঝিম ধরে বসে আছেন পলি বেগম। মালা সেই কখন তার হাতে ওষুধ ভেঙে দিয়ে গেছে। তিনি বোধ হয় ওষুধ খাওয়ার কথা ভুলে গেছেন।

-তোর বাপ কত বড় নিমকহারাম দেখেছিস! কত বড় বেইমান! আমার ছেলে গুলোও নিমকহারাম। সব সমান। কেউ আসলো না বাড়িতে। আমি মরলেও বোধ হয় ওরা আসবে না। এমন নিষ্ঠুর স্বামী, সন্তান তুই আর দেখেছিস মালা?

মালা রুমে ঢুকতেই পলি বেগম দুঃখ ভরা গলায় বললেন। দিনের বেশির ভাগ সময়ই তিনি এখন এসব বলেন। তার মাথায় সত্যি বোধ হয় গণ্ডগোল হয়ে গেছে।

-এটা তোমার বাড়ি। তুমি ওদের আসতে না বললে, ওরা কীভাবে আসবে?

-আমার এক ছেলে তো সারাজীবনের জন্য চলে গেছে। ও কি সত্যি আর কখনো আসবে না? ওর কারণেই আমার সংসার ভেঙেছে। আমার গাড়িটাও ভেঙেছে ও। তবুও আমি ওর জন্য কাঁদছি। আমার এত বড় বাড়িতে এখন একটা কাকও ডাকে না।

-অবশ্যই আসবে। তুমি ওষুধ খাও। আমি আলো নিভাবো।

পলি বেগম জানালা দিয়ে ওষুধ গুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন,

-এই ওষুধে কোনো কাজ হবে না রে মা! কেউ আমাকে পরোয়া করছে না। পৃথিবীতে আমার আর কোনো গুরুত্ব নেই। আমার এত অর্থ সম্পত্তি সব তুচ্ছ মনে হচ্ছে।

মালা আলো নিভিয়ে শুয়ে বলল,

-হুম। রাজ্য আছে। রানী আছে। কিন্তু প্রজা গুলো নেই। সেই শোকে রানীর তো মাথায় সমস্যা হবেই।

-কি বললি তুই?

-কিছু না। ঘুমাও। আর সবার জন্য তোমার এত দুঃখ হলে কাল গিয়ে সবাইকে নিয়ে আসো। এনে আবার নিজের ক্ষমতা, দাপট…।

-আমি কাউকে আনতে যাবো না। দুই এক দিনের ভিতরই এই বাড়ি তোর বাপের নামে লিখে দিবো। এরপর সে তার ছেলে আর ছেলের বউদের নিয়ে থাকবে এখানে। আমি দুই চোখ যেদিকে যায় চলে যাবো। আমার মনে কোনো শান্তি নেই।

-তাই ভালো হবে।

-ফুয়াদের বউটা কত বড় নিষ্ঠুর দেখলি! আমাকে একটা বার দেখতে আসলো না।

-হুম তোমার মত তেজ আছে।

মালা ঘুমিয়ে পড়লো। পলি বেগম সকালে উঠে কোথায় যেন চলে গেলেন। তিনি বোধ হয় সত্যি এই বাড়ি শফিক আহমেদের নামে লিখে দিবেন। তবুও মুখ ফুটে একবার কাউকে সাধবে না!
__

ফুয়াদ দুপুরের বাসে রওয়ানা দিয়ে ঢাকা পৌঁছালো রাতে। বাস থেকে নেমেই ফুলের দোকান খুঁজলো। রাত একটু বেশি হওয়ায় দোকানপাট প্রায়ই বন্ধ। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে একটা দোকান খোলা পেল। সেখান থেকে ফুল কিনে সোজা বাসার উদ্দেশ্যে রিক্সায় উঠলো।

এশা এখন সজাগ আছে নাকি ঘুমিয়ে পড়েছে? ও তেমন রাত জাগে না। নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে। ফুয়াদ রিক্সা থেকে নেমে দ্রুত ভাড়া মিটিয়ে উপরে উঠে।

ফ্ল্যাটের দরজায় তালা ঝুলানো। এশা এখানে নেই? কি আশ্চর্য কাণ্ড! এতদিন বন্ধ করে রাখা ফোনটা চালু করে ফুয়াদ। ব্যস্ত হয়ে এশার নম্বর ডায়াল করে। ফোন বন্ধ বলছে।

মেয়েটাকে এই এখানে থাকার জন্য বলেছে। টাকাও দিয়ে গেছে! তবুও সে এখানে নেই। ও বিরক্ত হলো। কিন্তু অস্থির হলো বেশি।

সম্পা ভাবীর সাথে এশার ভালো খাতির। সে অবশ্যই জানবে ও কোথায় আছে। ফুয়াদ তৎক্ষণাৎ তার কাছে কল দিলো। ফোন ধরলো রাহাত।

-ভাইয়া এশা কোথায়? আমি ওকে এই বাসায় থাকতে বলেছি। কিন্তু ও এখানে নেই।

রাহাত থমথমে মুখে বলল,

-আমার বাসা আসো। ম্যাসেজ করে অ্যাড্রেস পাঠাচ্ছি।

-ও তোমাদের বাসায়?

-এত কথা বলছো কেন! আসতে বলছি আসো।

ফুয়াদ আবার রাহাতের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। এত লম্বা জার্নি করে এসে এখন এখানে-ওখানে পাগলের মত ঘুরবে! মেয়ে মানুষ তো! সব সময় দুই লাইন বেশি বুঝতেই হবে।

ফুয়াদ হন্তদন্ত হয়ে রাহাতের বাসায় গেল। রাহাত বলল,

-বসো শান্ত হয়ে।

ফুয়াদ অস্থির ভঙ্গিতে বসে বলল,

-আমি কি মানুষকে বুঝাতে পারি না! নাকি মানুষ আমাকে বুঝতে চায় না। ওকে আমি পরিষ্কার ভাবে বলে গেলাম আমার বাসায় থাকতে। ও সেখানে নেই। এই মাঝরাতে আমি এখন ওকে এখানে সেখানে খুঁজে বেড়াচ্ছি ভাবী!

ফুয়াদ ক্লান্ত ভাবে একটা দম ফেলে বলল,

-আমি শুধু ওর সাথে দেখা করার জন্য এসেছি। নয়ত এখানে তো আমার কাজ নেই। আমি ফ্লাইটের দিনই আসতে পারতাম।

রাহাত জিজ্ঞেস করল,

-তুমি কোথায় যাচ্ছো?

-লন্ডন।

-ভেরি গুড।

-আচ্ছা বলো এশা কোথায়।

সম্পা কোনো কথা বলল না। রাহাত গম্ভীর গলায় প্রত্যুত্তর করল,

-অযথাই এসেছো। এশার সাথে তো দেখা করা আর সম্ভব না। এশা মারা গেছে। তুমি যেখান থেকে এসেছো আবার সেখানে চলে যেতে পারো। একবারে এসে ফ্লাইট ধরো।

ফুয়াদের পৃথিবীতে মহাপ্রলয় হলো। বিধ্বংসী প্রলয়। ওর মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হলো না। শরীরটা তরতর করে ঘেমে গেল। বাকশক্তি, শ্রবণশক্তি সব ভোঁতা হয়ে গেল।

-গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছিলো এশা। পনেরো দিন হাসপাতালে ছিলো। তোমার কথা বলেছিলো খুব। এক ঘন্টার ব্যবধানে মানুষের জীবনে কত অঘটন ঘটে যেতে পারে। তুমি সেখানে প্রচণ্ড কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষের মত কত গুলো দিন ধরে নিখোঁজ হয়ে ছিলে, একটা ফোন কল পর্যন্ত করোনি।

ফুয়াদকে সর্বহারা, নিঃস্ব দেখালো। ওর চোখের জল গাল পর্যন্ত গড়ালো। বেচারার ভেতরটায় কেমন দুর্বিষহ, অবর্ণনীয় যন্ত্রণাই না হচ্ছে! সম্পার মায়া হলো। রাহাত হলো অল্প কথার গম্ভীর মানুষ। সে যদি বলে সূর্য পশ্চিমে উঠেছে তাও বাসার সবাই বিশ্বাস করতে চাইবে। সম্পা বিরক্ত চোখে রাহাতের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল,

-ধুর! কি বিচ্ছিরি মিথ্যা বলছো!

-ও যা করেছে তাও খুব বিচ্ছিরি হয়েছে। অন্তত একটা রাত কষ্ট পাক!

ফুয়াদের বোধশক্তি সব অকেজো হয়ে গেছে। ওর কানে কোনো কথা ঢুকছে না। রাহাত বলল,

-তুমি বাঁধনহারা, একাকী জীবন চেয়েছো। অবশেষে সৃষ্টিকর্তা তোমাকে সেটা পাইয়ে দিয়েছে। অভিনন্দন। এবার তুমি যেখানে খুশি যাও। তোমার মা একজন খারাপ শাশুড়ি। তুমি একজন খারাপ স্বামী। অযথাই বড় বড় কথা বলো তুমি। তুমি আসলে মায়ের কার্বন কপি।

সম্পার খুব মেজাজ খারাপ হচ্ছে। ফুয়াদের এমন কি দোষ যে ওকে এসব বলে এক রাত যন্ত্রণায় রাখতে হবে! এশার মৃত্যু ওর জন্য কি সামান্য কোনো ব্যাপার!

রাহাত উঠে নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে বলল,

-আগামী সপ্তাহে ওর মৃত্যুর একচল্লিশ দিন হবে। পারলে মিলাদটা দিয়ে লন্ডন যেয়ো। সম্পা ওকে খাবার দাও। খেয়ে দেয়ে ঘুমাতে বলো। এত দুঃখ পাওয়ার নাটক করছে কেন ও!
(চলবে)

#ইসরাত_জাহান_তানজিলা