#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব ৩৭
গতকাল সন্ধ্যায় বেশ আয়োজন করে মেহেদি উৎসব হলো। গাঢ় সবুজ রঙের গারারা পরেছিল সাঁঝ। বৃষ্টিস্নাত বৃক্ষের মতো সতেজ চেহারাখানি দেখে উপস্থিত প্রতিটি ব্যক্তির মন একবার হলেও পুলকিত হতে বাধ্য হয়েছে।
আজ সাঁঝের বিয়ে। বহুল আকাঙ্ক্ষিত লাল রঙের জামদানী শাড়ি গায়ে জড়াতে যাচ্ছে। এই উচ্ছ্বাসের কাছে বাকিসব নচ্ছার তার কাছে।
দুপুরবেলা ভরপেট খাওয়াদাওয়া শেষে তিন বান্ধবী বসেছে সাজের ডালা নিয়ে। বিয়ের অনুষ্ঠানে যথেষ্ট ভীড় হলেও কনের ঘরটি বেশ ফাঁকা। বাড়ির মুরুব্বিদের সেখানে প্রবেশ একপ্রকার নিষিদ্ধ। এর দুটি কারণ রয়েছে। এক, নিবিঘ্ন সাজসজ্জা সম্পন্ন হওয়া। দুই, বিয়ে বিষয়ক জটিলতা থেকে সাঁঝকে মানসিকভাবে দূরে রাখা।
এত মানুষজন দেখে সে ভড়কে যাবে, সেটা সানান ভাই জানে। তাই সাঁঝের আশপাশ সবসময় পূর্বের মতোন নিরিবিলি রাখার ব্যবস্থাটি সেই করেছে।
সচরাচর মেকআপ সম্পন্ন করে বিয়ের পোশাক পরানো হয়। কিন্তু সাঁঝের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কিছু ঘটল। লাল রঙের চেরি রেড শেডের জামদানি শাড়িটি পরার তড় সইছে না দেখে জুবিয়া বলল,
– যাহ আগে শাড়িটা পরে ক্ষ্রান্ত হ। তারপর শান্ত হয়ে এখানটায় বস।
সাঁঝ বিনাবাক্যে শাড়িটি গায়ে জড়ালো। মুখে তার বিশ্ব জয়ের হাসি। ড্রেসিংটেবিলের সামনের টুলে বসে বলল,
– মেকআপ আমি নিজে করব।
ঝিলিক আগে সাজগোজ সম্পন্ন করে ফেলেছে। দইয়ের বাটি হাতে নিয়ে বসেছিল বিছানায়। বলল,
– বিয়ের কনে নিজেই নিজের সাজসজ্জা করছে, এমনটি আগে কখনো দেখিনি। তুই পারিসও বটে সাঁঝ।
– তোরা কেউ আমার থেকে ভালো মেকআপ করতে পারবি?
– তোর থেকে ভালো না পারি কিন্তু করতে পারব।
– যেমনতেমন সাজ আমার চলবে না। নিজের মেকআপ আমি নিজেই করব।
জিনিসপত্র এগিয়ে দিয়ে যথাসাধ্য সহযোগিতা করল জুবিয়া। খুব ভারি মেকআপ করা হলো না। চুলগুলো খোঁপা বেঁধে কয়েকটা গোলাপ গুজে দিল। গলায় সোনালি রঙের হার। নিচে ঝুলছে কয়েকটা গাঢ় সবুজ রঙের পাথর। তিন স্তরের একটি সিতাহারও পরল। কানে চাঁদবালি, মাথায় টিকলি। হাতে চুড়ির সাথে একটি করে বালা। দু হাতের মধ্যমায় দুটো আংটি। চোখে কাজল, আইলাইনার, ঠোঁটে লিপস্টিক। এই তো কনের সাজসজ্জা।
মাথায় দোপাট্টা দিয়ে ঘোমটা দেওয়ার আগেই দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। জুবিয়া দরজা খুলে দেখল সাঁঝের বড় ফুপু দাঁড়িয়ে আছেন। বললেন,
– কাজি সাহেব এসেছেন। তোমাদের হয়েছে?
বিকালবেলা কার্যক্রম শুরু হয়েছিল এর মাঝে কীভাবে রাত গড়িয়ে গেছে কেউ টের পায়নি। আয়নার সামনে বসে সাঁঝ বলল,
– এত তাড়াতাড়ি চলে এসেছে!
সাবা ভেতরে ঢুকে রীতিমতো হোঁচট খেলেন। কলঙ্কমুক্ত চাঁদের মতো রূপ নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে স্বর্ণলতার মেয়ে। আজ বিয়ের সাজে তাকে রাজেন্দ্রাণী লাগছে। বলতে দ্বিধা নেই, মনে মনে আফসানার ভাগ্য দেখে প্রচণ্ড ঈর্ষান্বিত হলেন সাবা।
– কাজিকে পাঠিয়ে দিব?
– পাঠিয়ে দিন। ঘোমটা দিলেই রেডি হওয়া শেষ।
জুবিয়ার জবাব শুনে প্রতিবাদ করে উঠল সাঁঝ। বলল,
– নাহ। এখনি পাঠাবেন না। জুবিয়ার সাজ বাকি।
– আমি আর কি সাজব! বিয়ে হচ্ছে তোর। আমাকে কে দেখতে আসবে? আমি পড়ে সেজে নিব এখন।
– সেজেগুজে তুই আমার পাশে বসবি। কাজিকে দশ মিনিট পর পাঠিয়ে দিয়েন। জুবিয়া তুই তাড়াতাড়ি শাড়ি পরে নে। আমি তোকে সাজিয়ে দিচ্ছি।
বিয়ের কনে মাথার লম্বা ঘোমটটিা গুটিয়ে রেখে বান্ধবীকে সাজিয়ে দিচ্ছে, এমন দৃশ্য কেউ কখনো দেখেছে? কনের খোঁজে যেই কক্ষে আসছে, সেই এমন দৃশ্য দেখে চোখ কপালে তুলছে।
*
বিছানার মাঝখানে কনে রূপে বসে আছে সাঁঝ। দুপাশে দুই বান্ধবী। সম্মুখে উৎসাহিত নারীরা জমায়েত হয়েছে। সাঁঝের মা এসে বিছানার একপাশে পা ঝুলিয়ে বসেছেন। সাওদা বেগমকেও দেখা যাচ্ছে। একটি চেয়ার টেনে কাজি সাহেব বসলেন। আগে কখনো বিয়ের কার্যক্রম অতি সূক্ষ্মভাবে দেখা হয়নি সাঁঝ ও জুবিয়ার। দুই বান্ধবী খুব মনোযোগ দিয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে। যেন খুবই জটিল কোনো পরীক্ষা চলছে ল্যাবক্লাসে।
একটি রেজিস্ট্রার খাতা এগিয়ে দিয়ে কাজি সাহেব বললেন,
– এখানে সাইন করুন।
সরু চোখে নীলচে কাগজটি নিরীক্ষণ করে কপাল কুচকে
,সাঁঝ বলল,
– কোথায় সাইন করব?
কাজি সাহেব নির্দিষ্ট জায়গা দেখিয়ে দিলেন। কলম বসাতে গিয়েও থামল সে। মুখ তুলে প্রশ্নাত্মক চাহনিতে বলল,
– বাংলায় সাইন করব নাকি ইংরেজিতে?
পাশ থেকে জুবিয়ে বলল,
– যে-কোনো একটাতে করলেই হলো।
খাতার উপর ঝুঁকে পড়ল জুবিয়া। হড়বড় করে বলল,
– নাহ, নাহ। বাংলায় সাইন করতে হয়। আমি বাংলায় সাইন করেছি।
তিন বান্ধবীর দুশ্চিন্তার বাহার দেখে দফায় দফায় অবাক হচ্ছে দর্শকবৃন্দ। সেদিকে বান্ধবীদল খুব একটা পাত্তা দিল না। সাইন করতে গিয়ে হাতের লেখায় বিশেষ মনোযোগ দিল সাঁঝ। লেখা সুন্দর হওয়ায় সন্তুষ্ট হয়ে খুশি মনে রেজিস্ট্রার খাতা এগিয়ে দিয়ে তাকাল জুবিয়ার দিকে। কিন্তু একি জুবিয়ার চোখে জল!
সে অবাক হয়ে বলল,
– ওমা! তুই কাঁদছিস কেনো?
– কারণ তোর বিয়ে হয়ে গেলো। বোকা মেয়ে। আজ থেকে তুই পর হয়ে গেলি।
কান্না হাসির মিশেলে বলে উঠল জুবিয়া। সাঁঝ অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
– আরেহ! সত্যি তো। আগে বলবি না। আমি তো টেরই পেলাম না। ধুর।
উপস্থিত সকলে হেসে উঠায় সাঁঝ ভীষণ লজ্জা পেল। সে আসলেই খেয়াল করেনি। সাইন করায় চিন্তায় এত বেশি ব্যস্ত ছিল যে নিজেকে আরেকজনের নামে লিখে দেওয়ার ব্যাপারটা তাকেই ভাবায়নি।
তবে এবার ভাবালো। যখন বেশ সমারোহে কাজি সাহেব কবুল বলতে বললেন। কক্ষের অস্বাভাবিক নীরবতায় সাঁঝ ভীষণ ঘাবড়ে গেল। ফ্যালফ্যাল করে তাকালো মায়ের দিকে। স্বর্ণলতা আরেকটু এগিয়ে গেলেন মেয়ের কাছে। কাঁধে হাত রেখে বললেন,
– দেরী করে লাভ নেই। বলে দে।
তিনি নিজেই নিমরাজি। তবুও মেয়েকে সাহস যোগাতে হবে বলেই কথাটা বলা। জুবিয়া টের পাচ্ছিলো, কীভাবে কাঁপছে সাঁঝের দেহ। দোপাট্টার নিচে বান্ধবীর উত্তপ্তটা হাতটা ধরে মিষ্টি করে হাসল জুবিয়া। ডোন্ট কেয়ার একটা ভাব নিয়ে বলল,
– আরে বলে দে। একটা কবুল-ই তো।
ফোস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে খুব সহজে সাঁঝ বলে দিল তিন অক্ষরের ভারি শব্দটি।
*
রাতের অন্ধকার ঠাঁই পায়নি আরাম আয়েশের ছাদে। জমকালো সাজসজ্জা, নানান রঙের বৈদ্যুতিক বাতিতে ঝলমল করছে চারপাশ। সাঁঝ অবাক চোখে দেখল চিরচেনা ছাদটার নতুন রূপ। আকাশ থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। খুব জোরালো নয়। অনেকটা শিশির কণার মতো। গা ভিজে না তেমনভাবে। আজ সারাদিন এমনিভাবে একনাগাড়ে কেঁদে চলেছে আকাশ। মাথায় ঘোমটা থাকায় ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছে না বলে ঘোমটা সরাতে যাচ্ছিল সে। জুবিয়া হাত ধরে ফেলল।
– তুলিস না। মুখ ঢেকে রাখ।
– কেনো?
– কত লোকজন দেখছিস না?
সে মুখ ফুলিয়ে আদেশ মেনে নিল। সবাই মিলে ধরাধরি করে ওকে নিয়ে বসালো একটা বেদীর মতো জায়গায়। বাধ্য মেয়ের মতো নিজেকে ওদের হাতে সঁপে দিয়েছিল সে। এক পর্যায়ে খেয়াল করল, বন্ধুরা কেউ আশেপাশে নেই। ভড়কে গিয়ে মাথা তুলে সামনের দিকে খুঁজল। নাহ, কেউ নেই।
উদ্বিগ্ন সাঁঝকে লক্ষ্য করে জুবিয়া বলল,
– এই যে আমরা এখানে।
সে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল বেদীর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে জুবিয়া ও ঝিলিক। ও বিরক্ত হয়ে বলল,
– ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? আমার পাশে এসে বস।
তখনি সামনে হট্টগোল শুরু হলো। হৈ রৈ করে কতগুলো ছেলে এগিয়ে আসছে। ওদের অরাজকতা দেখে সাঁঝের মুখ বিকৃত হলো। ওদের মাঝে সানান ভাইকেও দেখা যাচ্ছে। কুসুম রঙা একটা পাঞ্জাবি পরেছে। দেখেই সাঁঝের বমি পাওয়ার উপক্রম। রংটা আরেকটু গাঢ় হলে কমলা সুন্দরী বলে চালিয়ে দেওয়া যেত। এই মানুষটার পোশাকের বাহার দেখে যে কারো মেজাজ বিগড়ে যাবে।
সাঁঝ যখন নাক কুচকে ছেলেদের বাহারি কার্যক্রম দেখছিল তখন সানান ভাই ওর সামনে দাঁড়িয়ে একটি ফুলের তোড়া এগিয়ে দিল। প্রস্তুত সাঁঝ হকচকিয়ে গেলেও সহজাত প্রবৃত্তি অনুসারে হাত বাড়িয়ে তোড়াটি নিয়ে দেখল, একশত টাকার নোট দিয়ে বানানো হয়েছে ফুলগুলো। সে কিছু বুঝে উঠার আগেই জুবিয়া এসে মাথার ঘোমটা তুলে দিয়ে বলল,
– সামনে দেখ।
সে সামনে তাকিয়ে দেখল, ছবি তোলার জন্য ক্যামেরাম্যান প্রস্তুত। ক্যামেরা দেখলেই সাঁঝের মন ফুরফুরে হয়ে যায়। সে মিষ্টি হাসি ফোটালো ঠোঁটে। যাতে ছবি ভালো হয়। পর পর কয়েকটা ছবি তোলার পর সাঁঝের খেয়াল হলো ওর পাশে কেউ বসে আছে। এতক্ষণ ভেবেছিল ঝিলিক বোধহয়। কিন্তু কিছুটা অপরিচিত ভাইব পাচ্ছে সে। চট করে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল পাশে বসে থাকা ব্যক্তিটি সানান ভাই। মুহূর্তেই সাঁঝের দেহ পাথরসম শক্ত হয়ে গেল। গোল গোল চোখে চেয়ে রইল সানান ভাইয়ের দিকে।
অপ্রস্তুতভাব প্রকাশ করার সুযোগ পেল না। তার আগেই দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে সানান ভাই বলল,
– অনেক ছবি তোলা হয়েছে। এবার নিচে চল সবাই। টমটম এসে পৌঁছেছে কিনা খবর নিয়েছিস, আজম?
কথ বলতে বলতে সানান ভাই ছাদ থেকে বেরিয়ে গেলো। একটা জোরালো স্রোতের ধাক্কায় হাবুডুবু খাচ্ছে সাঁঝ, তখনি আরেকটা স্রোত নিয়ে প্রায় উড়ে এলো ঝিলিক। পাশে বসে হম্বিতম্বি করে নানান ভঙ্গিমায় ছবি তুলতে শুরু করল। নতুন ঘটনাক্রমে ক্ষণিকের অপ্রস্তুতভাব কেটে গেছে সাঁঝের। সে আবার অবুঝ পাখির মতো উড়তে লাগল নিজস্ব আকাশে।
বিদায় বেলায় একটা ঘোড়ার গাড়ি এলো। এই সময় কান্নার শোরগোল পড়ল কিছুটা। আঁচলে মুখ ঢেকে নীরবে কাঁদল স্বর্ণলতা। আর কে কে কাঁদল ঠিকভাবে জানে না সাঁঝ। চোখের জলে দৃষ্টি ঘোলাটে হয়েছিল বলে দেখতে পায়নি।
*
শ্বশুরবাড়িতে প্রথমবার পা রেখে অন্যদের কেমন লাগে তা জানা নেই। তবে সাঁঝের ব্যতিক্রম কিছু মনে হলো না। ছোটবেলা থেকে কতোবার আসা যাওয়া হয়েছে এ বাড়িতে! নতুন করে আর কি অনুভব করবে?
শুধু চারপাশে এতো মানুষজন দেখে প্রচণ্ড বিরক্ত হলো সে। মিষ্টি শরবত কি কি যেনো খেতে বলেছিল, সেগুলো চুপচাপ খেয়ে নিয়েছে। এরপর সবাই মিলে পাঠিয়ে দিল একটা কক্ষে। বিছানায় বসা মাত্র কক্ষটাকে চিনতে পারল সাঁঝ। এটা সানান ভাইয়ের কক্ষ। তাই নিয়ে চিন্তাভাবনা করার আগেই ঝিলিক, জুবিয়া এসে হাজির। সাঁঝের পাশে ধপাস করে বসে পড়ে জুবিয়া বিরস মুখে বলল,
– আন্টি আমাকে আজকেও বাড়ি যেতে দিচ্ছে না। দুদিন ধরে তোদের বাড়িতে রাত কাটাচ্ছি। ভাইয়া যা বকবে এবার!
– এত রাতে বাড়ি ফিরবি কেনো? তার থেকে ভালো আমাদের সাথে থেকে যা।
ঝিলিক বলল,
– তাহলে আমিও থাকব।
– দুই কদম হাঁটলেই তোদের বাড়ি। তোকে থাকতে হবে কেনো?
– তোদের ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। এমনিতেও সারাদিন ভারি জামাকাপড় বয়ে বেরিয়ে আমি অনেক ক্লান্ত। জম্পেশ ঘুম পাচ্ছে।
– আমারও একই অবস্থা। যা ভ্যাবসা গরম পড়েছে! প্রায় ঘেমে গেছি। ঘোমটার পিনটা খুলে দে, জুবু। এটাকে আগে সরাই।
– সেকি! এখনি ঘোমটা খুলে ফেলবি? দাঁড়া কয়েকটা ছবি তুলে নেই আগে।
অনলাইনে দেখা কয়েকটা কনে বেশে ছবির পুনরাবৃত্তি করা হলো। তিন বান্ধবী মিলে সেলফি তুলল, ক্যান্ডিলও নেওয়া হলো কয়েকটা।
*
বিশাল বড় একটা ছাদ। বেশির ভাগ জায়গা ফাঁকা পড়ে থাকে। ভাড়াটেদের ছাদে আসা বারণ। আজ সানান ভাইয়ের বিয়ের সুবাদে এখানেই আড্ডা বসেছে বন্ধুদের। কুড়ির অধিক যুবক গড়াগড়ি দিচ্ছে মেঝের শীতলপাটিতে। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি তাদের দমাতে পারছে না। বিভিন্ন ধরনের টক ঝাল খাবারের সাথে খুলেছে ম’দের বোতল।
প্রত্যেকের হাতে গ্লাস। শুধু খালি হাতে বসে আছে সানান ভাই। জমজমাট আড্ডা তার বিরক্ত লাগছে। কিন্তু বন্ধুরা তার বিরক্তিকে বিশেষ পাত্তা দিচ্ছে না।
হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে নড়েচড়ে বসল সে। বন্ধুদের হাসি তামাশাকে এড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। এরা ইচ্ছে করেই আটকে রাখতে চাইছে তাকে।
– কোথায় যাচ্ছিস, মামা?
আজমের প্রশ্নের বিপরীতে চোখ রাঙাল সানান ভাই। কিন্তু উত্তর দিল না। গুঞ্জন বলল,
– এত তাড়া কীসের সানান ভাই? আরে বসেন। বউ পালিয়ে যাচ্ছে না। বিয়ে হয়ে গেছে। এখন আর ভয় নেই।
– তোদের সাথে বসে থেকে অযথা নষ্ট করার মতো সময় আমার হাতে নাই।
– কবুল বলা মাত্র এভাবে আমাদের পর করে দিলেন! বড় কষ্ট পেলাম ভাই।
– মামা, তুই এমন করে বলতে পারলি? আমি আজম তোর সাথে কত রাত নির্ঘুম কাটায় দিছি। আর তুই আমার সাথে দুই মিনিট বসতে পারতেছিস না? এইভাবে পর করে দিলি মামা? তুই এমন করবি জানলে, আমি তোর বিয়া দিতাম না। কিছুতেই না।
– শালা নাটকবাজ। আজকে আমার বিশেষ দিন বলে ছেড়ে দিচ্ছি। সর সামনে থেকে। আমার বউ অপেক্ষা করতেছে।
– বউয়ের জন্য কি গিফট নিছিস, মামা?
– শপিং করার এত টাকা দিলাম! আবার কীসের গিফট?
– খালি হাতে বউয়ের কাছে যাচ্ছিস? প্রথম রাতে বউকে কিছু দিবি না?
মুখ উঁচু করে আকাশের দিকে তাকাল সানান ভাই। বৃষ্টির ফোটা এসে চুম্বন করল মুখমণ্ডলে। সে হেসে বলল,
– আমার সমস্ত উদাসীনতা, সমস্ত হেয়ালি বিকিয়ে
এক জীবনে জমানো সমস্ত ভালোবাসা উৎসর্গ করেছি তার নামে। আর কি দিতে বলছিস?
– ওহো মামা! বিয়ে করা মাত্র তুমি তো রোমান্টিক হইয়া গেছো। এত রোমান্টিকতা তোমার সাথে যাইতাছে না।
– তোদের বউ নাই তোরা রোমান্টিকতার কি বুঝবি? সারারাত ধরে ছাদে গড়াগড়ি দে, হতভাগার দল। আমি চললাম। খবরদার কেউ কল দিয়ে ডিস্টার্ব করবি না।
বন্ধু বিদায়ে সকলে আনন্দে হৈ হৈ করে উঠল। যেনো পূর্ণতা পেয়েছে সকলের প্রার্থনা। সফল হয়েছে অক্লান্ত পরিশ্রম।
*
দু হাতে দোপাট্টা ধরে মাথা ঢেকে পোজ দিচ্ছিল সাঁঝ, দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। তিনজনে তাকাল দরজার দিকে। কিছুপল বাদে দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো সানান ভাই। তাকে দেখে কক্ষে উপস্থিত তিন রমণী সটান দাঁড়িয়ে পড়েছে। জুবিয়া ও ঝিলিক দ্রুত নিজেদের জিনিসপত্র গুটিয়ে পুটলির মতো করে বুকে জড়িয়ে অপ্রস্তুতভাবে হেসে বলল,
– আসুন ভাইয়া। আপনার অপেক্ষাই হচ্ছিল।
তারপর সাঁঝের দিকে তাকিয়ে নিচুস্বরে বলল,
– আমরা চললাম। অল দ্যা বেস্ট।
অবাক সাঁঝ দু চোখ কপালে তুলে বলল,
– আমাকে রেখে কোথায় যাচ্ছিস? আমাকেও নিয়ে যা।
কথা শুনে ঝিলিক ও জুবিয়ার মাথায় হাত দেবার উপক্রম। অন্যদিকে সানান ভাই বুকের উপর দু হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে ছিল। সাঁঝের কথা শুনে তার বাম ভ্রু উঁচু হলো সামান্য। সবার এমন প্রতিক্রিয়া দেখার পর সাঁঝ নিজের ভুল বুঝতে পারল।
বান্ধবীরা আর কিছু না বলে কোনোরকমে কক্ষ থেকে বেরিয়ে ছুটল আরাম আয়েশের দিকে।
এতক্ষণ বিয়ের আয়োজন দেখেও দেখেনি সাঁঝ। বান্ধবীরা চলে যেতে হঠাৎ তার বোধোদয় হলো। বুঝতে পারল, ইতিমধ্যে তার জীবনে বিপুল পরিবর্তন ঘটে গেছে।
দোপাট্টাটিকে দু হাতে বুকের কাছে জাপটে ধরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল সে। ভয়, অস্বস্তিতে কণ্ঠনালি শুকিয়ে গেছে।
আলতো হাতে দরজা লক করে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সানান ভাই। মনে তার আনন্দের বন্যা বইছে। অবশেষে তার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। ভালোবাসার মানুষটিকে জীবনসঙ্গী রূপে পাওয়ার মধ্যে একধরনের প্রশান্তি আছে। যা জীবনকে পরিপূর্ণ করে।
আজকের এই দিনটিকে কল্পনায় কত রঙে, কত ঢঙে এঁকেছিল সে। ফুলে সজ্জিত বিছানায় ঘোমটায় মুখ ঢেকে বসে থাকবে লাল টুকটুকে সাঁঝ। তার উপস্থিতিতে লজ্জায় আরও অনেকটা গুটিগুটি হয়ে যাবে নববধূ।
কিন্তু বাস্তব চিত্রপটে কিছু পরিবর্তন হয়েছে। ঘরে ফুল আছে, তবে তা অতি সামান্য। সোফার টেবিলে কিছু রজনীগন্ধা রাখা। পিসির ডেস্কে কয়েকটা মোমবাতি জ্বলছে। যা ঘরে মৃদু আলোর সাথে গোলাপের ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে।
লাল টুকটুকে নববধূ বিছানার কেন্দ্রে মাথা নুইয়ে বসে নেই। বরং বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
সানান ভাই কাছে এসে দাঁড়াতেই সাঁঝ সামান্য তোতলিয়ে বলল,
– আ..আপনি এখানে.. মানে এই রুমে ঘুমাবেন?
ঘরে গোলাপ, রজনীগন্ধার ঘ্রাণ থাকা সত্ত্বেও সানান ভাইয়ের নাকে এসে ধাক্কা দিল কামিনী ফুলের সৌরভ। বহু পুরনো কিন্তু পরিচিত সুবাস মন আন্দোলিত করল। সুবাসের মালকিনের গায়ে নাক ডুবিয়ে আরও বিমোহিত হওয়ার সাধ জাগল মনে। আজ আর মনের পায়ে বেড়ি পরালো না সানান ভাই। সাঁঝের আরও কাছে এগিয়ে গিয়ে নিচু স্বরে বলল,
– আমার ঘরে আমি ঘুমাবো না তো কোথায় ঘুমাবো?
সাঁঝের মাথা ঠেকে সানান ভাইয়ের থুতনি বরাবর। তাই তো তার মনে হলো, সানান ভাই এসে ওর মাথার উপর বসে পড়েছে। দ্রুত এক পা পিছিয়ে গেল সে।
আশেপাশে চঞ্চল নজর ফিরিয়ে বলল,
– আমি ওয়াশরুমে যাই। ফ্রেশ হতে হবে।
পালানোর পায়তারা সফল হলো না। ঘুরে দাঁড়াতেই খপ করে হাত ধরে ফেলল সানান ভাই। প্রথম ছোঁয়ায় থরথর করে কেঁপে উঠল তার দেহ। সেই কম্পন যথাযথ অনুভব করেছে সানান ভাই। তার বুকের ভেতরটাও যে এভাবে কাঁপছে। তবুও শান্তভাবে বলল,
– আমার জন্য সাজলি, আমি দেখব না? এখনি ধুয়ে ফেলবি!
সাঁঝ এখনো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা পছন্দ হলো না সানান ভাইয়ের। অন্য হাতে থুতনি ধরে ওর মুখটা উঁচু করে ধরল। চোখে চোখ রাখতেই থমকে গেল দৃষ্টি। সানান ভাইকে এত কাছ থেকে আগে কখনো দেখেনি সাঁঝ। আজ প্রথমবার খেয়াল করল, তার চোখের রঙ গাঢ় বাদামি। গোলাকার বাদামি বলয়ের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে কালো বিন্দু। সাঁঝ যখন মনোযোগ দিয়ে কারো চোখ পড়ছিল, তখন আরেকজন আসক্ত হচ্ছিল তোতাপাখির মতোন লালচে ঠোঁট দুটোয়।
নেশাগ্রস্তের মতো সানান ভাই এগিয়ে গেল ওই ঠোঁট জোড়ার দিকে। তখনি ঘটল বিপত্তি। ধপ করে বিছানায় পড়ে গিয়ে ও মাগো বলে চিৎকার করে উঠল সাঁঝ। এমন আজব ঘটনায় কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে হো হো করে হেসে উঠল সানান ভাই।
সানান ভাইকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে দেখে পায়ে পায়ে পিছিয়ে যাচ্ছিল সাঁঝ। বিছানার শেষপ্রান্তে হোঁচট খেয়ে ঘটেছে এমন বিপত্তি।
মুখ অন্ধকার করে চিত হয়ে শুয়ে আছে সাঁঝ। সানান ভাই হাসতে হাসতে হেঁটে এসে ওর পাশে বসল। বলল,
– বিয়ের প্রথম রাতে একদম ধপাস করে আমার প্রেমে পড়ে গেলি, সাঁঝবাতি!
এমন লজ্জাজনক পরিস্থিতি সাঁঝের জন্য নতুন। একে তো বিয়ে বিষয়টা তার জন্য ভীষণ অস্বস্তিকর। তার উপর এভাবে চিৎপটাং হয়ে পড়ে যাওয়া। এই পাজি লোকটা এখন তার মজা উড়াবে।
সাঁঝ গোমড়া মুখ করে উঠতে নিয়ে বলল,
– আমি সায়রার রুমে ঘুমাবো।
বিছানায় কনুই ঠেকিয়ে একটুখানি উঠেছিল মাত্র। একটা শক্তপোক্ত হাত সাঁঝের উদর আঁকড়ে ধরে তাকে বালিশে ছুড়ে ফেলল। আতংকে চোখ দুটো খিচে বন্ধ করে নিয়েছিল সে। এবার পিটপিট করে চোখ খুলে চেয়ে দেখল মুখের উপর ঝুঁকে আছে সানান ভাই।
চিরচেনা মুখটায় অচেনা অভিব্যক্তি খেলা করছে। রমণী মন ঠিকই চিনে ফেলল সেই চঞ্চল চোখের ভাষা। তার গাঢ় নিঃশ্বাসের ব্যাকুলতা অনুধাবন করে ছটফট করে উঠল সাঁঝ।
সানান ভাইয়ের ভারি স্বর নিচু কণ্ঠে বলল,
– যে কারণে পড়িমরি করে বিয়ে করলাম, সেই কাজটা এখনো বাকি।
আতংকে জমে বরফ খণ্ডে পরিণত হলো সাঁঝ। শুধু ভয়ার্ত চোখ দুটো ঘুরিয়ে দেখল একখানা দানবাকৃতির হাত দুঃস্বপ্নের এতো এগিয়ে আসছে তার দিকে। পাট করে ভাঁজ করে রাখা জামদানী শাড়ির আঁচলটা সরে গেল বুকের উপর থেকে। কক্ষের উত্তপ্ত হাওয়া ত্বক ছুঁতেই আরেকবার ভয়াবহভাবে কেঁপে উঠল সাঁঝ।
আগ্নেয়গিরির উত্তাপে পুড়ে যাচ্ছে কাঁধের কাছটা। কারো নিঃশ্বাস হাওয়ার মতো গ্রীষ্মের হাওয়ার মতো দেহে অনুভূতি ছড়াতে পারে জানা ছিল না সাঁঝের। এরপর যখন আকস্মিকভাবে একজোড়া ঠোঁট বাম কাঁধের নগ্ন ত্বকে স্থির হলো, তখন শক্ত করে চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলল সে। দু হাতের মুঠোয় আঁকড়ে ধরল বিছানার চাদর।
মোম রঙা কোমল ত্বকে কতোক্ষণ বুদ হয়ে ছিল সানান ভাই নিজেও জানে। এই সর্বনাশী তিলটা ছুঁয়ে দেখার আজন্ম বাসনা তার। আজ গুনে গুনে সাত বছর পর অবশেষে বাসনা পূর্ণ হলো।
হঠাৎ খেয়াল হতেই ঝট করে মুখ তুলে সাঁঝের পাণে চাইল সানান ভাই। অবাক চোখে ভয়ার্ত হরিণীকে পর্যবেক্ষণ করে কানের উপর মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল,
– শ্বাস নে বেকুব। দম আটকে মারা পরবি যে।
সাঁঝের কোনো পরিবর্তন হলো না। সে এখনো শ্বাস আটকে মটকা মেরে পড়ে আছে। বাধ্য হয়ে সানান ভাইকে এ যাত্রায় রণে ভঙ্গ দিতে হলো। সাঁঝের উপর থেকে সরে এসে পাশের বালিশে কনুই ঠেকিয়ে শুয়ে পড়ে বলল,
– যাহ ছেড়ে দিলাম।
আটকে রাখা শ্বাসটা সশব্দে ছেড়ে দিল সাঁঝ। তারপর লম্বা শ্বাস নিল। এতক্ষণ শ্বাস আটকে রাখায় ফর্সা মুখটা লালচে হয়ে উঠেছে। শুকনো ঢোক গিলে চোখ খুলে ভয় নিয়ে তাকাল ডানপাশে।
রাক্ষসটা ওর দিকে চেয়ে আছে দেখে সাঁঝ চোখ ফিরিয়ে নিল। সানান ভাই ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
– তুই একটা আস্ত ভীতুর ডিম। পারিস শুধু সেজেগুজে পটের বিবি হয়ে বসে থাকতে।
বকা খেয়ে সাঁঝ ঠোঁট ফুলিয়ে নিচের দিকে তাকাতেই উন্মুক্ত উদর দেখতে পেল। চকিতে দ্রুত হাতে আঁচল টেনে ঢেকে নিল নিজেকে। ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ ভাবনায় ডুবে থেকে অতঃপর সাহস করে বলেই বসল।
– আমার ঘুম পাচ্ছে।
– ঘুমা। আমি কি তোকে বেঁধে রেখেছি?
অনুমতি পাওয়া মাত্র একপাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল সে। সানান ভাই বলল,
– তোর পিঠেও চমৎকার একটা তিল আছে দেখছি।
ঝট করে সোজা হলো সাঁঝ। বজ্জাত দর্জি ডিপ নেকের ব্লাউজ বানিয়ে দিয়েছে। এই অসভ্য লোকটার সামনে এটা পরে ঘুমানো কত রিস্কের সেটা ইতিমধ্যে সাঁঝের জানা হয়ে গেছে। উপায়ান্তর না পেয়ে টনটনে সোজা হয়ে চোখ খিচে পড়ে রইল সে।
*
রাত জাগা পুরনো অভ্যাস সানান ভাইয়ের। আজ আবার বিনিদ্র রজনীর উপযুক্ত কারণ সম্মুখে উপস্থিত। ঘুমের কি সাহস সানান ভাইয়ের দৃষ্টি রোধ করে!
সানান ভাইয়ের খুব কাছে ঘুমিয়ে আছে সাঁঝ। বাতাসে ভাসছে তার ভারি নিঃশ্বাস। সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখে ঘুম নামবে এটাই স্বাভাবিক।
বিয়ের ভারি সাজ এখনো সাঁঝের গায়ে। এভাবে ঘুমাতে ওর কষ্ট হবে। তাই উঠে বসল সানান ভাই। খুব সাবধানে একে একে খুলতে থাকল সাঁঝের গা ভর্তি গয়না। খোঁপার গোলাপগুলো তুলে নিয়ে খোঁপাটা খুলে দিয়ে চুলগুলো ছড়িয়ে দিল বাতাসে।
এত সবকিছুর মাঝে সাঁঝের ঘুমের একটুও ব্যাঘাত ঘটল না। এপর্যায়ে পাঠকদের জানিয়ে দেওয়া ভালো, পুরানের কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাতে পারে আমাদের সাঁঝবেলা। বিছানা থেকে তুলে পানির মধ্যে ফেলে দিলেও তার ঘুম ভাঙবে না। মাথার পাশে তবলা বাজিয়েও তাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা কষ্টসাধ্য।
ঠিক এই কারণেই এই সময়টিকে নিজের কার্যসিদ্ধির জন্য নির্বাচন করেছে সানান ভাই। গয়নাগুলো একপাশে গুছিয়ে রেখে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরল সাঁঝের হাত। আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল রেখে অপলক চোখে চেয়ে রইল শান্ত মুখটির দিকে। যেনো সে বিশ্বাস করতে পারছে না, সাঁঝকে সে সত্যি নিজের করে পেয়েছে।
অন্য হাতের সাঁঝের মুখমণ্ডলে হাত বুলিয়ে বলল,
– আজকে কয় তারিখ জানিস, সাঁঝবাতি? বিশ তারিখ। আমাদের প্রথম কবে দেখা হয়েছে সেটা মনে আছে? আমি নিশ্চিত তোর মনে নেই। সাত বছর আগে ঠিক আজকের দিনে আমাদের দেখা হয়েছিল। মে মাসের বিশ
আমরা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা এলাম। সেদিন আমার খুব মন খারাপ ছিল। কিছুতেই মন টিকছিল না এই অচেনা শহরে। বড়রা বাড়ির ভেতর নিজেদের আলোচনায় ব্যস্ত। আমি উদ্ভ্রান্তের মতো গলিতে একলা হাঁটছি। আম্মা এসে কয়েকবার ঢেকে গেছে। তবুও ভেতরে যাইনি।
চারদিকে অন্ধকার নামছিল। মেঘের আড়ালে লুকিয়েছে চাঁদ। অন্দর থেকে দাদীর গলা ভেসে আসছিল, সাঁঝ কই গেলি? বাতি জ্বলা। ঘরে আলো দে।
আওয়াজ শুনে আমি গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম সদর দরজার দিকে। হঠাৎ একটা আলো এসে আমার চোখের সামনে পড়ল। সাদা আলোর ছটা মিলিয়ে গেলে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো একটা নিষ্পাপ মুখ। মুখের সামনে ধরা রাখা হারিকেনের আলোয় তাকে চাঁদ বলে ভ্রম হয়। আমি তৎক্ষণাৎ তার নাম দিলাম সাঁঝবাতি।
তখন কতোই বা বয়স হবে তোর? দশ বোধহয়। মাত্র ফাইভে পড়িস। আমিও খুব একটা বড় ছিলাম না যে প্রথম দেখায় তোর প্রেমে পড়ে যাব। সেদিন বোধহয় আকৃষ্ট হয়েছিলাম।
প্রেমে পড়েছি আরেক সন্ধ্যায়। যেদিন প্রথমবার তোকে এভাবে গালের নিচে হাত রেখে ঘুমাতে দেখলাম, সেদিন আমার সর্বনাশ হলো। সেই গল্প আরেকদিন শোনাবো।
আজকে আরেকটা জরুরি কাজ বাকি আছে।
সানান ভাইয়ের একটা ছোট আলমারি আছে। সেটার উপরের ড্রয়ারগুলোতে শার্ট ভাঁজ করে রাখলেও একদম নিচের ড্রয়ারে একটা ডায়েরি রাখা আছে।
ডায়েরিটা নিয়ে এসে আবার সাঁঝের পাশে পা মুড়ে বসল সে। পাতা উল্টিয়ে চলে গেল একদম প্রথম পৃষ্ঠায়। সেখানে ডানপাশে কর্ণারে তারিখ লেখা। বিশ মে দুই হাজার বারো।
নিচে বড় করে লেখা “সাঁঝবাতি”।
এরপরে কয়েকটি পাতায় অল্প কিছু লেখা। পাতা উল্টিয়ে এক বছর পরের তারিখে চলে গেল সানান ভাই। দু হাজার তেরো সাল। ভাগ্যক্রমে সেটি ছিল মে মাসের শেষদিন।
পৃষ্ঠাটিতে লেখা,
“গভীর নিদ্রায় শায়িত ঘুমকুমারি,
তোমার মুদিত চক্ষু তরে নিবেদিত আমার সমস্ত ক্লান্তি।”
লেখাটায় হাত বুলিয়ে হাসি ফুটল সানান ভাইয়ের ঠোঁটে। অতঃপর সে চলে গেল সম্পূর্ণ নতুন একটি পৃষ্ঠায়।
ডানপাশে তারিখ লিখল, বিশ মে দুই হাজার উনিশ।
ডায়েরির পাতা খোলা রেখে গালে হাত দিয়ে সে চেয়ে রইল ঘুমন্ত সাঁঝের দিকে। অনেকক্ষণ গভীর চোখে পর্যবেক্ষণ করে কলম তুলে নিল হাতে। তারপর গুটি গুটি অক্ষরে লিখল,
“ঘনবারি কুন্তলরাশির মেঘকেশরী
তির তিরে কম্পিত তার চক্ষুপল্লব
ধনুসম বক্র ঘন কালো ভ্রু
শুষ্ক ওষ্ঠযুগল যেন কাঙ্ক্ষিত পুষ্পপল্লব।
অনতিকাল ধরে চেয়ে দেখি সুকান্ত মুখাবয়ব।
গভীর নিদ্রায় শায়িত ঘুমকুমারি,
তোমার মুদিত চক্ষু তরে নিবেদিত আমার সমস্ত ক্লান্তি।”
চলবে…
#অক্ষরময়ী
#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব ৩৮
ঘুমের মধ্যে গায়ের উপর চাপ অনুভব করল জুবিয়া। চোখ খুলে দেখল ঝিলিক ও তার মাঝে ঠেলেঠুলে জায়গা করে নিচ্ছে সাঁঝ। ঘুম ছুটে গেল ওর। দ্রুত উঠে বসে জিজ্ঞাসা করল,
– তুই এখানে কি করছিস?
বালিশে মাথা রেখে আরাম করে শুয়ে সাঁঝ বলল,
– তোরা আমাকে ওভাবে হুট করে ফেলে রেখে চলে এলি। এখন আমার ঘরে শান্তিতে ঘুমাচ্ছিস!
– কখন এলি?
– মাত্র এলাম।
এদের কথার শব্দে ঝিলিকের ঘুম ভেঙে গেছে। সাঁঝকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে বলল,
– এত সকালে তুই এখানে কীভাবে!
দুই বান্ধবী উঠে বসেছে। সাঁঝ উঠল না। শুয়ে থেকেই বলল,
– পায়ে হেঁটে।
– প্রথমদিনেই ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতি পারলি? আমি এত ক্লান্ত ছিলাম যে চোখ খুলে দেখি নয়টা বাজে।
কনুই দিয়ে খোঁচা মেরে ঝিলিককে থামিয়ে দিল জুবিয়া। সাঁঝ ভ্রু কুঁচকে উঠে বসতেই সে বলল,
– বিয়ের পরদিন সকালে এভাবে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি চলে আসতে নেই, সাঁঝ।
– কেনো? আসলে কী হয়?
অবুঝ চাহনিতে চাইল সাঁঝ। জুবিয়া উত্তর দেওয়ার আগে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো সাঁঝের মা। তিনি নাস্তা বানাচ্ছিলেন। এমন সময় সাওদা বেগম এসে বললেন,
– সাঁঝের মা, সাঁঝরে আইতে দেকলাম। মাইয়াটা গেল কই?
বৃদ্ধার কথা বিশ্বাস করেননি সাঁঝের মা। এখন স্বচক্ষে সাঁঝকে নিজের বিছানায় বসে থাকতে দেখে উনার চক্ষু চড়কগাছ। বিছানার শেষপ্রান্তে পা ঝুলিয়ে বসে জিজ্ঞাসা করলেন,
– কী হয়েছে? চলে এলি কেনো?
পিটপিট করে চেয়ে সাঁঝ জবাব দিল,
– কি আবার হবে? আমার বাড়িতে আমি আসতে পারব না?
স্বর্ণলতা উদ্বিগ্ন চোখে জুবিয়া ও ঝিলিকের দিকে তাকালেন। তারাও কিছু জানে না নিশ্চিত হয়ে মেয়েকে সূক্ষ্ম ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। সাঁঝের গায়ে বিয়েতে কেনা একটা গোলাপি রঙের সালোয়ার কামিজ। ভেজা লম্বা চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে আছে। মুখে চির চেনা লাবণ্য। তিনি স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বললেন,
– সানান কোথায়?
– ঘুমাচ্ছে।
গোমড়া মুখে উত্তর দিল সাঁঝ। স্বর্ণলতা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
– বিয়ের পরে এভাবে বাপের বাড়ি আসতে হয় না। নাইয়র আনতে আমরা যাব। তখন স্বামীসহ আসবি। এখন ফিরে যা।
মায়ের সাথে সহমত হতে পারল না সাঁঝ। সাহায্যের জন্য চাইল দুই বান্ধবীর দিকে। কিন্তু তাদের দেখে মনে হচ্ছে, তারাও মায়ের সাথে মত পোষণ করছে। সে মুখ ফুলিয়ে বিছানা থেকে নেমে ধুপধাপ পায়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। বাড়িতে উপস্থিত সকলে ইতিমধ্যে ঘুম থেকে উঠেছে। ঘুম ঘুম চোখে সাঁঝকে এ বাড়িতে দেখে তাদের ঘুম উড়ে গেল।
*
নবপরিণীতার ঘুমন্ত মুখটির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে জানা নেই সানান ভাইয়ের। দু দিকে পা ছড়িয়ে দেওয়া মাত্র ঘুমের মাঝেই মস্তিষ্ক সচেতন হয়ে উঠল। এখন সে একা নয়। বিছানায় আরেকজনও আছে। হাত পা ছড়িয়ে ঘুমালে চলবে না। পা গুটিয়ে নিয়ে ঘুমঘোরে সামান্য চোখ মেলে চাইল সে। দেখল পাশের স্থানটি ফাঁকা। চকিতে উঠে বসল। সাঁঝ কোথায়?
বিছানা থেকে নেমে দ্রুত পায়ে বাইরে এসে দেখল আফসানা ইতিমধ্যে নাস্তা বানানোর কাজ আরম্ভ করে দিয়েছে। ড্রয়িংরুমের সোফায় গড়াগড়ি দিচ্ছে সায়রা। দাদাভাইকে দেখে ছুটে এলো। ওকে কোলে তুলে মায়ের কাছে গেল সানান ভাই। চিন্তিত সুরে জানতে চাইল,
– সাঁঝবাতি কোথায়?
আফসানা বিরক্তিকর চাহনিভরা তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আবার মুখ ফিরিয়ে নিজের কাজ করতে লাগলেন। সানান ভাই ভ্রু কুচকে দেখল এমন কার্যকলাপ ফিরে এলো।
মর্নিং ওয়াক শেষে মাত্রই ঘরে প্রবেশ করেছেন সাবির। চোখের সামনে ছেলেকে দেখে পরিহাস করে বললেন,
– বিয়ের পরেরদিনই এতো উন্নতি! বিয়ের এত উপকারিতা আগে জানলে কয়েক বছর আগে তোর বিয়ে দিয়ে দিতাম।
তীক্ষ্মবাক্য উপেক্ষা করে সানান ভাই জিজ্ঞাসা করল,
– আমার বউকে দেখেছো?
– সেকি রে! এত তাড়াতাড়ি বউ হারিয়ে ফেলেছিস?
এত হেয়ালি নেওয়া যাচ্ছে না। সানান ভাই রেগে গিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল তখনি চোখে পড়ল পেছনে। দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করছে সাঁঝ। বাবাকে পাশ কাটিয়ে সাঁঝের নিকটে গিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল,
– কোথায় গিয়েছিলি?
বকা শোনা প্রস্তুতি নিয়েছিল সাঁঝ। এতোটা নরম সুর প্রত্যাশা করেনি। অবাক হলেও ভয়ার্ত কণ্ঠে জবাব দিল,
– ও বাড়িতে।
– জানিয়ে যাবি তো।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন সানান ভাই। তারপর সায়রাকে কোলে নিয়ে চলে গেল নিজের কক্ষে। ওকে বিছানায় নামিয়ে রেখে মুহুর্তের মধ্যে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
দু একঘন্টা বোধহয় ঘুমিয়েছে এরমধ্যে ডাকাডাকি শুরু। চোখ খুলতেই আফসানা বললেন,
– বউকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার রেওয়াজ আছে। বাজারসদাই করে নিয়ে যেতে হয়। তোর বাবার সাথে বাজারে যা।
সানান ভাই ভেবেছিল তিনবার কবুল বলে বউ নিয়ে আসবে। তারপর কাহিনি শেষ। কিন্তু বিয়ে যে এত ঝামেলার বিষয় কে জানত। সে বিছানা ছেড়ে উঠে বলল,
– এর থেকে পালিয়ে গিয়ে কাজি অফিসে বিয়ে করা ভালো ছিল। সেই যে পানচিনি দিয়ে শুরু হলো, তারপর তোমাদের রেওয়াজ শেষ হবার নাম নিচ্ছে না।
– যেতে ইচ্ছে না করলে যাবি না। বউকে একা পাঠিয়ে দে।
– রেওয়াজ চালু করেছো যেহেতু না মেনে উপায় আছে? আর বউকে একা পাঠিয়ে দিব মানে? বিয়ে করেছি বউয়ের সাথে থাকার জন্য। সে জাহান্নামে গেলেও আমি তার সাথে যাব।
আফসানা মুখ চোখ কুঁচকে ছেলের দিকে তাকালেন। এই মুখরা ছেলেকে নিয়ে হয়েছে যত জ্বালা। একদম দাদীর স্বভাব পেয়েছে।
সানান ভাই বাথরুমে ঢুকে আবার দরজা খুলে উঁকি দিয়ে বলল,
– মুখটা বাংলা পাঁচের মতো করে রেখেছো কেনো? ছেলের বিয়ে দিয়েছো। বাড়িতে নতুন বউ এসেছে। এই খুশিতে একটু হাসো।
*
বাজারসদাই যা করার সাবির শারাফাত করলেন। সানান ভাই শুধু পাশে দাঁড়িয়ে রইল আর দোকানিকে টাকা দিল। সাবির দাম পরিশোধ করতে চাইলে সানান ভাই বাঁধা দিয়েছে। তার শ্বশুরবাড়ির বাজার সে নিজের টাকায় করবে। সাবির আর জোর করেননি। একগাদা কেনাকাটা করে বিকালবেলা বউ নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে এসেছে সানান ভাই। এখানেও এসে দেখল চারপাশ লোকে লোকারণ্য।
ব্যাপার কি, যেখানেই যাচ্ছে সেখানেই সভা বসে যাচ্ছে। সে কি সাথে করে একদল মানুষ নিয়ে ঘুরছে? ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে ভাবনায় মগ্ন হলো সে।
ভালোভাবে খেয়াল করে দেখল, সে লোকজন নিয়ে ঘুরছে না। বরং নতুন বউয়ের আগে-পিছে মানুষজন গিজগিজ করছে।
একনাগাড়ে বসে থেকে, কিছুক্ষণ পর পর এটা-ওটা খেয়ে সানান ভাইয়ের নাভিশ্বাস দশা। সাথে করে যে বউটাকে নিয়ে এসেছিল, সেও জনসমুদ্রে কোথায় হারিয়ে গেছে।
একসময় অতিষ্ঠ হয়ে মেজ বাবাকে বলে দ্রুত পায়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। বাড়ির দিকে না গিয়ে বসল পল্লবের দোকানে। তাকে দেখে বন্ধুরা মুখ চিপে হাসছে।
বেঞ্চে ধপাস করে বসে সে বলল,
– বেশি করে আদা দিয়ে একটা রঙ চা দে, পল্লব।
বন্ধুর পেটে খোঁচা দিয়ে আজম বলল,
– খাওয়া কি বেশি হয়ে গেছে মামা? নতুন জামাইদের এরকম হয়। টেনশন নিস না, হজম হয়ে যাবে। বেশি বেশি পরিশ্রম করবি, তাহলে দেখবি বউও খুশি। স্বাস্থ্যও ফিটফাট।
প্রতিত্তোরে মাথায় জোরালো চাট্টি মেরে সানান ভাই বলল,
– চুপ শালা। আমার বউ তোর বোন লাগে। বুঝেশুনে কথা ক।
– এখন ভাবি হয়ে গেছে।
– তোদের সবার জন্য সে বোন। তার সম্পর্কে কোনো ভাবি স্বরূপ হাসি-মাজাক চলবে না।
গুঞ্জন হাসতে হাসতে বলল,
– ভাই চালাক আছে। বন্ধুর বউরে নিয়া মজা করতে পারলেও বোনরে নিয়া মজা করতে পারব না। এইজন্যে এই ব্যবস্থা।
– নতুন জামাই আমাদের বোনটাকে একা ফেলে রেখে এই শীতল রাতে চায়ের দোকানে কি করে?
উঠে গিয়ে চায়ের কাপটা নিয়ে ফিরে এলো সানান ভাই। গরম চায়ে সাবধানে চুমুক দিয়ে আজমের প্রশ্নের উত্তরে বলল,
– নতুন বিয়ে করে আচ্ছা মুশকিলে পড়েছি। যেখানেই যাচ্ছি সেখানেই মানুষজন ঘিরে ধরতেছে। শালার আমাদের পাড়ায় যে এত মাইয়া মানুষ আছে, আগে জানতাম না। সবাই এসে ঘিরে ধরতেছে আমার বউটাকে। যেন সাঁঝবাতি মধুর চাক। মৌমাছির মতো ভ্যানভ্যান করতেছে সবসময়। নিজের বউয়ের সাথে নিজেই শান্তিমতো দুটো কথা বলতে পারি নাই সারাদিন।
– বাঙালি বিয়েতে এরকমই হয় ভাই। কোনো প্রাইভেসি নাই। বিদেশে দেখেন না, বিয়ে শেষ হওয়া মাত্র বউ নিয়ে বর পালায় যায়। না হলে চলে যায় হানিমুনে। ভাই, আপনিও বউ নিয়ে হানিমুনে চলে যান। না হলে অন্তত এক সপ্তাহ বউয়ের কাছে ঘেষতে পারবেন না। এরপরে আবার শুরু হবে দাওয়াতের পালা। আজ এই শ্বশুর বাড়িতে দাওয়াত, তো কাল ওই ভাইয়ের বাড়িতে। জার্নি করতে করতে জীবনীশক্তি শেষ। রুমে ঢুকে শুধু ঘুম হবে। আর কিছু করার এনার্জি থাকবে না।
দোলনের কথার বিপরীতে রাগান্বিত দৃষ্টি ছুড়ে দিলেও কথাগুলো বেশ ভাবালো সানান ভাইকে। এক সপ্তাহ এভাবে নিজের বউয়ের দিকে দূর থেকে তৃষ্ণার্তের মত চেয়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এমনিতেই তার ভীরু বউ সবসময় তার থেকে দূরে থাকার সুযোগ খুঁজে। আত্মীয় স্বজনরা আরও সুবিধা করে দিচ্ছে।
*
– তোর বড় খালা কল দিয়েছিল। নতুন বউ নিয়ে ঘুরতে যেতে বলেছে।
মায়ের কথা শুনে প্লেট থেকে নজর সরিয়ে তার দিকে তাকাল সানান ভাই। ছেলের রুষ্ট চেহারা দেখে তিনি বললেন,
– আমি না করে দিয়েছি। বলেছি তোর অফিসে ছুটি নাই। যেতে পারবি না। এখন ওরা নতুন বউ দেখতে আসতে চাইতেছে।
– মানলাম আমার বউ অতি মূল্যবান। তাই বলে আমি কি মিউজিয়াম খুলে বসেছি। সবাই ছুটে আসছে বউ দেখতে!
সানান ভাইয়ের কথা শুনে তার বাবা ধমক দিয়ে বললেন,
– অসামাজিকের মতো কথা বলবি না। সবাই আগ্রহ নিয়ে নতুন বউ দেখতে আসবে এটাই স্বাভাবিক।
সানান ভাই মুখ অন্ধকার করে খেতে শুরু করল। অন্যদিকে যাকে নিয়ে এত কথা হচ্ছে সে মাথা নিচু করে চুপচাপ খাচ্ছে। এমনিতেই এই বাড়িতে সে কখনো স্বস্তিবোধ করেনি। সবসময় জড়তা নিয়ে চলাচল করত। বিয়ের পর সেই জড়তা আরও বেড়েছে। অদৃশ্য হয়ে চলাচল করতে পারলে সাঁঝের আরও ভালো লাগত। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। সারাদিন অচেনা মানুষজনের সামনে মাথায় ঘোমটা দিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে সে বিরক্ত। এখন আবার সানান ভাইয়ের খালা, মামারা আসবে। উনারা কেমন মানুষ কে জানে! আগে কখনো দেখা হয়নি। বড় মায়ের সাথে তার পরিবারের তেমন যোগাযোগ ছিল না।
এখানে আফসানা সম্পর্কে কিছু অতিরিক্ত কথা বলে নেওয়া ভালো।
আফসানা পারভীন, পৈতৃক নিবাস হালিশহর, চট্টগ্রাম। তিনি বাবা-মায়ের আট সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। সায়রার মতো তিনিও মায়ের শেষ বয়সের সন্তান। ফলস্বরূপ পাঁচ ভাই, দুই বোনের অত্যাধিক আদরে বড় হয়েছেন। প্রচণ্ড আহ্লাদী এবং জেদি আফসানা লেখা পড়ায় ভীষণ ভালো ছিলেন। তাই তো মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও পড়াশোনার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে কলেজ হোস্টেলে উঠার সাহস করেছিলেন।
সময়টা ১৯৯১ সাল। তখন মানুষজন এতোটাও উন্নত মানসিকতার ছিল না। তবুও আফসানার জেদের কাছে বাড়ির সবাই হার মানল।
বৃদ্ধ বাবা-মা এবং প্রাপ্তবয়স্ক ভাইবোনদের ছেড়ে একসময় তিনি চলে আসেন চট্টগ্রাম কলেজে। সেখানেই পরিচয় ঘরবাড়ি ছাড়া এক ছন্নছাড়া যুবকের সাথে। যে পড়াশোনার তাগিদে বাড়ির লোকজনের সাথে ঝগড়া করে ঘর ছেড়েছে। নামটি তার সাবির শারাফাত। সুদর্শন যুবকটি তখন অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। একাকী যুবকটির প্রতি মায়া অনুভব করতে গিয়ে কীভাবে যেন তাদের মধ্যে প্রেম হয়ে গেল। সে এক উথাল-পাথাল প্রেমকাহিনী।
দুজন নির্ভীক প্রেমিক প্রেমিকা চট্টগ্রাম শহরের রাস্তায় হাত ধরে হাঁটছিল, এই দৃশ্যটি দেখে ফেললেন আফসানার বড় ভাই। পরেরদিন উনাকে হোস্টেল থেকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হলো।
শাসন বারণ কিছুই মানলেন না দূরন্ত আফসানা। সপ্তাহ খানেক বাদে বাড়ি থেকে পালিয়ে এলেন সাবির শারাফাতের দরজায়। সেদিনই কাজি অফিসে বিয়ে করে নিলেন। শুরু হলো তাদের রূপকথার সংসার। বিনিময়ে বন্ধ হয়েছিল বাবার বাড়ির দরজা। তা নিয়ে খুব একটা আফসোস করেননি আফসানা। স্বামী সংসার নিয়ে দিব্যি আছেন। আর কি চাই!
পরের বছর ডিসেম্বরের কুয়াশাজড়ানো এক সকালবেলা সূর্যের আলোর মতো ঘরে এলো আফসানা-সাবিরের প্রথম সন্তান, সাইফান শারাফাত সানান।
এরপর কি আর কোনো হতাশা থাকতে পারে? সব ভুলে জীবনে অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়েছিলেন আফসানা। ততদিনে অনার্স শেষ করে হাইস্কুলে চাকরি নিয়েছেন। অভাবের সংসার ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিল, তখনি ঝড়ো হাওয়ায় উড়ো চিঠির মতো দুয়ারে এলো সাবির শারাফাতের পরকীয়ার খবর। এক মুহূর্তে সব হারিয়ে ফেললেন আফসানা।
ঘর ভাঙতে বসেছে, স্বামী চাকরি হারিয়েছে, সন্তান উচ্ছন্নে গেছে। আফসানার মনে হচ্ছিল তিনি জীবনের শেষ প্রান্তে চলে এসেছেন। বাবা-মাকে দেওয়া আঘাতের শাস্তি ইহকালেই কড়ায়গণ্ডায় বুঝিয়ে দিচ্ছেন সৃষ্টিকর্তা।
উপায় না পেয়ে হার মেনে নিয়ে উত্তাল সাগরে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। তখনি আবার ফিরে আসেন আপনজনেরা। হাত ধরে টেনে তুলেন অতল গহবর থেকে।
বেঁচে থাকাকালীন বাবার ক্ষমা উনার ভাগ্যে জুটেনি। মেয়ের চরম বিপদও টলাতে পারেনি আদর্শবান বাবাকে। তবে চুপ থাকতে পারেনি ভাইবোনেরা। ছোটবেলা থেকে তারাই যে আফসানাকে কোলে পিঠে মানুষ করেছেন।
সেইসময় বাবার ভয়ে লুকিয়ে চুপিয়ে যথাসম্ভব সাহায্য করেছিলেন। ফিরিয়ে দিয়েছিলেন হারিয়ে যাওয়া সবকিছু। ভেঙে যাওয়া সংসারের খণ্ডগুলো একটা একটা করে কুড়িয়ে সবাই মিলে জুড়ে দিয়েছেন। কিন্তু দাগগুলো মুছে দিতে পারেননি। সেগুলো আজও আফসানার হৃদয়ে দগদগে ক্ষত হয়ে বেঁচে আছে।
সেই যে যোগাযোগ শুরু হলো, তা আজও বিদ্যমান। বাবা-মা মারা গিয়েছে কিন্তু ভাই বোনেরা আজও বাবা-মায়ের মতো ছায়া হয়ে আছে আফসানার মাথার উপর। তারাই আফসানার শক্তি।
*
শাফিন আহমেদ নিজে হাতে চায়ের কাপটা তুলে দিলেন সানান ভাইয়ের হাতে। তারপর পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে বসে নিজের চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
– তোমাকে ডাকলাম বিয়ের শুভেচ্ছা জানাবো বলে। কিন্তু তুমি দেখছি মুখ গোমড়া করে বসে আছো। বিয়ে করে খুশি নও?
সানান ভাই আগের মতোই মুখ ভার রেখে জবাব দিল।
– আর বিয়ে! বউয়ের সাথে লুকোচুরি খেলে দিন কেটে যাচ্ছে।
তার কথা শাফিন আহমেদ বুঝলেন না। তাই সরাসরি পরবর্তী প্রশ্নে চলে গেলেন।
– হানিমুনে কবে যাচ্ছ?
– পারলে আজকেই চলে যেতাম। কিন্তু আমার বউয়ের ভিসা নেই।
– পাসপোর্ট আছে?
– আছে।
– আমাকে পাঠিয়ে দিও। ভিসার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কোথায় যেতে চাও?
– এমন কোথাও যেখানে কোনো মানুষজন আমাদের ডিস্টার্ব করবে না। চারপাশে এত মানুষজন দেখে আমি রীতিমতো বিরক্ত। ভাবছি মালদ্বীপের কোনো প্রাইভেট বীচে চলে যাব।
– প্রায় মাসখানেক আগে বুকিং দিয়েও এসব রিসোর্ট ফাঁকা পাওয়া যায় না।
সানান ভাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফায় পিঠ ঠেকিয়ে শাফিন আহমেদের দিকে তাকিয়ে বলল,
– ভেবেছিলাম বিয়ে করলে সব ঝামেলা মিটে যাবে। শান্তি অনুভব করব। এখন দেখছি আরও উদ্বিগ্নতা বাড়তেছে। অযাচিত অতিথিদের তাড়ানোর কোনো উপায় জানা আছে আপনার?
শাফিন আহমেদ ঠোঁট চেপে হাসলেন। এই ছেলেটিকে উনার ভীষণ পছন্দ। কিছুটা অগোছালো, কিছুটা বেপরোয়া। তাকে দেখলে মনে হয় যেন নিজের কৈশোরকে সামনে দেখছেন। টেবিলের উপর চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে সানান ভাইয়ের দিকে ঝুঁকে এলেন তিনি। দুই ভ্রুর মাঝে ভাঁজ ফেলে রহস্যজনক ভাবে বললেন,
– আই ক্যান সাজেস্ট ইউ অ্যা গুড প্লেস।
বাতাসে রহস্যের গন্ধ সানান ভাইয়ের ইন্দ্রিয় সক্রিয় করে তুলল। সোজা হয়ে বসে জানতে চাইল,
– টে মি।
– যদিও ব্যাপারটা একটু রিস্কি। কিন্তু আমি তোমাকে পছন্দ করি। স্নেহ করি বলে তোমার সাথে টপ সিক্রেট প্লেসটি শেয়ার করছি। আশা করি গোপনীয়তা রক্ষা করবে।
– আগে শুনি।
– ফিজি দেশের নাম শুনেছো?
– উহু।
– দক্ষিণ মহাসাগরে অবস্থিত একটি দেশ, ফিজি। একে বলা হয় দ্বীপের দেশ। বাংলাদেশ থেকে বেশ দূরে অবস্থিত। কিন্তু তুমি যেমন প্লেস খুঁজছ তেমন অনেক রিসোর্ট পাবে ফিজিতে। এই দেশের কোণায় কোণায় লুকিয়ে আছে ছোট-বড় অনেক দ্বীপ।
– ভিসা পাওয়া যাবে?
– আই ক্যান ম্যানেজ।
– রিসোর্ট?
– এখানেই রয়েছে টুইস্ট। যা বলছি মনোযোগ দিয়ে শোনো।
ফিজির লোমাইভিটি দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপ ইয়াদুয়া তাবু। খুব বেশি বড় নয়। ছোট একটা দ্বীপ। প্রায় সাত লাখ এক হাজার বর্গমিটার হবে। এখানে একসময় ফিজিয়ান ক্রেস্টেড ইগুয়ানারা বাস করত। এখন তারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে অথবা পাশের মূল দ্বীপ ইয়াদুয়াতে চলে গেছে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, জনবসতি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পর ফিজির বায়োডাইভার্সিটি স্ট্র্যাটেজি ও অ্যাকশন প্ল্যানের অধীনে একটিকে জাতীয় গুরুত্বসম্পন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এখন এটি জাতীয় সংরক্ষণ এলাকা হওয়ায় এখানে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
সানান ভাই এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। পৃথিবীতে এত চমৎকার একটি দেশ আছে তার জানা ছিল না। যেখানে আমাদের দেশে একটা মাত্র দ্বীপ, সেখানে এটি দ্বীপের দেশ। শুনতে শুনতে মনে অনেক স্বপ্ন এঁকে ফেলেছিল সে। অথচ এই লোক এখন বলছে, সেখানে জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ।
মুখে বিরক্তিকর শব্দ উচ্চারণ করে শাফিন আহমেদের কাছ থেকে সরে বসল সানান ভাই। মুখ ভার করে বলল,
– যেখানে প্রবেশ নিষেধ, সেখানকার গল্প শুনে আমার কি লাভ?
– আহা! পুরোটা শোনো আগে। প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া বনটি রক্ষার জন্য ফিজির বন বিভাগ কাজ করছে। প্রায়শই যেখানে যাতায়াত করতে হয় বন বিভাগের অফিসারদের। তাই অফিসারদের বিশ্রামের জন্য সরকারিভাবে একটি ছোট কটেজ তৈরি করা হয়েছে সেখানে।
– এক মিনিট। আপনি আমাদের সেই কটেজে পাঠানোর কথা ভাবছেন?
– এতক্ষণে বুঝলে?
– ওটা সরকারি প্রতিষ্ঠানের কটেজ। জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ এলাকায় আমাদের ঢুকতেই দিবে না। রাত্রিযাপন তো দূরের কথা।
– এখানেই আমার কারসাজি। ফিজির বন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ওসিয়া নাইকামু। উনার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট এর নাম সাইকস কাভিরা। লোকটা আস্ত হারামি। ভীষণ ধূর্ত। যেহেতু জায়গাটা নিষিদ্ধ তাই এরকম জায়গার চাহিদা কীরকম তুমি নিশ্চয়ই আন্দাজ করে পারছ।
– পারছি। সৃষ্টির শুরু থেকে নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের তীব্র আকর্ষণ রয়েছে।
– সেই আকর্ষণটাকেই পুজি করে বিজনেস করছে কাভিরা। সরকারি ভাবে বছরে দু একবার দ্বীপ পরিদর্শনে যায় বন বিভাগের লোকজন। বাকিসময় কটেজটাকে ইলিগ্যালভাবে রেন্ট দেওয়া হয়। গোপনে কটেজ বুকিং নেওয়ার জন্য একটি এজেন্সি চালু করেছে কাভিরা। শুধুমাত্র বিভিন্ন দেশের প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই বুকিং দিতে পারে। তুমি চাইলে আমি তোমাদের জন্য বুকিং দিতে পারি। কাভিরার সাথে আমার বেশ ভালো সম্পর্ক রয়েছে। আমি চাইলে না করবে না। ভিসা থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ চোখের পলকে করে দিবে।
– কাজটা কতোটা ঝুঁকিপূর্ণ?
– গোপনীয় রাখতে পারলে কোনো ঝুঁকি নাই। আমি নিজেই বেশ কয়েকবার গিয়েছি।
– নিশ্চয়ই সস্ত্রীক নয়।
প্রশ্ন শুনে শাফিন আহমেদ হো হো করে হেসে উঠলেন। এজন্যই সানানকে পছন্দ করেন তিনি। হাসি মুখে প্রশ্ন করলেন,
– তাহলে? রিস্ক নিতে চাইছ?
– আ’ম অ্যা থ্রিলার লাভার। তাই না করার প্রশ্নই আসে না। কী নাম সেই কটেজের?
– ভাকাভুই।
– ইন্টারেস্টিং নেম।
– ফিজিয়ান শব্দ। অনুবাদ করলে হয় রিবিল্ড, পুনরুজ্জীবন।
– ঠিক আছে। আমি আজকেই পাসপোর্ট পাঠিয়ে দিচ্ছি আপনাকে।
*
দুটো দিন কী দুঃসহ যন্ত্রণায় কেটেছে তা একমাত্র সানান ভাই জানে। বিয়ের পর কক্ষের দরজা বন্ধ করে বউয়ের ভয় ভাঙানোর কথা ছিল তার।
অথচ বাড়ি শুদ্ধ লোকজন সানান ভাইয়ের বউটাকে দখল করে বসে আছে। সে কি তার সাঁঝবাতিকে দেখবে! পাড়ার বুড়িগুলো তার সাঁঝবাতিকে সামনে বসিয়ে রেখে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। পাশে বসিয়ে রেখে গল্প করে। আর সাঁঝবাতিকেও বলি হায়! ওদের সামনে দাঁত বের হাসতে হবে কেনো? সানান ভাইয়ের সামনে দাঁড়ালে তার হাসি গায়েব হয়ে যায়। এমন ভয় পায় যেন সাক্ষাৎ যমদূত দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে।
গত দুই রাত অপেক্ষা করতে করতে একসময় বিরক্ত হয়ে বন্ধুদের আড্ডায় চলে গিয়েছিল সানান ভাই। ও মা! ফিরে এসে দেখে বিছানার কোণাকুণি হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে পাঁজি মেয়েটা। তখনি সানান ভাই ওর চালাকি ধরতে পেরেছিল। এখন দেখবে কতদিন চলে এই লুকোচুরি খেলা।
সাঁঝের বিয়ের আজ চতুর্থদিন। আজকে রান্নাঘরে যেতে হয়েছে ওকে। দুপুরে সবার জন্য রান্না করেছে। রান্না ঠিকঠাক হলেও খাবার সার্ভ করতে একটু দেরী হয়ে গেল। তিনটা পার হয়ে গেছে দেখে আঁচলে মাথা ঢেকে গুটিগুটি পায়ে সানান ভাইয়ের ঘরে উপস্থিত হলো সে।
পায়ের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে করল,
– টেবিলে খাবার দিয়েছি।
– আসতেছি।
ব্যস্ত সানান ভাই ফিরে না তাকিয়েই উত্তর দিল। সাঁঝ চলে যেতে নিয়েও ঘুরে তাকাল। বলল,
– আপনি কোথাও যাচ্ছেন, সানান ভাই?
ব্যাগে শার্ট-প্যান্ট দুটো একপ্রকার ছুঁড়ে ফেলে সানান ভাই তাকাল সাঁঝের দিকে৷ কোমড়ে দুই হাত রেখে বলল,
– হ্যাঁ যাচ্ছি। আজকে থেকে তোকে আর আমাকে পাহারা দিতে না। আমি কখন বাড়ির বাইরে যাচ্ছি সেই সুযোগে চোরের মতো ঘরে এসে ঘুমিয়ে পড়তে হবে না।
সাঁঝ দ্রুত পায়ে সেখান থেকে পালিয়ে এলো। ডাইনিংরুমের চেয়ারে বসে আছেন আফসানা। ছেলের অপেক্ষা করছেন। সাঁঝ এসে বলল,
– বড় মা, সানান ভাই কোথায় যাচ্ছে?
আফসানা ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। এই মেয়ে এখনো সানানকে ভাই ডাকছে শুনে বিরক্ত হলেও মনোযোগ দিলেন তার প্রশ্নে। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
– কোথায় যাচ্ছি আমি কীভাবে জানব? সর দেখি।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে সকলে গিয়ে উপস্থিত হলো সানান ভাইয়ের কক্ষে। তা দেখে সানান ভাই অবাক হয়ে বলল,
– আরে বাহ! এর মধ্যে পুরো পল্টন হাজির!
সাবা এগিয়ে গিয়ে তার ব্যাগে উকি দিয়ে বললেন,
– ব্যাগ গুছিয়ে কোথায় চললি?
– হানিমুনে যাচ্ছি।
– সেকি! কেনো?
– কেনো মানে? বিয়ের পর সবাই হানিমুনে যায়। আমিও যাচ্ছি।
সারা গা দুলিয়ে হাসলেন। সাঁঝের দিকে চেয়ে বললেন,
– বউ রেখে একা হানিমুনে যাচ্ছিস?
– বউ রেখে যাব কেনো? ওকে নিয়ে পালাবো বলেই হানিমুন প্ল্যান করেছি।
– নিজের বাড়ি থেকে বউ নিয়ে পালাবি?
– তোমরা যেভাবে আমার বউকে আটকে রেখেছো! এছাড়া আর কোনো উপায় নেই আমার কাছে।
– বড্ড নির্লজ্জ হয়েছিল। মেহমানকে কেউ এভাবে বলে?
– তোমরা মেহমান? আমি তো পরিবার বলে জানতাম। মেহমান মানলে এতক্ষণে গাড়ি ডেকে বিদায় করে দিতাম না?
কথাগুলো অপমান নাকি প্রশংসা হিসেবে গ্রহন করবে ভেবে পেলেন না সারা। তাই আর কথা না বাড়িয়ে উনারা বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে অবশ্য সাঁঝকে ডাকতে ভুললেন না।
– সাঁঝ তাড়াতাড়ি আয় ক্ষুধা লেগেছে। সারাদিন ব্যয় করে কী যে রান্না করলি! মুখে দিতে পারলে হয়।
– ভালো খাবার সবার পেটে সয় না, ফুপু। মানুষ ভেদে রুচি আলাদা।
সাথেই উত্তর দিলেন সানান ভাই। ঝগড়ুটে ছেলের বাহুতে চাট্টি মেরে চুপ করালেন আফসানা। সবাই বেরিয়ে যেতেই ছেলের সামনে বসে বললেন,
– এসব কী?
– হানিমুন ট্রিপ।
– আগে বলিসনি তো।
– মাকে বলব, আম্মা আমি হানিমুনে যেতে চাই? আমার লজ্জা লাগবে না বুঝি।
– হুম। খুব লজ্জাবোধ হয়েছে তোর। দেখে চোখ জ্বলে যাচ্ছে আমার। তা কোথায় যাচ্ছিস?
– ফিজি।
– সেটা আবার কোথায়?
– আছে একটা দেশ। তুমি চিনবে না।
– একলা একা অচেনা দেশে যাওয়ার কি দরকার? ভারত, নেপাল থেকে ঘুরে আসতে পারতি।
– ওসব নিয়ে চিন্তা করো না। ওখানে আমার পরিচিত লোক আছে।
খাওয়া শেষ করে সাঁঝকে একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়ে এলো সানান ভাই। দরজা লক করে বলল,
– জামা কাপড় গোছা। সাড়ে এগারোটায় প্লেন।
সাঁঝ এতক্ষণে মনের কথা বলার সুযোগ পেলো। মিনমিন করে নিচু স্বরে বলল,
– আমি যাব না।
সানান ভাই শান্তভাবে সাঁঝের সামনে এসে দাঁড়ালো। ঝুঁকিয়ে রাখা থুতনিতে এক আঙ্গুল রেখে ওর মুখটা উঁচু করে ধরে শীতল কণ্ঠে বলল,
– নিজ ইচ্ছায় যেতে না চাইলে হাত পা বেঁধে লাগেজে ভরে নিয়ে যাব।
তারপর ভয়ার্ত সাঁঝের থুতনি ছেড়ে দিয়ে বিছানার দিকে হাঁটল। মেঝে থেকে ব্যাগটা তুলে বিছানার উপর রাখতে রাখতে বলল,
– আর হ্যাঁ। সবসময় এমন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলে একদিন দেখবি বুকের সাথে থুতনি জোড়া লেগে গেছে।
সেসব অগ্রাহ্য করে সাঁঝ ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল,
– আমি বাড়ি যাব।
– এই ব্যাগের অর্ধেকটা ফাঁকা আছে। এইটুকু জায়গায় যে কয়টা কাপড় আটবে সেই কয়েকটাই তোর সম্বল। আটা ময়লার বক্স রেখে শুধু খুব জরুরি জিনিসপত্র নিবি। দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কাজে লেগে পড়। হাতে বেশি সময় নেই।
বাধ্যতা সাঁঝের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবাহিত। চাইলেও মনমর্জির পক্ষে জোরালো আওয়াজ তুলতে পারল না। ঘোলাটে চোখে এগিয়ে গেল নিজের লাগেজের দিকে। আলমারি গুছানোর সময় পায়নি এখনও। ও বাড়ি থেকে যা এনেছে তা লাগেজে রয়ে গেছে।
লাগেজ থেকে কাপড় তুলে বিছানার উপর রাখল। পাশে বসে থাকা সানান ভাই সেখান থেকে অপছন্দের কাপড়গুলো সরিয়ে রেখে নিজের পছন্দের একটি সালোয়ার কামিজ, তিনটে শাড়ি বাছাই করে সাঁঝের হাতে তুলে দিল।
– চোখ থেকে যেনো এক ফোঁটা পানি না পড়ে। এখন কান্নাকাটি শুরু করলে খুব খারাপ হবে কিন্তু।
সানান ভাইয়ের কথা শুনে সাঁঝের জলে টইটম্বুর আঁখি জোড়া অভিমানে আরও ফুলে ফেঁপে উঠল। জেদ দেখিয়ে মাথার আঁচল ফেলে দিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেল কক্ষের বাইরে। এই বাড়িতেই থাকবে না সে।
চলবে..
#অক্ষরময়ী