একগুচ্ছ শুকতারা পর্ব-২৬+২৭

0
160

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

২৬.
পেরিয়ে গেছে ৬ দিন।
এই ৬ দিনে নাতো শ্রুতি পার্থিবের দেখা পেয়েছে, আর না কথা বলেছে। সবার থেকে জানতে পেরেছে কাজের জন্য চট্টগ্রাম গেছে। শুনে শ্রুতির মনটা খারাপ হয়েছে কিনা শ্রুতি নিজেই বুঝেনি। সে কী নিজের অবচেতন মনে আশা করেছিল যে পার্থিব তাকে বলে যাবে? নাহ! সে এমন কিছুই আশা করেনি, করতে চায়না। তাদের সম্পর্ক কী স্বাভাবিক যে পার্থিব তাকে ঢোল পিটিয়ে বলে যাবে?

শ্রুতির ভীষণ মন খারাপ হচ্ছে। বর্তমানে সে সকালের নাস্তা করছে। সবাই বসেছে টেবিলে; তবুও মনে হলো তার আশেপাশে কেউ বসেনি। এতোদিন যাবত তার পাশে জলজ্যান্ত একটা মানুষ বসতো আর আজ সে নেই — কোনো মানে হয় এইসবের? গতদিনও ইলিশ মাছ রাঁধা হলো, অথচ শ্রুতি খেল না। অন্যান্যদিন পার্থিব বেছে দেয়, কাল শ্রুতির বাছতে ইচ্ছেই করল না। একারণে খাওয়াও হলোনা।
শ্রুতির বর্তমানে নিজের উপর রাগ চেপে বসছে। মনে হচ্ছে একশো কেজি রাগের বস্তা কেউ তার মাথায় চাপিয়ে দিল। পার্থিব তাকে বলে যায়নি, এরপর যাওয়ার পর ফোন করে কথাও বলছেনা। এরমানে পার্থিব তাকে নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয়, তাহলে অযথা সে কেন চিন্তা করছে?

শ্রুতি প্লেটের দিকে তাকিয়ে রুটি গুলো ছিড়ে ছিড়ে মুখে পুরলো অনেকাংশ। এরপর নিজের রাগ রুটির ওপর দিয়ে নাক কিঞ্চিৎ ফুলিয়ে চিবুতে লাগল।

শ্রুতি হামিমের ঘরে ঢুকেই দেখতে পেল হিয়া ভাবির মাকে। ভীষণ অবাক হলো। তাকে এখানে আশা করেনি; অবশ্য হয়তো আশা করা উচিতও ছিলনা। ভদ্রমহিলা এসেছে দুই কী তিন দিন হয়। তিনি এসেছেন নিজের মেয়ের জন্য। হিয়া ভাবি প্রেগন্যান্ট। নিজের মেয়েকে দেখতেই তার এই বাড়িতে আসা।
ভদ্রমহিলা শ্রুতিকে দেখে উঠে এলো। ভদ্রমহিলার চেহারা ভীষণ কোমল; কাঠিন্যতার ছোঁয়া নেই। শ্রুতি ভদ্রতাসূচক হাসল। হিয়া ভাবি ভীষণ মিশুক, শ্রুতিকে যথেষ্ট আদর করে। এখন শ্রুতিরও উচিত তার মাকে সম্মান দেখানো।

‘ কিছু লাগবে আন্টি? হঠাৎ এই ঘরে যে?’ সরল গলা শ্রুতির।
‘ কেন মা? এখানে আসা মানা?’ কোমল গলায় নিজের প্রশ্ন করলেন ভদ্রমহিলা।
‘ না, না। আমি এমনিই বলেছিলাম।’
‘ তোমার ভাই তো প্রতিবন্ধী তাইনা?’

শ্রুতি তার কোমল ধারালো কণ্ঠে চোখ তুলে তাকাল, ‘জ্বী।’

‘ মা, তোমার ভাইকে কিছুদিনের জন্য অন্য বাসায় রাখা যায়না?’

শ্রুতি কথার অর্থ না বুঝে তাকিয়ে রইল। মহিলা শ্রুতিকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন,
‘ জানোই তো হিয়া অনঃসত্ত্বা। এই সময়ে সুন্দর পরিবেশে থাকতে হয়। তারচেয়েও বড় কথা কিছুদিনের মধ্যে ছয়মামে পড়বে। তোমার তো জানার কথা যে ছয়মাসের পর গর্ভবতী মা যা যা দেখে বাচ্চা তেমনই হয়। যেমন আমাদের সময়ে গর্ভবতী মায়েরা বাঁদর দেখতো না, বাচ্চার মুখ বাঁদরের মতো হবে বলে। তাই বলছিলাম যে….. এই কয়েকটা দিন যদি তোমার ভাইকে অন্য কোথাও রেখে আসতে। আর তাছাড়া ছোটভাই বোনের শ্বশুরবাড়িতে পরে আছে, দেখতে কেমন লাগে তুমি বলো?’

শ্রুতি কিছুই বললনা। বুঝল, মহিলাটি চাচ্ছেনা তার ভাই এই বাড়িতে থাকুক। মহিলাটি হয়তো সুযোগ পেলেন, ‘ আমি আসলে চাচ্ছিনা আমার নাতি/নাতনির মুখ বাঁদরমুখো হোক।’
শ্রুতির নাক ফুলে উঠল। মহিলাটি যে তার ভাইকে অপমান করছে তা অনেক আগেই বুঝেছে। এখন কথাগুলো যেন বিঁধে গেল শরীরে। চোখ চোখ রাখল মহিলার। হয়তো কঠিন কিছু শোনাতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই কারো কণ্ঠে শুনতে পেল,
‘ হায়রে দুনিয়া! যুগ পালটালো অথচ মানুষের চিন্তাধারা না। এখনো এইসব কুসংস্কার ধরে বসে থাকলে চলে বেয়াইন? আমাদের সময় তো কতোকিছুই হতো; এখনো কী হয়? জ্ঞানহীন মানুষের মতো মেয়েটাকে কতোগুলো কথা শুনিয়ে দিলেন! কে বাঁদরমুখো শুনি? হামিম? কই আমার চোখে তো বাচ্চাটা কী শান্ত, সরল লাগছে।’

শ্রুতি তার চাচিশাশুড়ির দিকে চেয়ে রইল। তিনি আরোও বললেন, ‘ মেয়ের বাড়িতে এসেছেন। ঘুরুন, ফিরুন। সম্মানের সাথে চলেও যাবেন। তাই বলে সেই বাড়িরই অন্য বউয়ের ব্যাপারে নাল গলাবেন না।
হামিম শ্রুতির ভাই। হামিম নাতো আপনার মেয়ের জামাইর টাকা খাচ্ছে, আর নাতো এই বাড়ির কারোর টাকায় খাচ্ছে। সে খেলে তার দুলাভাইয়ের টাকায় খাচ্ছে। এতে মা ম/রা বাচ্চাটার অধিকার আছে।’

বলেই মিষ্টি হাসল রুমা বেগম। সেই হাসি দেখে ভদ্রমহিলাও সুন্দর হাসল। হয়তো বুঝেছে অতিরিক্ত কথা বলে অপমান হওয়ার চেয়ে অল্প কথায় মেনে নেওয়া ভালো। ভদ্রমহিলা আবারো হেসে বেরিয়ে গেল।
রুমা বেগম শ্রুতির সামনে দাঁড়াল। রয়েসয়ে বলল ‘ কষ্ট পেয়োনা। ভেবনা উনাকে শুধু তোমার ভাইয়ের জন্য বলেছি। উনি আগেও এসেছে এবং নানা ব্যাপারে নাক গলানোর চেষ্টা করেছে। অযথাই। তাই ভাবলাম এইবার বলা দরকার।’
শ্রুতি মাথা নাড়ল। রুমা বেগম হামিমের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ তোমার মা নাই, শ্রুতি। ঘরে সৎ মা। বোন হিসেবে তোমাদের দুইজনের দায়িত্ব হামিমরে দেখা। তাই কারোর কথায় কখনো পিছপা হবানা। আর শোনো মা, ওয়াহাব বাবারে এই ব্যাপারে কিছু বইলো না। ও জানতে পারলে লজ্জা পাব আমি।’
ওয়াহাব পার্থিবের আরেক নাম। পুরো নাম ওয়াহাব মীর পার্থিব। তার চাচিশাশুড়ি যে পার্থিবকে ওয়াহাব ডাকে তা শ্রুতি জানে। তাই হেসে সায় দিল। যার অর্থ সে বলবেনা। রুমা বেগম চলে গেলেন।
শ্রুতি ছোটবেলা থেকেই শ্বশুড়বাড়ি সম্পর্কে নানান নেতিবাচক কথা শুনেছে। অথচ এই বাড়িতে এসে তার ধারণা পুরোটাই পালটে যাচ্ছে। একটা বাড়ির সব মানুষ এতোটা শান্ত, অমায়িক, বিনয়ী হয় কীভাবে?

.
ছোটবেলার জীবনটাকে প্রায় সবাই আমরা যন্ত্রণার ভাবি। ভাবি কবে বড় হব, কবে আমরা সুখের নাগাল পাব। অথচ আমরা বুঝতেই পারিনা সুখের সময়ে থেকেই আমরা সুখ ধরতে চাই। মানুষ যেদিন জন্ম নেয় সেদিন সেই মানুষটার জন্য সবচেয়ে সুন্দর দিন। এরপর ধীরে ধীরে আসতে থাকে সব খারাপ দিন। অথচ বোকা মানুষেরা সুখের আশায় বসে থাকে। তারা বুঝতেও পারেনা অতীতের থেকে সুন্দর দিন আর হয়না।
কথাগুলো ভেবেও মাহাথির মানতে পারল না। সত্যিই কী অতীত, ছেলেবেলা সুন্দর? না, সুন্দর নয়। সবার অতীত, ছেলেবেলা সুন্দর হয়না। এতিম, অনাথের ছেলেবেলা আবার সুন্দর হয় কীভাবে?

মাইগ্রেনের ব্যথা এই কয়েকদিন ধরে ভীষণ বেড়েছে। মাহাথির চোখ বন্ধ করে ফেলল। এরপর নিজে মনে মনে উচ্চারণ করল — আমি অনাথ নই। আমারো বাবা, মা আছে। কিন্তু তারা আমাকে রাখেনি। ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে।

শৈশব মানুষের জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। তখনকার সব ঘটনাই যেন মস্তিষ্কে বিস্তরভাবে প্রভাব ফেলে। হয়তো
শৈশবে মানুষের মস্তিষ্ক সবকিছু ধারণ করতে পারেনা। তাই সব তাদের মনে না থাকলেও বিশেষভাবে প্রভাবিত ঘটনাগুলো তারা ভুলতে পারেনা। মাহাথির নিজের জীবনের আবছা স্মৃতিগুলো মনে করতে চেষ্টা করলে শুধুই মনে পড়ে — তার স্কুলে যাওয়া, অল্পকিছুতেই তাকে তার বাবা/মায়ের মার দেওয়া, প্রতিনিয়তই ঝগড়া/ঝাটি, মায়ের রাগারাগি, কান্নাকাটি। এরপর, এরপর একদিন তার বাবা তাকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে একটা জায়গায় নিয়ে এলো, তাকে খেলা করতে বলে কোথাও যেন চলে গেল। এরপর যখন মাহাথির তাকে দেখল গেট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে তখন দৌড়ে গিয়ে ভীষণ ডাকল, চিৎকার করল। অথচ তার বাবা তার ডাক শুনল না। ওই জায়গার কিছু লোক তাকে ধরে ভেতরে নিয়ে গেল। এরপর সেখানেই কেটে গেল তার দুইদিন। এরপরেই তো সে চলে গেল আরেকটা নতুন ঘরে। যেখানে সবাই তার অচেনা, অজানা। মাহাথিরের তখন কেবল মনে হত, তার বাবা-মা তাকে বিক্রি করে দিয়েছে, আর এনারা কিনে এনেছে। তাদের নিজের বাবা-মা মানতেই ইচ্ছেই করতো না। মন খারাপ করে বসে থাকতো জায়গায় জায়গায়। নিরবে কাঁদত। কিন্তু তার নতুন বাবা-মায়ের ভালোবাসায় নিজেকে আটকাতে পারেনি মাহাথির, তাদের বাবা-মা বলে ডাকা শুরু করে। শুরু হয় তার নতুন জীবন। তবুও, তবুও যেন স্মৃতি পিছু ছাড়েনা।

ছোট থেকেই সে অল্পভাষী, এখন পরিস্থিতির চাপে আরোও হয়ে গেছে। কাকে বলবে সে নিজের মনের কথা, কেউ তো তাকে বুঝেইনা। তাই সে আর চেষ্টাও করেনা। সেই তো খারাপ, একারণেই তার বাবা-মা তাকে অনাথ আশ্রমে ছেড়ে দিতে দ্বিধাবোধ করেনি।

মাহাথিরের ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। চারপাশ অসহ্য লাগতে শুরু করল। মাথাব্যথা যেন ১০ গুণ বেড়ে গেল। সে এইসব কথা মনে করতে চায়না। তবুও বেয়া/দব মন মাঝেমধ্যে চেষ্টা করে তার বাবা-মায়ের মুখ মনে করতে। বাবা-মা? যারা নিজের সন্তানকে ছেড়ে দিতে পারে, তারা আদৌও বাবা-মা? নাহ! তাদের বাবা-মা বলে তার বর্তমান আব্বা-আম্মাকে অসম্মান করতে চায়না মাহাথির। এরা যে সত্যিই ভীষণ ভালো মানুষ।

কপালে নরম হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলল মাহাথির। বিভা। মেয়েটাকে দেখে এখন রাগ হলোনা, ভীষণ মন খারাপ হলো।

বিভাও তাকিয়ে আছে মাহাথিরের দিকে। কপালে ভাঁজ। মনে চিন্তা যে, এইটা তার স্বামী নাকি অন্যকিছু? অল্পতেই মানুষটা এতো অসুস্থ হয়ে কেন পড়ে? হালকা বৃষ্টিতে ভিজলেই জ্বর, সর্দি, কাশি হয়ে যায়। বাইরের খাবার খেলে পেট সহ্য করতে পারেনা, গ্যাস্টিকের ব্যথা হয়। এছাড়া সারামাস তো কোনো না কোনো অসুখ-বিসুখ তো লেগে আছেই। সাথে ‘মাইগ্রেন’ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো। এতো নাজুক কোনো মানুষ হয়?

বিভাকে অবাক করে মাহাথির বিভার হাত ধরল। বিভা মাহাথিরের চোখের দিকে তাকাল। মাহাথিরের চোখদুটোতে লাল আভা। বিভা ঢোল গিলল, মানুষটার কী শরীর বেশি অসুস্থ?
বিভা তাকিয়ে দেখল মাহাথিরের মুখ বেঁকিয়ে হেসে আছে। হাসিতে কিছুটা বিদ্রুপ, কিছুটা মলিনতা। মাহাথির বলল,
‘ তুমি অনেক ভালো বিভা। আগেও বলেছি, আজকেও বলছি। একজন আদর্শ বউ তুমি। অথচ দেখো তোমার ভাগ্যে কিনা আমার মতো স্বামী জুটল। ইউ ডিজার্ভ বেটার। মোর বেটার দ্যান মি।’

‘ কী বলতে চাচ্ছেন?’

মাহাথির তার উত্তর দিল না। নিজের মতো বলল, ‘ আমার মা-বাবা তোমাকে কীভাবে আমার জন্য ঠিক করল আমি জানিনা। অবশ্য প্রতি বাবা-মাই চায় তাদের পুত্রবধূ ভালো হোক। সেই আশাতেই হয়তো। সেখানে তোমার জীবন নষ্ট হলো কিনা চিন্তাও করলনা। এখন প্রমাণ পেলে তো যে, সব মানুষেরাই স্বার্থপর? আমার আব্বা-আম্মাও কেবল আমার কথা চিন্তা করে তোমায় আমার কাছে বিয়ে দিয়েছে; তোমার কথা চিন্তা করেনি। আ’ম শিওর, তোমার মা বেঁচে থাকলে কখনো আমার কাছে বিয়ে দিতোনা। সে দেখে শুনে অন্য কোনো ভালো ছেলের কাছে বিয়ে দিতো; তুমি ডিজার্ভ করো এমন কেউ।’

মাহাথিরের কথা হাওয়ায় উড়িয়ে দিল বিভা,
‘ আপনার মাথার যন্ত্রণা কমেছে? বাড়লে তো সমস্যা। ডাক্তারের কাছে যাবেন?’

মাহাথিরের রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। তার কথা এই মেয়ে গায়েই মাখল না? বিভাকে দমাতে বলল, ‘ তোমার স্বামীর জন্ম-পরিচয়ের ঠিক নেই — তোমার ভাবতে খারাপ লাগছেনা? আমি তো কারোর অবৈধ সন্তানও হতে পারি?’

‘ আমার কাছে আপনার সবচেয়ে বড় পরিচয় আপনি আমার হাসবেন্ড। আর আপনার আব্বা-আম্মা আছে মাহাথির। তারা আপনাকে ভালোবাসে। আপনি এইভাবে বলে তাদের ছোট করছেন।’

মাহাথির বিভার হাতের আঙুল নিয়ে খেলছিল। বিভার কথায় চোখ তুলে তাকাল, ‘ আমি আমার আব্বা-আম্মাকে ভালোবাসি। তারা আমাকে ভালোবাসে। এই দু’টো কথা যেমন সত্যি, ঠিক তেমনি সত্যি তারা আমার আপন বাবা-মা নয়। এই পৃথিবীতে মাহাথির নামক মানুষের নিজের একান্ত, আপন বলে কেউ নেই। কেউ না বিভা।’
কণ্ঠটা কী করুণ শোনালো? বিভা তাকিয়ে রইল মাহাথিরের দিকে। মাহাথির উঠে গেল। রুমের লাইট অফ করে ফিরে এলো বিছানায়। বলল,
‘ আমি ঘুমাব। রাতে খাবনা। না মানে না। আশাকরি পতিব্রতা স্ত্রী হয়ে আমাকে ডেকে বিরক্ত করবেনা।’
মাহাথির উল্টো ঘুরে শুয়ে পড়ল। বিভা আগের মতোই বসে আছে। মনে মনে বলল,
‘ এই পৃথিবীতে আপনার আপন বলে কেউ নেই — কথাটা মিথ্যা মাহাথির। আমি আছি না? আপনার আব্বা-আম্মা আপনার আপন নয় এইটা যেমন সত্যি, আমি আপনার স্ত্রী এইটাও তেমনি সত্যি। পৃথিবীর ৮০১ কোটি মানুষের মধ্যে শুধুমাত্র আমি আপনার আপন — ব্যাপারটা কতো সুন্দর! দেখেছেন? শুধু সুন্দর নয়, অসম্ভব সুন্দর।’

_____
চলবে~
শব্দসংখ্যা – ১৬০০
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

২৭.
মধ্যরাত।
পার্থিব কপাল কুঁচকে বসে আছে বিছানায়। ঘুম আসছেনা। এই ছয়দিন সে কেমন করে পার করেছে তা কেবল সেই জানে। শান্তিপ্রিয় মানুষটার মনেও আজ কেবল অশান্তি আর অশান্তি।
পার্থিব একটু স্থির হতে চেষ্টা করল। উঠে রুমজুড়ে হাঁটাহাঁটি করল, পানি খেল। তাও যেন স্থির মানুষটার মধ্যে স্থিরতা ধরা দিচ্ছেনা। গত দিনগুলো শ্রুতির বিভিন্ন ছবি দেখে মনকে মানিয়েছে, আজ মন যেন তাতেও মানতে চাইছেনা। সে কী ফোন করবে শ্রুতিকে?
ফোন হাতে নিল। শ্রুতির নাম্বারে হাত স্থির করল। সেভ বলতে শ্রুতির নামের জায়গায় একটি লাভ ইমোজি আর একটি ডাইনির ইমোজি দেওয়া। নিজের করা কান্ডে এইবার পার্থিব নিজেই হেসে দিল। ধীরে ধীরে বলল,
‘ ডা/ইনি। আমার পারসোনাল ডা/ইনি।’

ক্লিক করতে গিয়েও করল না। ফোন টা বিছানায় ছুড়ে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। নিজের মনকে বুঝাতে চেষ্টা করল যে, আর মাত্র একদিন, এরপরেই দেখা করবে, কথা বলবে। অথচ, একি! তার মনও তার সাথে আজ নাফরমানি করছে।
মেয়েটার মধ্যে কী আছে? আপাতদৃষ্টিতে বলতে গেলে কিছুই নেই। অথচ পার্থিব কেমন মায়ায় পড়ে গেল। যেই মায়া থেকে সে উঠতেই পারছেনা। মায়া এতো ভয়ংকর? বাসার মা থেকে শুরু করে সবার সাথে সে কথা বলে ফেলেছে, শ্রুতির খোঁজখবরও নেয়া শেষ। তবুও মন মানছেনা। মনে হচ্ছে শ্রুতি তার সাথে একটু কথা বললেই তার শান্তি লাগবে, মনে হচ্ছে তার সাথে রাগী গলায় কথা বললে, ঝাঁঝালো কণ্ঠে ঝগড়া করলেই সে শান্তি পাবে। এমন নিরব বিচ্ছেদের থেকে তো শ্রুতির ঝগড়াই ভালো ছিল।

পার্থিব ভ্রু কুঁচকে ফেলল। সে চেয়েছে শ্রুতিকে একটু শাস্তি দিতে। অথচ শাস্তি সে নিজেই পাচ্ছে। এসবের কোনো মানে হয়? শ্রুতি তো নিশ্চয়ই নিজেরমতো আছে। কোনো চিন্তাও নেই তার জন্য। পার্থিব চোখ বন্ধ করল। এমন দ/জ্জাল একটা মেয়েকে তার মা তার জন্য পছন্দ করল কেমন করে? তার মায়ের চেয়েও তো সে বেশি দোষী। এমন মেয়েকে সে ভালোবাসে কেমন করে?
পার্থিব নিজের ফোনে শ্রুতির ছবি দেখতে লাগল; যা ওর থেকে লুকিয়ে তোলা হয়েছে। পার্থিব ছবি দেখতে দেখতে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। এরপর থেকে শ্রুতির কণ্ঠটা রেকর্ড করে রাখতে হবে, যাতে ঝগড়া করলেও সমস্যা না হয়। সে যেন কণ্ঠ শুনে নিজেকে স্থির রাখতে পারে। পার্থিব ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে গেল। বিছানায় টিকটিকির মতো আটকে থাকার চেয়ে কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখা অধিক শ্রেয়।

.
৮ দিন পর পার্থিব আসছে।
কথাটা শ্রুতি শুনেছে সকালবেলা। শ্রুতি লক্ষ্য করছে, না চাইতেও তার মুখটা হাসি হাসি হয়ে যাচ্ছে। অল্পতেই ভীষণ খুশি খুশি লাগছে। এই যে সারা সকাল সে প্রভা-প্রত্যাশা, হিয়া ভাবির সাথে কতো প্রাণখুলে গল্প করল! শ্রুতি অনুভব করছে তার হাত, পা হালকা কাঁপছে। পার্থিব আশায় সে কী বেশি উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে? সে কী খুব বেশি খুশি হয়ে যাচ্ছে পার্থিব আসবে বলে?
শ্রুতি আয়নার দিকে তাকাল। দেখতে তাকে আহামরি ভালোও লাগছেনা আবার খারাপও লাগছেনা। শ্রুতির ভ্রুতে ভাঁজ পড়ল। অন্যান্যদিন তো ঠিকই মুখটা একটু হলদেটে সুন্দর থাকে, আজ নেই কেন?
শ্রুতি নিজের চুলগুলো ঠিক করে চলে গেল নিচে।
নিচে হামিমকে বসিয়ে রেখে এসেছে। হামিমকে খাওয়ানোর নাম করে বসে থাকবে যেন পার্থিব ঢুকলেই তার চেহারা দেখতে পারে। নিজের চিন্তায় নিজেই ভীষণ অবাক হলো শ্রুতি।

বউয়ের অপেক্ষা দীর্ঘ করল না পার্থিব। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে সে বাড়িতে ঢুকল। হাতে ব্যাগপত্র।
শ্রুতি হামিমকে খাওয়ানোর ফাঁকে ফাঁকে লক্ষ্য করতে লাগল পার্থিবকে। গায়ের শার্ট ঘেমে গেছে, মুখেও বিন্দু বিন্দু ঘাম। এসেই সোফায় বসে পড়েছে। কী আশ্চর্য! একবার তার দিকে তাকিয়ে হাসলও না?

হামিমকে খাওয়ানো বাদ দিয়ে বসে আছে শ্রুতি। হামিমকে খাওয়ানো হয়ে গেলে সে এখানে বসে থাকতে পারবেনা। লোকটা ভাববে তাকে দেখার জন্য হয়তো বসে আছে যেটা মোটেও হতে দেওয়া যাবেনা। ভাব বেড়ে যাবে লোকটার। শ্রুতি ঠোঁট বাকিয়ে হামিমের মুখে খাবার দিল।

পার্থিব একটু বিশ্রাম নিয়েই সবার জন্য আনা ছোটখাটো উপহার দিতে লাগল। সবাইকে ডেকে ডেকেই দিল সে। এমনকি উঠে এসে হামিমকেও উপহার দিল। হামিমের জন্য নতুন ক্যানভাস, আর্ট পেপার, রঙ এনেছে সাথে আর্টের প্রয়োজনীয় সামগ্রী। শ্রুতিকে অবাক করে দিয়ে হামিম হেসে দিয়ে পার্থিবের কোমড় জড়িয়ে ধরল। বিনিময়ে পার্থিবও চমৎকার করে হাসল। শ্রুতি আড়চোখে দেখে চোখ নামিয়ে নিল।
সবাইকে গিফট দেওয়া শেষ হতেই পার্থিব উপরে চলে গেল বিশ্রামের জন্য। শ্রুতি তা লক্ষ্য করে নাক ফুলিয়ে ফেলল। সে হয়তো আশা করেছিল পার্থিব তাকেও কিছু দেবে। শ্রুতি নিজেকে গালি দিতে লাগল। সে এতো বোকা কেন? কার জন্য অপেক্ষায় ছিল সে? কার জন্য অপেক্ষা করেছে? কার সাথে একটু গল্প করার আশায় বসে ছিল? এই ফাল/তু মানুষটার জন্য যে কিনা তাকে গ্রাহ্যই করেনা? যার কাছে তার কোনো দামই নেই?
শ্রুতি নিজের দোষ দেখলনা। সব দোষ পার্থিবের ঘাড়ে দিয়ে মনে মনে বকতে লাগল। এই অস/ভ্য মানুষটার জন্য তার ভাইকে সকালের ৯ টার নাস্তা ১১ টায় করালো — ভাবতেই তার ম/রে যেতে ইচ্ছে করছে।

.
বিভা দাদীর সাথে কথা বলে ফোনটা রাখল। ভালো লাগছেনা। দাদীর অসুস্থতায় বিভার মনে হচ্ছে সে নিজেই অসুস্থ। আজ গিয়েছিল ভার্সিটি থেকে ফিরে দাদীর সাথে দেখা করতে। সেখানে গিয়ে দেখতে পেল তার সৎ মায়ের আগের ঘরের ছেলেরা এসেছে। তারা বিভার থেকে বয়সে বড়। বিভা তাদের মোটেও পছন্দ করেনা। তাই যতোদ্রুত সম্ভব দাদীর সাথে কথা বলে চলে এসেছে।
দাদীর শরীরটা মোটেই ভালো যাচ্ছেনা। বিভা আজ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাইল, দাদী রাজি হলোনা। হাজার জোড় করেও বিভা মানাতে পারল না। দাদীর এই অবস্থা শ্রুতি শুনলে অযথাই চিৎকার চেঁচামেচি করবে আমিন সাহেবের সাথে, এরপর কান্নাকাটি করে কষ্ট পাবে। শুধুশুধু শ্রুতিকে কষ্ট দিতে বিভা চায়না। তাই এতো অসুস্থতার কথা বলেনি শ্রুতিকে। সে থাকাকালীন শ্রুতি ফোন দিয়েছিল, তখনই কথা বলে নেয় দু’জনে।
বিভা নিজের মাথা চেপে বসে পড়ল। হঠাৎ করেই ভীষণ কান্না পাচ্ছে। নিজের ফোনে মায়ের ছবি বের করে ধীরকণ্ঠে বলল,
‘ আমি পারছিনা, আম্মু। আমি কোনো দায়িত্বই ঠিকভাবে পালন করতে পারছিনা। দাদীর খেয়াল রাখতে পারছিনা, হামিমও আমার কাছে নেই, শ্রুতির পড়ালেখাও আটকে আছে। এক ইয়ার লস হয়ে গেছে ওর। কিছুই সামলাতে পারছিনা আমি।’

শ্রুতির পড়ালেখা আটকে আছে — কথাটা ভুল। শ্রুতি নিজেই ভার্সিটিতে ভর্তি হয়নি নিজের জেদ বজায় রাখতে। বিভার ধমকি-ধামকিতেও কাজ হয়নি। শ্রুতির মতে, একটা বছর সে রিল্যাক্স করতে চায়। এরপর অন্যবছরে ভার্সিটির প্রিপারেশন নেওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে গেল। কারোর কিছু করার রইল না। তবুও এখনো সময় আছে অন্যান্য ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার। একারণেই বিভা দুপুরে কথা বলেছে পার্থিবের সাথে। বিভা নিজেই টাকা দিতে চেয়েছে, কিন্তু পার্থিব খুব বিনয়ীভাবে বিভাকে নাকচ করে দেয়। বিভাও মেনে নেয়। পার্থিবের ফোন রেখেই শ্রুতিকে ফোন করেছিল বিভা। এক দফায় বকা দিয়ে দিয়েছে। বিভার বকা শুনে শ্রুতি চুপ ছিল। এরপর গম্ভীরকণ্ঠে শুধু বলেছে, আচ্ছা ভর্তি হব আমি।

বিভার ভাবনার মাঝেই মাহাথির ঘরে ঢুকল। বিনা বাক্যব্যয়ে ট্রাউজারের পকেট থেকে টাকা বের করে বিভাকে দিল। বিভা তাকিয়ে রইল টাকার দিকে।
টাকা দিয়ে আলমারির কাছে গেল মাহাথির। আলমারি খুলে হঠাৎ করেই লক্ষ্য করল বিভা এখন আর নিজের কোনো জামা আলমারিতে রাখেনা। সব তারই জামা। বিশেষ ভাবল না এই নিয়ে। রাখেনা তার জনই ভালো। বেতনের বাকি টাকা ড্রয়ারে রেখে দিয়ে ঘুরে দেখল বিভা এখনো টাকা হাতে নিয়ে বসে আছে।
মাহাথির ভরাট কণ্ঠে বলল, ‘ আশা করি হাত খরচ এতেই হয়ে যাবে। অন্য মাসের থেকে এইবার দুই হাজার টাকা বেশি আছে।’

বিভা তাকাল মাহাথিরের দিকে। মাহাথির টাকা কেবল আজকে দিচ্ছে তেমন নয়। গত পাঁচ মাস ধরেই দিচ্ছে। বিয়ের দ্বিতীয় মাস থেকে দেওয়া শুরু করেছিল। সাথে ছিল গম্ভীরকণ্ঠের বাণী, ‘ লাখ টাকার চাকরি করিনা। আশা করি এতে তোমার হাত খরচ হয়ে যাবে। আরোও লাগলে বোলো। মোস্ট ইম্পোর্টেন্ট টাকার মূল্য দিও। বড়লোক বাপের মেয়ে হয়ে মধ্যবিত্ত স্বামীর আয় বুঝে খরচ করবে আই থিংক। আর এই টাকার সাথে এইটা ভেবে নিও না যে আমি তোমাকে ভালোবেসে টাকা দিচ্ছি। আমি জাস্ট আমার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন।’
বিভা নাকচ করেনি টাকা নিতে। কেন করবে? এই টাকায় তার অধিকার আছে। আর তার থেকেও বড় বিষয় সব ব্যাপারে নেতিবাচক চিন্তা আনলে চলবে? সব ব্যাপারে নেতিবাচক চিন্তা না এনে ইতিবাচক চিন্তাও আনা যায়। মাহাথির বিভাকে নিয়ে ভেবেছে, বিভার হাত খরচ নিয়ে ভেবেছে এইটাই কী যথেষ্ট নয় খুশি হওয়ার জন্য? বিভা তো এতেই খুশি। তাছাড়া বিভা যে ছোটখাটো অনলাইন বিজনেস করে তা মাহাথির জানে। জানা সত্ত্বেও নিজের স্ত্রীর হাত খরচের জন্য টাকা আলাদা করে দিচ্ছে ব্যাপারটা প্রতিবারের মতো এইবারেও বিভাকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করল। বিভা উঠে গেল মাহাথিরের জন্য চা আনতে।

বিভা ফিরে এলো মিনিট পনেরো পড়ে। এসে দেখল মাহাথির বিছানায় বসে কাগজপত্র নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে। এইটাই সময় মাহাথিরকে গিফট দেওয়ার। বিভা চায়ের কাপ খাটের পাশের ছোট টেবিলে রাখল। টেবিলটার কাছেই খাটে বসা মাহাথির।
বিভা গিয়ে নিজের ব্যাগ থেকে একটা সুন্দর ঘড়ি বের করল। আজ ভার্সিটি থেকে আসার পথে বিভা নিজের অজান্তেই কিনে ফেলেছে মাহাথিরের জন্য। বিভা ঘড়িটা নিয়ে চুপচাপ মাহাথিরের পাশে বসল। মাহাথির বুঝেও কিছু বলল না।
বিভা মাহাথিরের হাত থেকে কাগজ রেখে হাত এনে নিজের কোলে রাখল। ভীষণ যত্ন নিয়ে ঘড়িটা পরিয়ে দিল হাতে। এরপর মাহাথিরের কাঁধে মাথা রেখে মিষ্টি কণ্ঠে বলল, ‘ দেখুন মাহাথির, আপনার হাতে কী সুন্দর মানিয়েছে!’
ঘটনার আকস্মিকতায় মাহাথির নিজের হাতের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল কেবল। বিভা তার কাঁধে মাথা রাখছে! বিভার থেকে এইসবকিছু আশা করেনি মাহাথির। পুরুষালি কণ্ঠে বলল,
‘ এইসবের মানে কী বিভা?’
‘ গিফট মাহাথির। আপনার জন্য।’

সরল কণ্ঠে বলেই বিভা মাহাথিরের বাহুতে থুতনি রেখে তাকাল তার দিকে, ‘ আপনার পছন্দ হয়নি? আজ ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে কিনেছি। হঠাৎ করেই কিনলাম আপনার জন্য।’
‘ এইসব করে কী বুঝাতে চাইছো?’
‘ কিছুই বুঝাতে চাইছিনা মাহাথির। আবার অনেককিছুই বুঝাতে চাইছি। আপনার জানা দরকার আপনাকে কেউ অসম্ভব ভালোবাসে। আপনার জানা দরকার আপনাকে ভেবে কেউ তার পুরো দিন পার করে। কেউ সারাদিন আপনার কথা ভাবে। আপনি যে সকাল-বিকাল উচ্চারণ করেন আপনার কেউ নেই, কেউ নেই। আমি আছি তো মাহাথির। আপনার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষ।’
মাহাথির কিছু না বলে গম্ভীরমুখে তাকিয়ে রইল। তা দেখে বিভা ফের বলতে শুরু করল, ‘ এইভাবে তাকিয়ে লাভ নেই। আপনাকে ভালোবাসি তাই প্রকাশ করছি। ভালোবাসলে প্রকাশ করতে হয়। নয়তো আপনি জানবেন কেমন করে?’
কিছুক্ষণ থেমে বিভা আবারো বলতে শুরু করল, ‘ আপনার ব্যাপারে আরোও একটা রহস্য উদঘাটন করলাম। আপনি অযথাই চিল্লান আমাদের বিয়ের ব্যাপারে। অথচ আপনার বিয়ে না মানার কোনো কারণ নেই। বিয়ের শুরুতে বলেছিলেন আমি কালো বলে মানেন না। আসলে এটাও আপনার জন্য কোনো সমস্যা না। সমস্যা হলো আপনার জেদ। আপনি কোনো সম্পর্কে থাকতে চাননি সেই জেদ থেকেই আপনার এমন আচরণ। ঠিক বললাম?’

মাহাথির ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসল,
‘ খুব বেশিই চিন্তা করে ফেলেছো আমার ব্যাপারে। তোমার সবগুলো কথাই ভুল বিভা।’
মাহাথির উঠে দাঁড়িয়ে বিভার সামনে গেল,
‘ তোমার আর আমার সম্পর্কটা জাস্ট এন্ড জাস্ট অধিকার আর দায়িত্বের। আর তুমি আমাকে ভালোবাসো কি না বাসো এতে আমার কিছুই যায় আসেনা। আমার জন্য আমিই এনাফ। অন্য কারোর প্রয়োজন নেই। আর রইল তোমার গায়ের রঙ। যেখানে তোমাকেই পছন্দ করিনা সেখানে তোমার রঙ এর ব্যপারে ভাবাও দূরের কথা। তুমি আমি স্বামী-স্ত্রী তাই আমরা সংসার করছি। আজীবন করব। ভবিষ্যতে ভালোবাসা, মায়া যদি হয়’ও তাও জাস্ট হওয়ার জন্য হবে। আই মিন বলার জন্য বলব। তোমার সামনে থাকতে আমি স্বস্তি পাইনা বিভা একারণেই তোমার থেকে দূরে থাকি।’ বলেই মাহাথির গিয়ে বিছানায় বসল। এরপর আবারো বিভার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ বাই দ্যা ওয়ে, ঘড়িটা সুন্দর। হাতে সত্যিই মানাচ্ছে।’

বিভার আজ মন-মেজাজ ঠিক নেই। এই ভালো হচ্ছে তো এই খারাপ। এখনো তাই হলো। রেগে গেল বেশ। ইচ্ছে করল মাহাথিরের সামনে গিয়ে হাত থেকে ঘড়ি খুলে দূরে ছুঁড়ে ফেলতে, সাথে মাহাথিরের গালে একটা চড় লাগাতে। নিজের ইচ্ছেতে ছাঁই দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল বিভা।

.
মায়ের কোলে শুয়ে আছে পার্থিব। মাথায় যত্ন নিয়ে হাত বুলাচ্ছে তানহা বেগম। ছেলের গতিবিধি কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করেছে সে। সাথে নিজের ছেলেরবউ এর’ও। দু’জনের নিরব যু/দ্ধ আর কেউ না বুঝলেও তানহা বেগম ভালোই বুঝতে পারছে। চট্টগ্রাম যাওয়ার দিন হামিম, শ্রুতিসহ তার নিজের যত্ন নিতে বলে গেল। অথচ শ্রুতিকে একবারো ডাকল না। এরপর শ্রুতি এসে তার কাছে পার্থিবের ব্যপারে জানতে চাইল। তাছাড়া চট্টগ্রামে গিয়ে বার বার শ্রুতির কথা জিগ্যেস করা, শ্রুতির নির্লিপ্ততা, আজ বাসায় ফিরে শ্রুতিকে গিফট না দেওয়া, শ্রুতির রাগী, অভিমানী চেহারা সব যেন তাদের যু/দ্ধের চিহ্ন বহন করছে। মনের প্রশ্ন মুখে করল তানহা,
‘ শ্রুতির সাথে ঝগড়া হয়েছে?’
বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে উত্তর দিল পার্থিব, ‘ না, মা। ঝগড়া কেন হবে?’
‘ তাহলে মেয়েটার সাথে ভালোভাবে কথা বলছিস না কেন? আবার গিফট’ও দিসনি। আমি কিন্তু সবই লক্ষ্য করেছি।’
‘ উনার মাথা থেকে ভূ/ত নামাচ্ছি, মা।’

তানহা সরল মনের মানুষ। অল্পতে চিন্তিত হয়ে পড়ে। পার্থিবের কথায় আতংকিত হয় গেল,
‘ ভূ/ত নামাচ্ছিস মানে? আসলেই কী বউকে ভূ/তে ধরেছে? তোর বাবাকে আমি বলব?’
পার্থিব মায়ের কোলে ভালোভাবে শুয়ে নির্লিপ্ত ভাবে বলল, ‘ হ্যাঁ মা, বলো। বাবাকে বলো ওঝা ডাকতে। আর ভূতের ডিটেইলস জানতে চাইলে বোলো সন্ন্যাসী ভূতে ধরেছে। যেই ভূত সংসার করতে দিচ্ছেনা তোমার বউমাকে। সন্ন্যাসী বানাতে চাইছে।’

_____
চলবে~
শব্দসংখ্যা – ১৮৬৫
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান