#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব: ৩৫
চেতনা বোধ জাগ্রত হচ্ছে। কিন্তু সারা শরীরে অবশভাব বিরাজমান। হাত-পা এমনি ভারি হয়ে আছে যে নড়াচড়া করা যাচ্ছে না। চোখের পাতায় অবসন্নতা। আধো নিমজ্জিত দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে ভাবনায় তলিয়ে যাচ্ছেন বড় মা। কতক্ষণ ঘুমিয়েছেন তিনি?
একপাশে কাত হয়ে দেয়াল ঘড়িতে দেখলেন রাত দশটা বাজে। ঘরে একটি ছায়ামূর্তি হাঁটাচলা করছে। বারংবার পলক ফেলার পর ব্যক্তিটি চিনতে পারলেন। ব্যক্তিটি সাবির শারাফাত। মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছেন। পিঠের উপর হালকা হাত বুলিয়ে ঘরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে হাঁটছেন। কিন্তু সায়রাকে ঘুম পাড়াতে এত পরিশ্রম কেন? বিছানায় শুইয়ে দিলে এমনিতেই ঘুমিয়ে যেত।
তিনি যখন এতোকিছু ভাবছিলেন তখনি পাশের ঘর থেকে বিকট শব্দ ভেসে এলো। সায়রা কেঁপে উঠে বাবার বুকে আরেকটু সেধিয়ে গেল৷ বড় বাবা ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
এতোক্ষণে পূর্ণ চেতনা ফিরলো বড় মায়ের। ঔষধের প্রভাবে তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলেন। তন্দ্রাভাব কাটতেই ধড়ফড় করে উঠে বসলেন। ভয়ার্ত কণ্ঠে বললেন,
– ও কি আবার ভাংচুর করছে?
চমকে উঠলেন বড় বাবা। স্ত্রীর কাছে সরে এসে বললেন,
– মেজাজ খারাপ থাকলে ভাংচুর করে। এসব নতুন নয়। একি! তুমি কোথায় চললে?
– দেখে আসি ছেলেটার কি হলো।
– এখন যেও না ওর কাছে। আফসানা শোনো।
বড় মা শুনলেন না। শাড়ির আঁচল কাঁধে তুলে ছুটলেন ছেলের ঘরে৷ সানান বুঝদার ছেলে। কঠিন থেকে কঠিনতম পরিস্থিতি চতুরতার সাথে সামলায়। কিন্তু সবার একটা সহ্যসীমা থাকে। শান্ত নদীতেও একসময় ঝড় উঠে৷ তেমনি অনেক অনেক দিন পর একদিন সানান ভাইয়ের সহ্যের সীমা পার করে কিছু ঘটনা ঘটে। প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয় তার। নাহ, কোনোপ্রকার হাঙ্গামা সে করে না। শান্তভাবে নিজের ঘরে প্রবেশ করে ভাংচুর করে। তারপর ধ্বংসস্তুপের মধ্যে একলা বসে রয় সারারাত। পরেরদিন সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। ভোরের সাথে নতুনত্বের সূচনা হয়।
বন্ধ দরজা খুলে ঘুটঘুটে অন্ধকারের সাক্ষী হলেন বড় মা। ঘরে প্রবেশ করতেই পায়ের কাছে কিছু একটার সাথে সামান্য হোঁচট খেলেন। দেয়াল হাতড়ে সুইচবোর্ড খুঁজে বাতি জ্বালিয়ে দেখলেন, ঘরের অবস্থা বর্ণনাতীত খারাপ।
সানান ভাইয়ের সাধের মনিটর একপাশে ভেঙে পড়ে আছে। মেঝেতে মনিটর স্ক্রীনের কাচ ছড়িয়ে পড়েছে। মাউস, কীবোর্ড, পেনড্রাইভ, পেনসিল, কলম, খাতা, পানির বোতল থেকে শুরু করে আরও কতকিছু যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে!
বিস্ফারিত চোখে ধ্বংসযজ্ঞের পরবর্তী পরিণাম দেখে শুকনো ঢোক গিললেন তিনি। বিছানার শেষপ্রান্তের বোর্ডে হেলান দিয়ে মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে আছে সানান ভাই। হাঁটুর উপর দু হাত অযত্নে রাখা। মাথাটা নিচু করে রেখেছে বলে মুখ দেখা যাচ্ছে না।
বড় মা সাবধানে ডাক দিলেন,
– সানান?
সানান ভাই উত্তর দিল না। ওভাবেই মূর্তির মতো নিশ্চল বসে রইল। নিচু কণ্ঠে নাম ধরে আরও কয়েকবার ডেকে সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে গেলেন তিনি। ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে আলতো হাতে কাঁধ ছুয়ে বললেন,
– কী হয়েছে তোর?
– কিছু না।
সানান ভাইয়ের ভারি কণ্ঠ শুনে চমকে উঠলেন তিনি। ধপ করে বসে পড়লেন বিছানায়। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,
– তুই কাঁদছিস?
সানান ভাইয়ের শরীরটা সামান্য কেঁপে উঠল। তা দেখে কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিলেন তিনি৷ অসাড় দেহের ভার বিছানার উপর ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন। শেষবার ছেলেকে কাঁদতে দেখেছিলেন চট্টগ্রামে। তারপর আর কখনো সে কাঁদেনি৷ মন খারাপ করে কিংবা আবদার নিয়ে কারো কাছে ছুটে যায়নি। নিজের সমস্যাগুলো নিজেই সমাধান করেছে। কখনো হতাশ হলে ঘরের ভাংচুর করে আবার নতুন উদ্যোমে এগিয়ে গিয়েছে। কিন্তু কখনো কাঁদেনি।
পায়ের উপর হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠলেন বড় মা। সানান ভাই তার একহাতের তালুতে বড় মায়ের পায়ের তালু ছুঁলো। অন্য হাতে কনুইয়ের উপরের অংশ জড়িয়ে ধরে মাথা ঠেকালো মায়ের পায়ে৷ শাড়ির ভাজে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। এমন দৃশ্য দেখে বড় মা আকুল হলেন। দু হাতে সরাতে চাইলেন ছেলেকে। কিন্তু সানান ভাই সরলেন না৷
বড় অস্থির হয়ে তিনি জানতে চাইলেন,
– তুই কাঁদছিস কেনো? কি হয়েছে? বল আমাকে। মাকে বল। এই সানান?
অনেকক্ষণ ধরে মন ভরে কাঁদল সানান ভাই৷ তারপর একসময় ফিসফিসিয়ে বলল,
– ওরা না করে দিয়েছে, মা। কেনো না করে দিল? আমার যে সাঁঝবাতিকেই চাই।
এই বিয়েতে বড় মায়ের মত ছিল না কখনোই। কিন্তু ও বাড়ি থেকে প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়া হয়েছে শুনে তিনি যারপরনাই অবাক হলেন৷ এত দুঃসাহস ওদের! উনার ছেলেকে না করে দেয়।
ততক্ষণে কান্না থেমেছে সানান ভাইয়ের। মায়ের পায়ে হেলান দিয়ে মুখ তুলে চাইল মায়ের সুকান্তি মুখ পাণে। উন্মুখ হয়ে জানতে চাইল,
– আমি কি খুব খারাপ ছেলে? এতদিনের চেষ্টায় একটুও ভালো ছেলে হতে পারিনি, মা?
সানান ভাইয়ের চেহারা সরল, দীপ্তিময়। সবসময় প্রশান্তিদায়ক ঔজ্জ্বল্যতা বিরাজ করে। ছেলের মুখের দিকে তাকালে বড় মায়ের মন ভালো হয়ে যেত৷ উনার যৌবনকালের মায়াময় মুখখানা খুঁজে পান ছেলের মুখে। সেই সুশ্রী মুখটা একমুহূর্তে ঢেকে আছে ধূসর মেঘে। তীব্র ব্যথায় আচ্ছাদিত চোখ জোড়া করুণ, বিষাদমাখা।
তিনি বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলেন না। দু হাতে ছেলের সিক্ত কপোল মুছে দিয়ে চোখ মুখ শক্ত করে বললেন,
– ওদের কি যোগ্যতা আছে আমার ছেলেকে না করার?
তারপর দ্রুত পায়ে ছেলের ঘর থেকে চলে গেলেন৷ সায়রাকে নিজের পাশে শুইয়ে দিয়ে বিছানার একপাশে ঘুমিয়ে ছিলেন বড় বাবা। বড় মা গিয়ে উনার বাহু ঝাকিয়ে ঘুম ভাঙালেন। বেচারা সবেমাত্র ঘুমিয়েছিল। এমন আক্রমণে চমকে উঠে চোখ মেলে তাকালেন। কিছু বুঝে উঠার আগে বড় মা চাপা কণ্ঠে ধমকে উঠলেন,
– তোমার পরিবারের এত দুঃসাহস আমার ছেলেকে অপমান করে! কী ভেবেছে ওরা নিজেকে? অকৃতজ্ঞ, লোভীর দল। আমার সাথে অন্যায় করেছে, আমি কিছু বলিনি। কিন্তু আমার ছেলেকে আঘাত করার চেষ্টা করলে আমি চুপ থাকব না। সবকটাকে দেখে নিব৷
হতাশায় আকণ্ঠ ডুবে গিয়ে দু চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বড় বাবা। একটি মাত্র ভুল সারাজীবনের শান্তি কেড়ে নিয়েছে। এই বয়সে এসে লড়াই করার মানসিকতা ক্ষীণ হয়েছে। কচুরিপানার মতো ভেসে চলেছেন শুধু। লম্বা হাই তুলে খুব স্বাভাবিকভাবে বললেন,
– ঠিক আছে। সেসব কাল দেখা যাবে৷ এখন আমাকে ঘুমাতে দেও।
*
আকাশে গোল চাঁদ ছিল। ডান দিকে একটুখানি ক্ষয়ে গেছে মাত্র। ঝলমলে সোনালি আলো ছিল তার। কোথা থেকে হুড়মুড় করে এলো মেঘের দল। ঢেকে দিল চাঁদটাকে৷ অন্ধকার নেমে এলো চোখের পাতায়। মুখে ‘চ’ বর্গীয় ধ্বনি নিঃসৃত করে বিরক্তি প্রকাশ করল সানান ভাই৷
চায়ের দোকান প্রায় ফাঁকা। বন্ধুরা একে একে বাড়ি ফিরেছে। দোকানের সামনের বেঞ্চে শুয়ে আছে সে৷ ঊর্ধ্বমুখে চেয়ে আকাশ দেখছে। পল্লব দোকান গুছিয়ে নিয়ে বলল,
– ভাই, বাড়ি যাইবেন না?
– যাব। তুই দোকান বন্ধ করে চলে যা।
পল্লব দোকান গুটিয়ে চলে গেল। সানান ভাই আরও অনেকটা সময় অন্ধকার আকাশের দিকে চেয়ে রইল। কিন্তু চাঁদের দেখা মিলল না। উলটো মেঘ গুড়গুড় করতে শুরু করেছে। সানান ভাই উঠে বসল। অপরপাশের বেঞ্চে আজমকে বসে থাকতে দেখে অবাক হলো ভীষণ।
– তুই এখানো বাড়ি যাসনি?
– তোকে একা রেখে চলে যাব!
– তাহলে ভূতের মতো চুপচাপ বসে আছিস কেনো শালা?
– তোকে নির্বিঘ্নে চিন্তাভাবনা করার সুযোগ দিলাম। এতো তাড়াতাড়ি উঠে গেলি কেনো? আমি ভাবলাম, সারারাত এখানেই শুয়ে থাকবি।
– বৃষ্টিতে ভিজে অসুস্থ হওয়ার ইচ্ছা নাই। আমি শয্যাশায়ী হলে লড়বে কে?
– এখন কি করবি?
– মায়ের আঁচল ধরে ঘুরব। একমাত্র সেই পারবে আমাকে সাহায্য করতে।
– পুরো পরিবার তোর বিরুদ্ধে। মেয়ের যদি অন্তত রাজি থাকত। তবুও একটা আশা ছিল। কিন্তু সাঁঝ তোকে চাইছে না। যদি চাইত, তবে সবার সামনে দাঁড়িয়ে বুক ফুলিয়ে বলতে পারতি। সাঁঝ শুধু আমার।
আজমের বলার ভঙিমায় সানান ভাই হাসল। বড্ড বিষণ্ণ দেখাল সে হাসি। উদাস চোখে অন্ধকারে চেয়ে বলল,
– সে আমার নয়, কিন্তু সে পুরোটাই আমার।
– জোর করে বিয়ে করবি?
– দরকার হলে তাই করবো। কারণ আমি জানি ওকে আমি সুখে রাখতে পারব। জানিসই তো আমাদের বংশের মানুষগুলো ঘাড়ত্যাড়া। যার যেটা মন চায় সেটাই করে। উচিত অনুচিত বিচার করে না।
– ওর যদি অন্য পছন্দ থাকে? যদি অন্য কাউকে ভালোবাসে?
– সাঁঝবাতি কাউকে ভালোবাসে না। ওর মন এখনো জলের মতো স্বচ্ছ। সাদা ক্যানভাসের মতো শূন্য, উন্মুক্ত। সেখানে রঙ ছড়াবো একমাত্র আমি।
– এতোটা নিশ্চিত হচ্ছিস কি করে?
– সাঁঝবাতিকে আমার থেকে বেশি কেউ চিনে না। আমি ওকে ধরে রাখিনি ঠিকই। উড়তে দিয়েছি। সব ধরনের স্বাধীনতা দিয়েছি। কিন্তু কাউকে ভালোবাসার অনুমতি দেইনি।
– তোকেও ভালোবাসার সুযোগ দিসনি।
– হা হা। আমাকে ভালোবাসতে দিলে ওর জীবনটা নরক হয়ে যেত। হারিয়ে ফেলত নিজেকে।
– তাই বলে সারাক্ষণ ধমকের উপর রাখবি? মেয়েটা ভয় পায় তোকে।
– সাধে কি ধমকাই? ও আমাকে দেখলেই দূরে পালিয়ে যায় কেনো? আমি কি বাঘ ভাল্লুক? কি করেছি আমি যে এমন ভয় পায়? একসময় আমাদের মধ্যে কতো ভালো বন্ধুত্ব ছিল জানিস? নিজের জন্মস্থান, নিজের কৈশোর, বন্ধুবান্ধব, পরিচিত মুখ- সব ছেড়ে ঢাকায় চলে আসার কোনো ইচ্ছে ছিল না আমার। ওরা জোর করে নিয়ে এসেছিল। এখানে এসে শ্যাওলা পড়া বাড়িটা দেখে আমি আরও ভেঙে পড়েছিলাম। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, পালিয়ে যাব চট্টগ্রামে। ওখানে আমার বন্ধুরা আছে। ওরা আমাকে দূরে সরিয়ে দিবে না।
তারপর সাঁঝবাতিকে দেখলাম। ভীষণ আদুরে একটা বাচ্চা। ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব হলো। আমার প্রতিটি কাজে ও মুগ্ধ হতো। সানান ভাই বলতে পাগল ছিল। আমার অন্ধ ভক্ত যেনো। লোকের কাছে গর্ব সহকারে বলত, ওর সানান ভাই কী সুন্দর দেখতে! যেনো রাজপুত্তুর। ভীষণ মেধাবী, বুদ্ধিমান ছেলে। পরীক্ষায় কত ভালো রেজাল্ট করে! ফুটবল খেলে আবার ক্রিকেট মাঠে লম্বা ছক্কা পিটায়। সাঁতার কেটে পাড়ি দিতে পারে আস্ত একটা নদী। মোটকথা ওর সানান ভাই অলরাউন্ডার। আমাকে আগমনে সাঁঝবাতি এতো খুশি ছিল যেন রূপকথার রাজকুমার পেয়ে গেছে৷
শুধু ওর জন্য আমি থেকে গেলাম এই বিশ্রী শহরে। পড়াশোনায় আরও মনোযোগী হলাম। পরীক্ষায় ফাস্ট হতে হবে। তাহলে সাঁঝবাতি আরও খুশি হবে। খেলাধুলায় নিজের সর্বোচ্চটা দিতাম। আমি জিতলে সাঁঝবাতি এসে গলায় ঝুলে পড়বে।
এদিকে আমার গলায় মেডেল উঠত, হাসি ফুটত ওর মুখে। আমি হাতে ট্রফি নিতাম, দর্শক সারিতে লাফিয়ে লাফিয়ে হাত তালি দিতো ও৷
আমার সফলতায় একজনের মুখে হাসি ফুটে। আমাকে নিয়ে একজন গর্ববোধ করে। এটা আমাকে কী পরিমাণ অনুপ্রেরণা দিত! প্রশান্তি দিত! আমি আরও এগিয়ে যেতাম। তারপর একদিন সব হারিয়ে গেলো। খেলার মাঠে কেউ আমাকে উৎসাহ দিতে এলো না। উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করল না আমার সফলতার। রেজাল্টের দিন কেউ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকত না এনাউন্সমেন্টের অপেক্ষায়। ধীরে ধীরে আমার জেতার আগ্রহটাই হারিয়ে গেল। ছেড়ে দিলাম সবকিছু।
বন্ধুর মনের বিষণ্ণতা গ্রাস করেছে আজমের মন। একমনে তার কথা শুনছিল এতোক্ষণ। সানান ভাই থামতেই অপলক চেয়ে বলল,
– কেন এমন করল?
– আমি কীভাবে জানব? যা ওকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর।
– তুই জানতে চাসনি?
– সেই সুযোগ দিয়েছে আমাকে? সবসময় পালিয়ে বেড়াত আমার থেকে। আমাদের ইউনিটে আসা বন্ধ করে দিল। ডাকলেও আসত না। কী বিশ্রী কেটেছে সেই দিনগুলো! কত দীর্ঘ, কত যন্ত্রণাদায়ক একেকটা রাত! প্রহর কাটতে চাইত না। ঘরের ভেতরে গুমরে গুমরে মরতাম। একদিন ওর হাসি মুখটা দেখতে না পেলে আমার হাসফাস লাগত। ও তখন দেখতেও ছিল একদম পুতুলের মতোন কিউট। বড় বড় চোখ, ফুলকো গাল, টিয়াপাখির মতো লালচে ঠোঁট। একটা গুলুমুলু বাচ্চা। দেখলেই গাল টেনে আদর করে দিতে মন চাইত।
সানান ভাই আপনমনে হাসল। যেনো হারিয়ে গিয়েছে সোনালি অতীতে৷ আজম মুখ গোমড়া করে বলল,
– এমন একটা বাচ্চাকে তুই ধমকাতে পারলি? একটুও বুক কাপল না?
– নাহ কাপল না। ততদিনে শোকে পাথর হয়ে গেছে আমার বুক। ধমক দিলে ও ভয় পেয়ে আমার কথা শুনত। বাধ্য হয়ে গুটিগুটি পায়ে এসে সামনে দাঁড়াত। ওই বাহানায় চোখের দেখাটা অন্তত দেখতে পেতাম। ভালোভাবে ডাকলে কথা শুনত না বলেই কঠোর হতে হয়েছে। না হলে কে চায় ভয়ে ফ্যাকাশে হওয়া চেহারাটা দেখতে?
– বুঝিয়ে বলতে পারতি।
– বুঝার মতো বোধ বুদ্ধি আছে ওর?
– এখন যথেষ্ট বড় হয়েছে। বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার আগে ওর সাথে কথা বলে নিলে ভালো হতো।
– সেই সুযোগ আর নেই। জল অনেকদূর গড়িয়েছে। ওর চোখে এখন আমি একটা রাক্ষস। ভয়াবহ নিষ্ঠুর মানুষ। আমার কথা শুনবে না।
– তবে হয়েছে তোদের বিয়ে। ত্যাড়ামি আর জেদের মামলায় সাঁঝও বংশের ধাত পেয়েছে। তোরা কেউ কারো থেকে কম যাস না।
– দরকার হলে হাত পা বেঁধে ফেলে রাখব। তবুও আমার ওকেই চাই।
– জোর করে বিয়ে করা যায়। ভালোবাসা পাওয়া যায় না। তুই কি একটা ভালোবাসা বিহীন সম্পর্ক চাইছিস? জোর করে চোখের দেখা দেখতে গিয়ে তার পরিণাম দেখলি তো? ওর মনটাই বিষিয়ে দিয়েছিস তুই। এবার নিজের করে পেতে গিয়ে যদি পুরোটা হারিয়ে ফেলিস? ওর বয়স কম। এই বয়সে আবেগ কাজ করে বেশি। জোরজবরদস্তি করিস না মামা। হীতে বিপরীত হতে সময় লাগবে না। তার উপর তোদের পরিবারও তোর বিরুদ্ধে। তুই একা কয়জনের বিরুদ্ধে লড়াই করবি?
একা শব্দটা ভীষণ ভাবে নাড়া দিল সানান ভাইকে। এত বড় একটা পরিবার! তবুও দিনশেষে সে একা। মন বুঝার মতো কেউ নেই পাশে৷ অভিশপ্ত জীবনের বোঝা বইতে বইতে মাঝেমধ্যে ক্লান্ত লাগে। তখন মনে পড়ে সাঁঝবাতিকে৷ কী এমন হতো যদি মেয়েটা ওর পাশে থাকত?
আজমের প্রশ্নের উত্তর দিল না সানান ভাই। কিছুক্ষণ ম্লান চোখে চেয়ে থেকে সেখান থেকে চলে গেল।
*
সকালবেলা এক কাপ পানসে চা দেওয়া হয়েছে সাওদা বেগমকে। তিনি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করে ফেললেন।
– এটা চা হয়েছে? ঠিকঠাক এক কাপ চা-ও বানাতে শিখল না এতদিনে। নাস্তায় কি বানাইছে?
সাভিন মুখ গোমড়া করে উত্তর দিল,
– বিস্কুট।
– সেইডা দোকানে পাওয়া যায়। তোর মায়ে কি বানাইছে?
– কিছু না। মায়ের মুড অফ। চা বিস্কুট খেয়ে স্কুলে যেতে বলেছে।
– মুড অফ আবার কি?
– ও তুমি বুঝবে না। চা বিস্কুট খাও৷ আমি স্কুলে গেলাম।
সকাল শুরু হলো সাওদা বেগমের আহাজারির মাধ্যমে৷ এমন ননাবের ঘর থেকে বউ এনেছেন, বাচ্চাদের ঠিকঠাক খাবারটাও বানিয়ে দেয় না৷ চা বিস্কুট খেয়ে সারাদিনটা স্কুলে কি করে থাকবে উনার নাতি দুটো? এমন নিষ্ঠুর মা তিনি দ্বিতীয়টি দেখেননি।
টিউশন শেষ করে কোনোরকমে বাড়ির বাইরে পালানোর পায়তারা করছিলেন সাঁঝের বাবা৷ চুলার উপর রাখা পাতিল থেকে চা ঢেলে নিয়ে সোফায় বসলেন।
বিস্কুটের প্লেট এনে উনার সামনে রাখলেন সাঁঝের মা৷ স্বামীর বিকৃত মুখ দেখে তিনি বুঝে গেলেন, গরম চা মুখে দিয়ে ছ্যাঁকা খেয়েছেন। নীরবে চোখ রাঙিয়ে চলে যাচ্ছিলেন তখনি কলিংবেল বাজল৷
যেখানে জরুরি আলোচনা চলছে সেখানে বিনা আমন্ত্রণে বাগড়া দেওয়া বয়োজ্যেষ্ঠর স্বভাব। নিজের ঘরে আরাম করে নাস্তা খাওয়া বাদ দিয়ে ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হয়েছেন সাওদা বেগম। এই মুখরা মহিলার সামনে সাঁঝের মায়ের যুক্তি হাওয়ার মতো মিলিয়ে যাবে সেটাই স্বাভাবিক। যারপরনাই বিরক্তবোধ নিয়ে একপাশে বিরসমুখে বসে সুযোগের অপেক্ষায় আছেন।
বড় ভাইয়ের হাতে পানের ঢালা ও মিষ্টান্ন দেখে প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেছেন সাঁঝের বাবা। যে বাড়িতে প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে আছে, সে বাড়িতে মিষ্টি, পান সমেত অতিথির আগমনের মানে তিনি জানেন। ভয় হচ্ছে স্ত্রীকে নিয়ে।
অন্যদিকে সাওদা বেগম ভীষণ খুশি। উনার বড় ছেলের বউটা ভীষণ বুদ্ধিমতি। দফায় দফায় আলোচনা করে সময় নষ্ট না করে একেবারে বিয়ের পাকা কথা বলতে চলে এসেছে।
অদ্ভুত নীরবতা ঘর জুড়ে। হাঁসফাঁশ করে উঠে সাঁঝের বাবা বললেন,
– কী ব্যাপার স্বর্ণলতা? বসে রইলে যে! চা নাস্তার ব্যবস্থা করো।
অগ্নি নির্ঝরিত দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে সাঁঝের মা গেলেন রান্নাঘরে। সুযোগ পেয়ে সাওদা বেগম বিগলিত হেসে বললেন,
– ভালোই হইছে তোমরা নিজে আসছ। সামনাসামনি বসার দরকার ছিল। বিয়েশাদির কথাবার্তা ওমন দূরে দূরে থেকে হয় নাকি!
দুই ভাই আমসত্ত্ব মুখ নিয়ে বসে আছে দেখে বড় মা নিজেই আলোচনায় অংশ নিলেন। মুখখানা যথারীতি বরফ ন্যায় কঠিন। দীপ্ত কণ্ঠে বললেন,
– আমরা আজকেই দিন তারিখ ঠিক করতে চাইছি। শুনেছি, সাঁঝের ভর্তির আগেই বিয়ে দিতে চাইছ তোমরা।
সাওদা বেগমকে এড়িয়ে প্রশ্ন করা হলো সাঁঝের বাবাকে। সামান্য অপমানিত বোধ করলেন চুপ করে রইলেন সাওদা বেগম। সাঁঝের বাবা অপ্রস্তুতভাবে হেসে বললেন,
– স্বর্ণলতার তেমনি ইচ্ছে। কিন্তু সানানের সাথে বিয়ের ব্যাপারে… আসলে… কীভাবে যে বলি…
স্বামীকে বিপত্তি থেকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এলেন সাঁঝের মা। টেবিলে চায়ের কাপগুলো রেখে রুক্ষ স্বরে বললেন,
– সানানের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে চাইছি না আমরা।
– কেনো?
বড় মায়ের আত্মবিশ্বাসী শান্ত স্বরে সবাই নড়েচড়ে বসল। দুজন নারী একে অপরের বিপক্ষে দাঁড়ালে ফলাফল কখনো সুখকর হয় না। তাই সবাইকে সতর্ক থাকতে হলো।
বড় মা চতুর, কূটিল এবং শান্ত মস্তিষ্কের মানুষ। বিপরীতে সাঁঝের মা জানে শুধু হম্বিতম্বি করতে। একটুতেই ঘাবড়ে যাওয়ার যার স্বভাব সে এমন মুহূর্তে স্বাভাবিকভাবে ঘাবড়ে গেলেন। ঘাড় ফিরিয়ে স্বামীর দিক তাকালেন সাহায্যের জন্য। কিন্তু সে মেনিমুখো পুরুষ মানুষ চুপ করে আছে। একলা লড়তে হবে বুঝতে পেরে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
– বিয়েতে সাঁঝের মত নেই। মেয়েকে তো জোর করে যারতার হাতে তুলে দিতে পারি না।
সাঁঝের অমতের ব্যাপারে জানতেন না বড় মা। কিছুপলের জন্য থমকে গেলেও হার মানলেন না।
– এত তাড়াতাড়ি বিয়ের ব্যাপারেও সাঁঝের মত নেই। তবুও ওর মতের বিরুদ্ধে তোমরা বিয়ের আয়োজন করতে পারলে, মতের বিরুদ্ধে পাত্রটাও নির্বাচন করতে পারবে।
– আমারও মত নেই।
– কারণ? আমার ছেলে কোন দিক থেকে অযোগ্য? একটা কারণ দেখাও। কি হলো? চুপ করে আছো কেনো?
উত্তর খুঁজে না পেয়ে রাগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগলেন সাঁঝের মা। নিজের বোকামির কারণে এভাবে ফেঁসে যাবেন কে জানত? ভেবেছিলেন দু একটা ছেলে দেখবেন, আর রিজেক্ট করে দিবেন। একসময় সাঁঝের বাবা ক্লান্ত হয়ে গেলে তখনি জানাবেন তাশফীনের কথাটা। তখন বিশেষ অমত করার কারণ থাকবে না কারো কাছে। কিন্তু এর মধ্যে সানান বড়শি ফেলবে কে জানত।
এখন চাইলেও তাশফীনের নাম নিতে পারছেন না। সবাই তেড়ে আসবে উনার দিকে। জানতে চাইবে, যদি মনে মনে ছেলে ঠিক করাই ছিল তবে এতদিন নাটক করল কেনো? তখন কি জবাব দিবেন তিনি?
কোণঠাসা স্বর্ণলতার পাগল পাগল লাগছে।
সবাই উত্তরের অপেক্ষায় অথচ উত্তরদাতা নীরব। বাধ্য হয়ে সাঁঝের বাবা বললেন,
– ভাবি চা নিন। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
– আমরা চা খেতে আসিনি সাদিক। আমার ছেলে নিজে থেকে একটা প্রস্তাব রেখেছে তোমার কাছে। তাকে কি কারণে রিজেক্ট করা হলো, সেটার উত্তর জানতে চাইছি।
– আসলে আপনাদের সাথে আমাদের যায় না। কোনোরকমে খেয়েপড়ে বেঁচে আছি। কোথায় আপনারা আর কোথায় আমরা! সানানকে মেয়ে জামাই বানানোর কথা কখনো ভাবিনি। এভাবে হঠাৎ প্রস্তাব পেয়ে একটু ঘাবড়ে গিয়েছি আরকি। তাছাড়া আপনি বুঝতেই পারছেন, আপনাদের সাথে আমাদের সম্পর্কও কিছুটা শীতল। সাঁঝের মা ভয় পাচ্ছে।
কথাগুলো মাথা নিচু করেই বললেন সাঁঝের বাবা। ইতস্ততবোধের কারণ বুঝলেন বড় মা। নিজের গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন,
– তোমার মেয়ের বিয়ে হবে সানানের সাথে। সংসার করবে ওরা দুজন। তুমি সানানকে নিয়ে ভাবো। একটা সময় ওকে নিজে হাতে মানুষ করেছো। আমার ছেলে কেমন সেটা তুমি ভালো জানবে। মেয়ের জামাই করার যোগ্য কিনা সেটা তুমিই বিবেচনা করো। আর বাকি রইল আমাদের কথা। তোমাদের সাথে আত্মীয়তা করার ইচ্ছে আমারও নেই। কিন্তু আমার ছেলে অনেকদিন পর আমার কাছে কিছু চেয়েছে। মা হিসেবে সেটা তাকে এনে দেওয়া আমার কর্তব্য। আমি আমার কর্তব্য পালন করছি।
উপস্থিত সকলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন বড় মায়ের দিকে। বড় বাবা পারলে এখান থেকে একছুটে বেরিয়ে যেতেন। এমন অহমিকা সাঁঝের মায়ের আর সহ্য হলো না। বললেন,
– আপনার ছেলে চাইলেই তার সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। সাঁঝের সাথে সানানের বিয়ে দিব না। দরকার হলে মেয়েকে বাড়িতে বসিয়ে রাখব। এই আমার শেষ কথা। আপনার কর্তব্য পালনে সায় দিতে আমরা বাধ্য নই।
বড় মায়ের ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি দেখা গেল। তিনি কিছুক্ষণ সাঁঝের মায়ের গনগনে মুখপানে চেয়ে থেকে মুখ ফিরিয়ে সাঁঝের বাবাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
– তোমারও কি একই মতামত?
তিনি অপ্রসন্ন মুখে বললেন,
– মেয়েটা রাজি থাকলে তবুও…
– শোনো, সাদিক। আমার ছেলে আমার কাছে কিছু চেয়েছে আর আমি দেইনি, তা কখনো হয়নি। আজও তার ব্যতিক্রম হবে না। এতে যদি আমাকে আরও কঠোর হতে হয়। তবে তাই হবো।
সাঁঝের মা ক্ষেপা ষাঁড়ের মতো বলে উঠলেন,
– এখন কি জোর করে আমার মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দিবেন?
– নাহ। শুধু তোমাদের মনে করিয়ে দেই, এই যে আজ আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছো। বড় বড় কথা বলছ। স্থানী একটা ছাদের নিচে শান্তিতে ঘুমাচ্ছ। সেটা কিন্তু আমার বদৌলতে। একটা সময় ছিল যখন পথে নামতে বসেছিলে সকলে। তখন আমি বাবার বাড়ি থেকে সাহায্য নিয়ে এসে তোমাদের উদ্ধার করেছি। সাদিক যে টিউশনগুলো করাচ্ছে, সেগুলো আমার হাত ধরে শুরু হয়েছে। লাইব্রেরী কেনার অর্ধেক টাকা সানানের বাবা দিয়েছে। মনে আছে নিশ্চয়ই?
পুরনো কথা তুলতে চাই না। তোমরা বাধ্য করলে। যাই হোক, যেজন্য এতো কিছু বলা। আমাদের এতো দয়ার বিপরীতে তোমাদের কাঁধে কিছুটা হলে ঋণ জমেছে। ধরে নেও, এখন ঋণ পরিশোধ করার সময় এসেছে। আমাদের সকল সাহায্যে বিনিময়ে তোমাদের মেয়েকে চাইছি। আশা করি, এইটুকু কৃতজ্ঞতা বোধ তোমাদের আছে।
আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে বড় মা কক্ষ ত্যাগ করলেন। পেছনে ছুটলেন বড় বাবা। পুরোটা সময় তিনি মূর্তির মতো বসে ছিলেন। ভাইয়ের অপমানে প্রচণ্ড রুষ্ট হয়ে স্ত্রীর সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললেন,
– এভাবে বলা জরুরি ছিল?
– হ্যাঁ ছিল। কারণ, তোমার পরিবারের লোকজনের মিষ্টি পছন্দ নয়।
*
পুরুষ মানুষের পকেটে টাকা না থাকলে তারা নির্জীব হয়ে যায়। লোকে কিছু বলার আগে নিজেই নিজেকে তুচ্ছ ভাবতে শুরু করে। সাঁঝের বাবার চাকরিটা ওভাবে চলে যাওয়ার পর থেকে তিনি প্রায় সংসার ত্যাগ করেছেন। বাড়িতে তখন রোজ কলহ বিবাদ লেগে আছে। বড় ভাই পুরো পরিবার নিয়ে হাজির হয়েছেন। ব্যাপারটা পছন্দ করেননি উনার মা। অভাবের সময়ে আরও তিনটে মানুষকে দেখে স্ত্রীও মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিল। সব মিলিয়ে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছিল বাড়িতে। এসব থেকে পরিত্রাণ পেতে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। সেই থেকে শুরু। আজ পর্যন্ত মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেননি সাদিক শারাফাত।
মেয়ের প্রতি উনার আলাদা মায়া, ভালোবাসা রয়েছে। সেই মায়ার টানে এবার স্ত্রীর বিরুদ্ধে একটুখানি সোচ্চার হয়েছিলেন। আজ আবার সানান ভাইয়ের মা যখন চোখে আঙ্গুল দিয়ে উনার দূর্বলতা দেখিয়ে দিয়ে গেলেন, এরপর তিনি আবার মুষড়ে পড়লেন।
অন্যদিকে সাওদা বেগমের অযথা হা হুতাশ বন্ধ হচ্ছে না। ছেলের পাশে বসে একনাগাড়ে বকবক করে যাচ্ছেন।
– কী দরকার ছিল অমত করার? ভালোভাবে প্রস্তাব দিল তখন তোদের ভাব বেড়ে গেল। এখন খোঁচা মেরে দুটো কথা শুনিয়ে দিল,, তাতে শান্তি হয়েছে? কলিজা ঠান্ডা হয়েছে তোদের?
– মা, চুপ করো না।
– কেন চুপ করব আমি? তোর বউয়ের এতো অহংকার কীসের? তোরেও কি আর বলব! বউয়ের কথায় নাচা পুরুষ মানুষ। আমার একটা ছেলেও জাতের না। সবকটা বউয়ের তালে তাল মিলায় নাচে।
– দেখতেছো সাঁঝের মত নেই। আমি কি এখন হাত পা বেঁধে মেয়ের বিয়ে দিব?
– দরকার হলে তাই দিবি। বাপ-মায়ের ঋণ শোধ করা সন্তানের দায়িত্ব।
*
এমন অথৈ দরিয়া সাঁঝ আগে কখনো পড়েনি। হঠাৎ এমন বিপদে পড়লে কেমন অস্থির লাগে, তা ভুক্তভুগি পাঠকমাত্র বুঝবেন। হাত পা ছুঁড়ে কান্না করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। সব এলোমেলো লাগছে। মস্তিষ্ক উত্তপ্ত। মনের কথা বলার মতোন কেউ নেই পাশে। একলা একা সাঁঝ ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। একপাশে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে নিজের দুর্ভাগ্যে চোখের জল ফেলল।
সবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি উপেক্ষা করে অনেকগুলো বছর পর আজ সাঁঝের কক্ষে প্রবেশ করল সানান ভাই। বাড়ি পৌঁছে বড় মা তাকে হালকা ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলেছেন, আমার ভাগের দায়িত্ব আমি পালন করে দিলাম। শুনলাম সাঁঝ রাজি নয়। সেটা সামলানো তোর দায়িত্ব।
গল্পের শেষ অংশ নিজ হাতে লিখতে, বাধ্য হয়ে সানান ভাইকে আসতে হয়েছে। ড্রয়িংরুমে মেজ বাবার থেকে অনুমতি নিয়ে এসেছে অবশ্য।
সাঁঝের কক্ষের চিত্র প্রায় একই রকম। জিনিসপত্র ছড়িয়ে আছে মেঝেতে। সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে বিছানার পাশে দাঁড়াল। দরজার দিকে পিঠ করে শুয়ে আছে সাঁঝ। সানান ভাই ডাকল,
– এই সাঁঝবাতি?
সাঁঝ ফিরে তাকাল না। শুধু চমকে উঠে বালিশে আরও গভীরভাবে মুখ গুঁজে বিছানায় পড়ে রইল। সানান ভাই মৃদু হেসে সাঁঝের পিঠের পাশে বসল। গলা উঁচু করে সাঁঝের মুখের দিকে ঝুকে বলল,
– এতো কান্নাকাটি শুরু করছিস কেন? কেউ মরে-টরে গেছে নাকি?
ক্রন্দনরত ব্যক্তির সাথে এভাবে কথা বলা বিরক্তিকর মানুষটিকে নাকি সাঁঝের বিয়ে করতে হবে! দুঃখে, হতাশায় ঠোঁট ভেঙে কান্না এলো সাঁঝের। বালিশ থেকে মুখ না তুলেই ফ্যাসফেসে গলায় বলল,
– আমি আপনাকে বিয়ে করব না।
– কেনো করবি না? আমি কোন দিক থেকে খারাপ? দেখতে শুনতে তোর থেকে ভালো আছি। আটা ঘষেমেজে বাইরে যাই না। তবুও রাস্তাঘাটে মেয়েরা আমার দিকে ফিরে ফিরে তাকায়।
সাঁঝের ভীষণ রাগ হলো। ফিরে তাকানো একটা মেয়েকে ধরে বিয়ে করতে পারছে না রাক্ষসটা? ওর পেছনে পড়ে আছে কেনো? মনে আসলেও মুখে বলার সাহস নেই ওর। অত্যন্ত ধীরে বালিশ থেকে মুখটা তুলে ঘোলাটে ম্রিয়মাণ চোখে তাকিয়ে শুধু জানতে চাইল,
– আপনি আমাকে বিয়ে করতে চাইছেন কেনো, সানান ভাই?
সানান ভাই ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল। প্রশ্ন শুনে দূর্বোধ্য হাসল। তারপর আরও কিছুটা ঝুঁকে সাঁঝের মুখের সামনে মুখ নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
– তোর বাম কাঁধের কালো তিলটায় চুমু খেতে চাই। বিয়ে না করলে তো চুমু খেতে দিবে না। এজন্য বিয়ে করতে চাইছি।
চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে রইল সাঁঝ। কথা শেষ করে সানান ভাই সোজা হয়ে বসা মাত্র সাঁঝের বোধশক্তি ফিরল। এতক্ষণ ওড়না ছাড়া শুয়ে ছিল সে। একপাশে কাত হয়ে শুয়ে থাকার কারণে জামার গলা একপাশে সরে গিয়ে উন্মুক্ত হয়েছে কাঁধের অনেকটা অংশ। কালো রঙের বক্ষবন্ধনীর ফিতার আড়ালে উঁকি দিচ্ছে বড় কালো তিলটা। চকিতে উঠে বসল সাঁঝ। মাথার কাছের রাখা ওড়নাটা টেনে গায়ে জড়ালো।
সাঁঝের কান্না থেমেছে দেখে অলস পায়ে উঠে দাঁড়াল সানান ভাই। মাথার এলোমেলো চুলগুলো আঙ্গুল দ্বারা গুছানোর বৃথা প্রচেষ্টা করে বলল,
– এমনিতে চুমু খেতে দিলে অবশ্য বিয়ের আলোচনা আপাতর বন্ধ রাখা যায়।
রাগে, অপমানে সাঁঝের চোখ জোড়ায় আবার জল টলমল করতে শুরু করেছে দেখে কথা বাড়াল না সানান ভাই।
কক্ষ ছেড়ে যেতে যেতে গান ধরল,
“বৃষ্টিভেজা রাতে আমি তোমায় নিয়ে যাবো।
যতগুলো কথা হয়নি বলা
তোমাকেই বলে দিব
স্বপ্নীল এই পৃথিবীকে আজ তোমার রঙে রাঙাবো
অনেকদূরের আকাশ পথে তোমায় নিয়ে হারাবো..”
চলবে…
#অক্ষরময়ী
#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব: ৩৬
আলিশান প্রাসাদের মতো বাড়িটির বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়ছেন তোহাজ শিকদার। লম্বা দেহ, চওড়া কাঁধ, শক্তপোক্ত পেশীবহুল তাঁর হাত। শৃঙ্খলিত জীবনযাত্রার কারণে দেহে বয়সের ছাপ খুব একটা পড়েনি। উজ্জ্বল চোখ দুটোয় এখনো দৃঢ়তার ছাপ স্পষ্ট। স্বামীর পাশে বসে সেসব করছিলেন মাধবীলতা। পত্রিকায় চোখ রেখেই তোহাজ শিকদার দীপ্ত কণ্ঠে বললেন,
– কিছু বলতে চাও?
শৃঙ্খলা ও অনুশাসনের মধ্যে জীবনযাপন করা এই মানুষটির আশেপাশে থাকলে এখনো বুক দুরুদুরু করে মাধবীলতার। এটা ঠিক ভয় নয়, মাত্রাতিরিক্ত সম্মানবোধ বোধহয়। প্রয়োজনের অধিক সাহস সঞ্চার করে তিনি উত্তর দিলেন,
– তাশফীনের বিয়ের ব্যাপারে তোমার সাথে কথা বলতে চাইছি।
– বলো শুনছি।
– আমি চাইছি সাঁঝের সাথে তাশফীনের বিয়ে দিতে।
– সাঁঝ! তোমার বোনের মেয়েটা না?
– হ্যাঁ।
– আই সি। তোমার ছেলেরও নিশ্চয়ই একই ইচ্ছে?
– হ্যাঁ।
তোহাজ শিকদার পত্রিকাটি বন্ধ করে স্ত্রীর দিকে শান্ত চোখে তাকালেন। ভাবলেশহীন মুখটা কঠিন হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে।
– তুমি অত্যন্ত বোকা একজন মহিলা। নেহাৎ তোমাকে ভালোবাসি, তাই আমার সাথে তোমার সংসার এতদিন ধরে টিকে আছে।
মাধবীলতার মুখখানা অপমানে রক্তিম হয়ে উঠল। উনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তোহাজ শিকদার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
– তাশফীনের জন্য মেয়ে ঠিক করা আছে। আমার এক মেজর বন্ধুর মেয়ে। ডিএমসি থেকে এমবিবিএস পাশ করে মালয়েশিয়ায় গেছে উচ্চ শিক্ষার জন্য। সে ফিরে এলেই তার সাথে তোমার ছেলের বিয়ে দেওয়া হবে। তাই ছেলের বিয়ে নিয়ে তোমার দুশ্চিন্তা করতে হবে না। মর্নিং ওয়াকে যাচ্ছি। সাবধানে থেকো।
মাধবীলতা হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন। স্বামীকে রাজি করা কঠিন হবে সেটা জানতেন। কিন্তু তিনি ছেলের বিয়ে ঠিক করে বসে আছেন, সেটা জানতেন না। তোহাজ শিকদার একবার কোনোকিছু মনস্থির করে ফেললে, উনাকে টলানো অসম্ভব।
মাধবীলতা কাঁপাকাঁপা হাতে তাশফীনের নাম্বারে কল দিলেন। এখনো বন্ধ দেখাচ্ছে। ছেলের সাথে গতকাল সকালে একবার কথা হয়েছিল। কুড়িগ্রামের অবস্থা ভালো নয়। মানুষজনের ঘরবাড়ি ভেসে গেছে। এখনো খুব একটা সাহায্য সেখানে পৌঁছায়নি। বেসরকারি দু একটা সংস্থা এগিয়ে এলেও সরকার নীরব। বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে আজ দুদিন। তাশফীনের মোবাইলে চার্জ নেই। তাই মোবাইল বন্ধ পেলে মাকে দুশ্চিন্তা করতে না করেছে।
কিন্তু এই অবস্থায় দুশ্চিন্তার পাহাড় নামল মাধবীলতার বুকে।
মোবাইল হাতে বিষিণ্ণ মুখে বারান্দায় বসে আছেন তিনি। তখনি সাঁঝের মায়ের কলটি এলো। আতংকে মাধবীলতার মুখ শুকিয়ে গেছে। বোনকে এখন কি জবাব দিবেন তিনি?
– কথা বলেছো আপা?
– হ্যাঁ। মাত্রই কথা হলো।
– কী বলল দুলাভাই?
– জানিসই ও কেমন। তবুও আমি মানানোর চেষ্টা করছি।
– তাড়াতাড়ি কিছু একটা করো আপা। কিছুক্ষণ আগে বড় ভাবি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়েছিলেন।
– সেকি! না করিস নি?
– আমার একার কথায় কি এসে যায়! প্রস্তাব পেয়ে সকলে এক কথায় রাজি হয়ে গেছে। আমার হাতে আর কিছু নেই। তোমরা এগিয়ে না এলে বিয়েটা আটকানো যাবে না আপা।
– তুই চিন্তা করিস না। আমি তোর দুলাভাইকে রাজি করিয়ে…
মোবাইলটি হাত থেকে টান দিয়ে নিলেন তোহাজ শিকদার। তিনি কখন বাইরে থেকে ফিরে এসেছেন মাধবীলতা টের পাননি। ভয়ে উনার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তোহাজ শিকদার ভীষণ নির্দয় ব্যক্তি। কিছু বলার আগে সামনের মানুষটির কথা একবারও ভাবেন না।
তোহাজ শিকদার অবশ্য খুব শান্তভাবে মোবাইলটি কানে ধরে বললেন,
– তোহাজ শিকদার বলছি।
– আসসালামু আলাইকুম দুলাভাই।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। তোমার আপার সাথে তোমার কি নিয়ে কথা হচ্ছে তা আমি আন্দাজ করতে পারছি, স্বর্ণলতা। সে হয়তো তোমাকে এখনো আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে। তবে আমি স্পষ্টভাবে কথা বলতে পছন্দ করি।
তোমার মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে সম্ভব নয়। আমার ছেলের জন্য আমি মেয়ে পছন্দ করে রেখেছি।
রইলো সাঁঝের কথা। তোমাদের স্ট্যাটাসের সাথে আমাদের স্ট্যাটাস মিলে না। সাঁঝকে যদি ছেলের বউ করে নিয়ে আসি, ও আমাদের পরিবারে মানিয়ে নিতে পারবে না। কিংবা ও মানিয়ে নিলেও আমরা মেনে নিতে পারব না। আমরা এমন সব লোকের সাথে উঠাবসা করি, এমন সব জায়গায় যাই, এমনভাবে চলাফেরা করি – যা তোমরা এফোর্ট করতে পারবে না।
সোজা ভাষায় বলতে গেলে, ধরো আমার কলিগের বাড়িতে কোনো ফাংশনে গেলাম। সেখানে ফ্যামিলি মেম্বার হিসেবে সাঁঝকে প্রেজেন্ট করতে পারব? সেই যোগ্যতা আছে তোমার মেয়ের?
পর্যাপ্ত নিয়ম শৃঙ্খলা এবং আভিজাত্যে বড় হওয়া সত্ত্বেও মাধবীলতাকে প্রেজেন্টেব্যাল করে তুলতে আমার অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। সেখানে সাঁঝ বড় হয়েছে একটা সো কলড মিডলক্লাস ফ্যামিলিতে। তুমি কীভাবে ওকে আমার ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখো? এর জন্যেই কি তাশফীনের প্রতি তোমার এত উদারতা, এত ভালোবাসা?
ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না। একজন নারীর মমতায় যখন প্রশ্ন উঠে সে তখন নির্বাক হয়ে যায়। কষ্ট নাকি অপমান ভারি হয়ে উঠে, পরিমাপ করা অসম্ভব।
পাথরপ্রায় স্বর্ণলতা মোবাইল কানে চেপে মূর্তির মতোন দাঁড়িয়ে রইলেন। শুধু পাথুরে মূর্তির চোখ বেয়ে অনর্গল জলের ধারা বইছে। দরজায় খট শব্দ হওয়ায় ভ্রমের মায়াজাল কেটে গেল। দ্রুত চোখের জল মুছে কল কেটে দিলেন তিনি। যথেষ্ট অপমান হয়েছে। আর নয়।
মোবাইলটি স্ত্রীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে শান্ত চোখে চেয়ে আছেন তোহাজ শিকদার। মাধবীলতার ঘৃণিত দৃষ্টি উনাকে বিদ্ধ করতে পারল না। উল্টো নিজেই অভিযোগ করে বললেন,
– তোমার উচিত ছিল, সবার আগে আমার সাথে কথা বলা।
– সাঁঝকে ভালোবাসে তোমার ছেলে।
– এসব ক্ষণিকের মায়া। কেটে যেতে সময় লাগবে না।
– ছেলের প্রতি এতোটা কঠোর হতে পারলে?
– যা সঠিক, তাই করছি। ব্রেকফাস্ট করতে এসো।
*
স্ত্রীকে খুঁজে না পেয়ে ঘরে ফিরে এসেছেন সাঁঝের বাবা। অথচ এখানেই পেলেন ঘরবন্দী স্ত্রীকে। তাঁর মানসিক অবস্থা আন্দাজ করতে পারছেন বলেই, সাবধানে জিজ্ঞাসা করলেন,
– তুমি ঠিক আছ? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?
– নাহ। ঠিক আছি।
অস্বাভাবিক ভারি কণ্ঠে জবাব দিলেন সাঁঝের মা। যা শুনে দ্রুত পায়ে মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন সাঁঝের বাবা। সন্দেহজনক চোখে চেয়ে প্রশ্ন করলেন,
– অসময়ে ঘরে বসে আছো যে? রান্নাবান্না কিছু করবে না?
– হ্যাঁ। যাচ্ছি।
– সানান এসেছে বিয়ের তারিখ নিয়ে কথা বলতে।
– আমাকে জিজ্ঞাসা করছ কেনো? আমার মতামতের কোনো গুরুত্ব নেই এ বাড়িতে। তোমাদের যা ভালো মনে হয় করো।
সাঁঝের মা বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। বড্ড নিস্তেজ লাগছে। সবার সাথে লড়াই করা গেলেও নিজের দূর্ভাগ্যের সাথে লড়াই করার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা উনাকে দেননি।
*
সানান ভাইয়ের বড্ড তাড়া। হবেই না বা কেনো? এই পর্যন্ত আসতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি তাকে। বেশিদিন অপেক্ষা করতে গিয়ে আবার যদি কোনো ঝামেলা বাঁধে? তাই তো আগামী সোমবার বিয়ের দিন নির্ধারণের প্রস্তাব রাখা হলো।
সাঁঝের বাবা অবাক হয়ে বললেন,
– মাত্র তিনদিনে কীভাবে বিয়ের আয়োজন করব? এ অসম্ভব।
– তুমি কেনো এই বয়সে বিয়ের আয়োজনে ছুটাছুটি করবে?
– মেয়ের বাবা ছাড়া আর কে করবে?
– আমি সব ম্যানেজ করে ফেলব। তুমি বসে বসে মেয়েকে বিদায় দেওয়ার মেন্টাল প্রিপারেশন নেও।
– তাই বললে কি হয়! তোর নিজের বাড়িতেও আয়োজনের একটা ব্যাপার আছে না?
– দুটোই আমার বাড়ি। আমার সাথে তোমার যখন প্রথম দেখা হলো তখন কী বলেছিলে মনে নেই? বলেছিলে, আমিও তোর বাবার মতো। আমাকে মেজ বাবা বলে ডাকবি। সেই হিসেবে আমি তোমার ছেলে সমতুল্য। আমার বাড়িতে যা এরেঞ্জমেন্ট হবে তোমার বাড়িতেও তা হবে।
– তুই একা কয়দিক সামলাবি?
– একা কোথায়? আমার বিশাল বড় গ্যাং আছে। সবাইকে কাজে লাগিয়ে দিব।
– কাকে কাকে দাওয়াত করবি ভেবেছিস?
– কাকে কাকে মানে? পরিবারের লোকজন, কাছের বন্ধুবান্ধব ছাড়া আর কাউকে নয়। বেশি লোকজন আমার পছন্দ নয়।
যত কম লোকজন তত বেশি সুবিধা। সম্মতি প্রকাশ করলেন সাঁঝের বাবা। শুরু হলো বিয়ের আয়োজন। রাজশাহী থেকে সাজিদ এলেন স্ত্রী তাহমিদা এবং একমাত্র ছেলে সওগাতকে সাথে নিয়ে। সাবা ও সারা এসেছেন। সাথে বাচ্চাদের না দেখে সাওগা বেগম মন খারাপ করে বললেন,
– বাচ্চাদের নিয়ে এলি না কেনো? কেমন মা তোরা? বাচ্চাদের রেখে একা দাওয়াত খেতে চলে আসিস!
সারা মুখ গোমড়া করে বললেন,
– আমরাও আসতাম না। তুমি মন খারাপ করবে দেখে এলাম। এত শর্ট নোটিশে কেউ বিয়ে করে! সুনেরাহ এতো মন খারাপ করল! ও বলেছে আর কখনো নানু বাড়ি আসবে না।
সাওদা বেগম হেসে বললেন,
– আমার মন খারাপের জন্য তোরা আসিসনি। এসেছিস সানানের মায়ের ভয়ে। নিজে ফোন করে দাওয়াত দিয়েছে। না আসলে কথা শোনাবে এজন্য বাধ্য হয়েছিস আসতে। তোদের আমি চিনি না!
*
আরাম আয়েশে মানুষজন গিজগিজ করছে। দেয়ালের চারপাশে ছাদ থেকে নিচে নেমে গেছে বিভিন্ন রঙের ফেইরি লাইট। তারই কাজ চলছে। রিক্সা থেকে হাসিমুখে নামল জুবিয়া। ভাড়া মিটিয়ে এক প্রকার ছুটে গেলো ভেতরে। বান্ধবীর বিয়ে বলে কথা!
রান্নাঘরে দেখা মিলল সাঁঝের মায়ের। জুবিয়াকে দেখতে পেয়ে দরজা থেকে একপ্রকার টেনে নিয়ে গেলেন। তিনিই কল দিয়ে ডেকেছেন জুবিয়াকে। কক্ষের দরজা লাগিয়ে নিচু কণ্ঠে বললেন,
– কান্নাকাটি করে বাড়িঘর ভাসিয়ে দিচ্ছে তোমার বান্ধবী। বাড়িতে এতো লোকজন এসেছে। কী ভাববে বলো? মেয়েটার একটুও বুদ্ধিশুদ্ধি হলো না। ওকে একটু বুঝাও।
জুবিয়া অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,
– কাঁদছে কেনো?
– সানানকে বিয়ে করবে না, তাই কাঁদছে। ওকে বুঝাও, এ বাড়িতে মেয়েদের মতামতের কোনো গুরুত্ব নেই। যা চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাই মেনে নিতে হয়। ওর ভাগ্যে এটাই ছিল।
কয়েক মুহুর্তের জন্য হতবুদ্ধি হয়ে গেল জুবিয়া। বিড়বিড় করে বলল,
– আমি ভেবেছিলাম, তাশফীন ভাইয়ার সাথে সাঁঝের…
– আমিও তাই চেয়েছিলাম। কিন্তু এতো ভাগ্য নিয়ে আসেনি তোমার বান্ধবী। কুড়েঘরে জন্মে প্রাসাদের রাজপুত্রের স্বপ্ন দেখতে নাই। তুমি যাও ওর কাছে। এদিকে রাজ্যের কাজ পড়ে আছে। মেয়ের বিয়ে তো। রেঁধেবেড়ে আমাকেই খাওয়াতে হবে।
যে আনন্দ উচ্ছ্বাস নিয়ে জুবিয়া বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল, তাতে ভাটা পড়ল। মেঘে ঢাকা অন্ধকার মুখে সাঁঝের কক্ষে প্রবেশ করে দেখল চেয়ারে উদাস মুখে বসে আছে সাঁঝ। দরজা বন্ধ করে এগিয়ে যেতেই সাঁঝ ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল জুবিয়াকে। কিছু বলল না। শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল।
বিছানার মাঝখানে বসে আছে জুবিয়া। কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে সাঁঝ। এর মধ্যে খবর পেয়ে ছুটে এসেছে ঝিলিক। অদ্ভুত চোখে চেয়ে দেখছে দুই বান্ধবীর অন্ধকার মুখ। একসময় বিরক্ত হয়ে বলল,
– তুই এতো কাঁদছিস কেনো সাঁঝ? সানান ভাই কি খারাপ ছেলে? দেখতে কী সুন্দর! কত বড় বাড়ি উনাদের! তার থেকে বড় কথা, বিয়ের করে বেশিদূর যেতে হচ্ছে না। দু পা ফেললেই শ্বশুরবাড়ি। এমন ভাগ্য কয়টা মেয়ের হয়!
ঠোঁট বাকিয়ে কান্নারত সাঁঝ অভিমানী চোখে জুবিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
– ওকে চুপ করতে বল, জুবু।
– যাহ বাবা। আমি কি ভুল কিছু বলেছি? অচেনা কাউকে বিয়ে করার থেকে চেনাজানার মধ্যে বিয়ে করা ভালো। এতে আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভালো হয়।
জুবিয়া ধমক দিয়ে বলল,
– চুপ থাক গাধারাম।
– সম্পূর্ণ অচেনা একটা ছেলের সাথে বেড শেয়ার করার ব্যাপারটা আমার কেমন যেন লাগে! আমি কখনো পারব না ওসব। এজন্য প্রেম করে বিয়ে করেছি। আমাদের আগে থেকে চেনাজানা ছিল। তাই বিয়ের পর কোনো প্রবলেম হয়নি। সাঁঝের একটা প্রেম থাকলে ভালো হতো। প্রেমিক না হলেও একদম অচেনা ছেলের সাথে বিয়ে হচ্ছে না, এটাই স্বস্তির। সানান ভাইকে তো আমরা সবাই চিনি। ভালোই হলো, বল?
সাঁঝ রেগে গিয়ে উঠে বসল। আলোচনার উদ্দেশ্যে ঝিলিকের সামনে পা মুড়ে বসে বলল,
– কোন চেনাজানার কথা বলছিস তুই? যাকে এতদিন ভাই বলে জেনে এসেছি এখন চট করে তাকে স্বামী ভাবতে হবে। কীভাবে ভাবব বল? এর থেকে সম্পূর্ণ অচেনা একটা ছেলেকে বিয়ে করা ভালো ছিল। আগে থেকে জানতাম, এর সাথে সংসার করতে হতে পারে। মেন্টালি প্রিপেয়ার হয়ে থাকা যেত।
– এখন প্রিপারেশন নে। হাতে তিনদিন সময় আছে।
_ জুবু, একে কিন্তু আমি খু ন করে ফেলব।
– তুই বাদ দে ওর কথা।
– ওই রাক্ষসটাকে স্বামী ভাবতে বলছে কী করে! যে ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবে একটা কথা বলতে জানে না। সারাক্ষণ ধমক দেয়। তার সাথে সংসার করব। মার খেতে খেতে আমার জীবন চলে যাবে। আমার কি হবে, জুবু? কেমনে কী করব? ভাবতেই পাগল পাগল লাগতেছে।
– যে ভাবনায় কূল কিনারা পাওয়া যায় না, তা ভাবতে নেই। সময়ের হাতে ছেড়ে দিতে হয়। যখন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়াবি তখন দেখবি সবকিছু চমৎকারভাবে ম্যানেজ হয়ে গেছে। অথচ তুই এতদিন অযথা দুশ্চিন্তা করে মানসিক শান্তি নষ্ট করেছিস। তাই দুশ্চিন্তা বাদ। বিয়ের প্রিপারেশনের দিকে মনোযোগ দে। সারাক্ষণ এভাবে কান্নাকাটি করলে চেহারার কি হবে ভেবেছিস? কোথায় এই সময় ঠিকঠাক খাওয়াদাওয়া করবি, বেশি বেশি পানি খাবি, প্রোপারলি ঘুমাবি। তা না করে উনি কাঁদতে বসেছেন। কেঁদেকেটে কি লাভ হবে শুনি?
– আর ঘুম! আমি ভাবছি এই বাড়ি থেকে কীভাবে পালাবো। তাশফীন ভাইয়া থাকলে খুব ভালো হতো। ঠিক একটা বুদ্ধি বের করে ফেলত। ভাইয়াকে একটা কল দিয়ে দেখ না, জুবু।
– তুই নিজেই দে।
জুবিয়ার মোবাইল থেকে বার কয়েক তাশফীনকে কল দেওয়া হলো। কিন্তু মোবাইল বন্ধ দেখালো। ঝিলিক ভয়ার্ত চোখে সব কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে বলল,
– তুই কি সত্যি পালানোর কথা ভাবছিস?
– তবে কি মিথ্যা পালানোর কথা বলছি?
– পালাবি কীভাবে? চারপাশে কত লোকজন! বাড়ি থেকে বের হতে পারলেও এলাকার বাইরে যেতে পারবি না। সবখানে সানান ভাইয়ের স্পাই ঘুরে বেড়ায়। তুই যেখানেই যাস, সানান ভাই ঠিকই খুঁজে নিয়ে আসবে। তারপর তোর কি অবস্থা করবে সেটা ভাব।
নিশ্চিত ভবিষ্যৎ ভেবে তিন বান্ধবীর মুখ শুকিয়ে গেল। ভয়ার্ত মুখটায় সামান্য হাসি ফুটানোর বৃথা চেষ্টা করে জুবিয়া বলল,
– ও মজা করছে। তাই না সাঁঝ? বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবেই বা কোথায়? মন খারাপ থাকলে এরকম কতো কথাই ও বলে। ওসব বাদ দিয়ে চল এখন জরুরি আলোচনা শুরু করা যাক।
সাঁঝ আগ্রহী হয়ে জানতে চাইল,
– কীসের আলোচনা?
– বিয়ে জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। এই সময় অভিমান করে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকলে তোর লস। বেটার অপশন হচ্ছে মন থেকে মেনে নিয়ে বিয়ের আনন্দে মেতে উঠা। কীভাবে বউ সাজবি, মেহেদি দিবি এসব নিয়ে অনেক প্ল্যানিং করতে হবে। গেস্ট, ক্যাটারিং, ডেকোরেশন, ভেন্যু এসব ছেলেরা সামলে নিবে। কিন্তু হলুদের শাড়ি, মেহেদি ও বিয়ের ড্রেস, জুতা, ব্যাগ, গয়না, মেকআপ, হেয়ারস্টাইল -এসব আমাদেরকে ঠিক করতে হবে। ও বাড়ি থেকে টাকা পাঠানো হয়েছে। আন্টি বলল, আমরা যেনো আজকে বিকালেই শপিং করতে যাই।
সাজসজ্জায় আগ্রহী সাঁঝ আজকে আগ্রহ দেখালো না। মুখ ফুলিয়ে বলল,
– আমার এতো শখ নাই। ওই টাকা ওদের মুখে ছুঁড়ে দিয়ে আয়।
– ভেবে বলছিস? একবার ফেরত দিয়ে দিলে তোর কিপ্টে বর কিন্তু আর দিবে না। তখন পুরাতন জামাকাপড় পরে বিয়ে করিস। অনেক বছর পর বাচ্চাকাচ্চাকে বিয়ের ছবি বের করে দেখায় বলবি, দেখো বিয়ের দিন তোমাদের আম্মুকে কতো সুন্দর লাগছিল।
প্রিয় বান্ধবী হওয়ার সুবাদে সাঁঝের দূর্বলতা ভালোভাবে জানে জুবিয়ার। সেই সাথে কোমল, সরল মেয়েটির মনকে কীভাবে পরিচালিত করা যায়, সেই উপায়ও তার জানা। কূটিলতা মুক্ত সাঁঝের মন। জুবিয়ার কথা শুনে গভীর চিন্তায় মগ্ন হলো। সত্যিই তো। এভাবে বিয়ে হয় নাকি?
নিজের বিয়ের গল্প বলার বাহানা পেল ঝিলিক। বিয়ের সাজসজ্জা নিয়ে কত রিসার্চ সে করেছে! কোথায় কোন মার্কেটে কতোদিন ঘুরেফিরে শাড়ি, গয়না কিনেছে। সেইসব পরিশ্রমের কথা বলল। তারপর বিজ্ঞজনের মতো উপদেশ দিল,
– বিয়ের দিন পেরিয়ে গেলে পরে আফসোস করে লাভ হবে না। কারণ বিয়ে জীবনে একবারই আসে। সুযোগ একটাই। যা করার ভেবেচিন্তে করতে হবে।
এরপর আর বেশি কসরত করতে হয়নি। বিয়ে নামক গোলকধাঁধা থেকে বের করে সাঁঝকে ব্যস্ত রাখা হলো তার প্রিয় বিষয়ে। সাজসজ্জা। তিনি বান্ধবী মিলে জুবিয়ার মোবাইলে হামলে পড়ল। পিন্টারেস্ট, ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক থেকে শুরু করে যাবতীয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ঘেটে দেখা হলো। শত শত ওয়েডিং ভিডিও দেখা হলো ইউটিউবে। কীভাবে সাজবে, কীভাবে ছবি তুলবে সবকিছু নোট করা শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো পরেরদিন সকালে ওরা শপিং করতে যাবে।
*
বিয়ের আয়োজন খুব সাধারণভাবে সম্পন্ন করার কথা থাকলেও বাধ সাধলেন সাওদা বেগম। উনার বংশের তৃতীয় প্রজন্মের প্রথম বিয়ে। তাও আবার বড় নাতির বিয়ে বলে কথা। আয়োজনে কোনো কমতি রাখতে চাইছেন না। বৃদ্ধার এতো আহ্লাদ দেখে সাঁঝের মায়ের গা রি রি করছে। অন্যরা মনোক্ষুণ্ণ। তবে তারা খুব একটা প্রকাশ করছেন না। তালে তাল মিলিয়ে যাচ্ছেন।
মায়ের কথা রাখতে সকাল বেলা বাড়ির দুই নাইয়রি সাবা ও সারা সামনের উঠানে আয়োজন শুরু করল। গুদামঘর থেকে আনা হলো পুরনো কাহেল ছিয়া। তার গায়ে জাফরান ছুয়ে হলুদ কুটা আরম্ভ হলো। পাড়া পড়শিরা চারপাশে গোল হয়ে বসে গীত গাইছে। বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে তিন বান্ধবী।
জুবিয়া ও ঝিলিককে কাছে পেয়ে নিজের বিয়ের কথা প্রায় ভুলতে বসেছে সাঁঝ। অন্যদের মতো সেও বিয়ের আচার অনুষ্ঠান উপভোগ করছে। এজন্যই লোকে বলে, বন্ধুরা পাশে থাকলে কোনো বিপদকে বিপদ বলে মনে হয় না। সবটাই মনে হয় এডভেঞ্চার।
হলুদ কুটা শেষে পাতলা কাপড়ে চেলে নিয়ে কুলোয় রাখা হলো। এরপর উনারা ছুটলেন সানান ভাইয়ের বাড়ির দিকে। তারা যে সেই বাড়িরও নাইয়রি। সেখানে হলুদ কুটা শেষ করে হলুদের ডালা সাজাতে বসেছেন সাবা। নানান পদের মিষ্টি, দুটো মাছ এবং হলুদের কাপড়, ফুলের গয়নাসহ প্রয়োজনীয় নানা দ্রব্য সামগ্রী দিয়ে ডালা সাজানো হলো। ডালায় বড় দুটি কাতলা মাছ।
পাঁচশত টাকার পাঁচটি নোট গোল করে মুড়ে আকারে বড় মাছটির মুখে গুজে দিয়ে সাবা বললেন,
– এই হলো আমাদের সানান। আর এই যে ছোটটা, এটা সাঁঝ।
মাছ কুটতে বসে সেই টাকা পেলেন সাঁঝের ছোট ফুপু সারা। এত কম টাকা উপহার দেওয়ায় বড় বোনকে খোঁচা মেরে দুটো কথা বললে ভুললেন না।
ইতিমধ্যে সানানের গায়ে হলুদ দেওয়া হয়েছে। সে বেচারা নানান কাজে ব্যস্ত। কোনো রকম একটা সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে ড্রয়িংরুমের মেঝেতে বসেছে। সাবা বললেন,
– ছাদে এত সুন্দর করে স্টেজ সাজানো হয়েছে। ওখানে গিয়ে বসলে ভালো হতো না?
– সময় নেই ফুপি। যা করার এখানেই করো।
– পাঞ্জাবিটা খুল। গামছা গায়ে দিয়ে বস।
– অসম্ভব। পাঞ্জাবি খুলতে পারব না।
– তাহলে হলুদ লাগাবো কীভাবে?
– পুরো মুখ ফাঁকা পড়ে আছে। সেখানে দেও। হাতে পায়ে একটু ছোঁয়ালেই হবে।
যেখানে অনুষ্ঠান সেখানেই বুলুর মা। এসকল আয়োজনে রসালো তথ্য পাওয়া যায়। তাই বুলুর মা সবার আগে ছুটে উপস্থিত হয়। সানানের কথা শুনে গা দুলিয়ে হাসতে হাসতে বললেন,
– আমাগো সামনে পাঞ্জাবি খোলতে লজ্জা। বিয়ের পরে দেখমু কী করো। তখন তো সব খোলতে হইব।
সকলে লজ্জায় মুখ লুকালেও সানান ভাই লজ্জা পেল না। ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,
– ঘরের দরজা বন্ধ করে খুলব। আপনি দেখতে পাবেন না।
ঠোঁটকাটা ছেলের স্বভাব সম্পর্কে অবগত আফসানা। ওকে খোঁচালে কাউকে নিস্তার দিবে না। তাই তো বুলুর মাকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিলেন।
– ওর সাথে লাগতে যেও না বুলুর মা। অযথা মান সম্মান খোয়াবে।
বরের গা ছোঁয়ানো হলুদ নিয়ে কনের অপেক্ষায় সকলের প্রাণ ওষ্ঠাগত। মাথার উপরে তাপ ছড়াচ্ছে সূর্য। খোলা ছাদে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়! ওদিকে কনের সাজগোজ শেষ হচ্ছে না।
সাঁঝের বন্ধ দরজায় বারি মারলেন সাওদা বেগম। ওপাশ থেকে জুবিয়ার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
– আসছি। দুই মিনিট।
– তোমাগো সাজগোছ তো শেষ হইতাছে না এখনও? এতো সাইজা কি করবা? কিছুক্ষণ পরে গোসল করাইবা, তখন তো এই সাজ আর থাকবো না।
সাজসজ্জার তখনো ঢের বাকি। সবাই বিরক্ত হচ্ছে দেখে কোনোরকমে টেনেহিঁচড়ে ছাদে নিয়ে যাওয়া হলো সাঁঝকে।
সিল্কের একরঙা হলুদ শাড়ি পরেছে সাঁঝ। দুটো হলুদ গোলাপের নিচে একটি লাল গোলাপ ঝুলছে কানে। মাথায় হলুদ গোলাপের টিকলির শেষপ্রান্তে একটি লাল গোলাপ। দুই হাতে হলুদ, লাল গোলাপের মিশেলে ব্রেসলেট। মুখ গোমড়া করে ছাদের মাঝে রাখা পিঁড়িতে বসে আছে সে।
বাবার হাতে হলুদ অনুষ্ঠানের শুভারম্ভ হলো। এরপর একে একে অন্যরা সাঁঝের গায়ে হলুদের প্রলেপ দিতে থাকল। ক্যামেরা হাতে জুবিয়া এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,
– মুখটা ওমন অন্ধকার করে রাখছিস কেন? ছবি ভালো আসতেছে না। একটু হাস।
সাঁঝ ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
– ঠিকঠাক সাজতে পারলাম না। ছবি ভালো আসবে কই থেকে? চুলটা খোঁপা করা হলো না। খোলা চুলে নিশ্চয়ই পেত্নীর মতো লাগছে?
চুলের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া দুলটা উদ্ধার করে সোজা করে দিল জুবিয়া। বলল,
– খারাপ লাগছে না। ঠিকই আছে।
– ক্যাটক্যাটে লাল রঙের লিপস্টিক দিয়ে দিল ঝিলিক। আমি ন্যুড কালার দিতে চেয়েছিলাম।
পাশে বসে থাকা ঝিলিক হিসহিসিয়ে উঠল।
– লালটা বেশি ভালো লাগছে না, জুবিয়া?
– হ্যাঁ। এটাই ঠিক আছে। লাল গোলাপের সাথে ম্যাচ করেছে। তুই বেশি চিন্তা করতেছিস, সাঁঝ। ওসব বাদ দিয়ে একটু আরাম করে বস। পড়ে ছবি ভালো না আসলে আমাকে দোষ দিতে পারবি না।
হলুদ দেওয়া শেষ করে বড়রা সবাই ফিরে গেলেও কনে ও তার বান্ধবীদের ফটোসেশান আরও এক ঘন্টা ধরে চলল। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে সেখানে কলসি ভরে পানি এনে সাঁঝের গায়ে ঢেলে দিলেন বুলুর মা।
ফ্রেশ হয়ে একফাঁকে সানান ভাইয়ের হোয়াটসঅ্যাপে সাঁঝের একটি ছবি পাঠিয়ে দিল ঝিলিক। মূলত সানান ভাইয়ের স্পাইয়িং এর গুরু দায়িত্ব আপাতত তারই কাঁধে। ঝিলিকও প্রতি মুহূর্তের আপডেট জানিয়ে দিচ্ছে সানন্দে। কারণ সানান ভাই তার বাচ্চাকালের ক্রাশ। এমন রাজপুত্রের সাথে বান্ধবীর বিয়েতে সে ভীষণ খুশি।
ক্যাটারিং থেকে বড় বড় ডেক, চামচ, গামলা এসে পৌঁছেছে বাড়ির সামনে। সেগুলো হিসাব করে ঠিকঠাকভাবে নিচে নামানো হচ্ছে। কাজের লোকদের সাথে দাঁড়িয়ে তদারকি করছে সানান ভাই। গায়ের টিশার্ট ঘামে ভিজে গেছে। কপালে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘামের কণা। দুপুরের খাবারটা খাওয়ার সময় পায়নি এখনও।
পকেটের রাখা মোবাইলটি সশব্দে বেজে উঠল। আজকাল কিছুক্ষণ পর পর বেজে উঠছে এই যন্ত্রটি। দুটো বিয়ের দায়িত্ব তার কাঁধে। কত জায়গা থেকে যে কল আসছে তার ইয়াত্তা নেই। বাড়ি ভেতর থেকে আজম ডাকছে তারস্বরে। সেদিকে পা বাড়িয়ে পকেট থেকে মোবাইলটি বের করল সানান ভাই।
হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ এসেছে। একটি ছবি। হলুদ শাড়ি পরে বসে আছে একটি পরী। মুখে তার লাজুক হাসি। খোলা চুলের সাঁঝের নিষ্পাপ হাসি মুখটির দিকে তাকিয়ে সানান ভাইয়ের সকল ক্লান্তি মুছে গেল। মৃদু হেসে সে বিড়বিড় করে বলল,
– ফুটন্ত সূর্যমুখী,
শীতের নরম রোদের মতো সুন্দর তোর ঝলমলে হাসি।
চলবে..
#অক্ষরময়ী