#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব: ৩৩
গুমোট দুপুর৷ খাবারের টেবিলে যায়নি সাঁঝ। চুপচাপ নিজের ঘরে বসে আছে৷ ক্ষুধা লেগেছে কিন্তু কেউ খেতে ডাকেনি বলে অভিমান করে না খেয়ে বসে আছে৷ খাওয়ার পর্ব শেষ হওয়ার ঘন্টাখানেক পেরিয়েছে৷ সন্তান উপোস থাকার ব্যাপারটা মায়ের সহ্য সীমার বাইরে৷ অবশেষে সাঁঝের মা হার মানলেন৷
খাবার প্লেট হাতে গুটিগুটি পায়ে এসে সাঁঝের পাশে বসল সাভিন। সাবিলও এসেছে। সে বোনের অপরপাশে বসে বিগলিত হেসে বলল,
– মা খাবার পাঠিয়েছে। খেয়ে নেও৷
পেটের ভেতর আন্দোলন চললেও সাঁঝ মুখ ফিরিয়ে নিল।
– খাবো না৷ একবেলা ধরে মারবে৷ আরেকবেলা আদর করে খাওয়াবে৷
সাভিন অবাক হয়ে ভ্রু উঁচু করে বলল,
– তুমি তো ঠিকমতো মার খেলেই না৷ তাশফীন ভাইয়া এসে বাঁচিয়ে নিল। তাতেই অভিমান করে বসে আছো৷ সেই হিসেবে আমাদের দুজনের সপ্তাহখানেক না খেয়ে বসে থাকা উচিত ছিল৷ অথচ দেখো বোয়াল মাছ দিয়ে ভরপেট ভাত খেয়ে এলাম।
সাঁঝ থমকাল। সাভিনের মুখে অনুসন্ধানী দৃষ্টি ফেলে বলল,
– তোদেরকেও মেরেছে?
– শুধু মার! গতরাতে বাড়িতে ঝড় বয়ে গেছে আমাদের উপর দিয়ে৷ বাবা এসে যেই না তোমার ফেসবুক একাউন্টের কথা বলল, ওমনি মায়ের মাথা খারাপ হয়ে এলো। তোমাকে হাতের কাছে না পেয়ে রাগ মেটালো আমাদের উপর। ভাগ্যিস গতরাতে তুমি বাড়ি ছিলে না। ঐ মুহূর্তে তোমাকে সামনে পেলে মেরে আলুভর্তা বানিয়ে দিত। ওতো রাতে তোমাকে বাঁচানোর কেউ থাকত না। সকালে তাশফীন ভাইয়া ছিল বলে বেঁচে গেছ৷
– কেনো মেরেছে তোদের?
– অতি সামান্য কারণ। ঘরে লাইট বন্ধ না করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এটা অযুহাত ছিল মাত্র। আসলে তোমার উপর যে রাগ জমেছিল সেটা তাৎক্ষণিক কারো উপর ঝেড়ে ফেলার দরকার ছিল, তাই মেরেছে।
– আহারে! খুব মেরেছে না?
– দুজনের উপর সমান ভাগে বিভক্ত হয়েছে বলে কম মার খেয়েছি। তোমার একার উপর দিয়ে গেলে আজকে তুমি বিছানায় পড়ে থাকতে। এখন তাড়াতাড়ি খেয়ে নেও। না হলে আরেকদফা মার খাবে। এবেলা কিন্তু কেউ বাঁচাতে আসবে না।
মায়ের ঠিক নেই। এখন আদর করে খাবার পাঠিয়েছে। ফিরিয়ে দিলে ঝট করে রেগে গিয়ে উত্তম-মধ্যম বসিয়ে দিতে পারে। ক্ষুধাও লেগেছে বেশ। প্লেট কাছে টেনে খেতে শুরু করল সাঁঝ৷
*
পরবর্তী দিনগুলো চোখের পলকে কেটে গেল৷ অথচ সাঁঝের বাবার মনে হচ্ছে, প্রতিটি মুহূর্ত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। পরপর দুটো অঘটনের ফলে তিনি অত্যন্ত চিন্তিত। মেয়ের বিয়ের বিষয়টি অধিক গুরুত্ব সহকারে দেখা শুরু করেছেন। তবে এবার আর পূর্বের ভুল করলেন না৷ বারবার বাইরের লোকের সামনে মেয়েকে উপস্থাপনের ব্যাপারটা উনার ঠিক পছন্দ নয়৷ তাই আগে দুপক্ষ বাইরে বাইরে খোঁজ খবর নিতে থাকল৷ কিন্তু প্রতিবার মোক্ষম সময়ে এসে ছেলেপক্ষ নাকচ করে দেয়। এই নিয়ে কমপক্ষে সাতখানি ছেলে তিনি দেখেছেন৷ সবাই বিশেষ কোনো কারণ না দেখিয়ে নানান অযুহাতে পিছিয়ে গেছে৷ পরপর এমন ঘটনায় মুমূর্ষু হয়ে পড়েছেন তিনি৷
ভোরবেলা গম্ভীরমুখে ফাঁকা রাস্তা ধরে হাঁটছিলেন। হাত দুটো পিঠের দিকে মুড়ে রাখা। নিচের দিকে তাকিয়ে উদ্দেশ্যহীন চলছিলেন। কোথা থেকে সানান ভাই এসে পাশে দাঁড়ালো৷ তিনি অবাক চোখে সেদিকে তাকিয়ে হাসলেন।
– তুই হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলি?
– নিজের বাড়ি থেকে।
– এত সকালে কী মনে উঠেছিস? তোর না সকাল শুরু হয় দুপুরবেলা?
– ভাবলাম একটু এক্সারসাইজ করি৷ শুয়ে-বসে থেকে কেমন মুটিয়ে যাচ্ছি। কয়েকদিন পর ভুড়ি নামলে কেউ মেয়ে দিবে না।
– হা হা হা। বিয়েশাদির চিন্তা তোরও আছে তাহলে। আমি ভাবলাম, তোকে ধরে বেঁধে বিয়ে দিতে হবে। ঘর সংসারে মন নেই। যা বাউণ্ডুলিপনা করে বেড়াচ্ছিস আজকাল!
– বিয়ে করবো না কেন? কী আজব! আমি বিয়ের জন্য দু পায়ে রাজি৷ তোমরাই কেউ বিয়ের কথা বলছ না। আমি কি নিজ মুখে বিয়ের কথা বলতে পারি! আমার লজ্জা নেই বুঝি।
– তুই লজ্জা পাস! জানতাম না তো। লোকে তোকে ঠোঁটকাটা বলে ডাকে, তাই জানতাম।
– সে লোকে আদর করে ডাকে।
– তাহলে এবার তোর বিয়ে নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। দাঁড়া আগে সাঁঝে বিয়েটা হয়ে যাক।
– ওর বিয়ে কবে?
– আর বিয়ে! কী যে আছে মেয়েটার কপালে! দেখতে দেখতে ওর সমবয়সী সবার বিয়ে হয়ে গেল। অথচ কতদিন ধরে ছেলের খোঁজ চলছে, কিন্তু মেয়েটার কোনো গতি হচ্ছে না৷ কলেজের ভর্তিও শুরু হয়ে গিয়েছে। তোর মেজ মা জেদ ধরেছে, অবিবাহিত মেয়েকে কলেজে পাঠাবে না। এদিকে মনমতো ছেলেও পাওয়া যাচ্ছে না৷ সাঁঝও ক্ষেপেছে। ইয়ার গ্যাপ সে দিবে না। ভর্তি শেষ হওয়ার আগেই বিয়ের ব্যবস্থা করতে বলেছে৷
– বাহ! তোমার মেয়ে দেখছি বিয়ের জন্য নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে৷
– হা হা। বান্ধবীরা সবাই কলেজে যাবে, সে যেতে পারবে না। এই কারণেই মত দিয়েছে।
– অর্থাৎ বিয়ের কনে রাজি। এখন শুধু বর খুঁজে পাওয়া বাকি।
– হুম৷ এটাই এখন সবচেয়ে কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখি ওর মায়ের সাথে কথা বলে। সেও কেনো যেন শান্ত হয়ে বসে আছে৷ কিছু বলছে না।
ভর্তির এপ্লাই শেষ হওয়ার পথে৷ এক সপ্তাহ বাকি আছে। অপেক্ষা করতে করতে জুবিয়া আজ এপ্লাই করে এসেছে৷ সব শুনে সাঁঝের ভীষণ মন খারাপ হলো।
– কোন কলেজ চয়েজ দিলি?
– অন্য স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছে না। আমাদের তাঁতীবাজার কলেজেই পড়ব৷ এটাই ফাস্ট চয়েজ দিয়েছি। রেজাল্ট ভালো আছে। এখানেই হয়ে যাবে। তুইও কিন্তু এটাই চয়েজ দিবি৷
– ভর্তি হবো কিনা তাই জানি না।
– গ্যাপ দিস না সাঁঝ। এবার লেখাপড়া থেমে গেলে আবার শুরু করা কঠিন৷ সময়, সুযোগ কোনোটাই অনুকূলে থাকে না৷
– আমি কি করব? আমার হাতে কিছু আছে? একটা সাইকো ফ্যামিলিতে জন্মেছি৷ কেউ আমাকে বুঝে না৷ সবাই বিয়ের গান গাওয়া শুরু করে দিয়েছে৷ এই জেলখানা থেকে একবার বের হতে পারলে আমার শান্তি।
– বুদ্ধি খাটায় কাজ কর। ইমোশন দিয়ে জীবন চলে না। বাড়ি থেকে বের হয়ে কি করবি তুই? উল্টো অথৈ জলে পড়ে যাবি। ওখান থেকে কীভাবে কার্যসিদ্ধি করা যায় সেটা ভাব।
– কী করব আমি? আমার মাথা কাজ করতেছে না।
– আপাতত কিছু করার দরকার নাই৷ মাঝেমধ্যে আন্টিকে মনে করায় দিবি ভর্তির কথা৷ ভুলেও রাগারাগি, চিল্লাচিল্লি করবি না। বুঝিয়ে বলবি৷ তবুও যদি কাজ না হয় তাহলে অন্য উপায় অবলম্বন করতে হবে৷
– প্রথমটা ফ্লপ। আগেই বলে দিলাম। অন্য উপায়টা বল।
– বাড়িতে না জানিয়ে এপ্লাই করা৷
– অসম্ভব। আমাকে বাড়ি থেকে বের হতেই দেয় না৷ মোবাইলও ধরতে দেয় না এখন। কম্পিউটারের দোকানে গেলেই সানান ভাইয়ের স্পাইগুলা বাড়িতে জানায় দিবে৷
– তোকে বের হতে হবে না। তাশফীন ভাইয়াকে বলবি। উনি নিশ্চয়ই তোকে সাপোর্ট করবে৷ আর যদি না করে তবে লাস্ট অপশন হচ্ছি আমি৷ তোর হয়ে আমি এপ্লাই করে দিব।
– তুই টাকা পাবি কোথায়?
– ম্যানেজ হয়ে যাবে৷ তুই চিন্তা করিস না।
সাঁঝের কথা অনুযায়ী প্রথম প্ল্যান ফ্লপ হয়ে গেল নিমিষেই। মেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে তখনও এই এলাকার মানুষ ততোটা সচেতন ছিলেন না। মূলত ঢাকার আদিম বাসিন্দারা এখনো পড়াশোনাকে খুব একটা গুরুত্ব সহকারে দেখেন না। সেটা ছেলে হোক কিংবা মেয়ে। কোনোরকম অক্ষরজ্ঞান এবং হিসাবনিকাশ শিখে গেলে তারা ছুটে ব্যবসার দিকে। চাকরির থেকেও ব্যবসায় তাদের আগ্রহ বেশী। বোধ বুদ্ধি থাকলে এখানে বিপুল আয় করা সম্ভব। সার্টিফিকেটের বিশেষ প্রয়োজন পড়ে না। তাই এক টুকরো কাগজের অপেক্ষায় কতোগুলো বছর অযথা নষ্ট করার পক্ষে তারা নয়।
*
জৈষ্ঠ্যের প্রথম সপ্তাহ। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে প্যাচপেচে কাদাময় রাস্তাঘাট। লোকজন পারতপক্ষে বাইরে বের হওয়া এড়িয়ে চলার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে৷ কিন্তু ঘরকুনো সানান ভাই ব্যাঙের মতো গর্ত থেকে মাথা তুলে বেরিয়েছে৷ ঘোলা জলে শরীর ডুবিয়ে গলা উচিয়ে চিৎকার জুড়েছে। ঘ্যাঙর ঘ্যাং।
এমনি এক বৃষ্টি ভেজা বিকালে ক্লাবঘরের বারান্দায় চেয়ারে বসে বৃষ্টি দেখছিল আজম। সামনের রাস্তা দিয়ে সানান ভাইয়ের বাইক যেতে দেখে গলা উঁচু করে ডাক দিল। বিপরীতে বাইকের গতি মন্থর হলেও বাইক থেকে নামল না সানান ভাই। বিরক্তিঝরা কণ্ঠে বলল,
– কী হয়েছে?
– বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?
– কাজ আছে।
– ভিজে ভিজে অফিস যাচ্ছিস! মামা, তোর এতো উন্নতি!
– কাজ বলতে শুধু অফিস বুঝায় না। পার্সোনাল কাজও থাকে মানুষের।
সানান ভাইয়ের ব্যক্তিগত কাজ মানেই কোনো ঝামেলা পাকানো। সন্দেহ হলো আজমের। চেয়ার ছেড়ে উঠে বসে বন্ধুর বাইকের পেছনে বসে বলল,
– চল যাই।
– তুই বাইকে উঠছিস কেনো?
– তোর সাথে যাব।
– আমি আমার কাজে যাচ্ছি। বিরক্ত করবি না তো।
– তোর কাজ মানে আমার কাজ। তোর সবকিছু আমার। শুধু বউটা বাদে৷ ও আমার ভাবি লাগে।
– ঢং করবি না শালা। নাম গাড়ি থেকে।
– তোকে বিশ্বাস নাই মামা। কখন কোন অকাজ করে বসে থাকিস। আমি পাশে না থাকলে তোকে আটকাবে কে? চল তাড়াতাড়ি। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছি।
অগত্যা আজমকে সঙ্গে নিয়ে সানান ভাইয়ের বাইকটা ছুটে চলল। বিশালাকৃতির বাড়িটির সামনে বাইক থেকে নেমে আজম সবিস্ময়ে বলল,
– আমরা মেয়রের বাড়িতে কি করতে এসেছি?
– বেডা আমাদের সাপোর্ট পেয়ে মেয়র হয়ে গেল। এখন কিছু উপকারে আসুক।
বাইকের চাবি আঙ্গুলের মাথায় ঘুরাতে ঘুরাতে সানান ভাই ভেতরে চলল। আঁধার মুখে পেছনে ছুটতে ছুটতে আজম নিশ্চিত হলো। আরেকটা ঝামেলা পাকাতেই এখানে এসেছে সানান ভাই।
শাফিন আহমেদ কিছুক্ষণ গম্ভীর মুখে বসে থেকে বললেন,
– কুড়িগ্রামের বন্যা কবলিত মানুষজনকে সাহায্য করে আমার কি লাভ? আমি কেনো তাদের উপর ইনভেস্ট করব? ওদের জন্য সরকার আছে। ওই এলাকার এমপি আছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাগুলোও কয়েকদিনের মধ্যে চলে যাবে ঘটনাস্থলে। তুমি আমাকে ইনভলভ হতে বলছ কেনো বুঝতে পারছি না৷
সানান ভাই সোফায় হেলান দিয়ে রাজকীয় হালে বসে ছিল। সদ্য নির্বাচিত মেয়রের গাম্ভীর্যতায় সে ঘাবড়ালো না। বরং শান্তভাবে বলল,
– সলিমুল্লাহ মেডিকেলের একজন সিনিয়র ডক্টর বন্যা কবলিত মানুষদের চিকিৎসার জন্য যেখানে যাচ্ছেন। ওখানে ক্যাম্প করবেন। কিন্তু বাজেটের অভাবে প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র কিনতে পারছেন না। আপনি যদি উনাকে সাহায্য করেন তাহলে এই সুযোগে আপনার পাবলিসিটি হয়ে যাবে। ভেবে দেখুন, এটা আপনার জন্য অনেক বড় সুযোগ। দেশবাসীর সামনে নিজেকে প্রমাণ করার, পরিচিত হয়ে উঠার। আপনি নিশ্চয়ই শুধু উত্তর সিটি করপোরেশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চান না।
রাজনীতি বড় লোভনীয় জিনিস। ক্ষমতার লোভ মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায় সর্বক্ষণ। আরও চাই, আরও বেশি। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার আগে শাফিন আহমেদ এইটুকুতেই সন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু প্রথমবারেই নির্বাচনে জিতে আরও অনেকদূর এগিয়ে চলার মনোবল পেয়েছেন। তিনি আরও এগিয়ে যেতে চান। ব্যাপারটা এখনো কাউকে জানাননি। সামনে বসে থাকা যুবকটি কী করে তাঁর মনোবাসনা বুঝে গেল, তা ভেবে অবাক হচ্ছেন।
একবার এসিস্ট্যান্ট শফিকের দিকে চেয়ে চোখে চোখে শলাপরামর্শ করে নিলেন। এরপর ইতস্তত করে বললেন,
– উনাদের ক্যাম্পের ব্যাপারে তুমি কি করে জানলে?
– আমার সোর্স আছে। তার মাধ্যমেই জেনেছি। সেটা আপনার চিন্তার বিষয় নয়। আপনি ডোনেশনে ইন্টারেস্টেড কিনা সেটা বলুন৷ না হলে আমাকে অন্য জায়গায় যোগাযোগ করতে হবে।
– নাহ, নাহ৷ অবশ্যই ইন্টারেস্টেড। বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহায্যের সুযোগ নিজে এসে আমার সামনে উপস্থিত হয়েছে। এমন সুযোগ কী করে হাতছাড়া করি! আমি এখনি শফিককে পাঠিয়ে দিচ্ছি৷ ক্যাম্পের জন্য যা কিছু প্রয়োজন, সব আমার তরফ থেকে যাবে। শফিক, ব্যাপারটা তুমি নিজে তদারকি করবে।
কাজ শেষ হয়েছে। সানান ভাই উঠে দাঁড়ালো। আজম এখনো তব্দা খেয়ে বসে আছে। কে, কোথায়, কীসের ক্যাম্প করবে সেটা এখনো বুঝে উঠতে পারছে না। শাফিন আহমেদের থেকে বিদায় নেওয়ার সময় তিনি সরু চোখে চেয়ে প্রশ্ন করলেন,
– ওদের ক্যাম্পেইনে সাহায্য করে তোমার কি লাভ, সানান? ডক্টর কি তোমার পরিচিত?
– নাহ। আপনি যেজন্য সাহায্য করছেন, আমিও একই কারণে সাহায্য করলাম। ওই যে মানবিকতা।
আজম মনে মনে হাসল। তার বন্ধুটি কবে থেকে অন্যের ব্যাপারে মাথা ঘামানো শুরু করেছে? এমন অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে গেল অথচ সে টের পেলো না। তা কি করে হয়?
বাইকের পেছনে উঠে বসে বলল,
– তোর মতলবটা কি বলতো?
– জাল ফেলানোর আগে ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করে নিলাম। এবার বিনা বাধায় জাল ফেলব। মাছ ধরা পড়তে বাধ্য।
*
নিঝুম রাত। সাঁঝের বাবা বসে আছেন সোফায়। হাতে সকালের পত্রিকা মেলে ধরলেও সেদিকে মনোযোগ নেই৷ কিছুক্ষণ আগে মেয়ের বিয়ে বিষয়ক চিন্তা জাহির করেছিলেন স্ত্রীর সামনে। তিনি নির্বিকার মুখে শুনেছেন। কোনোপ্রকার উদ্বেগ জাহির করেননি। অথচ মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে তাঁরই অধিক তোরজোর ছিল এতোদিন। এখন হঠাৎ এই নির্লিপ্ততা কেনো?
সাঁঝের মা হাসিমুখে খাবারের টেবিল সাজাচ্ছেন। তাশফীন আজ এখানে খাবে৷ তাই এতো আয়োজন। সাঁঝের বাবা খাবারের টেবিলে বসে স্ত্রীকে বললেন,
– তোমার চিন্তা হচ্ছে না?
– কোন ব্যাপারে বলছ?
– সাঁঝের বিয়ে৷ ভর্তির ডেট শেষ হতে চলল৷
– বিয়ের ব্যাপারে এত তাড়াহুড়ো চলে না। দেখতে থাকো। যার সাথে জোড়া লিখা আছে, তার সাথেই মেয়ের বিয়ে হবে। এতো চিন্তা করে কোনো লাভ নেই।
খাবার টেবিলে তাশফীন জানালো হাসপাতালের কাজে তাকে কিছুদিনের জন্য শহরের বাইরে যেতে হবে৷ যা শুনে বিচিত্র কারণে মা-মেয়ের চেহারায় মেঘের ছায়া পড়ল৷ সাঁঝের মা বললেন,
– এভাবে হঠাৎ করে কেনো যাচ্ছ?
– হঠাৎ করে নয় খালামণি৷ কয়েকদিন ধরে প্রস্তুতি চলছিল।
– আপা জানে এই ব্যাপারে?
– হ্যাঁ। আজকেই বলেছি৷
– কবে ফিরবে?
– দুদিন লাগবে।
– ওহ আচ্ছা। সাবধানে যেও।
সাঁঝের মা অন্যমনস্কভাবে খাওয়া শেষ করলেন। অন্যদিকে সাঁঝ ইশারায় তাশফীনকে ঘরে ডাকল। সবার অলক্ষ্যে তাশফীন উপস্থিত হওয়া মাত্র সাঁঝ ভয়ার্ত চেহারায় নিজের উৎকণ্ঠা প্রকাশ করল।
– তুমি চলে গেলে আমার কী হবে?
– কী আবার হবে! বিয়ে করে ঘর সংসার করবি।
– ফাজলামি করো না ভাইয়া৷ এপ্লাইয়ের ডেট শেষের দিকে৷ তুমি এই সময় কেনো যাচ্ছ?
– হঠাৎ করে এই সময়ে বন্যা হলো। স্যার অবশ্য কয়েকদিন ধরে ক্যাম্পের কথা ভাবছিলেন৷ আমার যাওয়ার কথা ছিল না। বাজেট কম ছিল। তাই মাত্র দুজন জুনিয়র ডক্টরের সাথে উনি যেতে চেয়েছিলেন। হঠাৎ করে কোথা থেকে বাজেট এসেছে গতকালকে৷ এখন স্যার চাচ্ছেন বেশ বড় আকারে ক্যাম্প করতে। আমাদের পুরো টিমকে যেতে হবে।
– আসবে কবে? আমি ভেবেছিলাম তোমাকে দিয়ে এপ্লাই করিয়ে নিব। সব প্ল্যানে জল ঢেলে দিলে।
– দুদিনের কাজ। ডেট শেষ হওয়ার আগেই চলে আসব৷ এসে তোর ভর্তির বন্দোবস্ত করে ফেলব৷ প্রমিস৷
সাঁঝ ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমান করে বলল,
– আমাকে এই বিপদের মধ্যে ফেলে চলে যাচ্ছ। এর মাঝে বিয়ের নাম করে মা যদি আবার আমাকে মারধর করে, তখন কে আটকাবে?
– আমার মনে হয় না, এর মাঝে বিয়ে নিয়ে আর ঝামেলা হবে৷ ছেলে দেখতে দেখতে সবাই হাঁপিয়ে উঠেছে। কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে দেখছিস না? তবুও তুই একটু সাবধানে থাকিস। অকারণে খালামণির সাথে লাগতে যাস না। সে কিছু বললে চুপচাপ মেনে নিবি। মানার মতো না হলে চুপ থেকে এড়িয়ে যাবি। তর্ক করতে গিয়ে রাগিয়ে দিস না যেনো। জানিসই তো রেগে গেলে কেমন পাগলপ্রায় হয়ে যায়।
– তুমি তাড়াতাড়ি ফিরে এসো কিন্তু।
– আচ্ছা। তুই কিন্তু একদম লক্ষ্মী মেয়েটি হয়ে থাকবি৷ আমি ফিরে এসে সব ঠিক করে দিব।
সাঁঝকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে রেখে সেই রাতের বাসে কুড়িগ্রামের দিকে রওনা হলো তাশফীন। কুড়িগ্রামে তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি। চারপাশ দাপাচ্ছে সর্বনাশী ঝড়৷ গাছপালা ভেঙেচূড়ে রাস্তা আটকে গেছে। উপশহর থেকে গ্রামের দিকে ঢুকতেই অবস্থার আরও অবনতি হলো। কোথায় রাস্তা, কোথায় ঘাট! পিচঢালা রাস্তা ডুবে গিয়েছে নদীর জলে।
রাস্তা থেকে নিচে ঢালুর দিকে ছিল গ্রাম। যার কোনো অস্তিত্ব এখন আর নেই। সুবিশাল জলরাশির মধ্যে দু একটা খড়ের চালা চোখে পড়ছে৷ না জানি কার মাথা গোঁজার ঠাইটুকু ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে!
বেদনা ভারাক্রান্ত মনে ওরা গাড়ি থেকে নামল। নৌকার বন্দোবস্ত করা ছিল৷ মাঝিকে কল দিতে গিয়ে দেখা গেলো, এখানে নেটওয়ার্ক নেই। হাটু জলে পা ডুবিয়ে মালপত্র কাঁধে তুলে নিয়ে ওরা দশজন এগিয়ে গেল সামনে৷ কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর মাঝির দেখা পেল। অস্থায়ী একটি ঘাটে ডাক্তারদের জন্য অপেক্ষা করছিল একজন সুঠাম দেহের যুবক। সেই ওদের নৌকায় তুলে নিয়ে গেলো গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের দিকে। সেখানে ডাক্তারদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঝড় বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ওরা চলল প্রকৃতির অসংগতিতে সর্বহারা মানুষদের সাহায্যের উদ্দেশ্যে।
*
সাঁঝের বাবার মন ভালো নেই৷ তিনি ভেবেছেন স্ত্রীর বিরুদ্ধে গিয়ে পাশের কলেজে মেয়ের ভর্তির ব্যবস্থা করে দিবেন। প্রতিদিন ক্লাস করতে যেতে না পারলেও ভর্তি হয়ে থাকলে অন্তত বছরটা বরবাদ হবে না। পরীক্ষা আসতে আসতে মেয়ের একটা কিছু গতি হয়ে যাবে৷
সাংসারিক বিষয়ে নিজেকে জড়াতে ভালো লাগে না। তার উপর এই বয়সে এসে স্ত্রীর সাথে ঝামেলা করাটাও ভীষণ ক্লান্তিকর। স্বর্ণলতা একজন বিরক্তিকর মহিলা। মনে যখন যেটা আসে সেটা করেন। কারো মতামতকে তিনি গুরুত্ব দেন না। এমনকি স্বামীকেও বিশেষ গ্রাহ্য করেন না৷
হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাঁঝের বাবা লাইব্রেরী বন্ধ করলেন। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে৷ রাত খুব একটা গভীর হয়নি৷ দু একটা রিক্সা টুংটাং বেল বাজিয়ে ছুটাছুটি করছে। তিনি রিক্সার খোঁজ করছিলেন, এমন সময় আকস্মিকভাবে সানান ভাইয়ের আগমন ঘটল। তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন,
– তুই এই সময় এদিকে কি করছিস?
– মা বলেছিল সায়রার জন্য একটা বই নিয়ে যেতে৷ আগের বইটা নাকি ছিড়ে ফেলেছে। অফিস থেকে ফেরার পথে নীলক্ষেতে ঢুকেছিলাম বই কিনতে৷
– তোর বাইক কোথায়?
– সারাদিন বৃষ্টি হচ্ছিল দেখে বাইক নিয়ে বের হয়নি। কয়েকদিন আগে জ্বর থেকে উঠলাম৷ বৃষ্টিতে ভিজলে আবার জ্বর আসবে৷ তুমি বাড়ির দিকে যাচ্ছ?
– হ্যাঁ।
– চলো একসাথে যাই৷
প্লাস্টিক গায়ে মুড়ে রিক্সায় বসে আছে দুজন। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি এড়িয়ে রিক্সা চলছে পুরান ঢাকার সংকুচিত গলির ভেতর দিয়ে। বৃষ্টিভেজা আলস্যতা গায়ে মেখে নিজের জীবনের দুঃসময়ের গল্প করছেন সাঁঝের বাবা।
– মেয়ে মানুষ করা আসলেই অনেক ঝক্কি-ঝামেলার ব্যাপার। ছোটবেলায় শান্তশিষ্ট থাকে বটে। কিন্তু বড় হলে বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে যায়।
– ঘরে অমূল্য রত্ন থাকলে তার রক্ষণাবেক্ষণে যেমন ঝামেলা পোহাতে হয়, মেয়েরাও তেমনি অমূল্য রত্ন৷
– আমরা গরীব মানুষ। অমূল্য রত্ন ঘরে রাখার শক্তি, সামর্থ্য কোনোটাই আমাদের নাই৷ রক্ষণাবেক্ষণের ঝামেলা, সম্মানের ভয়, উপযুক্ত হাতে পাত্রস্থ করার দুশ্চিন্তা – এতকিছু সামলাতে গিয়ে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। এই বিশাল শহরে একটা যোগ্য ছেলে নেই! আজব ব্যাপার!
– আমার বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজতে শুরু করো, দেখবে মেয়েরও আকাল পড়ে যাবে৷ চোখের সামনে অগণিত ছেলেমেয়ে দেখা গেলেও তুমি যখন খুঁজতে যাবে তখন তোমার মনমতো কাউকে পাবে না৷ এটাই বাস্তবিকতা।
– আমার দ্বারা আর সম্ভব না। হার মেনে নিয়ে সাঁঝের মায়ের কাঁধে সবটা ছেড়ে দিব। ছেলের খোঁজ করতে গিয়ে ব্যবসাপাতি লাটে উঠেছে। কয়েকদিন ধরে বাচ্চাদের কী যে পড়াচ্ছি নিজেও জানি না৷
রিক্সা এসে থেমেছে আরাম-আয়েশের সামনে৷ সাঁঝের বাবা রিক্সা থেকে নামতেই সানান ভাইও নেমে পড়ল। নিজেই জোর করে ভাড়া মিটিয়ে রিক্সাওয়ালাকে বিদায় করল। তারপর ইতস্তত করে ডাকল,
– মেজ বাবা?
দরজার একপাশে মৃদু আলো ছড়াচ্ছে একটা বাতি৷ আলো আঁধারিতে সাদিক শারাফাতের মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তাতে অবশ্য সুবিধা হলো সানান ভাইয়ের৷ সে উনার সামনে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলল,
– তুমি রাজ্য জুড়ে সাঁঝের জন্য ছেলে খুঁজে বেড়াচ্ছ কেনো? আমাকে কি তোমার যোগ্য ছেলে মনে হয় না?
সাঁঝের বাবা বোধহয় কথাটি বুঝতে পারেননি৷ সামান্য হেসে হাত নাড়িয়ে কী যেন বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। আবছায়া অন্ধকারেও সানান ভাই দেখল মেজ বাবার মুখ থেকে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল হাসি৷ শ্রবণকৃত বাক্য দুটো মস্তিষ্কে ঢপ খেতে লাগল। কয়েক সেকেন্ড বিমূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে তিনি বললেন,
– এ তুই কি বলছিস, সানান?
– আমি কি এতোটাই অযোগ্য তোমাদের চোখে?
– তা নয়। আসলে সাঁঝের জন্য তোর কথা সেভাবে কখনো ভাবিনি।
– আমি নিজে তোমাকে প্রস্তাব জানালাম। এখন ভাবো।
– তোর সাথে সাঁঝ… না মানে .. কীভাবে সম্ভব? তোদের সাথে আমাদের যায় না।
– কেনো যায় না?
– আমাদের অবস্থা দেখ আর তোদের অবস্থা দেখ। ওতো বড় ঘরে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই৷ তাছাড়া তোর মা মানবে না।
– বিয়েটা আমি করব৷ আমাদের অবস্থা, আমার মা এসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।
– তুই… তুই কেনো হঠাৎ করে সাঁঝকে বিয়ে করতে চাইছিস?
– হঠাৎ পছন্দ হয়ে গেল, তাই। ভেবে দেখলাম, আমাদের দুজনেরই বিয়ের কথাবার্তা চলছে। আলাদা করে দুজনের জন্য ছেলে-মেয়ের খোঁজ না করে নিজেদের মধ্যে ব্যাপারটা মিটিয়ে নিলে ভালো হয়। তুমি এতদিন খোঁজ করে দেখলে তো উপযুক্ত ছেলে পাওয়া কতো ঝক্কির ব্যাপার। এতদিনে আমার দিকে তাকালে এতোটা কষ্ট করতে হতো না তোমাকে। বাড়ির মধ্যে ব্যাপারটা মিটে যেত।
সাঁঝের বাবা এখনও একটা ঘোরের মধ্যে আছেন। সানান ভাইয়ের কথার বিপরীতে উপযুক্ত কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে বললেন,
– আমি আসলে বুঝতে পারতেছি না৷ এমন হঠাৎ করে বললি! সাঁঝের মায়ের সাথে কথা বলে তোকে জানাচ্ছি। এখন বাড়ি যা।
কয়েকদিন ধরে ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে না সানান ভাইয়ের৷ অর্ধেক কাজ সম্পন্ন করে ঘুমানোর কথা ভেবেছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যজ্ঞে সবেমাত্র আগুন জ্বালানো হলো। এখনো কত আহুতি দেওয়া বাকি!
চলবে…
#অক্ষরময়ী
#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব: ৩৪
ঘড়িতে এখন কটা বাজে, জানা নেই। সানান ভাইয়ের মনে হচ্ছে সে ঘুমিয়েছে মাত্র কয়েক মুহূর্ত পূর্বে। এরই মধ্যে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটল। আধো চোখ খুলে দেখল কঠিন মুখে চেয়ে আছেন বড় মা। সানান ভাই আবারও চোখ বুজে ঘুমকাতুর কণ্ঠে বলল,
– বিরক্ত করো না, আম্মা। মাত্রই ঘুমালাম।
বড় মা সেসব কথা শুনলেন না। বরং ধমকে উঠলেন,
– এই উঠ। উঠ বলছি৷
সানান ভাই উঠল না। শুধু চোখ খুলে লম্বা হাই তুলে বলল,
– কী হয়েছে?
– সাদিককে কি বলেছিস তুই?
– ইতিমধ্যে খবর পেয়ে গেছো! তোমাদের নেটওয়ার্ক দেখছি ত্রি জির থেকেও ফাস্ট৷
– ভালো করে শুনে রাখ। ওই মেয়েকে আমি কিছুতেই আমার ঘরে আনব না।
– বিয়ে করব আমি৷ বউ আসবে আমার ঘরে। তোমার ঘরে যাবে না। তুমি চিন্তা করো না।
– হেয়ালি করার চেষ্টা করবি না, সানান। ওই বংশের মেয়ে আমার ঘরে বউ হয়ে আসবে না৷ কিছুতেই না৷
সানান ভাই এবার শান্ত চোখে চেয়ে শীতল কণ্ঠে বলল,
– আমিও তো একই বংশের ছেলে, আম্মা।
– এজন্যই ওদের মতো চণ্ডাল হয়েছিস। স্বার্থপর সব কটা। রক্ত জল করে সন্তান মানুষ করে কী লাভ হলো আমার? হলি সেই বাপের মতো অমানুষ। হবি না আবার! দেখতে হবে না কার রক্ত বইছে শরীরে।
বড় মায়ের কেঁদেকেটে একাকার অবস্থা। চোখে জল, মুখশ্রী কঠিন। জ্বলন্ত উনুনের মতো জ্বলছে চোখ দুটি। সেই তাপ ছড়িয়ে লালচে হয়েছে মুখমন্ডল। সানান ভাই শান্ত চোখে মায়ের রূপের এই পরিবর্তন দেখল।
অতীতের বন্ধ ঝাপি খুলতে শুরু করেছে। যা তারা ভুলে গিয়েছিল সাত বছর আগে৷ চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে আসার সময় অতীতকে সেখানে রেখে এসেছিল। আজ আবার স্ত্রীর মুখে এমন কথা শুনে বড় বাবা ভীষণ বিষণ্ণ বোধ করলেন। স্ত্রীকে থামানো দরকার। দ্রুত এসে বড় মায়ের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন নিজের কক্ষে৷
সানান ভাই আরও কিছুক্ষণ পলকহীন চোখে শূণ্যে চেয়ে থেকে বালিশে মাথা রাখল। তারপর ধীরে ধীরে তলিয়ে গেলো ঘুমের দেশে৷ চিন্তা করে কী আর হবে! সে জানত, জিততে হলে একদিন এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি তাকে হতেই হবে।
*
বন্ধ দরজার ভেতরে রাগে, ক্ষোভে রীতিমতো কাঁপছেন বড় মা। শেষে কিনা একমাত্র ছেলে তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল! এমন কিছু ঘটতে পারে তাঁর কিঞ্চিত সন্দেহ ছিল৷ কিন্তু সেটা সাত বছর আগের ঘটনা। একসময় ছেলের চোখে একটা ঘোর দেখেছিলেন। তৎক্ষণাৎ সচেতন হয়েছিলেন। নিজের কর্তব্য পালনে বিন্দুমাত্র সময় ব্যয় করেননি। সাবধানে সরিয়ে দিয়েছিলেন সাঁঝকে৷
তারপর? তারপর আলাদা হয়ে গিয়েছিল দুজনের দুটি পথ। ক্ষণিকের মোহ কেটে ছেলেটা এগিয়ে গিয়েছে নিজের জীবনে৷ তবে আজ আবার কেন ছেলের মন চলে গেলো ওই মেয়ের দিকে? কেনো তিনি ব্যর্থ হলেন?
অপরাধী মুখে দণ্ডায়মান স্বামীর দিকে চেয়ে গর্জে উঠলেন তিনি। পায়েচারি থামিয়ে স্বামীর সম্মুখে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল উঁচু করে শাসিয়ে উঠলেন।
– ওই মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে কিছুতেই হতে দিব না আমি। কী ভেবেছে তোমার পরিবারের লোকজন? নিজেদের মেয়েকে আমার ছেলের পেছনে লেলিয়ে দিয়ে আমার ছেলেটাকে আমার বুক থেকে কেড়ে নিয়ে যাবে? সেটা আমি কিছুতেই হতে দিব না।
– আহা! তুমি শান্ত হও। রাগের বশে কী বলছ নিজেও বুঝতেছ না।
– কী বুঝতেছি না আমি? আমাকে নির্বোধ মনে হয় তোমাদের? একসময় নির্বোধ ছিলাম। তোমার ভালোবাসায় অন্ধ ছিলাম। অনেক বছর আগে আমার সেই ভ্রম কেটে গেছে। এখন আমি পরিষ্কার চোখে তোমাদের ভালো মানুষির মুখোশের আড়ালে কুৎসিত চেহারাগুলো দেখতে পারি৷ আমার ছেলেটা বোকা বলে দেখতে পাচ্ছে না। এই সুযোগে ওরা আমার ছেলেকে ফাঁসিয়েছে৷ ওহ, এখন বুঝতে পারতেছি। এই জন্যে স্বর্ণলতা যখন তখন মেয়েকে এই বাড়িতে পাঠিয়ে দিত৷ ।
– বাজে বকো না আফসানা। তুমি নিজেই সাঁঝকে ডেকে আনতে কাজে সাহায্যের জন্য। ও নিজে থেকে কখনো আসেনি।
– তোহ? কাজের জন্য ডাকতাম। ছেলের বিছানায় উঠে যাওয়ার জন্য না।
– ছিঃ! চুপ করো। রাগে তোমার বিবেক বুদ্ধি লোভ পেয়েছে৷
বড় মা চুপ করলেন না। স্বামীর চোখে মুখে নিজের প্রতি ঘৃণা দেখে আরও উন্মাদ হয়ে গেলেন। তেড়ে এসে স্বামীর শার্টের কলার চেপে ধরে বললেন,
– আমার ওদিকে ওভাবে তাকাচ্ছ কেনো তুমি? ঘৃণা হচ্ছে? নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে আমাকে? তোমার থেকেও নিষ্ঠুর আমি? নাহ, নাহ। নিষ্ঠুরতার মাত্রায় তোমাদের ছাড়িয়ে যাওয়ার সাধ্য আমার এ জন্মে হবে না। তুমি, তোমার পরিবার নিষ্ঠুরতায় জগত শ্রেষ্ঠ। ভুলে গেছ সেসব কথা?
বড় বাবা আলতোভাবে স্ত্রীর হাতের উপর হাত রেখে নরম স্বরে বললেন,
– অতীত আঁকড়ে পড়ে থেকো না। সেসব অনেক আগের কথা। দিন বদলেছে, পরিস্থিতি বদলেছে, আমরা বদলেছি।
– নাহ, নাহ। কিছু বদলায় নি। সব একই রকম আছে। তোমরা সেই স্বার্থপর, নিষ্ঠুর-ই রয়ে গেছো। আমার সব কেড়ে নিয়ে তোমাদের শান্তি হয়নি। এবার… এবার আমার ছেলেটাকে কেড়ে নিতে চাইছ। এ আমি কিছুতেই হতে দিব না।
ঝটকা মেরে বড় বাবাকে ছেড়ে দিয়ে এলোমেলো পায়েচারি করতে লাগলেন বড় মা। কম্পিত হাতে খোলা চুলগুলো দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছেন। বিড়বিড় করে কথা বলছেন। বড় বাবা ভীষণ ঘাবড়ে গেলেন। স্ত্রীকে শান্ত করার যথাযথ প্রয়াস তিনি করলেন।
– সেসব নিয়ে পড়ে কথা হবে। তুমি আপাতত শান্ত হও। শরীর খারাপ করবে। এখানে একটু বসো।
– শারাফাত বংশের কারো ছায়া আমার সন্তানের উপর পড়তে দিব না আমি। দরকার পড়লে ছেলেমেয়েদের খু ন করে নিজে বিষ খাবো। তবুও ওই মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে হতে দিব না। বুঝতে পেরেছো তুমি?
– হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি। সাদিকের সাথে আমি কথা বলব। তুমি এখন শান্ত হও। এই ঔষধটা খাও দেখি। নেও হা করো।
ঘুমের ঔষধ কাজ করলো দ্রুত৷ বড় মা শান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছেন। শিউরে মাথা নিচু করে বসে আছেন বড় বাবা। মনে মনে ভাবছেন, ছেলেটা সব জেনেও কেন এমন একটা কাজ করে বসল? কেনো অতীতের নিভে যাওয়া উনুনে আগুন জ্বালালো? সে কি জানে না, তার মায়ের মানসিক অবস্থা?
এমন ছেলেমানুষি করার মতো অবিবেচক উনার ছেলে নয়। তবে কি সাঁঝের প্রতি তার বিশেষ দূর্বলতা আছে? কবে, কখন, কীভাবে ঘটল এমন সর্বনাশ?
*
আরাম আয়েশের ভেতরকার অবস্থা আরও করুণ, আরও ভয়াবহ। স্তম্ভিত চোখে চেয়ে আছেন সাঁঝের মা। সকালবেলা চায়ের কাপ নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে এমন কথা শুনে উনার মনে হচ্ছে, তিনি এখনো ঘুমের মধ্যে আছেন। ভয়ংকর কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছেন।
অন্যদিকে সাঁঝের বাবা নির্বিকার। ঘর লাগোয়া বিস্তীর্ণ বারান্দায় চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে দেখছেন ভোরের আকাশ। গতরাতে স্ত্রীকে কিছু বলেননি৷ রাতভর ভেবে নিজে নিশ্চিত হয়ে এখনি কথাটা পাড়লেন স্ত্রীর সামনে। কিন্তু নির্বোধ মেয়ে মানুষ কেমন তব্দা খেয়ে আছে দেখো৷
তিনি খানিক বিরক্ত হয়ে বললেন,
– কিছু বলছ না কেনো?
সাঁঝের মায়ের দুঃস্বপ্ন ভেঙে গেল। তিনি বোধ খানিকটা স্বস্তিও পেলেন। হকচকিয়ে গিয়ে স্বামীর পাশে রাখা চেয়ারে বসে নিজেকে ধাতস্থ করে শান্তস্বরে বললেন,
– সানান ছেলে মানুষ। বেখেয়ালে একটা কথা বলেছে। ওসব ভেবে কাজ নেই৷ তুমি না করে দিও।
– না করে দিব?
অবাক হলেন সাঁঝের বাবা। কী বলে এই নির্বোধ মহিলা? পাগল হয়েছে নাকি?
– হ্যাঁ দিবে। নাকি ও বাড়িতে মেয়ে পাঠানোর কথা ভাবছ তুমি?
– ভাবলে ক্ষতি কি? সানান ভালো ছেলে। কোনো বদঅভ্যাস নেই। চাকরী করে। আয় ইনকাম ভালো। আরকি চাই? চেনাজানার মধ্যে মেয়ের বিয়ে দিলে তোমাকেও মেয়ের ঘর সংসার নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না।
– তুমি কি কিছু বুঝতে পারছ না, নাকি সব দেখে শুনেও চোখ বুঝে এড়িয়ে যেতে চাইছ?
– কি বলতে চাইছ?
– বড় ভাবির কথা ভুলে গেছ? আমাদের প্রতি উনার তিক্ততা এখনো আগের মতোই রয়েছে। সে তার একমাত্র ছেলেকে আমাদের মেয়ের সাথে বিয়ে দিবে এ কথা ভাবলে কি করে?
– সানান আমাকে আশ্বস্ত করেছে। ওসব সে সামলে নিবে।
– তার মানে তুমি রাজি?
– অবশ্যই। অমত করার কোনো কারণ দেখছি না।
– আমি রাজি নই। ও বাড়িতে আমার মেয়েকে দিব না।
– দিবে না মানে? তবে কোন রাজবংশে মেয়ের বিয়ে দিবে তুমি? ছেলে খুঁজতে খুঁজতে আমি ক্লান্ত। আর দেখতে পারব না। সানানের ব্যাপারে আমার আগ্রহ আছে। এখন তুমি ভেবে দেখো। এখানে বিয়ে দিতে না চাইলে নিজে ছেলে খুঁজে এনে মেয়ের বিয়ে দেও। আমি এসবের মধ্যে নেই।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন সাঁঝের বাবা। দিনের শুরুটা হলো বিশ্রীভাবে। মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে উনার। বারান্দা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বললেন,
– সাঁঝের ভর্তি শেষ হতে বেশি দেরী নেই। সে কথা ভুলে যেও না। মেয়ের যেন ইয়ার গ্যাপ না যায়। এই আমি বলে রাখলাম।
আচমকা স্বামীর এমন হুশিয়ারি সংকেতে সাঁঝের মা চমকে উঠলেন। কথায় আছে হাতি গর্তে পড়লে মশাও লাথি মারে৷ উনার হয়েছে সেই দশা৷ সবাই একদলে ভীড়েছে। উনাকে একলা পেয়ে সাদিক শারাফাতের মতো নেতিয়ে পড়া মানুষও চোখ রাঙাচ্ছে। আজ হঠাৎ মেয়ের অভিভাবক হয়েছেন তিনি। এতদিন ঘর সংসার নিয়ে যার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না, আজ সে স্ত্রীর সামনে হম্বিতম্বি করছেন। একেই বলে পুরুষ মানুষ। সম্মানে টান পড়লে পুরুষত্ব জেগে উঠে।
সাঁঝের মা তিক্ত মুখে উঠে দাঁড়ালেন। মাধবীলতার সাথে কথা বলা দরকার। ওপাশে কথাবার্তা কতদূর এগোলো জানা যায়নি এখনো।
স্ত্রীর সাথে বাকবিতন্ডার পর সাঁঝের বাবা ভীষণ ক্ষেপে আছেন। কত বড় বেয়াদব মেয়ে মানুষ! স্বামীর মুখের উপরে কথা বলে। যেন মেয়ে তার একার। এককাল ছিল যখন মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে বাবার সিদ্ধান্ত ছিল শেষ কথা৷ মেয়েমানুষ দুনিয়াদারির কি বুঝে? অথচ আজকালকার মেয়েমানুষরা নিজেকে পণ্ডিত ভাবতে শুরু করেছে।
লম্বা লম্বা পা ফেলে সাঁঝের বাবা উপস্থিত হলেন নিজের মায়ের কক্ষে৷ এ ব্যাপারে সাওদা বেগমের মতামত হবে শেষ কথা। তিনি এখনো শারাফাত বংশের প্রধান। পরিবারের সংকটময় মুহূর্তে কিংবা জরুরি আলোচনায় উনার মতামত মানতে বাধ্য থাকে সকলে।
*
রাস্তায় দেখা ঝিলিকের সাথে। দেখা মাত্র মুখে আঁধার নেমেছিল সাঁঝের৷ না দেখার ভান করে মাথা নিচু করে হেঁটে আসছিল সাঁঝ। ঝিলিক সেসব খেয়াল করল না। বার কয়েক উচ্চস্বরে ডাকল। তবুও যখন সাঁঝ সাড়া দিল না। তখন দৌড়ে রাস্তা পার করে চলে এলো সাঁঝের সামনে।
– কখন থেকে ডাকছি। এত কি ভাবতে ভাবতে হাঁটছিস?
সাঁঝ অপ্রস্তুত ভঙিমায় সামান্য হাসল। অপ্রসন্ন মুখে কোনোরকমে বলল,
– ডাকছিলি! শুনতেই পাইনি।
– কেমন আছিস তুই? কতদিন পর দেখা!
– ভালো আছি। তুই ভালো?
– আমি বিন্দাস আছি।
– যাক ভালো। সুখে থাক। আজকে যাই রে। পরে কথা হবে।
– এত তাড়া কীসের? বাড়িতে চল। ইপ্তি এসেছে। ওর সাথে দেখা করে যা।
– অন্যদিন যাব। দেরী করলে মা বকা দিবে।
– চল তাহলে আমি তোদের বাড়ি যাই।
সাঁঝের চেহারাটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বলতে চাইল, তোকে না সেদিন অপমান করে মা তাড়িয়ে দিল। এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি?
মনের কথা মন রইল। কিছু আর বলা হলো না।
মানুষ এতো সহজে মনের কথা বলতে পারে না। যা কিছু বলে তার অর্ধেকটাই মনের কথার বিপরীত।
– নতুন জামাইকে বাড়িতে রেখে হাওয়া হয়ে গেলে আন্টির বকা খাবি। তার থেকে বরং একদিন সময় করে জামাই নিয়ে বেড়াতে আসিস।
– সেটা অবশ্য ভালো হয়। চল তাহলে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।
পূর্বের ঝিলিক কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। এ এক অন্য ঝিলিক। আনন্দিত, উচ্ছ্বসিত, সুখী এবং পরিপূর্ণ একটা মেয়ে। অনবরত বলে যাচ্ছে নিজের সুখের গল্প।
সাঁঝ মনোযোগী শ্রোতার মতো শুনছে । ঝিলিকের স্বামীর গল্প, শ্বশুরবাড়ির গল্প, নতুন পরিবারের মানুষগুলোর গল্প। মোটকথা ঝিলিকের সংসার সুখে ঠাসা। শুনতে শুনতে সাঁঝের মন ভালো হয়ে গেল। কোথায় যেন মিলিয়ে গেল মনের তিক্ততা। আহা! মেয়েটা এত সুখে আছে!
তার সামান্য কলঙ্কের বিপরীতে বন্ধু যদি সুখের একটা জীবন পায় তবে সমস্যা কোথায়?
ঝিলিক অবশ্য জানত না, তার সাথে রমনায় গেলে সাঁঝ এমন বিপদে পড়বে। সবাই প্রেমের শুরুতে নিরাপত্তার খাতিরে বন্ধুকে সাথে নিয়ে যায়। সেও নিয়ে গেছে। এখন বন্ধুটির যদি একটা রাক্ষুসে ভাই থাকে, সেটা কি ঝিলিকের দোষ? নিশ্চয়ই নয়৷
আর মায়ের কাছে স্বর্ণলতার নামের নালিশ? সে ব্যাপারেও ঝিলিককে সম্পূর্ণ দোষারোপ করা যায় না। ঝিলিক ছোট মানুষ। বাড়ি ডেকে নিয়ে প্রথমে অপমানটা স্বর্ণলতা-ই করেছেন। বিনাকারণে অপমানিত হয়ে ঝিলিকের বেশ অভিমান হয়েছিল। তাই তো মায়ের কাছে ওভাবে নালিশ করেছে। বিপরীতে এতোকিছু ঘটে যাবে তা সে কল্পনাও করেনি। সব দোষ বুলুর মায়ের। ওর নামেও এই মহিলা কত বাজে কথা রটিয়েছে!
বিয়ের পর আর বদনামের ভয়ে কাতর হয় না ঝিলিক। পাছে লোকে অনেক কিছু বলবে। লোকের কাজই অযথা কথা বানানো। পাশে যদি ইপ্তির মতো একজন জীবনসঙ্গী থাকে তবে লোকের কথায় কিছু আসে যায় না।
ঝিলিককে বিদায় দিয়ে বাড়িতে প্রবেশের সময় সাঁঝের মন অনেকটাই হালকা হয়ে গেছে। উত্তম জীবনসঙ্গী পাশে থাকলে তার জীবনেও আর কোনো দুঃখ থাকবে না। সুখে শান্তিতে জীবন কেটে যাবে। সুখের সংসারের স্বপ্ন নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল সাঁঝ।
সাওদা বেগমের মন বেশ ফুরফুরে। ছেলের সাথে কথা বলার পর থেকে উনার চেহারায় অন্য রকম দ্যুতি খেলা করছে। নিশ্চিন্ত দেখাচ্ছে সাঁঝের বাবাকেও। এদের পুলকিত চেহারা দেখে বুক কেঁপে উঠছে সাঁঝের মায়ের। বোনের সাথে উনার কথা হয়েছে। মাধবীলতা জানিয়েছেন, তোহাজ শিকদার বাড়ি ফিরেছেন আজ সকালে। সুযোগ বুঝে আজকেই স্বামীর সাথে কথা বলবেন তিনি।
সাঁঝের মা মনে মনে আল্লাহকে ডাকছেন। এখনো সুযোগ আছে। আল্লাহ চাইলে সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী হবে।
“কাঁচা মিঠে আলো নাম কি জানি তার
বড় অগোছালো কাটছে দিন আমার
বেজে উঠে মনে পিয়ানো গিটার
হালকা ঘুমপাড়ানি।
সে তো জল্পনাতে কল্পনাতে থাকছে জড়িয়ে
আর একলা রাতের আশকারাতে রাখছে জড়িয়ে ..”
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কানের দুল খুলতে খুলতে গুনগুন করে গাইছিল সাঁঝ। সাওদা বেগম ঘরে ঢুকে দোর দিলেন। উনার মুখে দুষ্টু হাসি। নাতনির কাছে দাঁড়িয়ে কনুই দিয়ে হালকা ধাক্কা মেরে বললেন,
– মনে বিয়ার রঙ লাগছে, বু?
সাঁঝ ফিরে তাকাল না। আয়নায় দাদীর প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে মিছে রাগ করে বলল,
– রঙ আমার মনে লাগেনি৷ তোমার মনে লাগছে। অসুস্থ শরীর নিয়ে এ ঘর-ও ঘর কেমন ছুটতেছো দেখো।
– নাতনির বিয়া, মনে রঙ না লাগায় উপায় আছে! তা নাগর দেখবি না?
লাজুক হেসে মাথা নিচু করে চুলের বেণী খুলতে থাকল সাঁঝ। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
– বিয়ে ঠিক করেছে নাকি? আমাকে ছেলের ব্যাপারে কেউ কিছু বলল না এখনো।
খানিক পথ হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন সাওদা বেগম। সাঁঝের বিছানায় বসে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে বললেন,
– নাগর দেখার জন্য আর তর সয় না দেখতাছি৷
– যাও তো। বাজে বকো না। আমি কখন দেখতে চাইলাম? তুমি বললে দেখে কথা এলো।
– হ্যাঁ, হ্যাঁ। সেসব আমি বুঝি৷ আমরাও এসব দিন পার কইরা আসছি৷
– কচু বুঝো তুমি। বিয়ে নিয়ে আমার এতোটাও আগ্রহ নাই।
– সে দেখব ক্ষণ৷ ঘুম থেকে উঠে যখন শুনবি আজকে বিয়ে, তখন দেখব কী করিস।
সাঁঝ অবাক চোখে ফিরে তাকাল। দাদীর মুখে এখনো মিটিমিটি হাসি। জেতার সম্ভাবনা ক্ষীণ বুঝতে পেরে দাদীর কাছে গিয়ে গা ঘেঁষে বসল। ফিসফিসিয়ে বলল,
– সত্যি বিয়ে ঠিক হয়েছে?
– এতক্ষণ ধরে সেই কথাই বলছি রে মুখপুড়ি।
– আমাকে একবার ছেলের ব্যাপারে কিছু জানালো না! আমার কোনো পছন্দ অপছন্দ নেই বুঝি? ছেলে যদি আমার পছন্দ না হয়, তখন?
– পছন্দ না হয়ে যাবে কোথায়? লাখে একটা সে। সোনার টুকরো ছেলে।
– তুমি দেখেছো তাকে?
– রোজ দেখি। তুইও চিনিস।
– কার কথা বলছ? এবার কিন্তু টেনশন হচ্ছে। হেয়ালি না করে বলো।
– আমাদের সানানের কথা বলছি রে গাধী। ওর সাথেই তোর বিয়ে ঠিক হয়েছে।
দাদীর কাঁধে রাখা সাঁঝের হাতটা খসে পড়ল। অবাক চোখে অপলক চেয়ে রইল সাওদা বেগমের চোখের দিকে। সেখানে আনন্দ, উত্তেজনা জ্বল জ্বল করছে। যেন তার কথার সত্যতার প্রমাণ দিচ্ছে তারা।
ক্ষণকাল পর সাঁঝ অপ্রস্তুতভাবে একটু হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু সে হাসি ফুটল না। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল,
– মজা করছ, বু?
– ধুর গাধী। মজা করব কেন? একটু আগেই তোর বাপের সাথে কথা হলো। ও বাড়ি থেকে প্রস্তাব এসেছে। তোর বাপও রাজি। বিয়ের সানাই বাজল বলে।
ঝট করে উঠে দাঁড়ালো সাঁঝ। এতক্ষণে তার ভয় কেটে গিয়েছে। দীপ্ত কণ্ঠে জানাল নিজের মতামত।
– অসম্ভব। সানান ভাইকে আমি কিছুতেই বিয়ে করব না। বাবাকে বলো অন্য ছেলে দেখতে৷
এতোদিন বাদে সাওদা বেগমের মনের আশা পূরণ হতে চলেছে। প্রথমে স্বর্ণলতা, এখন সাঁঝ। বারবার বাঁধা পাওয়ায় তিনি প্রচন্ড বিরক্ত হলেন। ক্ষণিকেই মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়ে কঠিন হলো কণ্ঠস্বর।
– কেন বিয়ে করবি না?
– দেশে কি ছেলের অভাব পড়েছে? শেষমেশ সানান ভাইকে তোমাদের নজরে পড়ল! ছি! ছি! আমি ভাবতেও পারছি না।
অন্য যেকোনো ছেলে নিয়ে এসো। আমি বিনাবাক্যে বিয়ে করে নিব। কিন্তু সানান ভাইকে না।
– কীসে কমতি আছে আমার নাতির? দেখতে ভালো, আয় ইনকাম ভালো, নেশাপানি কিছু করে না। আজ পর্যন্ত কেউ আমার নাতির বিরুদ্ধে একটা টু কথা বলতে পারে নাই৷ তুই না করিস কোন সাহসে? লাখে একটা আমাদের সানান।
– তোমার লাখে একটা নাতির সাথে স্বর্গের হুরপরীর বিয়ে দেও। আমার পেছনে পড়ে আছো কেনো? আমার তাকে পছন্দ না।
– পছন্দ না হইলেও বিয়া করা লাগব।
ক্রুদ্ধ সাঁঝ হিতাহিতজ্ঞান ভুলে হাতে কাছে যা পেলো তাই ঘরের মেঝেতে ছুড়ে ফেলল। পানির জগ, টেবিলঘড়ি, ফোনের চার্জার, বালিশ, বিছানার চাদর – সবগুলোর ঠাঁই হলো মেঝেতে।
সাওদা বেগম হতভম্ব হয়ে সাঁঝের কাণ্ডকারখানা দেখলেন। ঘরের ভেতরকার ঝনঝন শব্দ চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে ততক্ষণে।
কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়ির সবাই এসে উপস্থিত হলো। নিজের মায়ের প্রতি মেয়ের এমন উদ্ধত আচরণ দেখে হতবিহ্বল হয়ে পড়লেন সাঁঝের বাবা। ধমকে উঠলেন তিনি।
– কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছে তোর? দাদীর সাথে গলা উঁচু করে কথা বলছিস! বেয়াদব মেয়ে।
সাঁঝ আজ নির্ভীক, দুর্দমনীয়। বড়-ছোট কাউকে মানল না। রক্তচক্ষু মেলে বাবার দিকে চেয়ে হিসহিসিয়ে বলল,
– তোমার খুব কাণ্ডজ্ঞান আছে, তাই না? আমার বিয়ে ঠিক করার আগে একবারও আমাকে জিজ্ঞাসা করেছো? একবারও আমার মতামত জানতে চেয়েছো?
মেয়ের এমন আচরণে জ্ঞানশূন্য হয়ে গেলেন সাঁঝের বাবা। কোনো মেয়ে বাবার সাথে এমন উদ্ধতপূর্ণ আচরণ করতে পারে? তিনি হতবুদ্ধি হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালেন।
সাঁঝের মা দ্রুত মেয়ের কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে সামলানোর চেষ্টা করে বললেন,
– চুপ কর। এভাবে কেউ বাবার সাথে কথা বলে? গলা টিপে দিব একদম অসভ্য মেয়ে।
ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিল সাঁঝ। এই মুহূর্তে সে মাকেও ভয় পাচ্ছে না। ভয়ডর চিত্ত হতে বিদায় নিয়েছে। এ যেনো তার জীবন-মরণের লড়াই।
– কীভাবে কথা বলব তোমাদের সাথে? জ্বি-হুজুরি করতে হবে এখন? যা বলবে তাই ঘাড় কাত করে মেনে নিতে হবে?
– বড্ড বেশি বকছিস সাঁঝ। বিয়ে করতে না চাইলে করবি না। সেটা ভদ্রভাবে বলা যায়। এগুলো কী ধরনের আচরণ! বড্ড বাড়াবাড়ি করছিস এবার।
সাওদা বেগম পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন পুত্রবধূর মনের ভেতরকার কূটিল হাসি। এতক্ষণ সে একাই এই বিয়ের বিরুদ্ধে ছিল। এখন মেয়েকে পাশে পেয়ে সে নিশ্চয়ই মনে মনে আনন্দ বোধ করছে।
পুত্রবধূর কাছে নতি স্বীকার করতে তিনি নারাজ। ক্ষণিকের মধ্যে এ যেনো নিজের মানসম্মান রক্ষার লড়াই হয়ে উঠল।
তিনি দু কদম এগিয়ে ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,
– বিয়ে করবে না মানে? আলবাত করবে। সানানের সাথেই তোমার মাইয়ার বিয়ে হবে। দেখি কে আটকায়?
সাঁঝের মা সমান তেজ নিয়ে শাশুড়ির দিকে ফিরে চেয়ে শান্তকণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,
– এখন কী জোর করে সাঁঝের বিয়ে দিবেন? ও তো বলছে সানানকে ওর পছন্দ নয়।
– কেন পছন্দ না? কীসের এত দেমাগ তোমাদের মা-মেয়ের? তোমার মাইয়ার সাত পুরুষের ভাগ্য যে সানানের জন্য ওরে চাইছে৷ একটা হাঁক দিলেই আমার নাতির জন্য মাইয়ার লাইন দাঁড়ায় যাইব।
– আপনারা বরং হাঁক দিয়ে মেয়ের লাইন দাঁড় করান। সেখান থেকে মেয়ে পছন্দ করে আদরের নাতির বিয়ে দেন। শুধু আমার মেয়েকে রক্ষা দিন।
ছোট্ট একটি পরিবার দু দলে বিভক্ত হয়ে গেল। কেউ নীরবে যুদ্ধ করছে, আবার কেউ কামানের মতো গর্জে উঠছে৷ সারাটা দিন সাওদা বেগম ও স্বর্ণলতার গজগজ চলতে থাকল। বারান্দায় থম মেরে বসে আছেন সাদিক। নিজের ঘরে উচ্চস্বরে কাঁদছে সাঁঝ। সবার নাওয়া খাওয়া প্রায় বন্ধ।
সাভিন-সাবিল কোনোরকমে দু মুঠো ভাত মুখে দিয়ে ঘরে ঢুকে গেছে। আড়ালে থাকার যথাসাধ্য চেষ্টা চলছে। পারলে নিজেদের ছায়াটাও গায়েব করে ফেলে। বলা যায় না, কে কখন তাদের উপর রাগ ঝেড়ে দেয়।
বোনের কক্ষে প্রবেশের বৃথা চেষ্টা করছিল কয়েকবার। সেও আজ বারুদ হয়ে আছে। চোখের সামনে পড়লেই বাঘিনীর মতো তেড়ে আসছে মারতে। কিছুক্ষণ আগে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে দুটোকেই ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। ধারের কাছে কাউকে ঘেঁষতে দিচ্ছে না।
*
পুরো শারাফাত বংশে শোকের ছায়া নেমেছে। সাওদা বেগমের সুবাদে কালো মেঘের ছায়া ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। প্রথমেই তিনি কল করেছেন দুই মেয়েকে। একমাত্র এই মেয়ে দুটোই উনার কষ্ট বুঝে। কিন্তু আজ তারাও বৈরি আচরণ করছে। মায়ের মুখে সব শুনে মিনমিন করে বলেছে,
– সানানের সাথে কি সাঁঝের যায়? তোমরা কীভাবে ওমন সোনার টুকরো ছেলের সাথে ওই মেয়ের বিয়ে দিতে চাও!
এরপর যখন শুনলেন সাঁঝের মা বিয়েতে অমত করেছেন, তাতেই দল বদলে ফেললেন। ভাইয়ের বৌ যেদিকে যাবে তার বিপরীত দিকে যাওয়া তাদের সহজাত অভ্যাস। যার আজও অন্তরায়িত হলো না।
তবে মনে মনে এখনো তারা হতাশ। বড় ভাইয়ের ছেলের সাথে সাঁঝের বিয়ের হলে দুই পরিবারের মধ্যে বন্ধন মজবুত হবে। যা তাদের জন্য ক্ষতিকর।
দ্বিতীয় ফোনকল গেলো ছোট ছেলের কাছে। যে পারতপক্ষে বাড়ির ঝামেলা থেকে দূরে থাকে। স্ত্রী সন্তান নিয়ে রাজশাহীতে থিতু হয়েছেন আজ অনেকবছর হলো। মায়ের সাথে যোগাযোগ ফোনকলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সবশুনে সাজিদ বললেন,
– বিয়ে-শাদির আমি কিছু বুঝি না আম্মা। তোমরা যার সাথে বিয়ে দিয়েছো, চোখ বুঝে তার সাথে সংসার করছি। জীবন মন্দ কাটছে না। সাঁঝের সঙ্গে যদি সানানকে তোমাদের মানানসই মনে হয় তবে বিয়ের আয়োজন করো। আমরা গিয়ে নবদম্পতিকে দোয়া দিয়ে আসব৷
সবদিক সামলে বাজপাখির মতো তীক্ষ্ণ নজরে অপেক্ষা করতে লাগলেন সাওদা বেগম। কিন্তু তাঁর আড়ালে সর্বনাশ ঘটে গেল।
সারাদিন মেয়ের কান্নাকাটি, আহাজারি শুনে পিতৃহৃদয় বিগলিত হয়ে অবশেষে নতি স্বীকার করেছে। রাতে সবার অলক্ষ্যে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলেন সাঁঝের বাবা৷
যথারীতি চায়ের দোকানে আড্ডায় ব্যস্ত ছিল সানান ভাই। বড় বাবাকে আসতে দেখে বন্ধুদের রেখে এগিয়ে এলো। বন্ধুরা সবাই বিনাবাক্যে বেঞ্চ ছেড়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়েছে৷ চায়ের দোকানের কাঠের ছোট বেঞ্চটায় গুটিশুটি হয়ে বসলেন সাঁঝের বাবা। চায়ের কাপ হাতে মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ বসে থেকে অবশেষে শুকনো মুখে বললেন,
– তোর মেজ মায়ের সাথে কথা বললাম। সে রাজি হলো না। তবুও ভেবেছিলাম কোনোভাবে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করিয়ে নিব কিন্তু..
– কিন্তু কি?
– সাঁঝ মানছে না।
সানান ভাই অবাক চোখে চাইল। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, তার পরিকল্পনার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে একরত্তি একটা মেয়ে।
সানান ভাইয়ের থমকানো চোখের দিকে চেয়ে আরও গুটিয়ে গেলেন সাঁঝের বাবা। অপরাধীর মতোন বললেন,
– যার বিয়ে তারই মত নেই। এখানে আমাদের কি করার আছে বল? তবুও সবাই মিলে মানানোর কম চেষ্টা করিনি। মেয়েটা কিছুতেই মানল না। নাওয়া খাওয়া পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে বসে আছে। এখন শুধু মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কান্না করা বাকি। মেয়ে বড় হয়েছে। তার উপর জোর জবরদস্তি খাটে না। আমি ইস্তফা দিলাম। এখন দেখি ওর মা কি করে।
সানান ভাই কোনো উত্তর দিল না। মূর্তির মতো কঠিন মুখ করে সামনের দিকে চেয়ে আছে। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুরাও পরিস্থিতি আন্দাজ করে নিয়েছে। সবার মুখ অন্ধকার। কেউ কোনো কথা বলছে না। সাঁঝের বাবা উঠে দাঁড়ালেন। চা ভর্তি কাপটা বেঞ্চের উপর রেখে সানান ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
– তুই চিন্তা করিস না। তোর জন্য আমি ভালো দেখে একটা মেয়ে খুঁজে আনবো।
ক্লান্ত পায়ে তিনি চললেন বাড়ির পথে। এই মুহূর্ত থেকে আর মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে তিনি ভাববেন না। মেয়ের মা যা ভালো মনে করবে তাই হবে। তিনি ফিরেও তাকাবেন না সেদিকে।
চলবে..
#অক্ষরময়ী