একগুচ্ছ শুকতারা পর্ব-২০+২১

0
155

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

২০.
সুখের সময় বুঝি একটু তাড়াতাড়িই শেষ হয়। হামিম, শ্রুতি, পার্থিব চলে গেছে ৪০ মিনিট হলো। খুব বেশি সময় নয়, তবে বিভার মনে হচ্ছে অনেক সময়।
বিভা সোফায় বসে পুরো ঘরের দিকে তাকাল। কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা। মাঝারি আয়তনের ফ্ল্যাট’টাকে বিভার কোনো রাজপ্রাসাদের মতো মনে হচ্ছে। যেখানে সে একা, শুধু সে, আর কেউ নেই। অথচ কিছুক্ষণ আগেও ছিল।
খারাপ লাগছে ভীষণ। ছোট ছোট ভাই-বোন দুটো কতো বড় হয়ে গেছে। মনে পড়ল ছোটবেলার কথা। তিনজন একসাথে ঘুমানো, শ্রুতির অল্পতেই রে গে যাওয়া, কান্না করা, হামিমের যত্ন নেওয়া, নিজে মাঝে থেকে বাকি দু’জনকে দুহাতে আগলে রাখা – সব এক নিমিষে বিভার সামনে ভেসে উঠল। সময় এতো তাড়াতাড়ি কেন চলে যায়?

বিভার হঠাৎ মনে পড়ল শ্রুতির যাওয়ার আগের ঘটনা-
শ্রুতি যাওয়ার আগে বিভাকে অন্যঘরে ডেকে নিল। স্বাভাবিক কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
‘মাহাথির ভাই কী তোমার সাথে খুব খারাপ আচরণ করে?’
বিভা চমকে গেল। তাদের ব্যাপারে সে তো কিছু বলেনি, তবে শ্রুতি এমন কথা কেন বলছে? তবে কী মাহ্থির বলেছে? বলতেই পারে।
বিভা কী বলবে ভেবে পেল না। সে মিথ্যা বলতে পারে না। আর শ্রুতি যেহেতু বুঝে গেছে ইনিয়ে-বিনিয়ে কিছু বলেও বিশেষ সুবিধা বিভা করতে পারবে বলে মনে হলো না। উত্তর দিল, ‘না।’

‘তারমানে উনি খারাপ ব্যবহার করে?’

‘না, খারাপ ব্যবহার করেনা শ্রুতি। শুধু আমাকে মেনে নিতে পারছেনা। তবে নিবেনা এমন’ও না। সে চেষ্টা করছে।’ সত্য মিথ্যা মিলিয়ে উত্তর দিল বিভা।

‘উনাকে ডিভোর্স দিয়ে দে, আপা।’ শ্রুতির ক্ষো/ভ মেশানো কণ্ঠস্বর।
এমন কথা শুনে চমকে উঠল বিভা। এমন কিছু সে আশা করেনি। ডিভোর্স? কীভাবে সম্ভব!

‘তোকে এতো করে থাকতে বলছি। কিন্তু থাকবি তো না। বাড়ি যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছিস। গেলে এখনই চলে যা, নয়তো রাত হয়ে যাবে।’

‘কথা ঘুরাচ্ছিস, আপা? তুই উনাকে ডিভোর্স দিয়ে দে। আমি জানি উনি তোকে কষ্ট দেয়। কী দরকার এইভাবে থাকার? উনার মতো খারাপ মানুষের সাথে থাকার কোনো দরকার নেই।’

এই পর্যায়ে বিভার মুখ থেকে সব প্রতিক্রিয়া চলে গেল। শব্দবিহীন ঠোঁট প্রসারিত করল, ‘উনি খারাপ নয় শ্রুতি। একদম খারাপ নয়। আমি বলছি, আমাকে বিশ্বাস কর। উনি খারাপ নয়। খারাপ হলে উনাকে মনে জায়গা দিতাম না। যেভাবে আমিন শিকদারকে মন থেকে উঠিয়ে দিয়েছি, সেভাবে উপড়ে দিতাম যার ছাপটাও অবশিষ্ট থাকতো না। এতো চিন্তা করিস না, ঠিকভাবে নিজের সংসার কর।’ বিভা শ্রুতিকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আশ্বস্ত করল। শ্রুতি কিছু বলল না, কেবল তাকিয়ে রইল।

তাদের কথোপকথন তারা বাদেও যে আরেকজন শুনেছে, তা দু’জনের কেউ’ই জানে নি।

শ্রুতির কথা ভাবা শেষেই বিভা মনে করল ওদের যাওয়ার সময়ের আশ্চর্যজনক ঘটনা। শ্রুতিরা যখন যাওয়ার কথা বলল তখন তাদের থাকতে বললেও রাজি হলো না। এরপর মাহাথির সবাইকে চমকে দিয়ে হামিমকে রেখে দিতে চাইল। সেখানে বাঁধ সাধল পার্থিব। মুখে হাসি রেখে বিনীতভাবে শুধু বলল, ‘ভাইয়া, আজ নিয়ে যাই। অন্যদিন ওর জামা-কাপড়, জিনিসপত্র সহ নিজেই নিয়ে আসব। আর কয়েকটা দিন ছোটবোনের বাড়িতে থাকুক। প্লিজ?’
পার্থিব ছেলেটা অতিরিক্ত ঠান্ডা, ভদ্র। এতো সুন্দর করে অনুরোধ করায় মাহাথির কিছু বলতে পারেনি। মাথা নেরে সায় দিয়েছে।

.
পার্থিব কাজ করছে। তবে কাজে মন বসছে না ভালোভাবে। সে খেয়াল করেছে সেই বাড়ি থেকে আসার পর থেকেই শ্রুতি তাকে এড়িয়ে চলছে। তেমন উগ্র কিছু করেনি, তবে শ্রুতির এড়িয়ে চলা পার্থিব বুঝে নিয়েছে।
আবার কী হলো এই মেয়ের? ভূত নামতে না নামতেই আবার নতুন কোন ভূত মাথায় উঠল কে জানে। পার্থিব কম্পিউটারের মাধ্যমে ফেসবুকে ঢুকে টাইপ করতে লাগল – আমার বাবুর নাম হবে ভূতু, ভূত এবং মানুষের বাচ্চা ভূতু। ভূতের বাচ্চা ভূতু।
এখানে, সে নিজেকে মানুষ এর কাতারে রাখল। নিজের স্ট্যাটাস পড়ে, নিজেই হেসে দিল পার্থিব। স্বচ্ছ, সুন্দর হাসি।

.
শ্রুতি শুয়ে আছে চোখ বন্ধ করে। ঘুমানোর চেষ্টা করছে, ঘুম আসছে না। ভীষণ রাগ, অস্বস্তি হচ্ছে। উঠে বসল। নিজের এক হাতের আঙুল দিয়ে অন্য হাতের মাংস খু/বলে ধরল। সে রেগে গেলে নিজেকে শাস্তি দেয়, এতে সে শান্তি খুঁজে পায়। পার্থিব ঘরে নেই। কোথায় গেছে কে জানে! পার্থিবকে ধরে অনেক নৃ/শংস ভাবে খু/ন করতে ইচ্ছে করছে। তার জন্য সে হেরে যাবে। কে বলেছিল বন্ধুত্ব করতে। লাগবে না তার কোনো বন্ধুত্ব, তবুও হারবে না। কিছুতেই না।
আমিন শিকদারের কথা মনে পড়ে গেল। শ্রুতি তখন তার পাশে বসা ছিল। আমিন শিকদার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, সুন্দরমতো সংসার করছো; দেখে ভালো লাগছে। ব্যাসসস…আমিন সাহেবের কথাটায় শ্রুতির মনে হলো ওর গায়ে কেউ জ্ব/লন্ত কয়লা ছুড়ে মেরেছে। তার মনে হলো আমিন শিকদার হয়তো তাকে খোঁচা দিল, উপহাস করল। সে বলেছিল ছয় মাসের মধ্যে শ্বশুরবাড়ি থেকে ফেরত চলে যাবে। সাড়ে তিন মাস শেষ। অথচ তার ফেরার কোনো খবর নেই। কষ্টে শ্রুতির চোখে পানি চলে এলো। সে হারবে না। না মানে না।

.
‘উনি খারাপ নয় শ্রুতি। একদম খারাপ নয়। আমি বলছি, আমাকে বিশ্বাস কর। উনি খারাপ নয়। খারাপ হলে উনাকে মনে জায়গা দিতাম না। যেভাবে আমিন শিকদারকে মন থেকে উঠিয়ে দিয়েছি, সেভাবে উপড়ে দিতাম যার ছাপটাও অবশিষ্ট থাকতো না।’
কথাগুলো পোকার মতো কানে বেজে চলেছে। কেন বাজছে মাহাথির জানে না।
মন থেকে উঠিয়ে ফেলবে? এতো সাহস?
কথাটা বেশ ভালোভাবেই মাহাথিরের অহমে আঘাত হানলো। রাগ-ও হতে শুরু করল। তার রাগের কারণটা বেশ বৈষম্যমূলক। তার মতে, সে বিভাকে ভালোবাসুক বা নাই বাসুক, পছন্দ করুক বা নাই করুক। বিভার তার প্রতিই ভালোলাগা, ভালোবাসা আর যা কিছু হয় সব থাকতে হবে।
সে বিভাকে ভালোবাসে না, অথচ বিভা তাকে ভালোবাসে — ব্যাপারটা বেশ আনন্দের।

মাহাথির এমন কেন তা মাহাথির জানে না। বিভার সাথে খারাপ আচরণ-ই বা কেন করে তাও জানে না। শুধু জানে সে কোনো সম্পর্কে থাকতে চায় না, কোনো অদৃশ্য বাঁধনে বাঁধা পড়তে চায় না, সে থাকবে নিজের মতো। তার সাথে যেন অন্য কোনো জীবন না জড়ায়। তার কিছু হয়ে গেলে যেন অন্যকেউ কষ্ট না পায়। ‘কোনো সম্পর্কে থাকবে না’ – এই ভাবনা থেকেই বিভাকে দেখলে তার রাগ হয়। কিন্তু বললেই সব হয়না, সে চাক বা না চাক বিয়ে হয়ে গেছে। আজীবন তাদের একসাথেই থাকতে হবে।

হঠাৎ করে শ্রুতির কথা মনে পড়ল মাহাথিরের। বিভা যেমন শান্ত, শ্রুতি মেয়েটা ঠিক তার বিপরীত।
যাওয়ার সময় তখন। বিভা কোথাও গিয়েছিল, পার্থিব ফোনে কথা বলছিল। আচমকা শ্রুতি বলে বসে, ‘আপনি আমাকে যা ভুলতে বলেছেন তার কিছুই আমি ভুলিনি। ভুলবোওনা ভাইয়া। আপনি আমার আপাকে পছন্দ করেন না এইটা আমার মাথায় খুব ভালোভাবে গেঁথে গেছে।’

‘না ভুললে আমার কিছু করার নেই। সেদিন খারাপ ব্যবহার করেছি তার জন্য সরি। এর বেশি কিছু আমার বলার বা করার নেই।’ দায়সারা, নির্লিপ্ত কণ্ঠ মাহাথিরের।

শ্রুতির ভীষণ খারাপ লাগল। নিজের অবচেতন মনে আশা করেছিল মাহাথির তাকে বলবে ‘আমি বিভাকে ভীষণ পছন্দ করি, ভালোবাসি। আমি ওকে সুখে রাখব। তুমি চিন্তা করো না।’
বলল না কেন? শ্রুতি মনে হলো তার সামনে আরেক আমিন শিকদার। নিজের বাবার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে সে। সত্যিই সে আমিন শিকদারের মতো খারাপ? নাকি না? তার আপা তো বলেছে সে আমিন শিকদারের মতো নোংরা নয়। তার আপা হয়তো সত্যিই বলেছে। নিজের আপাকে বিশ্বাস করে ভীষণ বিশ্বাসের সাথে শ্রুতি বলতে শুরু করল,
‘আপনাকে একটা কথা বলি, আপনি খুব শীঘ্রই আমার আপাকে ভালোবাসবেন। মিলিয়ে নিয়েন।’

‘আমাকে দেখে তোমার মনে হয় তোমার কথা সত্যি হবে?’

‘আপনাকে দেখে কী মনে হয় তা আপাতত বলতে চাচ্ছি না। আর আপনি ভালোবাসবেন এইটা আমার বিশ্বাস। আপনার ওপর নয়, আমার আপার ওপর। আসলে সে মানুষটাই এমন। মায়ায় ভরা। সবাই তাকে ভালোবাসতে বাধ্য। সেখানে আপনিও বাধ্য, এবং আপনি তাকে ভালোবাসবেন’ই। দেখে নিয়েন।’

ভাবনা থেকে বের হলো মাহাথির। তার ভীষণ বিরক্ত লাগতে শুরু করল এখন। শব্দ পেয়ে পিছনে তাকাল। বিভা ধীর পায়ে এসে তার পাশে দাঁড়াল।

‘আপনি কী শ্রুতি কে কিছু বলেছেন?’

কিছু সেকেন্ড পার হওয়ার পরেও কোনো উত্তর এলো না। বিভা নিজের মতো বলল,
‘আপনি ওকে কিছু বলবেন না। ও আমার বোন। ওর তো নিশ্চয়ই কোনো দোষ নেই। তার চেয়েও বড় কথা, আমার বোন আমাকে অনেক ভালোবাসে। ওকে কেউ কিছু বললে যতোটা না কষ্ট পায়, আমাকে বললে তার চেয়ে বেশি কষ্ট পায়। তাই আশা করব আমার রাগ আমার বোনের ওপর দেখাবেন না।
মজার কথা কী জানেন, আপনি আর ও দু’জনের মাথাতেই সমস্যা। শালি-দুলাভাই শর্ট টেম্পারড। অল্পতেই রেগে আগুন।’
বলতে বলতে শব্দবিহীন হাসল বিভা।

মাহাথির বিভার কাছে গেল। বিভা হালকা চমকাল। দু’জনের দূরত্ব খুব সামান্য।
মাহাথির বিভার চুল কানে গুঁজে দিল সময় নিয়ে। বিভার বরাবর নিচু হয়ে শান্ত কণ্ঠে নিজের জেদ প্রকাশ করল, ‘আমি সেটাই করব যেটা আমি চাই। আমার চাওয়াতে তোমার মন মর্জি তো চলবে না বিভারাণি।’
____
চলবে~
শব্দসংখ্যা – ১২১৮
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

২১.
কাজের চাপ ইদানীং বেড়েছে। নিজের আরামপ্রিয় জায়গায় অর্ধশোয়া অবস্থায় কাজ করছে পার্থিব। কাজ করতে করতেই দেখলে পেল শ্রুতি ঘরে ঢুকল। পার্থিব আড় চোখে তাকালো। গম্ভীর চোখে পর্যবেক্ষণ করল শ্রুতিকে। ঢিলেঢালা এক কামিজ, গলায় ওরনা ঝুলানো। এক মুঠো ধরে চুলগুলো বাঁধতে চেষ্টা করছে। পার্থিব কিছু বলল না। গত ২ দিন ধরে কথা বলার চেষ্টা করেছে, বলেনি শ্রুতি। দুই দিন না, একদিন। কারণ গতদিন থেকে সে কাজে ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করছে।

পার্থিব লক্ষ্য করল শ্রুতি বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসল।
কিছুক্ষণ পার হলো। শ্রুতি বার বার তাকাচ্ছে পার্থিবের দিকে এবং তার কোলে রাখা ফাইলের দিকে।

‘আপনি কী ভীষণ ব্যস্ত?’ গম্ভীর কণ্ঠ।

‘না ব্যস্ত না। আপনার জন্য আমি সূর্যোদয় থেকে চাঁদের অস্ত যাওয়ার প্রতিটা সময়ই ফ্রী।’ মনে মনে বলেও মুখে বলল না। আজ একটু পার্থিবের অভিমান করতে ইচ্ছে করছে। সবসময় বউরা অভিমান করে, সে নাহয় রেকর্ড ভাঙুক। মুখে বলল, ‘হুম কিছুটা ব্যস্ত।’

‘আপনার কাজ রাখুন, আর আমার সাথে কথা বলুন।’ অধিকার, জেদ, আদেশ মিশ্রিত স্বর।
পার্থিব কোল থেকে ফাইল নামাল না। কাজ করতেই থাকল। শ্রুতির মন ক্ষুণ্ণ হলো কিছুটা। সবাই এমন কেন? সে যখন অধিকার দেখায়নি, তখন পার্থিবের কতো অভিযোগ! আর আজ সে নিজে থেকে কথা বলছে, এখন পার্থিব তার কথা শুনছে না। তাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। ভীষণভাবে মনক্ষুণ্ণ হলো। শ্রুতি উঠে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।

সিদ্ধান্ত নিয়েও উঠে গেল না। বসেই রইল। ফের বলল, ‘আমি একটা কাজ করে ফেলেছি।’ কণ্ঠে অসহায়ত্ব।
পার্থিব এবার চোখ তুলে তাকাল। ফাইল রেখে শ্রুতির দিকে গেল হাতে ভর দিয়ে। খাটের সাথেই তোষক মিশানো, তবে তোষক কিছুটা নিচু। বলতে গেলে পার্থিব গিয়ে শ্রুতির পায়ের সামনে বসল। দুই হাত দিয়ে শ্রুতির পা নিজের কোলে উঠিয়ে নিল। শ্রুতি বিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইল। পার্থিব শ্রুতির হাত ধরে শব্দ করে নিঃশ্বাস ছাড়ল,
‘আবার নতুন কী রাজকার্য করে আসছেন শুনি?’ চোখ হাতের থেকে নিল শ্রুতির চেহারায়।

‘মাহাথির ভাইয়াকে চ্যালেঞ্জ ছুঁ/ড়ে দিয়েছি।’ নির্লিপ্ত কণ্ঠ।
কথাটা শুনে পার্থিব ভ্রু কুঁচকে ফেলল।
শ্রুতি বুঝল পার্থিব বুঝেনি। তাই বলতে শুরু করল, ‘মাহাথির ভাইয়াকে বলেছি উনি আমার আপার প্রেমে পড়বে। পড়বেই।’

‘হুম ভালো করেছেন… এখানে সমস্যা কোথায়?’

‘প্রেমে যদি না পড়ে, তাহলে? তাহলে তো আমি হেরে যাব, পার্থিব।’

‘হারার জন্য ভয় পাচ্ছেন?’

‘হ্যাঁ পাচ্ছি। তার চেয়েও বড় বিষয়, হারি বা জিতি সেটা পরের বিষয়। উনি আমার আপাকে ভালোবাসবে না কেন? বাসতেই হবে। আমার আপা কী খারাপ?’

‘একদম না। উনি খুব ভালো মানুষ।’

‘তাহলে ভালোবাসবে না কেন বলুন? পৃথিবীটা এরকম কেন, পার্থিব? আমার মা তো খুব সুন্দর ছিল, তাও বাবা অন্য মেয়ের সাথে পরকীয়া করেছে। আমি কালো অথচ আপনি বলেন আমাকে ভালোবাসেন। অথচ আপাকে আবার ভাইয়া ভালোবাসে না। কেন?’ বিধ্বস্ত কণ্ঠ শ্রুতির।
পার্থিব বোঝানোর মতো শব্দ খুঁজে পেল না। অথচ সে বুঝতে পারছে শ্রুতির অবস্থা বেহাল; জীবন নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় আছে।
পার্থিব শ্রুতির পা নামিয়ে শ্রুতির পাশে গিয়ে বসল। কিছুক্ষণ পর মাথায় আদুরে হাত বুলাল যেন শ্রুতি কোনো ছোট বাচ্চা।
‘এতো অধৈর্য হলে চলবে? জীবনকে একটু সময় দিয়ে দেখুন, দেখবেন জীবন কতো সুন্দর। আপাকে নিয়েও এতো চিন্তা করবেন না। তার উপর এতোটুকু বিশ্বাস নেই? দেখবেন সে ঠিকই সব অর্জন করে নিবে। আর নাহলে আমরা তো আছিই। জোড় করে মাহাথির ভাইকে ধরেবেঁধে আপার প্রেমে ডুবিয়ে দিব। একদম হাত-পা বেঁধে। তাছাড়া উনাকে দেখে কী আপনার খারাপ মানুষ মনে হয়েছে?’

‘না হয়নি কিন্তু রাগী। আর আপাও বলেছে উনি ভালো। খারাপ না।’

‘তাহলে চিন্তা ঝেড়ে ফেলুন। যা হবে সব ভালো এবং সুন্দর হবে। মানুষের খারাপ দিনের পর খারাপ দিন নয়, ভালো দিন আসে। আপনারা জীবনে অনেক খারাপ দিন পার করেছেন, এখন শুধু সুন্দর দিনের অপেক্ষা।’

শ্রুতি কিছু বলছে না। পার্থিব শান্তকণ্ঠে বলল, ‘ঘুমিয়ে পড়ুন। রাত জাগলে শরীর অসুস্থ হবে।’

শ্রুতি শুয়ে পড়ল। মাথা বরাবর ফ্যানের দিকে চেয়ে আছে। সে ভেবেছিল পার্থিব তার সাথে কথা বলবে না। কারণ হিসেবে গত দুইদিন শ্রুতি তার সাথে কথা বলেনি। কিন্তু আজ কেন জানি নিজেকে আটকাতে পারেনি শ্রুতি। মনে হয়েছে তার এলোমেলো মনের চিন্তা কেবল ইনার কাছে এলেই একটা ঠিকানা পাবে। সেই ভাবনা থেকেই নিজে থেকে কথাগুলো বলল। এই মানুষটাকে তাকে যেভাবে বুঝায়, আর কেউ বুঝায়না। কেউ বুঝায়না কথাটা মিথ্যা। তার আপা বুঝায়। তবুও দুজনের ভালোবাসা দুরকম। এই দুজন বাদে কেউ কখনো এইভাবে ভালোবাসেনি, বুঝায়নি। পার্থিব কী তাকে সত্যি ভালোবাসে?
শ্রুতি ভাবল এইভাবে চলবে না। সে সময় বুঝে কোনো একটা ঝামেলা করে চলে যাবে এই বাড়ি ছেড়ে। সবাইকে ছেড়ে। সে তো সংসার করতে চায়না। তাহলে তার জন্য এইবাড়ির মানুষ গুলো কেন ভুগবে?

.
একটা বাসার সামনে বাইক থামাল মাহাথির। পেছনে ঘাড় ফিরাল। যার অর্থ – নামো। বিভা নেমে পড়ল।
কাল রাতে মাহাথির তাকে বলেছিল তার কোনো বন্ধু তাকে দাওয়াত দিয়েছে, সে যেন তৈরি থাকে। বিভা তৈরি ছিল। এরপর মাহাথিরের সাথে চলে এলো নাম না জানা স্বামীর বন্ধুর বাড়িতে।

মাহাথির বাইক থেকে নেমে ফল, মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে সামনে বাড়ল। বিভা গেল তার পিছু পিছু।
দরজা খুলল হালকা রঙের শাড়ি পরিহিতা এক বৃদ্ধা। চোখে চশমা। একবার মাহাথির, একবার বিভার দিকে তাকাল। মাহাথির, বিভা দুজনেই সালাম দিল। সে মাথা নেড়ে বলল, ‘ভিত্রে আসো।’
মাহাথির, বিভা ঢুকল। বিভা কী করবে ভেবে পাচ্ছেনা। হাসফাস লাগছে ভীষণ। এইভাবে অচেনা, অজানা বাড়ি। তবুও মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে। বিয়ের পর স্বামী নামক মানুষের সুবাদে’ইতো নতুন নতুন আত্মীয় হয়; তারও হয়েছে।
এরই মধ্যে বেরিয়ে এলো কামিজ পরিহিতা এক নারী। মাহাথির, বিভাকে দেখে হাসার চেষ্টা করল, সে নিজেও বিব্রত হয়ে গেছে। বিভা সালাম দিলে সালামের উত্তর নিলো। দুজনকে বসতে বলল। মাহাথিরের পাশেই বিভা বসে পড়ল। মাহাথির বলল,
‘কেমন আছেন আপনারা?’ কথাটা দুজনকেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে। তাই বৃদ্ধ মহিলা উত্তর দিল, ‘আছি বাবা আল্লাহর দোয়ায়।’
ততক্ষণে সদর দরজা দিয়ে আনাস ঘরে ঢুকল। ঢুকেই প্রাণখোলা হাসি দিল,
‘কখন পৌঁছালি? বাসায় শসা ছিল না তাই আনতে নিচে গিয়েছিলাম।’

‘মাত্রই।’ মাহাথিরের এক শব্দের গম্ভীর উত্তর।

আনাস ব্যাগ টেবিলে রেখে বিভার সামনে গিয়ে হাসিমুখে সালাম দিল। বিভাও সালামের উত্তর নিল।
আনাসের স্ত্রী রিধি তাদের জন্য ঠান্ডা ঠান্ডা আমের শরবত দিল।

আনাস হাসিমুখে বলল, ‘ভাবি, আমি আপনার একমাত্র দেওর/ভাসুর যাই বলেন। ও সরি সরি। আপনারতো দেওর আছেই। আমি হলাম আপনার একমাত্র স্বামীর একমাত্র বন্ধু। আপনি আসছেন, খুব খুশি হলাম।’
বিভা আনাসের কথায় মিষ্টি হাসল। রিধি এসে বলল, ‘আপনারা ওই ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেন। যা গরম। আমি খাবার বাড়ছি। খেয়ে দেয়ে গল্প করব।’

বিভা-মাহাথির দেখানো রুমে এলো। মাহাথির গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এলো। এসে বিভার দিকে তাকাল। বুঝল বিভার অস্বস্তি। গম্ভীরমুখে কেবল বলল, ‘হিজাব খুলে হাত মুখ ধুয়ে নাও, ভালো লাগবে।’
বিভা মাহাথিরের দিকে একপলক তাকাল। এই মানুষটা তার সাথে একটু ভালো ব্যবহার করলেই বিভা খুশি হয়ে যায়। অথচ ভালো ব্যবহার করতেই এনার যতো কিপটামি! বিভা হালকা মাথা নেড়ে সায় জানাল মাহাথিরের কথায়। এরপর চলে গেল নিজেও ফ্রেশ হতে।

সবাই বসে আছে খাবার টেবিলে। কেবলমাত্র রিধি ছাড়া। বিভা খেয়াল করেছে উনার পেট সামান্য উঁচু। ধীরে ধীরে হাঁটাচলা করে। হয়তো প্রেগন্যান্ট। এই অবস্থায় নিজে এতো কাজ করছে ভেবে বিভার খারাপ লাগল। সিদ্ধান্ত নিল সে গিয়ে সাহায্য করবে।
টেবিল থেকে নিঃশব্দে উঠে গেল রান্নাঘরে। রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়াতেই রিধি বলে উঠল, ‘এখানে কেন? কিছু লাগবে? আমাকে ডাকলেই পারতে।’
বিভা এইবার ভালোমতো লক্ষ্য করল। আসলেই তার সামনে দাঁড়ানো নারীটি প্রেগনেন্ট। বিভা বলল, ‘আপনাকে সাহায্য করি?’
‘আরেহ নাহ। সাহায্য লাগবে কেন? দেখো সব কাজ শেষ। তুমি গিয়ে বসো, আমি আসতেছি। আর আমাকে তুমি করে ডাকো। আমরা তো সেম সেম। তুমি যাও টেবিলে যাও, গরমে থেকো না।’

বিভা গেল না। দাঁড়িয়েই রইল। দুজনের মধ্যে চলল টুকটাক কথাবার্তা। খুব অল্পসময়েই দুজনে বেশ খাতির হয়ে গেল।

খাওয়া-দাওয়ার পর্ব চলছে। রিধির শ্বাশুড়ি আগেই খেয়ে উঠে পড়েছে। মাহাথির বিভার দিকে তাকাল। ভাবল এই মেয়েটা যেহেতু তার সাথে এসেছে, সেই হিসেবে মেয়েটার সমস্যার দিকে লক্ষ্য রাখা তার দায়িত্ব। যতোই অপছন্দ করুক না কেন।
‘কিছু লাগলে বা সমস্যা হলে বলবা।’

বিভা একপল তাকিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিল। রিধি খাওয়ার মাঝে বলে উঠল, ‘আপনাদের দুজনকে কিন্তু বেশ মানিয়েছে ভাইয়া। দুজনের চেহারাটাই মায়া মায়া। খুব সুন্দর লাগছে আপনাদের পাশাপাশি।’

কথাটা বিভা কী বলবে বুঝতে পারল না। আবার অস্বস্তিকর মূহুর্ত! প্রশংসা শুনতে তার অনেক লজ্জা লাগে। তবে মনে মনে অনেক বেশি খুশি হলো সে।
মাহাথিরের মাঝে তেমন ভাবাবেগ দেখা গেল না। শুধু ভদ্রতাসূচক হাসল। আনাস হেসে বলল,
‘আমার বন্ধুও যেমন সুন্দর, বন্ধুর বউও সুন্দর। সুন্দরে সুন্দর চেনে।’
স্বামীর কথায় রিধি দাঁত বের করে হেসে ফেলল। তার স্বামী আসলেই শয়/তান।

খাওয়া-দাওয়ার পরে চারজন মিলে গল্প করতে লাগল। গল্প বলতে সব কথা আনাস-রিধিই বলল। বিভা, মাহাথির কেবল নিরব শ্রোতা। তবে বিভাও অংশ নিয়েছে, নিরব ছিল শুধু মাহাথির।

দেখতে দেখতেও সন্ধ্যা হয়ে এলো। আকাশ মেঘলা। হয়তো ঝড় হবে।
মাহাথির আকাশের অবস্থা বুঝে বলল এইবার যাওয়া দরকার, এখন না গেলে পরে যেতে পারবেনা। আনাস, রিধি থাকতে বললেও মাহাথির শুনল না। কারোর বাড়িতে থাকতে পারে না মাহাথির।
সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল দুজনে। যাওয়ার আগে আনাস তাদের দু’জনের হাতে দুটো প্যাকেট দিল গিফট হিসেবে। তারা যেতেই রিধি বলল,
‘মাহাব ভাইয়ার বউটার উপর তো ক্রাশ খেয়ে গেলাম। কী মিষ্টি মুখ! মায়া মায়া চেহারা, গায়ের রং টাই যা একটু চাপা। তবুও চেহারা সুরত কিন্তু ভালোই। এতো মিশুক! আপনি জানেন, আমি রান্নাঘরে কাজ করছিলাম, নিজে থেকে গিয়ে সাহায্য করেছে আমাকে। শসা কেটে দিল, হাতে হাতে কাজ করল। এতো ভালো একটা মেয়েকে খুঁজে পেল কেমন করে? আমি অনেক খুশি হয়েছি। আমি কিন্তু আবার দাওয়াত দিব।’

আনাস হাসল। তার বউ অল্পতেই খুশি হয়ে যায়। তাই বিভার ব্যবহারেও খুশি হয়ে গেছে। যদিও বিভার ব্যবহার তারও ভালো লেগেছে। দেখেই বুঝা যায় কতো ভালো মেয়ে! অথচ তাকেই কিনা তার বন্ধু মেনে নেয়নি। আনাসের মনে হলো, মাহাথিরের ভাষায় বিভার মতো জ/ঘন্য মেয়েকেই মাহাথির একদিন ভীষণ ভালোবাসবে। আচ্ছা, সেদিন কী ওই শান্ত মেয়েটা মাহাথিরের ভালোবাসা গ্রহণ করবে নাকি ফিরিয়ে দিবে?
_____
চলবে~
শব্দসংখ্যা – ১৩২০
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান