এই মন তোমাকে দিলাম পর্ব-৩০+৩১

0
427

#এই_মন_তোমাকে_দিলাম
#পর্ব-৩০
#আরাদ্ধা_সাদাত_খান
রাজনীতি সব মানুষ করতে পারে না।মন্ত্রী কিংবা নেতা হওয়ার জন্য দরকার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং পর্যবেক্ষণ।তাদের চোখ কান খোলা রেখে চলতে হয়,নইলে বেশি দিন টিকে থাকা সম্ভব নয়।
তারিফ সাহেব ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি করে আসছেন।কত শত হামলার শিকার হয়েছেন! এরপর প্রেমে পড়লেন।বিয়ে করলেন। আল্লাহর রহমতে দুই বাচ্চার বাবা হলেন। এবং এখন সময়ের গন্ডি পেরিয়ে নানা হলেন।
ছেলে-মেয়েদের সাথে যথেষ্ট ফ্রিলি মিশেছেন তিনি ও জয়া।তাই বাচ্চাগুলো কখনোই তাদের কাছে কিছু লুকোয়নি। এমনকি সায়নের যখন আরিশার সাথে রিলেশন ছিলো, তখনও বাড়ির সবাই সব জানতো।
আবার হতে পারে বাবা-মায়ের কোনো বিশেষ ক্ষমতা আছে। ছেলে মেয়েদের মুখ দেখলেই তারা সব বুঝতে পারে।
রূপন্তীকে তিনি কিংবা জয়া কখনো ছেলের বউ হিসেবে দেখেননি, মেয়ে হিসেবে দেখেছেন।সেখান গত দুদিন ধরে রূপন্তীর হাফভাব দেখে দুজনেরই মনে হয়েছে মেয়েটা কোনো সমস্যায় ভুগছে। এতটা আনমনা রূপন্তী নয়।স্বামী স্ত্রী আলোচনা করে ঠিক করলেন তারিফ সাহেব কথা বলবেন রূপন্তীর সঙ্গে।

সন্ধ্যায় যখন সবাই অনুষ্ঠানের আলোচনায় মত্ত, তারিফ সাহেব তখন রূপন্তীকে ওনার স্টাডি রুমে চা দিয়ে যেতে বললেন। সীমন্তী তখন বলে উঠলো,
– আব্বু, ওর তো হাত পোড়া। আমি নিয়ে আসছি।
রূপন্তী বাঁধা দিলো।সে পারবে। তারিফ সাহেব চলে গেলেন।তানিয়া এসে এক কাপ চা রূপন্তীকে দিলো।রূপন্তী সেটা নিয়ে হাটা দিলো স্টাডি রুমের দিকে।
.
তারিফ সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে তীর্যক দৃষ্টি স্থাপন করলেন রূপন্তীর।রূপন্তী এতে একটু মিইয়ে গেলো। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলো,
-কিছু বলবেন বাবা?
তারিফ সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে শুধালেন,
– তোমাকে আমি সায়ন-সীমন্তীর মতোই মনে করি। আমার আরেকটা মেয়ে এসেছে এই বাড়িতে।এখন আমি তোমাকে যেই অধিকারে স্নেহ করি,একই অধিকারে তোমাকে শাসনও করতে পারবো।তুমি বিপদে পড়লে তোমার ঢাল হয়ে দাঁড়ানো আমার কর্তব্য।তুমি জানো নাকি জানি না। তবে তোমার বাবা আমার খুব কাছের একজন মানুষ ছিলেন। এখন তোমার আপন বাবা না থাকলেও আমি আছি। নির্বিঘ্নে নিজের সমস্যা আমার কাছে তুলে ধরবে।এত ক্ষমতা দিয়ে যদি নিজের ছেলেমেয়েদের সমস্যার সমাধান করতে না পারি, তবে আমি মন্ত্রী নয় একজন পিতা হিসেবে ব্যার্থ!
একটু থেমে আবার যোগ করলেন,
– আমার হাত অনেক দূর মা! তোমাদের মুভমেন্টের ব্যাপারে আমি সবই জানি।গত তিন দিন ধরে তোমাকে খুব ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করেছি।এত মিষ্টি একটা মেয়ের এমন ফ্যাকাশে চেহারা ভালো লাগে না।আমি অনেকটুকু নিজে খবর নিয়ে বুঝেছি এবং তাফসি মামনির কাছে শুনেছি।এখন আশা করি একটাও সিঙ্গেল ইনফো বাদ না দিয়ে তুমি আমাকে পুরো ঘটনা বলবে।

রূপন্তী গভীরভাবে দম নিলো।অতঃপর বলতে শুরু করলো,
“দেশে আসার পর এতিমখানায় যাওয়ার পর আমার রিমির সাথে পরিচয় হয়।মেয়েটা খুবই মায়াবী।যে কেউ তাকে স্নেহ করতে বাধ্য। সারাদিন এতিমখানায় আমার সাথেই থাকলো।ফেরত আসার সময় আবদার করলো আমি যাতে তাকে ঢাকায় নিয়ে আসি। তার আঠারো বছর হতে বেশি দিন নেই।আমিও মানা করিনি। ফেরত আসার পর বিয়ে হয়ে গেলো।কিছুদিন খবর নিতে পারিনি। এরপর থেকে মাদারের কাছ থেকে খবর নিতাম।আমি সপ্তাহে একদিন ভুলতার ওইদিকে চেম্বার করি। সেখানেই এক গার্মেন্টসে ওর জন্য চাকরি পাই। কিছু দূরেই মেয়েদের একটি হোস্টেলও আছে।সব ভালোই মনে হলো।নভেম্বরের দিকে ওকে নিয়ে আসলাম।ওকে গার্মেন্টস এ ঢুকিয়ে দিলাম।নারায়নগঞ্জ সরকারি কলেজে ভর্তি করিয়ে দিলাম।নিজে গিয়ে হোস্টেলে উঠিয়ে দিলাম। সব ঠিকঠাকই চলছিলো।এক শনিবারে ওকে নিয়ে লাঞ্চ করার সময়ই ও ঘটনাটা বলল।গার্মেন্টস এর মালিক যে সে বিদেশে থাকে।দেশ ছাড়ার পর গার্মেন্টস থেকে অর্জিত লাভটুকু বাদে সে আর কোনো মাথা ঘামাতো না।গার্মেন্টসটা অনেক বড় এলাকা নিয়ে।সেই জমিটাই রাফি এহমাদ দখল করেছে। গার্মেন্টস মালিকও এই নিয়ে একটাও টু শব্দ করেনি। এই গার্মেন্টসটাতে সব মহিলা কাজ করতো।বেশিরভাগ যুবতী। রাফি এহমাদে মাঝে মধ্যে এসে হুংকার ছাড়তো।দুই একটা মেয়ের উপর নজর পড়লে তাদের ধরে নিয়ে যেতো।কেউ কিছু বলতোনা।ভয়ে!এমনই একদিন সবাইকে শাসাতে এসেছে আর রিমি প্রতিবাদ করেছে। উনার মুখে থুথু ছিটিয়ে বলেছে মরে গেলেও তারা এই গার্মেন্টস ছাড়বে না।রাফি এহমাদ সেদিন শান্তভাবে চলে গিয়েছে।এতটুকু পর্যন্ত রিমি আমাকে সেদিন বলেছিলো।মেয়েটাকে নিয়ে আমি সেদিন থেকেই প্রচুর ভয় পেতে লাগলাম।পরেরদিনই সে ফোন দিয়ে জানালো ওদের সবাইকে এসে বের করে দিয়ে গেটে তালা লাগিয়ে দিয়েছে। আমি একজন লয়ার নিয়ে পরের শনিবার গেলাম।কিন্তু কাজ হলো না। যেখানে মালিকের কোনো মাথা ব্যাথা নেই সেখানে আমরা কি করতে পারি! সেদিন রাতেই একজন পেশেন্ট এলো।রিমি!খুবই ব্রুটাল ভাবে মারা হয়েছে।মেয়েটা মারা যাওয়ার আগে খালি একটা কথাই বলেছে, “ওরা আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে।” আমি বসে থাকতে পারিনি। এতিম হলেও ওর বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। কেস দিলাম।পুলিশটাকে মারা হলো। কক্স থেকে এসে আরো পাওয়ারফুল লয়ার হায়ার করলাম।রাফি এহমাদকে ডিএনএ টেস্ট করিয়ে এরেস্ট করা হলো।তবুও সে জেলের ভেতর থেকেই এসব করছে। সামনের সপ্তাহ প্রথম শুনানি।

তারিফ সাহেব পুরোটা মন দিয়ে শুনলেন।তারপর জিজ্ঞেস করলেন,
– রায়ানের ব্যাপারটা তো তোমার সাথেও হতে পারে।
– আমাকে আপাতত ভয় দেখাতে চাচ্ছে। চাচ্ছে আমি যাতে মাথা নত করে নেই। আমি আপনাদেরকে নিয়ে ভয় পাচ্ছি।সবচেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছি সায়নকে। আপনারা তাও গার্ডের মাঝে থাকেন। সায়ন একদম একা চলাফেরা করে।
তারিফ সাহেব ছেলের বউয়ের কথায় ছেলের জন্য ব্যাকুলতা দেখে হালকা হাসলেন।অতঃপর “চিন্তা করো না” বলে রূপন্তীকে পাঠিয়ে দিলেন।
.
আজ পাঁচ দিনের মতো হয়েছে রূপন্তীরা ঢাকায় ফিরেছে। ফিরে আবার সেই একই রুটিনে তাঁদের দিন যাচ্ছে৷
এই কয়দিনে রূপন্তীর নিকট আরো হুমকি এসেছে। সে পাত্তা দেয়নি।তবে আজ সন্ধ্যা থেকে সে চিন্তায় বুঁদ হয়ে আছে। কারন তার কাছে একটা ম্যাসেজ এসেছে,
– বুঝলাম, নিজের স্বামীকে তুমি একদমই ভালোবাসো না।

আজ শুক্রবার ছিলো।সায়ন সকালেই বেরিয়েছে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে।এখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়েছে, তবুও তার দেখা নাই।অস্থির হয়ে তাকে পুরোনো স্বভাবটাই বেছে নিতে হলো।হাত সিগারেট নিয়ে বারান্দায় গেলো।এই বিচ্ছিরি অভ্যাস তার অস্ট্রেলিয়ায় থাকতে হয়েছে।তবে এখন খুব কম খায়।সিগারেট ধরানোর আগে সে সায়নকে কল দিলো খোঁজ নিতে।এই কয়েকদিন রূপন্তী ওর সাথে একটু দূরত্ব বাড়িয়েছে।কথা বলেনি ঠিকঠাক।কল দিতেই সায়ন জানালো রাস্তায় একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। আসছে সে।
রূপন্তী একটা দম ফেললো।নাহ!ব্যাপারগুলো আর হালকা ভাবে নেওয়া যাবে না!
সিগারেটটা ধরাবে তার আগেই এক পেশেন্টের কল এলো।তার সাথে কথা বলতেই বলতেই আধ ঘন্টা কেটে গেলো।
অবশেষে সিগারেটটা ধরালো।তার দুই মিনিট এর মাথায় সায়ন এলো। রূপন্তীকে খুঁজতে খুঁজতে বারান্দায় এসে তাকে সিগারেট খেতে দেখে অবাকের শেষ মাত্রায় চলে গেলো।কেননা রূপন্তীর চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে।
সায়ন আজ আর সহ্য করলো।রূপন্তীকে শক্ত করে নিজের দিকে ফিরিয়ে কঠিন কণ্ঠে বলল,
-এতদিন কিচ্ছু বলিনি।আজ তুই নিজের সমস্যা না বলা পর্যন্ত ছাড়া পাবি না।
– ছাড়!কিছু হয়নি। আমাকে একটু একা থাকতে দে।
– উহু।আজ না বলা পর্যন্ত ছাড়বো না। আশ্চর্য!সমস্যা না বললে সমাধান করবো কিভাবে?
– লাগবে না সমাধান!তুই কয়দিনের জন্য চলে যা।আমার একদম এক থাকা দরকার!

দুজনই ত্যাড়া।সায়ন যখন বাড়াবাড়ি রকমের জোরাজোরি করতে লাগলো তখনই রূপন্তী ভয়ানক কাজটা করে বসলো।সায়নে ডান গালে জোরে একটা চড় মেরে চিৎকার করে বলল,
-ডোন্ট ইউ ডেয়ার টু ইন্টারফেয়ার ইন মাই পার্সোনাল লাইফ।চলে যা। এক্ষুনি।
সায়ন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিয়ৎক্ষন। এরপর আস্তে করে বারান্দা থেকে চলে গেলো।
রূপন্তী দেয়াল ঘেষে বসে পড়লো।হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।ছেলেটা তাকে একা ভালোবাসে না।সেও অনেক ভালোবাসে।সায়নের কিছু হলে তার একমাত্র দ্বায়ী সে হবে।তাছাড়া সায়নের কোনো ক্ষতি হওয়া মানে তার বুকে আঘাত লাগা।কি করবে সে? কি করবে? সায়ন প্রচন্ড জেদী। একবার এই ব্যাপারে জানলে সে মাঠে নামবেই। এর ফলে হতে পারে মৃত্যু!

রুমে যখন এলো তখন রাত বারোটা। পুরো বাসা খালি। সায়ন সত্যিই চলে গেছে। রূপন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেললো।সায়নকে কিভাবে ফিরাবে তার জানা নেই।অবশ্য তার আগে সে মরেও যেতে পারে!
কাল আবার ঢাকার বাহিরে যেতে হবে।শোয়ার সময় এলার্ম দেওয়ার জন্য ফোন হাতে নিতেই সায়নের মেসেজ চোখে পড়লো,
“সবাই সবকিছুর জন্য যোগ্য হয় না, এটা আমি ভুলে গিয়েছিলাম।প্যারা নেই। এখন থেকে মনে রাখবো।স্পেস চাচ্ছিস, দিলাম।কিন্তু আমার কসম রূপু,নিজের কোনো বিপদ ডেকে আনবি না।তোর কিছু হওয়া মানে আমার মরণ। যত যাই হোক,পরিশেষে ভালোবাসি,ভালোবাসি,ভালোবাসি!”
#চলবে।

#এই_মন_তোমাকে_দিলাম
#পর্ব-৩১
#আরাদ্ধা_সাদাত_খান
“গাড়ির চাবি ড্রয়ারে আছে। আমার সাথে রাগ করে গাড়ি না নিয়ে যাস না”
এটা দ্বিতীয় ম্যাসেজ ছিলো।যে কেউ লেখাগুলো পড়লে এর মধ্যে লুকিয়ে থাকা তীব্র ভালোবাসাটুকু বুঝবে। সাথে মাপতে পারবে কথাগুলোর পিছুন লুকিয়ে থাকা সুপ্ত অভিমানের পাল্লা।
.
পরেরদিন রূপন্তী প্রথমে নিজের হসপিটালে গেলো।এরপর সেখান থেকে দুপুরের পর নারায়নগঞ্জ গেলো।নারায়নগঞ্জের এই হাসপাতালে আসলেই তার বুকটা হাহাকার করে উঠে।
যাওয়ার সাথে সাথে একটা ও.টি এসিস্ট করতে হলো।এরপর পেশেন্ট লিস্ট দেখে মাথায় বাজ পড়লো।মানুষ ইদানীং এত অসুস্থ হয়!রাত দশটার দিকে দুজন লোক এসে তার কেবিনে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলো।রূপন্তী ভ্রূ কুঁচকে তাকাতেই একজন করুণ গলায় বলে উঠলো,
– ম্যাম, আমার মেয়েটার জ্বরে গা ফেটে যাচ্ছে। সাথে বমি।এত খারাপ অবস্থা যে ডাক্তার নিতে আসতে হলো।আপনি একটু আমার মেয়েটাকে দেখবেন?
– কবে থেকে জ্বর?
– আজ সকাল থেকে।
– টেম্পারেচার কত?
– আমি আসার আগে ১০৪ এর বেশি ছিলো।
– আচ্ছা, একটা ইঞ্জেকশন এর নাম দিচ্ছি। কিনে নিয়ে যান। আমি এসে পুশ করে দিবো।আপনাদের ঠিকানা আর ফোন নাম্বার আমার এসিস্ট্যান্ট এর কাছে দিয়ে যান।আমার আর পাঁচটা পেশেন্ট আছে।তাদের দেখেই আসছি।
ওনারা দুজন চলে গেলো।
রূপন্তী বাকি পেশেন্ট দেখা শেষ করে যেতে পারলো না।একটা ও.টি করতে হলো।ও.টি রুম থেকে বের হতেই তাকে জানানো হলো ওই লোকটা আবার ফোন দিয়েছে।তখন বাজে সাড়ে এগারোটা। ঠিকানা হাসপাতালের দারোয়ানের কাছ থেকে বুঝে নিয়ে সে রওয়ানা দিলো।
রাস্তা-ঘাট শুনশান। বাড়িটাও ভেতরের দিকে।রূপন্তীর একটু গা ছমছম করলেও সে পাত্তা দিলো না।
সে বাড়িটাতে পৌঁছালো বারোটার দিক।আশেপাশের বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলেও এই বাড়ির সবাই উদ্বিগ্ন চেহারা নিয়ে বসে আছে।যেই মেয়েটার জ্বর তার বয়স বেশি হবে না।১৪/১৫ হবে। অনেক জ্বর।রূপন্তী আগে ইঞ্জেকশন দিলো।সিম্পটম দেখে ডেঙ্গু মনে হচ্ছে।শীতকালে ডেঙ্গু! কি দিন আসলো!
কয়েটা ঔষধ আর টেস্টের নাম লিখে দিলো।মেয়ের মাকে বলল ওকে ভেজা কাপড় দিয়ে মুছিয়ে দিতে।
সব শেষ করে যখন সে বের হবে তখন সাড়ে বারোটারও বেশি বাজে।আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে সে রওয়ানা দিলো।দুই পাশে ক্ষেত, মাঝখানে রাস্তা।
সরু রাস্তা ছেড়ে একটা বড় রাস্তায় উঠে কিছুদূর এগোতেই তার বুক ছলাৎ করে উঠলো।
সামনে তিনটা গাড়ি দাঁড়ানো। তিনটে গাড়ি ঘিরে বেশ কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। একেকজনের হাতে একেক অস্ত্র।রূপন্তীর বুঝতে দেরি হলো না এদের উদ্দেশ্য।ঠান্ডা মাথায় ভাবলো কি করা যেতে পারে। ওরা যথেষ্ট দূরে এখনো।রূপন্তী তাই গাড়ি ঘুরাতে চাইলো। কিন্তু পারলো না।তার আগেই গাড়ির টায়ার কিছু এসে বিধতেই সেটা শব্দ করে ফেটে পরলো।তার কাছে কোনো অস্ত্রও নেই।

লোকগুলো দ্রুত কাছে আসলো।গাড়ির দরজা লক করা ছিলো।জানালা ভেঙে ভেতর থেকে আনলক করে দরজা খুলে রূপন্তীকে টেনে বের করলো।
রূপন্তী চোখ তুলতেই দেখতে পেলো কয়েক জোড়া চোখ তার সারা শরীরে নজর বুলাচ্ছে।সারা শরীর ঘিনঘিন করে উঠলো।যে ওর চুল মুঠ করে ধরে রেখেছে সে তখন বলে উঠলো,
– এই মা* নাকি স্যাররে জেলে ঢুকাইসে।এখন নিজেরে বাঁচাবি কেমনে কু*ত্তি?
বাকিরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।তাদের মাঝে একজন বলে উঠলো,
– স্যার,বড় স্যাররে তো কালকে-পরশুর মাঝে ছাইড়া দিবো।আগে বড় স্যার খাক, তারপর আমরা খাইয়া লাশ ফালায়া দিমু।এখন এইডারে বাঁইধা রাখি।
স্যার নামক মানুষটা রূপন্তীর দিকে তাকিয়ে এবার জিজ্ঞেস করলো,
– কিরে?!কেস উঠাবি নাকি আমাদের হাতে নিজের ইজ্জত দিবি?
রূপন্তী কিছুই বলল না।তার বদলে একদলা থুথু ছুড়ে মারলো ওই লোকের মুখে।
লোকটা সাথে সাথে রূপন্তীর গালে একটা থাপ্পড় মারলো।
– বে* তোরা গলা আমি আজই নামায় দিবো।কু*ত্তি কোথাকার!এই রামদাটা দে কেউ।
রামদাটা নিতে যাবে তার আগেই সবাই খেয়াল করলো দূর থেকে গুটি কয়েক হেডলাইটের আলো দেখা যাচ্ছে।গাড়ি গুলো খুব দ্রুত আসছে।
রূপন্তীকে টেনে হিচড়ে ওরা গাড়ির দিকে আগাবে তার আগেই পরপর ছয়টা গাড়ি এসে থামলো।তারপর প্রায় বিশজন মানুষ বেরিয়ে এলো বন্দুক হাতে।
এক মিনিটের মাথায় গোলাগুলি শুরু হলো।গোলাগুলির মাঝেই মাত্র আসা লোকগুলো থেকে একজন এসে রূপন্তীকে সরিয়ে নিতে লাগলো।কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।
রূপন্তীর হঠাৎ মনে হলো তার ডান কাঁধে তীক্ষ্ণ কিছু এসে বিঁধেছে। স্পর্শ করতেই ভেজা ভেজা অনুভন হলো।হঠাৎ করে তার চারপাশ অন্ধকার হয়ে এলো।
.
– হ্যা, আব্বু বলো।
– কোথায় তুমি?
-ফাহাদের বাসায়।
– ওকে নিয়ে জলদি তুমি নিজের হাসপাতালে যাও। ওটি রেডি করো।তোমার সিনিয়র কাউকে ফোন দিয়ে আসতে বলো।আধঘন্টার মাঝে সব রেডি করো।
– কিন্তু কি হয়েছে? কার অপারেশন করা লাগবে?সিনিয়র দরকার নেই, আমিই পারবো।
– যেটা বলছি সেটা করো।আমরা আসছি।

মনটা অস্থির হয়ে উঠলো।কে আসবে? বাবাই বা কেনো তাকে অপারেশন করতে মানা করছে?
এসব ভাবতে ভাবতেই সে নিজের প্রিয় এক স্যারকে কল করলো।আসতে রিকোয়েস্ট করলো।হাসপাতালে ফোন দিয়ে ও.টি রেডি করার কথা জানিয়ে দিলো।এরপর ফাহাদকে সাথে নিয়ে বের হয়ে গেলো।
এই ও.টি সে ই এসিস্ট করবে। তাই ও.টি ড্রেস পড়ে সেও রেডি হয়ে ও.টি রুমে চলে গেলো।স্যারও চলে এসেছেন।
নার্সরা সহ সব ঠিকঠাক করা সময় পেশেন্ট চলে এলো।রুমে এনে স্ট্রেচার ওদের সামনে রাখতেই সায়ন স্তব্ধ হয়ে গেলো।
এমন ভয়ংকর অবস্থা কিভাবে হলো!ডান কাঁধ থেকে শুরু করে পুরো বুক রক্তে ভেজা।গালে পাঁচ আঙুলের দাগ। ঠোঁটের কোণায় শুকনো রক্ত।
সায়নের হাত পা কাঁপতে লাগলো। ডক্টর ইতিমধ্যে ওকে অনেক রকম কাজ দিচ্ছে। সায়ন কিচ্ছু শুনতে পেলো না।”আমি এই ও.টি করতে পারবো না” বলতে বলতে সে ও.টি রুম থেকে বের হয়ে এলো।বাইরে ইতিমধ্যে তার পরিবারের সকলে দাঁড়ানো।ফাহাদ গেছে চেঞ্জ করতে।রোগী হিসেবে রূপন্তীকে দেখতেই ও বুঝে গিয়েছিলো সায়ন এই ও.টি করতে পারবে না।তাই আর দেরি করেনি।চেঞ্জ করে এসে সে সায়নের দিকে তাকালোও না।ডিরেক্ট ও.টি তে ঢুকে গেলো।

সায়ন তারিফ সাহেবের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ভেজা কণ্ঠে বলল,
– কি হয়েছে আব্বু?আমি কেনো কিছু জানি না?ওর এই অবস্থা কিভাবে হলো?
তারিফ সাহেব ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।ছেলের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
– এখন এসব জানা লাগবে না বাবা।আগে রূপন্তী সুস্থ হোক।

সায়ন এবার বাচ্চা ছেলেদের মতো তারিফ সাহেবকে জড়িয়ে ধরলো।বাবার বুকে মুখ গুঁজে কেঁদে দিলো।তারিফ সাহেব ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারলেন না।এখন তিনি কোনো ক্ষমতাশীল মন্ত্রী নন।এখন তিনি একজন সাধারণ পিতা।যে কিনা এখন নিজের ছেলেকে বুকে নিয়ে সামলাচ্ছেন।
#চলবে।