#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব ৪০
সময় দুঃখকে সহনীয় করে ফেলে, পরিস্থিতি শেখায় মানিয়ে নেওয়া।
জনমানবহীন সমুদ্রতীরে দুজন মানুষ একে অপরের প্রতি কতক্ষণ বিমুখ থাকতে পারে?
ধীরে ধীরে সহজ হতে লাগল সাঁঝ। একসময় সানান ভাইকে সে ভয় পেতো। কারণটা তার রুক্ষ আচরণ। যা বর্তমানে শিথিল হয়েছে।
যার সাথে এতদিন ভাইবোন সুলভ আচরণ ছিল, তার সাথে হঠাৎ বিয়ে হয়ে যাওয়ায় ভয়ের সাথে যুক্ত হয়েছিল অস্বস্তি। এই অপ্রীতিকর সত্যির মুখোমুখি হতে ভয় পেত সে। তাই তো পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা।
সমাধান হিসেবে সানান ভাই ওকে এমন পরিস্থিতিতে এনে দাঁড় করিয়েছে, যা থেকে পালানোর উপায় নেই। সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে সে বাধ্য।
আস্তে-ধীরে তার মন মস্তিষ্ক অভ্যস্ত হতে শুরু করেছে সম্পর্কের নতুন সংজ্ঞায়। সেই সময়টুকু সানান ভাই ওকে দিয়েছে। স্বামীসুলভ আচরণ প্রদর্শন করে অপ্রস্তুত করেনি ওকে।
ইয়াদুয়া তাবু দ্বীপটি পূর্বদিকে অবস্থিত হওয়ায় পশ্চিমের অস্তমিত সূর্যটি সমুদ্রতীর হতে অসম্ভব সুন্দর দেখায়। প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিভোর সাঁঝ খেয়াল করেনি চারপাশে অন্ধকার নামতে শুরু করেছে।
সানান ভাই উঠে দাঁড়িয়ে কাপড়ের বালু ঝেড়ে ফেলে বলল,
– চল ফিরে যাই। কালকে আবার আসিস।
সাঁঝ মুখ তুলে তাকাল সানান ভাইয়ের দিকে। দিনের শেষ প্রহরের লালচে আভা পড়েছে সানান ভাইয়ের মুখমন্ডলে। ফর্সা ত্বক চকচক করছে। গায়ের শার্টটির উপরের দুটো বোতাম খোলা। নগ্ন বুকের দিকে চোখ পড়তেই দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে তাকাল তার চোখের দিকে। সেখানে খেলা করছে অধীর আগ্রহ।
তখনি সাঁঝ খেয়াল করল সানান ভাই ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে ধীরগতিতে নিজের হাতটি এগিয়ে দিল। হাতটি আলতো বাধনে আঁকড়ে ধরল সানান ভাই।
এক হাতে ধরেছে কাঁধে ঝুলানো গিটারের ফিতা। অন্য হাতে সাঁঝের হাত ধরে হাঁটছে সে। ধীরপায়ে ওরা এগিয়ে চলল কটেজের দিকে।
রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর অভ্যাস নেই সানান ভাইয়ের। তবুও বিছানায় আধাশোয়া হয়ে একটা বই খুলে পাতা উল্টাচ্ছিল। পোশাক বদলে সালোয়ার কামিজ পরে বিছানার আরেকপাশে এসে বসল সাঁঝ।
সানান ভাইয়ের দিকে পিঠ করে বসলেও সে তার ইতস্ততা বুঝতে পারল। সাধে কি এই মেয়েটাকে সানান ভাই ধমকের উপরে রাখে? এখনি একটা ধমক দিলে সব অস্বস্তি জানালা দিয়ে পালাবে। সুরসুর করে শুয়ে পড়বে বিছানায়। কিন্তু সেটা করতে পারল না। নিজের বউকে কি ধমক দেওয়া যায়? বউকে রাখতে হয় আদর, সোহাগ, আহ্লাদে।
নরম সুরে বলল,
– বসে বসে ঘুমানোর প্ল্যান আছে?
হাতের নখ খুটতে খুটতে একদম নিচু স্বরে সাঁঝ বলল,
– এই বিছানায় ঘুমাবো?
– তুই চাইলে আমার বুকেও ঘুমাতে পারিস। আই ডোন্ট মাইন্ড।
কথা শুনে চমকে তাকাল সাঁঝ। দেখল সানান ভাইয়ের দৃষ্টি বইয়ের দিকে থাকলেও মুখে চাপা হাসি। লজ্জায় আতংকে সাঁঝের মুখখানা চুপসে গেল। সানান ভাই বলল,
– এমন ভাব করছিস যেন এর আগে আমার সাথে এক বিছানায় ঘুমাসনি। বিয়ের পর এই কয়েকদিন কোথায় ঘুমিয়েছিলি শুনি?
একই বিছানায় ঘুমালেও ও যখন ঘুমাতে যেত সানান ভাই ঘরে উপস্থিত থাকত না। যখন আসত ততক্ষণে সাঁঝ ঘুমিয়ে কাত। খুব সকালে একপ্রকার লুকিয়ে ঘর ছাড়ত সাঁঝ। ফলে বিব্রতকর পরিস্থিতি পড়তে হতো না। কিন্তু এখানে সেই উপায় নেই।
সানান ভাই এবার সামান্য কঠোর হলো। গম্ভীর স্বরে বলল,
– বেশি নাটক না করে চুপচাপ শুয়ে পড়।
সাঁঝ বাধ্য মেয়ের মতো বালিশে মাথা রেখে বলল,
– মা বলে, ঘুমের মধ্যে আমি অনেক নড়াচড়া করি। আপনার গায়ে হাত, পা লাগলে কিছু মনে করবেন না।
– এই কয়েকদিনে তার যথেষ্ট নমুনা দেখে ফেলেছি। কেউ ঘুমের মধ্যে এত নাচানাচি করতে পারে আমার জানা ছিল না।
সাঁঝের ঘুমের স্টাইল আসলেই শোচনীয়। ঘুমের মধ্যে পুরো বিছানায় ছোটাছুটি করার বদভ্যাস আছে। ঘুমন্ত অবস্থায় কারো নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তবুও সানান ভাইয়ের কথা শোনার পর সে বেশ সচেতন হয়ে শুলো।
সানান ভাই ডানপাশে শুয়েছে। অবচেতন মনে সতর্ক সাঁঝ সেদিকে ঘেঁষল না। যত দাপাদাপি করল বামপাশে।
ক্রাইম থ্রিলারের বইটিতে মনোযোগ দিয়েছিল সানান ভাই। পাতা উল্টানোর সময় আনমনে তাকাতেই বইটি ফেলে একপ্রকার ছুটে এসে আটকাল পড়ন্ত সাঁঝকে।
রুমের মাঝামাঝি অবস্থিত খাটটির দুপাশে ফাঁকা স্থান। বামপাশে এগিয়ে যেতে যেতে খাটের কিনারায় চলে গিয়েছিল সাঁঝ। শরীরের অর্ধেকটা ঝুলছে খাটের প্রান্তে। সেই অবস্থায় আবারও পাশ ফিরতে গিয়ে এবার পুরোটাই পড়ে যাচ্ছিল। সানান ভাই না আটকালে মেঝেতে পড়ে কোমর ভাঙ্গত নিশ্চিত।
বিছানার মাঝখানে ঘুমন্ত সাঁঝকে শুইয়ে দিয়ে সানান ভাই আপনমনে হাসল। ওর সূচালো নাকের ডগা টেনে দিয়ে বলল,
– সারাদিন তেলাপোকার মতো লাফালাফি করিস। ঘুমের মধ্যে একটু শান্ত হয়ে থাকা যায় না? এখনও ছুটাছুটি করতে হবে! তোকে অন্যভাবে সামলাতে হবে দেখছি।
বই গুছিয়ে রেখে লাইট বন্ধ করে নিজেও শুয়ে পড়ল ওর পাশে। ঘুম আসবে না জানে, তবুও সাঁঝকে সঙ্গ দিতে খোলা চোখে তাকিয়ে রইল অন্ধকারে।
*
সমুদ্রতীরের শুদ্ধ বাতাসে ভেজা ভেজা গন্ধ। সাধারণ তাপমাত্রার বাতাস সমুদ্রের পানি ছুয়ে আরও শীতল হয়ে এসে গায়ে ছড়াচ্ছে শীতলতা। পাশের ঘন জঙ্গলে জেগে উঠেছে নাম না জানা কিছু পাখি। তাদের চিৎকারে সাঁঝের ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে নতুন পরিবেশ দেখে একটুখানি ভড়কে গেলেও ধীরে ধীরে স্মৃতি হাতড়ে শান্ত হলো। উঠে বসতে গিয়ে দেখল সানান ভাই একহাতে জড়িয়ে ধরে আছে তার কোমর। দেহে তরঙ্গের মতো কিছু একটা ছড়িয়ে পড়ল। দ্রুত হাতটা সরিয়ে দিয়ে নেমে গেল বিছানা থেকে।
সানান ভাই উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে। গায়ে এখনো গতকালের জামাকাপড়। সাঁঝ আর সেদিকে তাকাল না। দ্রুত চলে গেল ওয়াশরুমে।
পাখিদের কলরবে বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারল না সানান ভাই। অবশ্য ঘুরতে এসে ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করে কে! লম্বা হাই তুলে ওয়াশরুমের সামনে গিয়ে দেখে ভেতর থেকে লক। দরজায় জোরে টোকা মেরে বলল,
– তাড়াতাড়ি বের হ। বাকি মানুষেরও ওয়াশরুম যেতে হয়।
দরজা খুলে সাঁঝ অবাক চোখে চেয়ে বলল,
– আপনি এত সকালে উঠেছেন?
সাঁঝের গা থেকে মিষ্টি ঘ্রাণ আসছে। শাওয়ার জেলের ঘ্রাণ বোধহয়। ঘ্রাণটা অন্য কারো ঠিকই পছন্দ হতো। সানান ভাইয়ের হলো না। সেই কামিনী ফুলের সৌরভ সে ভালোবাসে।
নাক কুঁচকে করে বলল,
– গায়ে কি মাখছিস? বিশ্রী গন্ধ আসতেছে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আমার। সর সামনে থেকে।
সাঁঝের মুখটা হা হয়ে গেল। এভাবে কেউ অপমান করে! মুখ ফুলিয়ে ঘরের ভেতর চলে গেল। এখানে ড্রেসিং টেবিল নেই। দেয়ালে সাথে একটা গোলাকার আয়না সেট করা আছে। সেটার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে প্রসাধনী মাখতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে।
সানান ভাই ফ্রেশ হয়ে এসে ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে কাজল দিচ্ছে সাঁঝ। সে আর বিরক্ত করল না। নিজেই রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের পানি বসালো। ফ্রোজেন পরোটা দুটো ভেজে, কাপে চা ঢেলে ঘরে এসে দেখল তখনো সাঁঝের সাজগোছ চলছে।
দু হাত কোমরে রেখে সে বলল,
– সারাক্ষণ সেজেগুজে পটের বিবি হয়ে ঘুরে বেড়ালে চলবে? খাওয়াদাওয়া কিছু করতে হবে না?
ঠোঁটে তখনো লিপস্টিক দেওয়া বাকি। লিপস্টিকটা নামিয়ে রেখে সাঁঝ বলল,
– স্যরি, স্যরি। আমি ভাবিনি আপনি এত সকালে ঘুম থেকে উঠবেন। এখনি নাস্তা বানিয়ে দিচ্ছি।
– লিপস্টিকটা দিয়েই আয়।
খাবার টেবিলে আরেকদফা অবাক হলো সাঁঝ। নাস্তা বানিয়ে টেবিলে সাজিয়ে রেখে তার অপেক্ষায় বসে আছে সানান ভাই। ভয়ে ভয়ে চেয়ার টেনে বসল সাঁঝ। খেতে শুরু করে সানান ভাই বলল,
– পাশে একটা পাহাড় আছে। ট্র্যাকিংয়ে যাব ভাবছি। কম্ফোর্টেবল ড্রেস থাকলে পরে রেডি হয়ে নে।
– আমি যাব না।
– জিজ্ঞাসা করছি না। যেতে বলেছি, সাথে যাবি। ঘরে বসে রান্নাবান্না করার জন্য এতদূর নিয়ে আসিনি তোকে। বাইরে ঘুরাফিরা কর। দেখ, দুনিয়াটা কত সুন্দর।
– ওতো উঁচু পাহাড়ে উঠতে পারব না, সানান ভাই।
– জগতে এমন কিছু নেই, যা তুই পারবি না। যতক্ষণ আমি তোর পাশে আছি, তুই সব পারবি।
অবাক চোখে চেয়ে রইল সাঁঝ। এমন দর্শনের কথা আগে কখনো সানান ভাইয়ের মুখে শুনেনি।
– ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো? আমাকে হ্যান্ডসাম লাগছে?
– কিছুটা।
মাথা নিচু করে লাজুক হেসে বিড়বিড় করল সে। শুনতে পেল না সানান ভাই। বাম ভ্রু উঁচু করে বলল,
– নিচুস্বরে কি বলছিস? শুনতে পাচ্ছি না। জোরে বল।
– হঠাৎ করে আপনার ড্রেসিং সেন্স এত ভালো হয়ে গেল কি করে? আজ আবার খাকি প্যান্টের সাথে ম্যাচ করে ডার্ক ব্লু শার্ট পরেছেন!
অনেকটা সাহস যুগিয়ে জিজ্ঞাসা করেই ফেলল সে। সানান ভাই থমথমে খেয়ে বিড়বিড় করে বলল,
– জাদিদকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম। ও চয়েজ করে দিয়েছে।
– তাই তো বলি। আপনার পছন্দ এত ভালো হয়ে গেল কী করে!
– মানে? কি বলতে চাচ্ছিস? আমার পছন্দ খারাপ?
সানান ভাইয়ের মেজাজ খারাপ হওয়ার পথে। নিজেকে গুটিয়ে নিল সাঁঝ। অপ্রস্তুত ভঙ্গিমায় হেসে বলল,
– না মানে চলার মতো আরকি।
– আমার পছন্দ যথেষ্ট ভালো। না হলে তোকে পছন্দ করতাম না।
লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে উপরের ঠোঁটে চেপে ধরল নিচের ঠোঁট। এত হাসি পাচ্ছে কেনো হঠাৎ!
*
অতি আত্মবিশ্বাস কাল হয়েছে সাঁঝের। সালোয়ার কামিজ পরে নাচতে নাচতে চলে এলেও ঝোপঝাড়ের পথ ধরে হাঁটতে গিয়ে বারবার কাপড় আটকে যাচ্ছে গাছের ডালে। যার ফলে ক্ষণে ক্ষণে থামতে হচ্ছে ওদের। সাঁঝ ভয়ে আছে এই বুঝি সানান ভাই জোরসে একটা ধমক দিল।
ওড়না উড়ছিল বলে গলায় ঝুলিয়ে নিয়েছে। এবার কামিজের কোণা গিয়ে লাগল কাঁটাযুক্ত গাছের ডালে। কাপড়ে টান পেয়ে সাঁঝ থেমে যেতেই সানান ভাইও থামল। ফিরে এসে কাঁ টা হতে কাপড় ছাড়াতে সাহায্য করতে লাগল।
– তুই যা শুরু করেছিস, আজকে পাহাড়ের উপর থেকে ফিরতে পারব বলে মনে হচ্ছে না।
– ফিরতে না পারলে রাতে থাকব কোথায়?
– জঙ্গলে থাকবি। সারারাত জেগে বাঘ ভাল্লুকের সাথে লড়াই করবি।
সানান ভাই এমনভাবে বলল যেনো এটা খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। এদিকে ভয়ে সাঁঝের গলা শুকিয়ে আসছে।
– আমি যাব না আপনার সাথে। আমাকে কটেজে দিয়ে আসুন।
কাপড়টি অক্ষত অবস্থায় ছাড়িয়ে নিয়ে সানান ভাই মুচকি হেসে বলল,
– মজা করছিলাম। তুই যে একটা ভীতুর ডিম সেটা আরেকবার প্রমাণিত হলো। তাড়াতাড়ি পা চালা সূর্য মাথার উপরে উঠার আগেই ফিরে আসতে হবে।
এবার সাঁঝের হাত ধরে হাঁটতে শুরু করল সানান ভাই। সাঁঝ বাঁধা দিল না। এখন হুটহাট হাত ধরলে আর অস্বস্তি হয় না।
কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই আবার বাঁধা পেল। এবার পোশাক আটকালো না। লম্বা চুলগুলো টান খেলো একটা শুকনো ডালে। মাথায় ব্যথা পেয়ে আর্তনাদ করে উঠল। সানান ভাই ভয় পেয়ে ছুটে এসে ছাড়িয়ে দিল চুলের গোছা।
ব্যথায় সাঁঝের চোখে পানি চলে এসেছে। ওর গালে হাত রেখে উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল,
– বেশি ব্যথা পেয়েছিস?
সানান ভাইয়ের ছোঁয়ায় সাঁঝের অনুভূতি বোধ স্তম্ভিত হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। সে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কোনো উত্তর দিল না।
– থাক আর যাব না পাহাড়ের চূড়ায়। চল ফিরে যাই। চুলগুলো খোঁপা করে নে।
হাত খোঁপা করে নিল সাঁঝ। সানান ভাই এবারও আগে আগে হাঁটছে। মাঝপথ থেকে ফিরে যেতে খারাপ লাগছে সাঁঝের। সানান ভাই এত শখ করে বের হলো ঘর থেকে। অথচ ওর জন্য পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে পারল না।
কিছুটা পথ নিচে নেমে সানান ভাই থামল। জঙ্গলের একটু ভেতরে কিছু গাছের কাছে এগিয়ে গিয়ে পকেট থেকে একটি ছোট ছু’রি বের করে একটা গাছ কাটতে লাগল। যা দেখে সাঁঝ বলল,
– এগুলো দিয়ে কি করবেন?
– রান্না করে খাবো।
সাঁঝ খেয়াল করে দেখল গাছগুলো দেখতে অনেকটা ভুট্টা গাছের মতো। যদিও ততটা লম্বা নয়। সবুজ কান্ড, সাথে বাঁশ পাতার মতো খসখসে কয়েকটা পাতা। এগুলো কীভাবে খায় কে জানে! দেখতে দেখতে কয়েকটি গাছ কে’টে ফেলল সানান ভাই। পাশে পড়ে থাকা গুল্মলতা দিয়ে সবগুলো একসাথে বেঁধে হাতে ঝুলিয়ে নিল।
– এগুলোর নাম দুরুকা। সিজির জনপ্রিয় সবজি। পাহাড়ী অঞ্চলে বেশী পাওয়া যায়। নারকেলের দুধ দিয়ে রান্না করে খেতে অনেক মজা।
– আপনি খেয়েছেন?
– নাহ। শুনেছি। আজকে রান্না করে দেখতে হবে
– ছিঃ! আমি পারব না এসব রান্না করতে।
– সে দেখা যাবে। আগে কটেজে নিয়ে যাই। চল।
*
দুপুরের খাওয়ার পর অফুরন্ত সময় পরে রইল। আজকে আর সমুদ্রপাড়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিল না সানান ভাই। অথচ সাঁঝ অপেক্ষায় আছে। প্রস্তাব পাওয়া মাত্র লুফিয়ে নিবে। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে ঘরে ঢুকে ঘুমের প্রস্তুতি নিতে শুরু করল সে।
অন্ধকার মুখে সে দৃশ্য দেখে হাত কচলাতে লাগল সাঁঝ। মনে মনে হাসলে মুখটা যথাসম্ভব গম্ভীর রেখে সানান ভাই বলল,
– কিছু বলবি?
সাঁঝ তার বড় বড় মায়াবী চোখে তাকিয়ে বলল,
– আপনি সাথে করে ক্যামেরা নিয়ে এসেছেন?
– হ্যাঁ। ব্যাগে আছে।
– আমার কয়েকটা ছবি তুলে দিবেন?
সানান ভাইকে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাঁঝ ভাবল সে রেগে গেছে।
– একটা তুলে দিলেও হবে।
– ঠিক আছে।
সাঁঝ ভাবেনি সানান ভাই এত সহজে রাজি হয়ে যাবে। রাজি যেহেতু হয়ে গেল তাই সাহস করে আরেকটু আবদার জুড়ে দিল।
– সমুদ্রপাড়ে সাদা শাড়ি পরে ছবি তুলব।
সানান ভাই তার ঘুমের পাট চুকিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে বলল,
– যা তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আয়।
সাঁঝকে আর কে পায়! পাখির মতো উড়ে গেল ওয়াশরুমে। ভাগ্যিস সাথে করে কয়েকটা শাড়ি নিয়ে এসেছিল। যদি জানত এতো সুন্দর একটা জায়গায় আসবে তাহলে আরও অনেককিছু সাথে নিত। সবুজ-নীল শাড়ি, ম্যাচিং চুড়ি, চাঁদনিচক থেকে কেনা নতুন দুল জোড়া, ন্যুড লিপস্টিক – সবাইকে খুব মনে পড়ছে।
একটা ছবির কথা বলে সারাটা বিকাল ফটোগ্রাফি চলল। সমুদ্রপাড়ে বসে, হেঁটে, দৌড়ে। বালুর উপর হেলে পড়া শুকনো গাছের গুঁড়ির উপর শুয়েও ছবি তোলা হলো। সমুদ্রের পানিতেও পা ভিজিয়ে হাঁটল।
অবশেষে সন্ধ্যা নামায় কমে গেল আলো। ছবি তোলা শেষ করে ক্লান্ত হয়ে দুজনে বসে পড়ল বালুর উপর। সানান ভাই ক্যামেরা হাতে নিয়ে ছবিগুলো দেখাচ্ছে। পাশে বসে মনোযোগ দিয়ে দেখছে সাঁঝ। ছবিগুলো এত সুন্দর এসেছে! সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো একদৃষ্টিতে দেখছে। মুখে চওড়া হাসি।
সানান ভাই দেখছে উচ্ছ্বসিত সাঁঝকে। উত্তেজনায় কখন যে এক হাত রেখেছে সানান ভাইয়ের কাঁধে সে খেয়াল তার নেই।
বাড়ি ফেরার আগে সানান ভাই বলল,
– চল সমুদ্রে নামি।
সাঁঝ ভয় পেয়ে দু পা পিছিয়ে গিয়ে বলল,
– আমি নামব না।
– না ছাড়া আর কিছু বলতে পারিস না তুই?
– আমি সাঁতার জানি না, সানান ভাই। পানিতে ডুবে যাব।
– কিছু হবেনা। আমি আছি না?
– আপনি যান। আমি এখানে বসি।
– সমুদ্রে এসে পানিতে না নামলে পাপ হবে, সাঁঝবাতি। প্রকৃতি রুষ্ট হবে তোর উপর। আয় আমার সাথে।
ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল সানান ভাই। ধীরে ধীরে নামল সমুদ্রের পানি। কোমর সমান পানিতে নামা পর্যন্ত সাঁঝ কিছু বলল না। কিন্তু এরপর পানির পরিমাণ যত বাড়তে লাগল, সে ছটফট করতে লাগল। চিৎকার করে সানান ভাইয়ের কান ঝালাপালা করে দিল।
বাধ্য হয়ে বুক সমান পানিতে থামতে হলো । সাঁঝও শান্ত হয়ে পানিতে খেলতে শুরু করল। ছোট ছোট স্রোত এসে ধাক্কা দিচ্ছে গায়ে। দু হাতের আঁজলায় পানি তুলে দূরে ছুঁড়ে মারতে লাগল। একবার ভুলবশত সানান ভাইয়ের গায়েও ছুঁড়ে মারল। বিপরীতে সানান ভাই কিছু বলল না। শুধু মুচকি হাসল। সে ডুবে আছে প্রেয়সীর ঠোঁটের হাসিতে। কয়েকটা পানির ফোটার কি সাধ্য তাকে প্রভাবিত করে।
নীলচে জলের স্বচ্ছতায় সাঁঝ এতটাই বিভোর ছিল যে সম্মুখের বিশাল ঢেউ চোখে পড়েনি। যদিও সুবিশাল ছিল না সেই ঢেউ। কিন্তু সাঁতার না জানা সাঁঝের আত্মা উড়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। মাথার উপর ঢেউ আছড়ে পড়তে সে চিৎকার করে উঠল।
– সানান ভাই আমি ডুবে যাচ্ছি। আমাকে বাঁচান।
হাবুডুবু খাওয়ার আগেই একটি শক্ত হাত কোমর জড়িয়ে ধরে তাকে শুন্যে তুলে নিল। জোরে শ্বাস নিয়ে হাঁপাতে লাগল সাঁঝ। ভেজা চুল থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। ঘোলাটে চোখে সানান ভাইয়ের দিকে তাকাল। সেও ভিজে গেছে।
সাঁঝের মনে হলো, নিশ্চিত মৃত্যু থেকে সে ফিরে এসেছে। পায়ের নিচে এখনো শুন্যতা বিরাজমান। ভয় পেয়ে দু হাতে সানান ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরে একপ্রকার ঝুলে পড়ল। কেঁদেকেটে বলল,
– আর একটু হলে মরে যাচ্ছিলাম। আপনি কি সত্যি সত্যি আমাকে পানিতে চুবিয়ে মারতে এনেছেন?
সানান ভাই হো হো করে গা দুলিয়ে হাসল। সাঁঝ মুখ ফুলিয়ে বলল,
– ভুলেও এমনটা ভাববেন না। আমার বাবা আপনাকে ছেড়ে দিবে না কিন্তু।
– এইটুকু পানিতে কেউ ডুবে মরে না। নিচে নাম।
কোমর ছেড়ে দিতে উদ্যত হতেই সাঁঝ আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সানান ভাইয়ের গলা। সেই সাথে চিৎকার তো আছেই।
– নাহ। ছাড়বেন না। আমি ডুবে যাব।
পানিতে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে দুজনে। গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে পোশাক। এখন আবার সানান ভাইয়ের গায়ের সাথে দ্বিতীয় ত্বকের মতো লেপ্টে গেল সে। এমন পরিস্থিতিতে প্রেমিক মন কতক্ষণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়?
তবুও সানান ভাই নিজেকে কঠোর সংযমে আবদ্ধ রেখে বলল,
– পানি বেশি গভীর না। পা রেখে দেখ।
তাকে ভরসা করে সাঁঝ ধীরে ধীরে পা নামাচ্ছিল পানিতে। তখনি আরেকটি বিশাকার ঢেউ দেখা গেলো সাগরের বুকে। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল সাঁঝের। চিৎকার করে উঠল,
– ঐ যে আরেকটা আসতেছে।
যতক্ষণে সানান ভাই সেদিকে তাকিয়েছে অনেক দেরী হয়ে গেছে। চোখের সামনে বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়তে দেখে ভয়ার্ত সাঁঝ আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তাকে। মুখ লুকালো তার গলার খাঁজে।
সানান ভাই দেখল এই ঢেউটি বেশ শক্তিশালি। সাঁঝকে বুকে আগলে নিয়ে দ্রুত ঢেউয়ের বিপরীতে ঘুরে দাঁড়াল।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সমুদ্রের বুকে ঢেউ আছড়ে পড়ে শান্ত হয়ে গেল। মুখ তুলে পিটপিট করে চাইল সাঁঝ। ঢেউরের ধাক্কায় সমুদ্রের আরও গভীরে চলে গিয়েছে ওরা।
সানান ভাইয়ের ভেজা চুল এসে ঢেকে দিয়েছে চোখ। মুখমণ্ডল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। দু হাতে সাঁঝকে জড়িয়ে ধরার কারণে চোখের উপর থেকে চুল সরাতে পারছে না। সাঁঝ একটু দয়া করে এক হাতে সানান ভাইয়ের চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দিল।
একজোড়া তীক্ষ্ণ বাদামী চোখ উন্মোচিত হলো। কিছু একটা ছিল সেই চোখের তারায়। মোহগ্রস্তের মতো সাঁঝ তাকিয়ে রইল সেদিকে। পলক ফেলতে ভুলে গেল।
ইয়াদুয়া তাবুর আরেকটি ডুবন্ত সূর্য নিজের সবটা আলো ঢেলে দিয়েছে সমুদ্রের বুকে। কনে দেখা আলোয় ভেজা শরীরে বুকের মাঝে আশ্রয় নেওয়া সাঁঝবাতিকে দেখে সানান ভাইয়ের সমস্ত সংযম, ধৈর্য, দ্বিধা একনিমিষে বিলীন হয়ে গেল।
ধীরে ধীরে ঝুঁকে এলো সাঁঝের মুখের কাছে। সরে যাওয়ার সুযোগ পেল না সে। হয়তো তার সেরকম অভিসন্ধিও ছিল না।
কিছু বুঝে উঠার আগে সানান ভাইয়ের ঠোঁট জোড়া নেমে এলো তার ঠোঁটে। কয়েক সেকেন্ড ঠোঁটের উপর স্থির হয়ে রইল। ততক্ষণে বোধশক্তি ফিরেছে তার। নড়ে উঠে ছেড়ে দিল সানান ভাইয়ের গলা। দূরে সরে আসতে চাইল। অনেকটা দেরী হয়ে গেছে।
এক হাতে কোমর জড়িয়ে রেখে ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে রেখেছে সানান ভাই। অন্য হাত উপরে এনে রাখল সাঁঝের ঘাড়ে। পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রেখে শুষে নিতে লাগল সাঁঝের সমস্ত দ্বিধা।
সাঁঝের মনে হচ্ছে শ্বাস নেওয়ার মতো এক বিন্দু অক্সিজেন অবশিষ্ট নেই এই পৃথিবীতে। দম আটকে আসার আগ মুহুর্তে সানান ভাই তাকে মুক্তি দিল। ঠোঁট জোড়া ছেড়ে দিলেও হাতের বাঁধন আলগা করল না। আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে রেখে কপাল ঠেকালো কপালে।
জালে আটকে পাওয়া মাছের মতো ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করে উঠল সাঁঝ। সানান ভাই তাকে ছাড়ল না। অনড় অবস্থায় চোখ বন্ধ রেখে ঠোঁটের কাছাকাছি ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
– নড়াচড়া বন্ধ কর। না হলে এমন কিছু করে ফেলব, পরে আফসোস করে কূল পাবি না।
সাঁঝ বোকা হলেও নর-নারীর শারীরিক ভাষা বুঝার মতো যথেষ্ট বয়স তার হয়েছে। নিজেদের অবস্থা মাত্রই খেয়াল হলো। লজ্জায় আরক্ত হলো মুখ। ফ্যাকাশে ঠোঁট জোড়া দাঁতে চেপে ধরে মুখ লুকালো সানান ভাইয়ের গলায়।
কানের কাছে মুখ নামিয়ে সানান ভাই ফিসফিস করে বলল,
– সাদা শাড়ি পরে পানিতে নামতে হয় না, সাঁঝবাতি। ঢেকে রাখার থেকেও প্রকাশ পায় বেশি।
*
চারদিকে অন্ধকারের চাদর নামতে শুরু করায় সমুদ্র থেকে ছুটে পালিয়েছে সাঁঝ। সানান ভাই উঠে এলো না। সমুদ্রের পানিতে ডুব দিল। সাঁতার কেটে পাড়ি দিল অনেকটা পথ।
বাড়ি ফিরে দেখল ফ্রেশ হয়ে চুলায় রান্না চাপিয়েছে সাঁঝ। সানান ভাই নিজেও ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করে বলল,
– দুরুকাগুলো কোথায়?
সাঁঝ তাকাল না। মুখেও কিছু বলল না। শুধু হাত দিয়ে ইশারা করে ফ্রিজের পাশে দেখিয়ে দিল।
– রান্না করতে পারবি?
এবারও মাথা দুলিয়ে না জানাল সে। ওগুলো নিয়ে এসে ঝুড়িতে রেখে সাঁঝের পাশে এসে দাঁড়াল সানান ভাই।
– কথা বলছিস না কেনো?
কাজের বাহানায় আরেকপাশে ঘুরে পেয়াজ কাটতে লাগল সাঁঝ। বাহু ধরে টেনে নিজের দিকে ঘুরালো সানান ভাই। লজ্জায় আরক্ত মুখখানা দেখে নীরবে হাসল। নাটুকেপনা করে বলল,
– ঠোঁট কেটেছে নাকি দেখি।
গালে হাত রেখে নিচু করে রাখা মুখটা উঁচু করতেই ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ঠোঁটজোড়া আড়াল করে ফেলল সে। সানান ভাইকে এড়িয়ে গিয়ে দুরুকার ঝুড়িটি নিয়ে আবার ফ্রিজের পাশে রেখে দিয়ে বলল,
– ফ্রিজে মুরগী ছিল। সেটা ভিজিয়ে দিয়েছি।
সানানা আরও কিছুক্ষণ রান্নাঘরে অযথা ঘোরাঘুরি করে সাঁঝকে বিরক্ত করল। সাঁঝ দক্ষতার সাথে তাকে এড়িয়ে গিয়ে নিজের মতো কাজ করছে। সানান অপেক্ষায় রইল রাতের। তখন দেখবে কী করে এড়িয়ে যায়।
কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে সাঁঝ ঘরেই এলো না। এবার রাগ হতে লাগল সানান ভাইয়ের। এতো জ্বালাতন কি সহ্য করা যায়?
হাতের বইখানা রেখে ড্রয়িংরুমে এসে দেখল সাঁঝ সেখানেই নেই। সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে অন্ধকার আকাশের দিকে।
সানান ভাই বিরক্ত সুরে শুধালো,
– অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কি করছিস?
সাঁঝ ফিরে তাকাল। মুখে ঝলমল করছে চাঁদের আলোর মতো হাসি। যা দেখে সানান ভাইয়ের হৃৎস্পন্দন এক সেকেন্ডের জন্য থেমে গেল।
– সানান ভাই, দেখুন আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টি আসবে।
পাশে এসে দাঁড়াল সানান ভাই। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
– আসলে আসবে। অনেক রাত হয়েছে। ঘরে চল।
– বৃষ্টিতে ভিজব।
– পাগল হয়েছিস? এই রাতের বেলা বৃষ্টিতে ভিজবে! ঘুমাতে চল। একদিনে দু’বার ভেজা যাবে না।
সাঁঝ জেদ দেখিয়ে বলল,
– আমি ভিজব।
– যা মন চায় কর।
সানান ভাই রাগ করে ঘরে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর সত্যি বৃষ্টি নামল। ঝুম বৃষ্টিতে সাঁঝ আয়েশ করে ভিজল। বৃষ্টি বিলাসের যথেষ্ট সময় দিয়েছে সানান ভাই। এবার জোর গলায় ডাক দিল।
– অনেক হয়েছে। আর ভিজিস না। ঠান্ডা লাগবে।
কিন্তু কে শুনে কার কথা! কাচের চুড়িতে রিনিঝিনি শব্দ তুলে সাঁঝ ভিজতে থাকল। সানান ভাই বাধ্য হয়ে বাইরে এসে ড্রয়িংরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে কঠিন চোখে চেয়ে বলল,
– তুই ভেতরে আসবি না?
কাঠের সিড়িতে পা ছড়িয়ে বসে আছে সাঁঝ। ফিরে তাকিয়ে বলল,
– আসছি। পাঁচ মিনিট।
সানান ভাই লম্বা লম্বা ফেলে সাঁঝের কাছে গিয়ে হাত ধরে টেনে তুলল। সাঁঝ হাত ছাড়িয়ে ছুটে যেতে চাইল সামনে। সানান ভাই হাত ছাড়ল না। বরং টান দিয়ে ওকে এনে ফেলল বুকে। সিক্ত ঠোঁট জোড়া পুনরায় দখল করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করল না।
ঠোঁটের দখলদারিত্ব না ছেড়ে কোলে তুলে নিল সাঁঝকে। ভেজা শরীরটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে বলল,
– বড্ড জ্বালাচ্ছিস সাঁঝবাতি। ভীতুর ডিমের সাহস বেড়ে গেছে। হু?
বিছানায় কনুই ঠেকিয়ে ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে লাগল সাঁঝ। সে যতই পেছায় সানান ভাই ততই আগায়। দুদিকে দু হাত চেপে ধরে আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল রাখল। মুখের উপর গরম উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
– এখন চুপ করে আছিস কেনো? সব সাহস শেষ হয়ে গেল?
এই প্রথমবার সানান ভাইয়ের চোখে চোখ রেখে বিনাশব্দে বাক্য বিনিময় করল সাঁঝ। আনমনে এগিয়ে গেল সানান ভাইয়ের দিকে। নিজে থেকে দখলে নিল বেদানার মতো রক্তিম ঠোঁটজোড়া।
নগ্ন উদরে হাতের ছোঁয়ায় কেঁপে উঠল সাঁঝ। চোখের তারায় দেখা দিল আতংক। ইতিমধ্যে তার হাত দু’খানা মুক্ত হয়েছে। দু হাতে উদরে রাখা সানান ভাইয়ের হাতটি সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে অস্ফুটে স্বরে বলল,
– নাহ।
কপালে ভাঁজ পড়ল সানান ভাইয়ের। ওর গালের হাত রেখে নরম সুরে জানতে চাইল,
– নাহ কেনো?
– জানি না।
– জানি না বললে হবে না। তোকে জানতে হবে। আমাকেও জানাতে হবে।
সাঁঝ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল,
– আমার ভয় করে।
নরম গালে নাক ডুবিয়ে সানান ভাই করুণ সুরে অনুরোধ করল,
– তুই যদি আজকেও ভয় পাস, বিশ্বাস কর নিজেকে কন্ট্রোল করতে গিয়ে আমি নিশ্চিত মরে যাব। বুঝতে পারছিস না আমার অবস্থা কতটা শোচনীয়? প্লিজ, প্লিজ সাঁঝবাতি। আজকের রাতটা একটু সাহসী হ। প্রমিস করছি, তোর সকল ভয় আমি দূর করে দিব।
সাঁঝ ঘাড় সোজা করে সানান ভাইয়ের চোখে চোখ রাখল। চোখজোড়ায় জল চিকচিক করছে। সাঁঝের বড্ড মায়া হলো। শুকনো ঢোক গিলে কোনো রকম বলল,
– আলোটা নিভিয়ে দিন।
সানান ভাই ঠোঁট চেপে হাসল। দুষ্টুমি করে বলল,
– আলো নিভিয়ে দিলে অন্ধকারে দেখব কীভাবে?
অসভ্য লোকটাকে এক ঝটকা মেরে নিজের উপর থেকে সরিয়ে দিল সাঁঝ। কিন্তু নিজে সরে যেতে পারল না। তার আগেই এক হাতের বন্ধনে আটকে ফেলল সানান ভাই। অন্য হাতে বাতি নিভিয়ে দিল।
ঝুপ করে নেমে আসা অন্ধকারে দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দ ঢাকা পরে যাচ্ছে। একসময় চোখ সয়ে এলো অন্ধকারে। মাঝেমধ্যে বজ্রপাতের ঝলকানিতে আলোকিত হচ্ছে ঘরের চারপাশ।
প্রকৃতি প্রদত্ত দৈবিক আলোতে রুক্ষ হাতের কোমল ছোয়ায় আবরণ মুক্ত হলো সাঁঝ। খোলা চোখে সানান ভাইয়ের অভিলাষী দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলানোর সাহস নেই। চোখ বুজে সে আবিষ্কার করল শরীরের বাঁকে বাঁকে উদ্ধৃত নতুন অনুভূতি।
ঠোঁটের সিক্ত ছোঁয়া, রুক্ষ হাতের স্পর্শ পৌঁছাচ্ছে শরীরের প্রতিটি স্থানে। অসহনীয় অনুভূতি সামলাতে টালমাটাল অবস্থা সাঁঝের।
তার থেকেও ভয়াবহ পরিস্থিতিতে রয়েছে সানান ভাই। কামনা, যাতনার দোলাচালে দুলছে।
মন আজ বড্ড বেপরোয়া। যেকোনো বাধা পেরিয়ে হাসিল করতে চায় নিজের অধিকার। অন্যদিকে মস্তিষ্ক সদা সতর্ক। কোনোরূপ অসংযত আচরণ ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে প্রেয়সীর সুমিষ্ট স্নিগ্ধতা। যে সরলতায় সে মুগ্ধ হয় প্রতি মুহূর্তে, তা হারিয়ে ফেললে কখনও ক্ষমা করতে পারবে না নিজেকে।
সাঁঝের কানের কাছে মুখ নামিয়ে মায়াভরা ভরাট কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলল,
– আজকেও শ্বাস আটকে রেখেছিস নাকি?
সাঁঝ জবাব দিল না। শুধু অন্ধকারে বিরক্তিসূচক কিছু শব্দ শোনা গেল। সানান ভাই নীরবে হাসল। নরম গালে নাক ঘষে বলল,
– আমার কাঁধে নিঃশ্বাস ফেল দেখি।
দুহাতে নগ্ন পিঠ আঁকড়ে ধরে বাধ্যগত সাঁঝ তার কাঁধে মুখ গুজে দিল। ঠিক তখনি নতুন ঢেউ আছড়ে পড়ল শরীরে। আকস্মিক তরঙ্গচ্ছ্বাসে টালমাটাল সাঁঝ আরও শক্ত করে ধরল একমাত্র অবলম্বন। যন্ত্রণার বিপরীতে দ্বিগুণ যন্ত্রণা ফিরে দেওয়ার নতুন অভ্যাস তৈরি হলো।
নখের আঁচড় ত্বক ভেদ করে আরও গভীরে প্রবেশ করলেও সামান্য মাত্র টু শব্দ করল না সানান ভাই। বিপরীতে পরম আবেশে চুমু খেল সাঁঝের কপালে।
*
উপরের সবুজ খোসা ছাড়িয়ে ভেতরের নরম অংশ দু হাতে ঝুরঝুরে করে নিয়ে অন্যান্য সবজির মতো রান্না করা হয় দুরুকা। ক্রিমি ভাব আনতে যুক্ত করা হয় নারকেলের দুধ বা ক্রিম। অনেকে টুনাও দেয়। সানান ভাই দিল না।
নারকেলের ক্রিম যুক্ত করে হালকা নেড়েচেড়ে চুলা থাকে নামিয়ে ফেলল। একটি বাটিতে তুলে নিয়ে পরোটার সাথে পরিবেশন করতে রাখল টেবিলে।
সকাল নয়টা বেজে গেছে অথচ সাঁঝের ঘুম ভাঙছে না। এদিকে রুটি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
বেড রুমের দরজা খুলতেই টুপ করে চাদরে মুখ ঢেকে নিল সাঁঝ। কিন্তু ইতিমধ্যে সে দেখে ফেলেছে।
ঘুম ভাঙার পরও ঘরে লুকিয়ে আছে দেখে আড়ালে নীরবে হাসল। সাঁঝের পাশে বসে মুখের উপর ঝুঁকে বলল,
– এই সাঁঝবাতি? এখনো ঘুমাচ্ছিস?
চাদরের আড়াল থেকে সাঁঝ উত্তর দিল,
– হু।
নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসি আটকাল সানান ভাই। আগের মতো করে বলল,
– ঘুম ভাঙেনি?
– উহু।
– পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি। তাড়াতাড়ি উঠে পড়। রুটি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
সাঁঝকে আর লজ্জায় না ফেলে সানান ভাই বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। চায়ের পানি বসিয়েছে চুলায়। দেশ ছেড়ে আসার আগে ইউটিউবে রান্নার ভিডিও দেখেছিল ঠিকই। কিন্তু এই মুহূর্তে ঠিক মনে পড়ছে না। রঙ চায়ের জন্য এক কাপ পানিতে কতটুকু চা-পাতা দিতে বলেছিল যেনো! উফ! রান্না এতো ঝামেলার কাজ জানলে বাড়িতে কয়েকবার প্র্যাক্টিস করে আসত।
মুখরা সানান ভাইয়ের কপালে বউ জুটেছে লাজুকলতা। মন খুলে দুষ্টামিও করতে পারছে না সানান ভাই। অথচ বউয়ের লালচে গাল দুটো দেখলেই তার মন আকুপাকু করে। নেহাৎ সে ছেলে ভালো, তাই নিজের ইচ্ছের আগে বউয়ের স্বস্তির কথা চিন্তা করে মুখটা বন্ধ করে রেখেছে।
*
পরবর্তী দিনগুলোতে সাঁঝকে কোনো অপ্রস্তুতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি সে ফেলেনি। পাহাড়ের চূড়ায় উঠেছে, সাঁঝের কিছু ছবিও তুলে দিয়েছে।
মোট সাতদিনের ট্যুর প্ল্যান করেছিল সানান ভাই। কিন্তু পঞ্চম দিনেই সাঁঝের নাভিশ্বাস দশা। এমন নির্জন এলাকায় একলা, একাকী জীবনযাপনে সে অভ্যস্ত নয়। মায়ের আঁচল ধরে, বাবার ছায়াতলে, দাদীর জর্দার ঘ্রাণে কেটেছে জীবন। সে কী করে একাকীত্বে শান্তি খুঁজে পাবে?
সানান ভাই না হয় প্রেমে মত্ত হয়ে প্রেয়সীর চোখের কাজলে ডুবে রয়েছে। সাঁঝের মনে তেমন কিছু নেই। সে ডুবে যাচ্ছে হতাশায়।
ঘরে অবশ্য একটা টেলিফোন আছে। রেডিও সিগন্যালের মাধ্যমে এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করা যায়। দেশ হতে আসা টেলিফোন ব্রিজ করে দেওয়া হয় এই কটেজের টেলিফোনে। প্রক্রিয়াটি জটিল। তাই দিনে একবার পাঁচ-ছয় মিনিটের জন্য বাবার সাথে কথা বলার সুযোগ পায় সাঁঝ।
কটেজে একটা ফিশিং রড ছিল সেটা দিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে গেছে সানান ভাই। টেলিফোনে কথা শেষ করে সাঁঝকেও যেতে বলেছে সেখানে।
সকাল থেকে মন খারাপ লাগছিল সাঁঝের। বাবা যখন বলল,
– কেমন আছিস, মা?
সে হু হু করে কাঁদতে শুরু করল। মনে হচ্ছে কতদিন বাবাকে দেখে না। মেয়ের কান্না শুনে অস্থির হয়ে পড়লেন সাদিক শারাফাত।
– কি হয়েছে মা? কাঁদছিস কেনো?
– আমি বাড়ি যাব। এখানে ভালো লাগছে না।
ব্যাস। সাদিক শারাফাতকে আর কে পায়। ভয়ে, শঙ্কায় তিনি বাড়িঘর মাথায় তুলে ফেলেন প্রায়। এমনিতেই মেয়েকে এতদূরে পাঠাতে চাননি। এখন আবার মেয়ে কাঁদছে।
দুটো মাছ হাতে বাড়ি ফিরে সানান ভাই দেখলেন বারান্দায় বসে আছে সাঁঝ।
– এখানে বসে আছিস কেনো?
সাঁঝ উত্তর দেওয়া টেলিফোন বেজে উঠল। এজেন্সি থেকে কল দিয়েছে। বলল,
– আফসানা পারভীন নামে একজন আপনার খোঁজ করছেন।
– সে আমার মা। লাইন ধরিয়ে দিন।
রিসিভারে প্রথমেই শোনা গেল আফসানার রাশভারী কণ্ঠ।
– কি করেছিস তুই? সাঁঝ কাঁদছে কেনো?
সানান ভাই ভ্রু কুচকে তাকাল। সাঁঝ কাঁদছে অথচ সে জানে না। হাজার মাইল দূরে মানুষজন জেনে বসে আছে। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে যা বুঝার তা বুঝে গেল সানান ভাই।
বাইরে এসে দেখল উদগ্রীব হয়ে ঘরের দিকেই চেয়ে আছে সাঁঝ। সানান ভাইয়ের রাগ তখন মধ্যগগনে। তবুও ধমক দিতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিল। শুধু অসন্তুষ্ট গলায় বলল,
– বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে সেটা আমাকে বলা যেত না?
সাঁঝকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কটেজ থেকে বেরিয়ে গেল। কোথায়, কোনদিকে গেল সাঁঝ জানে না। মাছ দুটো কুটে রান্না সম্পন্ন করে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল। দুপুর গড়িয়েও যখন সানান ভাই ফিরল না, দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল সে।
কটেজ ছেড়ে সমুদ্রতটে দাঁড়িয়ে চারপাশে অস্থিরভাবে চোখ বুলালো। নাহ, কোথাও কেউ নেই।
সাঁঝের এতো অভিমান হলো! বাবার কণ্ঠ শুনে আবেগী হয়ে না হয় বলে ফেলেছে, তাই বলে রাগ করে জনমানবহীন দ্বীপে একলা ফেলে চলে যাবে সানান ভাই?
সমুদ্রতটের শুকনো বালুতে বসে কতশত ভয়ানক পরিণতির ভাবনা আসছিল মনে, তখনি নজরে এলো সানান ভাই। বাম পাশের পাহাড় বেয়ে নিচে নামছে। সাঁঝ দ্রুত উঠে দৌড়ে গেল সেদিকে।
শক্তপোক্ত বুকটায় ঝাপিয়ে পড়ে দু হাতে শক্ত পিঠ আঁকড়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে বলল,
– বাবার সাথে কথা বলতে গিয়ে বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছিল। এজন্য বলে ফেলেছি। স্যরি। আর এমন কিছু বলব না।
– আবার কাঁদছিস কেনো? চুপ কর।
– আপনি আমার উপর রেগে আছেন?
ওকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে চোখ মুছে দিয়ে সানান ভাই বলল,
– নাহ। রাগ করব কেনো? বাড়ি যেতে ইচ্ছে করলে যাবি, এতে রাগ করার কি আছে?
– তাহলে আমাকে একা ফেলে চলে গিয়েছিলেন কেনো?
– পাহাড়ের ওপাশে আরেকটা দ্বীপ আছে। ওখানে টুরিস্ট এসেছে। আমরা ওদের সাথে শহরে যাব। সেখান থেকে দেশে ফিরব।
– আজকেই?
– হ্যাঁ। চল ব্যাগ গোছাতে হবে।
সানান ভাই সহজ আচরণ করলেও সাঁঝের মনে হলো, তার আচরণে সে রুষ্ট হয়েছে। রেগেও আছে বোধহয়। দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসা করার সাহস হলো না সাঁঝের।
সেদিন বিকালে টুরিস্টদের ছোট প্লেনে ওরা নাদী ফিরে গেল।
পেছনে পড়ে রইল সুন্দর কিছু মুহূর্ত। পড়ন্ত বিকালের নরম আলোয় আবারও রঙিন হয়ে উঠল লুকায়িত কটেজটি।
যেখানে বর্ষার ঝুম বৃষ্টিতে সাঁঝ ভিজেছিল। সাথে ভিজিয়েছিল সানান ভাইকে। তাদের প্রেমময় সূচনার সাক্ষী হিসেবে সমুদ্রতটের বালুকায় এখনো জেগে আছে কিছু পায়ের চিহ্ন। যা হয়তো বহমান বাতাসে খুব শীঘ্রই মুছে যাবে।
সমাপ্ত।