একগুচ্ছ শুকতারা পর্ব-২২+২৩

0
174

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

২২.
বিভা-মাহাথির সবেমাত্র বাসায় পৌঁছাল। ইতোমধ্যে ঝড় শুরু হয়ে গেছে। বৃষ্টির ছাঁটে দুজনেই হালকা পাতলা ভিজে গেছে।
মাহাথির বের হতেই বিভা গিয়ে ভেজা জামাকাপড় ছেড়ে নিল। রান্না করতে হবে রাতের। বাসায় তো কিছুই নেই। তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গেল।

বেশ কিছুক্ষণ পর গামছা শুকাতে ঘরে ঢুকল বিভা। বারান্দায় মেলে দিয়ে ঘরে এলো। মুখে ক্রিম মাখল হালকা। এরই মধ্যে মাহাথিরের কাঁশির শব্দ শুনতে পেল। ভ্রু কুঁচকে পেছন ফিরল। বিছানায় আধশোয়া হয়ে ফোন টিপতে টিপতে খুঁক খুঁক করে কাঁশছে মাহাথির।
হালকা অবাক হলো বিভা। বৃষ্টিতে ভিজতে না ভিজতেই ঠান্ডা লেগে গেল? অবশ্য কম সময়ই ভিজে নি। আনাস ভাইয়ের বাসা তাদের বাসা থেকে ভালোই দূরত্বে। চল্লিশ মিনিট লাগে আসতে-যেতে। বাসায় থেকে নামার পর পরই বৃষ্টি শুরু হলো। তাহলে তো ভালোই ভেজা হয়েছে। তাছাড়া এর আগেও একদিন অফিস থেকে ভিজে ভিজে বাড়ি এলো। অসময়ের বৃষ্টি মানেই খারাপ। বিভা ঘর থেকে নিশ্চুপে বেরিয়ে গেল।

.
ড্রইংরুমে বসে আছে সবাই। খাওয়া-দাওয়া শেষ। এখন ঘুমাতে যাওয়ার পালা। সবাই বসে আছে একসাথে। দিনের এই সময়ই তো সবাই একটু একসাথে সময় কাটাতে পারে।

আসাদ সাহেব একটা প্যাকেট নিয়ে এক গদির সোফায় বসল। প্রভা-প্রত্যাশা দুজনেই তার কিছু দূরে বসা। প্যাকেট থেকে বের করল শ্যাম্পু, তেল। তেল গুলো নিজের দুই মেয়ের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, ‘এই উঠতি বয়সে তেল লাগাতে হবে চুলে। নয়তো চুল ভালো হবেনা। তেল হলো চুলের খাবার। আজ রুমে গিয়ে দেখলাম তেল নাই। তাই নিয়ে আসছি দুজনের জন্য। তেল নাই যে বলবে না?’

প্রভা মুখ কুঁচকে ফেলল তেল দেখে। তেল নিয়ে তার যত বিরক্তি! প্রত্যাশা ঠোঁটে ভাসা ভাসা হাসি ঝুলিয়ে তেল নিজের দু’হাতে তুলে নিল। তার বাবা কত্তো ভালো! কত্তো খেয়াল রাখে – ভাবতেই তার ভীষণ খুশি লাগে। নিজেকে প্রিন্সেস মনে হয়। শুধু বাবা না, পার্থিব ভাইয়া, হিমেল ভাইয়া, চাচ্চু সবাই তাদের দু’বোনকে অনেক ভালোবাসে। একারণে প্রায়ই প্রত্যাশা আল্লাহকে থ্যাংকিউ দেয় তাদের মেয়ে করে পাঠানোর জন্য। মেয়ে না হলে, এতো ভালোবাসা পেত কোথায়?

ঘটনাটা চুপচাপ বসে দেখল শ্রুতি। মনে পড়ল বিভার কথা। তার আপা বলেছিল – এই পৃথিবীতে যদি সবচেয়ে নিকৃষ্ট বাবা থেকে থাকে, তাহলে সবচেয়ে ভালো, পবিত্র বাবাও আছে।
তার বাবা তার আপা, তাকে, ভাইকে – কাউকে ভালোবাসে না। উনার নাকি কালো মানুষ দেখলে বমি আসে। মা মারা যাওয়ার পর যখন তার বাবা নতুন বিয়ে করে ঘরে তুলল। তখন শ্রুতি কিছুতেই ব্যাপারটা মানত না। প্রায়ই আমিন শিকদারকে এটা সেটা বলত, কোলে উঠতে চাইতো, আগের মতো ভালোবাসতে বলত। এক পর্যায়ে আমিন সাহেব তাদের সাথে অতিরিক্ত খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করল। তখন অতোকিছু না বুঝতেও বড় হতে হতে আমিন সাহেবের কথার গভীরতা শ্রুতি মাপতে শিখেছে। আচ্ছা তার বাবা ভালো হলো না কেন? তার বাবাও তো তাদের দুই বোনের জন্য তেল নিয়ে আসতে পারতো। একজন ভালো বাবা হতে পারতো।

হঠাৎ দাদিকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছা করল শ্রুতির। এই মানুষটাকেও সে অসম্ভব ভালোবাসে। এই মানুষটা না থাকলে তাদের তিন ভাই-বোনকে বাড়ি থেকে বের করে দিতেও হয়তো দু’বার ভাবতো না কেউ। অথচ এখন শুধু ফোনে কথা হয়। তবুও, ৫ দিন হলো শ্রুতি ফোনটোন দিচ্ছে না। শ্রুতি ভাবল ফোন দিবে। কিন্তু মুখ দেখবে কীভাবে? দাদির তো বাটন ফোন। থাক, আপাতত কথা বলে নিক। ছোট্ট মুখ করে ধীরে উঠে গেল শ্রুতি।

.
বিভা ঘরে ঢুকল। দেখল মাহাথির অন্যদিক ঘুরে শুয়ে আছে। শরীর হালকা নড়ায় বুঝল এখনো কাঁশি হচ্ছে। অবশ্য খাওয়ার সময়ও কাঁশছিল।
বিভা বিছানায় উঠে বলল, ‘এদিকে ফিরুন।’

মাহাথির একবার পিছন ফিরে বিভার দিকে আর বিভার হাতে থাকা জিনিসের দিকে তাকাল। এরপর আবার আগের মতো হয়ে গেল। বিভা মাহাথিরের বাহুতে হাত রাখল, ‘এদিকে ফিরুন। ঠান্ডা লেগেছে। সেই কখন থেকে কাঁশছেন। এটা লাগালে আর কাঁশি হবে না।’

মাহাথির ভীষণ বিরক্তি নিয়ে ফিরল, ‘কী সমস্যা? ঘুমাতে দাও বিরক্ত করোনা।’

বিভা নিজের হাতে থাকা চামচের দিকে তাকাল। স্টিলের চামচে সরষের তেলের সাথে রসুন গরম করে এনেছে। আগে তার মা এরকম করত। এরপর বুকে, পায়ে, নাকে লাগিয়ে দিত। ঠান্ডা কমে যেত। অথচ মানুষটা কিনা লাগাতেই চাইছে না…

‘মাহাথির, ফিরুন। এইটা লাগিয়ে দিই। এরপর ঘুমান।’

মাহাথির ফিরল না। বিভা আবার ডাকতেই মাহাথির আকাশসমান বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘তুমি কী চাচ্ছো আমি এখন এখান থেকে উঠে যাই? না চাইলে এখান থেকে যাও।’

বিভা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। ঠান্ডায় কাঁশছে, আবার ভাবও দেখাচ্ছে। সে কী নিজের জন্য বলেছে নাকি?
কিছু সময় পার হলো। বিভা দুই হাতে মাহাথিরের বাহু ধরে নিজের দিকে ফিরাল। নিজের হাতেই অস্বস্তি, লজ্জা ঠেলে দিয়ে গেঞ্জি ঘুচিয়ে উপড়ে জমা করল। মাহাথির ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল কেবল। বিভা চামচ থেকে তেল নিয়ে বুকে ডলতে লাগল। সাথে তার শান্তস্বর,
‘এতো জেদ ভালো নয় মাহ্থির। পা/গলেও নিজের ভালো বোঝে। অথচ আপনি বোঝেন না। আমি কী ধরে নিব আপনি পাগলের থেকেও অবুঝ?’
বলেই মাহাথিরের চেহারার দিকে তাকাল। মাহাথির আগের মতোই গম্ভীর ভাবে তাকিয়ে আছে।

বিভা হাতে তেল মালিশ করে, পায়ের কাছে গেল। পায়ের তালুতে ধীরে ধীরে গরম তেল মালিশ করে দিল। মাহাথির যখন বুঝল যে বিভার কাজ শেষ, তখন মাহাথির এক লাফে উঠে বসল। বিদ্রুপের কণ্ঠে বলল,
‘তুমি একজন আদর্শ বউ, বিভা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তুমি আমার বউ।’

.
মাহাথির ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ। বিভার ঘুম আসছে না। মাহাথির আজ অনেক আগেই ঘুমিয়েছে। অন্যদিন ১২ টা, ১ টায় ঘুমায়। আজ ১০ টার দিকেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
বিভা সারা বাড়ি একা একা হাঁটল, নিজের মায়ের ডায়েরি পড়ল, বারান্দায় থাকা মাহাথিরের শার্ট এনে সুন্দর করে ভাঁজ করল।
আবারো বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টি নামবে, ঝড়ও কী আসবে? বিভা গিয়ে বারান্দায় দাঁড়াল। ঠান্ডা হাওয়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে। বিভা দাঁড়িয়ে রইল আর নিজের জীবনের হিসাব কষল।

রাত ১ টারও বেশি বাজে।
মাহাথিরের হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেল। পাশে তাকিয়ে বিছানা খালি দেখে ভীষণ অবাক হলো। উঠে বসার পর লক্ষ্য করল ঘুমানোর আগে ভীষণ মাথা ব্যথা ছিল। এখন নেই।
মাহাথির বারান্দায় তাকিয়ে দেখল বিভা দাঁড়িয়ে আছে। ঢিলেঢালা কামিজ, একপাশে ওরনা ঝুলানো, চুলগুলোও খোলা।

মাহাথিরের ভীষণ গরম লাগল। উঠে পড়ল। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। বিভা মাহাথিরের উপস্থিতি বুঝে বেশ চমকে গেল। মাহাথিরের দিকে তাকিয়ে কিছু বলল না। চুপচাপ চেয়ে রইল বাহিরের দিকে। মাহাথিরের গায়ে জামা নেই। ভীষণ লজ্জা করছে বিভার। মনে হলো, আগে ঘুমিয়ে গেলেই হয়তো ভালো হতো।

বাতাসে এখন ভীষণ আরাম লাগছে। একটা শীত শীত ভাব চলে আসছে। মাহাথির বিভার দিকে তাকাল। মেয়েটা হালকা ভিজে আছে জামা। বৃষ্টি পড়েছিল নাকি? এখন তো নেই। এখন তো সুন্দর বাতাস। কতোক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে এই মেয়ে? মাহাথির অনুভব করল বারান্দায় পানি। এরমানে ভালোই বৃষ্টি হয়েছে।

মাহাথির না চাইতেও আবারো বিভার দিকে তাকাল। বিভাকে ভালোভাবে লক্ষ্য করতেই
মাহাথিরের আবারো ভীষণ গরম লাগতে শুরু করল। বিভা তার স্ত্রী, সে মানুক আর নাই মানুক তাদের সম্পর্ক মিথ্যা নয়, আর না মিথ্যা বিভার প্রতি তার অধিকার। মাহাথির গিয়ে একদম বিভার পেছনে দাঁড়াল। বিভা চমকে উঠল। ঠিক করল ঘরে চলে যাবে।
বিভা ঘুরে যেতে নিতেই মাহাথির হাতের কবজি ধরে আটকে নিল। বিভা ধীরে ধীরে পেছনে ফিরল। মাহাথির বিভার হাত ধরেই আছে। বিভা মাথা উঁচিয়ে দেখল মাহাথিরের ভ্রু কুঁচকানো দুটো চোখ সাথে গম্ভীর, গভীর দৃষ্টি। এই দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার সাহস বিভার নেই। সে ভয়ংকর দৃষ্টির ভাষা বুঝে মাথা নামিয়ে ফেলল।

কেটে গেল ভালোবাসাবিহীন, অধিকার আর দায়িত্বের একটি রাত।

.
শ্রুতি দ্রুত রেডি হচ্ছে। হামিমকে নিয়ে আজ সে ডাক্তারের কাছে যাবে। পার্থিব বলেছে, পার্থিবের অপেক্ষা করতে। কিন্তু শ্রুতি পার্থিবের অপেক্ষা করবে না। সে একাই পারবে। আগে আপার সাথে যেত। আজ একাই যাবে।
সে তার শাশুড়িকে বলে নিয়েছে। তবে মিথ্যা বলেছে। বলেছে যে, পার্থিবই তাকে একা যেতে বলেছে, তাই তার শাশুড়ি তেমন কিছু বলেনি। শুধু বলেছে সাবধানে যেতে আর সাবধানে ফিরে আসতে, সাথে বাড়ির গাড়ি নিয়ে যেতে। শ্রুতি তাই মেনে নিয়েছে। নিজের কাছে যা টাকা ছিল সব নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
গন্তব্য – হাসপাতাল। শ্রুতি তাকাল তার ভাইয়ের দিকে। হামিম জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। শ্রুতি হামিমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তার ভাই একদিন সুস্থ হবে। হতেই হবে। তার ভাইয়ের হার্টের ছিদ্রের অপারেশন হবে, পায়ের অপারেশন হবে। তার ভাই বাঁচবে। অনেকদিন বাঁচবে। তাদের সাথে আনন্দে বাঁচবে। ভাবতেই শ্রুতির চোখ ভরে উঠল।

______
চলবে~
শব্দসংখ্যা – ১২০৩
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

২৩.
‘হামিমকে নিয়ে একা যাওয়ার কী খুব প্রয়োজন ছিল, শ্রুতি?’

‘হ্যাঁ ছিল। কেন? এখন কী আমার বাড়ির বাইরে নিজের ইচ্ছেতে যাওয়ার-ও অনুমতি নেই? বন্দি আমি?’

‘আমি সেটা বুঝাইনি। তিলকে তাল বানানো বন্ধ করুন। আমি শুধু বলতে চেয়েছি, আমি নিয়ে যেতাম আপনাদের। একটু অপেক্ষা করতে পারলেন না আমার জন্য?’

শ্রুতির মনে হলো সত্যি অপেক্ষা করলেই পারতো। সে কী বাড়াবাড়ি করে ফেলছে? তবুও নিজের ঠাঁট বজায় রাখল, ‘আমি আগেও নিয়ে গিয়েছি। এখানে সমস্যা কোথায়?’
পার্থিব হতাশ হলো। এই মেয়ে বুঝার নয়। সে শুধু বলতে চেয়েছিল, রাস্তায় আপদ বিপদও হতে পারত। সে যেহেতু ফ্রী ছিল তাহলে সে অফিস থেকে ফিরেই নিয়ে যেত। এছাড়া ডাক্তারের সাথে ভালোভাবে কথাও বলে নিত।
‘বাদ দিন। বলুন ডাক্তার কী বলল? হামিমের কী ঔষধ’ই চলবে? অপারেশন এর ব্যাপারে কিছু বলেছে?’

‘ঔষধ’ই চলবে। আর কিছু বলেনি।’
পার্থিবের বিশ্বাস হলোনা কথাটা। ছেলেটার দিনে দিনে অবনতি হচ্ছে, আর ডাক্তার কিনা ঔষধ দিয়ে বসিয়ে রাখছে?

.
পেরিয়ে গেছে আরোও কিছুদিন। বিভার জীবন সহজ হয়েছে নাকি জটিল তা বিভা ভেবে পায়না। মাহাথিরের প্রতি তার দুর্বলতা দিনকে দিন বাড়ছেই। আচ্ছা এমন কী হওয়ার ছিল? আজ বিভা বুঝতে পারে, ভালোবাসা কী। আজ বিভা নিজের মায়ের ভালোবাসার গভীরতা মাপতে পারে, যন্ত্রণা অনুভব করতে পারে। আমিন সাহেবের অন্যায়ের পরেও তার মা তার বাবাকে কতো ভালোবাসতো, অথচ লোকটা তার মূল্য দেয়নি। সব ভালোবাসাই কী এমন কষ্টের, যন্ত্রণার হয়?
ভাবতে ভাবতেই টিফিন বক্স খাবার ভরে দিল বিভা। মাহাথিরকে কতো বলেছে বাসা থেকে খাবার নিতে, অথচ লোকটা নেয়’ইনা। দুপুরের খাবারই আসল, অথচ দুপুরে কিনা ক্যান্টিন থেকে আজেবাজে খাবার খায়! মানে হয় এইসবের?

বিভা টিফিন নিয়ে সোফার ওপরে রাখা মাহাথিরের ব্যাগে ভরে রাখল। পেছনে তাকিয়েই দেখল মাহাথির তাড়াতাড়ি করে আসছে। নিচু হয়ে জুতা পড়া শুরু করল। বিভা বরাবরের মতোই আয়তুল কুরসি পড়ে ফুঁ দিয়ে দিল মাথায়। বাতাস পেয়েই মাহাথির বুঝল বিভার কাজ। মাথা উঁচু করে কেবল ভ্রুঁ কুচকে একবার তাকাল, ‘আমি এতোটাও বিশেষ কেউ নই। আমার সুরক্ষার জন্য এতো চিন্তা না করলেও চলবে।’
বলেই সোফার ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেল।

সব মানুষের মন সবসময় এক থাকেনা। কখনো অতিরিক্ত রাগ, দুঃখ, খুশি, দুষ্টুমি অনুভব হয়, অকারণেই। বিভার ক্ষেত্রেও হয়তো তাই হলো।
বিভা তার স্বভাবের বিপরীতে গিয়ে একটা কাজ করে বসল। অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে মাহাথিরকে ভেঙ্গাল। বিরবির করল, ‘পা/গল লোক কোথাকার! পাগলের থেকেও নি র্বোধ। গা/ধা। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে মাথাকে দুইভাগ করে দিতে; তাও যদি মানুষ হয়। খাবার যে দিলাম, খাবে? নাকি ফেলে দিবে রাগ দেখাতে? ফেলে দিলে উনাকে আজকে আমি খু/ন করব।’

নিজের কথার মানে বিভা নিজেই খুঁজে পেল না। হঠাৎ এতো রাগ করছে কেন সে? বিভা চুপচাপ চলে গেল ঘরে।

.
মাহাথির মুখ কুঁচকে বসে আছে। তার মুখভঙ্গির অর্থ – এইসবের মানে কী? আসার পর থেকেই দেখছিল তার ব্যাগ অন্যদিনের তুলনায় ভারি, ফোলা। ব্যাগ খুলেই দেখতে পেল টিফিন বক্স। বুঝল বিভার কাজ। ভীষণ রাগ হলো। মেয়েটা অতিরিক্ত করছে না? মাহাথির টিফিন বক্স রেখে কাজে মন দিল।

টিফিন টাইমে বাইরে গিয়ে খাওয়ার জন্য উঠতে গেল। তখনই মনে পড়ল, আজ তো বিভা খাবার দিয়ে দিয়েছে। বাইরে গিয়ে খাওয়ার কী দরকার?
টিফিন বক্স বের করতে করতে মাহাথিরের মনটা শান্ত হলো। কোথাও একটা ভালো লাগল। বাহিরের খাবার সে খেতে পারেনা, হজম হয়না, শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে। এর আগে সে প্রতিদিন নিজেই বাসার খাবার রান্না করে নিয়ে আসত। যা পারত তাই। বিয়ের পর বিভাকে কিছু বলা হয়নি, ইচ্ছে করেই বলেনি। অফিসের খাবার বলতে প্যাকেটের রুটি, জুস খেত; ক্যান্টিনে রান্না করা খাবার তার গলা দিয়ে নামেনা। কিন্তু দুপুরবেলা কী রুটি, জুস খেয়ে ক্ষিদে মেটে…..তবুও নিজের জেদের কারণেই মূলত বিভাকে নিজে থেকে কিছু বলেনি। বিভা কয়েকদিন বললেও মানা করে দিয়েছে।

মাহাথির টিফিন বক্স খুলল। ভুনা খিচুড়ি, আচার। খাবার দেখে মাহাথিরের মন অনেকটাই ভালো হয়ে গেল। খিচুড়ি তার পছন্দের। খিচুড়ি টা বিভা রান্না করেছে। কিন্তু আচার দেখে বুঝল আগেই বাসায় আচার ছিল, সেটাই দিয়েছে। খিচুড়ি টা দেখতেও সুন্দর হয়েছে। বিভার রান্নার হাত ভালো। অন্যরকম একটা স্বাদ থাকে। এর আগে নিজে যা পারতো তাই রান্না করে খেত মাহাথির, বুয়া শুধু ঘর ঝাড়ুমোছা করে দিত। বিয়ের পর বিভা বুয়াকেও না করে দিল। রান্না থেকে সবকিছু নিজে নিজে করে। কেন করে? তাকে ভালোবাসে বলে? আচ্ছা মেয়েটা এমন কেন? এতো নিঃস্বার্থভাবে কেউ কারোর জন্য ভাবে? এমনও আছে দুনিয়ায়?
মাহাথির খাবার মুখে তুলল।

‘ভাবি রান্না করেছে, বুঝি?’ দাঁত সবগুলো বের করে হাসল আনাস। কণ্ঠে দুষ্টুমি ভরপুর। মাহাথির তাকাল একপলক, ‘হুম।’

‘আমাকেও দিয়েছে দেখ, দেখ।’ বলেই নিজের বক্স দেখাল আনাস। উৎসাহের সাথে বলল, ‘দুজনকেই খিচুড়ি দিয়েছে। ব্যাপারটা জোস না? এরথেকে কী বোঝা যায় জানিস?’

মাহাথির মুখে খাবার নিয়ে তাকিয়ে রইল আনাসের দিকে। যার অর্থ – সে জানে না, জানতে চায়। আনাস অর্থ বুঝে বলল, ‘বোঝা যায় যে আমাদের দু’জনের বউ আমাদের ভীষণ ভালোবাসে। একদম ইনফিনিটি লেভেলের।’

‘নিজের টেবিলে গিয়ে ফালতু বকবক কর।’ বলেই মাহাথির নিজের মতো খাচ্ছে। আনাস মাহাথিরের স্বভাব সম্পর্কে জানে। নিজেও খুশিমনে খাওয়া শুরু করল।

আনাস, মাহাথিরের খাওয়া শেষ। কিছুক্ষণ পরে আনাস বলল, ‘তোদের মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেছে বন্ধু?’ উৎসাহ ভরা কণ্ঠ আনাসের।

‘ঠিক হয়েছে মানে? কী ঠিক হবে?’

‘তোদের সম্পর্ক। তুই, ভাবি হ্যাপি আছিস? আই মিন তোর ধারণা বদলেছে? ভাবিকে ভালোবাসিস?’

‘ভালোবাসব কেন?’

‘মানে? আমি আরোও ভাবলাম তুই সংসারে মনোযোগ দিয়েছিস।’ কণ্ঠে হতাশা, দ্বিধা।

‘সংসার করতে ভালোবাসা লাগে – জানতাম না তো। আমি তো জানতাম স্বামী-স্ত্রী থাকলেই সংসার করা যায়।’

‘এরমানে কী তুই এখনো ডিভোর্স এর চিন্তায় আছিস? মানিসনি ভাবিকে?’

‘ডিভোর্স কেন দিব? অনেকেই তো অমতে বিয়ে করে সংসার করছে। ডিভোর্স দিচ্ছে? আমি কেন দিব? ভালোবাসা ছাড়া সব হবে আমাদের মধ্যে। সংসার, বাচ্চা সব।’

আনাস হয়তো বুঝল মাহাথিরের কথা। ভীষণ রাগ হলো। মাথা নিচু করে হেসে দিল, ‘জানিস, এখন সবাই সবাইকে জানো/য়ার বলে গালি দেয়। কিন্তু কিছুদিন পর থেকে একে অন্যকে মাহা/থির বলে গালি দিবে।’

‘কী বলতে চাচ্ছিস?’ কন্ঠে বিরক্তি।

‘জাস্ট এইটাই বন্ধু যে, তুমি জানো/য়ার এর থেকেও নিকৃষ্ট। সরি, তোমাকে ডিস্টার্ব করার জন্য।’
আনাস চলে গেল। মাহাথির নির্লিপ্তভাবে বক্স ঢুকিয়ে পানি পান করতে লাগল।

.
বিভার মুখটা হাসি হাসি। না চাইলেও গালগুলো হেসে যাচ্ছে। বিভা দুই হাত দিয়ে থামানোর চেষ্টা করল। অল্প বিষয়েই সে এতো খুশি কেন হয় – জানে না।

মাহাথির রাতের খাবারের পরে রান্নাঘর থেকে হাত ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে পানি খেতে এলো। সে আসতেই বিভা জিগ্যেস করল, ‘আপনার কাছে খিচুড়ি কেমন লেগেছে?’

মাহাথির তাকিয়ে রইল বিভার দিকে। বিভা কী জানে যে ও খিচুড়ি খেয়েছে? যদি জানে তবে এইটা প্রেস্টিজের ব্যাপার হয়ে যাবে। বিভাকে সে পছন্দ করেনা, বিভা খাবার নিতে বললেও নেয়নি, অথচ বিভা খাবার দিয়েছে আর ও খেয়েছে — এটা তো ভীষণ লজ্জার ব্যাপার। মাহাথির কী বলবে ভেবে পেল না। গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে কেবল বলল, ‘কে বলেছে আমি খেয়েছি? খিচুড়ি তো আমি ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে এসেছি। এতোবার না করার পরেও কেন কথা শুনোনা তুমি? কী দরকার ছিল খাবার দেওয়ার?’
বলেই গ্লাস নিয়ে চলে গেল। বিভা তাকিয়ে রইল আহামক্কের মতো। মিথ্যা কথা সে আশা করেনি।
বিভা নিজের ফোনের হোয়াটসঅ্যাপে ‘আনাস ভাইয়া’ নামক ইনবক্সে ঢুকল। যেখানে একটি ছবি – মাহাথির হা করে খিচুড়ি মুখে ঢোকাচ্ছে, বক্সের খিচুড়ি অর্ধেক দেখা যাচ্ছে। তার নিচেই একটা ম্যাসেজ – “Vabi, Mahatir toh khub moja kore khichuri khelo. Amari lov lege gelo. Apnader bashay ekdin ashtesi bouke niye. Oboshhoi khichuri ranna korben. Shobai eksathe khabo. Kicchu mone korben na, daowat cheyei nilam.’’

বিভা হেসে ফেলল। রুমের দিকে তাকিয়ে ভ্রুতে ভাঁজ ফেলল, ‘মানুষের ঘাড় একটু বাঁকা থাকে। আর ওনার ঘাড় পুরোটাই বাঁকা। মাথার সামনের অংশ পিছে, পিছের অংশ সামনে নিয়ে চলাফেরা করে। ত্যাড়া কোথাকার! সাথে মিথ্যাবাদীও….’
.

রাত ১ টা ৪৫ মিনিট। বিভা, মাহাথির ঘুমে বিভোর। হঠাৎ ফোন বাজতেই ঘুমে ভাঁটা পড়ল। মাহাথির ফোন উঁচু করে নাম দেখল না, কেটে দিল। সেকেন্ড পার হতে না হতেই আবার ফোন। মাহাথির বিরক্তি নিয়ে উঠে বসল। কল রিসিভ করে কানে দিয়ে কোনোরকমে বলল,
‘হ্যালো কে?’
ঠিক তখনি শুষ্ক কণ্ঠের কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো। মাহাথির ভ্রু কুঁচকে ফোন নামিয়ে নাম্বার দেখল। ভ্রু থেকে ভাঁজ সরে গেল। ভীষণ অবাক হয়ে ফোন কানে নিয়ে ডাকল,
‘আব্বা?’

_______
চলবে~
শব্দসংখ্যা – ১২২৪
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান