এই সাঁঝবাতি পর্ব-১৫+১৬

0
16

#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব ১৫

সদর দরজাটি খুলে সাঁঝের মনে হলো সে অতল সামুদ্রিক নীরবতা পেরিয়ে হুট করে শহুরে কোলাহলে আছড়ে পড়েছে৷
বাড়ি জুড়ে অদ্ভুত চাঞ্চল্য বিরাজ করছে৷ মাত্র আধাঘন্টার জন্য বাইরে গিয়েছিল সাঁঝ৷ পাশের পাড়ায় বান্ধবী নীলিমার সাথে সাক্ষাৎ হয়নি বহুদিন৷ ঘরবন্দী মনটার উচাটন ঠেকাতে বাইরের হাওয়া বাতাস দরকার ছিল৷ স্বর্ণলতার মনটাও ফুরফুরে ছিল বোধহয়৷ অনুরোধ মাত্র অনুমতি দিয়েছেন৷
নীলিমার সাথে দেখা করে ফেরার পথে রাস্তায় যে তিক্ত ঘটনার সম্মুখীন সাঁঝকে হতে হয়েছে, সেই তিক্ততা বাড়ি ফিরে যেন বহুগুণ বেড়ে গেল৷ এমন বাড়িতে ফেরার থেকে রাস্তায় গন্তব্যহীন পায়েচারি ঢের ভালো৷

ড্রয়িংরুমের মেঝে থেকে কুশন দুটো তুলে সোফায় রেখে দিল সাঁঝ। মেয়েকে দেখে রান্নাঘর থেকে স্বর্ণলতা দ্রুত পায়ে এসে ফিসফিসিয়ে জানালেন,

– তোর ছোট ফুপু এসেছে৷

এমনটাই ভেবেছিল সাঁঝ৷ ছোট ফুপু বাড়িতে এলে এমন মাছের হাট বসে যায়৷ সাঁঝ বুঝতে পারল না, ফুপু কোন মন্ত্রী-মিনিস্টার যে তার আগমন বার্তা এভাবে ফিসফিসিয়ে সতর্কতার সাথে জানাতে হবে?

– তোর দাদীর ঘরে আছে৷ যা দেখা করে আয়। মুখটা এমন প্যাঁচার মতো করে রাখছিস কেন? মুখ ঠিক কর। ভালোভাবে কথা বলবি৷

– কোনোদিন খারাপভাবে কথা বলেছি? সে সুযোগ আছে এ বাড়িতে?

সাঁঝ বিরস মুখটাতে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে সাওদা বেগমের ঘরে গিয়ে দেখল বিছানায় পা তুলে বসে আছেন সাবা। সালাম শুনে পেছনে ফিরে তাকিয়ে চোখ দুটো তীক্ষ্ণ করে ফেললেন৷

– কেমন আছেন, ফুপু?

– ভালোই আছে৷ কিন্তু তুই এমন শুকাইছিস কেন? চেহারার কী অবস্থা! খাওয়া দাওয়া ঠিক করে করিস না? রাতে বোধহয় ঠিকঠাক ঘুমাইসও না। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে৷

সাঁঝের হাস্যমুখটিতে ঝট করে আঁধার নামল। বডিশেমিং ব্যাপারটা এই জেনারেশন কখনো বুঝবে না৷ সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্বে খুটিয়ে খুটিয়ে ক্রুটি বের না করলে ছোট ফুপুর আত্মা শান্তি পায় না৷

ঘরে শুয়ে বসে থেকে এই কয়েকদিনে সাঁঝের ওজন বেড়েছে পাঁচ কেজি। দিন রাত এক করে ঘুমানোর ফল৷ রৌদ্রহীন ঘরে দীর্ঘদিন ছায়ায় অবস্থানের কারণে ত্বকের উজ্জ্বলতা বেড়েছে অনেকখানি৷ তবুও সাঁঝ প্রতিবাদ না করে ছোট ফুপুর আত্মাকে শান্তি পেতে দিল৷

অযথা ওড়নায় আঙ্গুল পেঁচিয়ে বলল,

– সামনে রেজাল্ট, তাই নিয়ে একটু টেনশনে আছি। এজন্য বোধহয় শুকনা লাগছে৷

– রোদের মধ্যে বাইরে থেকে আসলো, এজন্য মুখটা শুকনা লাগতেছে৷

সাওদা বেগমের কথায় সাবার মুখে কুটিলতা জ্বল জ্বল করে ভেসে উঠল। অবাক বিস্ময়ে বললেন,

– এই সন্ধ্যাবেলা বাইরে গেছে মানে? এত বড় মাইয়ারে তোমরা রাত-বিরাতে পাড়া ঘুরতে এলাও করো কীভাবে? শাসন-বারণের বালাই নাই! তুমিও কিছু কও না, আম্মা? আমাদের বেলায় খুব শাসন করতা৷ নাতনির বেলায় চুপ কেন?

– আমারে কেউ জিগায় এখন? বুড়ি হই গেছি না।

– দেখতেছি সব। বাড়ির মালিকানা এখন বউদের হাতে। কবে যেন আমাদের মুখের উপরও দরজা বন্ধ হয়ে যায়৷ বাপ নাই। মা থেকেও নাই৷ আমাদের কি আর কোনো অধিকার আছে এই বাড়িতে?

দুজনের বক্তব্যের মাঝে নিজের উপস্তিতির কোনো কারণ খুঁজে পেলা না সাঁঝ৷ সে কি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি চলে যাবে? চলে গেলে সেটা আবার বেয়াদবি হিসেবে আখ্যায়িত করতে ছোট ফুপুর সময় লাগবে না।
কণ্ঠে যথাসম্ভব নম্রতা বজায় রেখে সাঁঝ প্রশ্ন করল,

– চা খেয়েছেন, ফুপু?

– দিলে না খাবো৷ সেই কখন এক কাপ চা দিতে বলছি। কী যে করতেছে তোর মা!

– আমি খোঁজ নিয়ে দেখতেছি৷

সুযোগ বুঝে দ্রুত বেরিয়ে এলো সাঁঝ। ছোট ফুপুর সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি। সবসময় খুঁত ধরায় ব্যস্ত থাকেন।

– চায়ের জন্য মরে যাচ্ছে ওদিকে৷ দেও না কেন এক কাপ চা বানায়৷

সাঁঝের কথায় ব্যস্ত স্বর্ণলতা চোখ পাকিয়ে তাকালেন৷ প্লেটে নুডলস ঢেলে বললেন,

– দিনদিন খুব বেয়াদব হয়ে যাচ্ছিস। কথার কী শ্রী! বড়দের সাথে এভাবে কথা বলা শিখিয়েছি আমি?

– যে যেমন তার সাথে তেমন আচরণ করতে হয়৷

– এই শিক্ষা নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গেলে দুই দিনে বাপের বাড়ি ফেরত পাঠাবে। উঠতে বসতে শাশুড়ির বকা শুনবি। সাথে আমাকেও শুনাবি। লোকে বলবে, আমি ঠিকঠাক মেয়ে মানুষ করতে পারি নাই৷ নাস্তাটা ওদের দিয়ে আয়। চা হয়ে গেছে৷

– শুধু ফুপুকে দেখলাম। বাকিরা কই?

– সাবিলের ঘরে বোধহয়।

নাস্তা দিতে গিয়ে আরেক মুশকিলে পড়ল সাঁঝ। সবাইকে একত্রিত করা গেল না৷ যার যার ঘরে পৌঁছে দিতে হলো খাবার। সাবিলের ঘরে পাওয়া গেল ইশানকে৷ তিনজনে মিলে একটা মোবাইলের স্ক্রীনে তাকিয়ে স্পাইডার ম্যান সিনেমা দেখছে৷ ইশানাকে খুঁজতে গিয়ে সাঁঝের চক্ষু চড়কগাছ৷ সাঁঝের ঘরে ঘাপটি মেরে বসে ছিল শয়তান মেয়েটা৷ বয়স পনেরো হলে কী হবে, স্বভাবে হয়েছে একদম বিচ্ছু৷ এসেই গোয়েন্দাগিরি শুরু করে দিবে। সাঁঝের ঘরে কোথায় কি আছে সব খুটিয়ে খুটিয়ে দেখবে৷ যেটা পছন্দ হবে, ব্যাগে ভরবে। জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজনও বোধ করবে না। অভিযোগ করতে গেলে, সবাই উল্টো বেয়াদবটার পক্ষ নিয়ে সাঁঝকেই শাসাবে।
নিয়েছে তো কি হয়েছে? ছোটবোন হয় নিতেই পারে।সাঁঝের মনে এতো হিংসা!
এই নিয়ে ছোট ফুপু আফসোসের আসর পেতে বসবেন৷ মায়ের হাতে আরও দু ঘা খেতে হবে সাঁঝকে।

ইশানার হাত থেকে লিপস্টিকটা নিয়ে নিচু গলায় ধমকের সুরে সাঁঝ বলল,

– নাস্তা দিয়েছি দাদীর ঘর৷ ফুপু ডাকতেছেন তোমাকে।

ইশানাকে দাদীর ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে সাঁঝ ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেল রান্নাঘরে৷ মুখ ফুলিয়ে লিপস্টিকটা সামনে ধরে বলল,

– দেখো, আমার লিপস্টিকটার কি হাল করছে। ভেঙে ফেলছে পুরোটা৷

– বাইরে ফালায় রাখছিস কেন? তুলে রাখতে পারিস নাই৷

– ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে রাখছি। আর কই রাখব? ওখানে গিয়ে হামলা চালাইছে শাকচুন্নিটা৷ তুমি বারণ করে দেও ওকে৷ আমার জিনিসে যাতে হাত না দেয়৷

– চুপ থাক৷ তোর দাদীর কানে গেলে আবার চিল্লাচিল্লি শুরু করবে। দুই দিনের জন্য মেহমান আসছে। ঝামেলা করিস না। নিজের জিনিসপত্র গুছায় রাখ।

– কেন আসছে এরা?

– সাবার দেবরের ছেলেটার বিয়ে৷ দাওয়াত দিতে আসছে৷

– দাওয়াত দিতে পুরো গুষ্টিশুদ্ধ হাজির হওয়া লাগে? পুরো বাড়ি এলোমেলো করে ফেলছে। এরা আমাদের বাড়িতে কেন আসে প্রতিবার? বড় বাবার ওখানে যাইতে পারে না? ওদের কতোগুলা রুম ফাঁকা পড়ে আছে৷

– মেয়েরা আসে মায়ের কাছে। ওর দাদী আমাদের কাছে আছে। স্বাভাবিকভাবে উনার মেয়েরা আমাদের এখানেই আসবে৷ তাছাড়া সানানের মা এসব ঝামেলা কাঁধে নেওয়ার লোক? এক মিনিটও সহ্য করবে না৷ এরাও ভাবীর ওখানে টিকতে পারবে না, বলে ওদিকে যায় না।

সাওদা বেগমের ঘর থেকে ডাক পরায় সাঁঝকে আবার ছুটতে হলো। মেয়েটা বাড়ি এসেছে থেকে শুধু ছুটেই যাচ্ছে৷ ফুটবলের মতো কখনো এর পায়ে, কখনো ওর পায়ে।

– নাস্তা নে সাঁঝ। মা-মেয়ে এতো কীসের কথা বলতেছিস রান্নাঘরে?

– রাতের রান্না নিয়ে কথা বলছিলাম ফুপু।

– রান্নাবান্না পারিস কিছু?

– হুম। সবই পারি।

– যাক ভালো৷ শ্বশুরবাড়িতে কথা শুনতে হবে না। বয়স তো অনেক হইল, তোর বাপ বিয়েশাদি নিয়ে কিছু ভাবতেছে?

– মাত্র এসএসসি শেষ হলো…

– এইট পাশ করে বড় আপার বিয়ে হইছে৷ আমার তো এসএসসি পরীক্ষা শেষ করে এসেই বিয়ে হলো। শেষ পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি এসে দেখি ছেলেপক্ষ বসে আছে। সেদিনই এই বাড়িতে, ওই ড্রয়িংরুমে বিয়ে পড়ায় দিছে আমার। আর তুই মাত্র বলতেছিস! কী ব্যাপার আম্মা? মেয়েকে কলেজে ভর্তি করানোর কথা ভাবতেছে নাকি সাদিক ভাইয়া?

সাওদা বেগম আয়েশ করে দুধ চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। এ বাড়িতে খুব কম সময় দুধ চা পাওয়া যায়৷ পাড়ার দোকান থেকে একটা দশ টাকার স্টারশিপের প্যাকেট আনতেও এদের অলসতা। প্রতিদিন বিকালবেলা এক কাপ লাল চা এনে হাতে ধরায় দিয়ে যায়। দুধ চা বানাইতে বললে বলবে, ঘরে দুধ নাই।

মেয়ের অভিযোগ শুনে সাওদা বেগমের মধ্যে হেলদোল দেখা গেল না৷ হেয়ালি করে বললেন,

– আরে নাহ৷ পড়ালেখার পেছনে ছুটতে গেলে বয়স কি আর বসে থাকবে? সাদিক কয়েকটা ঘটককে বলে রাখছে৷ ছেলের খোঁজ চলতেছে৷ মুখে বললেই তো আর ভালো ছেলে পাওয়া যায় না৷ আজকাল মনমতো পাত্র খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে গেছে।

সাঁঝ উদাস নয়নে দাদীর দিকে তাকাল। এতে তেমন কোনো লাভ অবশ্য হলো না। এই উদাসীনতা দেখার মতো দৃষ্টি এ বাড়িতে কারো নেই।

নীরবে প্রস্থান করছিল সাঁঝ, সাবা বললেন,

– সুনেরাহকে দেখছিস?

– আপুও এসেছে! কই? আমার সাথে দেখা হয়নি।

– এসেই ভাবীদের ওখানে ছুটেছে। এত করে বললাম, তাড়াতাড়ি চলে আসিস। মেয়েটা আজকাল কথা শুনছে না। ফিরলে আম্মার ঘরে পাঠিয়ে দিস।

°

সানান ভাইয়ের মাথা ধরেছে। গতকাল মাঝপথে মিটিং রেখে বাড়ি চলে আসল, তারপর থেকে শরীর জুড়ে জ্বর জ্বর ভাব। সেই যে এসে ঘরে ঢুকেছে আর বাইরে বের হয়নি৷ রাতের বেলার খাবারটা ঘরে দিয়ে এসেছেন আফসানা। দুটো নাপা খেয়ে আজ বেলা বারোটা অব্দি ঘুমিয়েছে৷ দুপুরে বেশি করে ঝাল দিয়ে গরুর গোশত কষে গরম ভাতের সাথে খেতে দিয়েছেন আফসানা। সেটাও একটুখানি মুখে দিয়েছে৷

তিতকুটে এক কাপ ব্ল্যাক কফি খেয়ে পিসির সামনে বসেছে সানান ভাই৷ এবারের প্রজেক্টের পোস্টারের জন্য ডিজাইনটার একটা লাইনও এখনো টানা হয়নি৷ অথচ সাত দিনের মধ্যে সবগুলো ডিজাইন সাবমিট করতে হবে।

দরজায় খুবই ধীর লয়ে ঠকঠক শব্দ হচ্ছে৷ সায়রা তার ছোট ছোট আদুরে হাত দিয়ে এমনভাবে নক করে৷ সানান ভাইয়ের রুমের দরজা লক করা থাকে না৷ তবুও নক না করে ঘরে প্রবেশের অনুমতি নেই৷ সায়রাও রেহাই পায়নি সানান ভাইয়ের এই অদ্ভুত নিয়ম থেকে।

সানান ভাই চেয়ার থেকে উঠে এসে দরজা খুলে দিল। সামনে দাঁড়িয়ে আছে সুনেরাহ। খোলা দরজাটা আরেকটু চাপিয়ে দিয়ে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সানান ভাই বলল,

– কী চাই?

– এতদিন পর দেখা হলো, কেমন আছি, কখন এসেছি – এসব জানতে চাওয়া উচিত তোমার। দরজা আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছ কেনো ভাইয়া?

– পরে আয়, ইশিতা। আমি ব্যস্ত আছি৷

– আবার ইশিতা! কতবার বলেছি, আমাকে সুনেরাহ বলে ডাকবে। সবাই তাই ডাকে। তুমি বারবার ভুলে যাও।

সুনেরাহ দরজায় ঠেলা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। সানান ভাইয়ের গায়ে একটা হাফ প্যান্ট আর ক্রপ টপস টাইপের গেঞ্জি৷ ঘরের পোশাকে সুনেরাহ- এর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে দেখে সানান ভাইয়ের মাথার ভেতর এবার হাতুড়ি পেটা শুরু হলো। দরজাটা হাট করে খুলে রেখে দ্রুত পায়ে গেমিং চেয়ারে গিয়ে বসল সানান ভাই।

– কিন্তু তোর নাম তো ইশিতা।

– ইশিতা চৌধুরী সুনেরাহ। ডাকনাম সুনেরাহ। তুমি আমাকে সবার মতো ডাকনাম ধরেই ডাকবে।

– সবাই যা করে তা করতে আমি বাধ্য নই। তাছাড়া নিজেই নিজের নাম “স” অক্ষরে রাখলে, তুই আমাদের বংশের কেউ হয়ে যাবি না। যাই করিস, তুই ইশিতা চৌধুরী-ই থেকে যাবি। কখনো শারাফাত হতে পারবি না।

সুনেরাহ ধীর পায়ে ঘুরেফিরে সানান ভাইয়ের পরিপাটিভাবে গোছানো ঘরটি দেখল। টানটান করে ভাঁজ করে রাখা বিছানায় পা ঝুলিয়ে, দু হাত দুদিকে ছড়িয়ে বসে বলল,

– বিয়ের পর মেয়েদের নামের টাইটেল চেঞ্জ করা যায়৷ ভাবছি শারাফাত বংশের কাউকে বিয়ে করে নিব।

সানান ভাইয়ের হাত দুটো কী-বোর্ড ও মাউসে ব্যস্ত থাকলেও মুখ ফিরিয়ে শীতল চোখে তাকাল সুনেরাহয়ের দিকে৷ সুনেরাহ হেসে বলল,

– আরে মজা করছিলাম। সেকেন্ড ইয়ারে উঠতে না উঠতেই বাড়িতে বিয়ের জন্য চাপ দেওয়া শুরু করেছে৷ এতো করে বলছি, অনার্সটা শেষ করতে দেও, কিছুতেই শুনছে না। মা এমন ব্যাকডেটেড একজন মহিলা! তোমাদের বংশের মানুষগুলোই কেমন যেনো। মান্ধাতার আমলের চিন্তাভাবনা ধারণ করে চলেছে এখনো৷

– মর্ডাণ লাইফস্টাইলে আমাদের সমস্যা হয়৷ রুচিতে বাঁধে। মান্ধাতার আমলের চিন্তাভাবনা নিয়েই আমরা গর্বিত। যে নিজের মাকে সম্মান দিতে জানে না, সে আরেকজনের চিন্তাভাবনাকে অপমান করবে এটাই স্বাভাবিক।

সুনেরাহ মুখ গোমরা করে উঠে দাঁড়াল। সানান ভাই ভেবেছে, ও চলে যাবে। কিন্তু সানান ভাইকে আরেকদফা বিরক্ত করতে সুনেরাহ গিয়ে দাঁড়াল গেমিং চেয়ারটার পেছনে। হাতলে হাত রেখে ঝুঁকে তাকাল মনিটরের স্ক্রীনে।

– কি কাজ করছ দেখি৷

– এসব তুই বুঝবি না।

– তুমি বুঝিয়ে দিলেই বুঝব।

সানান ভাই চেয়ারটা ঘুরিয়ে খানিকটা দূরে সরে গেল। সুনেরাহ হুমড়ি খেয়ে পড়তে গিয়ে শেষ মূহুর্তে টেবিল ধরে নিজেকে সামলে নিয়েছে৷

– কাজের সময় পিসির সামনে উঁকিঝুঁকি মারবি না। মনোযোগে বিঘ্ন ঘটে। পাশের ঘরে আম্মা আছে, সায়রা আছে। গিয়ে ওদের সাথে আড্ডা দে।

সুনেরাহ হেলেদুলে গিয়ে বসল সোফায়। সানান ভাই পারলে নিজের মাথার চুলগুলো নিজেই টেনে ছিঁড়ে ফেলে। কয়েকবার উঁচু গলায় আম্মা, আম্মা বলে ডাকল৷ আফসানা রান্নাঘর থেকে উত্তর দিলেন,

– রান্না বসাইছি।

– এক কাপ কফি দিয়ে যাও৷

সুনেরাহ চট করে সোফা থেকে উঠে পড়ল।

– আমি নিয়ে আসতেছি৷

সানান ভাইয়ের বলতে ইচ্ছে করল, আর আসতে হবে না। কফির কাপটা নিয়ে চিরতরে বিদায় হয়ে যা।
কিন্তু কিছুক্ষণ বাদে হাসি মুখে কফির কাপ হাতে ফিরে এলো সুনেরাহ। সেই কফি গিলতে গিয়েও গলায় আটকে যাচ্ছে।
সানান ভাই চেয়ার ছেড়ে উঠে গেল আলমারির কাছে। ড্রয়ার খুলে কী যেন খুঁজল।

– কি খুঁজছ? আমি হেল্প করব?

– আমার কাপড় কোথায় আছে তুই জানিস?

– নাহ।

– তাহলে অযথা কথা বলতেছিস কেন? চুপ করে বসে থাক নিজের জায়গায়৷

সুনেরাহ মুখ ফুলিয়ে বসে নিজের কফির কাপে চুমুক দিল।
সানান ভাই একাকী, নিঃসঙ্গ বসবাসরত মানুষ। নিজের ঘরে দ্বিতীয় কারো উপস্থিতি খুব বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারে না।
অযাচিত ব্যক্তিটির উপস্থিতিতে মেজাজ খেই হারিয়েছে অনেকক্ষণ আগেই৷
সানান ভাই অস্থিভাবে হেঁটে আবার গিয়ে বসল চেয়ারে৷ মোবাইলটি হাতে তুলে নিয়ে কল দিল স্বর্ণলতার নাম্বারে।
যথারীতি কল রিভিউ করল সাঁঝ। সানান ভাই তার জলদগম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করল,

– কোথায় তুই?

কান থেকে মোবাইলটি সরিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকাল সাঁঝ। সন্ধ্যাবেলা বাড়ির নাম্বারে কল দিয়ে জিজ্ঞাসা করছে, সাঁঝ কোথায়? এই সময় কি সাঁঝের বাইরে থাকার কথা? সন্দিহান সাঁঝ উত্তর দিল,

– কেন? বাড়িতে।

– এক্ষুণি এই বাড়িতে আয়।

– এখন! কালকে যাই? সন্ধ্যা হয়ে গেছে অলরেডি।

– এক থাপ্পড়ে দাঁত ফেলে দিব, বেয়াদব। আমার মুখের উপর কথা বলিস তুই! এই মূহুর্তে আসবি। দুই মিনিটে মধ্যে যেন তোকে আমার সামনে দেখতে পাই।

সাঁঝকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে খট করে কলটা কেটে দিয়ে কী-বোর্ডে ঝড় তুলল সানান ভাই। ওদিকে সুনেরাহ কপাল কুচকে বসে আছে৷ সাঁঝকে কেন ডাকছে সানান ভাই? ঘটনা কি?

প্রাণটা হাতে নিয়ে দুই মিনিটে হাঁপাতে হাঁপাতে সানান ভাইয়ের সামনে উপস্থিত হয়েছে সাঁঝ। বাইরে থেকে খোলা দরজায় উঁকি দিয়ে বলল,

– আসব?

সানান ভাই উত্তর দিল না। শুধু ঘাড় ফিরিয়ে শীতল চোখে তাকাল। সাঁঝ ধীর পায়ে ঘরে প্রবেশ করে ভয়ার্ত কণ্ঠে জানতে চাইল,

– কি হয়েছে?

সানান ভাই চেয়ার ঘুরিয়ে সরাসরি তাকাল সাঁঝের দিকে। বুকের উপর দু হাত ভাঁজ করে রেখে ধমকে উঠল,

– কাপড় ভাঁজ করে কোথায় রাখছিস? বাইরে যাব এখন একটা কাপড় খুঁজে পাচ্ছি না।

– হাই সাঁঝ।

পাশ থেকে হঠাৎ নারী কণ্ঠ শুনে চমকে উঠল সাঁঝ। সুনেরাহকে দেখে দ্রুত সালাম দিল।

– আসসালামু আলাইকুম, আপু। ভাল আছ?

– ওয়ালাইকুম আসসালাম। তুই দেখছি অনেক বড় হয়ে গেছিস! এখনো ছোটাছুটি থামেনি, হুহ?

– হাই, হ্যালো শেষ হলে আমার কাপড় খুঁজে বের করে দিয়ে উদ্ধার কর।

সানান ভাইয়ের কঠিন সুরে আলাপচারিতা বন্ধ করে সাঁঝ ছুটল আলমারির দিকে৷ ড্রয়ার খুলে এলোমেলো কাপড়গুলো দেখে আরেকবার হতাশ হলো।

– কী খুঁজব?

সানান ভাই ততক্ষণে কাজের মধ্যে ডুব দিয়েছে। মনিটরের স্ক্রীনে চোখ রেখে জবাব দিল,

– ভি নেকের টি-শার্ট।

– কোন কালারের?

– ওতো রঙ খেয়াল করিনি৷ হবে ওই ইটের মতো রঙ।

সানান ভাইয়ের ভি নেকের টি শার্ট আছে, তথ্যটি সাঁঝের নিকট নতুন এবং বিস্ময়কর। সবসময় কলার গলার টিশার্ট পরতে দেখা যায় সানান ভাইকে। কবে কোন সালে ভি নেকের টি শার্ট কিনেছে কে জানে! এই খড়ের গাদা থেকে সেটা কীভাবে খুঁজে বের করবে সাঁঝ?

– নতুন বউদের মতো মাথায় ঘোমটা দিয়েছিস কেন?

সুনেরাহ তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ম চোখে৷ এই মূহুর্তে ওকে একদম সাবার মতো দেখাচ্ছে। সাঁঝ খেয়াল করল না। নিজের মতো কাজ করতে করতে উত্তর দিল,

– আসার সময় ফুপু বলল, সন্ধ্যা হয়েছে তাই মাথায় কাপড় দিয়ে বের হতে।

চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে সুনেরাহয়ের মাথা ধরে গেছে। সানান ভাই আপনমনে কাজ করছে। ঘরে সাঁঝ থাকায় কাছে ঘেঁষতে পাচ্ছে না সে৷ এমন না যে ও সাঁঝকে ভয় পায়। ভয় তো পায় সানান ভাইয়ের কাঠকাঠ কথাগুলো। একলা ঘরে তবুও সেসব অপমান সুনেরাহ সহ্য করে নিবে। কিন্তু সাঁঝের সামনে সে কিছুতেই অপমানিত হতে পারবে না। মানসম্মান সব শেষ হয়ে যাবে।

কফিটুকু শেষ করে আস্তে-ধীরে উঠে দাঁড়ালো সুনেরাহ। পাশের ঘরে সায়রা বইপত্র খুলে বসেছে। আফসানা রান্নায় ব্যস্ত। ড্রয়িংরুমে টেলিভিশনে খবর দেখছে সাবির। সুনেরাহ গিয়ে তাঁর পাশে বসল। কিছুক্ষণ খবর দেখার পর মোবাইল বের করে ব্যস্ত হয়ে গেল ফেসবুকে।

টেবিল সাজিয়ে খাবারের জন্য ডাকছে আফসানা। সানান ভাইয়ের কাজও শেষ। সুন্দর একটা পোস্টার বানিয়েছে। ফাইনাল আউটপুট দেখে নিজেই ভীষণ খুশি হলো। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দেখল তখনো আলমারি সামনে দাঁড়িয়ে সাঁঝ। ছোট শরীরটা প্রায় আলমারির ভেতর ঢুকে যাওয়ার দশা। সানান ভাই গিয়ে সাঁঝের পেছনে দাঁড়িয়ে ঘাড়ের উপর উঁকি দিয়ে দেখল আলমারির প্রায় সব কাপড় ইতিমধ্যে বের করে ফেলা হয়েছে।
সাঁঝের কানের কাছে মুখ নামিয়ে নিচু স্বরে প্রশ্ন করল,

– খুঁজে পাসনি?

সাঁঝ চমকে উঠে পেছন ফিরে দেখল, নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে সানান ভাই। সরু চোখে চেয়ে আছে তারই দিকে। সে মুখ নিচু করে নীরবে দুপাশে মাথা দুলালো। সাঁঝের স্পষ্ট মনে আছে, সব কাপড় সাবধানতার সাথে ভাঁজ করে সে এখানেই রেখেছিল। ভি নেকের টি শার্টটা গেল কোথায়?

– যথেষ্ট কাপড় এলোমেলো করছিস। আর লাগবে না। কালকে এসে এগুলো আয়রন করে গুছিয়ে রেখে যাবি। অবশ্যই বিকালের পর আসবি। দিনেরবেলা এসে ঘুমের ডিস্টার্ব করলে রোদে দাঁড় করায় রাখব। মনে থাকবে?

সাঁঝ ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল। কাপড়ের স্তুপ থেকে একটা ট্রাউজার, টিশার্ট তুলে নিয়ে সানান ভাই চলে গেল বাথরুমে।

°

– সাঁঝ, আমাদের সাথে খাবি আয়।

সাবিরের ডাকে ফিরে তাকাল সাঁঝ। খাবার টেবিলে বসে আছে সাবির, সায়রা, আফসানা ও সুনেরাহ। সাঁঝ মিষ্টি হেসে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল।

– নাস্তা খেয়ে এসেছি৷ বাড়ি গিয়ে একটু পড়ে খাবো৷

– বাড়িতে কি আস্ত খাসি রান্না হয়েছে যে আমাদের এখানের খাবার মুখে রুচবে না?

পেছন থেকে শোনা গেল সানান ভাইয়ের কণ্ঠস্বর। পোশাক পাল্টে ভদ্র ছেলেটি সেজে বাবার পাশের চেয়ারে বসল৷

এই কটাক্ষের কি উত্তর দিবে? বড্ড অসহায় বোধ করল সাঁঝের৷ একনজর সবাইকে দেখে সিদ্ধান্ত নিল চুপচাপ বেরিয়ে যাবে। পা ফেলার আগেই সানান ভাই নিজের পাশের চেয়ারটা টেনে একটু পিছিয়ে দিয়ে আদেশ করল,

– এখানে বস৷

সাঁঝ সতর্ক চোখে তাকাল আফসানার দিকে৷ ওই সুন্দর মুখটায় নিজের জন্য এক আকাশ বিরক্তি দেখলে দৌড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে সাঁঝের। লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে নিজেকে।
সাঁঝের ইতস্ততবোধের কারণটা হয়তো বুঝলেন আফসানা। শীতল কণ্ঠে বললেন,

– সবার জন্য রান্না হয়েছে। খেয়ে যা।

সাঁঝ গুটিগুটি পায়ে এসে সানান ভাইয়ের পাশের চেয়ারে বসল। হাত-পা অসাড় লাগছে। প্লেট ধরতে গিয়ে দেখল হাত কাঁপছে। কেউ অবশ্য খেয়াল করল না।
শুধু সানান ভাই প্লেটটা হাত থেকে কেড়ে নিয়ে নিজের হাতে প্লেটে ভাত-তরকারি তুলে দিল। কষা গোশতের বাটিটা সাঁঝের দিকে এগিয়ে দিয়েছিল সুনেরাহ। সেটা সরিয়ে দিয়ে সানান ভাই বলল,

– এটা ঝাল।

ফিরে যাওয়ার সময় সুনেরাহ দুমদাম পা ফেলে লিফটের দিকে চলে গেল। দোতলা থেকে নিচে নামতে আজ পর্যন্ত কখনো লিফটের প্রয়োজন পড়েনি সাঁঝের। সে সিঁড়ি বেয়ে নামবে। সিঁড়ির দিকে যাওয়ার আগে সদর দরজা বন্ধ করতে আসা সানান ভাইয়ের দিকে তাকাল। মাথা নিচু করে অপরাধীর দৃষ্টিজোড়া লুকাতে পারলেও কণ্ঠের হতাশা লুকাতে পারল না।

– সবগুলো টি শার্ট উপরের তাকেই রেখেছিলাম। ভি নেকের টি-শার্টটা কোথায় যে গেল, বুঝতে পারছি না। এত খুঁজলাম, কোথাও নেই।

– থাকলে না খুঁজে পাবি।

সাঁঝ অবাক হয়ে তাকাল বুকের উপর হাত ভাঁজ করে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সানান ভাইয়ের দিকে।

– মানে?

– আমার ভি-নেকের কোনো টি-শার্ট নাই। যা কিছু এলোমেলো করছিস, কালকে এসে গুছিয়ে দিয়ে যাবি।

হতবাক সাঁঝকে দাঁড় করিয়ে রেখে দুম করে দরজা বন্ধ করে দিল সানান ভাই। নিচ থেকে সুনেরাহ-র ধৈর্যহারা কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। অনবরত ডাকছে সাঁঝকে। সাঁঝ দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল। সুনেরাহ পাকড়াও করল মাঝ রাস্তাতেই।

– সানান ভাই তোকে কি বলল?

– কখন?

– দরজার ওখানে।

– কাপড়গুলো ভাঁজ করে রাখতে বলল।

– তোকে কেন করতে হবে? বড় মামী কি করে?

– বড় মায়ের কোমড় ব্যথা। ঝুঁকতে পারে না৷ বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে পারে না।

– কাজের বুয়া?

– সানান ভাই উনার কাপড় কাউকে ধরতে দেয় না।

– তোকে দেয়?

এমন প্রশ্নের পেছনের সন্দেহ সাঁঝ বুঝল না। সরল মনে উত্তর দিল,

– হ্যাঁ। দেয় তো।

চলবে…
#অক্ষরময়ী

#এই_সাঁঝবাতি? পর্বঃ ১৬

সানান ভাইয়ের জীবনে রুটিন বলে কিছু নাই, সে কথা সবার জানা। কিন্তু এই কয়েকদিনে সাঁঝের ডেইলি রুটিনটাও এলোমেলো হয়ে গিয়েছে সানান ভাইয়ের কল্যাণে।

বাড়িতে দাদীর আদরের মেয়ে ফরমায়েশ পূরণে খাটতে হচ্ছে। অন্যদিকে যখন তখন সানান ভাই ডেকে পাঠায়। আজ শার্ট খুঁজে পাচ্ছে না, কাল প্যান্ট গায়েব। দরকারি কাগজপত্র টেবিল থেকে উধাও। কবে যেন বলে বসে,
আমার আন্ডারওয়্যারটা খুঁজে পাচ্ছি না। খুঁজে দিয়ে যা।

সাঁঝের এখন শুধু গলা ছেড়ে কান্না করা বাকি।
একদিন সানান ভাইয়ের অত্যাচারে ডুবে ম রা র ঠিক কিছুক্ষণ আগে সাঁঝের মুক্তি মিলল।
বিয়ে উপলক্ষ্যে সাবার শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে সবাইকে। দীর্ঘ ঘরবন্দী জীবনকালে সাতদিনের লম্বা ছুটিতে সাঁঝ যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে বসল।

গ্রীষ্মের প্রখর রোদ্দুরে খা খা করছে চারপাশ। ভর দুপুরবেলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন। ফ্যানের বাতাসটাও গরম লাগছে। এই ত্যক্ত বিরক্ত গরমে বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে সানান ভাই। তার ঘুমে সামান্যতম বিঘ্ন সে বরদাস্ত করে না। দিনের কোলাহল, অযাচিত শব্দ থেকে নিস্তার পেতে রুমটাকেও করে নিয়েছে সাউন্ডপ্রুফ।

মন ভরে এক দুপুর ঘুমিয়ে হেলেদুলে ড্রয়িংরুমে এলো সানান ভাই। সোফায় থমথমে মুখে বসে আছেন আফসানা। তীর্যক চোখে চাইলেন সানান ভাইয়ের দিকে। সানান ভাই বুঝে গেল, সে আজকে একটু বেশি দেরী করে উঠেছে। মায়ের বকুনি শুরু হতে পারে এক্ষুণি।

সানান ভাই কোনো দিকে না তাকিয়ে চুপচাপ খাবার টেবিলে গিয়ে বসল। আজকে কফির এপিসোড বাদ। কণ্ঠে মায়া ঢেলে ডাকল,

– আম্মা, ও আম্মা?

আফসানা তখনও নির্বাক। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছেন ছেলের ঢং। সানান ভাই থেমে রইল না। এক নিঃশ্বাসে ডাকতে থাকল।

– আম্মা, আম্মা। ও আমার আম্মা?

আফসানা বিরক্ত হয়ে সোফা থেকে উঠে সানান ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে ধমকে উঠলেন।

– কি হয়েছে?

সানান ভাই মুখ ফুলিয়ে মায়ের কোমড় জড়িয়ে ধরে আবদার করল,

– ভাত দেও। ক্ষুধা লাগছে।

আফসানার রাগ গেল না। বিরক্ত হয়ে বললেন,

– যা গিয়ে কফি গিল। ভাত খাওয়ার কি দরকার?

– কি রান্না করছ? সুন্দর ঘ্রাণ আসতেছে। তাড়াতাড়ি আনো। ক্ষুধায় পেট গুড়গুড় করতেছে।

– হইছে সর। আহ্লাদ করা লাগবে না। অর্ধেক দিন পার করে ঘুম থেকে উঠবে। স্বভাব বদলা সানান। এগুলা কোনো মানুষের আচরণ হতে পারে না। রাতের ঘুম কোনোভাবে দিনের বেলা পূরণ হয়?

ছেলের জন্য যত্ন করে কলিজা ভুনা করে রেখেছেন আফসানা। ভেবেছিলেন আজকের দিনটা অন্তত সবাই একসাথে বসে খাবে। কিন্তু সানান ভাইয়ের ঘুম থেকে উঠার নাম নেই দেখে সাবির ও সায়রা খাবার খেয়ে ইতিমধ্যে ভাত ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছে।

আফসানা নিজের প্লেট সাজিয়ে সানান ভাইয়ের সাথে খেতে বসলেন। তা দেখে সানান ভাই নড়চড়ে বসে বলল,

– কি বলবা বলে ফেলো। তোমার ভাবভঙ্গিমআ দেখে টেনশনে পড়ে যাচ্ছি।

আফসানা অবাক হয়ে বললেন ,

– আমি আবার কি বলব?

– কিছু একটা অবশ্যই বলবা। এত আয়োজন করে খেতে বসেছো কি এমনি?

আফসানা বাঁকা চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে প্লেটে মনোযোগ ফিরিয়ে নিলেন। ধীরে ধীরে ভাত মাখলেন কিন্তু মুখে পুড়লেন না। শান্ত কণ্ঠে বললেন,

– তোর ছোট ফুপু বিয়ের দাওয়াত দিয়েছে।

– আমি যেতে পারবো না। ব্যস্ত আছি।

প্লেট থেকে হাত তুলে আফসানা চোখ রাঙিয়ে তাকালেন। সানান ভাই বিশেষ পাত্তা দিল না।

– অসামাজিকের মতো আচরণ করবি না। দিন দিন মানুষ থেকে জানোয়ারে পরিণত হচ্ছিস। ভদ্রতা বোধ লোভ পাচ্ছে।

– আজব! বকছ কেন? কি এমন বললাম!

– কার বিয়ে, কবে বিয়ে কিছু না জেনে সরাসরি না করে দিলি কেনো?

– আচ্ছা স্যরি। এখন জিজ্ঞাসা করে নিচ্ছি। কার বিয়ে? কবে বিয়ে?৷ এক মিনিট। ওই ছ্যাবলা ইশিতার বিয়ে নাকি?

– আরফিনের। সাবার দেবরের ছেলে। বুধবার বিয়ে।

– সম্ভব না। তোমরা যাও। অফিসের নতুন প্রজেক্ট নিয়ে পুরো মাস আমি অনেক ব্যস্ত থাকব।

– অফিসে আর কেউ নাই? সব দায়িত্ব কি তুই মাথায় তুলে নিছিস? দুটো দিন ছুটি নিলে কোম্পানি বানের জলে ভেসে যাবে?

– অফিসে ম্যানেজ করা গেলেও আমি যাব না। তুমি জানো, এসব গ্যাদারিং আমার পছন্দ না। এত লোকজনের মাঝে আমার সাফোকেশন হয়। মাথা ধরে যায়।

– সাধে কি আর অসামাজিক বলি? তোর জন্য আত্মীয় স্বজনের কত কথা শুনতে হয় জানিস? কারো সাথে কথা বলিস না, কারো বাড়ি যাস না। কথা শুনতে হয় আমাকে।

– আমি জানতাম, আত্মীয় মহলে সবাই আমার প্রশংসা করে। সানান কত ভদ্র, কোনো বাজে অভ্যাস নাই। অযথা বাইরে ঘুরাঘুরি করে না। ভালো স্টুডেন্ট, ভালো চাকরি, সেট ক্যারিয়ার। দেখতে শুনতেও চমৎকার। পারফেক্ট ছেলে সানান। অল ইন ওয়ান। এই বদনামের চ্যাপ্টারটা শুরু হলো কবে থেকে? কেনো হলো?

সানান ভাইয়ের নাটকীয় সুরে আফসানা বিরক্ত হয়ে গজগজ করতে করতে খাওয়া ছেড়ে উঠে গেলেন। সানান ভাইয়েরও খাওয়া হলো না। মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেছে। এতদিনের জনপ্রিয়তা এভাবে হারিয়ে যাচ্ছে! ব্যাপারটা কোনোভাবে মানা যাচ্ছে না।

*

মায়ের বকুনির ভয়ে কফি না খেয়ে ঘরে চলে এসেছে সানান ভাই। এদিকে মাথা ঝিমঝিম করছে। এক কাপ কফি না খেলে মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যাবে। পিসির সামনে মাথা চেপে ধরে বসে রইল সানান ভাই।

দরজায় দুমদাম বারি মে/রে ঘরে প্রবেশ করলেন আফসানা। কফির কাপটা ঠাস করে টেবিলে রেখে বললেন,

– সবাইকে দাওয়াত দিয়েছে। স্বর্ণলতা অলরেডি সবাইকে নিয়ে সাবার সাথে চলে গিয়েছে। সায়রাকে নিয়ে আমি যাব মঙ্গলবার। তোর সময় না হলেও বিয়ের দিন গিয়ে দেখা করে আসবি। খুব দূরের রাস্তা তো নয়।

সানান ভাই ঝট করে মাথা তুলে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,

– সবাইকে নিয়ে গেছে মানে?

– কার কথা বলছিস?

– মেজ মা। ও বাড়ির সবাই গিয়েছে?

– হ্যাঁ। শুধু সাদিক বাড়িতে আছে। এতদিন টিউশন বন্ধ রাখা যাবে না।

– তুমি না বললে, বিয়ে বুধবার। শুক্রবারেই নাচতে নাচতে চলে যাওয়ার কি আছে?

– সাবা সাথে করে নিয়ে গিয়েছে। বিয়ে বাড়িতে লোকজন আসতে শুরু করেছে অলরেডি। কাজকর্ম বেড়ে গেছে। এজন্য স্বর্ণলতাকে নিয়ে গেল। বিনা পয়সায় খাটাবে আরকি।

– ফুপি বললেই উনাকে যেতে হবে? মেজ মাকে ওরা কাজের লোক পেয়েছে নাকি?

– দোষ একার সাবাকে দিচ্ছিস কেন? স্বর্ণলতা কম কীসের? সারাক্ষণ মাথা নিচু করে চলে। নিজেই নিজেকে সম্মান করতে না জানলে অন্যের থেকে কখনো সম্মান পাওয়া যায় না। নরম মাটিতে লোকে বেশি লাথি মারে। সাবা বলা মাত্র নাচতে নাচতে চলে গেল। না করলে কি জোর করে নিয়ে যেত?

মেজ মায়ের এই অসহায়, অবলা মানসিকতায় জীবনযাপনের স্বভাব সানান ভাইয়ের বিরক্ত লাগে। নিজেকে এতটাও অবহেলিত ব্যক্তি হিসেবে প্রেজেন্ট করা উচিত নয়। এতে নিজের সম্মানহানি হয়। লোকে মানুষ হিসেবে গণ্য করা ছেড়ে দেয়। সর্বদা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা শুরু করে।

থমথমে মুখে কফির কাপে চুমুক দিল সানান ভাই। আফসানা বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। সানান ভাই পিছু ডাকলেন,

– সাঁঝও গিয়েছে?

– হ্যাঁ। যুবতি মেয়েকে বাড়িতে একা রেখে যাওয়া যায় নাকি! শুনলাম তোর বড় ফুপুও নাকি কালকে যাবে।

– সবাই চলে গেল অথচ তোমরা বাড়িতে পড়ে আছো। ব্যাপারটা কেমন দেখায় না? আত্মীয় মহলে বেশ বদনামি হয়ে যাবে। তোমারও যাওয়া উচিত।

– কার সাথে যাব? তোর বাবার ছুটি নাই।

– চলো আমি তোমাদের কালকে দিয়ে আসি।

কথাগুলো বোধগম্য হতে বেশ খানিকটা সময় লাগল আফসানার। ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান কণ্ঠে বললেন,

– তুই নিয়ে যাবি?

– হ্যাঁ।

– তোর না অনেক কাজ?

– দিয়েই চলে আসব। উত্তরা আর কতদূর! এই তো এখানেই।

আফসানা বাঁকা চোখে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সানান ভাইয়ের মতিগতি বুঝার চেষ্টা করলেন। সন্দেহজনক বটে কিন্তু আশানুরূপ উত্তর খুঁজে না পেয়ে আফসানাকে সম্মতি জানাতে হলো।

*

সাবা শারাফাতের বিয়ে হয়েছে উত্তরার এক নামকরা ব্যবসায়ীর সাথে। উত্তরায় বেশ জনপ্রিয় বনেদি বংশ এই চৌধুরী পরিবার।

অর্থ, সম্পদ, সম্মান, আভিজাত্য – সব ঠিক থাকলেও শ্বশুরবাড়ির যৌথ পরিবারটি সাবার খুব একটা পছন্দ না। চৌধুরি পরিবারের চার জন ছেলের মধ্যে সাবার স্বামী বড়। সেই হিসেবে বাড়ির কর্ত্রী সাবা। তাই তো সবার মাথার উপর ছড়ী ঘুরাতে বেশ সুবিধা হয়েছে সাবার।

চৌধুরি পরিবারে এসেই রান্নাঘরে ঢুকতে হয়েছে স্বর্ণলতাকে। এতগুলো মানুষের তিনবেলা খাবারের আয়োজন এখন তার দায়িত্ব। অন্যদিকে সাওদা বেগম আছেন ভীষণ আনন্দে। বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে কাজের তদারকি করতে বেশ লাগছে। সাবিল-সাভিনও নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিয়েছে। এ বাড়ির সমবয়সী বাচ্চাদের সাথে ইতিমধ্যে ভাব হয়ে গিয়েছে ওদের। শুধু অস্থির সময় কাটতে লাগল সাঁঝের।

চৌধুরি বাড়িটা অনেকটা পুরনো জমিদার বাড়ির মতোন। দোতলা বাড়িটির চারদিকে অসংখ্য ঘর। মাঝখানে বড় একটি আঙ্গিনা। সেখানে সারাক্ষণ লোকজন গিজগিজ করছে।
লোকজনে সাঁঝের সমস্যা নেই। সমস্যা হচ্ছে শোয়ার জায়গা নিয়ে। সাঁঝকে থাকতে দেওয়া হয়েছে সুনেরাহ এর সাথে। এতগুলো ঘর, এতগুলো মানুষ থাকতে সুনেরাহ এর সাথে কেন জুড়ে দিতে হলো ওকে?

সুনেরাহ উঠতে বসতে সাঁঝকে অপমান করে, হেয় করে কথা বলে। সাঁঝের ভালো লাগে না।

দোতলা বাড়িটির ছাদটিও সুবিশাল। এই মূহুর্তে ছাদের এককোণায় বসে ঘুমে টুপছে সাঁঝ। গতরাতে ভালোভাবে ঘুমাতে পারেনি। বিয়ে বাড়িতে কাজের কমতি নাই। বারোটার দিকে ঘরে ঢুকে দেখল পুরো ঘর এলোমেলো। বিছানার উপর কাপড় ছড়ানো। ওগুলো সোফার উপর রেখে বিছানায় একটুখানি গা এলিয়ে দিয়েছিল সে। তখনি এলো সুনেরাহ। এসেই নাক উঁচু করে জানালো,

– এটা ঘর নাকি খড়ের গাঁদা? এত এলোমেলো হলো কি করে?

– আমি এসে এমনি পেলাম, আপু।

– এলোমেলো ঘর দেখেও এসব এভাবে রেখে শুয়ে পড়েছিস? কাজ চোর মেয়ে রে তুই।

– সকালে গুছিয়ে দেবো। বিছানা পরিষ্কার আছে। এসে শুয়ে পড়ো।

– অসম্ভব। অগোছালো ঘরে আমি কিছুতেই ঘুমাতে পারব না। আমার ঘর কখনোই এমন হয় না। তুই এসে ঘরটাকে গোয়াল ঘর বানিয়ে ফেলেছিস। এক্ষুণি উঠে তাড়াতাড়ি গুছিয়ে ফেল।

দাঁতে দাঁত চেপে বিছানা ছেড়ে উঠে সেই রাত্রিবেলা পুরো ঘর গুছিয়েছে সাঁঝ। এদিকে বিছানায় শোয়া মাত্র নাক ডেকে ঘুমাতে শুরু করেছে সুনেরাহ। মুখের কিছু বলতে না পারলেও ঘুমন্ত সুনেরাহ এর সামনে দাঁড়িয়ে ইচ্ছেমতো বকে নিয়েছে সাঁঝ।

– শাঁকচুন্নি একটা। অগোছালো ঘরে ঘুমাতে পারে না। আহ নাটক! তোর ঘর কোনদিন গোছানো ছিল রে শাঁকচুন্নি? ইচ্ছে করছে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দেই। নাটকবাজ মেয়ে।

মনের ঝাল মিটিয়ে যেইনা ঘুমাতে গিয়েছিল সাঁঝ, ভোর হতেই স্বর্ণলতা এসে হাজির। তুলে নিয়ে গিয়ে রান্নাঘরে চুলার কাছে বসিয়ে দিয়েছেন রুটি সেঁকতে।

তাঁর কাজ করার শখ জেগেছে করুক, তাই বলে সাঁঝকে কেন খাটিয়ে মা/রবে? সাঁঝের মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে জগত সংসারে আ/গু/ন লাগিয়ে দিতে। কিন্তু মায়ের হাতে ধোলাই খাওয়ার ভয়ে কিছু করতে পারেনা।

এই যে এখন সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ছাদে এসে একটুখানি বসেছে কি না বসেছে ইশানা এসে হাজির। এই মেয়েটাও আস্ত এক ঢংগী। নাক উঁচু করে চলাফেলা করে। এমন ভাব নেয় যেন কোন জমিদারের মেয়ে। কোমড়ে দু হাত রেখে সাঁঝের সামনে দাঁড়িয়ে ইশানা ধমকে উঠল,

– তুমি এখানে বসে আছ, ওদিকে কত কাজ পড়ে আছে।

ছাদের কার্নিশে হেলান দিয়ে সাঁঝও সমান তেজ নিয়ে বলল,

– সারাদিন মোবাইলে গেম না খেলে তুমি একটু কাজ করে দিলেই কাজ আর পড়ে থাকে না।

– কিহ! আমি কাজ করবো? তাহলে তোমাদের আনা হয়েছে কেনো?

– কাজ করার জন্য আনা হয়েছে আমাদের?

– তা নয়তো কি? মা বলেছে, সবাই দাওয়াত খেয়ে গিফট দিয়ে যাবে। তোমাদের তো টাকা নেই। তাই তোমাদের দুদিন আগে নিয়ে এসে ঘরের কাজগুলো করিয়ে নিবে। এতে আর চাচুর লস হবে না। কিন্তু তুমি এখানে কাজ ফাঁকি দিয়ে বসে আছো। মা ভীষণ ক্ষেপেছে।

একটা ছোট মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে অপমানে নীল হয়ে গেল সাঁঝের মুখ। স্তব্ধ চোখে চেয়ে রইল ইশানার তাচ্ছিল্যভরা চেহারার দিকে।

সিঁড়ি বেয়ে ধুপধাপ পায়ে দৌড়ে এলো কয়েকজন কিশোর। ছাদের এককোণে অবহেলায় পড়ে ছিল একটি ফুটবল। কিশোরদের মধ্যে একজন দৌড়ে গিয়ে সবার আগে ফুটবলটি তুলে নিল। কিশোরটিকে চিনল সাঁঝ। তার ছোট ভাই সাবিল। হুট করে আরেকজন কিশোর এসে বলটি কেড়ে নিয়ে ধাক্কা মে/রে ফেলে দিল সাবিলকে। এই কিশোরটিকেও সাঁঝ চিনে। ফুপুর ছোট দেবরের ছেলে, রনি।

সাঁঝ ছুটে গেল সাবিলের কাছে। শুনল রনির ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বর।

– তুই আমাদের খেলনা ধরবি না। মা বলেছে, খেলনা লুকিয়ে রাখতে। তোরা দেখলে চু/রি করে নিয়ে যাবি।

সাবিল হাটুতে ব্যথা পেয়েছে। চোখে পানি নিয়ে প্রশ্ন করল,

– আমি কেন তোমার খেলনা চুরি করব?

– কারণ তোর খেলনা নেই।

সাঁঝ দ্রুত পায়ে গিয়ে টেনে তুলল সাবিলকে। সোজা দাঁড় করিয়ে গালে থা/প্প/ড় মে/রে বলল,

– ওদের জিনিসে হাত দিয়েছিস কেনো? যা নিচে গিয়ে সাভিনের সাথে খেল।

*

– তোমাদের নিয়ে এসে কী যে ভুল করেছি ভাবী! বাড়িতে একটা ঝামেলা না বাঁধিয়ে ছাড়বে না তোমরা।

সাবার কথা শুনে স্বর্ণলতা অবাক হয়ে তাকালেন। শুকনো মুখে বললেন,

– কি হয়েছে সাবা?

– কি আবার হবে! তোমার ছেলে দুটো যা শুরু করেছে। রনির সাথে খেলনা নিয়ে ঝামেলা বাঁধিয়েছে। তাই নিয়ে আমার জা নালিশ দিয়ে গেল। ছেলে দুটোকে একটু সামলে রাখবে তো।

ঘুম থেকে উঠেই সোজা রান্নাঘরে ঢুকেছেন স্বর্ণলতা। এরপর আর বাইরে বের হওয়ার সুযোগ পাননি। বাচ্চাদের শাসন বারণ করা তো দূরের কথা, ওরা খেয়েছে কিনা সেটাও খোঁজ নেওয়া হয়নি। সবাই দুপুরের খাবার খেলেও তিনি এখনো মুখে খাবার তুলতে পারেননি। কাজের লোককে এঁটো থালাবাসন বুঝিয়ে দিয়ে তবেই গোসলে যাবেন। তারপর খাওয়া দাওয়া। খাবারের বাটিগুলো ঢেকে রাখতে রাখতে স্বর্ণলতা বললেন,

– ওরা ছোৎ মানুষ। বললেও কথা শুনে না।

– ওরা না হয় ছোট কিন্তু তোমার ধিঙ্গি মেয়েটা কোথায়? ওর খবর একটু রাখো। বাড়িতে কতো অচেনা, অজানা পুরুষ মানুষ এসেছে। এর মাঝে তোমার মেয়ে কই যে ঘুরে বেড়াচ্ছে! ওদিকে ইশানের বাবা, চাচাদের খাওয়া শেষ হয়েছে। উনাদের পান দিতে হবে। তোমার মেয়েকে খুঁজতে গিয়ে মানুষের পেটের ভাত হজম হয়ে যাচ্ছে। তবুও তার দেখা নাই।

সাবা রেগেমেগে বেরিয়ে যাওয়ার পর সাঁঝ এসে ঢুকল রান্নাঘরে। মেয়েকে দেখে স্বর্ণলতা বিরক্ত হয়ে বললেন,

– ভর দুপুরে কোথায় গেছিলি তুই? বাড়িতে কত ছেলে মানুষ ঘুরতেছে! মাথায় কাপড় নাই কেন তোর?

– ছাদে গেছিলাম।

– একলা ছাদে যাবি না। ওখানে পানের থালা রাখা আছে। তোর ফুপাকে দিয়ে আয়।

– কেন আমাকে দিয়ে আসতে হবে? বাড়িতে আর লোক নাই?

স্বর্ণলতা অবাক চোখে মেয়ের দিকে চাইলেন। কি হয়েছে এর? এভাবে কথা বলছে কেনো? জ্বিনে ধরেছে নাকি?

– একটু কাজ করলে তোর হাত খসে পড়বে?

– হ্যাঁ পড়বে। আমরাই কেন কাজ করব? আর কেউ তো করছে না। তুমি আসছ থেকে রান্না সামলাচ্ছো। এত রান্না তো বাবুর্চি নেয়নি কেন? এগুলাতে করতে নিয়ে আসছে আমাদের? আমরা কাজের লোক?

– মাথা খারাপ হইছে তোর? নিজের বাড়িতে কাজ করলে কেউ কাজের লোক হয়? বিয়ে বাড়িতে কেউ বসে আছে? সবাই কিছু না কিছু করতেছে।

– হ্যাঁ করতেছে। তোমার শাশুড়ি বারান্দায় বসে পান চিবাচ্ছে। পাশের বাড়ির মহিলাদের সাথে ফুপু আড্ডায় বসছে। উনার জা তিনজনকে দেখলাম পুকুরপাড়ে বসে হাওয়া খাচ্ছে। সুনেরাহ আপু, ইশানা ওরা কই? গিয়ে দেখ সেজেগুজে ফটো তুলতেছে। আর ছেলেগুলা বাইরের স্টেজে নাচতেছে। খেটে মরতেছি আমরা।

– এখন কাজ কম দেখে বসে আছে। কালকে থেকে সবাই ব্যস্ত হয়ে যাবে। তাছাড়া কাজের তদারকি করার ব্যাপার আছে না? ওগুলা এই বাড়ির লোকজন-ই করতেছে। তুই যা পানটা দিয়ে আয়।

– থাকব না আমি এখানে। চলো আমরা বাড়ি চলে যাই। বিয়ের দিন একেবারে আসব।

– তাই হয় নাকি! মেহমান সবাই আসতে শুরু করেছে আর আমরা চলে যাব? তোর বড় ফুপু আসবে আজকে। ইশানার ফুপুরাও আজকে আসতেছে।

– ওরা কেউ কাজ করতে আসতেছে না। আসতেছে বিয়ের দাওয়াত খেতে। আমরা গিফট দিতে পারব না জন্য আমাদের কাজের লোকের মতো খাটানো হচ্ছে।

মায়ের মুখের উপর চিৎকার করে কথাগুলো বলে পানের প্লেট নিয়ে সাঁঝ চলে গেল। ওর ছলছল চোখ দেখে স্বর্ণলতা লজ্জার সাথে ভীষণ কষ্টও পেল। দ্রুত রান্নাঘরের এককোণে লুকিয়ে চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল মুছে নিতে ভুলল না।

চলবে..
#অক্ষরময়ী