এই সাঁঝবাতি পর্ব-০৬

0
15

#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব:০৬

আজ সাঁঝের ভীষণ মন খারাপ। কয়েকদিন ধরে উদাসীন দিন কেটেছে বলে নিজের দিকে নজর দেওয়া হয়নি। মন খারাপ ছিল অথবা খুব ব্যস্ত ছিল ব্যাপারটা এমন নয়। তবুও কীভাবে যেন বেখেয়ালি দিন কেটে গেল।

আজ দুপুরে ভাত ঘুমের পর ফ্রেশ হতে গিয়ে যখন হাতের দিকে চোখ পড়ল তখন দেখল, হাতের মেহেদীর রঙ উঠে গিয়েছে। এদিকে পুরো বাড়ি খুঁজে একটা মেহেদির টিউব খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেই থেকে সাঁঝের মাথা দপদপ করতে শুরু করেছে। রঙহীন হাত সাঁঝের পছন্দ নয়। যতবার নিজের ফ্যাকাশে হাতের দিকে চোখ পড়ছে, সাঁঝের মুখটাও অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।

বাবা এখনও বাড়ি ফিরেনি। কল দিয়ে একটা মেহেদি নিয়ে আসতে বললে নিশ্চয়ই নিয়ে আসবে। কিন্তু কল দেওয়ার জন্য মায়ের কাছে মোবাইল চাইতে হবে। সেই সাথে দর্শাতে হবে কারণ। সাঁঝ বাবার কাছে মেহেদির আবদার করতে কল দিতে যাচ্ছে জানামাত্র মায়ের বকুনি শুরু হয়ে যাবে। মেয়ের এই আহ্লাদী স্বভাব মোটেও পছন্দ নয় স্বর্ণলতার। মেয়ে মানুষের এতো কীসের রংঢং? এত কীসের বায়না?

অতিরিক্ত চিন্তায় সাঁঝ এ ঘর ও ঘর পায়েচারি করতে লাগল। ওর অস্থিরতা দেখে সাওদা বেগম বিরক্ত হয়ে গর্জে উঠলেন,

– এই ছেমড়ি, এত মোচড়ামোচড়ি করতাছ কেলা?

সাঁঝ মলিন মুখে দাদীর দিকে তাকালে সাওদা বেগমের রাগ পড়ে গেল। উনার বংশের এতগুলো ছেলেমেয়ের মধ্যে সাদিকের এই মেয়েটা হয়েছে সবচেয়ে সুন্দর। যেমন গায়ের রঙ, তেমনি মুখের আকৃতি। জগতের সমস্ত মায়া এসে জমা হয়েছে লম্বাটে চোখ দুটোয়। দিনদিন শরীর গড়ন বদলে ফুটে উঠছে নারী সুলভ আকর্ষণীয়তা।
সাঁঝ নিজেও বেশ সৌন্দর্য সচেতন মানুষ। সবসময় পরিপাটি হয়ে থাকে।

সাওদা বেগম পলকহীন চোখে পরীর মতো সুন্দর মেয়েটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। অতঃপর মুগ্ধতা ভুলে দোয়া পড়লেন যেন নাতনির নজর না লেগে যায়। কণ্ঠে আদর ঢেলে ডাকলেন,

– এইদিকে আইসা আমার পাশে বস। কিতা হইছে কানে কানে ক দেখি।

দাদীর আদরে সাঁঝ ঠোঁট ফুলিয়ে পাশে গিয়ে বসে করুণ সুরে জানাল নিজের দুঃখের কথা। সাওদা বেগম তার নড়বড়ে দাঁতের নিচে সুপারি, পান চিবিয়ে সাঁঝের কথা শুনলেন।

– তোর মায়ের মোবাইলটা দিয়া তোর বাপেরে একটা কল দে।

– মেহেদীর কথা শুনলে মা বকবে।

– ক যে আমি কল দিতে কইছি।

– উহু। তবুও আমাকে বকবে। তুমি বলো।

সাওদা বেগম উঁচু কণ্ঠে হাঁক ছাড়লেন,

– ও বউ, মোবাইলটা দিয়া যাও।

স্বর্ণলতা রাতের রান্নার আয়োজন করছিলেন। সেখান থেকে চিল্লিয়ে জানতে চাইলেন,

– মোবাইল দিয়ে কি করবেন?

– সাদিকরে কল দিমু। আমার পান শেষ হইছে।

– মোবাইলে ব্যালেন্স নাই।

– আমি কতা কইলে তুমাগো মোবাইলে ট্যাকা থাকে না! নিজেরা দিনভর ফোন কানে দিয়া ঘুইরা বেড়াও, তহন ট্যাকা উড়ে যায় না? আমার পোলা হাড়ভাঙা খাটুনি খাইরা ট্যাকা পাঠায়, আর এদিকে সেই ট্যাকা দিয়া ফুর্তি চলে। আমি চাইলে কয়, নাই! মনে করো আমি কিচ্ছু বুঝি না?

– কয় টাকা দেয় আপনার ছেলে ? ওই কয়টা টাকা দিয়ে কীভাবে সংসার চলে সেই খবর কেউ রাখেন? আপনার ছেলেকে বলব, পরের মাস থেকে মাসের টাকাটা আপনার হাতে দিতে। আপনি আমাকে হিসাব করে বাজার খরচের টাকা দিয়েন, আমি বাজার সদাই করে এনে আপনাদের খাওয়াবো।

– কি এমন মাছ-গোশত খাওয়াও আমারে, যে এত ট্যাকা লাগে? ওই তো শাকপাতা সিদ্ধ কইরা দেও। আমি বুড়া মানুষ, ওই দিয়া খাই। তাতেও খাওয়নের খোঁটা! পোলাপাইন মানুষ কইরা এমন দিন দেখমু ভাবি নাই! দুইবেলা খাইতে দিলেও এখন খোঁটা শুনতে হয় পোলার বউর কাছে! আল্লাহ, এই দিন দেখার আগে মরনটা দিয়া দিলা না ক্যান!

মা-দাদীর ঝগড়ার মাঝখানে বড্ড অসহায় বোধ করছে সাঁঝ। সামান্য এক কল দেওয়া থেকে ব্যাপারটা ঝগড়ার মোড় নিল! বরাবর এমনি হয়। মা-দাদীর আলোচনা প্রতিবার তুমুল ঝগড়ায় রূপ নেয়। এই ঝগড়া বাবা বাড়ি ফেরার আগ পর্যন্ত চলতে থাকে। বাবা ফিরলে দুইপক্ষ-ই বাবার কাছে নালিশ জানায়। সেসব কথা বাবা গম্ভীরমুখে শুনেন। তারপর ঠান্ডা মাথায় দুইজনকে বুঝিয়ে শুনিয়ে মীমাংসা করে দেন। পরদিন আবার সব ঠিক হয়ে যায়। আজও সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। শুধু মাঝখান থেকে রঙহীন থেকে যাবে সাঁঝের হাত। ভেবেই গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে সাঁঝের।

রাত দশটায় বাড়ি ফিরলেন সাদিক। বাড়ির পরিবেশ তখন ঝড় আসার পূর্বমুহূর্তের মতো ভয়াবহ শান্ত। সাঁঝের দুই ভাই সাভিন-সাবিল ড্রয়িংরুমের মলিন সোফা সেটে বসে নীরবে অংক কষছে। মাইর খাওয়া থেকে বাঁচতে মায়ের সাথে খাওয়ার টেবিল সাজাচ্ছে সাঁঝ। সাওদা বেগমের ঘরের দরজা খোলা। তিনি গম্ভীর মুখ করে খাটে বসে চেয়ে ছিলেন সদর দরজার দিকে। ছেলেকে দেখা মাত্র মুখখানা আরও গম্ভীর করে ফেললেন।

বাড়ির এমন থমথমে পরিস্থিতি আজ নতুন নয়। কিছু একটা হয়েছে আঁচ করতে সময় লাগল না সাদিকের। ঘরে প্রবেশ না করে ছেলেদের পাশে সোফায় বসে উদ্দেশ্যহীন প্রশ্ন ছুড়লেন,

– কিছু হয়েছে নাকি?

প্রশ্ন শুনে কারো মধ্যে হেলদোল দেখা গেল না। শুধু সাঁঝ এক গ্লাস পানি এনে বাবার হাতে তুলে দিল। গ্লাস হাতে নিয়ে সাদিক নিচু গলায় জানতে চাইলেন,

– দুজনে আবার ঝগড়া করেছে?

সাঁঝ নিঃশব্দে উপর নীচে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে দ্রুত ফিরে গেল মায়ের কাছে। এদিকে সাদিক পড়লেন বিপাকে। স্ত্রী ও মায়ের মধ্যে কার কাছে আগে যাওয়া উচিত, তাই নিয়ে দ্বিধায় ভুগছেন। গ্লাসে ধীরে ধীরে চুমুক দিয়ে সময় ব্যয় করছিলেন, তখনি সাওদা বেগম ডাক দিলেন।

– সাদিক? সাদিক এইদিকে আয়।

সাদিক একপলক স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আস্তেধীরে উঠে দাঁড়ালেন। স্বর্ণলতা অবশ্য কোনোদিকে তাকালেন না। নিজের মতো রান্নাঘর থেকে ডালের বাটি আনতে গেলেন।

সাদিক ঘরে প্রবেশ করা মাত্র সাওদা বেগম হাতের তজবিটা গুটিয়ে রেখে বললেন,

– সানা, সাবা দুজনরেই কল দে। কেউ একজন আইসা আমারে নিয়া যাক।

সাদিক মায়ের পাশে বিছানায় মুখোমুখি বসলেন। কপালের ঘাম পাঞ্জাবির হাত দিয়ে মুছে বললেন,

– কেন আম্মা? হঠাৎ মেয়ের বাড়ি যাবেন কেন?

– হঠাৎ না, আমার তো আগেই চইলা যাওয়া উচিত আছিল। তোর বউ আমারে ঘাড় ধইরা বাইর কইরা দেওনের আগেই, আমি নিজেই মান-ইজ্জতের সাথে চইলা যাই। তিন তিনটা পোলা মানুষ করছি, এই লাইগা? যেন শেষ বয়সে মেয়ের জামাইর বাড়ি গিয়া ঠাঁই নিতে হয়! আমার পোলারা তো একেকজন মহা ব্যস্ত। কারো সময় নাই। মায়ের মুখের দিকেও কেউ চায় না।

সাদিক মায়ের চামড়ায় ভাঁজ পড়া হাতটা পরম আদরে নিজের হাতে তুলে নিয়ে বললেন,

– কে আপনাকে আপনার বাড়ি থেকে বের করে দিবে? এটা আপনার বাড়ি। আমরা বরং আপনার বাড়িতে আশ্রিত।

– আমার কোনো কিছু না। তোগো বাপের সম্পত্তি তোগোরে দিয়া গেছে। তোরা রাজের হালে খাবি। আমারে সে গাঙ্গে ভাসায় দিয়া গেছে। কিছু দিয়া যায় নাই। মাথার উপরে ছাদ নাই, খাওয়নের ট্যাকা নাই। পোলার বউ আইজ খাওয়নের খোঁটা দেয়, কাইল ঘর থাইকা বাইর কইরা দেয়।

নিজের নামে এমন মিথ্যে অপবাদ শুনে স্বর্ণলতা আর স্থির থাকতে পারলেন না। ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়লেন,

– আমি কখন আপনাকে বের করে দিলাম?

– দেও নাই তো এখন দেও। খাড়ায় রইছো কেন? গলা ধাক্কা দিয়া বাইর কইরা দেও।

– আহ স্বর্ণ। তুমি আবার এখানে আসতে গেলে কেন? নিজের কাজে যাও।

স্বামীর এমন এক তরফা বিচারকার্যে বড্ড অভিমান হলো স্বর্ণলতার। নীরব চোখে এক আকাশ অভিমান নিয়ে স্বামীর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে স্বর্ণলতা ফিরে গেলেন। সাদিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

– আবার কি নিয়ে ঝামেলা বাঁধল, আম্মা?

– আমি ঝামেলা বাঁধাইছি?

– আমি কখন বললাম, আপনি বাঁধিয়েছেন? কি হয়েছে সেটা বলেন। বাইরে থেকে এসে এখনো হাত মুখে পানিও দেই নাই। বড্ড ক্লান্ত লাগতেছে।

ছেলের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে সাওদা বেগম ইস্তফা দিলেন। না হলে আজকে স্বর্ণলতাকে দেখে নিতেন। ফক্কিন্নির ঘরের ছাওয়াল তারে টাকার দেমাগ দেখায়।

– তোর বউরে কইলাম মোবাইলটা দিতে। তোরে একটা কল দিমু। সে জমিদারের মাইয়া মুখের উপর না কইরা দিল। আমি কি নিজের জন্য কিছু চাইতে তোরে কল দিতে চাইছি? মাইয়াটা সারাদিন মুখ আন্ধার কইরা ঘুরতাছে। সে মা হইয়া মাইয়ার দিক চায়া দেখে না। মাইয়াটা সারাদিন মেহেদী, মেহেদী করতেছিল। তোরে মেহেদী আনতেই তো কল দিতে চাইছি নাকি? তার জন্যে কতডি কথা শুনায় দিল আমারে।

ঘটনার সূত্রপাত শোনার পর আর কিছু জানার দরকার হলো না সাদিকের। নিজের মাকে সামলাতে নিচু গলায় তিনি কি কি বললেন, তা আর জানা গেল না।

এদিকে সাঁঝের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। দাদীর কথা শোনা মাত্র অ/গ্নি দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে মা। চোখ দিয়েই ভস্ম করে দিবে আজকে। সাঁঝ ভয়ে একবার মুখ তুলে মায়ের কঠিন মুখশ্রী দেখে আবার ঝট করে মাথা নিচু করে ফেলল। স্বর্ণলতা চাপা কিন্তু গম্ভীর স্বরে জানতে চাইলেন,

– তুই কল দিতে কইছিলি?

সাঁঝ শুকনো ঢোক গিলে বলল,

– মেহেদি শেষ হয়ে গেছিল।

– শেষ হয়ে গেছে তো কি হইছে? মেহেদি দেওয়াই লাগবে? খুব রঙ লাগছে না তোর? কীসের জন্য মেহেদি দিবি তুই? বিয়ে লাগছে? এই জানোয়ারের বাচ্চা, আমার দিকে তাকা।

সাঁঝ তাকাল না। মাথাটা আরও নিচু করে ফেলল। অভাব অনটনে ভরা এই আফসোসের সংসারে অতিষ্ট স্বর্ণলতা মেয়ের বিলাসীতাকে ঠাঁই দেওয়ার স্থান খুঁজে পায় না। এই সংসারে আহ্লাদ মানায়? আজ চুড়ি, কাল টিপ, দুল, ফুল আরও কতো কি! রোজ রোজ এত বায়না কেনো? সাঁঝ কি জানে না, মেয়ে মানুষের এত চাহিদা থাকতে নাই?

এক হাতে সাঁঝের চুলের খোঁপাটা ধরে মুখ উঁচু করতে বাধ্য করলেন স্বর্ণলতা। অন্য হাতটা সজোরে নেমে এলো সাঁঝের গাল লক্ষ্য করে। সপাৎ করে হাতটা আছড়ে পড়া মাত্র সাঁঝের তুলতুলে নরম গালটা লালচে হয়ে গেল। সাঁঝ উচ্চ শব্দ করল না। শুধু কেঁপে উঠল খানিকটা। স্বর্ণলতা থেমে রইলেন না। সজোরে আরেকটা চড় বসালেন বেহায়া মেয়ের গালে। চড়ের শব্দে সাভিন-সাবিল দুজনেই সোফায় গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। সাদিক যতক্ষণে মায়ের ঘর থেকে ছুটে এলেন ততক্ষণে সাঁঝের গালে আরও দুটো চড় পড়েছে। এক ঝটকায় স্বর্ণলতাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে মেয়েকে নিজের বুকে টেনে নিলেন সাদিক।

– পাগল হয়ে গেছ তুমি? ওকে মারছ কেন?

রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য স্বর্ণলতা দেয়ালের সাথে লেপ্টে ঘেষে দাঁড়িয়ে ফোঁস ফোঁস করছেন। পলকহীন চোখে সাদিকের বুকে লেপ্টে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকা সাঁঝের দিকে তাকিয়ে স্বর্ণলতা উত্তপ্ত কণ্ঠে বললেন,

– রোজ রোজ এত কীসের বায়না ওর? এখনও ছোট খুকিটি আছে? ওর বয়সী মেয়েরা বিয়েশাদী করে বাচ্চা সামলাচ্ছে আর ও এখনো মেহেদী দিয়ে বেড়াচ্ছে। আর কতো বুঝানো লাগবে ওকে?

ছোট রান্নাঘরটিতে কোনোরকমে চাপাচাপি করে প্রবেশ করলেন সাওদা বেগম। সাঁঝের রক্তিম গাল দেখে হায় হায় করে উঠলেন,

– আমারে তো মারতে পারবে না, এইজন্য আমার রাগটা মাইয়ার উপর ঝাড়ল। আহারে, গালটা পুরা জখম হইয়া গেছে। কতবার কই, তুমি মা। তুমি মাইয়ার গালে মারবা না। এতে বাচ্চার হায়াত কমে যায়। কিন্তু এই বেডি আমার কোন কথা কানে তোলে না! আয় বু, আয়। গালে বরফ লাগায় দেই।

সাওদা বেগম সাঁঝকে নিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসানো মাত্র সাবিল দৌড়ে গেল বরফ আনতে। সাভিন বোনের গা ঘেষে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকল। সাদিক এক পলক ওদের দিকে চেয়ে সদর দরজার দিকে চললেন। পেছন থেকে স্বর্ণলতা প্রশ্ন করল,

– তুমি আবার কোথায় যাচ্ছ?

– আসতেছি।

অল্প কথায় জবাব দিয়ে সাদিক বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে। সাওদা বেগম সাঁঝের গালে বরফ ঘষতে ঘষতে বিলাপ করতে ভুললেন না।

– সারাদিন খাটাখাটনি কইরা বাড়ি আইসাও শান্তি পায় না পোলাডা। এই রাইতের বেলায় আবার কই গেল কে জানে! সাবিল, একটা কল দিয়া খোঁজ নে। ঘরের বউ ভালো না হইলে বেডা মাইষের জীবনে শান্তি আছে? কোনোখানে শান্তি নাই।

স্বর্ণলতা কিছু বললেন না। মেয়ের কাছে এগিয়েও গেলেন না। চুপচাপ প্লাস্টিকের ডাইনিং টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

সাদিক ফিরলেন প্রায় আধাঘন্টা পরে। হাতের মেহেদি দুটো সাঁঝের কোলের উপর রেখে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চুপচাপ ঘরে চলে গেলেন। কিছুই হয়নি এমনভাবে ফ্রেশ হয়ে এসে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে সবাইকে ডাক দিলেন।

– খেতে এসো। রাত অনেক হয়েছে।

সবাই চুপচাপ এসে খাবার টেবিলে বসল। শ্বাস আটকে নীরবে দু মুঠো খেয়ে ছুটল নিজের ঘরে। যেন সবার থেকে পালিয়ে একলা নিভৃতে মুখ লুকাতে চায়।

এঁটো বাসন ধুয়ে, রান্নাঘর মুছে স্বর্ণলতা ঘরে এলেন। পানির বোতলটা টেবিলের উপর রেখে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন বিছানায়। অপরপাশে শুয়ে ছিলেন সাদিক। অন্ধকারে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কীসের হিসাব মিলাচ্ছেন কে জানে! স্বর্ণলতাকে অপরপাশে মুখ ফিরিয়ে শুতে দেখে আলতো কণ্ঠে শুধালেন,

– মেয়েকে একটা মেহেদী কিনে দেওয়ার সামর্থ্যও কি আমার নেই, স্বর্ণ?

চেপে রাখা কান্নাটা আরেকটু কষ্ট করে গলার ভেতর আটকে রেখে স্বর্ণলতা তার গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলেন,

– বড় ভাবির থেকে টাকা ধার নিয়ে বাজার করেছি আজকে। মাসের এখনো এক সপ্তাহ বাকি।

আরও কিছু হয়তো বলার ছিল স্বর্ণলতার। কিন্তু বলা হলো না। তার আগেই এক ফোঁটা জল চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। পাছে সাদিক টের পেয়ে যায়, সেই ভয়ে চুপ করে গেলেন স্বর্ণলতা। নীরবে গড়িয়ে যেতে দিলেন জলের ধারা।

সাদিক ঘাড় ফিরিয়ে দেখলেন, ওপাশের গভীর নীরবতা। নিজেই পাশ ফিরে এগিয়ে গেলেন স্বর্ণলতার দিকে। এক হাতে স্বর্ণলতাকে জড়িয়ে ধরে স্বর্ণলতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

– তুমি চিন্তা করো না। মাত্র সাতটা দিন-ই তো। ম্যানেজ হয়ে যাবে। এক তারিখে টিউশনের টাকা হাতে পেয়ে গেলে আর চিন্তা নেই।

মাসের শুরুতে টিউশনের টাকার সাথে আসবে সাভিন- সাবিলের স্কুলের বেতন, কোচিং ফি, সাওদা বেগমের ঔষধ, বাজার-সদাই। আর টাকা থাকে কোথায়?
মেয়েটার বিয়েও দিতে হবে। বয়স তো কম হলো না। আশেপাশে সাঁঝের বয়সী সব মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। পুরান ঢাকায় মেয়ে এসএসসি পাশ করেছে মানে বিয়ের বয়স তলানিতে এসে ঠেকেছে। কয়েকদিন পর পাড়ায় সাঁঝকে নিয়ে গুজব শুরু হতে সময় লাগবে না।

স্বর্ণলতার খুব বলতে ইচ্ছে করল, “আমার আর এসব ভালো লাগে না, সাদিক। বড্ড ক্লান্ত লাগে।”

কিন্তু কিছু বলা হলো না। নীরবতা ঢেকে নিল রাতের আঁধার।

চলবে…
#অক্ষরময়ী