#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব: ১৩
মেঘাবৃত আকাশে সামিয়ানা টাঙিয়েছে আঁধার। অপরাহ্নের শেষ ভাগ আসন্ন। জুবিয়া ভেবেছিল, আজ বোধহয় বৃষ্টি থামবে না৷ ভাগ্যিস কেনাকাটা শেষ করে বাড়িতে পৌঁছানোর পর বৃষ্টিটা হুট করে নামল। কড়া রোদ্দুরের মধ্যে এমন আচমকা বৃষ্টি নামবে কে জানত! দুপুরের খাবার না খাইয়ে সাঁঝ ওকে কিছুতেই ছাড়বে না। বাধ্য হয়ে আবার আরাম-আয়েশে ফিরতে হয়েছে জুবিয়াকে৷ তারপর থেকে ঝরছে অঝোর বৃষ্টি।
মেঘের আড়ালে সূর্যটা ঢাকা পড়েছে অনেকক্ষণ। আর কিছুক্ষণ পরে আজকের মতো বিদায় নিত নীরবে, নিভৃতে। বিদায় সম্ভাষণের সুযোগটাও হয়তো মিলত না। সূর্যের এমন অনাড়ম্বর প্রস্থান মেঘের বুঝি পছন্দ হলো না৷ হুট করে থামিয়ে দিল ঝুম বৃষ্টি। চোখের পলকে রাশি রাশি মন খারাপের মেঘ উড়ে গিয়ে খিলখিলিয়ে শেষবারের মতোন হেসে উঠল সূর্য৷ জীবনীশক্তির সমস্তটুকু বিলিয়ে দিয়ে আলোয় ভরিয়ে দিল ধরাধাম।
জুবিয়ার আর অপেক্ষা করল না। চটজলদি ব্যাগটা হাতে নিয়ে ঘর ছাড়ল। তিথীকে এতক্ষণ একলা রেখে বেরিয়ে পরার অপরাধে ভাইয়ের থেকে বেশ কিছু কড়া কথা শুনতে হবে। তিথী যদি আরেকটু ইন্ধন যোগায়, তবে দু চারটে চড়-থাপ্পড়ও ভাগ্যে জুটে যেতে পারে৷ জুবিয়া ভাবল, আজকে রাতের রান্নায় ভালোমন্দ কিছু রাঁধবে। এতে যদি ভাইয়ের মন ভালো করা যায়৷
বাড়ির সামনের গলিতে দাঁড়িয়ে আছে সাঁঝ। একটু আগে জুবিয়াকে রিক্সায় তুলে দিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরেছে সে। হঠাৎ কোথা থেকে কতোগুলো নোংরা জল এসে পড়ল গায়ে৷
আকস্মিক ঘটনায় চমকে গিয়ে দুপাশে হাত ছড়িয়ে চিৎকার করে উঠল সে। অথচ সামনের ব্যক্তিটি এমন অপকর্ম করার পরও বিবেকহীনের মতো হেলাফেলা করে বলল,
– রাস্তার মাঝখানে এমন খাম্বার মতো দাঁড়ায় আছিস কেন?
সাঁঝ খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে ছিল? সত্যি? সে আপনমনে রাস্তার একপাশ দিয়ে হাঁটছিল। অন্যপাশে বৃষ্টির পানি জমেছে। বাইক চালকের কি উচিত ছিল না সেটা লক্ষ্য করা এবং বাইকের গতি কমিয়ে দেওয়া? হাতে বাইক চলে এলে কি এদের হুশ-জ্ঞান থাকে না?
সাদা রঙের নতুন ড্রেসটা আলমারি থেকে বের করে আজকেই প্রথমবার পরেছে। বাইরে থেকে এসে তখনো পোশাক বদলানো হয়নি৷ সেটাই বুঝি কাল হলো। কাদায় মাখানো পোশাকটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখে পানি এসে গেল সাঁঝের।
রাগে মাথার ভেতর আগুন জ্বলছে। কিন্তু সামনের মানুষটিকে জ্বালিয়ে দেওয়ার কোনো উপায় সাঁঝের জানা নেই।
নিজের দূর্দশা দেখে মন ভরে গেলে সাঁঝ তাকাল সামনে। মানুষটার না বাড়ি ফেরার খুব তাড়া ছিল, তাইতো উড়োজাহাজের বেগে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল বাইকটিকে। আশেপাশে মানুষ থাকুক আর পিঁপড়ে থাকুক। সেসব দেখার সময় নেই।
তবে এখন কেনো বাইক দাঁড় করিয়ে রেখে শীতল চোখে চেয়ে আছে সাঁঝের দিকে?
রাগটা পায়ের নিচে চাপা দিয়ে সাঁঝ শুধু অবাক হয়ে চেয়ে দেখল। এমন পরিস্থিতিতে রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখা কতোটা কষ্টকর তা বোধহয় সামনের মানুষটি বুঝল না। উলটো সাঁঝের মেজাজ বিগড়ে দিতে মেঘমন্দ্র স্বরে প্রশ্ন করল,
– তুই কি এইমাত্র আমাকে চোখ রাঙানি দিলি, সাঁঝবাতি?
সাঁঝ হতাশ চোখে তাকিয়ে থেকে দুপাশে মাথা দুলিয়ে উত্তর দিল। নাহ। এত বড় স্পর্ধা এখনো সাঁঝের হয়নি।
– গুড। এরপর থেকে রাস্তাঘাট চলার সময় সতর্ক থাকবি।
বিনা পয়সায় দুটো জ্ঞানের কথা শুনিয়ে দিয়ে সানান ভাই চলে গেল নিজের বাড়ির দিকে৷ সাঁঝ নিজেকে প্রবোধ দিতে বলল,
“সারাদিন অফিস করে মেজাজ বিগড়ে আছে বোধহয়। আমার ড্রেসটা নষ্ট করে কোন সুখ মিলল কে জানে! আস্ত চাঁড়াল একটা।”
°
আরাম-আয়েশে কোনো ব্যক্তি খুব বেশিক্ষণ আরাম-আয়েশ করতে পারে না। এই যেমন, এশার নামাজ পড়ে পানের ডালাটা নিয়ে মাত্র একটু আরাম করে বসেছিলেন সাওদা বেগম। পাশের ঘর থেকে চেঁচামেচির আওয়াজে উনার আরামে বিঘ্ন ঘটল। মাধবীলতাও শপিংব্যাগ নিয়ে বসেছিলেন সাঁঝের বিছানায়। প্রথম স্যালারি পেয়ে তাশফীন সবার জন্য কেনাকাটা করেছে। সেসবই মিলিয়ে দেখছিলেন তিনি৷ চাপা কন্ঠস্বরের শব্দে তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেন।
বেগুনি রঙের একটা শাড়ি কিনেছে সাঁঝ। সেটাই স্বর্ণলতাকে দেখাতে গিয়েছে। শাড়ি দেখে স্বর্ণলতা নিশ্চয়ই মেয়েটাকে ধমকাচ্ছে।
মাধবীলতা ঘরে প্রবেশ করে দেখলেন, বিছানায় মাথা নিচু করে বসে ফোঁপাচ্ছে সাঁঝ। পাশে দাঁড়িয়ে বকাবকি করছে স্বর্ণলতা। বকার তালে মাঝেমধ্যে মেয়ের মাথায়, ঘাড়ে, পিঠে – যেখানে হাত পৌঁছাচ্ছে সেখানেই মারছে।
শান্তশিষ্ট, ভদ্র ছোটবোনটা অভাব-অনটনে একটু ছোটমনের অধিকারী হয়েছে, সে খবর মাধবীলতার জানা৷ কিন্তু এমন অসভ্য, অমার্জিত ও বর্বর হয়েছে সেটা দেখে মাধবীলতা হতভম্ব দাঁড়িয়ে রইলেন দরজায়। উনাকে ঠেলে একপাশে সরিয়ে দ্রুত বেগে ঘরে প্রবেশ করলেন সাওদা বেগম।
দু হাতে নাতনিকে বুকে জড়িয়ে আড়াল করে নিয়ে তিনি নিজেও দ্বিগুণ উৎসাহে চিৎকার জুড়ে দিলেন।
– মাথা খারাপ হইছে তোমার? মাইয়াটারে মারতাছো কেন? কথা নাই, বার্তা নাই যখন তখন মাইয়ার গায়ে হাত তুলো। এই তোমার শিক্ষার নমুনা?
স্বর্ণলতাও কম কীসে? এতক্ষণ নিচু গলায় কথা বললেও এ পর্যায়ে শাশুড়ির সাথে তাল মিলিয়ে গলা উঁচু করে ফেললেন।
– শখে মেয়ের গায়ে হাত তুলি না আমি। মেয়ে দোষ করে তাই শাষণ করি।
– কি করছে আমার নাতনি? কি এমন করছে যে এমন গরুর মতো পিটাইতাছো? কোন মহাপাপটা করছে?
– ওকেই জিজ্ঞাসা করুন।
সাওদা বেগম রাগান্বিত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে যখন বুঝলেন স্বর্ণলতার থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যাবে না, তখন সাঁঝের দিকে তাকালেন।
দু হাতের আঁজলায় সাঁঝের মুখটা ধরে জিজ্ঞাসা করলেন,
– ও বু, কি করছিস তুই?
সাঁঝ তখনো কাঁদছে। হেঁচকির তালে তালে কেঁপে উঠছে শরীরটা। ফুপিয়ে ফুপিয়ে উত্তর দিল,
– একটা শাড়ি কিনেছি।
শাড়ি কেনার জন্য কেউ মেয়েকে মারে? সাওদা বেগম অবাক হওয়ার পর্যাপ্ত সময়ও পেলেন না। তার আগেই স্বর্ণলতা ধমকিয়ে উঠলেন,
– কয় টাকা দিয়ে কিনছিস সেটাও বল।
– কিনলে কিনছে একটা শাড়ি। এইজন্য তুমি মাইয়ারে মারবা?
স্বর্ণলতা আরেকবার ধমকাতেই শাড়ির দাম বলল সাঁঝ।
– দশ হাজার।
উত্তর শুনে সাঁঝের গাল থেকে হাত খসে পড়ল সাওদা বেগমের। আতংকিত চোখে নাতনির দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। সবিস্ময়ে আওড়ালেন,
– এত টাকা দিয়ে শাড়ি কিনছিস তুই? কি করতে?
সুযোগ হাত ছাড়া করলেন না স্বর্ণলতা। গর্জে উঠলেন তখনি।
– দশ হাজার টাকা দিয়ে সারা মাস খেয়ে পরে বাঁচতে হয় আমাদের৷ আর এই মেয়ে দশ হাজার টাকার শাড়ি কিনে বাড়ি ফিরছে। ওর যে হাত-পা এখনো ভেঙে ফেলিনি এটাই অনেক।
স্বর্ণলতার বিলাপ থামছে না। এদিকে সাওদা বেগমও শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। কিছু না করেও অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বসে আছে সাঁঝ। মাধবীলতার পক্ষে আর চুপ করে থাকা সম্ভব হলো না। ঘরে প্রবেশ করে শান্তস্বরে বলল,
– শাড়িটা ওকে তাশফীন কিনে দিয়েছে। উপহারের জিনিসের দাম নিয়ে এমন চিৎকার চেঁচামেচি করতেছিস কেনো,স্বর্ণ?
– সে যেই কিনে দিক। ও কেন নিবে এত দামী শাড়ি? আমাদের যে কাপড় কেনার সামর্থ্য নাই, সেটা আরেকজন দিতে চাইলেই নিতে হবে? এত লোভ এই মেয়ের! কখনো এত টাকার শাড়ি চোখে দেখছে ও?
– আজকে এই কাজটা করে তুই আমার ছেলেকে অপমান করলি। ও শখ করে একটা শাড়ি কিনে দিয়েছে বলেই মেয়েটাকে মারলি তো?
– ভুল বুঝছ আপা। এখানে তাশফীনকে টেনে এনো না। এই মেয়ের নিজের সীমা জানা জরুরি। সারাদিন শুধু ওর মাথায় কেনাকাটার চিন্তা ঘুরে। কখনো ঘর-সংসার নিয়ে ভেবেছে? সংসারে কীভাবে টাকা আসে, কয় টাকা আয় হয়, সেই টাকা দিয়ে কীভাবে সংসার চলে – এসব নিয়ে ওর কোনো চিন্তাভাবনা নাই। ওর শুধু এটা চাই, ওটা চাই৷ জামা চাই, জুতো চাই, কসমেটিকস চাই। কেনো? কেনো এত কিছু চাই? আমাদের সামর্থ্য যেমন, সেই অনুপাতে চাওয়া-পাওয়া থাকা উচিত।
– তোর টাকায় শাড়িটা কিনেনি যে, তোকে এত হিসাব নিকাশ করতে হবে।
– কয় টাকা বেতন পেয়েছে ছেলেটা? বিশ হাজার, পঁচিশ হাজার? এই মেয়ে একাই দশ হাজার টাকা উড়িয়ে চলে এলো। না হয় তাশফীন অফার করেছে, তাই বলে ও হিসাব করে খরচ করবে না? মেয়ে মানুষ এত বেহিসাবি হলে চলবে? এই টাকা দিয়ে তাশফীনের এক মাসের হাত খরচ চলে যেত।
– শোন, তাশফীনের বাবার যথেষ্ট আছে। বেতনের দু-চার টাকার জন্য ওর হাত খরচ আটকাবে না৷ আমরা কেউ ছেলের টাকার আশায় বসে নাই। ছেলেটা বেতন পেয়ে শখ করে সবার জন্য কেনাকাটা করেছে। সবার জন্য কিছু না কিছু কিনেছে৷ সাঁঝের যে বান্ধবীটা সাথে গিয়েছে ওকেও একটা ড্রেস কিনে দিয়েছে৷ কাউকে উপহার দিতে গেলে এত হিসাব করে দিতে হয় না। সামনের মানুষটার মুখের হাসিটা দেখতে হয় শুধু৷ সাঁঝের শাড়ির শখ তাই ওকে একটা শাড়ি কিনে দিয়েছে। তাতে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে বুঝলাম না। মেয়েটা শখ করে এলো তোকে শাড়িটা দেখাতে৷ আর তুই ওকে ধরে পিটাচ্ছিস। বাহ! কী চমৎকার কাজ! এই না হলো মা। মেয়ের মুখের হাসি, মেয়ের উচ্ছ্বাস একবারো তোর নজরে এলো না? দিন দিন কেমন অমানুষের মতো হয়ে যাচ্ছিস স্বর্ণ। এই দেশে অভাব- অনটনে আরও অনেকে দিন কাটায়। কই ওরা তো তোর মতো ফ্রাস্ট্রেটেড না। তুই আসলে নিজেই তোদের এই অবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে পারিস নি। সারাক্ষণ হীনমন্যতায় ভুগিস। আর দোষ দিচ্ছিস মেয়েকে।
এমন আক্রমণের মুখে স্বর্ণলতা মিইয়ে গেল৷ তবুও কিছু একটা বলতে হয় বলেই বলল,
– শাড়ির শখ জন্য কি এখন শাড়ির গোডাউন খুলে বসবে? ওর আলমারিতে কতোগুলো শাড়ি পড়ে আছে জানো? আরও কেন শাড়ি কিনতে গেল?
দাদীর বুক থেকে মুখ উঠিয়ে প্রতিবাদ করে উঠল সাঁঝ।
– একটাও জামদানী শাড়ি আছে আমার? কখনো কিনে দিয়েছ?
শাশুড়ির সামনে এমনিতেই বোনের তোপের মুখে পড়ে স্বর্ণলতার মুখে চুনকালি পড়েছে। মেয়েও সুযোগ বুঝে সাহসী হয়ে উঠল নাকি? মায়ের মুখের উপর তর্ক করছে! ক্ষয়ে যাওয়া প্রদীপ যেমন নিভে যাওয়ার আগে দপ করে জ্বলে উঠে শেষবার, তেমন করে জ্বলে উঠল স্বর্ণলতা।
ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে ঝেটিয়ে একটা চড় বসালো সাঁঝের গালে।
– আবার মুখের উপর কথা বলছিস…
ঘটনা এত দ্রুত ঘটল যে উপস্থিত মানুষগুলো কেউ প্রতিক্রিয়া জানানোর সুযোগটাও পেল না। তখনি ঘরের ভেতর প্রবেশ করল আরেকজন ব্যক্তি। স্বর্ণলতার উদ্ধত হাত ঠেকিয়ে গর্জন করে উঠল।
– আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলো এত সাহস তোমার!
সাদিক শারাফাতের কণ্ঠস্বর বজ্রনাদের মতো আছড়ে পড়ল ঘরজুড়ে৷ আঁচল টেনে ঘোমটা দিলেন মাধবীলতা। সাওদা বেগম আগুনে ঘি ঢালতে চাইলেও ছেলের রাগান্বিত মুখশ্রী দেখে আর সাহস পেলেন না। এমনিতেও উনার মেজ ছেলেটা বড্ড শান্ত। মাথায় বাজ ভেঙে পড়লেও কখনো টু শব্দটা করে না। এতটাই নিরীহ, এতটাই নির্বিবাদী সে৷ কিন্তু কখনো যদি হুট করে রেগে যায় তবে আর নিস্তার নেই।
সাওদা বেগম নাতনির হাত ধরে টেনে তাকে নিয়ে চললেন নিজের ঘরে। মাধবীলতাকে কিছু বলে দিতে হলো না। তিনিও দ্রুত পায়ে নীরবে ঘর ত্যাগ করলেন।
°
রাত্রি কতটুকু গড়ালো সাঁঝের জানা নেই। সে চোখ মেলে তাকিয়ে আছে অন্ধকারে৷ বন্ধ জানালার গ্লাস ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করেছে গলির মোড়ের নিয়নবাতির মরা আলো। পথের ধারে ভূতগ্রস্তের মতো যে দাঁড়িয়ে থাকে চিরকাল।
সিলিং-য়ে ঘড়ঘড় করে অনবরত ঘুরছে একটা পুরাতন ফ্যান। ফ্যানটার সার্ভিসিং করা জরুরি। হাওয়া কমে এসেছে অনেক। এইটুকু বাতাস গ্রীষ্মের তালপাকা গরমের সাথে পাল্লা দিতে পারছে না।
রাতের নৈশব্দকে ভেদ করে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ চারপাশ আরও ভারী করে তুলল। সাঁঝ ফিরে তাকাল না। শুধু ফিসফিসিয়ে বলল,
– তুমি সত্যিই কালকে চলে যাবে, খালামণি?
মাধবীলতা এখনো রেগে আছেন। রাতে খাবার টেবিলে উপস্থিত হতেও রুচিতে বাঁধছিল। নেহাৎ সাদিক নিজে ঘরের দরজার সামনে ডাকতে এসেছিল। বাড়ির জামাইয়ের মুখের উপর না করা যায় না৷ যতোই বোনের সাথে দ্বন্দ চলুক, জামাই সম্প্রদায়ের সম্মানের কথা সবসময় মাথায় রাখতে হয়। খাবার টেবিলে বসে মাধবীলতা জানিয়ে দিয়েছেন, আগামীকালকে তিনি ফেরত যেতে চান। সাওদা বেগম অবশ্য মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করে বলেছেন,
– এখনি যাইবা কেন? কতকাল পর বোনের বাড়ি আইলা! এমনে রাগ কইরা চইলা যাওনের কোনো মানে হয়? বোনে-বোনে দ্বন্দ কার না হয়? আমরা বোনরা দিনে চারবেলা কইরা ঝগড়া করতাম। যেমনতেমন ঝগড়া না। চুল ছুড়াছুড়ি ঝগড়া। আবার পরেরদিন সব ভুইলা গলা জড়াজড়ি কইরা খেলা জুড়ে দিতাম। এখন দেখো, ঝগড়া করা তো দূরের কথা, বোনের চেহারাটা দেখারও উপায় নাই। সবাই মাটির তলায় চইলা গেছে। কোনদিন যেন আমারও ডাক পড়ে।
– রাগ করে যাচ্ছি না। স্বর্ণের উপর আবার কীসের রাগ! আমরাই হয়তো ঠিকঠাক শিক্ষা দিয়ে মানুষ করতে পারি নাই। এজন্য এমন গোঁয়ার হয়েছে। আমি এমনিতেও কাল পরশুর মধ্যে চলে যেতাম। তাশফীনের ফ্ল্যাটটা গুছিয়ে দিতে এসেছিলাম। ওদিকে আপনার জামাই একা মানুষ। কী করছে, কীভাবে খাচ্ছে – কে জানে। কাজ যেহেতু শেষ তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াই ভালো।
– ভুল কিছু কও নাই। তোমার এই বোনটার মাথার সমস্যা আছে। একটুতেই ছ্যাত কইরা উঠে। আমার পোলাডা মাটির মানুষ দেইখা এখনো সংসার করতাছে। অন্য কেউ হইলে কবেই ছাড়াছাড়ি হইয়া যাইত।
মায়ের এমন কথায় সাদিক শারাফাত বড্ড বিরক্ত হলেন। বড্ড বাড়িয়ে চাড়িয়ে কথা বলেন সাওদা বেগম। হুটহাট রেগে যাওয়ার স্বভাব আছে স্বর্ণলতার। তাই বলে মাথার সমস্যা বলবে? বিয়ে করে যখন এ বাড়িতে এলো, তখন স্বর্ণলতা এমন ছিল না৷ চুপচাপ, শান্তশিষ্ট একটা মেয়ে ছিল। অভাব-অনটন আর দুশ্চিন্তায় এমন খিটমিটে হয়ে গেছে। তবুও সাদিক কি ছাড় দেয়? দেন না তো। এই যে একটু আগেও ধমকিয়ে এলেন। গায়ে হাত তোলা বাদে সবরকম শাসন-ই করেন সাদিক। বুঝিয়ে বলা, আদর করে বলা, অনুরোধ থেকে শুরু করে শাসানো, ধমকানো – সবটাই করেন। তবুও মাঝেমধ্যে হতাশাগ্রস্ত স্বর্ণলতা নিজেকে ধরে রাখতে পারে না।
– পরে সময় করে আবার আসব।
– আমার জন্য এসব হলো। ভাইয়ার থেকে এত দামী শাড়ি নেওয়াটা উচিত হয়নি।
– বাজে কথা বলবি না। তোর জন্য কিছু হয়নি। বোনে বোনে এমন একটু-আধটু ঝগড়া হয়। তোর বোন নেই, তুই বুঝবি না।
– তুমি যে রাগ করে একদম চলে যাচ্ছ।
– রাগ করে যাচ্ছি না। কাজ শেষ তাই যাচ্ছি৷
– তুমি সত্যি মায়ের উপর রেগে নেই?
– নাহ।
– মা আসলে খুব ভালো। আমাদের অনেক ভালোবাসে। নিজে না খেয়ে আমাদের খাওয়ায়। কেউ বিপদে পড়লে ছুটে যায়। সবার উপকার করে। শুধু মাস শেষে হাতে যখন টাকা কমে আসে, তখন এমন হুটহাট রেগে যায়।
– টাকার চিন্তা এ জগতের সবচেয়ে বাজে দুশ্চিন্তা। যখন সংসার করবি তখন বুঝবি।
– তোমাকে একটা প্রশ্ন করি? নিউট্রাল এন্সার করবে।
– বল।
– শাড়িটা আমি ফিরিয়ে দিলে খারাপ দেখাবে? ভাইয়া কি রাগ করবে?
– কেন ফিরিয়ে দিবি?
– এত টাকা দিয়ে শাড়িটা কেনা আমার উচিত হয়নি৷ শাড়িটা দেখে মায়ের খুব খারাপ লেগেছে৷ ওটা থাকলে মায়ের কষ্ট হবে।
– আর ওটা ফিরিয়ে দিলে তাশফীনকে অপমান করা হবে।
সাঁঝ চুপটি করে অন্ধকারে নিঃশ্বাসের পরিধি মাপতে থাকল। অন্ধকার কতটা গাঢ় হলে, হারিয়ে যায় দীর্ঘশ্বাস? শোনা যায় না মন খারাপের গুঞ্জন?
– আচ্ছা খালামণি?
– হুম?
– শখ পোষা কি অন্যায়? এই যে আমার সাজতে ভালো লাগে, কেনাকাটা করতে ভালো লাগে – এটা কি বাজে নেশা? আমি কি উচ্চাভিলাষী?
মাধবীলতা পাশ ফিরে চাইলেন। বালিশে কনুই ঠেকিয়ে হাতের তালুতে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে শুয়ে তাকালেন সাঁঝের মুখের দিকে। অন্ধকারে স্পষ্ট কিছু দেখা যাচ্ছে না। তবুও চোখ সয়ে যাওয়া আঁধারে সাঁঝের মলিন মুখটা মাধবীলতার বুকে তীরের মতো বিঁধে গেল।
– শখ পোষা অন্যায় নয়। এই পৃথিবীতে সবাই শখ পুষে। একেকজনের শখ একেকরকম। আমার একটা বাগানের শখ, তোর মায়ের শখ ক্রোকারিজ। তোর বাবার শখ নতুন বই, সাভিনের শখ ক্রিকেট বল৷ সাবিলের শখ একটা বাইক। তোর দাদীর শখ পানের বাটা। আমরা কেউ কি শখের ঊর্ধ্বে? দেহের ভেতর মনটা যতদিন জীবিত আছে, সজীব আছে, ততদিন শখ থাকবে। তুই কি জানিস? সবাই শৌখিন হতে পারে না? আমরা যারা এখনো মনের ভেতর শখ লালন-পালন করি, তারা আসলে ভাগ্যবান।
– তাহলে মা বকে কেন?
– তোর মা আসলে ভয় পায়।
– কীসের ভয়?
– এই শখ যেন পাছে তোর কষ্টের কারণ না হয়ে যায়৷
– শখ কী করে কাউকে কষ্ট দেয়?
– দেয় না? শখ পূরণ হলে যেমন আনন্দ হয়, তেমনি শখ পূরণ করতে না পারলে কষ্ট হয়। শাড়ি কিনতে না পারলে তোর কষ্ট হয় না? পছন্দের লিপস্টিকের শেডটা তোর কাছে নেই বলে তোর মন খারাপ লাগে না?
– হ্যাঁ লাগে।
– এভাবেই শখ আমাদের কষ্ট দেয়। শখ পূরণ করতে না পারার অসামর্থ্যতা তিলে তিলে শেষ করে দেয় মানুষকে। শোকে পাথর হয়ে যায় লোকে। যেমনটা হয়েছে তোর মা।
– আমার মা?
– হুম। তোর কি মনে হয়, তোর এই সাজগোজের শখটা কোথা থেকে এসেছে?
– মায়ের থেকে? মায়েরও বুঝি সাজগোজের শখ ছিল?
– শুধু শখ? রীতিমতো পাগল ছিল। একদম তোর মতো ছিল তোর মা। এক জামা দুইবার পরতে চাইত না। রং-বেরংয়ের চুড়ি, ফিতা, নেইলপালিশ, আলতা, লিপস্টিক – সবটা চাই তার।
– কী বলছ! মাকে আমি কখনো সাজতে দেখিনি৷ সামান্য কাজলটুকুও চোখে ছোঁয়াতে দেখিনি। আমি একবার মাকে কাজল পরাতে গিয়েছিলাম, এমন ধমক দিয়েছিল!
– আগে সাজত। এখন সাজে না।
– কেন?
– বিয়ের পর যতদিন নতুন বউ ছিল, ততদিন কেউ সাজতে বারণ করেনি। কিন্তু দিন গড়াতেই শ্বশুরবাড়ি থেকে বাঁধা এলো। বাড়ির বউয়ের এত সাজসজ্জা লোকে বাঁকা নজরে দেখে। সেজেগুজে ঘরের কাজকর্ম করাটাও কঠিন ছিল। তাছাড়া তোর বাবার আর্থিক অবস্থাও ভালো ছিল না। স্বল্প আয়ে যেখানে সংসার চালানো মুশকিল সেখানে সাজসরঞ্জাম কেনা বিলাসিতা মাত্র৷ এদিকে নতুন একটা শাড়ির জন্য তোর মায়ের পুড়ত। শেষ হয়ে যাওয়া ক্রিমের কৌটাটা অবহেলায় একপাশে পড়ে থাকত। অভাবের সংসারে একসময় কাজল ফুরালো, আলতা ফুরালো। মাথার তেল শেষ হলো। পেটের দায়ে গয়নাগাটি বাজারে উঠল। আলমারি ভরা পাট করা শাড়ির জায়গায় জোড়া তালি দেওয়া শাড়ি জমল। ধীরে ধীরে মরে গেল তোর মায়ের মন। শখ -আহ্লাদ কোনো এক পুরনো দিনের ভাঁজে রেখে দিয়ে এখন অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছে স্বর্ণলতা।
এজন্যই তোকে নিয়ে, তোর শখ নিয়ে স্বর্ণলতা ভয় পায়। বিয়ের পর যদি শখ পূরণের পরিবেশ না পাস, তবে মানিয়ে নিতে বড্ড কষ্ট হবে তোর।
স্বর্ণলতা জানে, আশা-আকাঙ্ক্ষা-বাসনা বুকের ভেতর নীরবে মাটি চাপা দিতে কত কষ্ট হয়। ঘর পোড়া গরু, মেঘ দেখলে ভয় পায়৷ চোখের সামনে তোকে এমন শখ পুষতে দেখে নিজের কথা মনে পড়ে বোধহয়। এজন্যই সময় থাকতে তোকে আটকানোর চেষ্টা করতেছে।
– বাবা কি মাকে সাজতে দিত না?
– বউ পরিপাটি হয়ে থাকুক, সেটা কোন পুরুষ চায় না? সবাই চায়। কিন্তু সাজসরঞ্জাম কিনে দেওয়ার সামর্থ্য তোর বাবার ছিল না।
– তোমরা তাহলে আমাকে বড়লোক দেখে বিয়ে দিও৷
রাতের নিস্তব্ধতাকে খন্ড-বিখন্ড করে মাধবীলতা হেসে উঠলেন। সাঁঝের রেশমী চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
– বিয়ে আল্লাহর হাতে। তবে আমি চেষ্টা করব তোর শখকে সোনায় মুড়িয়ে রাখতে। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা। কার কপালে কি আছে, তা কি বলা যায়? তোর মাকেও আমরা বনেদি পরিবার দেখে বিয়ে দিয়েছিলাম। অথচ এখন তোদের অবস্থা দেখ।
– আমরা আগে বড়লোক ছিলাম?
– তবে কি আমরা এমন দুস্থ দেখে বিয়ে দিয়েছি স্বর্ণকে? আমার বাবা দেখেশুনে তার মেয়ে দুটোর বিয়ে দিয়েছিলেন। সরকারী চাকুরীজীবী ছেলে, বনেদি পরিবার। তোর খালু আর্মি, আর তোর বাবা হাইস্কুলের শিক্ষক।
– আমার একটু আধটু মনে আছে, বাবা তখন হাইস্কুলে চাকরি করত৷ এরপর চাকরিটা কেন ছাড়ল মনে নেই৷ অনেক ছোট ছিলাম তখন।
– তুই তখন কেজি স্কুলে। ফাইভে পড়িস৷ তখনি তোর বাবার চাকরিটা গেল।
– কীভাবে?
– মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়েছিল লোকে। স্কুলের সভাপতি, ম্যানেজিং কমেটি আর অধ্যাপক মিলে টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ দিত৷ স্কুলের বেশ কয়েকজন শিক্ষক এ ব্যাপারে জানত৷ তোর বাবার কানেও খবর পৌঁছে ছিল। তবুও সবাই নিজের চাকরি বাঁচাতে চুপ থেকেছে। সেইবার শারীরিক শিক্ষার জন্য নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া শুরু হলো। পছন্দনীয় ক্যান্ডিডেটের থেকে সাত লাখ টাকা ঘুষ চেয়েছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ। সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল৷ কিন্তু আরেকজন ক্যান্ডিডেট দশ লাখ টাকা অফার করে বসল। চাকরিটা ওকে দিতে হবে। সামনে থেকে আসা টাকার লোভ সামলাতে পারেনি স্কুল কতৃপক্ষ। দশ লাখ টাকার বিনিময়ে দ্বিতীয়জনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। এবার প্রথমজন চুপ করে থাকবে কেনো? বাবার জমি বিক্রি করে বেচারা টাকা ম্যানেজ করেছিল। এদিকে চাকরি পেল আরেকজন। জমিও গেল, চাকরিও গেল। সেই লোক ক্ষেপে গিয়ে স্কুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলো। এসব নিয়ে এলাকায় প্রচুর ঝামেলা হয়েছিল তখন। শিক্ষাবোর্ড থেকে তদন্তের জন্য অফিসার এসেছিল। স্কুলের সবাই চুপ থাকলেও তোর বাবা চুপ থাকেনি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে একাই রুখে দাঁড়িয়েছিল। সাক্ষী দিয়েছিল স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হয়নি৷
স্কুলের ম্যানেজিং বোর্ডের সভাপতি ছিল ভীষণ ধুরন্ধর ব্যক্তি। নিজে বাঁচতে ফাঁসিয়ে দিয়েছে তোর বাবাকে। ওই সপ্তাহেই তদন্ত কমিটির নিকট ম্যানেজিং বোর্ড রিপোর্ট জমা দিয়েছিল তোর বাবা আর অধ্যাপকের বিরুদ্ধে।
পরেরমাসেই ঘুষ নিয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগে স্কুলের অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপকের মানে তোর বাবার চাকরি চলে যায়।
– বাবা প্রতিবাদ করেনি? এটা তো অন্যায়।
– প্রতিবাদ করে কোনো লাভ হয়নি। স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে ম্যানেজিং বোর্ডের সবাই রিপোর্টের পক্ষে সাক্ষী দিয়েছে। এমনকি যে ব্যক্তির অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু হয়েছিল, সে ব্যক্তি পর্যন্তও বলেছে টাকা লেনদেনের সময় অধ্যাপকের সাথে তোর বাবাও সেখানে উপস্থিত ছিল।
– কী খারাপ মানুষ! ওকে বাঁচাতেই বাবা সাক্ষী দিয়েছিল, আর সেই মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে বাবাকে ফাঁসিয়ে দিল!
– হ্যাঁ দিল। নিজের স্বার্থে মানুষ সবকিছু করতে পারে৷ ওই লোক চাকরির জন্য সাত লাখ টাকা অলরেডি জমা দিয়ে ফেলেছিল। ম্যানেজিং বোর্ডের সভাপতি ওকে বলেছে, সে যদি মিথ্যা সাক্ষী দেয় তবে সাত লাখ টাকা ফিরিয়ে দিবে। সেই সাথে পরের সার্কুলারে ওকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগও দিবে। সেজন্যই সে মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে তোর বাবাকে ফাঁসিয়ে নিজের কার্যসিদ্ধি করে নিয়েছে।
– চাকরি দিয়েছিল উনাকে?
– হ্যাঁ। তোদের হাইস্কুলে এখন যে টিচার শারীরিক শিক্ষা ক্লাস নেয়, উনিই সেই ব্যক্তি।
– ছিহ! ভাবতেও ঘৃণা লাগছে, এমন একজনকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। শ্রদ্ধা করেছি।
– দুনিয়াটা এমনি, সাঁঝ। স্বার্থপরতায় ভরা। যারা অন্যায় করে, তারা কোনোকিছুতে ভয় পায় না। সেই ঘটনার পরেও স্কুলের অপকর্ম থেমে থাকেনি। প্রত্যেকটা নিয়োগে ওরা ঘুষ নিয়েছে। তোর বড় চাচাও তো একই স্কুলে ঘুষ দিয়ে চাকরিতে ঢুকেছে।মজার ব্যাপার কি জানিস? সানানের বাবার চাকরির আলোচনায় সাদিকও উপস্থিত ছিল।
– বাবা! যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে গিয়ে একদিন চাকরি হারাতে হয়েছে, সেই অন্যায় বাবা কীভাবে করতে পারল?
– করতে হয়েছে। বাধ্য হয়েছে করতে। সেসময় তোদের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। চাকরি হারিয়ে সাদিক বাড়িতে বসা। সানানের বাবাও চট্টগ্রাম থেকে পরিবার সমেত ফিরে এসে বাড়িতে উঠেছে। তোর ছোট চাচা নিজের পরিবার নিয়ে ঢাকায়। বাড়ির কোনো খোঁজ খবর সে রাখত না। তোদের পরিবার চলত সানানের নানা বাড়ির সহয়তায়। সেই বিপদের দিনে আফসানা একাই সংসারটা সামলিয়েছে। বাবার বাড়ি থেকে চাল, ডাল থেকে শুরু করে শাকসবজি কিনা নিয়ে এসেছে মেয়েটা! মানসম্মানের তোয়াক্কা করেনি।
তখন স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের জন্য আবার সার্কুলার দিল। সাদিকের যেহেতু চাকরি সম্ভব না, একমাত্র ভরসা ছিল সানানের বাবা। কিছু একটা না করলে না খেয়ে মরতে হবে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছিল। বাধ্য হয়ে অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়াতে হয়েছে তোর বাবাকে। ম্যানেজিং বোর্ড অবশ্য সাদিকের সাথে হওয়া অন্যায়ের ভর্তুকি হিসেবে খুব অল্প টাকা চার্জ করেছিল সানানের বাবার থেকে৷ দুই লাখ টাকার বিনিময়ে চাকরিটা পেয়ে যায় সানানের বাবা। সেটাও কিন্তু আফসানা তার বাবার বাড়ি থেকে এনে দিয়েছিল। মেয়েটা অনেক করেছে এই সংসারের জন্য। তোর বড় চাচা আজকে এতদূর আসতে পেরেছে শুধুমাত্র তার বউয়ের কারণে।
সাঁঝ নিশ্চুপ। অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছে। বড় মাকে কখনো এত উদার মনে হয়নি। সবসময় চাপা একটা অহং নাকের ডগায় নিয়ে ঘুরেন। যেন তিনি কোনো এক রাজ্যের রাজকন্যা। আর বাদবাকি সবাই অচ্ছুতজাতি। যাদের দিকে তাকালে কপালে ভাঁজ পড়ে আফসানার। সেই ব্যক্তি একসময় পুরো পরিবারের হাল ধরেছিল? কীভাবে সম্ভব? এজন্যই কি মা সবসময় বড় মায়ের গুনগান গায়?
– সাঁঝ?
– হুম?
– শাড়ি নিয়ে আজকে বাড়িতে যা হলো, এসব তাশফীনকে বলার দরকার নাই। ছেলেটার মন খারাপ হয়ে যাবে।
– ঠিক আছে। বলব না।
– তুইও এসব মনে রাখিস না। মা রাগ করে অনেক সময়, অনেক কিছু বলে থাকেন। এসব মনে রাখতে নেই। মায়েরা সবসময় সন্তানের ভালো চায়। মায়ের আচরণ এখন অযৌক্তিক মনে হলেও, যখন বড় হবি, বুঝতে শিখবি তখন মায়ের প্রতিটি কথা, প্রতিটি কাজের যৌক্তিকতা খুঁজে পাবি।
চলবে…
#অক্ষরময়ী
#এই_সাঁঝবাতি? পর্বঃ ১৪
গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ্দুরে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে একখানা শাড়ি কিনতে মার্কেটে যেতে হবে ভাবতেও গা শিউরে উঠছে সাঁঝের। সূর্যের দাপটে ঘরের ভেতর টিকে থাকা যেখানে মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে খোলা আকাশের নীচে জ্যামে বসে থাকলে তীব্র তাপদাহে সাঁঝ নিশ্চিত শুটকির মতো শুকিয়ে যাবে।
জুবিয়াটাও ভীষণ ব্যস্ত। সাঁঝকে মা একা ছাড়বেন না। অথচ পহেলা বৈশাখের জন্য একটা শাড়ি কেনা জরুরি। তাশফীন ভাইয়া বলেছে এবারে রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান দেখাতে নিয়ে যাবে।
লোকে শুনলে হয়তো হাসবে কিন্তু সাঁঝ কখনো ছায়ানটে বর্ষবরণ দেখেনি। বুঝ হওয়ার পর থেকে বাবাকে ব্যস্ত পেয়েছে। সবসময় শুধু ছুটছে। সাঁঝ যখন একা চলার মতো বড় হলো, তখন নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে পায়ে শেকল পরানো হলো। নির্দিষ্ট সীমানার বাইরে একা পা ফেলতে মানা। সাঁঝকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার মতোও কেউ ছিল না বাড়িতে।
এবার যখন সুযোগ এসেছে, সাঁঝ কিছুতেই তা হাত ছাড়া করবে না।
বাধ্য হয়ে ফেসবুক পেজগুলোতে শাড়ির খোঁজ করতে হলো। বাবা অবশ্য লুকিয়ে এক হাজার টাকা দিয়েছে সাঁঝকে। এই বাজেটের শাড়ি পাবে কিনা, এটাই চিন্তার বিষয়।
দিন রাত এক করে সাঁঝ শাড়ি খুঁজতে থাকল। পছন্দ হয় অনেক কয়েকটাই, কিন্তু দাম আকাশচুম্বী। যেগুলোর দাম কম, সেগুলো দেখতে তেমন একটা ভালো নয়।
মান খুব বেশি ভালো না হলেও চলবে। পরবে সেই একদিন। শুধু দেখতে একটু আকর্ষণীয় হওয়া চাই।
অবশেষে খুঁজতে খুঁজতে রত্নের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। একটা লাল শাড়ি খুঁজে পেয়েছে সাঁঝ। দামও হাতের নাগালে। মাত্র সাতশ টাকা। লাল জমিন আর পাড় জুড়ে সাদা রঙের আলপনা জলছাপ দেওয়া।
জুবিয়ারও শাড়িটা বেশ পছন্দ হয়েছে। দুই বান্ধবী দুটো শাড়ি নিয়ে ফেলল তখনি।
– এটা তুই কী করে করতে পারলি সাঁঝ? আমাদের সাতটায় বের হয়ে যাওয়ার কথা ছিল।
সাঁঝের বিছানায় বিরস মুখে বসে আছে জুবিয়া। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে বাড়ির কাজ শেষ করে, শাড়ি পরে রেডি হয়ে মোহাম্মদপুর থেকে এসে দেখে সাঁঝ তখনো ঘুমাচ্ছে। কার না মেজাজ খারাপ হয়?
– এলার্ম সেট করে ঘুমিয়েছিলাম। কখন বেজেছে, কখন কেটে দিয়েছি – কে জানে! মায়েরও দোষ আছে। একবারও ডাকেনি আমাকে।
– আন্টি তোকে ডেকে ডেকে বিরক্ত হয়ে নিজের কাজে চলে গেছেন। শুধু মাত্র দরজা ভাঙা বাকি ছিল। এত ঘুম কেউ কীভাবে ঘুমায় আমি বুঝি না। বিয়ের পর এই গভীর ঘুমের জন্য জামাইয়ের পিটুনি খাবি তুই দেখে নিস।
– বদদোয়া দিচ্ছিস?
বাথরুম থেকে উঁকি দিল সাঁঝ। চোখে টলটল অভিমান। জুবিয়া তাকাল না ওর চোখের দিকে। মেয়েটার মুখ জুড়ে এত মায়া! চোখ দুটো যেন শান্ত দীঘি। সতেজ, শীতল বাতাসে সারাক্ষণ চিকন ঢেউ খেলে যায়।
– রাতে নিশ্চয়ই দেরী করে ঘুমিয়েছিস?
– ওই একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল। ইচ্ছে করে করিনি। শাড়ির সাথে জুয়েলারি, জুতো ম্যাচিং করে রাখা, সাজগোজের জিনিসপত্র চুজ করা, ফুল ম্যানেজ করা। আরও কত কাজ করতে হয়েছে জানিস? শুধু পারফিউমটা খুঁজতে ঘন্টাখানেক লেগেছে।
– কোথাও যাওয়ার আগের রাতে আউটফিট, অর্নামেন্ট টেবিলের উপর সাজিয়ে রেখে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকে কী আনন্দ পাস তুই জানিস। ক্রিঞ্জি ব্যাপার-স্যাপার। এখনো বের হচ্ছিস না কেনো? এতক্ষণ বাথরুমে কি করতেছিস তুই?
– আসতেছি বাপু। শ্বাসটাও নিতে দিবে না এখন।
– কখন শাড়ি পরবে, কখন সাজবে! সাজতে বসলে আবার এক ঘন্টা ওখানেই গেল। ইয়া খোদা!
– আমার শাড়ি পরতে বড়জোর পাঁচ মিনিট লাগবে।
– মাসে হাজারবার শাড়ি পরলে আমিও এক্সপার্ট হয়ে যেতাম। এমন ঝটপট যদি বাকি কাজগুলোও করতি! অন্তত মেকআপটা…
– আজকে আমি পাঁচ মিনিটে মেকআপ শেষ করে তোকে অবাক করে দিব।
– চাপাবাজী কম করবি আমার সাথে।
– যাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ। কালকে রাতে একটা টিউটোরিয়াল ভিডিও দেখেছে আমি।
– এই মূহুর্তে অন্তত এক্সপেরিমেন্ট করতে বসিস না। দোহাই লাগে। এমনিতেই সময় নাই। ঠিকঠাক মেকআপ করতে না পারলে আরও সময় গচ্চা যাবে।
– আরে কিছু হবে না। আমার উপর ভরসা রাখ।
– তোকে আমি একটু ভরসা করতে পারি না। অন্তত এই ব্যাপারে তো একদমই না।
– সাজগোজের ব্যাপারে আমাকে সন্দেহ করা তোর সাজে না।
– মেকআপ ঘেটে গেলে?
– ওভাবেই বের হয়ে যাব। ঠিক আছে?
– ওকে ডান।
শাড়িটা কোমড়ে প্যাঁচিয়ে চুলগুলো খোঁপা বেঁধে সাঁঝ একটা টুল নিয়ে বসল ড্রেসিং টেবিলের সামনে। মুখে ময়েশ্চারাইজার মেখে ব্রাশটা হাতে তুলে নিয়ে জুবিয়ার দিকে ফিরে তাকিয়ে ভ্রু উঁচু করে হাসল। জুবিয়া তখনো সন্দিহান। পাঁচ মিনিটে রেডি হওয়ার গালগল্প সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না।
ব্রাশে সামান্য ফাউন্ডেশন নিয়ে মুখে ছোঁয়ালো।
চোখের নিচে কনসিলার, গালে-নাকে কন্ট্রোলারও হাতের আঙ্গুল দিয়ে সেট করল। পাউডারদানী থেকে হালকা পাউডার ছোঁয়ালো মুখে। তুলির সাহায্যে হালকা ব্লাশ দিল গালে, নাকের ডগায়। ব্রাউন কালারের আইশেডো, মাসকারা ও কাজলে সেজে উঠল টলটলে চোখ দুটো। পীচ কালারের লিপস্টিকে রাঙালো ঠোঁট। নিয়মিত ব্যবহার্য সেই কালো ছোট্ট টিপটা দিল কপালে।
টুল থেকে উঠে লিপস্টিকটা জুবিয়ার দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল,
– কয় মিনিট হয়েছে?
– ছয় মিনিট।
– নট ব্যাড। প্রথমবার হিসেবে অনেক কম সময়। লাল লিপস্টিকটা মুছে এই লিপস্টিকটা দে। আমি ততক্ষণে ঝুমকা আর চুড়িটা পরে নেই।
সাঁঝ, জুবিয়া ঘর থেকে বের হলো হৈ-রৈ করতে করতে। যেন হাঁটতে চলতেই নাস্তা তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। ধমক দিতে আসছিল স্বর্ণলতা, কিন্তু চোখের সামনে দুজন স্বর্গলোকের অপ্সরাকে দেখে উনার পা দুটো আপনা থেকেই থেমে গেল।
সাঁঝ যখন খিলখিলিয়ে হেসে প্রশ্ন করল,
– কেমন লাগছে?
স্বর্ণলতা নিজের প্রতিক্রিয়ায় লজ্জা পেয়ে দ্রুত সরে গেলেন সেখান থেকে। ছদ্ম রাগ দেখিয়ে শাসানোর চেষ্টা করলেন,
– খেতে আয় তাড়াতাড়ি। ছেলেটা কখন থেকে অপেক্ষা করে আছে।
অন্যদিকেতাশফীন বসে চা খাচ্ছিল। এই দুই মহান নারীর অপেক্ষায় প্রহর গোনা এখন তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। বিরক্ত, তাড়া, অস্থিরতা কোনটাই আর বোধ হচ্ছে না।
সাঁঝকে দেখে তাশফীনের সকল অপেক্ষা যেন গন্তব্য খুঁজে পেয়েছে। নিশ্চল দেহ, থমকানো দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে সম্মুখে। অসাড়তা ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত সত্তায়।
– ভাইয়া, তুমি নাস্তা করেছো? একি! তোমার পাঞ্জাবিতে চা পড়েছে যে।
সাঁঝ ছুটে এসে হাঁটু গেড়ে বসল তাশফীনের পায়ের কাছে। সাদা পাঞ্জাবির নিচের এককোণায় চা পড়ে ভেসে যাচ্ছে। সাঁঝ দ্রুত হাতে তরলটুকু ছেঁকে ফেলে দিল। জুবিয়াও দৌড়ে এসে এমন পরিস্থিতি দেখে খানিকটা ভড়কে গেল। নতুন পাঞ্জাবিটা নষ্ট হয়ে গেলে?
– বাথরুমে গিয়ে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। না হলে চায়ের দাগ বসে যাবে।
জুবিয়ার কথায় দ্রুত সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো তাশফীন। অপ্সরাদের রূপে বিমোহিত হয়ে চায়ের কাপ ছলকে উঠেছে। কী এক বিব্রতকর পরিস্থিতি! পাঞ্জাবির কোণা চিপে ধরে তাশফীন ছুটল বাথরুমে।
°
পুরনো শ্যাওলা পড়া দেয়ালের গা বেয়ে একেবেকে চলেছে একটা কুঞ্জলতা গাছ। নরম সবুজ রঙয়ে ছেয়ে গেছে চারপাশ। দেয়ালের পাশ দিয়ে চলে গেছে একটা ময়লার ড্রেন। ঢাকনা ছাড়া নোংরা ড্রেনটার ওপাশে সাবধানে পা রাখল সাঁঝ। হাত বাড়িয়ে টুপ করে একটা কুঞ্জলতা ছিঁড়ে গুজলো চুলে।
“এই তো হেথায় কুঞ্জ ছায়ায়
স্বপ্ন মধুর মোহে…”
আপন মনে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে হাঁটছিল সাঁঝ। কানে ফুল গুজেছে বলে মনটা বেশ ফুরফুরে। দামী গয়না কিংবা রাস্তার ধারের অবহেলিত ফুল – শৃঙ্গারের পরে সাঁঝের আত্মবিশ্বাস আকাশ ছুঁয়ে যায়। মনে হয় হাওয়ায় উড়ছে, রোদের মতো হাসছে।
“তুমি জ্বালাইয়া গেলা মনের আগুন নিভাইয়া গেলা না..”
বিশ্রী সুর, বিদঘুটে হাসি, ইঙ্গিতপূর্ণ অঙ্গভঙ্গিতে ক্ষণিকেই মনটা বিষিয়ে উঠল সাঁঝের। ওড়নার কোণ চেপে রাস্তার সাথে মিশে যেতে চাইল। আড়চোখে একবার চেয়েও দেখল ছেলেগুলোকে। সাঁঝের থেকে দুই তিন বছরের বড় হবে। ওরা এপাড়ার ছেলে নয়। সিটি কর্পোরেশনের উপ-নির্বাচনের ঘোষণা হয়েছে গতকাল। নির্বাচনী প্রচারণার পোস্টার লাগাতে এসেছে।
সাঁঝ দ্রুত পা চালিয়ে রাস্তাটা পেরিয়ে যেতে চাইল। হাতের মুঠোয় খুলে নিল কুঞ্জলতা ফুলটা।
হঠাৎ করে পেছনে হৈ চৈ শুরু হয়েছে। দেখবে না, দেখবে না করেও সাঁঝ ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। ছেলেগুলোকে ঘিরে বেশ বড় একটা জটলা বেঁধে গেছে ইতিমধ্যে। এপাড়ার কয়েকজন ছেলে পল্লবের দোকানে চা খাচ্ছিল। ওরাই আটকে ফেলেছে ছেলেগুলোকে। এদের মধ্যে কয়েকজনকে সাঁঝ চিনে। সানান ভাইয়ের সাথে পল্লবের দোকানে চা খেতে দেখেছে কয়েকবার।
এমন পরিস্থিতে স্বর্ণলতার আদেশ অনুসারে দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যাওয়া দরকার। কিন্তু সাঁঝ বেশ আগ্রহবোধ করল। ছেলেগুলো একটু আগেই তাকে হেনস্থা করেছে। ওদের কি শাস্তি হয়, তা স্বচক্ষে দেখার বাসনা সাঁঝকে খানিকটা সাহসী করে তুলেছে।
লম্বা মতো ছেলেটা যে ঠাস ঠাস করে চড় বসাচ্ছে অপরিচিত ছেলেগুলোর গালে, ওকে সাঁঝ চিনে। ওর নাম আজিম। পাড়ায় সবচেয়ে বড় ক্লাবটার সভাপতি সে। আজিমের আরেকটা পরিচয় হলো, সে সানান ভাইয়ের কাছের বন্ধু। এদের সাথে বন্ধুত্ব করার দায়ে বড় বাবার কাছে বেশ কয়েকদফা বকা খেয়েছে সানান ভাই। কিন্তু লাভের কিছু হয়নি। ক্লান্ত হয়ে বড় বাবা বকাবকি থামিয়ে দিয়েছে, কিন্তু সানান ভাই থামেনি। এখনো এই বেপরোয়া ছেলেগুলোর সাথে মাঝরাত অব্ধি জুটিয়ে আড্ডা দেয় সানান ভাই।অবশ্য বন্ধু হিসেবে ছেলেগুলো খারাপ নয়। বরং একটু বেশি ভালো। এদিক থেকেও বরাবরের মতো সানানা ভাইয়ের লাক ভালো।
রোমাঞ্চর ঘটনাটি চেয়ে দেখতে দেখতে সাঁঝ হকচকিয়ে গেল। একটা ছেলের শার্টের কলার ধরে এদিকেই টেনে নিয়ে আসছে আজিম। ওরা কি সাঁঝের কাছে আসছে? বিস্মিত সাঁঝ অস্থিরচিত্ত নিয়ে হতবাক দাঁড়িয়ে রইল। অথচ এই মূহুর্তে ওর উচিত দৌড়ে বাড়ির দিকে চলে যাওয়া।
– স্যরি বল।
সাঁঝের সামনে দাঁড় করিয়ে ছেলেটাকে ধমকে উঠল আজিম। ভয় পেল সাঁঝ। দু পা পিছিয়ে গিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকাল। ছেলেটা রক্তিম চোখে সাঁঝের দিকে তাকিয়ে শীতল গলায় ক্ষমা চাইল।
– স্যরি আপু বল।
আজিমের ধমকে তোতা পাখির মতো আরেকবার কথাগুলো আওড়ালো ছেলেটা। সাঁঝ লক্ষ্য করল, ইতিমধ্যে ছেলেটার ঠোঁট কেটে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে। সাঁঝের কিছু বলা উচিত, কিন্তু গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। হাঁটু কাঁপছে খানিকটা।
– আর যদি এই পাড়ায় দেখি, পা ভেঙে রেখে দেব। জিনিসপত্র নিয়ে ভাগ এখান থেকে। ওই গুঞ্জন, এদের পোস্টারগুলো সব ছিঁড়ে ফেল।
ক্লাবের ছেলেরা হুমড়ি কেটে পড়ল দেয়ালে লাগানো পোস্টারের উপর। সাঁঝের আর কিছু দেখার সাহস হলো না। কম্পিত পায়ে ছুটতে শুরু করল বাড়ির দিকে।
°
অলস বিকেলে বারান্দায় বসে আছে সাঁঝ। কায়দা করে আজকে বাবার মোবাইলটা সে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। গ্যালারিতে সাঁঝের অনেকগুলো ছবি জমা হয়েছে। একেকটা ছবি চাঁদের মতো সুন্দর। এই সুন্দর ছবিগুলো ফেসবুকে আপলোড দিতে না পারার কষ্টে সাঁঝের বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা হচ্ছে। অথচ ফেসবুকে ঘাপটি মেরে আছে সানান ভাই। ছবি আপলোড দেওয়া মাত্র সেই খবর বাবার কানে চলে যাবে।
শেষবার ধমকও দিয়েছিলেন, মায়ের কানে তুলবেন ফেসবুক আইডির কথাটা। ছবি আপলোডের খবরটা দেওয়ার দরকার নাই। শুধুমাত্র ফেসবুক আইডির কথা শুনলেই তাণ্ডব শুরু হয়ে যাবে বাড়িতে। এই মূহুর্তে কোনো ঝড়-তুফান চায় না সাঁঝ। এমনিতেই সামনে এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট। সাঁঝের বিশ্বাস সে দুটো গোল্লা পাবে। এরপরে আবার কলেজে ভর্তি। মা জেদ ধরেছে, বিয়ে না করিয়ে তিনি কিছুতেই সাঁঝকে কলেজে ভর্তি করাবেন না। এতোসব ঝামেলা অপেক্ষা করছে সাঁঝের জন্য।
এখন নতুন টপিক সামনে এনে মায়ের মেজাজ খারাপ করানো যাবে না। তাই বুকে পাথর চেপে বসে আছে সাঁঝ। এই কয়েকটা দিন ফুল, পাতা, সূর্য, আকাশ-পাতালের ছবি আপলোড করেছে ফেসবুকে। লাইক, কমেন্ট আসছে যদিও, কিন্তু সাঁঝের কষ্ট হচ্ছে নিজের ছবিগুলোর জন্য।
উদাস নয়নে আকাশে মেঘের ভেলা দেখতে দেখতে সাঁঝ মেসেজ লিখল,
– আমার বুক ব্যথা করতেছে।
ক্ষণিকবাদে উত্তর এলো। এই সময়টা খানিক বিশ্রাম নেয় জুবিয়া। বিছানায় হেলান দিয়ে টাইপ করল,
– কেনো? কী হলো হঠাৎ! উল্টাপাল্টা কিছু খাইছিস ?
– আমার এত সুন্দর, সুন্দর ছবিগুলো আপলোড দিতে পারছি না। কাউকে দেখাতে পারছি না। কপ্লিমেন্ট পাচ্ছি না। এত দুঃখ আমার ছোট্ট মনটা নিতে পারতেছে না।
– নাটক কম কর হারামি।
– জুবু…
– কি?
– তুই আমার কষ্টটা বুঝতেছিস না কেনো?
– কষ্ট বুঝলাম। তারপর?
– এখন আমি কি করব? উপায় বল।
– সানান ভাইকে ব্লক দে।
– আজকেই আম্মুকে এসে বলে দিবে।
– তাহলে ফটো আপলোড দেওয়ার আশা চিরতরে বাদ দে।
– আমার এত সুন্দর ছবিগুলো অবহেলায়, অনাদরে পড়ে থাকবে?
– আপলোড দিলি, লোকে দেখল। তাতে কি লাভ হলো?
– সুন্দর, সুন্দর মন্তব্য পেলাম। আমার মন ভালো হয়ে গেল। কেউ আমার প্রশংসা করলে আমার অনেক ভালো লাগে।
– এক কাজ কর। ছবিগুলো আমাকে পাঠিয়ে দে। আমি দেখি, মন্তব্য করি। তুই পড়ে মন ভালো করে ফেল। হবে না?
– দারুণ আইডিয়া। তুই আসলেই জিনিয়াস। দাঁড়া এক্ষুণি পাঠাচ্ছি।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না জুবিয়াকে। বৃষ্টির দিনে শাড়ি পরে তোলা ছবি থেকে শুরু করে গতকাল পর্যন্ত যত ছবি সাঁঝ তুলেছে সবগুলো এলো জুবিয়ার মেসেঞ্জারে।
– ভালো কমেন্ট করবি।
সাঁঝের মেসেজ দেখে জুবিয়া হাসল। ধরে ধরে প্রতিটি ছবির জন্য মন্তব্য লিখল দ্রুত।
– মন ভালো হয়েছে?
– খুব হয়েছে। আইডিয়াটা দারুণ। সানান ভাই এবার কিছু বলতে পারবে না। উনার আদেশ অমান্য করা হলো না, আবার ছবি শেয়ার করাও হলো। দাঁড়া, আরও কয়েকজন ক্লোজ ফ্রেন্ডকে পাঠাই।
– দেখেশুনে। অপরিচিত কাউকে পাঠাতে যাস না আবার।
– ওকে টিচার।
সাঁঝের বেশ উচ্ছ্বসিত লাগছিল। বেছেবেছে কয়েকটা ছবি সিলেক্ট করে পাঠালো কয়েকটা পরিচিত ফ্রেন্ডের একাউন্টে। যেখানে কাজিন গ্রুপের কয়েকজনের একাউন্টও সামিল ছিল।
সবাই বেশ প্রশংসা করল সাঁঝের।
তাশফীন লিখেছে,
– দেখতে হবে ফটোগ্রাফার কে।
– মডেলের কোনো ক্রেডিট নেই?
– অবশ্যই আছে। বিশাল আকাশের চাঁদটা তো সেই-ই।
গোধূলি আলো তখন আকাশে নিজের রঙ ছড়িয়েছে। সেই মূহুর্তে ঘর ছাড়ল সাঁঝ। ছাদের মেঝেতে ওড়না ছড়িয়ে বসল। খোলা চুল, কানে ঝুমকা, গোলাপি থ্রি-পিস গায়ে। প্রসাধনী হিসেবে গালে মেখেছে গোধূলি বেলার কনে দেখা আলো।
সেলফি ক্যামেরায় ঝটপট ক্যাপচার করল কয়েকটি ছবি। তারপর সেগুলো পাঠিয়ে দিল গুটিকয়েক বন্ধুদের মেসেঞ্জারে।
হালকা কিছু কথা হচ্ছিল মেসেঞ্জারে। সাঁঝের ঝুমকা, লম্বা চুল আর গায়ের জামাটা নিয়ে। নিউমার্কেটের একটা দোকান থেকে খুব কম দামে কেনা জামাটা কাজিনমহলে এত প্রশংসা পাবে সেটা কে জানত! সাঁঝ মিটমিটিয়ে হাসছিল। তখনি এলো মেসেজটা।
সানান ভাই লিখেছে,
– আর একটা ছবি যদি আমার মেসেঞ্জারে আসে এই মূহুর্তে তোদের বাড়ি গিয়ে তোর মোবাইলটা সহ তোকেও আছাড় মেরে আসব।
মেসেজটা পড়তে গিয়ে সাঁঝের কানে বাজল সানান ভাইয়ের মেঘমন্দ্র স্বর। উপরের মেসেজগুলো স্ক্রল করে দেখল, ছবি পাঠাতে গিয়ে কখন যেন সানান ভাইয়ের একাউন্টটা সিলেক্ট করে ফেলেছিল। নীল শাড়ী পরে বৃষ্টিতে ভেজা, বসুন্ধরার লিফটে মিরর সেলফি, পহেলা বৈশাখের লাল টুকটুকে শাড়ি এবং একটু আগে তোলা গোধূলিবেলায় উদাস হয়ে গালে হাত দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকা – সবগুলো ছবিই পাঠানো হয়েছে সানান ভাইয়ের একাউন্টে। সাঁঝ জিহ্বায় বেশ করে একটা কামড় দিয়ে মেসেঞ্জার থেকে বের হয়ে টুপ করে ডাটা অফ করে দিল।
°
মিটিংয়ের মাঝখানে সানান ভাইয়ের চেহারার রঙ উড়ে যাওয়ার ব্যাপারটা নজরে এড়ায়নি জাদিদের। বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে কানের কাছে মুখ নামিয়ে জানতে চাইল,
– এনি থিং রং?
সানান ভাই গম্ভীর মুখটা তুলে চাইল। অন্যমনস্ক রয়ে আওড়ালো,
– হুম?
– তোকে অস্থির দেখাচ্ছে।
সানান ভাই উত্তর দিল না। চট করে মাথাটা দুদিকে দুলিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। যেন মস্তিষ্কের ভেতরকার কোনো জট ছড়াচ্ছে। শিরদাঁড়া সোজা করে সামনে তকিয়ে আত্মবিশ্বাসী মানুষটা দীপ্ত স্বরে ঘোষণা করল হঠাৎ,
– আজকের বিফ্রিং এ পর্যন্ত-ই। যাকে যে কাজ বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেই অনুযায়ী কাজ করবেন। ডেটলাইন শেষ হওয়ার আগেই আমার টেবিলে রিপোর্ট জমা দেওয়া চাই।
একটানা কথাগুলো বলে হতভম্ব সবাইকে বিস্ময়ের দ্বারপ্রান্তে রেখে সানান ভাই বেরিয়ে গেল। জাদিদ ছুটে গিয়ে সানান ভাইকে পাকড়াও করলেও সন্তোষজনক উত্তর পেল না। উল্টো সানান ভাই শার্টের একটা বোতাম খুলে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে বলল,
– এসব বালছালের ড্রেস আমি কি এমনিতেই পরতে চাই না? গরমে সেদ্ধ হয়ে গেলাম বাল।
এমন অভিযোগ শুনে বোকা বনে গেল জাদিদ। এসি রুমে বসে কেউ কীভাবে গরমে সেদ্ধ হয়ে যায়! বিভ্রান্ত জাদিদ মজা করে বলল,
– আজব! হঠাৎ হট ফিল করার মতো কী এমন ঘটল, মামা?
সানান ভাই ধ্বংসাত্মক চাহনী ফিরিয়ে দিয়ে বলল,
– ভালো লাগতেছে না। বাড়ি গেলাম।
কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করে সত্যি সানান ভাই বেরিয়ে গেল।
চলবে..
#অক্ষরময়ী