এই সাঁঝবাতি পর্ব-৩৯

0
15

#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব ৩৯

কুড়িগ্রাম থেকে একটি ট্রাক যাচ্ছে ঢাকার উদ্দেশ্যে। সেটাতে উঠে বসেছে কয়েকজন যুবক। কয়েকদিনের নিরলস পরিশ্রমে তারা ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। ব্যাগপত্র যত্রতত্র ফেলে রেখে ট্রাকের ধুলো ময়লা যুক্ত মেঝেতে শুয়ে পড়েছে।

মাথার উপরে রাতের অন্ধকার আকাশ। পশ্চিম দিক হতে আধা ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদটি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। মাঝেমধ্যে মেঘ ঢেকে দিচ্ছে চাঁদের গরিমা। চাঁদের সাথে মেঘের এই লুকোচুরি খেলা দেখে তাশফীনের মুখে আলতো হাসি ফুটল।

রাতের জ্যামবিহীন রাস্তায় অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রাকটি পৌঁছে গেছে রংপুর শহরে। মর্ডান মোড়ের একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকে সকলে ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খেলো। এই ফাঁকে বন্ধ মোবাইল ফোনগুলোতে চার্জ দিয়ে নিয়েছে।

ট্রাকে উঠার আগে মাকে কল দিল তাশফীন। ছেলে ঠিকঠাক আছে শোনার পর যেন জীবনীশক্তি ফিরে পেলেন মাধবীলতা। বললেন,

– সোজা বাড়ি চলে এসো।

– বাসায় গিয়ে একদিন রেস্ট নিয়ে তারপর যাব।

– নাহ। বাসায় যাওয়ার দরকার নাই। যে কয়েকদিন ছুটি আছে আমার কাছে এসো থাকো। ওখানে কি না কি খেয়েদেয়ে ছিলে! শরীরের অবস্থা নিশ্চয়ই খারাপ করে ফেলেছো।

– এক সপ্তাহের ছুটি আছে মা। আপাতত বাসায় গিয়ে ঘুমাব। এখানে ওখানে ছুটাছুটি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এই মুহূর্তে আর জার্নি করতে ইচ্ছে করছে না।

– তাশফীন, তুমি আমার কথা শুনছ না কেনো? বললাম না বাড়ি আসতে।

মায়ের কঠিন ধমকে চমকে উঠল তাশফীন। মমতাময়ী মা হঠাৎ কেন এভাবে কথা বলছে? দ্রুত সচেতন হয়ে জিজ্ঞাসা করল,

– এভাবে কথা বলছ কেনো? তুমি ঠিক আছ? বাবা কিছু বলেছে তোমাকে? ঝগড়া হয়েছে তোমাদের?

একমাত্র সন্তানের সাথে কখনো কড়া সুরে কথা বলেননি মাধবীলতা। আজ নিজের অসহায়ত্ব ধরে রাখতে না পেরে বিরূপ আচরণ করে বসলেন। পরমুহূর্তেই অবশ্য থমকে গেলেন। ছেলের চিন্তিত কণ্ঠস্বর শুনে বুকের ভেতরে ব্যথা অনুভব হলো।

– আমি ঠিক আছে। তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সিলেট আসো। জরুরি প্রয়োজন।

গম্ভীর সুরে কথাগুলো বলে কল কেটে দিলেন তিনি। তাশফীন পড়ে গেলো মুশকিলে। মায়ের অস্বাভাবিক আচরণ দায়িত্বশীল তাশফীনকে স্বস্তিতে থাকতে দিল না। ট্রাক হতে সহকর্মীরা ডাকছে। এখনো অনেকটা পথ যেতে হবে।

মোবাইল পকেটে রেখে সে এগিয়ে গেল। ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করল,

– এখান থেকে এয়ারপোর্ট কতদূরে বলতে পারবেন?

প্রশ্ন শুনে ড্রাইভারকে বেশ চিন্তিত দেখাল। পাশে বসে থাকা সহকারীকে জিজ্ঞাসা করল,

– তুই চিনিস নাকি সুমন?

সদ্য যুবক সুমন, লেখাপড়া বেশিদূর না করলেও ভীষণ বুদ্ধিমান। লোকজনের কথাবার্তা মনোযোগ দিয়ে শুনে। সেই সুবাদে অনেক তথ্য তার জানা। সে বিজ্ঞ ব্যক্তির মতো মাথা দুলিয়ে বলল,

– রংপুরে কোনো এয়ারপোর্ট নাই। প্লেনে চড়তে চাইলে আপনাকে সৈয়দপুর যেতে হবে।

– সেটা এখান থেকে কতদূর?

– বাসে চল্লিশ মিনিটের মতো লাগবে।

– গাড়ি পাব?

– মেডিকেল মোড় থেকে গেটলক যায়। কিন্তু এত রাতে গেটলক পাবেন না। সব চইলা গেছে। আপনি এক কাজ করেন। ঢাকার কোচ যেগুলা ফিরত আসতেছে সেগুলাতে উঠে পড়েন। বাসস্ট্যান্ড থেকে রিক্সা বা অটো নিয়ে এয়ারপোর্ট চলে যাবেন।

– ধন্যবাদ।

তাশফীনের এভাবে হঠাৎ করে অন্য পথে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তে সহকর্মীরা চিন্তিত। সে ওদের বুঝিয়ে বলল। জরুরি ভিত্তিতে বাড়ি যেতে হবে। তারা যেন চিন্তা না করে। পৌঁছে সবাইকে জানিয়ে দিবে।

সৈয়দপুর থেকে ঢাকা, এরপর ঢাকা থেকে সিলেট। এভাবেই বাড়ি পৌঁছানোর পরিকল্পনা সাজিয়েছে সে। পরিকল্পনা অনুসারে অল্প সময়ের মধ্যে শাহজালাল বিমানবন্দরে পৌঁছে গেল। ভাগ্য ভালো ছিল বলে লাস্ট ফ্লাইটটি যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দেড় ঘন্টা দেরীতে ছাড়ল।

তাশফীন যখন এয়ারপোর্টের জেট ব্রিজ দিয়ে দ্রুত পায়ে প্লেনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো, তখন দুটো পরিচিত মুখ এয়ারপোর্টে প্রবেশ করল মাত্র।

*

মাঝরাতে ছেলেকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মাধবীলতা হতবাক হয়ে গেলেন। তোহাজ শিকদার নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করেন। দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। অসময়ে কলিংবেলের শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেলেও বিছানা ছাড়েননি। অনেকক্ষণ যাবত স্ত্রীকে ফেরত আসতে না দেখে বিছানা ছেড়ে উঠে এসে ড্রয়িংরুমে ছেলেকে দেখে তিনিও খানিক সময়ের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।

– অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছে। ওকে রুমে যেতে দাও। বাকি কান্নাকাটি সকালে করো।

ছেলের রোদে পোড়া কালচে চেহারা, জলে ভেজা স্যাঁতসেঁতে হাত পা, উসকোখুসকো চুল দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন মাধবীলতা। স্বামীর কথা শুনে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালেন।

– রাতে কিছু খেয়েছো?

– আমি খেয়ে এসেছি। তোমার কি হয়েছে বলো? ফোনে এত অস্থিরভাবে কথা বলছিলে কেনো?

– তোমার জন্য চিন্তা হচ্ছিল। এখন চোখের সামনে সুস্থ ভাবে দাঁড়িয়ে আছো দেখলাম। আমার শান্তি হলো। যাও গিয়ে রেস্ট নেও। সকালে কথা হবে।

নিজের কক্ষে শুয়ে সাঁঝের কথা ভাবছে তাশফীন। কতদিন মেয়েটার সাথে কথা হয় না। পীড়িত লোকজনের সেবায় ব্যস্ত দিনরাত কেটেছে বলে এতদিন প্রেয়সীকে মন করার সময় পায়নি। কিন্তু এখন বিস্তর অবসরে মনটা তার বেলার জন্য উচাটন হয়ে আছে।

আগে বাবার ফোনটা প্রায়শই নিজের কাছে রাখত সাঁঝ। ফেসবুক একাউন্ট খোলার ব্যাপারটা জানাজানি হওয়ার পর ফোন হাতে নেওয়া বন্ধ হয়ে গেল।

তাশফীন চিন্তাবোধ করলেও এত রাতে আর কল দিয়ে সাঁঝের সাথে কথা বলা সম্ভব হলো না।

সামান্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে। তবে তা নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবার সুযোগ পেল না। অল্প সময়ের মধ্যে ক্লান্ত দেহটি নিমজ্জিত হলো ঘুমের জগতে।

*

বাড়ির সকলের চোখের সামনে থেকে একপ্রকার ছোঁ মেরে নিয়ে আসা হয়েছে সাঁঝকে। অভিমানী স্বর্ণলতা কিছু না বললেও ঘোর আপত্তি জানিয়েছেন সাদিক। কিন্তু সানান ভাইয়ের কথার তোপে কেউ টিকতে পারেনি। এক ঘন্টার নোটিশে বিবাহিত স্ত্রীকে বগলদাবা করে চলে এসেছে এয়ারপোর্টে। সাবির শারাফাত ছেলের সাথে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত আসতে চেয়েছিলেন। কাউকে সাথে আনেনি সানান ভাই।

সিএনজি থেকে নেমে এয়ারপোর্টের সুউচ্চ ভবন, অচেনা মানুষজন, কোলাহল দেখে মিইয়ে গেল সাঁঝ। অন্যদিকে উচ্ছ্বসিত সানান ভাই সিএনজি থেকে ব্যাগ নামিয়ে তাকে ডাকল,

– চল ভেতরে যাই।

দু তিনটে সিড়ির ধাপ পেরিয়ে সানান ভাই দ্রুত পায়ে ভবনের ভেতরের দিকে হাটতে শুরু করেছে। তাকে ফেলে একাই চলে যাচ্ছে!

সাঁঝ অবাক চোখে চেয়ে থেকে একপ্রকার ছুটে গিয়ে একহাতে জড়িয়ে ধরল তার হাতের কনুই।

আকস্মিক ঘটনায় সানান ভাই থমকে দাঁড়ালো। এই প্রথম সাঁঝবাতি নিজে থেকে ছুঁয়ে দিল।

জীবনের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশের উত্তেজনায় এত অস্থির ছিল যে কিছু মুহূর্তের জন্য সাঁঝের প্রতি মনোযোগ কমে গেছে। নিজস্ব কর্মকাণ্ডে অনুতপ্ত বোধ করল সে।

সাঁঝের হাতটি নিজের হাতে বন্দী করে নিয়ে চিকন আঙ্গুলের ভাজে নিজের আঙ্গুল জড়িয়ে নিয়ে মৃদু হেসে নরম সুরে বলল,

– ভয় পাচ্ছিস?

সাঁঝ দুদিকে মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানাল। ভয়ের চেয়ে অস্বস্তি হচ্ছে বেশি। সালোয়ার কামিজ পরিহিতা সাঁঝকে কুর্তি, প্যান্ট পরিয়েছে সানান ভাই। তাই নিয়ে সামান্য অস্বস্তি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে।

বাকিটা পথ হাতে হাত রেখে, পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটল ওরা। প্লেনের নির্দিষ্ট সীটে বসেও সানান ভাই সেই হাত ছাড়ল না।

*

খাবার টেবিলে ছু’রির সাহায্যে ব্রেড কেটে কাটা চামচে তুলে নিলেন তোহাজ শিকদার। খাবার মুখে পুড়ে আড়চোখে তাকালেন মাধবীলতার দিকে। সেদিনের পর অভিমানী স্ত্রী লোকটি তাঁর সাথে কথাবার্তা বন্ধ করে দিয়েছে। তা নিয়ে রুষ্ট হননি তিনি। মাঝেমধ্যে স্ত্রীর অভিমান দেখতে ভালো লাগে।

চেয়ার টেনে মায়ের উল্টোদিকে মুখোমুখি বসল তাশফীন। হাসি মুখে সকালের শুভেচ্ছা জানাল।

– গুড মর্নিং।

তোহাজ শিকদার হাসি মুখে উত্তর দিলেন,

– গুড মর্নিং মাই বয়। ক্যাম্পেইন কেমন হলো?

– বেশ ভালোভাবে সম্পন্ন হয়েছে। আমরা যথাযথ সময়ে উপস্থিত হওয়ায় তেমন কোনো জটিল রোগ ছড়াতে পারেনি। যথেষ্ট মেডিসিন সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম বলে সবাইকে প্রপার ট্রিটমেন্ট দিতে পেরেছি। থ্যাংকস টু দ্যা গায় হু গিভ দ্যা ডোনেশন।

– তুমি আমাকে বলতে পারতে। আই ক্যান হেল্প।

– প্রফেসর নিজে ডোনেশনের ব্যাপারটা দেখছিলেন। এজন্য তোমাকে জানাইনি।

– আই সি।

প্লেটে খাবার তুলে নিয়ে তাশফীন সরু চোখে তাকাল মায়ের দিকে। কেমন যেনো মনমরা দেখাচ্ছে!

– তোমার কি হয়েছে, মা? শরীর খারাপ লাগছে?

– নাহ। আমি ঠিক আছি।

– মুখ শুকনা লাগছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে। ব্রেকফাস্ট শেষ করে তোমার প্রেশার মেপে দেখব।

– দরকার নাই। প্রেশার নর্মাল আছে।

– সেটা চেক করলে বুঝা যাবে। তোমার সাথে খালামনির কথা হয়েছে? সকালে কয়েকবার কল দিলাম, কেউ রিসিভ করল না।

ছেলের কথা শুনে মাধবীলতা শুকনো মুখে তাকালেন তোহাজ শিকদারের দিকে। তিনি স্বাভাবিকভাবে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। মায়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাশফীনও বাবার দিকে তাকাল। গতকাল থেকে এত রহস্য দেখতে দেখতে সে ক্লান্ত।
প্রশ্ন করার আগেই তোহাজ শিকদার তার গমগমে গলায় বলল,

– মেয়ের বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত আছে বোধহয়।

কথাটি বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল তাশফীনের। এতক্ষণ ব্রেডে মনমতো জ্যাম লাগিয়েছে। দু হাতে তাতে তুলে কামড় বসাতেই যাচ্ছিল। বাবার কথা শুনে হাতটা থমকে গেল। ব্রেডটি প্লেটে ফেরত রেখে সন্দিহান গলায় বলল,

– মেয়ের বিয়ে মানে?

তোহাজ শিকদার উত্তর না দিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। উপায়ন্তর না দেখে সে এবার মাকে প্রশ্ন করল,

– বাবা কার কথা বলছে মা?

থমথমে মুখে জবাব দিলেন মাধবীলতা। বুকে পাথর চেপে বললেন,

– গত বিশ তারিখ সাঁঝের বিয়ে হয়ে গেছে।

অনেকক্ষণ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না তাশফীন। যেন মায়ের কথাটি সে বুঝতেই পারেনি এমনভাবে অপলক চেয়ে রইল মায়ের দিকে। কিন্তু মাধবীলতা স্পষ্ট দেখলেন, ছেলের হাত মৃদু কাঁপছে। সান্ত্বনা জানানোর ভাষা খুঁজে পেলেন না তিনি। মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলতে শুরু করলেন।

– তোমার খালামনির তাড়া বেশি। এক দুদিনের প্রিপারেশন কীভাবে যেন মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিল। অবশ্য ওদের যা আয়োজন! দু চারটে লাইট, আর রঙিন সামিয়ানা। এসব সস্তা আয়োজন করতে বেশি সময়ের দরকার হয় না। আমাদের ছেলেমেয়ের বিয়ের আয়োজন করতে মাস খানেক লেগে যায়। ইমপোর্টেন্ট গেস্টদের শিডিউল পাওয়া মুশকিল।

তোহাজ শিকদার আরও কি কি যেন বলছিল, সেসব তাশফীনের কানে এলো না। একটা তীক্ষ্ণ তরঙ্গ তার কানে এসে ধাক্কা দিচ্ছে অনবরত। মাইকে সিগনালের সমস্যা হলে একটা বিদঘুটে শব্দ কান ঝালাপালা করে দেয় না? ঠিক সেরকম শব্দ। সে কান চেপে ধরল না। মস্তিষ্ককে যন্ত্রণা দিতে থাকল। মন পুড়ছে, মস্তিষ্ক শান্তিতে থাকবে কেনো? সেও যন্ত্রণা ভোগ করুক।

ছেলেকে অনড়ভাবে বসে থাকতে দেখে একসময় ভয় হতে লাগল মাধবীলতার। চোখের পানি মুছে উঠে এসে তাশফীনের কাঁধে হাত রেখে ডাকলেন,

– তাশফীন? কিছু বল।

তাশফীন ঘাড় ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকাল। শান্তভাবে বলল,

– তুমি না অপেক্ষা করতে বলেছিলে? বলেছিলে তোমার উপর ভরসা রাখতে। তু্মি সব ঠিক করে দিবে। আমি তোমার সব কথা মেনেছি। তবে এমন হলো কেনো, মা?

ছেলের চোখজোড়ায় তীব্র অভিমানের সাথে মনের পবিত্রতা দেখলেন মাধবীলতা। যা উনাকে মনে করিয়ে দিল, স্বচ্ছ হৃদয়ের মানুষগুলো সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায়। যন্ত্রণা ভোগ করে। আজ প্রথমবার উনার আফসোস হলো। ছেলেটা তার বাবার মতো কূটিল হলে বেশ হতো। অন্তত জীবনে এভাবে হেরে যেতে হতো না।

নিজের স্বার্থ হাসিল করতে অমানবিক, বেপরোয়া হওয়া জরুরি। তাশফীনের মতো নরম হৃদয়ের ধীরস্থির মানুষেরা তা পারে না বলে দিনশেষে সব হারিয়ে ফেলে।

ছেলেকে বুকে চেপে শব্দ করে কাঁদতে শুরু করলেন মাধবীলতা। তাশফীন কাঁদল না। চোখ বন্ধ করে চুপ করে রইল।

মা-ছেলের শোক সমারোহ দেখে বড্ড বিরক্ত হলেন তোহাজ শিকদার। চায়ের কাপটা রেখে চলে গেলেন নিজের কক্ষে।

ইউনিফর্ম পরে পরিপাটি হয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হচ্ছিলেন, তাশফীন এসে পথ রোধ করে দাঁড়ালো। ওকে দেখাচ্ছে ঠিকানাবিহীন উদ্ভ্রান্তের মতো। চোখ দুটো লাল। মুখমণ্ডলে অদ্ভুত বেপরোয়া ভাব। নম্র, ভদ্র ছেলের এত অধঃপতন দেখে যথেষ্ট হতাশ হলেন তিনি। বললেন,

– কিছু বলবে?

– তুমি আমার সাথে এমন করলে কেনো?

তোহাজ শিকদার বুঝলেন, উনার বোকা স্ত্রী ছেলেকে সবটা বলেছে। সেই সাথে বাবার বিরুদ্ধে উস্কেও দিয়েছে। তিনি মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রেখে শান্তভাবে ছেলেকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন।

– যৌবনে এমন অনেক কিছু আমাদের আকৃষ্ট করে যা আমাদের স্ট্যাটাসের সাথে যায় না। সব কিছুকে সিরিয়াসলি নিতে নেই। বিবেক বুদ্ধি দিয়ে ভাবতে শিখো। সাঁঝের প্রতি তোমার অনুভূতি সাময়িক মোহ মাত্র। একসাথে বড় হয়েছো। তোমাদের মাঝে ভালো বন্ধুত্ব ছিল। এজন্য এখন খারাপ লাগছে। কিছুদিন পর এই মোহ কেটে যাবে। দেখবে তোমার সামনে দিয়ে ওই মেয়েটা তার হাসবেন্ডের হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে অথচ তোমার ভালো-মন্দ কিছু ফিল হচ্ছে না।

বাবার কথা মাঝে টেবিলের উপর রাখা ফুলদানিটা মেঝেতে ছুড়ে ফেলল তাশফীন। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে লাগল নিজের রাগ, ক্ষোভ।

তোহাজ শিকদার শান্ত চোখে ছেলের উদ্ধত আচরণ দেখলেন। সদ্য মন ভেঙেছে ছেলের। সেই সুবাদে এইটুকু বেয়াদবি ক্ষমা করে দিলেন।

– বাড়ি এসেছো। ছুটি কাটাও। জাফলং, সাদা পাথর, রাতারগুল ঘুরে আসতে পারো। বাইরে বের হও। দুনিয়া দেখো। নতুন বন্ধুবান্ধব বানাও। দেখবে পথ চলতে ফিরতে কতো মেয়ে পছন্দ হয়ে যাচ্ছে। তবে ভুলেও প্রেমে পড়তে যেও না। আমার বন্ধুর মেয়ের সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করে রেখেছি। ওর সাথেই তোমার বিয়ে হবে।

তাশফীনের চোখে বিষাদের ঘন মেঘ। বাবার কথা শুনে মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি দেখা গেল। রক্তাভ চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,

– তোমার কনফিডেন্স দেখে অবাক হচ্ছি। এতকিছুর পরও তুমি ভাবলে কি করে, আমি তোমার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করব?

এবার আর বেয়াদবি সহ্য করলেন না তোহাজ শিকদার। গর্জন করে উঠলেন,

– আমার ছেলে হয়ে তুমি..

– আজ থেকে আমি তোমার ছেলে নই। তোমার সাথে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করতেই এখানে এসেছি। এই মুহূর্তে আমি ঢাকা ফিরে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে কখনো আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা তুমি করবে না। আর না আমার জীবনে দখলদারির চেষ্টা করবে।

– একটা সামান্য মেয়ের জন্য তুমি নিজের বাবা-মাকে ত্যাগ করছ?

– বেলা কোনো সামান্য মেয়ে নয়। সে আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল। আমার পড়াশোনা, ক্যারিয়ার, একমুখী জীবন সবটাই ছিল ওর জন্য। কৈশোর থেকে আমি নিজেকে একজন বেটার পারসোন হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা করেছি শুধুমাত্র এই জন্য যাতে একদিন মাথা উঁচু করে খালামনির সামনে দাঁড়িয়ে বেলাকে চাইতে পারি। তোমার জন্য আজ আমাকে সব হারাতে হলো। আর কীসের আশায় জীবন নামক রেসে ছুটব আমি?

– সময়ের সাথে জীবনের লক্ষ্য বদলায়।

– আমি বদলাতে চাই না। বেলা আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল, আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।

চলে যেতে গিয়েও ঘাড় ফিরিয়ে বাবার দিকে শেষবার তাকাল তাশফীন। প্রচণ্ড ঘৃণা নিয়ে বলল,

– আমি কখনো তোমাকে ক্ষমা করব না। তোমার মতো বাবা কোনো সন্তানের না হোক।

ব্যাগটা কাঁধে তুলে বেরিয়ে গেল তাশফীন। মাধবীলতা ছেলের পেছনে ছুটলেন। হাত ধরে মিনতি করে বললেন,

– তুই আমাকে ক্ষমা কর, বাবা।

– ক্ষমা! তোমাদের প্রতি আমি বরং কৃতজ্ঞ, মা। জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা আজ তোমরা আমাকে দিলে। জীবনের লক্ষ্য পূরণে কারো উপর ভরসা করতে নেই। নিজের লড়াইটা নিজেকে লড়তে হয়। তোমাদের প্রতি আস্থা না রেখে আমি নিজে যদি বেলাকে পাওয়ার চেষ্টা করতাম, তবে পৃথিবীর কারো সাধ্য ছিল না ওকে আমার থেকে কেড়ে নেয়। তোমাদের সম্মানের কথা ভেবে প্রেমের সম্পর্কে জড়াইনি। না হলে বেলার মন জয় করা আমার জন্য কঠিন ছিল না।

– এভাব আমাকে ফেলে যাস না। আমি অনেক চেষ্টা করেছি।

– তোমাদের চেষ্টায় যথেষ্ট ত্রুটি ছিল।

– কল দিলে অন্তত দুটো কথা বলিস মায়ের সাথে।

– আমাকে খুঁচিয়ে আর রক্তার্ত করো না। আই হ্যাড এনাফ।

মাধবীলতার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তাশফীন চলে গেল। তিনি সেখানেই মাটিতে বসে পড়ে কাঁদতে লাগলেন। একমাত্র সন্তান আজ সব মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে বিদায় নিল।

দোতলার কক্ষের জানালা থেকে তোহাজ শিকদার ছেলের বিদায় যাত্রা দেখলেন। তিনি জানেন, যে যাচ্ছে সে আর ফিরবে না। তাশফীন শান্ত, কিন্তু একবার জেদ করে বসলে আর রক্ষা নেই।

তাশফীনের বাড়ি থেকে বাসস্ট্যান্ড রিক্সায় বিশ মিনিটের পথ। অথচ সে রিক্সায় উঠল না। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে হাঁটতে থাকল। মাথার উপর চনচনে রোদ। কান্না আটকে রাখতে গিয়ে এমনিতেই চোখে জ্বালা করছে। রোদের কারণে তা আরও দ্বিগুণ হলো। তাশফীন অবশ্য এতোকিছু অনুভব করতে পারছে না। অদ্ভুতভাবে তার অনুভূতি শক্তি শুন্যে নেমেছে। পুরো শরীর অসাড়। শুধু বুকের বাম পাশটা বড্ড ভারি লাগছে।

উদাস চোখে উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটতে হাঁটতে দেড় ঘন্টা পর বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছালো। উদ্দেশ্য ঢাকায় যাওয়া। চিরচেনা বাসা-বাড়ি লেনে গিয়ে কি করবে সে জানে না। শুধু জানে, তাকে ওখানে যেতে হবে। না হলে এই শ্বাসকষ্ট কমবে না।

*

ঢাকা থেকে নাদী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় চব্বিশ ঘন্টা। একটানা বসে থাকতে হলে যে কারো অবস্থা খারাপ হয়ে যেত। ভাগ্যিস সিঙ্গাপুরে দুই ঘন্টার ট্রানজিট ছিল। সাঁঝের অবশ্য বেশি সমস্যা হয়নি। সীটে বসার কিছুক্ষণ পর সে ঘুমিয়ে পড়ে। সানান ভাই ডেকে দিলে চোখ একটুখানি খেয়ে আবার ঘুমায়।

ওরা যখন নাদী এয়ারপোর্টে পৌঁছাল তখন নাদীতে ভোর হতে শুরু করেছে। সানান ভাইয়ের হাত ধরে প্লেন থেকে নেমে ধূসর আকাশ দেখে মন ভালো হয়ে গেল সাঁঝের। কিন্তু শরীরের অবসন্নতা জানান দিচ্ছে, সে কতটা ক্লান্ত। জোর করে এতদূর নিয়ে আসায় মনে মনে সানান ভাইয়ের গুষ্টি উদ্ধার করে ফেললেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারল না।

বিমানবন্দরের বাইরে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল এজেন্সি থেকে পাঠানো গাইড মোসে নাড্ডা। কালো, খাটো ধরনের লোকটার ছবি সানান ভাইকে দেখানো হয়েছিল। তাই খুঁজে পেতে অসুবিধা হলো না। মোসের কাছে পৌঁছানো মাত্র অভিবাদন জানিয়ে হিন্দি ভাষায় সে বলল,

– কারে উঠে বসুন। আপনাদের জন্য সিপ্লেন রেডি আছে।

সানান ভাই চিন্তিত সুরে জানতে চাইল,

– পৌঁছাতে কতক্ষণ সময় লাগবে?

– আধাঘন্টা।

লোকটার সাথে সাবলীলভাবে হিন্দিতে কথা বলছিল সে। সাঁঝ যদিও হিন্দি বুঝে কিন্তু বলতে পারে না। সে বড় বড় চোখে তাকিয়ে দেখে যাচ্ছিল দুজনকে। সানান ভাই ওর দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল,

– আর আধাঘন্টা কষ্ট করতে পারবি না?

এমন নরম সুর শুনে আরও একবার হোঁচট খেল সাঁঝ। এই মানুষটার নিত্যনতুন রূপে সে এখনো অভ্যস্ত হতে পারেনি। মাথা হেলিয়ে জানাল সে পারবে। সানান ভাই ওর গালে হাত রেখে বলল,

– মুখটা একেবারে শুকিয়ে গেছে। ক্ষুধা পেয়েছে? কিছু খাবি?

– পানি খাবো।

মোসের কাছে পানি চাইলে সে তার কার থেকে একটি পানির বোতল বের করে দিল। দশ মিনিট পরেই সমুদ্র তীরে এসে থামল কারটি। সাঁঝ দেখল একটি অদ্ভুত যান সমুদ্রের বুকে স্থির হয়ে আছে। যেটাতে ওকে উঠতে বলা হলো। সে উঠল না। বরং দেহ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল। সানান ভাই মুখ চেপে হেসে এক লাফে উঠে পড়ল বিএন-টু আইসল্যান্ডারে। তারপর হাত বাড়িয়ে দিল সাঁঝের দিকে। এবার হাত ধরে সাঁঝও উঠে বসল সানান ভাইয়ের পাশে। ড্রাইভিং সীটে বসল মোসে। কিছুটা পথ সমুদ্রের বুক চিরে বড় বড় ঢেউ তুলে সিপ্লেনটি এগিয়ে গেল।

প্রাণের ভয়ে সানান ভাইয়ের বাহু চেপে ধরেছে সাঁঝ। ধীরে ধীরে সিপ্লেনটি উপরের দিকে উঠতে লাগল। সে চোখ বন্ধ করে মুখ লুকাল সানান ভাইয়ের বুকে। সানান ভাই একহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে সাঁঝের কাঁধ। কিছুক্ষণ পর কানের কাছে মুখ নামিয়ে ডাকল,

– এই সাঁঝবাতি?

বুক হতে মুখ তুলে পিটপিট করে চাইল সাঁঝ। চোখের ইশারায় জানালার দিকে তাকাতে বলল সানান ভাই। ভয়ার্ত চোখে জানালার দিকে তাকালেও যে দৃশ্য সে দেখল, তাতে ইহজাগতিক কোনো ভয় আর হৃদয়ে ঠাঁই নিতে পারে না।

নিচে বিস্তৃত জলরাশি। নীলচে ঢেউ, তাতে চিকচিক করছে সদ্য উদিত সূর্যের সোনামাখা রোদ্দুর। কখনো চোখে পড়ছে সবুজ উপত্যকা। বড় বড় গাছ চাদরের মতো ঢেকে রেখেছে চারপাশ।

দেখতে দেখতে ওরা চলে এলো গন্তব্যে। আকাশ পথ থেকে ধীরে ধীরে সমুদ্রের বুকে ফিরে এলো প্লেনটি। চারপাশে জলরাশি ছড়িয়ে পড়লেও এবার আর সাঁঝ ভয় পেল না। বরং উচ্ছ্বসিত হয়ে হেসে উঠল।

সেই পদ্মকুড়ির প্রস্ফুটন দেখে সমস্ত ক্লান্তি মুছে গেল সানান ভাইয়ের। এত যুদ্ধ, এত লড়াই, এত পরিশ্রম শুধুমাত্র এই হাসিটুকু দেখার জন্যই সে করেছে।

সানান ভাইয়ের হাত ধরে সমুদ্রতটের চকচকে বালুকায় পা রাখল সাঁঝ। ছোট বালু কণা সরে গিয়ে সামান্য ডুবে গেল পা জোড়া। আনমনে হেসে পা টেনে তুলে আরেকটু দূরে পা ফেলল।

সানান ভাই ব্যাগপত্র নামিয়ে নিতেই কিছু ইন্সট্রাকশন দিয়ে সিপ্লেন নিয়ে ফিরে গেল মোসে। শব্দ শুনে যতক্ষণে সেদিকে মনোযোগ দিল সাঁঝ, ততক্ষণে মোসে অনেকটা পথ পেরিয়ে গেছে। সে আতংকিত হয়ে চিৎকার করে উঠল,

– উনি আমাদের একা ফেলে চলে গেল কেনো? আমরা এখন ফিরব কীভাবে?

সানান ভাই বালুপথ ধরে সমুদ্রের বিপরীতে হাঁটতে ধরে বলল,

– আমরা এখনি ফিরব না। কিছুদিন এখানেই থাকব।

পিছু নিল সাঁঝ। বিস্মিত হয়ে বলল,

– এখানে কোথায় থাকব?

– ভেতরে কটেজ আছে।

সাঁঝ আশেপাশে তাকিয়ে দেখল। বালুতট থেকে একটু ভেতরে যেতেই অচেনা গাছপালা চোখে পড়ছে। তারই পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটি কটেজ। কাঠের তৈরি কটেজটি কয়েকটি মোটা কাঠের স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে।

সে সানান ভাইয়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল,

– চারপাশ এত সুনসান। আশেপাশে কোনো মানুষজন দেখা যাচ্ছে না। এখানে কি কেউ থাকে না?

– নাহ। মানুষ বলতে শুধু আমরা দুজন আছি।

সাঁঝ থমকে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বলল,

– আপনি আমাকে এমন জায়গায় নিয়ে এসেছেন কেনো?

সানান ভাইও দাঁড়ালো। ফিরে এসে সাঁঝের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রহস্যময় হেসে ফিসফিসিয়ে বলল,

– এখানে তোকে মে’রে ফেলা সহজ। কোনো সাক্ষী নেই, প্রমাণ নেই। মে’রে বালু চাপা দিতে পারব। অথবা সমুদ্রে ফেলে দিব।

মুহূর্তেই মনে পড়ল, নিষ্ঠুর সানান ভাইয়ের দেওয়া শাস্তিগুলোর কথা। এই মানুষটির পক্ষে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। তাকে মে’রে ফেলে একা বাড়ি চলে গেলে পরিবারের লোকজন খুব একটা ঝামেলা করবে না। উল্টো বলবে, নিশ্চয়ই সাঁঝ উল্টাপাল্টা কোনো কাজ করেছে। এজন্যই মে’রেছে।
কারণ তাদের স্নেহের সানান কখনো কোনো ভুল করতেই পারে না।

ভয় পেলেও মুখে অকৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে সে বলল,

– আপনি মজা করছেন, তাই না?

– মোটেও না। আমি অনেক সিরিয়াস। লাখ লাখ টাকা খরচ করে এতদূর কি এমনি নিয়ে এসেছি!

যেনো এখনি হৃদয় থমকে যাওয়া কথাগুলো সে বলেনি এমন ভাব করে হেলেদুলে আবার হাঁটতে শুরু করল সানান ভাই।
ভয়ার্ত সাঁঝ আশেপাশে তাকিয়ে আরেকবার নিশ্চিত হলো, সত্যিই দ্বীপটি জনমানবহীন।

কাঠের কয়েকটি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। সিঁড়িতে পা রাখতে ক্যাচ ক্যাচ শব্দ হচ্ছে। কাঁধের ব্যাগটা ড্রয়িংরুমের সোফায় ছুড়ে ফেলে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেল সানান ভাই। দ্রুত গোসল সেরে নিম্নাঞ্চলে একটা তোয়ালে জড়িয়ে বাইরে এলো। সোফায় রাখা ব্যাগ থেকে থ্রি কোয়াটার প্যান্টটা খুঁজছিল এমন সময় বেডরুমের দরজা খুলে বাইরে এলো সাঁঝ।

সানান ভাইকে এভাবে দেখে একটা বিকট চিৎকার দিয়ে আবার বেডরুমে ডুকে দরজা বন্ধ করে দিল। সানান ভাই ঘাড় ফিরিয়ে এমন নাট্যকর দৃশ্য দেখে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। শুধু বাম ভ্রু একটু উঁচু করে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিল।

জামা কাপড় পরে বেডরুমের দরজায় নক করলে সাঁঝ দরজা খুলে দেয়। সানান ভাই সোজা গিয়ে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়ল। বিস্ময়ে বিমূঢ় সাঁঝকে উদ্দেশ্য করে বলল,

– পুরোটা রাস্তা নাক ডেকে ঘুমিয়েছিস, আমি তোকে পাহারা দিয়েছি। এখন আমি ঘুমাবো তুই আমাকে পাহারা দিবি।

ঘুমানোর জন্য কাউকে সাত সমুদ্র তেরো নদী পারি দিয়ে এতদূর আসতে দেখেনি সাঁঝ। আজকে দেখল। তারপর হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইরে এসে বেডরুমের দরজা বন্ধ করে নিজে চলে গেল ফ্রেশ হতে।

নাদীর সময় অনুযায়ী আজ, ছাব্বিশ মে দুই হাজার উনিশ।
সাঁঝ এবং সানান ভাইয়ের হানিমুন যাত্রায় আপনাদের স্বাগত। ব্যস্ত সাঁঝকে কিছুটা সময় নিজেদের সাথে বেঁধে রাখতে এক অভিনব পথা অবলম্বন করেছে সানান ভাই। হানিমুনের জন্য বুকিং করেছে একটি প্রাইভেট আইল্যান্ড। নিজের দেশ থেকে বউকে তুলে নিয়ে এসেছে সিজিতে।

দ্বীপ দেশ সিজি। লোকে বলে দ্বীপপুঞ্জের দেশ। ভিতেলোয়ু ও ভানুয়ো দুটো প্রধান দ্বীপ নিয়ে গঠিত দেশটিতে ছোট বড় সব মিলিয়ে প্রায় ৩৩৫টি দ্বীপ রয়েছে।

এত সব দ্বীপের মধ্যে ওরা এসেছে ইয়াদুয়া তাবু দ্বীপে। এটি প্যাফিসিক মহাসাগরের লোমাইভিটি দ্বীপকুঞ্জের একটি। যা ফিজির পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। অদ্ভুত এই দ্বীপের বাকি বর্ণনা শাফিন আহমেদের মুখে আপনারা শুনেছেন।

চলুন আমরা ফিরে যাই সাঁঝের কাছে।

সারাদিন সানান ভাই ঘুমালো। এই সুযোগে সাঁঝ পুরো বাড়ি দেখে ফেলেছে। কটেজের তিনপাশে টানা বারান্দা। ভেতরে একটি ড্রয়িংরুম। একপাশে রান্না করার জায়গা। একটা মাত্র কক্ষ। তার সাথে ছোট একটি ওয়াশরুম। দ্বীপটি জনমানবশূন্য হলেও এই কটেজটিতে প্রয়োজনীয় সবকিছু রয়েছে।

গোসলে সেরে নিজের পছন্দনীয় লাল শাড়ি পরল সাঁঝ। ম্যাচিং করে দুল, চুড়ি পরে নেইলপালিশও লাগাল। হালকা লিপস্টিক, কপালে কালো টিপ। ভেজা চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে দিয়ে তারপর রান্নাঘরে ঢুকল।

এক কাপ চা, দুটো বিস্কুট নিয়ে বসল বারান্দায় রাখা চেয়ারে। এখান থেকে সমুদ্র দেখা যায়। কিছুক্ষণ পর পর নীলচে জলরাশি এসে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে তীরের বালু।
সমুদ্রের তীরে হাঁটতে ইচ্ছে হলেও একা যাওয়ার সাহস হলো না।

সানান ভাই ঘুম থেকে উঠে দেখল অপরিচিত কটেজটাকে নিজের বাড়ি বানিয়ে ফেলেছে তার সাঁঝবাতি। ইতিমধ্যে রান্নাও হয়েছে। সামুদ্রিক মাছ ছিল ফ্রিজে। মোসে প্রয়োজনীয় সবকিছু আগেই মজুদ করে রেখে গিয়েছে। যাতে অতিথিদের কোনো কিছুর অভাববোধ না হয়।

খেতে বসে সানান ভাই খেয়াল করল আজও সাঁঝ বরাবরের মতো চুপ করে আছে। কিন্তু ওর মধ্যে কিছুটা অস্থিরতা লক্ষ্যনীয়। সানান ভাই মনে মনে হাসল। খাওয়া শেষ করে বলল,

– বীচে হাঁটতে যাবি?

সানান ভাইয়ের সাথে হাঁটতে বের হওয়ার থেকে ঘরবন্দী জীবনে বেশি সাচ্ছন্দ্যবোধ করবে সাঁঝ। যদিও সকাল থেকে মন টানছে সমুদ্রতীরে। তবুও প্রস্তাব নাকচ করে দিল।

– নাহ। আপনি যান।

– একলা ঘরে কি করবি?

– অনেক কাজ আছে। থালাবাসন পরিষ্কার করব।

– ওকে। যেমনটা তোর ইচ্ছে। থাক একা।

দেখতে দেখতে হাতের কাজগুলো শেষ হয়ে গেল। একলা ঘরে সাঁঝের মন কেমন হুহু করে উঠল। মোবাইল নেই, টিভি নেই। সময় ব্যয় করার সব রাস্তা বন্ধ। বইপত্র পড়া সাঁঝের কম্য নয়। তাই ওগুলোর খোঁজ সে করল না। বাবা-মা, দাদী, সাভিন-সাবিল সবার কথা মনে পড়তে শুরু করেছে। আরাম আয়েশ, বাসাবাড়ি লেন, মোড়ের দোকান সবাই হুড়মুড় করে এসে হানা দিল স্মৃতির পাতায়। মাত্র দুদিনের দূরত্বে সাঁঝের এমন দশা। বাকিদিন গুলো কীভাবে কাটবে কে জানে!

বারান্দার চেয়ারে বসে এসব ভাবছিল সাঁঝ। সমুদ্রের দিকে চোখ পরতেই দেখল সানান ভাই কটেজের দিকে ফিরছে। যার জন্য সাঁঝের এই বিরহ যাতনা তাকে দেখে সাঁঝের ভীষণ রাগ হলো। এই লোকটা জোরজবরদস্তি করে কেনো সাথে নিয়ে এলো ওকে? সমুদ্র দেখার শখ তো একলা আসত। বিয়ে করেছে বলে সবখানে বউকে বগলদাবা করে নিয়ে ঘুরতে হবে?

চেয়ারে পা তুলে হাঁটুতে মুখ গুজে বসে আছে সাঁঝ। সানান ভাই ওর সামনে দাঁড়িয়ে দু হাত মেলে বলল,

– এগুলো কি বল দেখি?

সাঁঝ দেখল সানান ভাইয়ের হাতে কমলা রঙের কিছু ফল। দেখতে অনেকটা সফেদার মতো। সে চিনতে পারল না। চেনার চেষ্টাও করল না। মুখ ফুলিয়ে বলল,

– জানি না।

– এগুলোর নাম কটন ফল। মজাদার একটা ফল। খেয়ে দেখ।

– এখন খেতে ইচ্ছে করছে না।

সানান ভাই কিছু বলল না। চুপচাপ তাকিয়ে থাকল সাঁঝের দিকে। সাঁঝ ভাবল, এই বুঝি জোরসে ধমক দিল। অথবা মাথায় একটা চাট্টি মারল। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে সানান ভাই ফলগুলো নিয়ে ভেতরে চলে গেল। সাঁঝ অবশ্য দেখল না সানান ভাইয়ের কূটিল হাসি। কেনো হাসছে কে জানে!

কোথা থেকে একটা নীল রঙের গিটার কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে এলো সানান ভাই। সাঁঝের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,

– সমুদ্র দেখতে যাবি নাকি বসে থাকবি?

– যাব না।

– ঘুরতে এসে ঘরে বসে থাকে কে? আজব! থাক তুই। আমি গেলাম।

ওকে একা ফেলে সানান ভাই সত্যিই চলে গেল। গমনপথে তাকিয়ে সাঁঝের এত মন খারাপ হলো! আরেকবার সাথে যেতে বললে কি এমন হতো? একটা ধমক দিলেই তো সাঁঝ চলে যেত তার সাথে। কিন্তু নাহ। সাথে নিয়ে এসে এখন নিজের মতো করে একলা ঘুরছে। আর ঘরে ফেলে রেখেছে সাঁঝকে। নিশ্চয়ই রান্নাবান্না করার লোক নেই বলে ওকে এনেছে।

ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে গিয়েও কাঁদল না। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভাবল, সেও যাবে ঘুরতে। দরকার হলে একা একা ঘুরবে। মানু্‌ষজন নেই, মানে বিপদের আশংকা নেই। পথঘাট চিনে না, তাই বেশিদূর যাবে না। সামনে হাঁটাহাঁটি করে ফিরে আসবে।

গুটিগুটি পায়ে কটেজ থেকে বেরিয়ে নরম বালুকায় পা রাখল সাঁঝ। ডানদিকে খানিকটা দূরে সানান ভাই বসে আছে। তাকে দেখে বামদিকে হাঁটতে শুরু করল সাঁঝ।
কয়েক পা এগিয়ে ঘুরে আবার ডানদিকে হাঁটতে শুরু করল। এখানে হিংস্র জন্তু আছে কিনা কে জানে!

সানান ভাইয়ের উপর রাগ করে নিজের জীবন বিপন্ন করার মতো বোকা মেয়ে সাঁঝ নয়। এর থেকে সানান ভাইয়ের আশেপাশে থাকা ঢের ভালো।

সাঁঝকে আসতে দেখে সানান ভাইয়ের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখা গেল। বিরবির করে বলল,

– বাড়িতে সবাইকে পেয়ে আমাকে ভুলে যেতি। আমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতি, লুকিয়ে থাকতি। এখন দেখ, তোকে এমন জায়গায় এনেছি যে আমি ছাড়া তোর গতি নাই। যেখানেই যাস, আমার কাছেই ফিরে আসতে হবে। খোদার নামে শপথ করে বলছি সাঁঝবাতি, যখনি আমার কাছ থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টা করবি। আমি তোকে এতটা অসহায় করে দিব যে আমার কাছে আসা ছাড়া তোর হাতে আর কোনো অপশন থাকবে না।
কারণ, তোর-আমার সম্পর্কে কোনো প্রকার আপোষ করতে আমি রাজি নই। তোর পুরোটাই আমার চাই।

শুকনো বালুর উপর পা ছড়িয়ে বসে গিটারে টুংটাং শব্দ তুলছে সানান ভাই। পরনে অফ হোয়াট কালারের থ্রি কোয়াটার প্যান্ট, আকাশী রঙের শার্ট। কোলে গাঢ় নীল রঙের গিটার। সামনে নীলচে জলরাশি। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। সবমিলিয়ে ছবির মতোন সুন্দর একটি দৃশ্য।

সাঁঝ মুগ্ধ চোখে চেয়ে নিঃশব্দে এসে তার পাশে বসল।খানিকটা লজ্জা লাগছে অবশ্য। তাই মাথা নিচু করে বালুতে আঙ্গুল দিয়ে মিছে আঁকাবুকি করতে লাগল। সবটাই বাহানা মাত্র। আসলে তার মনোযোগ চলে গেছে সানান ভাইয়ের ভরাট কণ্ঠে। গলা ছেড়ে গাওয়া সেই গানে,

ও মন হারিয়ে বসে আছি দেখ
প্রথম বারেরই দেখায় কত না হলো তোলপাড়
দু’চোখ দেখেছে তোকে আজ যেই
হারিয়ে ফেলেছি খেই আমিও আমার কথায়।
খেয়ালী দিন মায়াবী রাত এক নিমেষে
তাকালি তুই আমি হঠাৎ অন্য দেশে।

ওরে মনওয়া রে
ওরে মনওয়া রে
কেয়সা হে তু বাতা….

চলবে..
#অক্ষরময়ী