#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব ২৭
নদীর একূল ভাঙে ওকূল গড়ে, এই তো প্রকৃতির নিয়ম। কলঙ্কের কালি লেগেছে সাঁঝের গায়ে, অন্যদিকে কাঁচা হলুদের প্রলেপ পড়ছে ঝিলিকের ত্বকে।
আজকাল ঘরবন্দী জীবন কাটছে সাঁঝের। আকস্মিক সমালোচনার প্রকোপে এ বাড়ির সবাই হতভম্ব। প্রতিটি সদস্য নির্বাক দিনযাপন করছে। কে কাকে দোষী সাব্যস্ত করবে তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না। সবাই যেন নিজস্ব জগতে বন্দী। শোকাহত পরিস্থিতি কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনের কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না কারো মধ্যে।
বন্ধ জানালার পাশে বসে দিন কাটে সাঁঝের। ছোট ভাই দুজন বাইরে খেলতে যায় না। বাড়ির ছাদে শর্ট পিচে ক্রিকেট খেলে। মায়ের মুখটা সারাক্ষণ ভার। রান্নাবান্না করে, খায়দায়, ঘুমায়। বাবা ব্যস্ত নিজের কাজে। শুধু রাতে বাড়ি ফিরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
মৃতপ্রায় বাড়িতে মাঝেমধ্যে সাওদা বেগমের গলার স্বর শোনা যায়। মেয়েদের কল এলে মোবাইলে চিৎকার করে তিনি শাপশাপান্ত করেন।
– আমাগো মাইয়ার নামে যেই বেডি এমন গুজব ছড়াইছে না, তার উপর আল্লার গজব পড়বো। ফুইলের মতন পবিত্র মাইয়ার গায়ে কলঙ্ক দিছে। দেহবি আল্লার বিচার, ধংস হইবো সবডাই।
সাঁঝের মা সব শোনেন, বিরক্ত হন মনে মনে। মুখে কিছু বলেন না। তাশফীন আসে মাঝেমধ্যে। সাঁঝের সাথে গল্প করে, হাসানোর চেষ্টা করে, ক্লান্ত হয়ে ফিরে যায়। সাঁঝ হাসে না। অনুভূতিরা কাজ করে না। মস্তিষ্ক থমকে গেছে।
সাভিন-সাবিল স্কুল থেকে ফিরছিল। রিক্সা থেকে নামতেই সানান ভাইয়ের সাথে দেখা। অফিসের দিকে যাচ্ছিল বোধহয়। ওদের দেখে বাইক থামিয়ে বলল,
– কি অবস্থা তোদের?
সাভিন বলল,
– ভালো আছি ভাইয়া।
– বাড়ির কি অবস্থা?
– আগের মতোই।
– গাধাটা কান্নাকাটি করে এখনো?
– নাহ। ঠিক আছে।
সাবিল বিরোধিতা করে বলল,
– কাঁদে। এখনো কাঁদে। আমি কয়েকবার দেখেছি।
– চুপ কর। তুই বেশি জানিস।
– লুকিয়ে কাঁদে তাই তুই জানিস না।
দুই ভাইয়ের তর্কাতর্কির মাঝে সানান ভাই বলল,
– সাবিল বাইকে উঠ।
– কোথায় যাব?
– মোড়ের দোকানে। সায়রা আইসক্রিম খেতে চেয়েছে। কিনে দিচ্ছি, তুই ওকে দিয়ে আসিস। আমার অফিস যেতে হবে।
সাভিন মানা করতে চাইল। ওরা মাত্রই স্কুল থেকে ফিরেছে। রোদে, গরমে ভীষণ ক্লান্ত। কিন্তু তার আগেই সাবিল বাইকে উঠে বসল। সানান ভাইয়ের বাইকটা চলে যেতেই ক্লান্ত সাভিন পা বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল।
– আপনার বাইকটা দাম কত, সানান ভাই?
– দেড় লাখের মতো। কেন?
– আমি যখন বড় হবো তখন আপনার বাইকের মতো একটা বাইক কিনব।
– আমার বাইক তোর পছন্দ?
– হ্যাঁ অনেক। আপনার সবকিছু আমার পছন্দ। বড় হয়ে আমি আপনার মতো হবো।
– স্কুলে যাওয়া আসার সময় যখন বাইকে উঠতে বলি তখন উঠিস না কেন?
– মা না করছে।
– কেন?
– আমাদের বাইক নাই। আপনার বাইকে উঠলে লোকে নানান কথা বলবে।
– এত কঠিন কথা মাথা ঢুকায় কে? ছোট আছিস, ছোটদের মতো চলবি।
দরজায় ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। সাঁঝ নিজের জায়গা থেকে নড়ল না। দরজা লক করা নাই। যার দরকার সে নিজেই দরজা খুলে ভেতরে আসবে। খুব প্রয়োজন না হলে একসময় বিরক্ত হয়ে চলে যাবে।
ব্যক্তিটি গেল না।বরং চাপিয়ে রাখা দরজা খুলে উঁকি দিয়ে বলল,
– আপু আসব?
– আয়।
– মা ডাকছে
– কেন?
– আইসক্রিম খেতে।
– আইসক্রিম কে আনছে?
– সানান ভাই।
– উনার থেকে আইসক্রিম নিতে গেছিস কেন, ছোটলোক?
– উনি নিজেই দিল। সায়রার জন্য কিনেছে। আমাদের জন্যেও একটা বাটি কিনে দিল।
– দিল আর তুই নিয়ে আসলি?
– না করলে রাগ করত না?
– সব রাগ উনার। বাকি মানুষের রাগ, অভিমান থাকতে নাই। স্বার্থপর লোক একটা। খাবো না আইসক্রিম। যা এখান থেকে।
সাবিল মুখ ফুলিয়ে চলে গেল৷ বাড়ির সবারই মেজাজ বিগড়ে আছে৷ যার কাছেই যাও সেই ধমক দিচ্ছে।
*
বুলুর মা আজকে নতুন শাড়ি পরেছে। মেরুন রঙের এই শাড়িটা কিনে দিয়েছে ঝিলিকের মা। উনার মেয়ের বিয়েতে বুলুর মা পুরাতন শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াবে, ব্যাপারটা কেমন দেখায় না?
শাড়ি পেয়ে বুলুর মা ভীষণ খুশি। বিয়ে বাড়িতে তিনি লাফিয়ে লাফিয়ে কাজ করছেন৷ কাউকে কাজ দেখিয়ে দিতে হচ্ছে না। দুপুরবেলা এলাকার মানুষজন এবং নিকট আত্মীয়দের দাওয়াত খাওয়ানো হয়েছে৷ আপাতত থালাবাসন পরিষ্কারের কাজ চলছে। তদারকি করছেন বুলুর মা। ওদিকে আঙিনা ঝাড় দেওয়া হলো কিনা কে জানে! কাজের মহিলাদের ঠিকঠাক কাজ করতে বলে বুলুর মা ছুটলেন বাইরে৷ কাজের লোকেরা যা ফাঁকিবাজ!
আঙিনার অবস্থা দেখে তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন,
– ওই যে ওখানে হাড় পড়ে আছে। ওটাকে সরাও৷ চোখ বন্ধ করে কাজ করো নাকি তোমরা!
সদর দরজা হাট করে খোলা। লোকজন আসছে, যাচ্ছে। বুলুর মা খেয়াল করলেন, একটা ছেলে অনেকক্ষণ ধরে দরজার বাইরে থেকে উঁকিঝুকি দিচ্ছে। আত্মীয়দের মধ্যে কেউ হলে সোজা বাড়ির ভেতরে চলে আসত। উঁকিঝুকি দিবে কেন? ইতস্ততবোধ তারাই করে যাদের মনে চোর আছে।
বুলুর মা থপথপ করে পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে ধমক দিয়ে বললেন,
– এই ছেলে? কাকে খুঁজো?
মুহাব হকচকিয়ে গিয়ে এলোমেলো উত্তর দিল।
– নাহ মানে.. কাউকে না।
– বাড়ির সামনে দাঁড়ায় উঁকি মারতেছো। আবার কও কাউকে না। কি দরকার?
– কিছু না।
– অবশ্যই কিছু আছে৷ তোমারে তো এই পাড়ায় আগে দেহি নাই। কই থাইকা আসছ? কার কাছে আসছ?
– আমি এই পাড়ায় থাকি না৷
– সেইটা আগেই বুঝছি৷ এখন তাড়াতাড়ি কও কারে চাও৷ না হলে লোকজন ডাইকা এমন ঢলা দিব না।
– না মানে… এটা ঝিলিকদের বাড়ি না?
– হ্যাঁ। ওর সাথে কি দরকার?
– ঝিলিকের সাথে দেখা করতে চাই৷ একটু ডেকে দেওয়া যাবে?
– আইজ ওর বিয়া৷ তুমি আইছ দেখা করতে। মতলবটা কি?
সন্দেহ গাঢ় হওয়ায় মুহাবের কাছাকাছি এগিয়ে গেলেন বুলুর মা। ফিসফিসিয়ে বললেন,
– তোমার লগে ঝিলিকের সম্পর্ক আছিল নাকি? ধোঁকা দিয়া বিয়া কইরা নিতাছে?
– ছিঃ ছিঃ! কি বলেন! প্রেম ছিল ইপ্তির সাথে৷ ওর সাথেই এখন ঝিলিকের বিয়ে হচ্ছে৷
বুলুর মা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে গেল। এক হাতে মুখ ঢেকে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে মুহাবের হাত ধরে একটু আড়ালে টেনে নিয়ে গেলেন।
– এই পোলা, মিছা কথা কইতাছ না তো?
– মিথ্যা কথা বলব কেন?
– কত বড় মিছা কথাটা কইল বেডি! তার মাইয়ার প্রস্তাবের বিয়া হইতাছে। গর্বের শেষ নাই। মিথ্যুক একটা। আমি জানতাম, কোনো একটা ঝামেলা নিশ্চয়ই আছে। না হলে এমন তাড়াহুড়ো কইরা মাইয়ার বিয়ে দিব কেন। এই, ঝিলিকের সাথে তোমার কিসের কথা?
– আপনাকে বলা যাবে না। আপনি ঝিলিককে ডেকে দিন।
– বিয়ার দিন বউ বাইরে আসব, তোমার কি মাথা খারাপ?
– তাহলে ওর বান্ধবীটাকে ডেকে দিন। কি যেন নাম মেয়েটার!
– কোন মাইয়ার কথা কও?
– আরে সেদিন রমণা পার্কে ঝিলিকের সাথে ছিল যে মেয়েটা। ওকে সাথে নিয়েই তো ইপ্তির সাথে দেখা করতে এসেছিল ঝিলিক। আমিও ছিলাম ইপ্তির সাথে। ওদের দুজনকে কথা বলতে দিয়ে আমি আর মেয়েটা অনেকক্ষণ পার্কের বেঞ্চে বসে গল্পও করলাম।
– সাঁঝের কথা কও?
– হ্যাঁ, হ্যাঁ। সাঁঝকে একটু ডেকে দিন। ও জানে ইপ্তির কথা৷
– বেঞ্চে বসে তোমরা দুজন ওদের পাহারা দিছিলা? সাঁঝরে তুমি আগে থাইকা চিনতা না? তোমাদের মধ্যে প্রেম নাই?
– প্রেম! কী যে বলেন আন্টি! সেদিন ঝিলিকের সাথে গেল বলেই না একটু কথা হলো। হাই, হ্যালো টাইপের কথা৷ একবারই দেখা হয়েছে আমাদের৷
– ওহ। এইবার বুঝছি আসল কাহিনি। শোনো, সাঁঝ এই বাড়িতে নাই। কি কইতে চাও, আমারে কও।
– আপনি অন্য কাউকে বলবেন না তো?
– কমু না।
– ঝিলিক আসলে ইপ্তিকে ব্লক করে রেখেছে। ওদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে সামান্য। ঝিলিককে গিয়ে বলুন, ইপ্তি বলেছে ব্লকটা খুলে দিতে৷
– আচ্ছা কমু নে। তুমি এখন যাও এইখান থাইকা।
মুহাব হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। প্রায় দৌড়ে পালাল সেখান থেকে৷ মোড়ের চায়ের দোকানে ছুটে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
– আপনার কথা মতো কাজ করেছি। এখন আমাকে যেতে দিন।
সানান ভাই তখনো মাথা নিচু করে মোবাইল স্ক্রল করছে। কয়েক সেকেন্ড বাদে মাথা তুলে মুহাবের দিকে গভীর চোখে তাকাল। চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে ডাকল,
– এদিকে আয়।
মুহাব শুকনো ঢোক গিলে আশেপাশে তাকাল। সানান ভাইয়ের বন্ধুরা বাজ পাখির মতো তাকিয়ে আছে তারই দিকে। মুহাব ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে সানান ভাইয়ের সামনে দাঁড়াল। শক্তপোক্ত হাতের একটা চ/ড় এসে পড়ল গালে। একপাশে হেলে পড়তে গিয়ে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল। সানান ভাই চায়ের কাপটা ধীরেসুস্থে বেঞ্চের উপর রেখে আরেকটা চ/ড় দিল। তার শীতল কণ্ঠে টেনে টেনে বলল,
– যা এখন ডাক তোর বাপগুলারে৷ দেখি কে এসে বাঁচায় তোকে শু*য়োরের বাচ্চা।
মুহাব মাথা নিচু করে ভেজা গলায় বলল,
– বললাম তো ভুল হয়ে গেছে৷ আর হবে না।
আজম বেঞ্চ থেকে উঠে এসে ওর চুলগুলো মুঠো ভরে ধরে মাথায় কয়েকটা চা/পড় মারল। সেই সাথে গালিগালাজ তো চলছেই।
– আবার মুখে মুখে কথা কস খা*কীর পোলা। এইখানে পুতে ফেলব বা*ঞ্চোত। খুব গরম না তোর? বহুত চর্বি হইছে। সব ঠান্ডা করে দিব মা**চো*..
আজমের মুখের ভাষা জঘন্য থেকে জঘন্যতম পর্যায়ে চলে যেতে থাকল। দোলন আর গুঞ্জন মিলে ঝাপটে ধরে থামাল ওকে। সানান ভাই শান্ত চোখে তাকিয়ে দেখল সবটা। মুহাব ততক্ষণে কাঁদতে কাঁদতে সানান ভাইয়ের পায়ে লুটিয়ে পড়েছে।
সানান ভাই তার জলদগম্ভীর স্বরে বলল,
– তোকে যদি আর কখনো আমার আশেপাশে দেখি, সেদিনই তো শেষ দিন হবে৷ যা ভাগ এখান থেকে।
মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে ছিল মুহাব। কোনোরকমে উঠে দাঁড়িয়ে বাকিদের দিকে ক্ষমা স্বরূপ দৃষ্টিতে তাকাল। আজম বলল,
– ভালো চাইলে, আমাগো নেটওয়ার্কের কারো সামনে কখনো পড়বি না৷ যেখানেই তোরে দেখমু ওইখানে ঠাইসা ধরমু। দোলন, মালডারে যেইখান থাইকা তুলছোস ওইখানে ফালায় দিয়া আয়।
ওরা চলে যেতেই আজম হাত রাখল বন্ধুর কাঁধে৷ আশ্বাস দিয়ে বলল,
– চিন্তা করিস না মামা। দাবার গুটি ঘুইরা গেছে৷ বাকি কাজ বুলুর মা কইরা দিব। এই মহিলা সকালের পত্রিকার থেকেও বেশি কার্যকরী।
পাবন পুত্র হনুমানের লেজে যখন আগুন লেগেছিল তখন সে অস্থির হয়ে এদিক ওদিক ছুটে পুরো লঙ্কা রাজ্য পুড়িয়ে দিয়েছিল৷ বুলুর মায়ের অবস্থা এখন অনেকটা সেরকমই। পাছার আগুনের তাপে তিনি দুদণ্ড দাঁড়াতে পারছেন না৷ এমন একটা চাঞ্চল্যকর তথ্য কাকে বলবেন, আর কাকে না বলবেন! তিনি শুধু ছুটছেন। যাকেই পাচ্ছেন তাকেই চেপে ধরে বলছেন,
– শুনলে বিশ্বাস করবা না। ঝিলিকের মা মহিলাটা আস্ত একটা শিয়াল। যেমন তেমন শিয়াল না। খেঁকশিয়াল। এমন চালাক মাইয়া মানুষ আর একটাও দেহি নাই আমার জীবনে৷ নিজের মাইয়ার পাপ ঢাকতে সাঁঝরে ফাসায় দিল কেমনে, দেখছ? নিজের মাইয়া মা*গিরী কইরা বেড়ায়। সেই বদনাম ঢাকতে দোষ দিল আরেকজনের মাইয়ার উপর৷ আর কি কি যে করছে আল্লাহ মাবুদ জানে। আমি তোমারে কইতাছি, মিলায় নিও। নিশ্চয়ই ওই পোলার লগে মুখ কালা করছে। পেট বাঁধাইছে মনে হয়৷ এইজন্য এমন তাড়াহুড়ো কইরা বিয়া দিতাছে৷ ভাবছে কেউ কিছু বুঝতে পারবে না। কিন্তু আমি বুলুর মা, আমার চোখ ফাঁকি দেওয়া সহজ কথা না৷
নতুন তথ্যে পাড়া জুড়ে হৈচৈ পড়ে গেল৷ কানাঘুষোর খবর ঝিলিকের মায়ের কাছেও আসতে শুরু করেছে। তিনি বারবার আল্লাহকে স্মরণ করছেন। ওদিকে ঝিলিক বসে আছে বউ বেশে৷ এমন মুহূর্তে চাইলেও মেয়েকে কিছু বলতে পারছেন না তিনি৷ শুধু দোয়া করছেন, ভালোই ভালোই বিয়েটা মিটে যাক।
রাত আটটায় ইপ্তিরা এলো ঝিলিকদের বাড়িতে। আঙিনা জুড়ে মহিলাদের ভীড়। এতো লোকজন বর দেখতে এসেছে! অথচ ভীড় এড়াতে দুপুরবেলাতেই দাওয়াতের পর্ব শেষ করতে বলেছিলেন ইপ্তির বাবা৷ অত্যাধিক লোকজন দেখে তিনি মনে মনে খানিক বিরক্ত হলেন।
দেখা গেল, পাড়ার মহিলাদের মনোযোগ বরের থেকে বউয়ের দিকে বেশি। ঝিলিক ঠিকঠাক খাচ্ছে কিনা, বমি করছে কি, গা গুলাচ্ছে অথবা পেট উঁচু হয়েছে কিনা সেসব দেখছে সূক্ষ্ম চোখে৷
জাহানারাও বুদ্ধিমান মহিলা। মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকজনের ধারের কাছে কাউকে ঘেঁষতে দিলেন না৷ বিশেষ করে বুলুর মায়ের দিকে তিনি বিশেষ নজর রাখলেন৷ নিজের বোনকে রাখলেন বুলুর মায়ের সাথে। যাতে বরপক্ষের সাথে আলাদা করে কথা বলার কোনো সুযোগ সে না পায়৷
অবশেষে রাত দশটায় কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই বিবাহ সম্পন্ন হলো ঝিলিক ও ইপ্তির৷ জাহানারা আর দেরী করলেন না। একপ্রকার জোরজবরদস্তি করে সময়ের আগেই মেয়ের বিদায় পর্ব সম্পন্ন করলেন।
*
অবেলায় ঘুমিয়ে আছে সাঁঝ৷ গায়ের উপর কারো হাত পড়তেই চমকে চোখ মেলে তাকাল। অবাক হয়ে উঠে বসে বলল,
– এসব কি করছ?
সাঁঝের মা কিছু বললেন না৷ পাঁচশ টাকার নোটটি দিয়ে সাঁঝের মাথা থেকে পায়ের দিকে গা মুছে যাচ্ছেন৷ মুখে বিড়বিড় করে দোয়া পড়ছেন। সাঁঝ বাকহারা পুতুলের মতোন বসে দেখল মায়ের কার্যকলাপ।
কাজ শেষে সাভিনকে ডেকে সাঁঝের মা বললেন,
– এই টাকাটা মসজিদের দানবাক্সে দিয়ে যায়৷
– একটু পরে যাই। পড়তে বসছি।
– এখনি যা৷
সাভিন বিরস মুখে রুম থেকে বিদায় নিতেই সাঁঝ বলল,
– এসব কি মা?
– মানত করছিলাম। আল্লাহ সহায় ছিলেন বলেই এত বড় বিপদ ঘাড় থেকে নেমে গেল। জীবনটা জাহান্নাম বানায় দিছিল এরা৷ এখন বুঝছিস, আমি কেন মানুষকে এত ভয় পাই? এরা দাবানলের থেকেও দ্রুত গুজব ছড়ায়৷ তোর জীবনটা পু*ড়িয়ে ছাই করে দিত৷ ভাগ্যিস ঝিলিকের কথাটা বুলুর মায়ের কানে গেছে।
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে সাঁঝ বিছানা থেকে নামল। ঝিলিক ওর বান্ধবী। প্রাইমারি থেকে হাইস্কুল লেভেল পর্যন্ত একসাথে পড়াশোনা করেছে। বন্ধুর প্রতি এখনো ভালোবাসা রয়ে গেছে মনের গহীনে। পাড়া জুড়ে ঝিলিকের নামে ছি ছি রব সাঁঝকে বড় কষ্ট দিচ্ছে৷ কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারছে না।
আয়না থেকে কালো টিপ তুলে কপালের মাঝখানে দিয়ে বলল,
– চা খাবে, মা?
– বানা। চিনি কম করে দিস৷
আজকাল তাড়াতাড়ি লাইব্রেরি বন্ধ করে বাড়ি ফিরছেন সাদিক। কাজে মন বসছে না৷ মনটা বড্ড উদাস। দরজার পাশে জুতো রেখে ভেতরে প্রবেশ করে বললেন,
– সাঁঝের বান্ধবীটার কি হয়েছে? আসার সময় আকবর ভাই কী সব বলছিলেন।
– কি বলেছে?
– প্রেম করে নাকি বিয়ে করছে৷ আমাদের সাঁঝও নাকি জানত ওসব৷ একসাথে রমণায় যেত ছেলের সাথে দেখা করতে।
বাবা-মায়ের কথার মাঝে বাগড়া দিল সাঁঝ। মুখ ভার করে বলল,
– একবারই গিয়েছি শুধু৷ এরা এমনভাবে বলছে যেন রোজ রোজ আমি ওদের পাহারা দিতাম।
ফোড়ন কাটতে ভুলল না সাঁঝের মা। চোখ রাঙিয়ে বললেন,
– মায়ের সাথে মিথ্যাচার করলে এভাবেই ধরা খেতে হয়৷
_ আমি কি জানতাম, নিউমার্কেটের নাম করে পার্কে নিয়ে যাবে আমাকে?
– তুই একটা বলদ৷ তোর মতো হাদারামকে হাটে নিয়ে বিক্রি করে দিলেও তুই টের পাবি না৷
সাঁঝের বেশ অভিমান হলো৷ মুখ ফুলিয়ে গেল সাওদা বেগমের ঘরে৷ পানির ডালা নিয়ে বসেছিলেন তিনি৷ সাঁঝকে দেখে বললেন,
– ঘরের কোণায় কোণায় উঁকি মাইরা কি খুঁজোস?
– তোমার শাড়িগুলা কই রাখছ?
– কেন? কি করবি?
– পরব।
– বুড়ি মানুষের শাড়ি পরবি তুই?
– হ্যাঁ পরব৷
– কেন? মনের রঙ উইড়া গেছে? জোয়ান বেডি লাল, হলুদ শাড়ি পরবে তা না আসছে বুড়ি মাইনষের শাড়ি পরতে৷
– তুমি বড্ড বেশি কথা বলো। কই রাখছো সেটা বলো৷ তোমার নাতনি সুন্দর আছে, বুঝলা? যা পরবে তাই মানাবে।
– খাটের নিচে ট্রাংকে আছে৷ নিয়া যা।
অফ হোয়াইট কালারের একটা তাঁতের শাড়ি নিল সাঁঝ। ঝটপট শাড়ি পরে হাতে-পায়ে আলতা দিল। লাল কাঁচের চুড়ি পরল দু হাত ভরে৷ মেঝেতে বসে কোলের উপর এক হাত রেখে হাতের ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করল।
ক্যাপশন দিল, “হাদারামের আজ অভিমান হয়েছে।”
পোস্ট দেখে ফিক করে হেসে উঠল সানান ভাই৷ বন্ধুরা সবাই অবাক হয়ে তাকাল। কয়েকদিন ধরে আষাঢ় মাসের অন্ধকার আকাশের মতো থমথমে মুখ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সানান ভাই৷ এখন হঠাৎ হাসছে কেনো?
আজম উঁকি দিয়ে ছবিটা দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,
– সাদা শাড়ি পরছে কেন? বিয়ের আগেই বিধবা হইতে চাইতাছে নাকি?
সানান ভাই এমন চোখ রাঙানি দিল যে এ যাত্রায় আজম নিজের মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইল।
চলবে..
#অক্ষরময়ী
#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব ২৮
এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। এ প্লাস মিস হয়ে গিয়েছে সাঁঝের। তাই নিয়ে আজ সারাদিন বকাঝকা চলছে। অন্য বাচ্চারা কত ভালো রেজাল্ট করেছে অথচ সাঁঝকে পড়াশোনার এত সুযোগ সুবিধা দেওয়ার পরেও রেজাল্টের এত বাজে অবস্থা। স্বর্ণলতার মন মেজাজ দুটোই বিক্ষিপ্ত। অনবরত বকাঝকা চলছে।
– অন্যদের কথা না হয় বাদ দিলাম। একই বংশের ছেলে সানান। ওর রেজাল্ট দেখ আর তোর রেজাল্ট দেখ। খেলাধুলা করে, ডিজাইন শিখে, বাড়ির কাজে ভাবিকে সাহায্য করে তারপর পড়াশোনা করেছে। তবুও কখনো কোনো পরীক্ষায় প্লাস মিস যায়নি। আর তোকে বসায় খাওয়াই, পারলে মুখে তুলে দেই। সেখানে রেজাল্ট আসে ফোর পয়েন্ট।
দুপুর থেকে এত কথা শুনতে শুনতে সাঁঝ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। প্লেটের ভাতগুলো শেষ করে উঠে যেতে যেতে বলল,
– এতোই যদি সানান ভাইকে পছন্দ তাহলে এক কাজ করো। সানান ভাইকে তুমি নিয়ে আসো। আমি বড় মায়ের কাছে চলে যাই।
– ওই বাড়িতে কেউ তোরে নিব না।
সাওদা বেগম তিরস্কার করে বললেন। একের পর এক দূর্ঘটনায় মূমুর্ষ সাঁঝ। জীবন নিয়ে শঙ্কিত। জীবনযাপনে চেপে ধরেছে হতাশা। মুখ ফুলিয়ে দাদীর দিকে তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেল নিজের রুমে।
সপ্তাহ না পেরোতেই চারদিকে ভর্তির হৈচৈ পড়ে গেল। নতুন কলেজে ভর্তি হওয়া নিয়ে জুবিয়া ভীষণ এক্সাইটেড। ক্ষণে ক্ষণে কল দিয়ে বিরক্ত করে যাচ্ছে সাঁঝকে।
– কোন কোন কলেজ চয়েস দিবি কিছু ঠিক করলি?
– ভর্তি করাবে কিনা সেটাই শিওর না। তুই আছিস কোন কোন কলেজ নিয়ে৷
– কেন ভর্তি করাবে না?
– ভুলে গেছিস মা কি বলেছিল? বিয়ের পরে বাকি পড়াশোনা।
– আজব ব্যাপার। কবে বিয়ে দিবে আর কবে ভর্তি হবি! এমনভাবে বলতেছে যেন বিয়ের জন্য ছেলে রেডি করে রাখছে। ভাতের প্লেটে ভাত সাজানো আছে। তোকে হাতে তুলে দিবে আর তুই গপাগপ গিলবি। এ পর্যন্ত কয়টা ছেলে দেখাইছে তোকে?
– একটাও না।
– কবে ছেলে দেখা শুরু করবে আর কবে বিয়ের সানাই বাজবে? ততদিন তুই কি পড়াশোনা বন্ধ করে ঘরে বসে অপেক্ষা করবি? তুই একটা কাজ কর। আন্টিকে গিয়ে বল, তোর ভর্তির এপ্লাই শুরু হয়ে গেছে। এক মাসেরও কম সময় আছে হাতে৷ এরমধ্যে বিয়ে দিতে পারলে বিয়ে দিক। না হলে কলেজে ভর্তি করাক।
– পাগল তুই! বিয়েতে রাজি হয়ে যেতে বলতেছিস?
– হ্যাঁ বলতেছি। প্রথমত, তোর মায়ের যা জেদ! তুই উনার কথার বিরুদ্ধে গেলে হিতে বিপরীত হবে। এর থেকে ভালো, রাজি হয়ে যা। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, এই কয়েকদিনের মধ্যে ভালো ছেলে খুঁজে মেয়ের বিয়ে দেওয়া অসম্ভব ব্যাপার। ভর্তির ডেট শেষের দিকে আসলে রিকুয়েষ্ট করে বলবি, তোমরা ছেলে দেখতে থাকো। এদিকে আমি কলেজে পড়তে থাকি। তখন আন্টির হাতে কোনো অপশন থাকবে না কলেজে ভর্তি করানো ছাড়া৷ এক ঢিলে দুই পাখি মারা হয়ে যাবে। আন্টি তোর উপর রেগেও গেল না। কলেজেও ভর্তি হতে পারলি৷
– আর যদি ছেলে খুঁজে পায়?
– বিয়ে করে নিবি।
– কিহ!
– দেখ, আজ নয় তো কাল বিয়ে করতেই হবে৷ বিয়ে ব্যাপারটা এতোটাও ভয়ংকর কিছু না। সবাইকে বিয়ে করতে হয়৷ আমাদের ক্লাসের অর্ধেকের বেশি মেয়ের অলরেডি বিয়ে হয়ে গেছে৷ আমাকে বিয়ে দিলে আমি ভাই নাচতে নাচতে বিয়ে করে নিতাম। কিন্তু বিয়ের খরচের ভয়ে আমার ভাই-ভাবি বিয়ের কথা মুখে আনে না৷ তাছাড়া আমি চলে গেলে বাড়ির কাজকর্ম কে করে দিবে? বিনা পয়সায় কাজের লোক পেয়েছে৷ হাত ছাড়া করতে চাচ্ছে না।
– সত্যি, রাজি হয়ে যাব? ভেবে বলছিস?
– হ্যাঁ। সব দিক বিবেচনা করে বলছি। তোর জন্য বেটার অপশন হচ্ছে, বিয়েতে রাজি হয়ে যাওয়া। তবে শর্ত থাকবে, বিয়ের পর পড়াশোনা করাতে হবে৷
জুবিয়া বুদ্ধিমতী মেয়ে। সবসময় সমস্যার সম্মুখীন হওয়া মাত্র সাঁঝ যাদের কাছে ছুটে যায় তাদের মধ্যে সবার প্রথমে নাম আসে জুবিয়ার৷ তারপর আসে তাশফীনের নাম। তবে বিয়ে বিষয়ক আলোচনা তার সাথে করা যায় না। এসব মেয়েলি ব্যাপার নিয়ে তাশফীন ভাইয়ার সাথে কথা বলতে বড্ড লজ্জা করে সাঁঝের৷
শুকনো কাপড়গুলো গুছিয়ে আলমারিতে তুলে রাখছেন স্বর্ণলতা। সাঁঝ এলো গুটিগুটি পায়ে। ভয়ার্ত চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বিছানায় গিয়ে বাবার পাশে বসল। আধশোয়া হয়ে একটা বই পড়ছিলেন সাঁঝের বাবা৷ মেয়েকে দেখে বই রেখে সোজা হয়ে বসলেন।
– কিছু বলবি?
– আমাদের ভর্তি শুরু হয়েছে৷ অনলাইনে এপ্লাই করতে হবে। কোন কোন কলেজ চুজ করব সেসব নিয়ে কথা বলা দরকার৷
সাঁঝের কথা শুনে স্বর্ণলতা ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন৷ রুক্ষ, শুষ্ক কণ্ঠে কিছু বলে উঠার আগে চোখের ইশারায় তাঁকে থামিয়ে দিলেন সাঁঝের বাবা। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নরম গলায় বললেন,
– কিছুদিন আগে তোকে নিয়ে যা কিছু ঘটে গেল, সেসব দেখে আমি বেশ ঘাবড়ে গিয়েছি। আগে তোর মা নানান কথা বলত, পাড়াপড়শিদের নিয়ে ভয় পেত। আমি ততোটা গুরুত্ব দেইনি। তুই নিজেও মায়ের কথায় বিরক্ত হতি, তাই না? ভাবতি মা সবসময় বেশি বেশি ভাবে। অযথা ভয় পায়।
সাঁঝ উত্তর দিল না। বাবার কথা সত্যি৷ মায়ের অহেতুক ভয় পাওয়া, সারাক্ষণ সতর্কতার সাথে চলাফেরা করা সাঁঝের বিরক্ত লাগত বটে। কিন্তু এই মুহূর্তে তা মুখে স্বীকার করা যাচ্ছে না৷
– তোর মা চাইত, কোনো ঝামেলা বধার আগেই ভালো একটা পরিবার দেখে তোর বিয়ে দিতে৷ আগে আমার মত না থাকলেও, বর্তমানে আমিও চাইছি তোর বিয়েটা হয়ে যাক৷
সাঁঝ অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকাল। মায়ের অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করার বাতিক আছে৷ সামান্য ঘটনায় হাইপার হয়ে যায়৷ তাই বলে বাবাও একই কথা বলবে!
– ওভাবে তাকানোর কিছু নেই, সাঁঝ৷ পাড়ার লোকজন কেমন সেটা নিজের চোখে দেখেছিস৷ তিলকে তাল বানিয়ে ছাড়ল। তুই সেদিন ঝিলিকের সাথে রমণাপার্কে গিয়েছিস, সেটা যদি বুলুর মা না রটাতো তাহলে কি হতো ভেবেছিস? এলাকার মানুষ তোকে নিয়ে ছি ছি করত৷ কোনো ভালো ঘরে তোর বিয়ে দিতে পারতাম না। বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা মাত্র পাড়ার লোক এই দূর্ঘটনার কথা তুলে বিয়ে ভেঙে দিত৷ কেউ শুনতো না তোর কথা। গলা ফেটে চিল্লিয়ে মরলেও কেউ তোকে বিশ্বাস করত না। বিনা কারণে সারাজীবন কলঙ্ক বয়ে বেড়াতে হতো তোকে। পুরো পাড়ায় যুবতী মেয়ে বলতে তুই একা রয়ে গেছিস। বাকি সবার বিয়ে হয়ে গেছে। এখন সবার নজর থাকবে তোর উপর। এরা ভবিষ্যতে তোর আরও বড় কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করবে না, তার কি গ্যারান্টি আছে? তুই যথেষ্ট বড় হয়েছিস, মা। বাবার কথাগুলো বুঝার চেষ্টা কর। তারপর বুঝতে পারবি বাবা-মা কেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
– আমি আগের থেকে আরও বেশি সতর্ক হয়ে চলাচল করব। কখনো কোনো ভুল পথে পা বাড়াব না। তাহলে পাড়ার লোকে বদনাম দিবে কি করে? আমি যদি কোনো খারাপ কাজ না করি, তবে ওদের ভয় পেতে হবে কেনো?
স্বামীর উপর সবটা ছেড়ে দিয়ে এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন স্বর্ণলতা। মেয়েকে তর্ক করতে দেখে রগচটা মানুষটি আর চুপ থাকতে পারলেন না। বললেন,
– স্কুল পাশ করা মাত্র ডানা গজাতে শুরু করেছে৷ মুখে মুখে তর্ক করতেছিস। কলেজে গেলে বাবা-মাকে বেঁচে খাবি৷ আমার মুখের উপর মিথ্যা কথা বলে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে গেছে পার্কে। এরপর কলেজের নাম করে কবে, কোনদিকে চলে যাবে সেসব কি আমি খুঁজতে যাব?
– একটা ভুল করে ফেলেছি। আর কতোবার কথা শোনাবে?
– হাজারবার শোনাব। কলেজের নাম করে আজকাল মেয়েরা কোথায় যায়, সেসব কি আমি জানি না? চোখ, কান বন্ধ করে চলি না আমি। সামনের কলেজের মেয়েগুলা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ভিক্টোরিয়া পার্কে গিয়ে বসে থাকে৷ সদরঘাটে গিয়ে সিগারেট টানে। গায়ে কলেজের ইউনিফর্ম, কাঁধে কলেজ ব্যাগ। একটুও ভয়ডর নাই এদের কলিজায়। কার্জনহল, নীলক্ষেত, রমণাপার্ক ওদিকের কথা আর নাই বা বললাম। সেদিন বাজার করে বাড়ি ফিরতেছি, রিক্সায় দুইটা ছেলেমেয়েকে এমন অবস্থায় দেখলাম। আস্তাগফিরুল্লাহ। বর্ণনা করার মতো না। কাজী নজরুলের ইউনিফর্ম পরা ছিল। বয়স কতোই বা হবে। সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে বোধহয়৷ অথচ এদের বাবা-মা জানে আমার ছেলেমেয়ে কলেজে গেছে পড়তে৷ এই তাদের পড়াশোনার নমুনা! দূর থেকে যারা পড়তে আসছে এগুলা তো আরেক কাঠি উপরে৷ বুলুর মা যেই বিল্ডিংয়ে থাকে সেই বিল্ডিংয়ে দুইটা ছেলে-মেয়ে উঠছে। পড়াশোনা করতে ঢাকায় পাঠাইছে বাবা-মা। প্রতি মাসে বাড়ি থেকে টাকা আসতেছে আর ওরা এখনে সংসার করতেছে। বলে তো স্বামী-স্ত্রী। আল্লাহ-ই জানে আদোও বিয়েশাদি কিছু করছে নাকি এমনি থাকতেছে৷ এমন বে..
– আহ লতা! বাদ দেও না। বাচ্চাদের সামনে কি বলতেছ!
– কেন বলব না। ওরা করতে পারে, আমরা বলতে পারব না? তোমার মেয়ে বলদ পাইছে আমারে৷ এতো কিছু দেখার পরেও ওরে আমি বাইরে ছাইড়া দিমু? জীবনেও না। এমন লেখাপড়ার দরকার নাই আমার।
যে শান্ত মস্তিষ্ক নিয়ে আলোচনা করতে এসেছিল তার বিন্দুমাতে অবশিষ্ট নেই সাঁঝের৷ একপাক্ষিক বক্তব্য শোনারও ইচ্ছে নেই। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মায়ের সমান তেজ দেখিয়ে বলল,
– অনেক দিন থেকে শুনতেছি বিয়ে দিবা। এইবার বিয়েটা দিয়েই দেও। এসএসসি শেষ হইছে কম দিন তো হয় নাই। এখনও বিয়ে দিতে পারলা কেন? তেইশ তারিখ এপ্লাইয়ের লাস্ট ডেট। এর আগে বিয়ে দিয়ে উদ্ধার করো আমাকে। আমি কোনোভাবেই এক বছর গ্যাপ দিতে পারব না।
মেয়ের এমন তেজ দেখে বাবা-মা দুজনই স্তব্ধ। এই কি তাদের চেনাজানা শান্ত-শিষ্ট মেয়ে? মোটেও না। সাময়িক হতভম্বতা কাটিয়ে উঠে স্বর্ণলতা বললেন,
– দেখেছো তোমার মেয়ের অবস্থা? এমনি কি বলছি, সময় থাকতে মেয়ের বিয়ে দিতে৷ তেজ দেখেছো ওর? দিন দিন আরও বাড়বে। তখন আর আটকাতে পারবে না। আগেই বলে দিলাম।
সাঁঝের বাবা নিরহ মানুষ। সাংসারিক ঝামেলা থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করেন। স্ত্রীর অতিরিক্ত কথা বলা, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করার স্বভাব সম্পর্কে অবগত থাকায় এতদিন এসব বিষয় তেমন একটা গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি। কিন্তু সাঁঝের ব্যাপারে পাড়ায় যে সমালোচনার ঢেউ উঠল, তা উনার শান্ত মনটাকে অস্থির করে তুলেছে। এদিকে মেয়ের আবদারও অনর্থক নয়৷ ব্যাচের সবাই কলেজে ভর্তি হয়ে যাবে, সে কলেজে ভর্তি না হয়ে বাড়িতে বসে থাকতে পারে না৷ সাঁঝের মায়ের যা মানসিক অবস্থা! মেয়েকে কলেজে পাঠিয়ে এই মহিলার রাতের ঘুম উড়ে যাবে৷
সবদিক বিবেচনা করে গভীর রাত্রে সাদিক শারাফাত নিজ স্ত্রীকে বললেন,
– আমার লাইব্রেরির পাশে যে ভাইয়ের লাইব্রেরি আছে উনি একটা ছেলের কথা বলেছিলেন কয়েকমাস আগে। ছেলেটা ডিফেন্সে জব করে৷ বড় কোনো পোস্টে নয়। সৈনিক পোস্টে আছে৷ ভাবছি ছেলেটার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিব। তুমি কি বলো?
– ভাবতে দেও আমাকে। কালকে সকালে জানাচ্ছি।
যে ব্যক্তি মেয়ের বিয়ে নিয়ে সারাক্ষণ অস্থির থাকে, সে এমন প্রস্তাব হাতের মুঠোয় পেয়েও এমন নিরুদ্বেগ। অবাক হলেন সাদিক শারাফাত। তবে কি সাঁঝের বিয়ের তোড়জোড় সবাইটাই স্বর্ণলতার ফাঁকা বুলি? নাকি অন্য কোনো পরিকল্পনা আছে স্বর্ণলতার মনে?
চলবে..
#অক্ষরময়ী