একগুচ্ছ শুকতারা পর্ব-০৪

0
200

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

৪.
খাটের পাশেই ফোমের তোষক জাতীয় কিছুতে আরামে ঘুমাচ্ছে পার্থিব৷ দৃশ্যটা সুন্দর। আরামপ্রিয় দৃশ্য। হিম বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে গা৷ তার দরুন পার্থিব এর শরীরে পাতলা এক চাদর যা তার ঘুমকে আরো গভীর ও আরামদায়ক করে তুলছে৷ সেদিকেই শ্রুতির নিষ্প্রভ দৃষ্টি। লোকটা কী সুন্দর ঘুমাচ্ছে! অথচ তার কোনো কার্যকলাপ শ্রুতির ওপর প্রভাব ফেলছে না৷

এক দৃষ্টিতে শুধু ভেবে চলেছে হামিম কী করছে? বিদায়বেলায় হামিম এর দেখা পায়নি শ্রুতি, বিভা৷ ছেলেটা কোথায় ছিল কে জানে! হতে পারে তার ভাই শারীরিক মানসিক কোনো দিক দিয়েই সম্পূর্ণ সুস্থ নয়৷ কিন্তু তার ভাই তো তার বোনদের চেনে৷ ভালোবাসে৷ হামিমের দুনিয়া বলতেই বিভা আর শ্রুতি৷ আজ তারাই দূরে সরে এলো৷ কী করছে তার ভাই?
ছোটবেলায় তাহিরার পেটে যখন হামিম ছিল তখন অন্য মানুষেরা বলত শ্রুতির বোন হবে৷ কথাটা মূহুর্তের মধ্যে গায়ে জ্বলন ধরানোর কাজ করতো৷ শ্রুতি রেগে মুখ ফুলিয়ে সকলকে বলে দিত,’আপনি আর আমাদের বাড়িতে আসবেন না৷’
জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে আকাশের তারাগুলো দেখায় মনোনিবেশ করলো শ্রুতি৷ সারা আকাশ জুড়ে তারা৷ কেবলমাত্র এক জায়গাতেই তিনটে তারা। বিভা, শ্রুতি আর হামিম৷ অধর প্রশস্ত করে হাসল শ্রুতি৷ এর থেকে সুন্দর দৃশ্য আর হতে পারে না৷

.
‘কাল একটু ক্লান্ত ছিলাম৷ তাই জলদি ঘুমিয়ে পড়েছি। আপনি বোরিং ফিল করেননি তো?’ বলল পার্থিব।

‘আপনার এতো উদ্বিগ্ন হবার মতো কী হলো? ঘুম পেয়েছে ঘুমিয়ে গেছেন৷ এখানে এমন করে কৈফিয়ত দেওয়ার মতো কিছু হয়নি৷ আমি কী কিছু জিগ্যেস করেছি?’

পার্থিবের মন ক্ষুণ্ণ হলো কিছুটা। শ্রুতির কাছে এমন ব্যবহার সে আশা করেনি আবার ভালো ব্যবহারও আশা করেনি৷ আচ্ছা, শ্রুতি কী ওই সামান্য ব্যাপার নিয়ে এখনো রাগান্বিত? যদিও অমতে বিয়ে করাটা স্বাভাবিক ব্যাপার নয়৷ তবুও….বিয়ে তো হয়ে গেছে, এখনো রেগে থাকবে?

শ্রুতি খাটে বসে আছে৷ পার্থিব শ্রুতির সাথে কথা বলার প্রসঙ্গ খুঁজল৷ ভালো কোনো প্রসঙ্গ পাওয়া গেল না৷
‘আপনি কী আমার ওপরে কোনো কারণে রেগে আছেন শ্রুতি?’

‘সেটা আপনার না জানলেও চলবে৷ প্লিজ! আমাকে আমার মতো থাকতে দিন।’

বাহির থেকে তানহা বেগমের গলা শুনতে পাওয়া গেল৷ সে রুমে প্রবেশ করেই সর্বপ্রথম দুইজনের দিকে তাকিয়ে মন মাতানো এক হাসি দিলেন৷ তার হাসিতেই যেন সকালের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেল বহুগুণ।

‘পার্থিব! শ্রুতি! নিচে যাবি কখন? ব্রেকফাস্ট করতে হবে তো৷ দুজনে জলদি নিচে আয়।’

বলেই তানহা বেগম চলে গেলেন৷ শ্রুতি সেদিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবেই পার্থিব এর সামনে এসে দাঁড়াল৷ অশ্রু ভাসা চোখে অনুরোধ করে বলল, ‘আপনি আমায় সাহায্য করবেন?’
নিজের ঠোঁটের হাসিটুকুর রেশ গলায় মাখিয়ে বলল, ‘শুধু একবার বলে দেখুন।’

‘আমি আমার ভাইয়ের সাথে কথা বলতে চাই৷’
পার্থিব বুঝতে পারলো শ্রুতির মনের অবস্থা। তবে এটা ভেবে বেশ অবাক হলো যে শ্রুতির ভাই আছে। শ্রুতির ভাই সম্পর্কে কিছু জানে না পার্থিব। কই বিয়ের দিনও তো সে দেখল না৷ কই ছিল তার ভাই?
কথার মাঝেই প্রভা-প্রত্যাশার আগমন৷
‘ভাবী সারাদিন আমার হ্যান্ডসাম ভাইয়ার সাথে থাকলে হবে? খাবার খাবে কখন?’ বলেই নিজের চোখের চশমাটা ঠিক করল প্রভা৷
হটাৎ কারো কথায় চমকে উঠল শ্রুতি৷ তাদের কথা কানে পৌঁছাতে পারল না শ্রুতির৷ তার আগেই প্রভা-প্রত্যাশা দুইজন মিলে শ্রুতির দুই হাত ধরে নিয়ে যেতে লাগল৷ শ্রুতি পিছন ঘুরে ব্যাকুল দৃষ্টিতে চাইলো৷ পার্থিব নিজের চোখের পলক ফেলে আশ্বস্ত করলো শ্রুতিকে৷

.
খেতে গিয়েও ফ্যাসাদে পরলো শ্রুতি৷ সে বুঝেনা তার চারপাশে ঝামেলাগুলো এমন করে ওঁৎ পেতে থাকে কেন? তার পাতে দেওয়া হয়েছে ইলিশ মাছের টুকরো আর ভাত৷ অথচ সে জীবনেও নিজে বেছে মাছ খায়নি৷ অন্য মাছ খেলেও সে ইলিশ মাছ খায়না৷ খায়না বলতে কাঁটা বাছতে তার ভালো লাগেনা৷ ওই বাড়িতে তো ইলিশ মাছ রান্না হলে সেদিন বিভা নিজে মাছ বেছে হামিম আর তাকে খাইয়ে দিত৷ কিন্তু এখানে তো বিভা নেই৷ হামিম নেই৷ কেউ নেই৷
ভাবতেই গলায় ব্যথা হতে লাগল শ্রুতির৷ প্লেটের দিকে তাকিয়ে এক দলা সাদা ভাত মুখে পুরে নিল সে। আনমনে চিবুতে লাগল৷
‘একি! তুমি মাছ খাচ্ছো না কেন?’ আহাজারি করে বলল তানহা৷
‘আমি ইলিশ মাছ খেতে পারি না।’ শান্ত তবে সোজা উত্তর দিল।
তানহা শাসন করে বললেন, ‘এ মা! আমাকে বলবে তো! আমি সাহায্য করছি দাঁড়াও।’
শ্রুতি মাথা নিচু করে না বোঝাল ৷ সে কারোর সাহায্য চায়না৷ লাগবে না সাহায্য৷

তানহা আদুরে হাত মাথায় বুলিয়ে দিলেন৷ মাংসের বাটি এগিয়ে পাতে তুলে দিলেন৷ শ্রুতি নিচু হয়ে চোখের পানিগুলো সামলে নিল৷ শ্রুতির ধারণা সে কঠিন ধাঁচের মেয়ে৷ তবে অল্পতে চোখে পানি আসার মানে কী?
পাশে থেকে পার্থিব মাছ বেছে শ্রুতির পাতে তুলে দিল। বলল,
‘খেয়ে নিন শ্রুতি৷ ইলিশ আমার প্রিয় মাছ৷ আপনি খেয়ে দেখুন কতো মজা! কাঁটা হয়তো একটু বেশি তবে স্বাদ তার চেয়েও বেশি৷ কাটার জন্যই বোধহয় মাছ টা এতো মজা।’

আড় নজরে তাকাল শ্রুতি৷ এই কয়েক ঘন্টায় সে যা বুঝেছে তার ভিত্তিতে – পার্থিব বড্ড বেশি কথা বলে। অযথাই কথা বলে৷ শ্রুতি কী বলেছে যে সে ইলিশ খায় না? তার কাঁটা বাছতে ভালো লাগেনা বলে সে খায় না৷ অথচ লোকটা এমন ভাব করল যেন শ্রুতি কোনোদিন ইলিশ মাছ খায়’ইনি৷ পার্থিব মাছ বেছে বেছে শ্রুতির পাতে তুলে দিচ্ছে৷ কৃতজ্ঞতার বদলে শ্রুতির রাগ হচ্ছে৷

তবে তানহার ব্যাপারটা বেশ লাগছে৷ স্বামীদের তো এমনই হওয়া উচিত৷ স্ত্রীদের প্রতিটি ব্যাপারে নজর রাখা। দায়িত্বশীল হওয়া৷ স্ত্রীদের প্রতি যত্নবান হওয়া৷ আদর্শ স্বামী হওয়া৷ নিঃসন্দেহে তার ছেলে পার্থিব আদর্শ স্বামীর দলে পরে।

.
আনমনে বসে আছে বিভা৷ মনে জমেছে অজস্র কালো মেঘ৷ বৃষ্টি পরে মনটা পরিষ্কার হলে ভালো হতো৷ অথচ বৃষ্টি পড়ুক তাও বিভা চায় না৷
ও বাড়িতে ফোন দিয়েছিল ৷ দাদি ফোন ধরেছে৷ হামিমকে চাইলো বিভা। অথচ হামিম বিভার সাথে কথা বলতে নারাজ৷ হাজার বলেও কথা বলানো যায়নি হামিমের সাথে৷ বিভা আরো জেনেছে হামিম তার ঔষধ খাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে৷ ক্ষিদে পেলে ভাত খায় নিজ হাতে অথচ ঔষধ খায় না৷ দাদি ঔষধের কথা বললে অযথাই চিল্লাপাল্লা করে৷
বিভা সকালে যাও খেয়েছে কিন্তু হামিমের কথাটা শোনার পর দুপুরে গলা দিয়ে খাবার নামেনি বিভার৷ পৃথিবীটা কেমন যেন! বড্ড মন খারাপ করা৷ পৃথিবীর স্বভাবই হয়তো মন খারাপ করিয়ে দেওয়া৷ এই যেমন কাল রাত থেকে আজ পর্যন্ত নিজের স্বামীর সাথে স্বাভাবিক কথাই বলতে পারেনি বিভা৷ রাতে দুইজন দুইজনের মতো ঘুমিয়েছে৷ সকাল বেলা নাকি নিজের কাজে চলে গিয়েছে মাহাব৷ বিভার শ্বাশুড়ি, শ্বশুড় মিলে একাই নাস্তা করে নিয়েছিল৷ দুপুরেও তাই৷ লোকটা এমন করছে কেন? এইদিকে তার শ্বাশুড়ি তাকে এইটা সেইটা বলে পাগল বানাচ্ছে৷ সব প্রশ্নই মাহাব লোকটাকে নিয়ে৷ যার সাথে কথাই বলেনি, তাকে নিয়ে কী উত্তর দিবে?
এরই মাঝে শ্বাশুড়ির ডাক পরতেই তার কাছে চলে গেল বিভা৷

.
বিভা সুন্দর একটা সংসার চায়। ভালোবাসা চায়। নিজস্ব এক পৃথিবী চায়৷ যেখানে সবাই সবাইকে ভালোবাসবে৷ কোনো কষ্ট থাকবে না। তবে হ্যাঁ মান-অভিমান অবশ্যই থাকবে৷
বিভার মনটা এখন ভালো। শ্রুতির সাথে তার কথা হয়েছে। শ্রুতির পর দাদীর সাথে কথা বলে আবার হামিমের খোঁজ নিয়েছে বিভা৷ জানা গেছে দাদী হামিমকে ঔষধ খাওয়াতে সক্ষম৷ শুনেই বিভা খুশিতে গদগদ হয়ে গেছে। খুশির জন্য বেশি কিছু প্রয়োজন পরে না৷ কেবলমাত্র আপনমানুষের ভালো থাকাই যথেষ্ট।
দাদী কথার এক ফাঁকে আরো বলেছেন,
‘স্বামীর ঘর ভালো কইরা করিস বিভা৷ মনে রাখিস স্বামীর ঘর আসল ঘর। তোর বাপ খারাপ দেইখা পুরা পুরুষজাত খারাপ না। স্বামী হইলো আপন মানুষ। পৃথিবীতে স্বামীর থিকা আপন কেউ নাই। তাই তারে মাইনা চলবি। খুশি রাখার চেষ্টা করবি। আর বহুত ভালোবাসবি। বুজলি ছেমড়ি?’

‘বুঝেছি।’ এক শব্দে উত্তর দেয় বিভা৷ দাদী এইসব না বললেও বিভা শুনতো৷ অকারণে মানুষকে কষ্ট দেওয়া তার পছন্দ না৷ বিয়ে যেহেতু হয়েছে, সংসারও হবে৷ তার জন্য অন্য মানুষেরা কেন কষ্ট পাবে?

দাদীর কথায় কী ছিল বিভা জানে না৷ তবে অদৃশ্য কোনো কারণে নিজের স্বামীর জন্য টান অনুভব করছে সে। তার আপনজনদের তালিকা সীমিত। কিন্ত বিভার ইচ্ছে সে তার আপনজনদের তালিকা বৃদ্ধি করবে৷ নিজের ভাবনায় নিজেই হেসে উঠলো বিভা৷ তার মুচকি হাসিটা সুন্দর। মলিন হাসি, তবে ভীষণ সুন্দর।
______________

চলবে~