এই ভালো এই খারাপ পর্ব-৩১ এবং শেষ পর্ব

0
267

#এই_ভালো_এই_খারাপ #পর্ব_৩১
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

আয়জার বিয়ের ঝামেলা চুকে যাওয়ার পর আজলান তিথিকে খুঁজছে। আয়জার বিদায় বেলায় মেয়েটা কেঁদেকেটে একসা করেছে। এরকম অবুঝ মেয়েমানুষ নিয়ে সংসার করা যায়? “তুমি কেন কাঁদছো” জিজ্ঞেস করতেই রেগে গিয়ে বলল,

“তুমি পাষাণ ভাই হতে পারো। আমি পাষাণ ভাবি নই। আমার বোন নেই। ও আমার বোন হয়ে উঠেছিল। তুমি আমাকে হাসতে বারণ করতে পারো। কাঁদতে বারণ করতে পারো না।”

আজলান কোনোমতে সরে পড়েছিলো। এখন কোথায় গেল? আম্বিয়া বেগম তাকে এদিকওদিক ঘুরঘুর করতে দেখে বলল,

“ডোডোর মাকে খুঁজছিস নাকি?”

আজলান বলল,”হ্যা। ওই ডোডোকেও দেখতে।পাচ্ছি না তাই।”

আম্বিয়া বেগম বললেন,”তোর মেঝ ফুপুর ঘরে দেখলাম সবার সাথে বসে গল্পগুজব করছে।”

আজলান অবাক কন্ঠে বলল,”মেঝ ফুপুর ঘরে?”

“হ্যা তাই তো।”

আজলান আর কথা না বাড়িয়ে মেঝ ফুপুর ঘরে গিয়ে দেখলো তিথি ডোডোকে কোলে নিয়ে বড় ফুপুর পাশে বসে গল্প করছে। মেঝ ফুপুও উপস্থিত সেখানে। কারো চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না গতকাল এখানে যুদ্ধ চলছিলো। সে আফসোসের সহিত মাথা দুলিয়ে চলে এল ঘরে। তিথি কিছুক্ষণ পর ডোডোকে নিয়ে হাজির হলো। ডোডোকে বলল,

“কোমরটা ব্যাথা হয়ে এল আমার। তুই মা ছাড়া কিচ্ছু বুঝিস না ডোডো?”

আজলান ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। ডোডো তার মায়ের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। তিথি বলল,

“আরেহ ব্যাটা হাঁ করে কি দেখছিস? তোর দাদা দেখে পছন্দ করে ছেলের বউ করে নিয়ে এল। তোর বাপ এক বাচ্চার মা বানিয়ে দিল। কিছুদিন পর তুই আমাকে শ্বাশুড়ি বানাবি। এখন আর মুখ দেখে কি করবি? তুই কি বড় হবি না? তোর আর ভাইবোন লাগবে না? আমি কি তোকে কোলে নিতে হাঁটতে হাঁটতে বুড়ি হয়ে যাব?”

আজলান ধমকে উঠে বলল,”ননসেন্স ও কিছু বোঝে এসবের?”

ডোডো এবার আজলানের দিকে তাকিয়ে হাত ঝাপটাতে লাগলো। আজলান তাকে কোলে নিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

“তুমি এক্ষুণি এই ভারী শাড়ি ছাড়ো। সুতির কাপড় গায়ে দাও। ঘেমে ভূত হয়েছ।”

তিথি সোজা ওয়াশরুমে চলে এল। সেলোয়ার-কামিজ গায়ে দিয়ে বেরিয়ে এসে বলল,

“আয়জা চলে যাওয়ার পর আমার একটুও ভালো লাগছেনা আফিষাঁড়।”

আজলান বলল,”ঘুমিয়ে পড়ো।”

“না, ঘুমাবো না। চলো কোথাও বেড়াতে যাই। রাস্তায় হেঁটে আসি। মকবুল চাচার দোকান থেকে দু প্লেট ফুচকা খেয়ে আসি। চলো।”

আজলান বলল,”মাথা খারাপ? কোথাও যেতে পারব না। আয়জাকে দেখতে যেতে হবে।”

তিথি বলল,

“আমাকেও নিয়ে চলো।”

“তুমি কাল যেও।”

ডোডো ঘুমিয়ে পড়ায় আজলান তাকে শুইয়ে দিল। গালে কয়েকটা চুমু খেয়ে বলল,

“মেহবুব শোনো।”

তিথি দৌড়ে এল। আজলান বলল,”এবার শুয়ে পড়ো ওর পাশে।”

তিথি শুয়ে পড়লো। আজলান মা ছেলের গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দিয়ে বলল,

“এবার ঘুমাও।”

তিথি বলল,”আচ্ছা।”

সে চোখ বুঁজলো। আজলান ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে বাইরে চলে গেল। বাড়িটা সত্যিই নীরব হয়ে গেছে। আফতাব শেখ জানালেন,

“আজ আর ওই বাড়ি যাচ্ছি না। কাল সকালে তুমি তোমার বউ নিয়ে বোনের শ্বশুরবাড়িতে যাবে।”

আজলান শেখ বলল,”চিরকাল আপনার কথায় মানতে হয়েছে।”

আফতাব শেখ বললেন,”এজন্যই তুমি ভালো একটা বউ পেয়েছ।”

আজলান বলল,”তা অবশ্য মানতে হবে।”

আফতাব গর্ব করে বললেন,”জীবনে যাই করো এই মেয়েকে কখনো হেয় করে কথা বলবে না। সে সব বোঝে। বুঝেও না বুঝার ভান করে অপর মানুষটিকে যাচাই করার জন্য।”

আজলান বাইরে বেরিয়ে গেল। ঘন্টাখানেক বাইরে হাঁটাহাঁটি করে ঘরে এসে তিথিকে চুপিসারে ডেকে বলল,

“মেহবুব চলো বাইরে যাই।”

তিথি ঘুম থেকে উঠে তার এমন আহ্লাদেপনা দেখে বলল,”ঢঙের কথা বলার সময় পায়নি। রাত কটা দেখেছ?”

আজলান তাকে জোর করে তুলে দিল। বলল,”ডোডো ঘুম থেকে উঠার আগেই চলে আসবো।”

তিথি বলল,”না বাপু। আমি আমার বাচ্চাকে ফেলে কোথাও যাব না।”

আজলান বলল,”ওকেও নিয়ে যাব।”

তিথি খুশি হয়ে বিছানা থেকে নামলো। বলল,”শাড়ি পড়বো?”

আজলান বলল,”ওই আকাশি রঙেরটা পড়ো।”

তিথি বলল,”ওটা পড়লে আমাকে কালো লাগে।”

আজলান একটু রেগে বলল,”রাতের আঁধারে সবাই কালো। চুপচাপ পড়ো। ডোডো উঠে যাবে।”

তিথি বলল,”ওকেও একটা পাঞ্জাবি পড়িয়ে দেব?”

“দরকার নেই।”

তিথি শাড়ি পড়তে লাগলো। কুঁচি ধরতে ধরতে বলল,”একটু সাহায্য করো।”

আজলান বিরক্ত হয়ে এগিয়ে গেল। শাড়ির কুঁচি ধরতে ধরতে বলল,

“একটা শাড়িও পড়তে জানো না তুমি।”

তিথি বলল,”আমি আমার বরটাকেও পড়তে জানিনা।”

আজলান এতে কিছুটা চমকালো। কিন্তু অত মাথা ঘামালো না। তিথি শাড়ি পড়া শেষ করে মাথায় সাদা মালা পড়তেই ডোডো কেঁদে উঠলো। তিথি ছুটে গিয়ে তাকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে বলল,

“ওই গুলুমিয়া তুই দেখি হেব্বি বজ্জাত। তোর মা বাপকে একটু ভালো সময় কাটাতেও দিস না। ঘুমা চুপচাপ।”

আজলান দাঁত চিবিয়ে বলল,”হোয়াট ইজ গুলুমিয়া?”

তিথি ফিক করে হেসে ডোডোর গালে চুমু খেতে খেতে বলল,”আমার বাপ। আমার কইলজ্যা। আমার জামাইয়ের একমাত্র আবিষ্কার।”

আজলান আরও রেগে গেল। তিথি হাসলো। তিথি লিপস্টিক দেখিয়ে দিল। আজলান তার কথামতো লিপস্টিক নিয়ে এসে ঠোঁটে পড়িয়ে দিতে দিতে বলল,

“আহা নড়চড় করো না তো।”

তিথির ঠোঁট একে অপরের সাথে লাগিয়ে প্পাহ প্পাহ শব্দ করে ডোডোর গালে চুমু দিতেই লিপস্টিকের দাগ বসে গেল। আজলান চাপা স্বরে হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,

“এটা কি করলে?”

তিথি ফিক করে হেসে বলল,
“আদর দিলাম। সব তুমি নেবে নাকি?”

আজলান বলল,”আচ্ছা ওকে রেখে দাও। চলো।”

তিথি বলল,”না। ওকে রেখে যাব না। আমার বাচ্চা ভয় পেয়ে কেঁদে উঠবে।”

আজলান ডোডোকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে দুপাশে বালিশ রেখে বলল,”চুপ। চলো।”

বাইরে বাতাস বইছে। আকাশের অবস্থা ভালো না। যেকোনো সময় ঝড়ো হাওয়া বইবে। আকাশ ভাঙবে, বৃষ্টি ঝড়বে।

আজলান তিথির হাত ধরে বাইরে নিয়ে এসেছে। আকাশের এমন অবস্থা দেখে সে তিথিকে নিয়ে ঘরে চলে এল। তিথি বলল,”কি হলো?”

আজলান দরজা বন্ধ করে দিল। তিথি তেড়ে এসে বলল,”খেলবো না। তুমি আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে বলেছিলে। বাইরে কি সুন্দর আবহাওয়া। না না খেলবো না। ভন্ড লোক কোথাকার। মিথ্যে বলেছ কেন?”

আজলান ঘরের জানালা খুলে দিয়ে বলল,”ওই দেখো আকাশের অবস্থা কেমন। মনে হচ্ছে এক্ষুণি কেঁদে দেবে।”

তিথি রাগে শাড়ির আঁচলে লিপস্টিক মুছে ফেলেছে। আজলান লিপস্টিক নিয়ে তাকে জানালার পাশে টেনে এনে বলল, “মেহবুব তুমি না খেললেও আমি খেলবো। লিপস্টিক পড়ো।”

তিথি ঠোঁট বাড়িয়ে দিল। আজলান লিপস্টিক পড়িয়ে ঠোঁটের কোণায় তীর্যক হাসির রেখা টেনে বলল,”অন্ধকারে সবাই কালো। তুমি একটু বেশিই।”

তিথির মন খারাপ হয়ে এল আকাশের মতো। সে আজলানকে সরিয়ে দিয়ে বলল,”না না আমার মন খারাপ করে দিয়েছ তুমি। এভাবে লোভ দেখানো ঠিক হয়নি। তারমধ্যে বলছো আমি কালো। এসব ঠিক না।”

আজলান তাকে তার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে বলল,”ওই দেখো বৃষ্টি হচ্ছে।”

তিথি দেখলো। আজলানের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,”ভিজতে ইচ্ছে হচ্ছে গো। চলো না।”

আজলান তার কোমর পেঁচিয়ে ধরে গালে নাক ঠোঁট ঘষে চুমু খেয়ে বলল,

“এত বেশি কথা বললে এক্ষুণি জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দেব।”

তিথি চুপ করে রইলো। পুরুষালী ঠোঁটের চুম্বনে গোটা মুখটা ভিজে উঠতেই তিথি ফিক করে হেসে ফেলে বলল,”আমার চরিত্রহীন বেডামানুষ।”

আজলান ভীষণ খেপে গেল। এইসময় কেন এসব কথা বলতে হবে? এক বাচ্চার মা হয়ে এখনো জানেনা কোথায় কি বলতে হবে। সে তিথিকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “তোমাকে আদর করার চাইতে ঘুমানো ভালো।”

তিথি তার গলা জাপ্টে জড়িয়ে ধরে ফরসা গালে ছোট্ট ছোট্ট চুমু দিয়ে লিপস্টিকের ছাপ বসিয়ে দিতে দিতে বলল,

“মেহবুব! তোর জামাই একটা লাল কুমড়াপটাশ।”

আজলান বলল,”কি অবস্থা করেছ আমার?”

তিথি বলল,”ধুর ব্যাটা, তোমাকে আদর করার চাইতে ঘুমানো ভালো।”

বলেই সে চলে যাচ্ছিলো। আজলান পেছন পেট জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে চেপে ধরতেই তিথি খিলখিলিয়ে হেসে উঠে বলল,

“আব্বারে তোমার গোলামের ফুতের গায়ে রাতের শয়তানটা ভর করছে আবার।”

আজলান তাকে সামনে ফিরিয়ে বলল,”এক্ষুণি লিপস্টিকের দাগ মুছবে। এক্ষুণি।”

তিথি বলল,”চলো চলো বৃষ্টিতে ভিজবো। বেশিদূর যাব না।”

আজলানকে নিয়ে বেরিয়ে এল সে। আজলান সদর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। তিথি একদৌড়ে বাইরে বের হয়ে ঘুরতে ঘুরতে বলল

“আফিষাঁড় এত সুন্দর বৃষ্টি আমি আগে দেখিনি।”

আজলান বলল,”জ্বর হলে সর্দি মুছতে এসো আমার বুকে!”

তিথি দুহাত মেলে ঘুরতে ঘুরতে বলল,”

“আফিষাঁড় আমার এত খুশি লাগছে কেন?”

আজলান তার কাছে দৌড়ে এল। বলল,”তুমি পাগল? এভাবে চেঁচাচ্ছ কেন? আস্তে বলো।”

তিথি এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। আজলান বলল “হয়েছে এবার চলো।”

তিথি বলল,”জ্বর হোক।”

আজলান বলল,”না না চলো।”

তিথি থামলো না। আজলান তাকে পাজাকোলা করে তুলে নিয়ে বলল,

“মাথা খারাপ করবে না মেহবুব। জ্বর হলে আমাকেই সামলাতে হবে।”

তিথি চুপ করে রইলো। তার হঠাৎ কান্না পাচ্ছে। সে তো এমন একটা স্বপ্ন দেখেছিলো। যাকে সে ভালোবাসবে তার সাথে বৃষ্টিতে ভিজবে। কিন্তু এই ব্যাটা তাকে ভিজতে দিল না কেন আরেকটু?

আজলান তাকে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
“একি তুমি কাঁদছো কেন?”

তিথি কাঁদতে কাঁদতে বললো,”আমি এমন বৃষ্টি আগে কখনো দেখিনি।”

আজলান বলল,”আর কি দেখোনি?”

তিথি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,

“এমন তোমাকেও।”

সমাপ্ত….