এই সাঁঝবাতি পর্ব-২১+২২

0
16

#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব ২১

বাড়িতে নতুন বউ এসেছে৷ বউ বরণে ব্যস্ত সময় কেটেছে বড়দের৷ বর-বউকে রুমে পাঠিয়ে যে যার মতো বিশ্রাম নিতে চলে গেল। বাসর রাত আরফিনের অথচ আনন্দ, উত্তেজনায় উচ্ছ্বসিত দুষ্টু ছেলের দল।

বারবিকিউ পার্টির আয়োজন করা হয়েছে ছাদে। উচ্চস্বরে গান বাজছে। নানা রকম স্ন্যাকস রাখা হয়েছে টেবিল জুড়ে৷ কয়লা থেকে ধোঁয়া উঠছে একপাশে৷ সানান ভাই চেয়ার টেনে পা ছড়িয়ে বসে কিছুক্ষণ পরপর বারবিকিউ চেক করছে।

মাঝখানে উদ্যম নৃত্যে মেতেছে একটা দল। একজন হাঁপিয়ে গেলে তার জায়গা নিচ্ছে আরেকজন। দলের সদস্য কমছে না, বরং বাড়ছে৷ পালা করে নেচে চলেছে অনবরত।

“চিকন ছাকন মাঞ্জা ধূলে গানের তালে তালে
হায় হায় গানের তালে তালে
হাসি দিলে টোল পড়ে তোমার দুটি গালে
চুপিচুপি ডাকো তুমি কাছে আসনা
আসলে তুমি আমায় ভালোবাসো না…”

জিন্স প্যান্ট, শার্ট পরে ছেলেদের কোমর দুলিয়ে নাচতে দেখে সানান ভাই নিজেও হাসি চেপে রাখতে পারছে না৷ সুনেহরা হাসতে হাসতে প্রায় লুটিয়ে পড়ছে সানান ভাইয়ের গায়ের উপর৷
সানান ভাই বিরক্ত হয়ে বলল,

– বারবার গায়ের উপর ঢলে পড়তেছিস কেন? যা দূরে গিয়ে দাঁড়া।

সুনেহরার মন খারাপ হলো। গানের দলটাকে পেরিয়ে অপরপাশে খাবার টেবিলের পাশে একটা চেয়ার টেনে বসল। আরেক চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ পরপর শিস বাজাচ্ছে ইশানা। সুনেহরা ওর হাতটা টেনে মুখ থেকে সরিয়ে দিল৷ ইশানা জেদ করে আবারও শিস বাজালো কয়েকবার।

গান শেষ হতেই ক্লান্ত ঋষভ এসে বসল ইশানার পাশে৷ পরবর্তী গানে নাচার জন্য আরেকদল উঠেছে মঞ্চে৷ সুনেহরা বিরক্ত হয়ে আশেপাশে তাকাল। সাঁঝকে উঠতে দেখল ছাদে৷ ফুল তোলা একটা জামা পরেছে। চুলগুলো খোলা। রূপকথার রাজকন্যার থেকে কম কিছু দেখাচ্ছে না ওকে। সুনেহরার দ্বিগুণ মেজাজ খারাপ হলো। ঝাঁঝালো কণ্ঠে ডাক দিল,

– সাঁঝ, শরবত বানিয়ে নিয়ে আয়। যা গরম পড়েছে!

মেহমানদের মিষ্টি পরিবেশন করে সবে একটু বিশ্রামের সুযোগ পেল সাঁঝ। সবাই ছাদে আনন্দ করছে দেখে সেও বিশ্রাম না নিয়ে ক্লান্ত শরীরকে টেনে নিয়ে এসেছে ছাদে। এখন আবার শরবতের আবদার।

সাঁঝ নিচে নেমে গিয়ে বড় পাত্রে শরবত বানিয়ে আনল। এ কাজে তাকে সাহায্য করল বাড়ির কাজের মহিলাটি। সাঁঝের সাথে হাত মিলিয়ে শরবতের গ্লাস তুলে দিল সবার হাতে। গ্লাসে চুমুক দিয়ে সুনেহরা নালিশ জানাতে ভুলল না।

– চিনি কম হয়েছে।

– ঘরে যেইটুকু চিনি ছিল, সবটাই ঢাইলা দিছি৷

উত্তর দিল কাজের মহিলাটি। সাঁঝ মনে মনে হাসল। ইশানাকে শরবত দিয়ে, পাশে বসে থাকা ঋষভকেও দিল এক গ্লাস। পেছনের সারিতে বসে নিজের শরবতের গ্লাসে চুমুক দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঋষভের চেয়ারের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় টের পেল একটি হাত খুব বিশ্রী ভাবে ছুঁয়ে দিল কোমর৷ সেই স্থানে বরফের ন্যায় জমে গেল সাঁঝ।

ঘাড় ফিরিয়ে দেখল ঋষভ আপনমনে গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে৷ সাঁঝ তাকাতেই মুখ তুলে চাইল ওর দিকে৷ ঠোঁটের কোণে দেখা দিল কূটিল হাসি। সাঁঝের গা ঘিনঘিন করে উঠল। আশেপাশে তাকাল সাহায্যের জন্য৷ কিন্তু সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত। কেউ ওর দিকে নজর দিল না।
সাঁঝ এক ছুটে ছাদ থেকে নিচে নেমে গেল। সারারাত না ঘুমিয়ে চোখের জল ফেলল শুধু।

সবার অলক্ষ্যে একটি মেয়ের স্বচ্ছ, পবিত্র মন পঙ্কিলতার ছোঁয়ায় এক নিমিষে ধ্বংস হয়ে গেল। কেউ টের পেল না৷

*

ভোরবেলা তিনটা গরু জ বা ই করা হয়েছে। বিশাল আয়োজন হবে বৌভাতে৷ এলাকার সকলকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। সকালের জন্য রান্না হচ্ছে খিচুড়ি। চারপাশে মশলার ঘ্রাণ। বড় ডেক রাখা হয়েছে বারান্দায়। যে যার মতো তুলে নিবে।
পাশেই বিছানো আছে পাটি। প্লেট হাতে পাটিতে বসে খাচ্ছে বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ৷ শুধু দেখা নেই সাঁঝের। রাগে সাঁঝের মায়ের মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। লুকিয়ে সাভিনকে পাঠিয়েছেন নবাবজাদিকে ডাকতে৷ এখানে কেউ যদি শুনে সাঁঝ এখনো ঘুম থেকে উঠেনি, তবে নানান কথা শুরু হয়ে যাবে।

সাভিন ফিরে এলো একা। মায়ের পাশে বসে ফিসফিসিয়ে বলল,

– আসছে না৷

– কেন?

– ক্ষুধা নাই বলল।

– এখানো ঘুমাচ্ছে?

– নাহ। জেগে আছে। কিন্তু বিছানা ছাড়ে নাই৷

স্বর্ণলতা প্লেট রেখে উঠে দাঁড়ালেন। সবার আড়ালে দ্রুত চলে গেলেন দোতলায় সাঁঝের রুমে। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে সাঁঝ৷ দরজা আটকে মেয়ের পিঠে জোরে একটা চাপড় মারলেন। সাঁঝ কিছু বুঝে উঠার আগেই বাহু ধরে টেনে তুলে বললেন,

– বেলা কয়টা বাজে? লোকে তোর জন্য খাবার আগলে বসে থাকবে?

কাঁদতে কাঁদতে সাঁঝের চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। আর কাঁদল না। গোঁ ধরে বলল,

– কাউকে খাবার আগলে বসে থাকতে হবে না৷ আমি খাব না।

– কেন খাবি না।

– ক্ষুধা নাই।

– সারারাত পার করে সকালে কার ক্ষুধা থাকে না? মেহমানের বাড়িতে নাটক করবি না। তাড়াতাড়ি নিচে আয়৷

– আমি বাড়ি যাব।

স্বর্ণলতা চলে যাচ্ছিলেন। সাঁঝের কথা শুনে ফিরে এসে চট করে একটা থাপ্পড় মারলেন ওর গালে। সাঁঝ কাদল না। আরও জেদ দেখিয়ে বলল,

– থাকব না এখানে। আমাকে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করো।

– রান্নাঘরে অনেক কাজ আছে। নিচে আয়।

সাঁঝ নিচে গেল না। বালিশে মাথা দিয়ে রেখে আবার শুয়ে পড়ল। গতকাল রাতে রুমে আসার পর আর বের হয়নি। বারবিকিউ খাওয়ার সময় সাবিল এসেছিল ডাকতে। সাঁঝ যায়নি। সে ঠিক করেছে এই রুম থেকে তখনি বের হবে যখন সে বাড়ি যাবে৷

বেলা বাড়তে শুরু করলে সাঁঝ একসময় ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্ন দেখল৷ লাল টুকটুকে সেমি ব্রাইডাল শাড়ি পরেছে সে। চারপাশে অনেক মানুষজন দেখা যাচ্ছে৷ বোধহয় কোনো মেলা বসেছে। সাঁঝ বুঝতে পারছে না এমন জনসমাগমে সে শাড়ি পরে এসেছে কেনো। তাও আবার বিয়ের কনেদের মতো সেজেছে।
ভীড় ঠেলে সে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে৷ কিন্তু এগোতে পারছে না। অথচ তার আশেপাশের লোকগুলো একজন আরেকজনের গায়ে ধাক্কা দিয়ে, ঠেলাঠেলি করে ঠিকই হাঁটাচলা করছে৷ সাঁঝ খেয়াল করল প্রতিটি মানুষ ওর পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় গা ছুঁয়ে যেতে শুরু করেছে। আকস্মিক ঘটনায় বেশ হকচকিয়ে গেল সাঁঝ। এখান থেকে সরে যাওয়ার উপায় নাই৷ চারপাশে মানুষজন ঘিরে ফেলেছে ওকে৷ ধীরে ধীরে মানুষগুলোর নজর পড়ল সাঁঝের উপর। চলার পথ পরিবর্তন করে ওরা এগিয়ে আসতে লাগল সাঁঝের দিকে৷ অস্থির সাঁঝ দুহাতে আড়াল করতে চাইল নিজেকে। কিন্তু কতোগুলো হাত বিশ্রীভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছে নগ্ন উদর, কোমর, পিঠ, গলা। সাঁঝ চিৎকার করতে চাইছে কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। সারাদেহে পোকার মতোন কিলবিল করছে অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ। ধাক্কাধাক্কির কারণে সাঁঝ একসময় মাটিতে পড়ে গেল। তবুও হাতগুলো থামল না। দেহের আরও গভীরে পৌঁছে যেতে শুরু করেছে ওরা৷ একটা হাত শাড়ির আঁচল ধরে টান দিতেই চিৎকার করে উঠল সাঁঝ৷

চারপাশে তাকিয়ে দেখল, সে এখনো বিছানায় শুয়ে আছে। সকালের মিষ্টি রোদ মিলিয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে। কড়া রোদ প্রবেশ করছে জানালা দিয়ে। সে বিছানা থেকে নামল। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে চারপাশ। এটা সুনেহরার রুম। ওরা এখন উত্তরায়। ছোট ফুপির বাড়িতে৷ আরফিন ভাইয়ার বিয়ে হয়েছে গতকাল। আজ তার বৌভাত৷

বাইরে বেশ কোলাহল শোনা যাচ্ছে। কে যেনো গলা ছেড়ে কাঁদছে৷ মেয়েলি কণ্ঠস্বর। বিলাপ করছে করুণসুরে। কে এভাবে কাঁদে? কেন কাঁদে?

ব্যাপারটা জানা দরকার। দরজা খুলে বাইরে পা রাখতে গিয়েও থমকে দাড়াল সাঁঝ। ওর ভয় লাগছে৷
বাইরে কী হচ্ছে সেটা জানার আগ্রহের থেকে ভয়ের মাত্রাটা বেশি৷ ও বের হলো না। চুপচাপ দরজায় দাঁড়িয়ে রইল।

এদিকে ছুটে আসতে দেখা গেল ইশানকে৷ সাঁঝকে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,

– ঘুমাচ্ছিলি নাকি?

– হুম।

– বেশ, বেশ। আ/গুনে ঘর পু/ড়ে ছাই হয়ে গেলেও তোর ঘুম ভাঙবে না।

– ওদিকে কি হচ্ছে? কে কাঁদছে?

– তোর ছোট ফুপু।

– কেনো?

– উনার বাড়িতে এসে এত বড় অঘটন ঘটে গেল বলে উনার খারাপ লাগছে।

– কি ঘটেছে?

– ঋষভ ভাইয়ার খুব বিশ্রীভাবে হাত কে/টেছে।

– সেকি! কীভাবে কা/টল?

– দরজার চিপায় পড়েছে।

– অনেকটা কেটেছে?

– হুম। চারটা আঙ্গুল শেষ। চামড়া কেটে গিয়ে ভেতরের সাদা মাংস দেখা যাচ্ছে। হাড়ের জন্য কোনোরকম হাতের সাথে আটকে আছে এখনো।

ইশান স্বাভাবিকভাবে বর্ণনা করলেও সাঁঝের গা শিউরে উঠল। দ্রুত পায়ে ছুটল নিচে৷
বারান্দায় শুয়ে রাখা হয়েছে বড় ফুপুকে। উনার জ্ঞান নেই। ছেলের এই অবস্থা দেখে মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন। পাশে বসে বিলাপ করছেন ছোট ফুপু৷ উনাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির মহিলারা৷

পুরুষ সদস্যরা কিছুক্ষণ আফসোস করে নিজের কাজে ফিরে গেছেন। দুপুরের মধ্যে রান্না শেষ করে ফেলতে হবে। নামাজের পরপরই দাওয়াতের লোকজন আসতে শুরু করবে।

সাঁঝ আতংকিত চেহারা নিয়ে মায়ের পাশে বসল। ছোট ফুপু তখনো গলার ছেড়ে বিলাপ করে কাঁদছেন। উনার গলা বসে গেছে।

“ছাদের দরজাটা কবেই নষ্ট হয়েছে৷ একটু বাতাসেই দুমদাম বারি খায়৷ ইশানের বাবাকে হাজারবার বলেছিলাম, মিস্ত্রি ডেকে দরজাটা ঠিক করে নেও৷ ওই লোক আমার একটা কথা শোনে না৷ একটা ইট এনে দরজার নিচে রেখে দিল। বিয়ে বাড়িতে ওসব ইট-ফিট কি জায়গামতো থাকে? কে না কে ইটটা সরায় ফেলছে। আহারে আমার বাবাটা! বাতাসের ধাক্কায় হাতটা সরানোর সময়টাও পায় নাই।”

সাঁঝ গুটিগুটি মেরে মায়ের গা ঘেঁষে জানতে চাইল,

– কেমনে কি হইল?

বড় ফুপুর জ্ঞান ফিরেছে। তার হাতের তালুতে তেল মালিশ করছে স্বর্ণলতা। মেয়ের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে নিচু গলায় উত্তর দিলেন,

– তুই পড়ে পড়ে ঘুমা।

– আমি জেগে থাকলে কি দূর্ঘটনা ঘটত না? যার হওয়ার তা হবেই।

– ছাদের দরজাটা ইট চাপা দেওয়া ছিল। বাচ্চারা মনে হয় খেলার সময় ইট সরায় দরজার সামনে এনে রাখছে। ইটে ধাক্কা খাইছে ঋষভ। দরজার ফ্রেম ধরে সামলাতে গেছিল। ওপাশ থেকে বাতাসের ধাক্কায় দরজা লেগে গেছে।

– ঋষভ ভাইয়া এখন কই?

– হাসপাতালে নিয়ে গেছে।

বাড়ির পরিবেশ থমথমে। নতুন বউ তার ঘরে গুটিশুটি মেরে বসে আছে। আকস্মিক দূর্ঘটনায় বেশ ভয় পেয়েছে৷ একটু পরপর কেউ না কেউ এসে তার সামনে আফসোস করে যাচ্ছে।

“ঋষভের সে কী চিল্লানি! আমি দৌড় মেরে গিয়ে দেখি, দরজার পাল্লা আর ফ্রেমের মাঝখানে হাত আটকে আছে। তখনো বাইর করতে পারে নাই। সানান গিয়ে দরজার পাল্লা সরায় টান দিয়ে হাত বের করল৷ হায়রে র/ক্ত! তুমি দেখলে তোমার মাথা ঘুরায় যাইত, নতুন বউ। যুবক ছেলে। শরীর জুড়ে গরম র/ক্ত। সব গলগল করে বের হচ্ছিল।”

গল্প শুনে নতুন বউ আরও বেশি ভয় পায়। আশেপাশে তাকিয়ে নীরবে স্বামীর খোঁজ করে। ঋষভকে সাথে নিয়ে আরফিন গেছে হাসপাতালে। ঘন্টা দুয়েক বাদে ওরা ফিরে আসতেই নতুন বউ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

ঋষভের হাতের বেশি ক্ষতি হয়নি। তবে ক্ষত বেশ গভীর। এক দুই মাস খুব ভোগাবে। ডান হাত দিয়ে আপাতত কিছু করতে পারবে না। পুরোপুরি বেডরেস্টের আদেশ জারি হয়েছে। দুপুরের খাবার না খেয়ে ওভাবেই ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল সাঁঝের বড় ফুপু।

তিনি চলে যাওয়া মাত্র শোকের কুয়াশা কেটে গিয়ে ছড়িয়ে যেতে লাগল বিয়েবাড়ির উচ্ছ্বাস।

*

সারাদিন কিছু মুখে তুলেনি সাঁঝ। মেয়ের জেদ দেখে স্বর্ণলতা প্রচন্ড বিরক্ত। নিজের বাড়িতে এই ঘটনা ঘটলে এতক্ষণে পিটিয়ে পিঠের ছাল তুলে ফেলতেন। অন্যের বাড়ি বলে শুধু চোখ রাঙানি দিচ্ছেন। সাঁঝ সেসবে বিশেষ পাত্তা দিচ্ছে না। মায়ের ভয় এড়াতে নিজেকে আটকে ফেলেছে ঘরে৷ না দেখল মায়ের রক্তিম চোখ, না পেল ভয়।

মেয়ের জেদ দেখে স্বর্ণলতার দুশ্চিন্তা বাড়ছে। এইতো খারাপ বয়সটা চলে এসেছে। শুয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হতে বেশি সময় লাগবে না৷ স্বর্ণলতা স্পষ্ট বুঝতে পারছেন, ইতিমধ্যে প্রজাপতি ডানা মেলতে শুরু করেছে। আগে সন্দেহ ছিল, গতকাল তিনি নিশ্চিত হয়েছেন।

বরযাত্রীদের গাড়িটা বেরিয়ে যাওয়ার পর বাড়িটা একটু শান্ত হয়েছিল। মেয়ের খোঁজ করতে গিয়ে স্বর্ণলতার চক্ষুচড়ক গাছ। হালকা গোলাপি রঙের একটা জামা পরে রুম থেকে বের হচ্ছিল সাঁঝ। শান্ত নদীতে ফুটে থাকা কোনো পদ্ম ফুলের থেকে কম সুন্দর লাগছিল না স্বর্ণলতার মেয়েকে। কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন তিনি জানেন না। সন্তানের উপর মায়ের নজর লাগে বেশি। কথাটি খেয়াল হতেই চোখ ফিরিয়ে নেন৷

আবেগ ধীরে ধীরে প্রশমিত হলে স্বর্ণলতা খেয়াল করলেন, এমন কোনো জামা কখনো মেয়েকে কিনে দেওয়া হয়নি। এই জামা এলো কোথা থেকে?

– কার জামা এটা? কোথায় পেলি?

মায়ের প্রশ্ন শুনে মুখ শুকিয়ে এসেছিল সাঁঝের৷ মিথ্যা কথা বলতে সে জানে না। ছোটবেলা থেকে কঠোর ন্যায়-নীতি শিক্ষায় বড় হয়ে এসেছে সে। দাদী সবসময় জাহান্নামের কঠিন শা/স্তির গল্প রসিয়ে রসিয়ে বলতেন।

“সবার চোখ ফাঁকি দিতে পারলেও আল্লাহর চোখ ফাঁকি দিতে পারবি না, বু। কেউ দেখতাছে না মনে কইরা কারো গাছের ফল ছিঁড়া দৌড় দিলি। কিন্তু উপরে বইসা থাইকা আল্লাহ ঠিকই দেখল। মুচকি হাইসা কইল, হিসাবের খাতায় টুকে রাখলাম, বান্দা। ম/রার পর এর শাস্তি পাইবা।”

ছোট সাঁঝের কাকচক্ষু দুটো তখন আরও বড় দেখাত। মার্বেলের মতোন চোখ গোল গোল করে সে জানতে চাইত,

“কি শাস্তি দিবে?”

“বড় কড়াইয়ে তেল গরম করবে৷ টগবগ টগবগ কইরা ফুটব সেই তেল। তোরে চুবাইবো সেই গরম তেলে।”

গা শিউরে উঠত সাঁঝের। দাদী থামে না। একেকপর এক গল্প বলে যায়।

“মিছা কতা কোনোকালে কবি না। আল্লাহ সব দেখছে, সব জাইনা বইসা রইছে। তার লগে মিছা কতা কওন যায়? যায় না। মিছা কথা কইলে আল্লাহ কি করব জানোস? যেই জিহ্বা দিয়া মিছা কতা কবি সেই জিহ্বা টাইনা বাইর কইরা মাথার উল্টা দিকে গাছের সাথে পেরেক মাইরা দিব৷”

অন্যরা যেখানে রূপকথার গল্প শুনে বড় হয়, সাঁঝ সেখানে এমন ভয়ংকর সব শাস্তির গল্প শুনে বড় হয়েছে। যা আজও মন মস্তিষ্কে স্থায়ীভাবে বসত করে আছে৷

সাঁঝকে চুপ থাকতে দেখে সন্দেহ গাঢ় হয়েছিল স্বর্ণলতার। ধৈর্যের বাধ ভেঙে যাচ্ছিল তখনি এলো আরফিনের মা। সাঁঝকে দেখে সবিস্ময়ে বললেন,

– আরে সাঝ! তোমাকে কী সুন্দর লাগছে! কবে কিনেছো এটা?

সাঁঝ মাথা নিচু করে ভয়ার্ত কণ্ঠে জবাব দিল,

– থ্যাঙ্কিউ আন্টি। কালকে কিনেছি৷

– ওহ হ্যাঁ। তুমিও তো মার্কেট গিয়েছিলে ওদের সাথে৷ আরফিন কিনে দিয়েছে বুঝি?

সাঁঝ হ্যাঁ, না কিছু বলেনি৷ তা আগেই স্বর্ণলতার ডাক পড়েছে অন্যদিকে। সে যাত্রায় সাঁঝ বেঁচে গেলেও ব্যাপারটা স্বর্ণলতাকে স্বস্তি দিচ্ছে না। কেনো অন্যের থেকে জামা কিনে নিতে হবে? সেদিন তাশফীনের থেকে শাড়ি নিল, এবার আরফিনের থেকে জামা। মেয়েটা তাঁর দিনদিন বখে যাচ্ছে। হাত পাতার স্বভাব হয়েছে। এখন আবার জেদ করাও শিখে গেল।

একটা ছোট প্লেটে খাবার নিয়ে সায়রাকে খাওয়াচ্ছিলেন বড় মা। সানান ভাই মাত্র হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। বড় মা বললেন,

– সানান, ফ্রেশ হয়ে এসে খেতে বস।

– সময় নাই, আম্মা। বাড়ি যেতে হবে।

– এখনি যাবি! খেয়ে-দেয়ে বিকালে যাস।

– সম্ভব না। কাজ পড়ে গেছে।

– ঠিক আছে। সায়রাকেও জামা কাপড় পরিয়ে দে৷ আমি গিয়ে ব্যাগ গুছাই৷

সানান ভাইয়ের মুখটা সকাল থেকে বেশ থমথমে। তাই কথা বাড়ালেন না বড় মা। ছেলের মন-মেজাজ সম্পর্কে তাঁর বেশ ধারণা আছে৷ খুব বেশি ক্ষেপে গেলে বড় মা হাত গুটিয়ে নেন। আজকেও তাই করলেন।

অসময়ে চলে যাওয়ার ব্যাপারটা কেউ ভালোভাবে নিবে না, সেটা তিনি জানেন। কিন্তু এসব নিয়ে তিনি ভাবছেন না। নিজের সন্তানদের ভালোমন্দ সবার আগে। কে কি ভাবল তা দিয়ে কি করবেন?

আধাঘন্টার মধ্যে ব্যাগপত্র নিয়ে সানান ভাইকে বের হতে দেখে ছোট ফুপুর মাথায় হাত। ছেলেটা সেই সকাল থেকে কিছু মুখে দেয়নি৷ খালি মুখে বাড়ি ছাড়ছে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। প্রথমে অনুরোধ তারপর অনুযোগ করেও বিশেষ লাভ হলো না।

সানান ভাই একটু তাড়া দেখালে বড় মা দ্বিগুণ তাড়া দেখান। ছেলের তালে তাল মিলিয়ে চলা উনার চিরকালের স্বভাব। এ নিয়ে সবাই কানাঘুষা শুরু করল। বড় মা কি চাইলে পারতেন না, ছেলেকে আটকাতে? অবশ্যই পারতেন। কিন্তু সেটা না করে তিনি আরও ছেলেকে উস্কে দিয়েছেন।

সানান ভাইরা যখন কারে উঠে বসল তখন নিচে নামল সাঁঝ। সায়রা ওকে দেখে জানালা দিয়ে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছে।
ঘটনা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় ব্যয় করল সাঁঝ। অত:পর দৌড়ে গেল কারের কাছে। বড় মাকে বলল,

– আপনারা চলে যাচ্ছেন?

– হ্যাঁ। সানানের হঠাৎ কাজ পড়েছে।

– আমিও যাব। আমাকে সাথে নিয়ে যান।

অন্য কোনো সময় হলে এমন আবদার করা সাঁঝের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাও আবার সরাসরি বড় মায়ের কাছে আবদার! অসম্ভব প্রায়। গতকালের ঘটনার পর এ বাড়িতে আতংকে দিন কাটছে সাঁঝের। বাঁচার তাগিদে মানুষ কী না করে! সা।ঝও নিজের ভয়, অস্বস্তি দূরে সরিয়ে আবদার করে বসেছে।

বড় মা নিজেও এমন ঘটনায় অবাক হয়ে সাঁঝের দিকে চেয়ে আছেন। মেয়েটার কণ্ঠ কাঁপছে। চোখ দুটো এমনিতেই সারাক্ষণ ছলছল করে। এই মূহুর্তে জল আরও গাঢ় হয়েছে। তিনি কিছুক্ষণ নীরবে চেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে সানান ভাইয়ের দিকে তাকালেন। সানান ভাই সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে থেকে জবাব দিলেন,

– পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে আসতে বলো। এর বেশি অপেক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব না।

সাঁঝকে আর কিছু বলতে হলো না। হাওয়ার মতো ছুটে গেল রুমে। জামা পাল্টে অগোছালো চুল কোনোরকমে বেণী করে নিল। হ্যান্ডব্যাগটা হাতে নিয়ে বাইরে বের হতেই পথ রোধ করে দাঁড়ালো সাঁঝের মা।

– তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে?

– কেনো কি হয়েছে?

– তুই ওদের সাথে যাবি? ওরা কার ভাড়া করে নিয়ে এসেছে। তুই ফ্রিতে ওদের কারে উঠবি?

– আমাকে একা যেতে দিবে না। ওদের কারে যাওয়া যাবে না। তাহলে কীভাবে যাব? তুমি বাড়ি দিয়ে আসবে আমাকে?

– তোর আজকেই বাড়ি যেতে হবে কেন? মতলবটা কি?

– কোনো মতলব নাই। বিশ্বাস না হলে সাভিনকে আমার সাথে পাঠিয়ে দেও। ও পাহারা দিবে আমাকে৷

কাউকে সাথে দিতে হলো না। বড় মা জানালেন, স্বর্ণলতা না ফেরা পর্যন্ত সাঁঝকে তিনি নিজের কাছে রাখবেন।

কারে উঠে সাঁঝের মন খারাপ হয়ে গেল৷ ঘুম থেকে উঠে মুখে একটু পানি দিয়ে চলে এসেছে৷ নিশ্চয়ই পাগলের মতো দেখাচ্ছে ওকে। ব্যাগে একটা ছোট আয়না আছে৷ সেটা বের করে নিজস্ব প্রতিবিম্ব দেখে চমকে উঠল।
আহারে! কেমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে মুখটা। একটুও সাজসজ্জা নেই৷ ও কি এখন একটু সেজে নিবে?

ব্যাকসীটে একাই বসেছে সে। সাজলেও কেউ খেয়াল করবে না। ভাবনা মাত্র জানালার গা ঘেঁষে সামনের দিকে ঝুঁকে বসল।

বড় মা চোখ বন্ধ করে সীটে হেলান দিয়েছেন। সায়রা মায়ের বুকে ঘুমাচ্ছে। সানান ভাই মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভ করছে। এই সুযোগে সাঁঝ সাজতে বসল।

চলবে..
#অক্ষরময়ী

#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব ২২

জরুরি কাজের কথা বলে বাড়ি ফিরে বিছানায় উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে সানান ভাই৷ বড় মা জানতেন এমন কিছুই হবে৷ ছেলের নিকট দিনের বেলা ঘুমানো সবচেয়ে জরুরি কাজ৷ তিনি নিজেও খানিকটা ক্লান্ত ছিলেন। হাতের কাজ গুছিয়ে বেডরুমে চলে গেলেন৷
সায়রার রুমে বিশ্রাম নিচ্ছে সাঁঝ৷

কথা ছিল, কিছু সময় সানান ভাইদের বাড়িতে থাকবে সে। কিন্তু মেয়েকে রেখে মন টিকল না সাঁঝের মায়ের৷ বৌভাত শেষ হতেই সন্ধ্যা নাগাদ ফিরে এলেন তিনি৷

সানান ভাই ঘুম থেকে উঠল রাত আটটায়৷ ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসে দেখল ড্রয়িংরুমে দুধের গ্লাস নিয়ে বসে আছে সায়রা৷ পাশে বসে বড় বাবা তাকে বুঝাচ্ছে, দুধ খাওয়া কতটা জরুরি৷ সায়রা মনোযোগ দিয়ে শুনছে কিন্তু গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে না৷

সানান ভাই গিয়ে সায়রার অপরপাশে বসে বলল,

– দুধ খেতে ইচ্ছে করছে না?

সায়রা দুপাশে মাথা দুলালো।

– বেশ৷ খেতে ইচ্ছে করলে খাবে না৷ বেসিনে গিয়ে ঢেলে দেও৷

সায়রা তৎক্ষনাৎ সোফা থেকে নেমে বেসিনের দিকে চলে গেল। ওর জন্য রাখা টুলের উপর দাঁড়িয়ে পুরোটা ঢেলে দিয়ে খুশি মনে আবার এসে বসল বাবা ও দাদাভাইয়ের মাঝখানে৷
ছেলের এমন অনাচারে বিরক্ত হলেন বড় বাবা৷ চোখ রাঙিয়ে তাকালেন কিন্তু সানান ভাই নিজের জগতে ব্যস্ত৷ আশেপাশে তাকানোর সময় নাই৷

বড় মা এক কাপ এনে৷ টেবিলে রাখলেন। বড় বাবা সেটা নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়েছে মাত্র, সানান ভাই হাওয়ার গতিতে ছোঁ মেরে কাপটি দখল করে নিল৷ বড় বাবা অবাক, বিস্মিত। স্ত্রীর নিকট অভিযোগ করার আগেই সানান ভাই চায়ের কাপে আয়েশ করে চুমুক বসিয়ে বলল,

– চমৎকার চা বানিয়েছ আম্মা। এই চায়ের জন্য তোমাকে পুরষ্কৃত করা উচিত৷ বলো তুমি কি চাও৷ লজ্জা পেয়ো না। বলো, বলো।

বড় বাবা হতবাক হয়ে দেখলেন যুদ্ধে নামার আগেই তিনি হেরে গেছেন। বড় মায়ের মুখে চাপা হাসি। তবুও একটা ধমক দিয়ে বললেন,

– ঢং করবি না আমার সাথে। কাজের কথা বলে সবাইকে ধরে-বেঁধে নিয়ে এলি। এই তোর কাজের নমুনা?

– ঘুম অতীব জরুরি কাজ। ওই বাড়িতে সব কটা দিন না ঘুমিয়ে কেটেছে। ওহ হ্যাঁ, আজকের বিশেষ ঘোষণা শুনে যাও। আর কখনো কেউ আমাকে কোনো প্রকার দাওয়াতে যাওয়ার কথা বলবে না। আমি ভেবে দেখলাম, এসব আচার অনুষ্ঠান আমার পছন্দ হচ্ছে না। আই হেইট ইট৷

বড় মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলেন রান্নাঘরে। আরেককাপ চা এনে দিলেন স্বামীকে।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বড় বাবা নিজের গম্ভীর সত্তাকে আয়ত্বে এনে সামান্য কেশে সবার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করলেন৷

– শুনলাম, ঋষভ হাতে ব্যথা পেয়েছে।

সানান ভাই বুঝলেন, বাবা তার সাথে কিছু জরুরি বিষয়ে আলোচনা করতে চাইছেন৷ উদাস গলায় বলল,

– অলরেডি সবই জেনে বসে আছো৷ নতুন করে প্রশ্ন করার মানে কি?

– প্রয়োজন আছে বলেই করছি৷ এমন একটা দূর্ঘটনা কীভাবে ঘটল?

– ওই যে বললে, দূর্ঘটনা। দূর্ঘটনা এভাবেই ঘটে।

– ঋষভ যখন হাতে ব্যথা পেল, তখন তুমি কোথায় ছিলে?

সানান ভাই অবাক হয়ে তাকাল বড় মায়ের দিকে। সাময়িক হতভম্বতা কাটিয়ে শুধাল,

– তোমার জামাই কি বলতে চাচ্ছে? আমি ঋষভের হাতে দরজা চাপা দিয়েছি?

– আমি কিছু বলতে চাইছি না৷ যা বলার তুমি নিজে বললে।

সানান ভাইয়ের স্মিত হওয়া রাগটা ফিরে আসছে বুঝতে পেরে আলোচনায় হস্তক্ষেপ করলেন বড় মা৷

– সারাক্ষণ আমার ছেলের পেছনে লাগা বন্ধ করো। ঋষভের সাথে সানানের কীসের শত্রুতা যে ওমন করবে?

– কারো সাথে সমস্যা বাঁধাতে সময় লাগে না তোমার গুনধর পুত্রের। আর সে কীভাবে শত্রুতা নিভায় সেটা নিশ্চয়ই তোমাকে বলে দিতে হবে না?

সানান ভাই চায়ের কাপটা ঠাস করে টেবিলের উপর রেখে উঠা দাঁড়াল। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার আগে উঁচু গলায় জানতে চাইল,

– সাঁঝবাতি কই? আছে না চলে গেছে?

– চলে গেছে। ওর মা চলে আসছে সন্ধ্যায়।

*

বাড়ি ফেরার পর থেকে সাঁঝ কামরাবন্দী৷ কোথাও বের হয় না। কারো সাথে কথা বলে না৷ চুপচাপ নিজের রুমে কি যে করে সেই জানে। ওরা ফিরে এসেছে খবর পেয়ে পরেরদিন সন্ধ্যায় তাশফীন এলো সবার সাথে দেখা করতে৷ সাঁঝের খোঁজ করায় স্বর্ণলতা একগাদা নালিশ জানালো মেয়ের নামে৷ সাঁঝ চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে৷ হৈ-হুল্লোড়ে মেতে থাকা ওর স্বভাব। এমন থম মেরে বসে থাকাটা তাশফীনকে বেশ ভাবাল।

সাঁঝের রুমে গিয়ে দেখা গেল সে জানালার ধারে হেলান দিয়ে বসে আছে৷

– কেমন আছিস বেলা?

সাঁঝ একপলক ফিরে চেয়ে আবার তাকাল খোলা আকাশের দিকে৷ মুখ ভার করে জবাব দিল,

– ভালো৷

– শুধু ভালো! অদ্ভুত! তুই কবে থেকে এক শব্দে জবাব দেওয়া শুরু করলি?

সাঁঝ জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল৷ বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসল তাশফীন৷ খেয়াল করল ওকে বসতে দেখে নিজে খানিকটা গুটিয়ে নিয়েছে সাঁঝ৷ মনে মনে বেশ অবাক হলেও সেটা প্রকাশ করল না৷ হাসি মুখে বলল,

– বিয়ে কেমন ইনজয় করলি?

– ভালো না।

– কেনো?

– এমনি৷

– শুনলাম তোর ফুপুর ছেলেটার হাত কেটেছে।

– বেশ হয়েছে৷

তাশফীন থমথমে খেয়ে গেল হঠাৎ৷ সাঁঝ প্রচন্ড নরম মনের মানুষ। কখনো উঁচু গলায় কথা বলে না।কাউকে কটু কথা বলতে পারে না। মন খারাপের ঘটনাগুলো বেশিক্ষণ মনেও রাখে না৷ তার মুখে এমন কথা শুনে বেশ হকচকিয়ে গেল তাশফীন।

– দেখি আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বস৷

সাঁঝ ওভাবে বসে রইল। যেন নিজস্ব জগতে হারিয়ে গেছে৷ তাশফীন একটু জোরে ডাকল।

– বেলা?

চমকে উঠল সাঁঝ৷ ঘাড় ফিরিয়ে মলিন মুখে তাকিয়ে বলল,

– কি?

– এদিকে আয়৷

– নাহ। কি বলবে ওখান থেকে বলো।

– কি হয়েছে তোর?

– কই? কিছু হয়নি৷ কী আবার হবে?

– এমন মনমরা হয়ে বসে আছিস কেন? খালামণি বলল, কারো সাথে কথা বলছিস না৷ ঠিকমতো খাচ্ছিস না৷ ফেসবুকেও দেখলাম কোনো আপডেট নেই৷ কি হয়েছে?

– কিছু না৷ বাইরে যেতে ভালো লাগে না।

– বিয়ে বাড়িতে কিছু হয়েছে?

অনেকটা সময় নিয়ে সাঁঝ দুপাশে মাথা দুলালো।

– কেউ কিছু বলেছে?

আবার মাথা দুলিয়ে না জানালো।

– অবশ্যই কেউ কিছু বলেছে৷ তুই মিথ্যে বলছিস। এজন্য মুখে না বলে ইশারায় জবাব দিলি৷

সাঁঝ মাথা নিচু করে প্রায় বুকের সাথে থুতনি ঠেকিয়ে ফেলল। তাশফীন এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে ওর মাথায় হাত রেখে ডাকল,

– বেলা? একি কাঁদছিস নাকি?

সাঁঝ কাঁদতে কাঁদতে দুপাশে মাথা দুলালো। সে কাঁদছে না৷

– আচ্ছা ঠিক আছে। কিছু বলতে হবে না। কান্না বন্ধ কর৷

সাঁঝ আজকাল নিঃশব্দে কাঁদতে শিখেছে। একটুও শব্দ হয় না৷ শুধু কান্নার গতি বেড়ে গিয়ে হেঁচকি এলে দেহখানা একটু পরপর দুলে উঠে।

তাশফীন বেশ অসহায় বোধ করল। মেয়েটা এমন ভাবে কাঁদছে কেনো? মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

– এবার কান্না না থামালে খালামণিকে ডেকে আনব৷

কান্না থামিয়ে সুস্থির হতে বেশ খানিকটা সময় লাগল সাঁঝের। তাশফীন ধৈর্য্য নিয়ে অপেক্ষা করল। কোনো প্রকার দয়া, করুণা দেখাল না৷ স্বাভাবিকভাবেই বলল,

– ইশ! কেঁদেকেটে শার্ট ভিজিয়ে দিয়েছিস। আমার জায়গায় তোর ওই রাক্ষস কাজিনটা হলে এই শার্ট তোকে দিয়ে ধুইয়ে নিত৷ আমি ভদ্র ছেলে বলে পার পেয়ে গেলি৷

জলসিক্ত চোখ-মুখ নিয়ে হেসে উঠল সাঁঝ।

– এবার বলতো কি হয়েছে?

সাঁঝ উদাস নয়নে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কথা গুছিয়ে নিল। লজ্জায় নিচু হলো দৃষ্টি। বেশ কসরত করে ফ্যাকাশে গলায় বলল,

– ঋষভ ভাইয়া আমার সাথে অসভ্যতামি করেছে৷

বুঝতে বেশ সময় লাগল তাশফীনের৷ অবাক হয়েছে সে। রাগ লাগছে বেশ। তবুও শান্ত গলায় বলল,

– কীভাবে কি হয়েছে পুরোটা বল, বেলা।

– রাতের বেলা ছাদে বারবিকিউ পার্টি হচ্ছিল। আমি সবাইকে শরবত দিচ্ছিলাম। ঋষভ ভাইয়া আমার গায়ে বিশ্রীভাবে টাচ করেছে৷

দু হাতে মুখ ঢেকে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ল সাঁঝ। তাশফীন অবাক হয়ে বলল,

– আর কিছু করেছে?

দুপাশে মাথা দুলালো ও।

– আবার কাঁদতে বসলি কেনো? চুপ কর৷ তুই কিছু বলিস নি ওই বেয়াদবটাকে?

– কি বলব আমি? তখনি ছাদ থেকে চলে এসেছি৷

– তোর উচিত ছিল ঠাটিয়ে একটা চড় মারা।

– সবাই দেখে নিত, না?

– দেখলে দেখত৷ সবাইকে দেখানোই উচিত ছিল৷ ওদের জানানো দরকার ছিল ঋষভ কতোটা নোংরা মানসিকতার।

– কেউ আমার কথা বিশ্বাস করত না। উল্টো সবাই আমাকেই খারাপ মেয়ে ভাবত।

– তোকে কেন খারাপ ভাববে?

– ওখানে এতগুলো মেয়ে থাকতে শুধু আমার সাথেই এমন হলো কেনো? নিশ্চয়ই আমি বাজে কিছু করেছি৷ উনাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছি৷

– কীসব পাগলের মতো কথা বলছিস? আর কারো গায়ে হাত দেয়নি বলে তোর সাথে হওয়া অন্যায় মিথ্যে হয়ে যাবে না৷ ঋষভের মতো ছেলেদের অন্যায় করতে কোনো কারণ লাগে না৷ এসব কথা খালামণিকে জানিয়েছিস?

– নাহ৷ কেউ জানে না৷

– কী আশ্চর্য বেলা! এত বড় একটা ঘটনা তুই খালামণিকে জানাবি না? আমি এক্ষুণি কথা বলছি খালামণির সাথে৷

তাশফীন বিছানা ছেড়ে উঠতে গেলে সাঁঝ দ্রুত এসে হাত ধরে ফেলল। অনুরোধ করে বলল,

– তুমি প্লিজ মাকে কিছু বলো না৷ মা আমাকে খুব বকবে৷

ও আবার কাঁদতে শুরু করেছে দেখে তাশফীন ওর পাশে বসে নরম গলায় বলল,

– ঠিক আছে, ডাকছি না খালামণিকে। তুই শান্ত হ৷ আমি কিছু কথা বলব তোকে৷ মনোযোগ দিয়ে শুনবি।
এই জগতে মেয়েরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয় কার দ্বারা জানিস? আপনজনের দ্বারা। আত্মীয় রূপী কিছু অমানুষ ভদ্রতার মুখোশ পড়ে বাড়ির মেয়েদের জীবনটা নরক বানিয়ে দেয়। এই সিচুয়েশনে মেয়েরা কি ভুল করে জানিস? সবটা লুকিয়ে যায়৷ বদনামের ভয়ে, লোকে কি বলবে ভেবে মুখ বন্ধ করে রাখে। দিনের পর দিন নীরবে অত্যাচার সহ্য করে। এই সুযোগটাই কাজে লাগায় অমানুষগুলো।
একই ভুল তুই নিজেও করছিস, বেলা। তোর সাথে যা হয়েছে সেটা যদি তোর মাকে না জানাস তবে সে সচেতন হবে কি করে?

– মা রাগ করবে। আমাকে ছাদে যেতে বারণ করেছিল, তবুও আমি গেছি৷ এই নিয়ে কথা শোনাবে৷

– মায়ের আদেশ অমান্য করে ছাদে যাওয়ার থেকে বেশি অন্যায় কাজ কাউকে হেনস্তা করা। তুই ভাবছিস, ছাদে গিয়েছিস বলে তোর সাথে এমনটা হয়েছে৷ ঋষভ চাইলে কি অন্য কোথাও তোর সাথে অসভ্যতা করতে পারত না? অবশ্যই পারত। যে অন্যায় করতে চায়, সে যে কোনো পথ ঠিকই খুঁজে নেয়৷
আমার কথা শোন, বেলা। তুই এখনি পুরো ঘটনাটা খালামণিকে জানাবি৷

– বাদ দেও না। যা হবার তা হয়ে গেছে। এখন থেকে আমি সচেতন থাকব। আর যাব ওর সামনে।

– বোকা মেয়ে। ঋষভ তোদের আত্মীয়। তুই চাইলেও ওকে এড়িয়ে চলতি পারবি না। ও তোদের বাড়ি আসবে, তোকে ওদের বাড়ি যেতে হবে। ফ্যামিলি ফাংশনে তোদের হরহামেশাই দেখা হবে৷ কি করে ইগনোর করবি? আত্মীয়ের সাথে বাজে আচরণ করলে, অকারণ এড়িয়ে চললে তোর মা রাগ করবে না? রাগ করলে খালামণিকে তুই দোষ দিতে পারবি না৷ কারণ উনি তো জানেনই না উনার মেয়ে কেন এমন আচরণ করছে। এর থেকে ভালো হয়, তুই খালামণিকে পুরো ঘটনা জানা। অভিভাবক সচেতন থাকলে ঋষভ আত্মীয়তার সুযোগ নিতে পারবে না।

– আমি কিছু বলতে পারব না। আমার ভয় করছে।

– আচ্ছা বেশ। তুই বস। আমি গিয়ে খালামণির সাথে কথা বলছি।

তাশফীনের মুখে সব শুনে স্বর্ণলতা সাঁঝের মা হয়ে রইলেন৷ রাগে নাকি অসহায়ত্বে জানা নেই, তবে তিনি নিজেও সামান্য কাঁপছিলেন। তাশফীন বলল,

– খালামণি, তুমি একটু এই চেয়ারটায় বসো৷

তিনি বসলেন না। কম্পিত পায়ে মেয়ের রুমে গেলেন। বিছানার মাঝখানে বসে সাঁঝ কাঁদছিল। তিনি আলতো হাতে মেয়েকে জড়িয়ে বুকে টেনে নিলেন। মায়ের সান্নিধ্যে সাঁঝের কান্নার গতি বেড়ে গেল। স্বর্ণলতা কিছু বললেন না। শুধু মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন।

এরপর আর কখনো মেয়েকে আত্মীয়দের মাঝে একা ছাড়েননি তিনি৷ বাড়িতে কেউ বেড়াতে এলেও মেয়েকে প্রায় আঁচলে বেঁধে ঘুরেছেন। একটা ঘটনার রেশ ধরে একজন মায়ের গোটা পুরুষ সমাজ থেকে বিশ্বাসটাই উঠে গেল।

চলবে..
#অক্ষরময়ী