#এই_সাঁঝবাতি? পর্বঃ ১৭
সাঁঝের বড় ফুপুর নাম সানা। শ্বশুর বাড়ি গাজিপুর। তিনি উত্তরা এসে পৌঁছালেন বিকালবেলা। চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা, মাথায় আধপাকা চুলের খোঁপা, পরনে তাঁতের অফ হোয়াইট শাড়ি। মাইক্রো থেকে নামলেন সদর্পে।
সাথে এসেছে উনার দুই ছেলে ঋষভ ও ঋত। বড় ছেলে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। ছোট ছেলে দশম শ্রেণীতে। স্বামী গত হয়েছেন প্রায় তিন বছর। স্বামী ছিলেন সরকারী কর্মকর্তা। গাজীপুরে তাদের অর্থ সম্পদের কমতি নেই। আভিজাত্যের কমতি নেই এই পরিবারের মাঝেও।
সানার আগমনে বাড়িতে যেন উল্লাস শুরু হয়ে গেল। শারাফাত পরিবারের বড় মেয়ে সে। স্বভাবে, চলনে, বলনে গাম্ভীর্যতা ঠিকরে পড়ে।
জমিদার বাড়ির ভেতর বারান্দায় কাঠের চেয়ারে বসে দেওয়া হলো তাদের। গরমে এতখানি পথ পেরিয়ে এসেছে। এসি মাইক্রো থেকে নেমে ঘামছিল কূল কূল করে। বড় একটা স্ট্যান্ড ফ্যান আনা হলো। রান্নাঘরে কাজের মহিলারা ব্যস্ত হয়ে পড়ল শরবতের আয়োজনে।
চৌধুরী পরিবারের কর্ত্রীদের সাথে সবে পরিচয় পর্ব জমে উঠেছে, কাজের মহিলাদের সাথে সাঁঝ এসে উপস্থিত হলো। সবার জন্য শরবত বানানো হয়েছে। একে একে সবাইকে শরবত পরিবেশন করে ঋষভের সামনে এলো সাঁঝ। ঋষভ ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল। চোখে চোখ পড়া মাত্র ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল।
কাজিন মহলের মধ্যে এই ছেলেটাকে সাঁঝের ভালো লাগে না। কেমন যেন তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়। ঠোঁটে লেগে থাকে একটা বাঁকা হাসি। এমন চাহনি সাঁঝের বোধগম্য হয় না। তবে অস্বস্তি হয় ঠিকই।
গ্লাস এগিয়ে দিতেই ঋষভ হাত বাড়াল, তবে গ্লাসটি ধরল না। গ্লাস পেরিয়ে ঋষভের হাত এগিয়ে গেল সাঁঝের দিকে। উষ্ণ আঙ্গুল কানের লতি ছোঁয়া মাত্র ঈষৎ কেঁপে উঠে পিছিয়ে গেল সাঁঝ।
– একটা শুকনো পাতা লেগে ছিল চুলে।
দুই আঙ্গুলের মাঝে ধরে থাকা শুকনো পাতাটি ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল ঋষভ। শরবতের গ্লাসটি হাত থেকে নিয়ে সাঁঝের চোখে চোখ রেখে চুমুক দিল তাতে। সাঁঝ তখনো নিঃশ্বাস আটকে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে।
ধ্যাণ ভাঙল সুনেরাহ এর আওয়াজে। নতুন অতিথির আগমনে উচ্ছ্বসিত হয়ে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলছে সে।
সাঁঝ তাকিয়ে দেখল সদর দরজা পেরিয়ে প্রবেশ করছে সানান ভাই। কোলে সায়রা, পাশে হেঁটে আসছে আফসানা।
সবার মনোযোগ সানান ভাইয়ের দিকে। এই ফাঁকে ট্রে তুলে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে দ্রুত প্রস্থান করল সাঁঝ।
*
সানান ভাই বলেছিল আফসানাকে পৌঁছে দিয়ে সে চলে যাবে। অথচ এখানে এসে আড্ডার আসর পেতে বসেছে। বাচ্চা থেকে শুরু করে বড় – সকলে ঘিরে ধরেছে সানান ভাইকে।
নিজস্ব জগতে ব্যস্ত সানান ভাই বেশ ভালো গল্প বলতে পারে। আড্ডার আসরে মাতিয়ে রাখে সকলকে। এজন্যই কিশোরদের মাঝে সানান ভাইয়ের তুমুল জনপ্রিয়তা রয়েছে।
অন্যদিকে মুরুব্বিদের কাছে সানান ভাই একজন সুশীল নাগরিক। যে ভালো রেজাল্ট নিয়ে পড়াশোনা শেষ করেই চাকরি পেয়েছে। এখন মোটে অঙ্কের বেতনও পাচ্ছে।
দেখতে সুদর্শন হওয়ায় রমণী মহলেও সানান ভাইয়ের সমান খ্যাতি রয়েছে। সেই সাথে নাকউঁচু স্বভাবের কারণে মেয়েরা সানান ভাইয়ের পায়ে পায়ে ঘুরতে থাকে। অথচ সানান ভাই ফিরেও তাকায় না।
অনেক হলো সানান ভাইয়ের প্রশংসা। এবার আফসানার দিকে নজর দেওয়া যাক। আফসানা বারান্দার চেয়ারে বসে সবার সাথে গল্প করলেও নজর দিয়ে রেখেছেন ছেলের দিকে। এ বাড়ির একটি ছেলে ভালো গান গায় বোধহয়। গিটার নিয়ে টুংটাং সুর তুলেছিল। তারই সাথে ইতিমধ্যে ভাব জমে গেছে সানান ভাইয়ের। আফসানা উঁচু আওয়াজে সানান ভাইকে ডাক দিলেন,
– সানান, তোর না অফিসে যাওয়ার কথা?
– হ্যাঁ যাচ্ছি।
– অফিস আওয়ার শেষ হলে যাবি? পাঁচটা বাজতে চলল।
এমন অনাসৃষ্টি কথা শুনে সাবা ছুটে এলেন আঙিনা থেকে।
– চলে যাবে মানে?
– ওর অফিসে কাজ আছে।
– সেসব আমি শুনব না। কাল বাদে পরশু গায়ে হলুদ। এখন ফিরে যাওয়ার দরকার নাই। এসেছো যখন থেকে যাও। কত কাজ পড়ে আছে চারদিকে। হাতে হাত লাগিয়ে কাজগুলো গুছিয়ে ফেলো।
– এখন যাক। বিয়ের দিন আসবে। এমনিতেও তোমার ভাতিজা কি আর কাজের ছেলে? ভাতটা পর্যন্ত তুলে খায় না।
– কাজ বলতে কি আর গাছ কাটা বুঝাচ্ছি নাকি ভাবী? ওইতো বাইরে হেঁটে কাজের তদারকি করবে একটু।
– বাড়িতে এতো লোক থাকলে ওর দরকার হবে না। ও বরং যাক।
মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সুনেরাহ। যখন দেখল মায়ের অযুহাত ফুরিয়ে এসেছে তখন নিজে নামল ময়দানে। বলল,
– বিয়ের কিছু কেনাকাটা এখনও বাকি। মা বলছিল সানান ভাই এলে সবাই মিলে মার্কেটে যাব।
সাবার হঠাৎ মনে পড়ায় সানানের দিকে তাকিয়ে অনুরোধ করলেন,
– ছেলেটার শেরওয়ানি কেনা বাকি। তোরা ছেলেরা ছেলেদের পোশাক সম্পর্কে ভালো জানবি। এজন্য সুনেরাহকে যেতে দেয়নি। বলেছি, তুই এলে একসাথে গিয়ে কিনতে।
সহমত পোষণ করল সানাও। বললেন,
– দুদিন ছুটি নিয়ে নে অফিস থেকে। ভাইবোনদের সাথে ঘুরাফেরা কর, আড্ডা দে। এমনিতেও তোদের দেখাসাক্ষাৎ হয় না অনেকদিন। এই সুযোগে সবাই মিলে হৈ-চৈ কর। তুই চলে গেলে ফাঁকা ফাঁকা লাগবে।
এমনিতেও থেকে যাওয়ার বায়না খুঁজছিলেন সানান ভাই। এখানে এসে সাঁঝবাতির পিঠে দুটো ডানা গজিয়েছে। উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে চারদিকে। সে কি ভেবেছে, সানান ভাই খেয়াল করেনি? অবশ্যই খেয়াল করেছে। সে আসা মাত্র কীভাবে ভাব দেখিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল! আদব কায়দা সব ভুলে গিয়েছে মেয়েটা। ভদ্রতার লেশমাত্র নাই। না সালাম দিল, না হালচাল জিজ্ঞাসা করল।
এর একটা বিহিত করা দরকার।
সানান ভাই রাজি হয়ে গেল। বলল,
– আচ্ছা ঠিক আছে। সবাই যখন এত করে বলছ, তোমাদের কথা ফেলি কী করে? চলে গেলে বলবে, সানান ছেলেটা আস্ত বেয়াদব হয়েছে। তোমাদের সম্মানে থেকে যাচ্ছি। তবে ওসব কাজকর্ম করতে আমি পারব না। যা গরম এখানে! ঘরে এসি আছে? নাকি লাগাওনি এখনো?
সাবা মুখ অন্ধকার করে জবাব দিলেন,
– নাহ রে বাবা। পুরাতন রুমে কীভাবে এসি লাগাবো? ওভাবেই আছি গরমে ঘেমেনেয়ে।
– ওহ নো। রাতে ঘুমাব কী করে!
– দক্ষিণের বড় রুমটায় বেশ বাতাস আসে। ওই রুমটা খুলে দিচ্ছি। জানালা খুলে দিয়ে ঘুমাবি। এসির থেকেও বেশি আরাম পাবি।
এত সহজে মেনে নেওয়ার ছেলে সানান ভাই নয়। নিজের ছেলেকে আফসানা ভালোভাবে চিনেন। তাই ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইলেন ছেলের দিকে। কী চলছে এই ছেলের মনে? হঠাৎ করে এত বাধ্য হয়ে গেল কীভাবে?
*
শপিং করতে যাওয়া সাঁঝের নিকট ঈদের থেকেও বেশি আনন্দের৷ অথচ এ বাড়ির যুবক যুবতীরা এখন শপিংয়ে যাবে, সাঁঝ যেতে পারছে না৷ কেউ ওকে সাথে যেতে বলছে না। স্বর্ণলতাও বলেছে, বাড়িতে অনেক কাজ আছে৷ সেগুলো করতে৷ শপিংয়ে ওর কি কাজ?
সাঁঝ বেশ কয়েকবার রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সবার ঘরের আশেপাশে ঘুরঘুর করল৷ কেউ ওকে বিশেষ পাত্তা দিল না। মেয়েরা সাজগোজ নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত৷ সুনেরাহ এই নিয়ে তিনবার জামা পাল্টালো৷ একটাও তার মনমতো হচ্ছ না৷
সাঁঝকে দেখতে পেয়ে ডেকে বলল,
– কোন ড্রেসটা পড়ব বলতো?
– ডার্ক ব্লু টা পড়ো৷ রাতের বেলা ঝলমলে আলোতে আকর্ষণীয় দেখাবে।
সুনেরাহ মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে চেঞ্জ করে এলো। সাঁঝ বেরিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু ছোট অবুঝ মনটা মানল না। কতটুকুই বা বয়স ওর? সবে সতেরোতে পা দিয়েছে৷ মনটা এখনো কৈশোরের আটকে আছে। তুলোর মতো নরম, স্বচ্ছ তার মন, মস্তিষ্ক। বয়সটা এখনো আবদার, আহ্লাদের৷ ফিরে এসে বড্ড আশা নিয়ে বলল,
– আপু, আমিও তোমাদের সাথে যাই?
– পাগল! কোথায় যাচ্ছি জানিস? ব্র্যান্ডের শো রুমে যাব। তোর ওখানে কি কাজ? ওখানে যাওয়ার মতো প্রোপার একটা ড্রেস আছে তোর?
– আমার সুন্দর সুন্দর ড্রেস আছে। কমদামি হলেও বেশ ক্লাসি৷
– কোয়ালিটি দেখেই বুঝা যায় ওগুলোর দাম কেমন। আমাদের সাথে গেলে মানুষ হাসাবি শুধু৷ তার থেকে ভালো বাড়িতে থাক। রান্নায় হেল্প কর।
সাঁঝের কোমল মনে একের পর দাগ কেটে দিয়ে হৈ হুল্লোড় করে যুবক যুবতীরা দলবলে বের হলো বাড়ি থেকে।
বড় ফুপুদের মাইক্রোবাসটা আর সানান ভাইয়ের ভাড়া করা কারে সবাইকে গাদাগাদি করে বসতে দেখল সাঁঝ। না কিছু বলল, না একটুখানি কাঁদল। শুধু নীরব আর্তনাদ বুকে চেপে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে।
ইশ! মার্কেটে গিয়ে ওরা কতো আনন্দ করবে! ওর কেন একটা ভালো জামা নেই? একটা ব্র্যান্ডের জামার দাম কত হয়? খুব বেশি কি?
পাঁচ হাজার, দশ হাজার? এমনি হবে হয়তো। ওসব দোকানে ও কখনো যায়নি। সর্বোচ্চ এক হাজার টাকার জামা আছে ওর কালেকশনে। তাও আবার নিউমার্কেট থেকে কেনা৷
চলবে..
#অক্ষরময়ী
#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব ১৮
সানান ভাই হঠাৎ করে অফিস ফাঁকি দেওয়ায় আবার বিপাকে পড়েছে জাদিদ। আজকে খুব জরুরি একটা প্রজেক্ট সাবমিটের ডেট ছিল। সানান ভাইকে না পেয়ে কোনোরকম ক্লায়েন্টদের সামলে নিয়েছে সে। কিন্তু সানান ভাই এখন বলছে, তার ছুটি চাই৷ আগামী তিন চার দিন অফিসে যেতে পারবে না। এসব শুনে জাদিদের মাথা দপদপ করা শুরু করে দিয়েছে।
– তুই একবারে ছুটি নিয়ে নে৷ আর অফিসে আসার দরকার নাই।
– থ্যাঙ্কিউ বস। আমি কবে থেকেই এই কথা বলতেছি৷ অফিস করতে আমার ভালো লাগে না। খাবো, ঘুরব, আড্ডা দিব আর ঘুমাবো। জীবন একটাই। এতো খেটে কি হবে?
– সানান। মজা করবি না মা*দারি। টেনশনে আমার বাথরুম আটকে আছে বাল।
– এত টেনশন নিয়া কি হবে? তোর একটা বউ থাকলে বলতাম, যা মামা। বউরে একটা চুম্মা দিয়া আয়৷ দেখবি টেনশন গায়েব। সাধে কি বলি, সব চুল পড়ে যাওয়ার আগেই বিয়েটা কইরা নে মামা।
– তোর ফালতু কথা শোনার জন্য আমি তোরে কল দেই নাই৷ কালকে কখন আসবি সেটা বল?
– ফোন রাখ এখন। পরে কথা হবে।
– এই ফোন কাটবি না৷ কখন আস….
সানান ভাই কল কেটে দিয়ে কয়েক পা সামনে এগিয়ে এলো। আঙিনার নারকেল গাছের নিচে গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে সাঁঝ। জলে ছল ছল চোখগুলো তাদের দিকেই নিবদ্ধ।
সানান ভাই সেসবে মনোযোগ না দিয়ে নিজের গম্ভীর কণ্ঠে ডাক দিল,
– এই সাঁঝবাতি, সায়রা কোথায়?
আকস্মিক প্রশ্ন সাঁঝ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ওড়নায় আঙ্গুল পেঁচিয়ে ঝটপট উত্তর দিল।
– বড় মায়ের কাছে।
– যা গিয়ে ওরে রেডি করে নিয়ে আয়। পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে গাড়িতে উঠবি। বেশিক্ষণ ওয়েট করতে পারব না। আজকে ওসব আটা ময়দা মাখামাখি বাদ।
সাঁঝ বোকার মতো চেয়ে রইল। কিন্তু সুনেরাহ গাড়ি থেকে নেমে এসে বলল,
– ও কি আমাদের সাথে যাবে?
সানান ভাই মোবাইলের স্ক্রীনে চোখ রেখে উত্তর দিল,
– হ্যাঁ।
– কেনো?
বড্ড হতাশ শোনালো সুনেরাহ এর কণ্ঠ। সানান ভাই অবাক চোখে তাকাল সুনেরাহ এর দিকে। বিস্ময় প্রকাশ করে বলল,
– ও সাথে না গেলে সায়রাকে দেখবে কে? তুই দেখবি?
– আমি ওসব পারব না।
– এজন্যই সাঁঝবাতি আমাদের যাচ্ছে।
– সায়রাকে সাথে নিতে হবে কেন?
– পাগল নাকি তুই? এই গ্যাদারিং এর মধ্যে আমি ওকে রেখে বাইরে যাব? আম্মা ব্যস্ত থাকবে কাজে। ওকে দেখবে কে?
যৌক্তিক প্রশ্ন। তবুও সুনেরাহ রাগ হলো। সানান ভাইয়ের অতিরিক্ত আহ্লাদ ছোটবোনের প্রতি। বুড়ো বয়সে বাচ্চা নিল সানান ভাইয়ের মা৷ আর সে বাচ্চা পালতেছে সানান ভাই। এসব আদিখ্যেতা দেখলে সুনেরাহ-র গা জ্বলে যায়। দুমদাম পায়ে সে কারের দিকে চলে গেল।
সানান ভাই তাকাল সাঁঝের দিকে। ধমক দিয়ে বলল,
– তুই এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? সময় কি তোর জন্য থেমে থাকবে? মহারাণী ভিক্টোরিয়া তুই?
সাঁঝ দুপাশে মাথা দুলিয়ে না জানিয়ে দৌড়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।
কারের সামনের সীটে বসে আছে সুনেরাহ। ড্রাইভিং সীটে সানান ভাই। মাইক্রোবাসে সবাই গাদাগাদি করে বসেছে। সায়রা ছোট মানুষ। এই গরমে বদ্ধ পরিবেশে কিছুতেই জার্নি করতে পারবে না। ওকে কোলে নিয়ে কারের ব্যাক সীটের দরজা খুলল সাঁঝ৷ সানান ভাই সামনে থেকে ডাক দিল,
– সামনে এসে বস।
সামনে বসে আছে সুনেরাহ৷ সাঁঝ কীভাবে সেখানে গিয়ে বসবে? কোলে বসবে ওর? সানান ভাইটা মাঝেমধ্যে এত বোকার মতো কথা বলে! উপায় না পেয়ে সাঁঝ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেও সুনেরাহ ক্ষেপে গেল৷ বলল,
– সামনে আমি বসেছি। ও পেছনে বসলে কি হয়?
সানান ভাই আরেকদফা অবাক হয়ে তাকাল সুনেরাহ এর দিকে।
– তুই পেছনে গেলে কি সমস্যা? সায়রা ব্যাকসীটে বসতে পারে না৷ সামনে বসতে চাইলে তুই সায়রাকে কোলে নিয়ে বস।
গত সপ্তাহে কেনা নতুন জামাটা প্রথমবার পরেছে সুনেরাহ। একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে সেই জামায় ভাঁজ ফেলতে সে কিছুতেই পারবে না৷ কুচকে যাওয়া জামা পরে আউটলেটে ঘুরলে ওর মান-সম্মান কিছু থাকবে? ওর একটা ক্লাস আছে না?
সুনেরাহ মুখ গোঁজ করে বলল,
– ব্যাকসীটে আমি বসতে পারি না। আমার মাথা ধরে যায়।
– তাহলে তুই মাইক্রোতে চলে যা। ঋষভ ড্রাইভ করছে। ওর পাশের সীটে গিয়ে বস।
স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে আঙ্গুল নাচাতে নাচাতে জবাব দিল সানান ভাই৷ রাগে, ক্ষোভে, অপমানে সুনেরাহ-র চোখে জল আসার যোগাড়৷ দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে রইল সানান ভাইয়ের দিকে৷ সানান ভাইয়ের চোখে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নাই। তা অবশ্য ছিলও না কখনো৷ মুখের বুলি দ্বারা মানুষকে আঘাত করে সর্বদা নির্বিকার থাকে এই ব্যক্তি৷ এবারও তাই রইল৷ তাড়া দিয়ে বলল,
– কী করবি তাড়াতাড়ি কর। দেরী হয়ে যাচ্ছে৷
সুনেরাহ সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে কারের দরজা খুলে দ্রুত নেমে পড়ল৷ সামনে দাঁড়িয়ে আছে সাঁঝ। কোলে বসে থাকা সায়রা আপনমনে সাঁঝের লম্বা বেণী নিয়ে খেলছে৷ সুনেরাহ প্রায় চোখের দৃষ্টি দিয়ে জ্বা*লিয়ে দিত চাইল এই দুই মেয়েকে। দেখো কেমন নিরীহ মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে! যেন তারা কত নিরুপায়! দেখলেই মেজাজ বিগড়ে যায় সুনেরাহ-র৷ মনের রাগ মনে চেপে রেখে সর্বোচ্চ তেজ নিয়ে ব্যাকসীটের দরজা খুলে ধুপ করে বসে পড়ল সে।
উত্তপ্ত পরিস্থিতিকে একপাশে রেখে চুপচাপ সামনের সীট দখল করে বসল সাঁঝ৷ পুরো রাস্তায় ব্যস্ত সময় কাটাল সায়রার সাথে৷ কখনো সায়রার ক্লিপ সেট করে দিল। বাতাসে উড়ন্ত চুল কানে পেছনে গুজে দিল।
সায়রাও ব্যস্ত সাঁঝের হাতের বাহারি চুড়ি নিয়ে৷ কানের ঝুমকায় টোকা দিয়ে বারবার শুনছে ঝুনঝুন শব্দ। সাঁঝের কপালের ছোট কালো টিপটার প্রতি তার ভীষণ লোভ৷ খুলে নিতে চাইছে কিন্তু প্রতিবার সাঁঝ দুষ্টু হেসে আরেকপাশে মাথা সরিয়ে নিচ্ছে৷
মার্কেট বেশি দূরত্বে নয়। তাড়াতাড়ি পৌঁছে যেতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সুনেরাহ। এদের আহ্লাদ দেখে শরীরে আ/গু/ন জ্ব/লছে৷
মোট বারোজন এসেছে শপিং করতে৷ একসাথে লিফটে উঠা সম্ভব হলো না। অর্ধেককে নিয়ে ঋষভ চলে গেল প্রথমে। বরাবরের মতো সানান ভাইয়ের সাথে চিপকে রইল সুনেরাহ। লিফটে উঠে সানান ভাইকে নয়তলার বাটন প্রেস করতে দেখে সুনেরাহ তাকে শুধরে দিল।
– ম্যান কালেকশন আটতলায়। নয়তলার বাটন প্রেস করলে কেন?
– আমরা নয়তলা-ই যাব বলেই প্রেস করেছি।
কার থেকে নেমেই সায়রাকে কোলে নিয়েছে সানান ভাই। অথচ যাকে আনা হয়েছে সায়রার দেখাশোনার জন্য সে মহারাণীর মতো হেলেদুলে হেঁটে বেড়াচ্ছে৷ মার্বেলের মতো বড় চোখ দুটো দিয়ে অবাক হয়ে তাকাচ্ছে চারপাশে৷ যেন জীবনে আগে কখনো এত বড় ভবন দেখেনি। উফ! এই মেয়েটার ছোটলোকি চালচলন দেখলেই সুনেরাহ-র রাগে মাথা ফেটে যাওয়ার যোগাড়৷ এসব আনকালচার, ক্লাসলেস মানুষকে কেউ সাথে নিয়ে ঘুরে! লোক হাসানো কান্ডকারখানা।
– কেনো যাচ্ছি?
– কাজ আছে।
– ওই ফ্লোরে কি কাজ তোমার?
– তোকে বলতে হবে? কে তুই? বললাম ওদের সাথে চলে যা৷ না গিয়ে এখন এত প্রশ্ন করতেছিস কেন? আর একটা কথা বললে লিফট থেকে বের করে দিব। চুপ করে দাঁড়ায় থাক।
সুনেরাহ মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে রইল। নয়তলায় রয়েছে সকল রেস্টুরেন্ট। কর্ণারের টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল সানান ভাই৷ চেয়ার টেনে সায়রাকে বসিয়ে দিয়ে নিজে হাঁটু মুড়ে বসল ওর সামনে। ছোট্ট হাত দুটো ধরে আদুরে কণ্ঠে শুধালো,
– প্রিন্সেস কি খেতে চায়? কি অর্ডার করবো তোমার জন্য?
– আইসকিম।
ঝটপট উত্তর দিল সায়রা। কপালে চুমু দিয়ে সানান ভাই উঠে দাঁড়াল। ফিরে এলো তিনটে আইসক্রিম নিয়ে। তিনজন মেয়ের হাতে তিনটে আইসক্রিম ধরিয়ে দিয়ে সাঁঝকে বলল,
– এখানে বসে সায়রাকে আইসক্রিম খাওয়া৷
সাঁঝ ভিতুর ডিম। ভড়কে গিয়ে বলল,
– একা বসে থাকব?
– নাহ৷ দুজনে মিলে দোকলা বসে আইসক্রিম খাবি৷ কেউ ডিস্টার্ব করবে না। রেস্টুরেন্ট মালিক আমার পরিচিত। সায়রা আরও কিছু খেতে চাইলে অর্ডার দিয়ে নিস। আমাদের শেরওয়ানি কেনা হয়ে গেলে আমি এসে তোদের নিয়ে যাব।
সাঁঝের সম্মতির অপেক্ষা না করে সুনেরাহকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– তুই যাবি নাকি এখানে বসবি?
– অবশ্যই যাব। শপিং করতে এসেছি, আইসক্রিম খেতে নয়।
– তাহলে আমাদের সাথে ঘুরতেছিস কেন? এইটথ ফ্লোরে নেমে গেলেই পারতি৷ এখানে এসে আইসক্রিমও নিলি, এখন আবার শপিং করতেও যাবি। আচ্ছা লোভী মেয়ে তো তুই।
– আমি চেয়েছি তোমার আইসক্রিম?
– খাইতে না চাইলে ফেরত দে৷ কেউ জোর করছে তোরে?
সুনেরাহ আইসক্রিম ফেরত দিল না। উল্টো রাগ করে সেখান থেকে চলে গেল লিফটের দিকে৷ সানান ভাই ওর পিছু নিল। বাকিরা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। যদিও সানান ভাই শেরওয়ানি সম্পর্কে কিছু জানে না। জীবনেও কিনেনি এসব। প্রয়োজন পড়েনি কখনো। দু চারটে বিয়ে করলে না বলতে পারত কোন শেরওয়ানি বরের জন্য ভালো। কিন্তু সানান ভাইয়ের এমন মন্দ কপাল, ছাব্বিশ পেরিয়ে সাতাশে পড়ল তবুও আজ অব্দি একখানা বিয়ে করতে পারল না।
*
সুনেরাহ-র কাজিনদের এখনো শপিং শেষ হয়নি। শেরওয়ানি কেনার পর তাদের মনে হলো, নিজেদের জন্য আরও কিছু কেনাকাটা করা দরকার। মেয়েদের আবদারের কাছে মাথা নোয়াতে হলো আরফিনকে। সবাই মিলে হা/ম/লা দিল সাততলায় ওমেন্স কালেকশনে।
সানান ভাই তখন সাঁঝ ও সায়রাকে নিয়ে ফিরেছে মাত্র। মেয়েরা মৌমাছির মতো শাড়ি, কুর্তি, টু পিস, স্টিচ, ননস্টিচ সেকশনে ছড়িয়ে পড়ল৷ সায়রাকে কোলে নিয়ে সানান ভাই একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। এপাশে কিছু খেলনা দেখে সায়রা বায়না ধরেছে তার একটা পুতুল চাই। বোনের আবদার অবহেলা করা সানান ভাইয়ের পক্ষে অসম্ভব। তাই সানান ভাই চলে গেল সেদিকে৷
সায়রা ভীষণ লক্ষ্মী মেয়ে। একবার যেহেতু বলে ফেলেছে তাই পুতুল সে একটাই নিবে৷
কিন্তু ডল সেকশনে পান্ডা, র্যাবিট, টেডি, হ্যালো কিটি, মিলি, মিকিমাউস, মোটু-পাতলু, লাবুবু ইত্যাদি খেলনা দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ল। কোনটা ছেড়ে কোনটা নিবে?
হ্যালো কিটি ও মিকি মাউস দুটো দু হাতে নিয়ে দাদা ভাইয়ের দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে জানতে চাইল,
– কোনতা সুন্দল?
সানান ভাই গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছুপল দেখে উত্তর দিল।
– দুটোই সুন্দর। তুমি দুটোই নিয়ে নাও৷
– নাহ, নাহ। একতা নিব৷ তুমি বলে দেও।
সানান ভাই একটা বাছাই করে দিলে সেটা আর সায়রার পছন্দ হয় না৷ অন্যটার দিকে আগ্রহভরে তাকিয়ে থাকে। ভাই-বোনের বিপত্তি দেখে শপিংমলের সবাই ভীষণ আনন্দিত। ছেলেরাও এগিয়ে গিয়ে সানান ভাইয়ের ভোগান্তি কমানোর চেষ্টা করল। কিন্তু সায়রাকে দমানো গেল না৷
ঋত হেসে বলল,
– দেখতে হবে বোনটা কার। বড় হয়ে আরও বেশি দুষ্টু হবে। এই মেয়ে তোমাকে খুব প্যারা দিবে সানান ভাই৷ এখন থেকে প্রস্তুতি নেও।
– এগুলা প্যারা না রে পাগল৷ এগুলাই জীবনের আনন্দ। সুন্দর মুহূর্ত। মেয়েরা আবদার, আহ্লাদ না করলে আর কে করবে? আমরা ছেলেরা করবো? মেয়েদের কাজ আহ্লাদ করা৷ ছেলেদের কাজ সেই আহ্লাদ উপভোগ করা।
এতগুলো মানুষ কেউ সায়রাকে সাহায্য করতে পারল না। অভিমানে মুখ ফুলিয়ে একগাদা পুতুলের উপর বসে রইল সে৷ নেহাৎ সায়রা ভালো মেয়ে, তাই কাঁদল না। অন্য কেউ হলে এতক্ষণে কেঁদে, চিৎকার করে শপিংমল মাথায় তুলে ফেলত।
সায়রার অভিমানে ফুলে থাকা গাল দুটো টেনে আরফিন বলল,
– তুমি এই মিকি মাউসটা নেও সানান ভাইয়ের থেকে। হ্যালো কিটিটা আমি তোমাকে কিনে দেই। দুদিন পরে তো ভাইয়ার বিয়ে। সেই উপলক্ষে ভাইয়া তোমাকে গিফট দিচ্ছি৷ ঠিক আছে?
সায়রা বিভ্রান্ত হয়ে তাকাল তার দাদাভাইয়ের দিকে। তার থেকে চোখের ইশারায় সম্মতি পেয়ে রাজি হয়ে গেল। অবশেষে প্রায় অদমনীয় যু*দ্ধ শেষে ছেলেরা যখন ফিরল তখনো মেয়েদের কেনাকাটা নাকি একটুখানি বাকি।
ক্লান্ত পথিকের ন্যায় বাড়ির ছেলে সদস্যরা সিঁড়ির পাশে আশ্রয় নিল৷ সানান ভাইয়ের কোলে সায়রা। আরফিনের কোলে হ্যালো কিটি। ঋষভের কোলে মিকি মাউস। ঋতের হাতে শেরওয়ানির ব্যাগ৷ গৃহহীনের মতো ওরা চেয়ে রইল চেঞ্জিংরুমের দরজার দিকে। যেখানে একজনের পর আরেকজন মেয়ে বেরুচ্ছে। আবার কেউ ঢুকছে। সামনে দাঁড়িয়ে বিশাল লম্বা লাইন।
সানান ভাই এতকিছু খেয়াল করল না৷ সে দেখল সাঁঝবাতিকে। টু পিস এবং কুর্তি সেকশনে মনোযোগ দিয়ে ড্রেস খুঁজে চলেছে সে৷ সবচেয়ে সুন্দর, পছন্দনীয় ড্রেসগুলো বের করে হাতে তুলে দিচ্ছে অন্যদের হাতে। এই যে এখনি একটা চেরি রেড কালারের ড্রেস তুলে দিল সুনেরাহ-রার হাতে। সেটা ছোঁ মেরে নিয়ে চেঞ্জিংরুমের দিকে ছুটল সুনেরাহ। তা দেখে মুখ ফুলিয়ে ইশানা বলল,
– তুমি আমাকে ভালোগুলো দিচ্ছ না কেনো? আমাকেও এমন একটা সুন্দর ড্রেস চুজ করে দেও।
সাঁঝকে বড্ড নিরুপায় দেখালো৷ এতগুলো ড্রেস দেখালো ইশানাকে, একটা পছন্দ হচ্ছে না। অন্যের হাতে যেটা দেখছে সেটাই ওর পছন্দ হয়ে যাচ্ছে।
আশেপাশে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিয়ে অন্যদিকের সেকশনে এগিয়ে গেল সাঁঝ। যাওয়ার আগে ডামির গায়ে পরানো বেবি পিংক কালারের ফ্লোরাল ড্রেসটার দিকে আরেকবার তাকাতে ভুলল না। এত সুন্দর জামা সাঁঝ আগে কখনো দেখেনি। জামাটা পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা। লেহেঙ্গার মতো প্রশস্ত। সবচেয়ে সুন্দর ওড়নাটা।
প্রথম দেখায় চোখ আটকে গিয়েছিল সাঁঝের। দ্বিতীয় দফায় চোখ আটকেছে প্রাইজ ট্যাগে। সাত হাজার চারশত পঁচানব্বই টাকা প্লাস ভ্যাট৷ দাম দেখে সাঁঝের কলিজা পর্যন্ত থরথর করে কেঁপে উঠেছিল।
এরা পাগল নাকি? এত টাকা দিয়ে কে একটা জামা কিনবে?
সবার কেনাকাটা শেষ হতে রাত দশটা বেজে গেল। এরমধ্যে বাড়ি থেকে কয়েকদফা কল চলে এসেছে। বিল কাউন্টারে প্রতিযোগিতার মতো দৌড়ে দৌড়ে পেমেন্ট করছে একেকজন। সাঁঝ একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখল। এরা টাকাকে কিছু মনে করে না। সুনেরাহ একটা ড্রেস কিনল নয় হাজার টাকা দাম। চোখের সামনে দেখেও বিশ্বাস হতে চাইছে না সাঁঝের।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাঁঝ নিজের সমস্ত দুঃখ, সমস্ত আফসোস উড়িয়ে দিল। সে এখান থেকে বাড়ি ফিরবে হাসি মুখে৷ কোনো হতাশাকে মনের মধ্যে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিতে দিবে না। নিজেদের এই আর্থিক অবস্থার মধ্যে, সাধ্যের মধ্যে যতটুকু পাচ্ছে তাই নিয়ে খুশি থাকার চেষ্টা করবে।
সাঁঝ আপনমনে মলিন হেসে সায়রার দিকে তাকাল। সামান্যদূরে ছেলেরা সবাই দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েদের পেমেন্ট ক্লিয়ার হলে না হয় নিজেরাই চলে আসবে। আপাতত এখানে সাঁঝের কোনো কাজ নেই৷ সে চলল সায়রার কাছে।
– এক্সকিউজ মি, ম্যাম? আপনার ব্যাগটা।
সেলসম্যানের ডাকে পা থমকালো সাঁঝের। কাকে ডাকছে? সাঁঝকে? কপালে গাঢ় ভাঁজ পড়ল সাঁঝের।
ওকে আরেকদফা অবাক করে দিয়ে সেলসম্যান ওর দিকে একটা শপিংব্যাগ এগিয়ে দিল।
– কার এটা?
– ম্যাম, আপনার ড্রেসটা।
সাঁঝ কখন ড্রেস অর্ডার করল? কী আশ্চর্য কথা! অনিচ্ছাসত্ত্বেও ব্যাগটি হাতে নিয়ে অবাক হতেও ভুলে গেল সে৷ হতবাক চোখে চেয়ে রইল ব্যাগের ভেতরের ড্রেসটির দিকে। সেই বেবি পিংক কালারের ফ্লোরাল ড্রেসটা!
সাঁঝ তার কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে বলল,
– এটা আমি প্যাক করতে বলিনি। আমি যাস্ট দেখছিলাম। আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে।
– কিন্তু ম্যাম, আপনার নামেই অর্ডার করা হয়েছে।
– কে করেছে?
– স্যরি ম্যাম। নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না। তবে আপনাদের গ্রুপেরই কেউ একজন ক্যাশ কাউন্টারে পাঠিয়েছে।
– কে পাঠিয়েছে আমি জানি না। কেউ বোধহয় মজা করেছে।
– কিন্তু ম্যাম আপনার নামে অলরেডি বিল হয়ে গেছে।
– এটা আমি নিতে পারব না। আমার কাছে কোনো টাকা নেই।
– ম্যাম, এটার বিল পে করা হয়ে গেছে৷ আপনি নিয়ে যেতে পারেন।
জীবনের সবচেয়ে বড় আশ্চর্যজনক ঘটনার সামনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাঁঝ। এমন পরিস্থিতিতে তার কী রকম প্রতিক্রিয়া জানানো উচিত? খুশি হবে নাকি অবাক হবে? খুব বেশি খুশি হবে নাকি একটু হবে?
আনন্দে এক্ষুণি একটা লাফ দিয়ে উঠলে লোকে তাকে পাগল ভাববে কি? নিশ্চয়ই ভাববে। এর থেকেও বেশি দামের ড্রেস কিনে এরা এমনভাবে বেরিয়ে যাচ্ছে যেন কিছুই হয়নি। হরহামেশাই কিনছে যে। কিন্তু সাঁঝের জীবনকালে এমন ঘটনা আজই প্রথম।
অত্যাধিক খুশি হওয়াটা খুব বেশি অকওয়ার্ড দেখাবে না বোধহয়। ওরা যেদিন প্রথম খুব দামী একটা ড্রেস কিনেছিল, ওদেরও এমন অনুভূতি হয়েছিল নিশ্চয়ই৷ প্রথম অভিজ্ঞতায় সবাই নার্ভাস হয়, সবাই আবেগী হয়। তাই না?
এলোমেলো ভাবনার মাঝে সাঁঝ খেয়াল করেনি কখন তার চোখে জল জমেছে। ইশিতা এসে যখন বলল, সাঁঝ ভীষণ লজ্জা পেলো।
– তোমার চোখে পানি কেনো? তুমি কাঁদছ!
সাঁঝ দ্রুত চোখের কোল মুছে বলল,
– কই না তো।
ইশানা সে কথা শুনবে কেনো? ফ্লোরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে নিজের বোনকে ডাকল।
– এই সুনেরাহ আপু দেখো, ড্রেস কিনতে না পেরে সাঁঝ আপু কাঁদছে। তোমাকে বলেছিলাম না, আমরা ড্রেস কিনছি বলে ওর সহ্য হচ্ছে না৷ এবার মিলল আমার কথা?
ইশানার কথা শুনে ওরা সবাই হো হো করে হেসে উঠল। আশেপাশের ক্রেতারাও অবাক চোখে তাকাল সাঁঝের দিকে। যেন সে এক আশ্চর্য বস্তু। কারো চোখে তাচ্ছিল্য, কারো চোখে সহমর্মিতা দেখে সাঁঝের ইচ্ছে হলো এখানেই প্রাণ ত্যাগ করে৷ ছিঃ! কী লজ্জা!
মাথা নত করে থুতনি একেবারে বুকের সাথে মিশে ফেলতে চাইছে সে। কানের ভেতর ভোঁ ভোঁ আওয়াজের মাঝে দূর থেকে ভেসে এলো সানান ভাইয়ের রাশভারি কণ্ঠস্বর।
– তোরা কি এখন বের হবি নাকি আমরা তোদের ফেলে রেখে চলে যাব? বাড়ি থেকে বারবার কল আসতেছে।
আর কিছু অবশ্য বলতে হলো না কাউকে। পড়িমরি করে ছুটল সবাই। কার আগে কে গিয়ে উঠতে পারে গাড়িতে, এ যেনো প্রতিযোগিতা লেগেছে।
চলবে..
#অক্ষরময়ী