এই জোছনা ধারায় পর্ব-৩৭+৩৮

0
234

#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-৩৭

বিয়ে রাখবে না! বিয়ে না রাখার মত কি হলো! ফুয়াদের তীব্র আকুলতা কিছুটা রাগে গড়ালো। কিন্তু ও নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল এশার দিকে। মেয়েটার চেহারা কেমন শুকিয়ে গেছে। ক্লান্ত, অবসন্ন দেখাচ্ছে। কিন্তু চোখ-মুখের অভিব্যক্তি খুবই কঠিন! ফুয়াদের প্রতি উপচে পড়া রাগ, অভিমান, ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ যেন।

ফুয়াদ স্থির হয়ে নরম গলায় বলল,

-আই থিংক আমার সাথে বিয়ে না রাখতে চাওয়ার মত কিছু হয়নি। আমি মেয়ে নিয়ে পালিয়ে যাইনি এশা। আমি আমার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব কাউকে জানিয়ে যাইনি। কিন্তু ওই বিধ্বস্ত মনে তোমাকে ঠিকই লম্বা চিঠি লিখে জানিয়েছি। আমার মানসিক অবস্থাটা বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তুমি কি একটুও বুঝোনি এশা? যদি বুঝতে তাহলে তো তুমি আমার বাসায়ই থাকতে। রোদে পুড়ে টিউশনি করে চেহারার এই অবস্থা করতে না। আমার প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হচ্ছে তোমার উপর। তবুও দেখো আমি নিজেকে শান্ত রাখছি। তোমাকে জড়িয়ে ধরতে চাচ্ছি। কারণ তুমি আমার জীবনে ম্যাটার করো এশা।

এশা কোনো প্রত্যুত্তর করলো না। ওর মুখ ইস্পাতের মত কঠিন। ফুয়াদ ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলল,

-কতদিন পর দেখা হলো। হোক পু্রোটা আমার দোষ। তোমার রাগ, অভিমান, বিরক্তি, ক্ষোভ হতেই পারে আমার উপর। হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এসবের আড়ালে তো একটু অন্য অনুভূতিও থাকতে পারতো। তুমি বোধ হয় আমার জন্য অপেক্ষাই করোনি। মনে হচ্ছে আমি জীবনে ফিরে না আসলেও তোমার কিছু এসে যেতো না। অথচ আমি ভেবেছিলাম…।

ফুয়াদ থেমে বলল,

-সকালে তোমার সাথে দেখা হলো। তখন আমার ব্রেন ঠিকঠাক কাজ করছিলো না। কিন্তু তোমার ব্রেন তো ঠিক ছিলো। তুমি আমাকে ওভাবে এড়িয়ে চলে গেলে! আর এখন আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরতে চাইলাম! অথচ তুমি যন্ত্রের মত এখানে দাঁড়িয়ে আছো। কতটা ব্যাকুল হলে মানুষ একবার জড়িয়ে ধরার জন্য এভাবে অনুনয় করে এশা!

এশা এবার মুখ খুলে নিচু স্বরে বলল,

-মা ওখানে। রুমে গিয়ে কথা বলি।

-না, রুমে গেলে তো আমি তোমাকে খেয়ে ফেলবো। আমার স্পর্শ নাকি তোমার ভালো লাগবে না। তো কার স্পর্শ ভালো লাগবে? আমি কিসের জন্য ঢাকায় আসলাম! আমার তো সোজা লন্ডনের ফ্লাইট ধরা উচিত ছিলো।

এশা রুমে চলে আসে। কিছুক্ষণ পর ফুয়াদও আসে। এশা রুমের দরজা আটকাতে আটকাতে বলল,

-আমার কাছে আসবেন না। আমাকে কোনো ভাবে স্পর্শ করার চেষ্টা করবেন না। তাহলে আমার খুব ভালো লাগবে।

ফুয়াদ টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলল,

-ঠিক আছে।

-কি যেন বলছিলেন? আপনি আমাকে লম্বা চিঠি লিখে জানিয়ে গিয়েছেন। আপনার জীবনে আমি ম্যাটার করি। আপনি আমার জন্য ঢাকায় এসেছেন। আচ্ছা এগুলোকে কি আপনি আমার প্রতি মহৎ আচরণ ভাবছেন?

-না, আমার মত ব্যর্থ মানুষের কারো প্রতি মহৎ আচরণ করার সাধ্য নেই। কাউকে নিজের পরিস্থিতি বুঝানোরও ক্ষমতা নেই।

-মন মেজাজের দোহাই দিয়ে আপনি লাপাত্তা হয়ে যাবেন। একটা বার কল দেওয়ারও প্রয়োজন মনে করবেন না। হুট করে নিজের মর্জি মতো ফিরে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরতে চাইবেন। আবার নাকি আপনি লন্ডন যাবেন। যাওয়ার জন্য সবকিছু রেডি করে এসেছেন। আচ্ছা আমাদের তো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কি এরকম হয়? এতটা ঠুনকো! লন্ডন, আমেরিকা কোথায়ও যেতে কিছু জিজ্ঞেস করতে হয় না! আসলে আমি আপনার জীবনে এতটা গুরুত্বহীন যে আমার প্রতি সামান্য স্বাভাবিক আচরণও আপনার কাছে বিশেষ মনে হয়।

ফুয়াদ অধৈর্য মুখে বলল,

-ব্যাপার গুলোকে এত জটিল করে ভেবো না এশা। একটু সহজ ভাবে বুঝো। জীবনে একের পর এক বিভিন্ন ঝামেলায় আমার মন-মেজাজ অস্থির ছিলো। বিয়েটাও সেই অস্থিরতার ভিতরেই হয়েছে। এখন আমি স্থির হয়েছি। আর কোনো অন্তর্দ্বন্দ্ব, দ্বিধা নেই আমার মনে। আমি তোমার সঙ্গে সংসার করতে চাই। আগের কথা বাদ দাও। দেশের বাইরে যাওয়ার সবকিছু আগেই হয়েছে। এখন হলে অবশ্যই তোমাকে জিজ্ঞেস করতাম। এটা আমার জীবনের অনেক বড় একটা স্বপ্ন এশা। একটু এপ্রিশিয়েট করো। পরিবারের মানুষদের কাছ থেকে আমি জীবনে কোনো ব্যাপারে কখনো এপ্রিশিয়েশন পাইনি।

-হ্যাঁ আমি আপনাকে এপ্রিশিয়েট করছি। আপনার সকল স্বপ্ন পূরণ হোক। লন্ডনের জীবন সুন্দর হোক।

-তোমাকেও নিয়ে যাবো। আমাদের লন্ডনের জীবন সুন্দর হবে।

-আমার এত বড় স্বপ্ন নেই। মা বোধ হয় খাবার বেড়েছে। আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। আপনি খেয়ে চলে যান।

ফুয়াদকে হতাশ দেখালো। এই হতাশা ছাপিয়ে ধীরে ধীরে প্রচণ্ড রাগ হতে লাগলো। সব মিলিয়ে কিরকম অসহনীয় অনুভূতি হচ্ছে ওর। সহজ কথা গুলো এশা কেন বুঝতে পারছে না? নাকি বুঝতে চাচ্ছে না?

-লন্ডন যাওয়ার আগে কিছুদিন আমার সাথে থাকতে এসেছেন! শরীরের টানে এসেছেন। এরপর লন্ডন যাওয়ার পর আপনাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না আমি সেটা জানি। আপনাকে আগাগোড়া আমার চেনা হয়ে গেছে। কয়টা দিন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করুন। লন্ডন গেলে মেয়ের অভাব হবে না। আপনার ভালোবাসা.. সুন্দর হাসির মেয়ে সুস্মিতাও লন্ডন থাকে।

-তোমার কি ধারণা বাংলাদেশে মেয়ের অভাব আছে! শরীরের টানে তোমার কাছে এসে এভাবে একবার জড়িয়ে ধরার জন্য করুণা করতে হবে!

এই বলে ফুয়াদ ক্ষিপ্ত মুখে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে সজোরে দরজা খুলল। এশা বাঁধা দিলো না। মিনারা বেগম গোসলে ঢুকেছেন। বাসা থেকে বের হয়ে ক্রোধান্বিত পায়ে ধপধপ করে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে বেড়িয়ে পড়লো ফুয়াদ।

জীবনে কাউকে এভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেনি ও। কারো প্রতি এত ব্যাকুল হয়ে অনুরোধ করেনি। আজ করেছে। সর্বোচ্চ আকুলতা প্রকাশ করেছে। বিপরীতে কি পেল? বিরক্তি, অবহেলা!

মন থেকে চাওয়া সকল কিছুই ওকে এভাবে হতাশ করেছে। আজ এশাও করলো।
__

মিনারা বেগম গোসল সেরে বের হয়ে দেখলেন ফুয়াদ চলে গেছে। তার খুব রাগ হলো এশার উপর। এগুলো কেমন খামখেয়ালি আচরণ!

-ছেলেটা নিজে থেকে সেধে বললো আমাকে রান্না করতে। যত যা ই হোক, তুই ওকে এভাবে না খেয়ে যেতে দিলি কীভাবে?

-আমি তাকে খেয়ে যেতে বলছি!

-এশা, বিয়েটা কোনো ছেলেখেলা না। সংসার জীবনে এর চেয়ে আরো অনেক কিছু হয়। ফুয়াদ যদি সেরকম খারাপ হতো আমিই তোকে ওর সাথে ফিরে যেতে দিতাম না। তোর ভালোটা আমি তোর চেয়ে বেশি বুঝি।

-আমি তো বলিনি মা ছেলেখেলা!

-ওর সঙ্গে যা। বাচ্চা হওয়ার খবরটা ওকে বল। এরপর যদি আবার মনে হয় ও তোকে অবহেলা করছে। তোর প্রতি কোনো অন্যায় আচরণ করছে। আমি নিজে তোকে নিয়ে আসবো।

-বাচ্চা হওয়ার খবরটা উনি যেন কিছুতেই না জানে। আমি তোমাকে অনুরোধ করছি।

-এসবের মানে কি!

-সে বাচ্চা চায় না মা। সে লন্ডন চলে যাবে। আমার প্রতি এত অন্যায় আচরণ করে, এরপর হঠাৎ এসে আমাকে মাথায় তুলে নাচতে চাইলেই তার মাথায় উঠতে হবে? সে আবার যেকোন সময় পরিবর্তন হয়ে যাবে।

মিনারা বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

-মান-অভিমান যা করার কর। কিন্তু ডিভোর্সের কথা মাথা আনিস না। তুই এখন আর একা নেই মা। তোর ভিতর আরেকটা প্রাণ আছে।

এশার চোখ ছলছল করছে। ও চোখ মুছে বিষণ্ণ গলায় বলল,

-সে লন্ডন গিয়ে আবার নিখোঁজ হয়ে যাবে। এই সন্তানের সমস্ত দায়-দায়িত্ব আমারই! আমি সেজন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত। দুঃখকে আমি ভয় পাই না। যা হওয়ার হবে। সারাজীবন কষ্ট করেই বড় হয়েছি।

-এত আগ বাড়িয়ে ভাবছিস কেন? ও তোর প্রতি অবশ্যই অন্যায় করেছে। সেই অন্যায়ের ব্যথায় আমার বুকেও যন্ত্রণা হয়েছে। কিন্তু এখন এর জন্য কি সংসার ভাঙার কথা চিন্তা করা উচিত হবে? ও যদি পরিবর্তন না হতো তাহলে আলাদা ব্যাপার ছিলো!

-এত অস্থির হচ্ছো কেন মা? তার পরিবর্তনের স্থায়ীত্ব কতটুকু সেটা আমাকে বুঝতে দাও! দেখেছো এইটুকুতেই কীভাবে রাগ করে চলে গেল! এত অধৈর্য আমার ব্যাপারে!

এর ভিতর ফুয়াদ ফোন করলো মিনারা বেগমের ফোনে। তিনি ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে বলল,

-আন্টি আমি খুব ক্ষুধার্ত। কাল থেকে কিছু খাইনি। আপনার মেয়েকে দিয়ে আমার জন্য খাবার পাঠালে খুব ভালো হতো। আর ওকে বলুন আমি ওকে কোনো ভাবেই স্পর্শ করবো না। আপনাকে সাক্ষী রেখে বললাম।

মিনারা বেগম বিব্রতবোধ করলেন। তিনি বললেন,

-ঠিক আছে। আমি ওকে দিয়ে তোমার জন্য খাবার পাঠাচ্ছি।

-আপনি শিওর ও আমার জন্য খাবার নিয়ে আসবে? আসার পথে ও আবার খাবারে বিষ মিশিয়ে দিতে পারে। লক সিস্টেম কোনো লাঞ্চ বক্স থাকলে সেটায় খাবার দিয়েন।

মিনারা বেগমের কাছে লক সিস্টেম কোনো লাঞ্চ বক্স নেই। তার চেয়ে বড় ব্যাপার এশা শক্ত হয়ে বসে আছে। ও কিছুতেই ফুয়াদের জন্য খাবার নিয়ে যাবে না।

-মা, তুমি ওই লোকটাকে নিয়ে এত আদিখ্যেতা করছো কেন? ক্ষুধার্ত হলে খাবার বাইরে থেকে কিনে খাক। আমার শরীর ভালো লাগছে না। আমি যেতে পারবো না।

-এমন নিষ্ঠুর আচরণ করছিস কেন? গাড়িতে করে গিয়ে খাবারটা দিয়ে আসবি শুধু। আর শোন ও বলেছে তোকে স্পর্শ করবে না!

-ছিঃ! তোমার কাছে এসব বলেছে।

মিনারা বেগম একটু তড়িঘড়ি করে খাবার বাড়ে। এর ভিতর ফুয়াদ তাকে ফোন দিয়ে আবার বলল,

-আন্টি ও যদি আমার জন্য খাবার নিয়ে না আসে, আমি কিন্তু ওখান থেকে ওকে তুলে নিয়ে আসবো। ও আমার বউ। ওকে তুলে আনলে কে আটকাবে বলুন! আপনি কি আটকাবেন?

এই লোকের দ্বারা এসব অসম্ভব ব্যাপার না। এসব তামাশা ভালো দেখাবে না! এশা শেষমেশ দায়সারা ভাবে তেতো মেজাজে রাজি হলো। কিন্তু ও মনস্থির করলো খাবার দরজার সামনে রেখে চলে আসবে।
(চলবে)

#ইসরাত_জাহান_তানজিলা

#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-৩৮

মিনারা বেগম এশার হাতে লাঞ্চ বক্স ধরিয়ে দিয়ে বাসার গেটের সামনে থেকে রিক্সায় তুলে দিলেন। রিক্সা চলতে শুরু করার আগ মূহুর্তে তিনি ওকে সতর্ক করে বললেন,

-খাবারে আবার কিছু মিশিয়ে নিয়ে যাস না।

এশার কপালে ভাঁজ পড়ে। ও ভ্রু কুঁচকে তাকায়,

-কি আবোলতাবোল বলছো!

-আমি না, ফুয়াদ বলেছে।

-কোথায় কি ছিলো এতদিন! মাথায় বোধ হয় সত্যি গণ্ডগোল হয়েছে।

-আমারও তাই মনে হচ্ছে।

ফুয়াদ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ফুল গাছের টব গুলো দেখছে। ওর আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট। সিগারেট খাওয়া কমিয়েই দিয়েছিলো। কিন্তু এখন এশা যা যন্ত্রণা করছে! এছাড়া নিজের মেজাজ ঠিক রাখার উপায় নেই।

এশা এখানে থাকলে ওর এই শখের গাছ গুলো অন্তত এভাবে পানির অভাবে শুকাতো না। মেয়েটা এমন অবুঝের মত আচরণ কেন করছে! এখন যদি খাবার নিয়ে না আসে তাহলে মেজাজ ঠিক রাখা কঠিন হয়ে যাবে। এত নির্দয় আচরণ তো ওর প্রাপ্য না!

ফুয়াদ দেখলো গেটের সামনে একটা রিক্সা থেমেছে। রিক্সা থেকে অতি রূপবতী এক রমণী প্রচণ্ড বিরক্ত মুখে নেমে ধপধপ করে পা ফেলে বাসার দিকে এগিয়ে আসছে। তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে সে খাবার দরজার সামনে রেখেই চলে যাবে।

হাতের সিগারেটটা ফেলে দ্রুত দরজার দিকে এগিয়ে আসে ফুয়াদ। ওকে আগে থেকে এভাবে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এশা মনে মনে বোধ হয় খানিকটা হতাশ হলো। এখন নিশ্চয়ই খাবার দরজার সামনে রেখে চলে যেতে পারবে না। কিছুটা সময় আবার তার মুখোমুখি ব্যয় করতেই হবে।

-এই নিন আপনার খাবার। আমি আসি।

ব্যস্ত কণ্ঠে ফুয়াদের দিকে লাঞ্চ বক্স এগিয়ে দিয়ে বললো এশা। ওর আসলে তেমন কোনো ব্যস্ততা নেই। তবুও ভান করছে। হয়ত বুকের মধ্যে জমে থাকা পাহাড় সমান রাগ, অভিমান, ক্ষোভের কারণে! এমন কোনো রাত নেই যে ও কাঁদেনি! প্রতিটা মুহুর্ত যন্ত্রণা নিয়ে কাটিয়েছে। ভাতের লোকমা গুলো দলা পাকানো কষ্টের মত গলা দিয়ে নেমেছে। ভেতরটা যে কতখানি পুড়েছে তা কাকে বুঝাবে!

-খাবার তো রেস্টুরেন্টেই খেতে পারতাম। তোমাকে ডেকেছি কেন তাহলে! তুমি এত বোকা এশা!

লাঞ্চ বক্স হাতে না ধরেই রহস্যময় ভঙ্গিতে একটু হেসে বলল ফুয়াদ। এরপর এশার হাত ধরে এক টানে দরজার সামনে থেকে ভিতরে নিয়ে আসে।

-আরে কি করছেন!

গম্ভীর, বিচলিত কণ্ঠ বলে উঠলো এশা। ফুয়াদও দরজায় তালা লাগাতে লাগাতে ভারী গলায় বলল,

-তোমাকে একেবারে বোকা বলা অন্যায় হবে! তোমার মাথায় কিছুটা ভালো বুদ্ধি-জ্ঞানও আছে। তুমি আসলে ঠিকই ধরেছো। আমি শরীরের টানেই তোমার কাছে ঢাকায় এসেছি। লন্ডন গিয়ে আর কোনো যোগাযোগ রাখবো না। পুরুষ মানুষ তো বুঝছো! এরকমই! শরীরই সব। দুনিয়াতে যা করে শরীরের টানেই করে। তাছাড়া তুমি যা সুন্দরী, তোমার যা ফিগার! তোমার হাজবেন্ডের এসব টান একটু বেশিই থাকবে।

এশাকে আতঙ্কিত দেখালো। এসব ফুয়াদের মনের কথা? তার চেহারা দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। তাহলে ওই বাসায় বসে যে ব্যাকুলতা দেখালো! সেসব মিথ্যা? সেই ব্যাকুলতা মিথ্যা হওয়ার আশঙ্কায় ওর বুকের ভিতর ধীরে ধীরে কেমন অসহনীয় ব্যথা অনুভব হতে লাগলো।

ফুয়াদ দীর্ঘ সময় এশার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। এরপর হতাশ কণ্ঠে বলল,

-ভয় পেলে নাকি? না এশা, তোমার মাথায় আসলেই কোনো বুদ্ধি-জ্ঞান নেই। তুমি হচ্ছো একজন বোকা সুন্দরী।

-আপনার উদ্দেশ্য কি পরিষ্কার করে বলুন।

-আমার বাসার ফ্রিজটা খালি। আমার উদ্দেশ্য হলো তোমাকে কে*টে টু*ক*রো টু*ক*রো ওটার ভিতর ভরে রাখবো। স্টুপিড!

-আমি বাসায় যাবো। দরজা খুলুন।

-তোমরা মেয়েরা পরিষ্কার, সোজাসাপ্টা কথা বুঝতে পছন্দ করো না। এখন শুনো বাঁকা করে বলি, আগামী সপ্তাহের শুরুতেই আমার ফ্লাইট। এই এক সপ্তাহ তুমি এখানেই থাকবে। এটাই তোমার বাসা। তুমি এই বাসার সম্রাজ্ঞী। মুঘল সম্রাজ্ঞী নূর জাহান। তোমার মনের সমস্ত রাগ, জেদ, অভিমান, অভিযোগ, ক্ষোভ.. যা কিছু আছে আমার প্রতি, সব এখানে বসেই ঝাড়ো। শুধু আমার সঙ্গে বিয়ে রাখবে না হেনতেন এ সমস্ত কথাবার্তা বলবে না।

এশা কোনো প্রত্যুত্তর না করে চুপচাপ চেয়ার টেনে বসলো। ওর দৃষ্টি অমনোযোগী।

ফুয়াদ লাঞ্চ বক্স খুলে প্লেটে খাবার বেড়ে এশার মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসে জিজ্ঞেস করলো,

-আমার হাতে খাবে? আঙুলের স্পর্শ লাগবে কিন্তু ঠোঁটে। হ্যান্ড গ্লাভস পরে নিবো?

এশা চোখ তুলে ফুয়াদের দিকে তাকালো। বিষণ্ণ গলায় বলল,

-আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। আপনি খেয়ে নিন।

-আমি চলে যাওয়াতে তুমি বোধ হয় একটু বেশিই দুঃখ পেয়েছো। সেই অভিমান ভুলতে পারছো না। অভিমান নিয়েই না হয় তুমি এই কয়টা দিন আমার সাথে থাকো। এরপর যদি মনে হয় আমি খারাপ স্বামী তাহলে আমার সাথে বিয়ে রাখার দরকার নেই।

ফুয়াদ এক প্রকার জোর করে এশার মুখে খাবার তুলে দিয়ে বলল,

-আমাকে বিশ্বাস করতে দ্বিধা হচ্ছে। ভাবছো আমি হয়ত আবারও নিখোঁজ হয়ে যাবো। তোমার এই অবিশ্বাস তৎক্ষণাৎ দূর করে দেওয়া তো সম্ভব না। তবে একটা প্রস্তাব দেই তোমাকে। এই এক সপ্তাহ আমি তোমাকে একটুও ছুঁবো না। তুমি যে ভয়াবহ খোঁটা দিয়েছো আমাকে! যেদিন তোমাকে লন্ডন নিতে পারবো সেদিন আবার নতুন করে ফুলসজ্জা করবো।

এশার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়াচ্ছে। অনেকক্ষণ যাবৎ এই কান্না চেপে রেখেছিল। কেন কাঁদছে তা সঠিকভাবে গুছিয়ে ভাবতে পারছে না।

-এগুলো চোখের জল নাকি অভিমানের বরফ গলা পানি? তা হলে বেশি করে কাঁদো। যাওয়ার আগে যেন একবার জড়িয়ে ধরে যেতে পারি।

কতদিন পর পেট ভরে খেল এশা! যার সঙ্গে বিয়ে রাখবে না বলে তীব্র অভিমান নিয়ে দুর্বিষহ দিন কাটিয়েছে, তার হাতেই খেল! মানুষের মন কত বিচিত্র!

খাওয়া শেষে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই গলগল করে বমি করে দিলো এশা। সমস্ত বমি পড়লো ফুয়াদের গায়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় ফুয়াদ বিমূঢ় হয়ে গেল,

-তুমি কি গলায় আঙুল দিয়ে ইচ্ছে করে আমার গায়ে বমি করলে?

এশাকে চূড়ান্ত বিব্রত দেখালো। ও মুখ চেপে রেখে বলল,

-না, আমি ইচ্ছে করে করিনি। দুঃখিত।

ফুয়াদ দ্রুত বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বলল,

-কোনো ব্যাপার না। তুমি তোমার রাগ, ক্ষোভ, অভিমান যেভাবে খুশি ঝাড়ো। আমার শরীরে ছু*রি দিয়ে আঘাত করলেও কিছু বলবো না। ইউ আর এলাওড টু ডু এভরিথিং।

ফুয়াদ একেবারে গোসল সেরে বের হয়ে দেখলো এশা বিছানার এক কোণে জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে। কয়েকবার ডেকে বুঝলো ঘুমিয়ে পড়েছে।

যে মেয়ে এখানে আসতেই চায়নি। বাধ্য হয়ে এসে আবার সঙ্গে সঙ্গে চলে যেতে চেয়েছে। ফুয়াদ জোরজবরদস্তি করে আটকে রাখলো! তা নিয়েও কিরকম প্রতিক্রিয়া করলো। সেই মেয়ে এইটুকু সময়ের মধ্যে কত নিশ্চিন্তে এখানে ঘুমিয়ে পড়েছে। মেয়েদের মন বুঝতে পারা এত কঠিন ব্যাপার!

এশার এখানে কোনো জামাকাপড় নেই। ফুয়াদের এখন প্রথম কাজ হলো ওর জন্য জামাকাপড় কিনে আনা। ঘুম থেকে উঠে গোসল করার জন্য জামাকাপড় না পেলে আবার ওর গায়ে বমি করে দিতে পারে।

ফুয়াদ বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বলল,

-এশা, বোকা সুন্দরী! মুঘল সম্রাজ্ঞী নূর জাহান। আমি একটু বের হচ্ছি।

এশা ঘুমে তলিয়ে আছে। ফুয়াদ বাসা বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে বেড়িয়ে পড়লো।

মেয়েদের জামাকাপড় কেনার কোনো অভিজ্ঞতা নেই ফুয়াদের। দোকানদার যা ভালো বলেছে তাই নিয়ে চলে এসেছে। বাসায় ফিরে দেখলো এশা সামনের রুমে বসে আছে। সদ্য বোধ হয় ঘুম ভেঙেছে।

-একটু কষ্ট করে দেখবেন প্লিজ আপনার গায়ে ঠিকঠাক হয় কিনা!

এই বলে বসতেও পারলো না ফুয়াদ। এর ভিতর কলিংবেল বাজে। এই বাসায় কে আসবে?

পলি বেগম এসেছেন। তিনি বাসার ভিতরে ঢুকলেন না। দরজার সামনে দাঁড়িয়েই কোনো ভূমিকা ছাড়া বললেন,

-কালকে বাসায় যাবে। তোমার তেজওয়ালা বউকেও নিয়ে আসবে। তোমাদের সবার সঙ্গে আমার কথা আছে। তোমার বাপকে গ্রাম থেকে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে এনেছি। তোমাদের জন্য যেন পুলিশ পাঠাতে না হয়!

বড়লোকের বিরাট পুলিশি কারবার! তারা ডাকলেই পুলিশ হাজির! এগুলো কি ভাড়া করা নকল পুলিশ? কি মারাত্মক কাণ্ড! এশা আড় চোখে তাকিয়ে থাকে।

(চলবে)

#ইসরাত_জাহান_তানজিলা