#এই_মন_তোমাকে_দিলাম
#পর্ব-৩৪
#আরাদ্ধা_সাদাত_খান
সারাদিন অনেক আড্ডা দেওয়া হলো।আজ আর কোনোদিকে যায়নি।সুগন্ধা বিচে গিয়েছিলো।সেখান থেকে দুপুরে এসে নেমেছে পুলে।এরপর যে যার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আবার লাঞ্চ করতে বেরিয়েছে।লাঞ্চ শেষে একটা টং দোকান থেকে চা খেয়ে মেয়েরা ঠিক করলো শাড়ি পড়বে।আরাদ্ধা বেশ কয়েকটা শাড়ি এনেছে। সায়রা আর আরহাও এনেছে।রূপন্তী যেকোনো একজনের কাছ থেকে নিয়েই পড়তে পারবে।
দিন ছোট। মেয়েগুলোর সাজগোজ শেষ করতে করতেই দিন শেষ হয়ে গেলো।তবুও সূর্য ডোবার আগ মুহুর্তে সবাই বিচে গিয়ে সিংগেল থেকে শুরু করে কাপল,গ্রুপ সব ভাবে ছবি তুললো।
সন্ধ্যার পর সবাই একটা রেস্টুরেন্টে বসলো নাস্তা করার জন্য। অর্ডার দেওয়া শেষ হলে মুগ্ধ বলে উঠলো,
– আচ্ছা গাইস! বি রেডি!আগামী ৭মার্চ সেনাকুঞ্জে আমাদের রিসিপশন হবে। তোদেরকে আর কার্ড দিবো না।ভালো মানুষের মতো চলে আসিস।
সায়ন আর রূপন্তীর চোখাচোখি হলো।ইশারায় কথা বার্তা শেষ করে সায়ন হালকা গলা খাকাড়ি দিয়ে বলল,
– ইয়ে দোস্ত…
– কিছু বলবি?
সায়ন এবার সবার দিকে তাকিয়ে বলল,
– আগামী আঠাশ তারিখ আমাদের রিসিপশন।আব্বু মনে হয় আইসিসিবিতে বুকিং কনফার্মও করে ফেলেছেন।
আরহা চোখ বড় বড় করে বলল,
– আঠাশ তারিখ মানে? এই মাসের আঠাশ তারিখ?
রূপন্তী মিষ্টি হেসে মাথা নাড়লো।
সবাই আবার হইহই করে উঠলো।ওদের দুজনকে প্রথমে কয়েকটা গালি মারলো।তারপর ঠিক করলো কি কি করবে। একটা হলুদের অনুষ্ঠান তো মাস্ট।আরাদ্ধা তক্ষুনি চাচ্চুকে ফোন দিয়ে এই কথা বলল।তারিফ সাহবের কোনো কিছুতেই কোনো দ্বিমত নেই। বাচ্চারা যেভাবে আনন্দ করতে পারবে সেভাবেই সব করবে। সাথে সাথে ঠিক হয়ে গেলো ছাব্বিশ তারিখ হলুদ করবে। এখন শেষ মুহুর্তে কোনো সেন্টার খালি পাবে না, তাই ঠিক হলো হলুদ সায়নদের বাড়িতেই করা হবে।
রূপন্তী আর সায়ন আপাতত নীরব শ্রোতা। বাকিরা সবাই ব্যাস্ত প্ল্যানে। ঠিক হলো আটজন মিলেই ওদের সব শপিং করবে। হলুদের অনুষ্ঠানের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব আরহানের।ওর কোন এক ফ্রেন্ড আছে, তাকে দিয়ে করাবে।রিসিপশনে রূপন্তী লেহেঙা না পড়ে শাড়ি পড়তে চাচ্ছে।
শাড়ির দায়িত্ব সায়রা নিয়ে নিলো।যদিও হাতে সময় কম,তবুও সে চেষ্টা করবে নিজের ডিজাইনের একটা শাড়ি করে দেওয়ার।
তাহলে হলুদের কেনাকাটা,সায়নেত কেনাকাটা, আর বাকি প্রাসঙ্গিক জিনিসপাতি কিনতে ওদের কয়েক ভাগে বের হতে হবে।যেহেতু সবাই ব্যাস্ত নিজেদের চাকরি নিয়ে।
.
সন্ধ্যার নাস্তা করে সবাই আবার বিচে গেলো।কালকে সকালে সবাই চলে যাবে। তাই বলতে গেলে সবাই রাতের সমুদ্রকে বিদায় দিতে গেলো।
ঘোরাঘুরি শেষে হোটেলে আসলো সবাই রাত সাড়ে নয়টার দিকে। কেউই আর ডিনার করবে না।ঠিক হলো আগামীকাল ভোরে সবাই সূর্যোদয় দেখতে যাবে।
বিদায় নিয়ে যে যার রুমে চলে গেলো।
রূপন্তী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গয়নাগাটি খুলছে।ঠিক সেই সময় সায়ন পিছন থেকে রূপন্তীকে জাপ্টে ধরলো।পিঠের অনাবৃত অংশে ঠোঁটের চাপ দিতে দিতে মোহগ্রস্ত কণ্ঠে বলল,
– তোকে আজ অনেক সুন্দর লাগছিলো।
রূপন্তী ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
– ধন্যবাদ।
সায়ন এবার ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে মিশিয়ে ধরলো।ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,
– তুই সুস্থ হয়েছিস না?
– তাই তো মনে হয়!
সায়ন আর দেরি করলো না। ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে কোলে তুলে বিছানার দিকে এগোলো। রূপন্তী যতক্ষন কিছু বলবে ততক্ষনে খেয়াল করলো তার পড়নের শাড়ি ইতিমধ্যে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সায়ন ততক্ষনে ভয়ানক রকমের অস্থির হয়ে গেছে।
রূপন্তী তাকে আটকালো চূড়ান্ত মূহুর্তে। “আমার পিরিয়ড চলে সায়ন!”
নিচু কণ্ঠে কথাটা শুনতেই সায়ন পেটিকোটের ফিতা থেকে হাত সরিয়ে আনলো।তবে নিজের পুরো অস্থিরতা মিটালো রূপন্তীর নরম ঠোঁটের মাঝে।
এরপর বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লো।রূপন্তী উঠে দাঁড়ালো।লাগেজ থেকে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলো।ও আসার পর সায়নও ফ্রেশ হয়ে আসলো।দুজনই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।রূপন্তী কাছে এসে ওর বুকে মাথা রেখে বলল,
-এতদিন অনেকবার এপ্রোচ করেছিলাম।তুই ই আসিস নাই!
– তোর শরীর দূর্বল ছিলো।আমার ভালোবাসা নিতে পারতো না।
– তুই এত ওয়াইল্ড?!
– পরে টের পাবি।
– কিন্তু আমি একটা ডিসিশন নিয়েছি।
– কী?
-যেহেতু এখনো বাসর করতে পারলিনা।একদম বাসর রাতে বাসর করিস। ততদিন পর্যন্ত চুমুও বাদ।
সায়ন আৎকে জিজ্ঞেস করলো,
– মানে কী?
– মানে হচ্ছে আমি এত সহজে তোর কাছে ধরা দিবো না।
বলেই সায়নের কাছ থেকে সরে আসতে চাইলো।কিন্তু সায়ন চেপে ধরলো রূপন্তীকে নিজের সাথে। কঠিন গলায় বলে উঠলো,
– কি বলতে চাস সোজাভাবে বল।
রূপন্তী স্বাভাবিক গলায়ই বলে উঠলো,
– বিয়ের পর পর আমার সাথে কত্ত খারাপ ব্যবহার করতি মনে আছে?শুধু তোকে জড়িয়ে ধরতাম বলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিস।অথচ তুই জানতি আমি ইচ্ছ করেই তোকে জড়িয়ে ধরতাম।
শেষ কথাটা বলতে গিয়ে রূপন্তীর গলা ধরে এলো।সায়ন ব্যাকুল হয়ে ওকে নিজের সাথে আরো মিশিয়ে ধরলো।অস্থির কণ্ঠে বলে উঠলো,
-সরি তো সোনা! আর ওগুলো তো পাস্ট!সেসব মনে করে প্রেজেন্ট কেনো নষ্ট করবি?
– সেই ঘটনাগুলো আমার মনে দাগ কেটে গিয়েছে।আর আমি শুধু সেটার জন্য বলছিনা।মাঝে মধ্যে দূরত্ব থাকা ভালো।তাতে আমি তুই দুজনই নিজেদের ভালোবাসার গভীরত্ব মাপতে পারবো।দেখবি এত অপেক্ষার পর যখন একজন আরেকজনকে পরিপূর্ণভাবে পাবো,আমাদের আত্মা অন্যরকম এক তৃপ্তিতে উদ্বুদ্ধ হবে।
– কিন্তু তোকে ছাড়া তো আমার ঘুম হয় না।
– বেশি না তো।মাত্র উনিশ দিন। এবার বলতে পারিস আমি প্রতিশোধ নিচ্ছি।আই প্রমিস এটাই শুরু এবং এটাই শেষ। আমার দ্বারা আর কোনো প্রকার কষ্ট পাবি না।তবে তোর দ্বারা যদি আমি কোনো কষ্ট পাই, আমি অনেক দূরে চলে যাবো।
সায়ন কিছু বলল না।পারছে না মেয়েটাকে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলতে।যদি জানতো মেয়েটা একসময় জীবন হয়ে যাবে, তাহলে কখনোই তখন অবহেলা করতো না।
.
বুলেট ট্রেনের গতিতে সময় যাচ্ছে। আজ পঁচিশ তারিখ। কালকে হলুদ। এই কয়দিনে সবার মোট সাতবার বের হতে হয়েছে শপিং করতে।যদিও শেষের দিকে রূপন্তী খালি আরহাকে নিয়ে কিংবা আরাদ্ধাকে নিয়ে বের হয়েছে। সায়ন সাহায্য নিয়েছে নিজের অন্যান্য বন্ধুদের।
আজ সবাই সাভারের দিকে যাচ্ছে।রওয়ানা দিতে হয়েছে রাত দশটার দিকে।কেননা হাসপাতালে প্রচুর চাপ ছিলো।
কক্সবাজার থেকে এসে সত্যিই রূপন্তী সায়নের কাছে ধারে ঘেষে নাই।তাছাড়াও দুজনেরই চাপ প্রচুর বেড়ে গিয়েছিলো।এপ্রিল মাসে একটা কোর্স এন্ট্রেন্স এর পরীক্ষা আছে। আরাদ্ধা,রূপন্তী, ফাহাদ,সায়ন,মুগ্ধ, পাঁচজনই এই পরীক্ষা দিবে।
তাই দেখা যাচ্ছে হসপিটালে থেকে এসেও বিশ্রাম নেয়ার বদলে খাওয়া দাওয়া করে পড়তে বসতে হয়েছে।
সায়ন আজ আশায় ছিলো অন্তুত রূপন্তীর গা ঘেষে ঘুমুতে পারবে। কিন্তু বাড়ি গিয়ে টের পেলো ঘরের মানুষই আসল শত্রু।
সীমন্তী নিজের জামাইকে সায়নের কাছে পাঠিয়ে রূপন্তীকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছে। সায়নের মুখটা মলিন তো হলোই,সাথে রায়ানএর মুখটাও এত্তটুকু হয়ে গেলো।বউ ছাড়া থাকা যে কত কঠিন সেটা সব বিয়াইত্তা পোলারা জানে।
পরেরদিন সকাল থেকেই আত্বীয় স্বজন সবাই আসতে শুরু করলো।তাদের ফ্রেন্ড গ্রুপও চলে এলো।ইতিমধ্যে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের লোকেরা ছাদ সাজানো শুরু করে দিয়েছে। অনুষ্ঠান ছাদে হবে।
রূপন্তীকে জয়া বেগম সায়নের সব আত্মীয়দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।রূপন্তীও খুব সুন্দর মতো সবার সাথে মিশে গেলো।
দুপুরের পর থেকেই রূপন্তীকে সাজানো শুরু হলো।একটা কমলা আর হলুদের মিশ্রণের শাড়ি বাংলা ভাবে পড়িয়ে দেয়া হলো। সাজগোজ রূপন্তী নিজেই করলো।চুল বেঁধে দিলো সীমন্তী।
কাঁচা ফুলের গয়নাতে ওকে একটা ফুলের বাগান মনে হচ্ছিলো।এত মোহনীয় লাগছিলো!
সন্ধ্যার পরপরই অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেলো।সায়নের গায়ে সাদা পাঞ্জাবী।রূপন্তীকে দেখে তার হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে এলো।
যখন ওদেরকে আলাদা ফটোশুট করার জন্য নিয়ে যাওয়া হলো তখন সে টুপ করে মেয়েটার কপালে একটা চুমু খেয়ে বসলো।রূপন্তীও বিনিময়ে একটা মিষ্টি হাসি দিলো।
কিছুক্ষনের মধ্যেই বন্ধু-বান্ধবরা, কাজিনরা নিজেদের নাচ-গানের মাধ্যমে অনুষ্ঠান জমজমাট করে তুললো।বর-বউ নিজেরাও নাচের ওস্তাদ।তাদের পার্ফমেন্সের সময় সবচেয়ে বেশি হইচই হলো।
উপস্থিত সকলে সেইরকম জমজমাট একটা রাত পার করলো সেইদিন।
#চলবে।
#এই_মন_তোমাকে_দিলাম
#পর্ব-৩৫
#আরাদ্ধা_সাদাত_খান
বহু অপেক্ষার পর সেই দিনটা চলে এলো।সকালে উঠে নাস্তা খেয়েই রূপন্তীকে নিয়ে ওর বান্ধবীরা বেরিয়ে গেলো।উত্তরায় একজন আর্টিস্টের কাছে রূপন্তীর বুকিং দেয়া আছে। বাকিরা কো-আর্টিস্টদের কাছে সাজবে।।
বিকেলের দিকে সায়নকেও রেডি করলো ওর বন্ধুরা।শার্ট প্যান্ট পড়ার পর দুলাভাইরা,অর্থাৎ রায়ান আর আরহান ওকে কোর্টটা পড়িয়ে দিলো।ওর গায়ের কোর্ট এর কালারটা কথায় বোঝানো যাবে না।খুবই ডার্ক ব্রাউন একটা কালার যেটা প্রথমে কালো মনে হলেও আসলে কালো না।শার্ট রূপন্তীর সাথে মিলিয়ে মভ কালার পড়েছে। ফাহাদ এসে হেয়ার ব্রাশ করে দিলো।জুতা-মোজা পড়ার পর সায়নকে পুরোই হার্টথ্রব লাগছিলো।যে কারো হৃদপিন্ড ছিনিয়ে নিতে পারবে সে।
সকলে মিলে বেরিয়ে পড়লো সেন্টারের উদ্দেশ্যে।
বর আসার বেশ অনেক্ষন পর বউ আসার তলব পড়লো।
কিন্তু বউকে গাড়ি থেকে নামতে দেওয়া হলো না।আগে বরকে সবাই একটা এন্ট্রি ড্যান্স দিয়ে ঢোকালো।এরপর বউকে আনা হলো।তাকেও সেই রকম ভাবে স্বাগতম জানানো।রূপন্তীকে স্টেজে আনার পর সায়নের চোখে পানি চলে আসলো।এত সুন্দর কেন লাগছে?!এবং রূপন্তীর হাত ধরে উঠানোর সময় সে সত্যি সত্যি কেঁদে দিলো।রূপন্তী তো হতভম্ব!আর বাকিরাও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
যদিও প্রচন্ড লজ্জা লাগছিলো,তবুও রূপন্তী সবার সামনে সায়নকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।বলুক মানুষ কটু কথা! তার তো জামাই। মানুষটার চোখের জল তার কেন সহ্য হবে?আর সেই চোখের জলের কারণ তো সে নিজেই।
ও জড়িয়ে ধরার সাথে সাথেই আশেপাশে হুলুস্থুল পড়লো।সায়নও চোখের পানি মুছে রূপন্তীর মাথা উঠিয়ে কপালে একটা চুমু খেলো।ফিসফিস করে বলল,
– মাশাল্লাহ!পরী একটা!
রূপন্তী সাথে সাথে লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।প্রতিটা মুহুর্ত ক্যামেরাবন্দি হলো।অতঃপর অনুষ্ঠান শুরু হলো।একে একে সবাই এসে পরিচিত হচ্ছে, ছবি তুলছে।সায়ন আর রূপন্তীর অবস্থা খারাপ।রূপন্তীর এমনেও শরীরটা সকাল থেকে খারাপ লাগছিলো।এরমধ্যে এত হুলুস্থুল। খাবার টেবিলে বসেও বেশি খেতে পারলো না।সায়ন জোরাজোরিও করলো না।মনে মনে ভাবলো বাসায় গিয়ে ভালোমতো খাইয়ে দিবে।
অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত সাড়ে বারোটা বেজে গেলো।এরপর অবশ্য বাসায় যেতে তেমন সময় লাগলো না।
সায়নের রুম ওর বন্ধুরা মিলে অনেক সুন্দর করে সাজিয়েছে। রূপন্তীকে আরাদ্ধা আর সীমন্তী মিলে রেখে আসলো।সায়ন আসতেই সবাই মিলে ধরলো।অনেক্ষন দরদাম চলল।শেষে বিশ হাজার টাকা দিয়ে সে রেহাই পেলো।
রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে পিছনে ফিরে বিছানার দিকে তাকাতেই তার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো।মেয়েটা কীরকম এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে পড়েছে? এগিয়ে এসে মুখের উপর ঝুঁকলো।কিরকম আদুরে যে লাগছে! ঠোঁট ডুবিয়ে গালে একটা চুমু খেতে চাইলো।কিন্তু আলতোভাবে ঠোঁট লাগাতেই সে আৎকে উঠলো।ঠোঁটটা মনে পুড়ে গিয়েছে।দ্রুত হাতে দিয়ে কপাল,গলা চেক করলো।শরীর পুড়ে যাচ্ছে!
গাল ঝাকিয়ে ডাকার চেষ্টা করলো,
– রূপু!এই রূপু!একটু আমার দিকে তাকা সোনা!
রূপন্তী চোখ গুলো আধো আধো ভাবে খোলার চেষ্টা করলো, পারলো না।ইতিমধ্যে সে অনেকটা অচেতন হয়ে গেছে।
সায়ন অস্থির হয়ে গেলো।তবুও ঠান্ডা ভাবে সব সামলানোর চেষ্টা করলো।বুকের ভেতরটা পুরো অস্থির হয়ে আছে। মেয়েটার উপর একটার পর একটা ফাড়া যাচ্ছে।
সবার আগে নিজে চেঞ্জ করে নিলো এরপর রূপন্তীর গয়নাগাটি খুললো।চুলে সেভাবে ক্লিপ মারা হয়নি। তাই তেমন একটা ঝামেলা হলো।
শরীর থেকে শাড়ি-ব্লাউজ সব খুলে দিলো। একটা বালতিতে পানি এনে তোয়ালে ভিজিয়ে স্পঞ্জ করতে লাগছে। গায়ের তাপ এত বেশি যে সায়নের এই শীতের মধ্যে গরম লাগছে। পাশে বসা যাচ্ছে না। রূপন্তীর মেকাপ রিমুভার দিয়ে মুখের মেকাপ উঠিয়ে দিলো। তারপর তোয়ালে দিয়ে মুখটা মুছিয়ে ওর লাগেজ থেকে একটা নাইটি বের করে পড়িয়ে দিলো।জ্বরটা যদি এক ফোঁটা কমতো!
আর কোনো উপায় না পেয়ে আরাদ্ধা আর সীমন্তীকে ডেকে নিয়ে আসলো।তার চোখে ইতিমধ্যে পানি ছলছল করছে। আরাদ্ধা বিরক্ত হয়ে একটা ঝাড়ি মারলো,
– ইদানীং এরকম কথায় কথায় চোখের পানি ফেলছিস কেন?বিয়ে কি তুই একাই করেছিস? নাকি দুনিয়াতে জ্বর খালি তোর বউরই হয়?
– তুই ই দেখ। মেয়েটা উপর পর পর একটা করে ঝড় যাচ্ছে।পানিতে পড়লো, গুলি খেলো, এখন আবার জ্বর!ওর সাথেই কেন এসব হচ্ছে?আমার সাথেও তো হতে পারে!ও একা কেন কষ্ট পাচ্ছে?!
আরাদ্ধা আর কিছু বলল না।ননস্টপ স্পঞ্জ করতে লাগলো।সীমন্তী সুপ বানিয়ে নিয়ে এলো।রূপন্তীকে দুই চামচ খাওয়াতেই গড়গড় করে বমি করে দিলো।সায়ন দ্রুত কোলে নিয়ে ওয়াশরুম থেকে মুছিয়ে নিয়ে এলো।ফাহাদকেও ইতিমধ্যে বলা হয়েছে। ও আর মুগ্ধ মিলে গেছে ঔষধ আনতে।আরহা আর সায়রাও এসে রূপন্তীর পাশে বসেছে। আরহান গিয়েছিলো রুমে রাখা এক্সট্রা কম্বল আনতে। ফেরত এলো আরাদ্ধা ফোন হাতে,
-আদ্ধা দেখ তো তোর ফোনে তখন তখন থেকে কল আসছে।
সাথে সাথেই ফোনটা আবার বেজে উঠলো।হাসপাতাল থেকে কল।আরাদ্ধা কথা কল রাখলো, সাথে সাথে ফাহাদ আর মুগ্ধ উদ্বিগ্ন মুখে ঢুকলো।ফাহাদ হড়বড় করে বলে উঠলো,
-খবর পেয়েছিস?! ঢাকার একটা বড় বস্তি পুড়ে ছাই! যে যেখানে আছে চলে যেতে বলেছে।
আরাদ্ধাও সায় জানালো। তাকেও এজন্যই ফোন দেয়া হয়েছে। হতাহতের সংখ্যা ইতিমধ্যেই অনেক। আল্লাহ মাফ করুক এটা যাতে আর না বাড়ে।
.
সায়নকে নিয়ে যেতে খুবই কষ্ট হয়েছে। সে রূপন্তীকে ছেড়ে যাবেই না।শেষমেশ নিজের পেশার প্রতি আর অবহেলা করতে পারেনি। নিজের নেওয়া শপথকে অমান্য করতে পারেনি।
মা আর বোনকে ভালোমতো সব বুঝিয়ে গেছে।
একটানা তিনদিন সব ডাক্তারদের অন ডিউটি থাকতে হলো।একবার এক হাসপাতালে দৌড়াতে হয়েছে।অনেক মানুষকে তারা বাঁচাতে পারেনি। বস্তিটা অনেক বড় একটা এলাকা জুড়ে ছিলো।এখন তো আবহাওয়া শুষ্ক। কয়েক সেকেন্ড লেগেছ আগুন ছড়িয়ে পড়তে।গরীব মানুষগুলো সারাদিন খাটা-খাটনি করে সবে দুই চোখ এক করেছিলো।কিন্তু সেই শান্তির নিদ্রা চিরনিদ্রায় পরিবর্তিত হবে কে জানতো?
আরাদ্ধারা টানা তিনদিন ডিউটি করে ছাড়া পেলো।একটা ট্র্যাজেডি ঘটে গেছে বলা যেতে পারে।তারা সবাই মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছে।দেখেছে মানুষকে ধুকে ধুকে মরতে।
ডিউটি শেষ করার পর সবাই ফ্রেশ হয়ে সাভারের উদ্দ্যেশ্যেই রওয়ানা দিলো।রূপন্তীর ডেঙ্গু ধরা খেয়েছে এটা সীমন্তী জানিয়েছে।
সায়ন এই কয়েকদিন একটা জিনিস খুব ভালোমতো টের পেয়েছে। রূপন্তী যতই হম্বি-তম্বি করুক,দিন শেষে মেয়েটার শরীর যথেষ্ট নাজুক।অনেক বেশি সেন্সিটিভ!এই কয়দিনে কি অবস্থা হয়েছে কে জানে!
বাড়ি ফিরে বউয়ের ধারে কাছে অবশ্য সে যেতে পারলো না।কারণ তাকি ঘিরে বাকিরা ভীড় জমিয়েছে।রূপন্তীর জ্বর একটু কমেছে৷ তবে শরীর অনেক দূর্বল।সীমন্তী আর জয়া পুরোটা সময় ওর সাথে ছিলো।সায়ন যহেতু কাছে যেতে পারলো না তাই জামাকাপড় নিয়ে গোসল করতে চলে গেলো।
বের হয়ে দেখলো পুরো রুম ফাঁকা।রূপন্তী বিছানায় হেলান দিয়ে তারই দিকে তাকিয়ে আছে।কাছে যাবে তার আগেই রূপন্তী ক্ষীণ কণ্ঠে বলে উঠলো,
– আগে খেয়ে আয়। তারপর এসে ঘুমাবি। যাহ!
ঠিক একই সময় সীমন্তী আসলো সায়নকে খাওয়ার জন্য ডাকতে।রূপন্তীকে কিছুক্ষন আগেই খাইয়ে দিয়ে গেছে।তাই সায়ন নিচে গিয়েই খেয়ে আসলো।এসে রুমের পর্দা টেনে দিলো,এরপর দরজাটা লোক করে শেষমেশ বিছানায় গা এলালো। রূপন্তী নিজেই এগিয়ে গিয়ে সায়নের সাথে মিশে গেলো।মেয়েটাকে আগলে ধরতেই সায়নের মনটা প্রশান্তিতে ছেয়ে গেলো।রূপন্তীর কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল,
– কতদিন ধরে দূরে সরিয়ে রেখেছিস হিসেব আছে?
– হুম।আচ্ছা হাসপাতালের খবর কী?কতজন মারা গেলো।
– মোট তিনশোজন থাকতো।এখন পর্যন্ত ৭৫ জন মারা গেছে। ১১৫ জন চিকিৎসারত
– ওহ।
– তোর শরীর কেমন? জ্বর আছে?
– হালকা।
আর কোনো কথা হলো না। সায়ন এক সময় রূপন্তীর ঠোঁটের খুব কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,
– ঠোঁটে একটা চুমু খাই?!
রূপন্তী বলতে চাইলো,” না, বমি করেছি।মুখে গন্ধ আর জীবানু.”
বলতে পারলো না। তার আগেই ঠোঁটজোড়া তীব্র আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলো।রূপন্তী নিজেও সাড়া দিতে দিতে মনে মনে একটা কথা বলল,”ওরে ব্যাটা!চুমু যেহেতু খাবিই তাহলে আর পারমিশন কিসের নেস?”
#চলবে।