এই ভালো এই খারাপ পর্ব-০৮

0
97

#এই_ভালো_এই_খারাপ ( কপি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
#পর্ব_৮
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

কাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছিলো। ঘুমটাও বেশ ভালো হয়েছে তিথির। অবশ্য স্বামী সোহাগ পেলে সেদিন ঘুম এমনিতেই ভালো হওয়ার কথা কিন্তু তিথির ঘুম বেশি ভালো হয়েছে ফাটাকেষ্ঠর হাসি দেখে। বিয়ের পর হয়ত এই প্রথমবার সে ফাটাকেষ্ঠকে হাসতে দেখেছে। যারা হঠাৎ করে হাসে তাদের হাসি দেখলে মনে হয় এত সুন্দর দৃশ্য আর হতেই পারে না।

লোকটা সচারাচর হাসে না। তিথির সাথে একদমই না। শৈশব থেকেই একটা কড়া নিয়মের মধ্যে বড় হওয়া আজলান শেখ হয়ত এমন এলেবেলে, অগোছালো, উচ্ছৃঙ্খল মেহবুবা মাহনূরের মতো মেয়েকে জীবনসঙ্গী হিসেবে চায়নি। হয়ত চেয়েছে একজন ফিটফাট, গোছালো, সুশৃঙ্খল, শান্ত-ভদ্র, সংযমী, টিপটপ, গোলগাল গোছের সংসারী মেয়ে। যে হাসবে, কাঁদবে, কথা বলবে কিন্তু তার আওয়াজ ঘরের বাইরের মানুষের কানে যাবে না।
যাকে বকলে রাগ করবে, অভিমানে হয়ত গাল ফুলাবে, বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদবে। বিনিময়ে হাজারটা আবদার করবে। সেখানে তারও রাগ ভাঙানোর সুযোগ থাকবে কিন্তু উল্টো চেঁচামেচি করবে না।
যার প্রতিটা কাজ হবে নিখুঁত। যার হাতের ছোঁয়ায় ঘরের প্রতিটি আনাচকানাচ হয়ে উঠবে ঝকঝকে তকতকে।

কিন্তু সেই জায়গায় মেহবুবা মাহনূরের মতো এমন বাচাল, চঞ্চলমতি, দুরন্ত, ঠোঁটকাটা, উচ্ছৃঙ্খল, অগোছালো মেয়েকে দেখে পাগলপারা দিশেহারা আজলান শেখ একের পর এক বিস্মিত হচ্ছিলো তখন মেহবুবা মাহনূর তাতে আরও তেল মশলা যোগ করে দিল নিজের বোকামি দ্বারা।

আজলান শেখ চুপচাপ তার কাজ, চলনবলন দেখছিলো প্রথম দিন থেকেই। চোখের সামনেই যেন নিজের একটা বিপরীত প্রতিবিম্ব দেখতে পাচ্ছিলো সে। পিতার উপর রাগ চেপে চুপচাপ ঘরের বধূকে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে বিয়ের পরের দিনই তার বৈপরীত্য টের পেল সে।

হিসেব নিকেশ করে, গুছিয়ে কথা বলা আজলান দেখলো, তার বধূর প্রনাউন্সিয়েশন ঠিকঠাক নেই, লাগামহীন প্রকাশভঙ্গী, কনসিডারেশন লেভেল জিরো, ম্যানার্স আয়ত্ত করেনি। সবাইকে নিজের মতো করে ভেবে নেয়। সবাইকে তার নিজের ভাষায় বুঝাতে চেষ্টা করে।

শুধু তাই নয় আজলান দেখলো তার বিয়ে করে আনা নতুন বধূ একটা শাড়ি খু্ঁজতে গিয়ে সবকটা কাপড়চোপড় এলোমেলো করে তারমধ্যে বসে আছে। এমনকি তার আইরন করা সব কাপড়চোপড় বিছানায় পড়ে আছে এলোমেলো হয়ে।

যেখানে লেভেন্ডার, রোজিব্রাউন, ট্যান, অলিভ, ধূসর ইত্যাদি ইত্যাদি শীতল রঙগুলোর শাড়ি আর সেলোয়ার-কামিজ এনে ভরিয়ে দিয়েছে আজলান শেখ সেখানে তিথির পছন্দ টকটকে লাল, কমলা আর হলুদ সবুজ রঙের পোশাক।

হাজারটা পছন্দ, অপছন্দের ভীড়ে আজলান শেখের কাছে তিথির ভেজা চুলে মুখ ডুবিয়ে আদর করাটা পছন্দের হলেও চুল বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানিতে ভিজে যাওয়া ব্লাউজের পিঠ একদম অপছন্দ কিন্তু সেই অপছন্দের কাজটাই যেন তিথির ভারী পছন্দের। ভালো করে চুল না মুছে তোয়ালে ছাড়িয়ে নেয়াটা তার একটা বাজে অভ্যাস।

মাথার একগাদা লম্বা চুলগুলো না আঁচড়ে মোচড়াতে মোচড়াতে রমলা চাচীর মতো উঁচু করে বেঁধে রাখাটা যেখানে তিথির পছন্দ আর স্বস্তি সেখানে তার চুলের বেণীতে গেঁথে দেয়ার জন্য আজলানের আনা ফুলের জায়গা হয়েছে জালানার ওপাশে।

বিয়ের দু’দিনের মাথায় তিথির পিরিয়ড দেখা দিয়েছে। পিরিয়ডকালীন সময়ে সে আজলানের ধারেকাছে আসেনি। বিয়েতে আসা এক মুরব্বি নাকি তাকে বলেছে, ওইসব হলে তারা স্বামীর আশপাশে যেত না। মাটিতে শুঁতো। তিথি আশেপাশে আসা তো দূর। জরুরি কাজে ডাকলেও আভিরাকে দিয়ে বলে পাঠালো, তোমার মামাকে বলবে আমি নাপাক, নাপাক।

তোতা পাখির মতো হুবহু নকল করে আভিরা এসে সেটা বলাতেই আজলান স্তব্ধ। একটা নর্মাল বিষয়কে সে নাপাক নাপাক বলে ঘৃণা ধরিয়ে দিয়েছে। তারপর থেকে আজলান তাকে বিছানায় আর ডাকেনি। না ডাকায় সে আরেক রাগ। সুস্থ হওয়ার পর বিছানায় বসে নাক টানতে টানতে বলল, ” আমি ভালো হয়ে গেছি। ”

আজলান বলল, ” হোয়াট? ”

তিথি বলল, ” মানে এখন ওসব শেষ। ”

” কোনসব? ”

তিথি বলল, ” ওইসব আর কি। নাম ধরলেও ঘৃণা লাগে আমার। ”

আজলান বলল, ” আউট। তুমি ওখানেই থাকবে। ”

তিথি কেঁদেকেটে রেগেমেগে দু তিনরাত মেঝেতে শুয়েছে। তারপর এক ঝড়ের রাতে বজ্রপাতের শব্দে ভয় পেয়ে বিছানায় উঠে বরের বুকে গুঁজে যেতেই যখন আরাম পেল আর নামেনি। আজলানের ঘুমন্ত মুখটার উপর আলতো হাতে চড়াতে চড়াতে বলল, “ছেলেদের ওগুলো হয় না জানি। অন্যকিছুও হয় না? ”

আজলান জবাব দিল। ” হয়। ”

তিথি ইয়াকক বলে একলাফে দূরে যাবে তক্ষুণি খপ করে ধরে তাকে নিজের জিম্মায় নিয়ে নিল আজলান। বুকের নীচে চাপা দিয়ে বলল, ” বউ থাকলে কিচ্ছু হয় না। না থাকলে হয়। ঘুমাও তো ডিস্টার্ব না করে। ”

তিথি ফিসফিস করে বললো, ” ওগুলোকে স্বপ্নদোষ বলে মদন। ”

তা শুনে আজলান তাকে সোজা ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। পরে আবার মায়া লাগলো কান্না শুনে। ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে আনলো ঠিকই কিন্তু মেঝেতে ঘুমাতে হয়েছে তিথিকে। ওখানে ঘুমাতে ঘুমাতে সে বড়ো দুঃখ নিয়ে কেঁদে বললো,

” ওহ এজন্যই তুমি অত পারফিউম ইউজ করো। বুঝি বুঝি সব বুঝি। ”

আজলান রাগ করে কয়েকটা দিন একদম কাছে ডাকেনি তাকে। তিথি তাও শোধরালো না। নিজ থেকে উঠে এল না। উল্টো বললো,

” তুমি সুস্থ হলে আমাকে ডেকো। বর ছাড়া ঘুম আসে নাকি? ”

আজলান দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলো সে হাসবে নাকি কাঁদবে। নাকি এই মেয়েকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেবে।

চলমান….