এই সাঁঝবাতি পর্ব-১০

0
16

#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব:১০

মেঘমিলনে চেয়ে রাগ করো না
মন চায় তোমায় আজি রাতে…

দিনভর ঝিরিঝিরি বর্ষণে ত্যক্তবিরক্ত জনজীবন। জল কাদা পেরিয়ে সাবধানে রাস্তার একপাশ দিয়ে হাঁটছে সাঁঝ। প্রকৃতির সন্নিকটে দাঁড়িয়ে মনটা বেশ প্রফুল্ল। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ছাতা দুলিয়ে চলছে সে৷
সামনে থেকে সানান ভাইয়ের বাইকটিকে আসতে দেখে সতর্ক হাতে মাথায় ঘোমটা টানা ওড়নাটা আরেকটু টেনেটুনে ঠিক করে নিল৷ দোয়া করতে লাগল যেন তাকে লক্ষ্য না করে সানান ভাইয়ের বাইকটি পাশ কাটিয়ে চলে যায়। কিন্তু বিধিবাম। মানুষ যা ভয় পায়, তাই তার সাথে ঘটে৷

বাইকটি এসে সোজা থামল সাঁঝের সামনে। সানান ভাই আজ হেলমেট পরেননি৷ তেমন একটা পরতে দেখাও যায় না। কালেভদ্রে পরেন বোধহয়।

– হেলে-দুলে কই থেকে আসা হচ্ছে?

সানান ভাইয়ের সন্দেহবাতিক দু চোখ৷ গমগমে কণ্ঠেও বিশেষ অনুসন্ধানের সুর।
সাঁঝ একপাশে দাঁড়িয়ে আশেপাশের সবকিছুর দিকে অস্থির দৃষ্টি ফেলে জবাব দিল।

– মোড়ের দোকানে গিয়েছিলাম।

– কেন?

– চিনি আনতে৷

– এই ভর দুপুরবেলা দোকানে গেছিস? বাড়িতে আর কেউ নাই?

– সাভিন, সাবিল দুজনে স্কুলে। বাবা লাইব্রেরিতে। আপনি নিশ্চয়ই এই বিকেলবেলা অফিসে যাচ্ছেন?

কিছুক্ষণ বাদেই সন্ধ্যা নামবে। অথচ সানান ভাইয়ের চোখে এটা ভর দুপুর। নিশ্চয়ই বারোটায় ঘুম থেকে উঠে বেলা গুনতে শুরু করেছে। সাঁঝের স্পষ্ট খোঁচা এড়িয়ে গিয়ে সানান ভাই কর্তৃত্বের সুরে বলল,

– যখন তখন ঢ্যাং ঢ্যাং করে মোড়ের দোকানে চলে যাবি না। বাজার সদাই কি লাগবে আগের রাতের মেজ বাবাকে বলতে পারিস না?

– বাবাকে বলা আছে। রাতে নিয়ে আসবে। তাশফীন ভাইয়ার ঠান্ডা লেগেছে৷ তাই ভাবলাম মোড়ের দোকান থেকে খানিকটা চিনি এনে আদা চা বানিয়ে দেই৷

সানান ভাই উদার মনের মানুষ। দয়া করে গতকালের ঘটনাটা ভুলিয়ে দিয়েছিল। চায়ের কাপের সাথে ফু দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরেছিল ফুরফুরে মনে। এখন আবার তাশফীনের নামটা শুনে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো মুহূর্তেই। হঠাৎ ধমকে উঠল সানান ভাই৷

– আমি এদিকে বৃষ্টিতে ভিজছি আর তুই ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছিস। আদব-কায়দা কি সব বৃষ্টির জলে ধুয়ে ফেলেছিস, বেয়াদব?

সাঁঝ হকচকিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে ছাতাটা সানান ভাইয়ের মাথার উপর ধরল। তাতে সানান ভাই সন্তুষ্ট হলো না। ছো মেরে ছাতাটা নিজের হাতে নিয়ে নিল৷

– যা ভাগ এখন থেকে। আমার অফিসের দেরী হয়ে যাচ্ছে৷

বাইক চালিয়ে অফিসে যাবে সানান ভাই৷ এখানে ছাতার কি কাজ, খুঁজে পেল না সাঁঝ। হতভম্ব সাঁঝ কয়েক সেকেন্ড মূর্তির ন্যায় থম মেরে রইল। বৃষ্টির তোড় বাড়তেই সাঁঝের হুশ ফিরল। দ্রুত পায়ে কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে ফিরে তাকাল পেছনে৷ ছাতা মাথায় বাইকের উপর বসে ওর দিকেই বাজের ন্যায় তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে সানান ভাই।

– বৃষ্টিতে ভেজার খুব শখ না তোর, সাঁঝবাতি? কর এখন বৃষ্টিবিলাস।

সানান ভাইয়ের সেই দৃষ্টির তোপে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারল না সাঁঝ। ঘাড় ফিরিয়ে এক ছুটে বাড়ির পথ ধরল। ভেজা কাপড়ে বাড়িতে প্রবেশ করে স্বর্ণলতার কাছে আরেকদফা ধমক খেয়ে সাঁঝের প্রফুল্লতা কোন মেঘের সাথে উড়ে পালালো কে জানে!

°

তাশফীনের নতুন আস্তানা নিজ হাতে গুছিয়ে দিতে ঢাকায় এসেছে মাধবীলতা। মূলত মাকে নিয়ে আসতেই সেদিন ঢাকা এসে আবার তাড়াহুড়ো করে সিলেট ফিরে গিয়েছিল তাশফীন।

এই মুহূর্তে মা-ছেলে থেকে শুরু করে সাঁঝেরা তিন ভাইবোন সবাই তাশফীনের ফ্ল্যাট গোছাতে ব্যস্ত৷ কেউ বেড সেট করছে, কেউ টেবিল গোছাচ্ছে, কেউ বা রান্না ঘরের কেবিনেটে মশলার বয়াম গুছিয়ে রাখছে৷ সাঁঝ তার পছন্দনীয় কাজটা বেছে নিয়েছে৷ তাশফীনের কাপড়গুলো গুছিয়ে রাখছে আরএফএল এর আলমারিতে৷

নতুন বিছানায় হালকা বেগুনি রঙের একটা চাদর বিছানো হলো। বালিশ দুটো গুছিয়ে রেখে বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে ধপ করে শুয়ে পড়ল তাশফীন। কালো শার্টটা আলমারিতে তুলে রেখে সাঁঝ ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে হাসল৷

– এইটুকুতেই ক্লান্ত?

বিছানায় কনুই ঠেকিয়ে মাথা উঁচু করে সাঁঝের দিকে তাকাল তাশফীন। ঘরোয়া সালোয়ার কামিজ গায়ে, ওড়নাটা বুক ঢেকে কাঁধ হতে কোমড়ের দিকে প্যাঁচিয়ে রাখা। অবিন্যস্ত চুলের আলগা হাত খোঁপাটা ঝুলছে ঘাড়ের উপর৷ তেলতেলে মুখটায় মায়াবী হাসি। তাকিয়ে থাকতে থাকতে তাশফীনের প্রাণ জুড়িয়ে গেল, যেভাবে তপ্ত দুপুরে শীতল বাতাসে মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়।

রান্না ঘর গুছিয়ে মাধবীলতা এসে দরজায় উঁকি দিয়ে বললেন,

– হলো তোদের?

তাশফীন ঘাড় ফিরিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়ালো৷ মাধবীলতা এগিয়ে এসে ছেলের হাত ধরতেই উনাকে টেনে এনে বিছানায় বসালো তাশফীন। মায়ের কোলে মাথা রেখে ওভাবেই শুয়ে শুয়ে দেখতে থাকল সাঁঝকে৷

– কাজের সময় এ কোন বায়না? সর দেখি। মেয়েটা একা একা কাপড় গোছাচ্ছে৷

– এই তো শেষ। তুমি বসে রেস্ট নেও খালামনি৷ অনেকক্ষণ ধরে কাজ করেছ৷

– সবাই মিলে হাতে হাতে করলাম বলে এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। না হলে তাশফীন একা কী করে গোছাতো কে জানে!

তাশফীন মায়ের গায়ের সাথে আরেকটু লেপ্টে গিয়ে বলল,

– এজন্য তোমাকে নিয়ে এলাম। তুমি গুছিয়ে না রাখলে আমি কোনো জিনিস খুঁজে পাই না৷

– এবার নিজেরটা নিজে গুছিয়ে রাখতে শিখো৷ যতদিন না বউমা আসছে।

– এইটুকু সময়ের জন্য আমি আবার কেনো এসব শিখতে যাব। যার কাজ সে এসে করে যাবে৷

মাধবীলতা একপলক কাজে ব্যস্ত সাঁঝকে দেখে নিয়ে বললেন,

– রান্না বসাবো ভাবছি৷ কি খাবি বল?

সাঁঝ তৎক্ষণাৎ বিরোধিতা করে বসল।

– একদম না৷ মা বলেছে আজকে তোমরা আমাদের ওখানে খাবে৷ ওসব রান্নাবান্নার ঝামেলায় জড়াতে যেও না৷

– তবে কিচেনের চুলাটার কি কাজ?

– তরকারি গরম করা আর চা বানানো৷ আপাতত এইটুকুই। ভাইয়ার খাবার আমাদের বাড়ি থেকে আসবে। রান্নাবান্না কিছু পারে ভাইয়া! চুলা ধরাতে গিয়ে হাত-টাত পুড়িয়ে ফেললে?

– এত বড় ছেলেকে তোরা কয়দিন বসিয়ে খাওয়াবি? ইনকাম করতে শুরু করেছে এখন খরচ করাও শিখুক। বাজার-সদাই করে নিজের খরচে খাক।

– সে কখনোসখনো বাজার করতে চাইলে করবে। সমস্যা নাই৷ আমি বা মা মাঝেমধ্যে এসে রান্না করে দিয়ে যাব৷ তাশফীন ভাইয়া, তুমি কিন্তু ভুলেও চুলার কাছে যাবে না।

মাথার চুলে মায়ের আঙ্গুলের জাদুর ছোঁয়ায় চোখ বুজে ছিল তাশফীন। ওভাবে বন্ধ চোখের তারায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। আলতো হেসে বিড়বিড় করল,

– মাঝেমধ্যে কেন বেলা? তুই সারাক্ষণের জন্য থেকে যেতে পারিস না?

°

মধ্যরাত অব্দি সিঁড়িতে দৌড়ঝাঁপের শব্দে সানান ভাইয়ের মাথা ব্যথা ধরে গেছে। বিল্ডিং-য়ের লিফট থাকা সত্ত্বেও সাভিন-সাবিল নামক দুই বিচ্ছু সিঁড়ি দিয়ে চলাচল করছিল। ভদ্রভাবে হাঁটাচলা করলে তবুও মানা যেত। ওদের চলন বর্ণনা দেওয়ার মতো নয়। ধুপধাপ পা ফেলছে, দৌঁড়াচ্ছে, একজন আরেকজনকে ধাক্কাচ্ছে, উচ্চস্বরে হাসছে, দরজা দুমদাম খুলছে, বন্ধ করছে৷

সানান ভাই ভদ্র মানুষ বলে এসব কিছু চুপচাপ হজম করে গেছে৷ অন্য সময় হলে অবশ্য একটা রামধমক দিত। কিন্তু তাশফীনের মা এ বাড়ির অতিথি। উনার সামনে সানান ভাই অভদ্র আচরণ করতে পারে না৷ তাই তো নিজের গেমিং চেয়ারে বসে দু হাতে চুল টেনে নীরবে সহ্য করে যাচ্ছে৷

রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে খোলা জানালা দিয়ে চিকন একটা কণ্ঠ ভেসে এলো।

– তুমি ঘুমাও। খালামনিকে আমি নিয়ে যাচ্ছি৷ একা ভয় পাবে না তো?

সানান ভাইয়ের আর সহ্য হলো না৷ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে চলল দরজার দিকে৷ বিড়বিড় করে বলল,

– ছোট খোকা সে। রাতের বেলা একলা ভয় পাবে। কোলে বসিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে যা৷

সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিল সাঁঝ। দোতলার সিঁড়িতে খুব সাবধানে পা রাখল৷ রাত জেগে কাজ করে সানান ভাই৷ এখনও নিশ্চয়ই জেগে আছে মানুষটা। হাঁটাচলার শব্দে কি শুনতে পাচ্ছে? যদি বিরক্ত হয়?

মনের ভাবনা ইতি টানার আগেই দুম করে সদর দরজা খুলে বেরিয়ে এলো সানান ভাই। আকস্মিক ঘটনায় ভয়ে দু পা পিছিয়ে গিয়ে পড়তে পড়তেও নিজেকে সামলে নিল সাঁঝ৷ সানান ভাই একটা সবুজ কচি পাতা রঙের প্যান্ট পরে আছে। যেটা ঠেকেছে হাঁটুর উপরে। গায়ে লাল রঙের টিশার্ট৷ দেখেই সাঁঝের মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেল।

– তোদের যাত্রাপালার মঞ্চ সাজানো শেষ হয়েছে নাকি আরও বাকি আছে?

সানান ভাইয়ের বিরক্তিভাজন কণ্ঠটা শুধু সাঁঝের কানে পৌঁছাল। বোধগম্য হলো না কিছুই৷ বোকার মত প্রশ্ন করল,

– জ্বি?

– কটা বাজে এখন?

সাঁঝ তার হাতে থাকা বাবার মোবাইলে সময় দেখে নিয়ে বলল,

– সাড়ে বারোটা।

– এই মধ্যরাতে মানুষজন ঘুমায়৷ এটা সিঁড়িতে দাপাদাপি করার সময় না। এইটুকু বোধবুদ্ধি তোর নাই? লিফট ইউজ না করে সিঁড়িতে লাফালাফি করতেছিস কেন?

– এগোরাটায় আপনাদের লিফট সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়।

– তো বন্ধ করবে না? সারারাত জেগে তোদের নাটক শেষ হওয়ার অপেক্ষা করবে? মানুষের ঘুম-নিদ্রা নাই?

– আপনি ঘুমাচ্ছিলেন, সানান ভাই?

সাঁঝ মাথা নিচু করে অপরাধী সুরে জানতে চাইল।

– আমি না ঘুমালেও আমার পরিবারের লোকজন ঘুমাচ্ছিল। তোদের এই অসভ্য আচরণের কারণে ওদের ঘুমের সমস্যা হচ্ছে।

– স্যরি। তাশফীন ভাইয়া আজকে আপনাদের ফ্ল্যাটে উঠল৷ আমরা উনার ঘর সাজিয়ে দিতে এসেছিলাম৷

– সে কি নতুন বর, যে তার ঘর সাজিয়ে দিতে হবে?

– না মানে, নতুন ফ্ল্যাট গোছানো অনেক ঝামেলার কাজ। ভাইয়া একা কীভাবে ম্যানেজ করত! এজন্য খালামণির সাথে আমরাও এলাম।

– বাকিরা কই?

– সাভিন-সাবিলের সাথে খালামণি নিচে নেমে গেছে৷

– ঘর গোছানোর খুব শখ না তোর? কালকে সকালে এসে আমার ঘরটা গুছিয়ে দিয়ে যাবি৷ অনেক নোংরা হয়ে আছে। ঠিক সাতটায় তোকে যেন আমার ঘরে পাই।

– এত সকালে! আপনি তো এত সকালে ঘুম থেকেই উঠেন না৷ দুপুরে আসি?

– আমার সাথে তোর কি? তুই আসবি, নিজের কাজ করে চলে যাবি৷ সাতটা মানে, সাতটাই। এক সেকেন্ডও যেন দেরী না হয়৷

সানান ভাই যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই দরজা বন্ধ করে ঝড়ের গতিতে ফিরে গেল৷ এদিকে ঠোঁট উলটে দাঁড়িয়ে আছে সাঁঝ। এখন প্রায় একটা বাজে। গিয়ে ঘুমাবে কখন আর সকালে উঠবে কখন?

সকালে বাসি মুখে মা বাড়ি থেকে বের হতে দিবে না। অন্তত এক কাপ চায়ের সাথে দুটো বিস্কুট খেয়ে আসতে হবে। মানে, সকালে উঠে, ফ্রেশ হয়ে চা বানিয়ে, খেয়েদেয়ে আবার সাতটার মধ্যে সানান ভাইয়ের বাড়িতে হাজিরা দিতে হবে৷ তাহলে সাঁঝকে বিছানা ছাড়তে হবে কত সকালে?

সাঁঝের গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে৷ সকালে একবার ছাতা কেড়ে নিয়ে বৃষ্টি ভেজাল। এখন আবার ঘর গুছিয়ে দেওয়ার আদেশ। পেয়েছি কি এরা সাঁঝকে? কাজের লোক নাকি শখের খেলনা? যখন যেভাবে ইচ্ছে খাটিয়ে নিচ্ছে।
এমন স্বৈরাচর শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও করা যায় না। কিছু বলতে নিলেই সাঁঝের মুখ চেপে ধরবে স্বর্ণলতা।

বিপদে আপদে ওদের আর্থিকভাবে সহায়তা করে আফসানা। রান্না বেশি হলে সেটাও সাঁঝদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে ভালোমন্দ খাওয়ার ব্যবস্থা করে৷ শপিং করতে গেলে মাঝেমধ্যে ওদের জন্যেও দু একটা জামা কাপড় নিয়ে আসে। তাতেই কৃতজ্ঞতা বোধের শেষ নেই স্বর্ণলতার৷ আফসানা ছাড়া এইটুকু সাহায্য কেইবা করে?

সাঁঝ বুঝতে পারে না, টাকা জিনিসটা এমন কেনো? টাকা থাকলে কত সহজে মানুষকে দমিয়ে রাখা যায়। ইচ্ছে খুশি মতো পুতুল নাচ নাচানো যায়৷ দু টুকরো রুটি ছুড়ে দিলেই আস্ত একটা মানুষকে হাতের মুঠোয় ভরে ফেলা যায়। তখন তাকে বসতে বললে বসে, দাঁড়াতে বললে দাঁড়ায়।

টাকা থাকলে মানুষের আনন্দের অভাব হয় না। একটা মানুষকে অপমান করে, হেয় করে খুব সহজেই আনন্দ পাওয়া যায়। ভালো লাগছে না, যাই কাউকে গিয়ে ধমক দিয়ে আসি৷ অপমান করে আসি৷ মানুষটার চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে কীভাবে এদের মন ভালো হয়ে যায়।
সাঁঝ ভেবে পায় না, লোকে এত অদ্ভুত হয় কীভাবে? কই তার তো এমন হয় না৷ কখনো কাউকে নিয়ন্ত্রণ করার অভিপ্রায় জাগে না।

নিচ থেকে মাধবীলতার ডাকে দ্রুত পা চালিয়ে নিচে গেল সাঁঝ। সাবধানে লোহার পকেট গেইটটা বন্ধ করে দিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়াল।

ঘরে ঢুকে সানান ভাই চারপাশটায় চোখ বুলিয়ে নিল৷ সবকিছু এত চকচক করছে কেন? ঘরটা পরিষ্কার তকতকে থাকলে চলবে না৷ ঘর হতে হবে নোংরা।

সানান ভাই আলমারি খুলল। গোছানো কাপড়গুলো এলেমেলো করল। ড্রেসিংটেবিলের উপর থেকে চিরুনিটা নিয়ে ছুড়ে মারল বিছানায়৷ পারফিউমের বোতল, ফেসওয়াশ দুটো ফেলল দুদিকে৷ টেবিলের উপরের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রগুলো একপাশে রেখে বাকি খাতাপত্র এলোমেলো করল। পানির বোতল থেকে খানিকটা পানি ফেলল মেঝেতে৷ নোটপ্যাড থেকে পাতা ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফু দিয়ে ঘরময় ছড়িয়ে দিল। বিছানা বালিশ এলোমেলো করতে হলো না। শুলে ওটা এমনিতেই এলোমেলো হয়ে যাবে।

পরিপাটি ঘরটা এখন আস্ত গোয়ালঘরের মতো দেখাচ্ছে। নিজের শিল্পকর্মে সন্তুষ্ট হয়ে গর্বে বুকটা ভরে এলো সানান ভাইয়ের৷

মুচকি হেসে মেঝের পানিতে পা ফেলে এগিয়ে গেল বিছানার পাশের ডেস্কটায়। যেটা সানান ভাইয়ের ওয়ার্কিং স্পেস৷ ডেস্ক থেকে হেডফোনটা নিয়ে কানে চেপে বসে পড়ল গেমিং চেয়ারটায়৷ এখন আর কোনো ধুপধাপ শব্দ কানে আসার দরকার নাই৷

“মুভ ফর মি, মুভ ফর মি, মুভ ফর মি
এন্ড হোয়েন ইউ আর ডান,
আই উইল মেক ইউ ডু ইট অল এগেইন…”

সুরের তালে মাথা দুলাতে দুলাতে সানান ভাই ডুবে গেল নিজের কাজে।

চলবে..
অক্ষরময়ী