একগুচ্ছ শুকতারা পর্ব-৪০+৪১+৪২

0
174

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

৪০.
জীবন। মাত্র তিন বর্ণের একটি শব্দ। বর্ণ সংখ্যার দিক থেকে এর ভার যেমন হালকা, উপলব্ধির দিক থেকে এর ভার তেমন বিরাট ভারী। আমরা মানুষেরা জানিনা, বুঝিনা আগামী দিন কী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে। অথচ কতো আগ্রহী হয়ে বসে থাকি পরবর্তী দিনের জন্য। কখনো কখনো সেই দিন আমাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে খুশি করে, বাঁচার নতুন প্রেরণা জোগায়, কখনোবা সেই দিন আমাদের মধ্য থেকে বাঁচার ইচ্ছেটাকেই নিঃশেষ করে দেয়। কখনো কখনোবা নিজের শক্তি প্রতীয়মান করতে ভীষণ রকমের চমক দিয়ে দেয় মানুষ নামক প্রাণীকে।
এই যেমন বিভার ক্ষেত্রে হলো। সে বর্তমানে ধ্যান-জ্ঞান ভুলে শান্ত হয়ে বসে আছে। তার খেয়াল কোনদিকে বোঝা যাচ্ছেনা। এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। বিভার মনে হচ্ছে, সে কোনো স্বপ্নে বাস করছে। কিছুক্ষণ পর ঘুম ভেঙে যাবে। এরপর উঠে হাত-মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে যাবে। আম্মা যদি রুটি বানিয়ে রাখে তাহলে তো ভালোই হবে। কাজ কমে যাবে। সে তখন এসে মাহাথিরকে ডাকবে অফিসের জন্য। অথচ বিভার ধারণা ভুল হলো। এইটা কোনো স্বপ্ন নয়। স্বপ্ন হতে পারেনা। বর্তমানে তার গা চুঁটচুঁট করছে। শরীর চুলকাচ্ছে ধুলোর কারণে। স্বপ্নে বুঝি এইসব হয়?
বিভা জোড়ে নিঃশ্বাস ছাড়ল। এই তো, আওয়াজ হলো। স্বপ্নে শ্বাস নেওয়ার আওয়াজ হয়? এতো এতো যুক্তির পরেও বিভার মন মানল না। উঠে গেল বিছানা হতে। বাইরে গিয়ে দেখল আব্বা, আম্মা বসে। হ্যাঁ, সব ঠিকই আছে। সবাই সবার জায়গায় ব্যস্ত। সেও তো কিছুক্ষণ আগে ভার্সিটি থেকে এলো। আসার পথে হাসপাতালে গেল রিপোর্ট আনতে। আর তারপর…….তারপর জানতে পারল সে চারমাসের সন্তানসম্ভবা। এইসব স্বপ্ন কীভাবে হবে?
বিভার কানে ভাসল ডাক্তারের আশ্চর্যময় কণ্ঠ, ‘ আপনার প্রেগ্ন্যাসির চারমাস চলছে অথচ আপনি জানেনই না? কোনো সিম্পটম নজড়ে পড়েনি? কেমন অদ্ভূত কথা বলছেন আপনি?’

বিভা বিছানার দিকে চাইল। সে বাস্তবেই আছে। একদম বাস্তব। এগিয়ে গিয়ে রিপোর্ট উঠিয়ে ব্যাগে রাখল। শান্ত হয়ে বিছানায় বসে পড়ল। কিছু ভালো লাগছেনা, বিশ্বাস হচ্ছেনা যে সে প্রেগন্যান্ট। আচ্ছা, সে কী খুশি নয়? বিভা প্রশ্নটা করে মন থেকে ‘না’ উত্তরও দিত পারল না আবার ভীষণ উচ্ছ্বাস নিয়ে ‘হ্যাঁ’-ও বের হলোনা। চিন্তা হচ্ছে। ধীর পায়ে গিয়ে গোসল সারল। এরপর বিছানায় গা এলিয়ে দিল বিভা। ওমনি ফোন বেজে উঠল। বিভা উঠিয়ে দেখল – ‘Mahthir’।
মন সায় দিল না কল উঠানোর জন্য। শরীর ভেঙে ঘুম আসছে।
চোখ বন্ধ করল বিভা। মাঝে পেরিয়েছে বেশ কিছুদিন। মাহাথিরের নতুন কিছু পাগলামির মধ্যে তিনবেলা ফোন দেওয়া যোগ হয়েছে নতুন করে। এমন নয় বিভা দেয়না কিংবা দিলে রিসিভ করেনা। বিভা প্রয়োজনমতো কল করে আগেরমতোই। তবুও বিভার রাখার কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার মাহাথির কল করে। ফোন ধরে যদি জিগ্যেস করা হয় কেন করেছে, মাত্র তো কথা হলোই। তখন সে গম্ভীর মুখে উত্তর দেয়,
‘ ওই কল তুমি করেছো আমার খোঁজ নিতে। তাই এই কল আমি করলাম তোমার খোঁজ নিতে।’
বিভার চোখের কণা বেয়ে নেমে পড়ল চিকন জলধারা। ডানহাত আপনা-আপনি চলে গেল নিজের পেটে।

.
ঘুম থেকে উঠে নিজের শাশুড়ীকে সুসংবাদ টা বিভা দিল কোনো আয়োজন ছাড়াই। নিজের ঘরে এনে স্বাভাবিক স্বরে বলল,
‘ আপনি দাদী হতে চলেছেন, আম্মা।’

বলতে গিয়ে কণ্ঠটা হালকা কেঁপে উঠল। হাসিনা বিভার দিকে তাকিয়ে রইল কোনোরকম প্রতিক্রিয়া ছাড়াই। সে একবার বিভার মুখ, একবার বিভার পেটের দিকে তাকিয়ে কথাটাকে হজম করে নিল। হজমক্রিয়া সম্পন্ন হতেই সে হাসল। মন থেকে আসা হাসি যাকে বলে। বিভার কপালে চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরে রাখল কিছু মূহুর্ত। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলল, ‘ আমার সোনা মা। আল্লাহর রহমতে তোমার কোল ভরব। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে থাকো, মা। আল্লাহ দুনিয়ার সব খুশি তোমার নামে করুক। তোমার মা বাঁইচা থাকলে খুশি হইত খুব। দেখতা উল্লাস কারে বলে! কিন্তু ভাগ্যে ছিল না। আমাদের হাতে তো কিছু নাই! আমি যাই তোমার আব্বারে বইলা আসি।’
হাসিনা তার খুশি, আফসোস মিলানো অনুভূতি শেষ করে রুম ত্যাগ করল। বিভার ভাবনায় ঢুকিয়ে দিয়ে গেল তাহিরার কথা। বিভা মনে মনে ভাবল, তার মা তাদের ভাই-বোনকে কতো ভালোবাসতো! কতো আদর করতো! তাদের নিয়ে কতো পাগলামিটাই না করতো! আচ্ছা, সেও কী করবে এমন পাগলামি? তার সন্তানকে নিয়ে? তার জীবন্ত পুতুলকে নিয়ে? অনেক্ষণ বাদে বিভার মুখে হাসি ফুটল। প্রাণবন্ত হাসি। বিভা নিজের পেটের দিকে চেয়ে রইল ঠোঁট প্রসারিত করে। তার কাছে হঠাৎ করে মনে হলো — জীবন এতো সুন্দর কেন?

.
দরজা খুলতেই এক জোড়া হাত এগিয়ে এলো মাহাথিরের দিকে। তার দু’গাল আঁকড়ে ধরে কেউ কপালে চুমু খেল। ঘটনা এতো তাড়াতাড়ি ঘটল যে মাহাথির বিমূঢ় হয়ে পড়ল। সামনে তাকিয়ে বুঝল তার আম্মাই তাকে বিদুৎবেগে চুমু খেয়েছে কপালে। এবার তার বিষণ্ণ মুখ জোড়ায় ছড়িয়ে পরল অবাকের রেশ। তবে তাকে অবাক হওয়ারও সুযোগ দেওয়া হলোনা। তার আগেই তার কানে এলো ধৈর্যহীন কিছু বাক্য, ‘ মাহাথির, আমার আব্বা। নিজে বাপ হইতাছো, এইবার একটু নিজে ব্যাঁকা থিকা সোজা হও। মানুষের মতো মানুষ হও। তুমি বাপ হইতাছো আব্বা। আর আমি দাদী।’

হাসিনার মুখে আনন্দের হাসি। মাহাথির একটু সময় নিল। সে হাসিটা তো বুঝল, তবে কথাগুলো বুঝেনি। নিজে বাপ হইতাছো — মানে? মন বলছে, সে যা শুনেছে তা ঠিক। তবে মস্তিষ্ক মানল না। কারণ এতো তার কল্পনার বাইরের কথা বলছে তার আম্মা, যেই ব্যাপারে সে ভাবেইনি। ততোক্ষণে সে জুতো-মুজা ছেড়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে। ঘরে ঢুকেই দেখল কাঠের সোফায় বসা সিদ্দিক সাহেবের মুখে বাচ্চাদের মতো উপচে পড়া হাসি। সিদ্দিক সাহেব ভীষণ উৎসাহ নিয়ে বলল,
‘ সুখবরটা শুইনা এতো খুশি হইলাম যে সামনের দোকানে যে মিষ্টি পাইসি তাই নিয়া আসছি। খাইয়া দেখোতো বাপ, ভালো কিনা।’
মাহাথির তখনো প্রতিক্রিয়াহীন। বুঝেও কিছু বুঝছে না সে। সিদ্দীক সাহেব বলল,
‘ বাপ হইবা শুইনাও মুখ বেজার কইরা রাখবা নাকি? হাসো একটু? আমার বাপের হাসি আমিও একটু দেখি?’

এইবার মাহাথিরের মাথা জুড়ে কেবল একটা কথাই ঘুরতে লাগল। তা হলো — বিভা প্রেগন্যান্ট। আসলেই কী তাই? ইশ! কথাটা কী ভারী! কথাটা এতো ভারী কেন? মাহাথিরের মনে হলো এই কথাটার ভার সে সহ্য করতে পারছেনা। সোফায় বসে পড়ল সে। অফিস থেকে ফিরেই এইসব কেমন যেন কারেন্টের শক লাগার মতো লাগল। মাহাথির ঢোক গিলল। গলাটা শুকিয়ে আসছে ভীষণ। বিভা সত্যিই প্রেগন্যান্ট? বিভার পেটে সত্যিই তার একটা অংশ বেড়ে উঠছে? তার অংশ? মাহাথির বুকে এক চিকন ব্যথা অনুভব করল। সাথে মনে হলো কেউ বুকে ভীষণ জোড়ে চাপ দিয়েছে। প্রতিবারের মতো সেই অস্থির মূহুর্তেও বিভা এসে স্থির করল তাকে। শরবতের গ্লাস সামনের টি-টেবিলে রাখল। তাদের কেউ তখনো চোখ তুলে অপরমানুষটিকে দেখেনি। বিভা গ্লাস রেখে সোজা হতেই মাহাথির বসে থাকা অবস্থায় চোখে তুলে চাইল। মিলে গেল দুই জোড়া দৃষ্টি।
বিভা দেখল সাদা রঙের শার্ট পরিহিত পুরুষের মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ঘামগুলো কী সুন্দর মানাচ্ছে তাকে! কপালের বিন্দুগুলো যেন সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। শ্যাম মুখশ্রীতে থাকা আগ্রহ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে শান্ত, গভীর, দিঘির মতো দুটো চোখ। বিভা সেই চোখ পড়ার চেষ্টা করল না। সাহসে কুলালো না ওর। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। অথচ তবুও দুইজনের শান্ত চোখ জোড়ায় বিনিময় হয়ে গেল শতশত অনুভূতি।

.
বারান্দায় থম ধরে বসে আছে মাহাথির। ঘরে যাওয়ার সাহস হয়নি। বিভার মুখোমুখি হওয়ার সাহস হচ্ছেনা। সব মিলিয়ে কেমন যেন মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি দুঃখ লাগছে বিভার মুখে হাসি না দেখে। সে কী বিভার কাছে অপরাধী নয়? বিভা যদি বলে, হ্যাঁ আপনি অপরাধী। আপনি নিজের প্রয়োজনে আমাকে কাছে টেনেছেন। ভালোবেসে নয়। এই সন্তানও আপনার ভালোবাসার নয়। তখন কী হবে?
চোখ বন্ধ করে ফেলল সে। নিজের ওপর ভীষণ ঘৃণা হলো। একদম দুনিয়া যেন ভেঙে মাথার ওপর পড়ে গেল। এতো সুন্দর একটা সংবাদ অথচ সে খুশি না হয়ে নিজেদের সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে ভাবছে। নিজের করা প্রতিটা ভুল, অন্যায় যেন শরীরে বিঁধে পড়ছে। এমন হওয়ার কথা ছিল বুঝি?

সে বাবা হচ্ছে। ভাবতেই বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হলো। অস্থির অস্থির লাগলো। ঢোক গিলে নিজেকে শান্ত করার প্রচেষ্টা করেও বিশেষ লাভ হলোনা। মাথা নিচু করে হাত দুই হাঁটুতে রাখল। মাহাথির অবাক হয়ে লক্ষ্য করল তার চোখের কোল বেয়ে নেমে গেল এক ফোঁটা সুখাশ্রু।

সময় পার হলো অনেকক্ষণ। নিজেকে স্বাভাবিক করে কল হিস্ট্রিতে গিয়ে ‘Shruti’ নামক নাম্বারে ডায়াল করল সে। হয়তো ওদের জানানো হয়নি। তাই মাহাথির ঠিক করল সেই জানাবে। তার বাচ্চা, তার অধিকার ভাবতেই কোথাও একটা ভালোলাগা কাজ করল। কিছুক্ষণ পর কল রিসিভ হতেই মাহাথির অস্থির কণ্ঠে বলল,
‘ তুমি খালামণি হতে চলেছো শ্রুতি। ভাবলাম এই সুন্দর সংবাদ পাওয়ার অধিকার সবার আগে তোমার তাই জানালাম। পার্থিবকে জানিয়ে দিও।’

মাহাথির ঘরে ঢুকে দেখল বিভা শুয়ে আছে। চুপচাপ। শান্তভাবে। যেন কিছুই হয়নি। আর পাঁচটা দিনের মতো সব স্বাভাবিক। মাহাথির হামিমের ঘরে চলে গেলো। হামিম ঘুমিয়ে আছে। আশাহত হলো মাহাথির। হামিমের সাথেও কথা বলতে পারবেনা। বলবে কার সাথে? মাহাথির ক্লান্ত হয়ে খাটের পাশে বসতেই হামিম তার বড় বড় চোখ খুলে ফেলল। উৎফুল্ল হয়ে বলল, ‘ হ্যাল্লোওও!’
মাহাথির হামিমের মুখভঙ্গি দেখে হেসে ফেলল, ‘ ঘুমোওনি তুমি?’
‘ নো। ঘুমাইনি। চেষ্টা করছিলাম আসেনি। তাই চোখ বন্ধ করে ছিলাম। আপোকে বোকা বানিয়েছি।’ বলেই ইঁদুরের মতো দাঁত বের করে হাসতে লাগল।
মাহাথির স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ‘ আমি বাবা হচ্ছি হামিম। আর তুমি মামা। আমিতো অনেক খুশি কিন্তু তোমার ফিলিংস কেমন?’
‘ মামা কেমন করে হয়? বলো বলো?’ কণ্ঠে দুষ্টুমি।
মাহাথির হাসল। বুঝল হামিম এখন দুষ্টুমির মুডে আছে। বলল, ‘ তোমার আপোর পেট থেকে ছোট্ট একটা বাচ্চা বের হবে। সেই বাচ্চাটা তোমাকে মামা বলে ডাকবে। বুঝেছো?’
হামিমকে তেমন উৎফুল্ল দেখা গেল না। সে বিজ্ঞ, কৌতূহলী কণ্ঠে বলল, ‘ টম এন্ড জেরিতে যেমন ছোট ছোট মুরগির বাচ্চা পানিতে বড় মুরগির পিছনে ঘুরে তেমন করে কী আপোর বাচ্চাও আপোর পিছনে ঘুরবে?’
হামিমের এমন কথায় মাহাথির হালকা ভড়কে গেল। কীসের মধ্যে কী আনলো ছেলেটা? তবুও বলল, ‘ হ্যাঁ, যখন হাঁটা শিখবে তখন ঘুরবে।’
হামিমকে এইবার একটু খুশি হতে দেখা গেল। অবাকের সাথে খুশি মিশিয়ে বলল,
‘ আপোর পেট থেকে তারমানে মুরগির বাচ্চা বের হবে? ওয়াওওও!’

হামিমের মুখভঙ্গি দেখে না হেসে পারল না মাহাথির। সাথে নিজের ভাবকে বজায় রাখতে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘ হ্যাঁ মুরগির বাচ্চা বের হবে। আর সেই মুরগির বাচ্চাটা আমার। আমি দিয়েছি তোমার আপোর পেটে। তাই সব ক্রেডিট আমার।’

হামিমের খুশি এবার আকাশ ছুঁলো। বলল,
‘ আমার পেটেও একটা মুরগির বাচ্চা এনে দেও প্লিজ প্লিজ প্লিজ!’
হামিমের এমন কথায় হতবিহ্বল হয়ে পড়ল মাহাথির। বলে কী এই ছেলে! মাহাথিরের মনে হলো তার এইখানে আসা ভুল হয়েছে। এর থেকে সে যদি ঘরে বসে বিভার রাগ ঝাড়া শুনতো তাও ভালো ছিল। ভাগ্য ভালো ঘরে কেউ নেই। নয়তো মান-ইজ্জত আর কিছু অবশিষ্ট থাকতো না। মাহাথির সিদ্ধান্ত নিল উঠে পড়বে। তা হতে পারল না। তার আগেই হামিমের অনুরোধ কানে এলো, ‘ মুরগি না। হাতির বাচ্চা দেও আমার পেটে। ছোট্ট হাতির বাচ্চা। এইটুকু। অনেকগুলা দিবে কিন্তু।’
হাতের দুই আঙুল দিয়ে দেখাল হামিম। মাহাথির মাথা চুলকাতে লাগল। নিজে থেকে এতো বাড়াবাড়ি করে বলতে কে বলেছিল? এখন একে বুঝাবে কীভাবে? গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ‘ তোমাকে না ওইদিন হাতি এনে দিলাম?’
‘ ওইটা কথা বলেনা। নড়চড় করেনা। আমার নড়চড় করা হাতি লাগবে যেটা আমার পিছন পিছন ঘুরবে।’
মাহাথির করুণ দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল তার শালার দিকে। তার আশেপাশের সবাই তার ওপর এমন নির্যাতন করে কেন?

.
পার্থিব ঠোঁটে হালকা হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে শ্রুতির দিকে। সেই সন্ধ্যা থেকেই হাসছে মেয়েটা। এখনো কী সুন্দর হাসছে! ঠোঁটে হাসি রেখেই তাকিয়ে আছে নীলাম্বরের দিকে।
শ্রুতি নিজের উপচে পড়া খুশি কণ্ঠে মেখে প্রশ্ন ছুঁড়ল, ‘ আপনার কেমন লাগছে খবরটা শুনে?’
পার্থিব ঠোঁটে হাসি রেখেই কপাল চুলকাল। মুখভঙ্গির অর্থ – আর কতোবার একপ্রশ্ন জিগ্যেস করবে এই মেয়ে।

‘ আর কতোবার বললে আপনি বিশ্বাস করবেন যে আমি খুশি?’ পার্থিবের ঠোঁটে প্রশয়ের হাসি।
শ্রুরি চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল। বলল,
‘ এরমানে আপনি খুশি না। খুশি থাকলে আমি একশোবার প্রশ্ন করলেও আপনি কিছু বলতেন না।’
পার্থিব দমে গেল। কিছু বলল না। বলা মানেই দশ নাম্বার বিপদ সংকেত। এরা বউমানুষ। এদের কোনো ভুল হয়না। ভুল হতেই পারেনা। পার্থিব আর নিজের বউকে রাগাল না। এগিয়ে গেল। শ্রুতিকে জড়িয়ে ধরল। নিজের থুতনি শ্রুতির কপালে ঠেকিয়ে বলল,
‘ কে বলল আমি খুশি না? আপার বাচ্চা হবে আর আমি খুশি হবোনা? আমি খুশি শ্রুতি। ভীষণ খুশি। হিমেল ভাইয়ার বাবুকে পেয়ে যেমন আপনি-আমি খুশি। একইরকম বিভা আপার বাবুর সংবাদ শুনে আমি একইভাবে খুশি। ঠিক করেছি, আপার বাচ্চাকে ‘ছোটআব্বু’ বলা শেখাবো। কেমন হবে?’
পার্থিবের কথায় যেন শ্রুতির খুশি বাড়ল বহুগুণ। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে না আনতে পেরে সামান্য জোড়ে বলে উঠল, ‘ দারুণ হবে। আমাকে ছোটআম্মু বলবে।’

শ্রুতির হাসোজ্জ্বল মুখের দিকে চেয়ে পার্থিব বলল, ‘ মাহাথির ভাইয়ার বাচ্চার সাথে আমার বাচ্চার বিয়ে দিব। এটা কেমন হবে?’
পার্থিবের ধারণা ছিল শ্রুতি হালকা হলেও লজ্জা পাবে। তবে শ্রুতি লজ্জা শব্দের ধারকাছ দিয়েও গেলনা। দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বলে উঠল, ‘ এইটা দারুণের ওপর দারুণ হবে। তবে আপার কী বাচ্চা হবে সেটাতো আমি জানিনা।’
‘ আপার মেয়ে হবে দেইখেন।’
‘ আচ্ছা যেটাই হোক। আপার বাবু হওয়ার পরে আমরা বাবু নেব। আর আপার বাবু যদি মেয়ে হয় আমাদের টা ছেলে হবে। আর তাদেরটা যদি ছেলে হয় আমাদেরটা মেয়ে হবে। ওকে?’
শ্রুতি এমনভাবে কথা বলল যেন ওরা যা বলছে ঠিক তেমনভাবেই সব হবে। এমন কথায় পার্থিবের ভীষণ মায়া হলো এই মেয়েটার প্রতি। কী সরল কণ্ঠে কথা বলছে! যতো দেখে ততোই আটকে যায়। পার্থিব শ্রুতির দুই হাতের আঁজলায় চুমু খেয়ে বলল, ‘ ওকে।’
পার্থিব শ্রুতির আঁজলায় মুখ ডুবিয়ে আছে। শ্রুতি মুখ এগিয়ে নিয়ে পার্থিবের কপালে চুমু খেল। ভীষণ যত্ন নিয়ে।

.
মহান আল্লাহ তা’য়ালা পৃথিবীকে কী সুন্দর করেই না সৃষ্টি করেছে। এই যে কী সুন্দর সৃষ্টিকতার নিয়মে পৃথিবীর পরিবর্তন ঘটছে। সকাল বেলা যে আসমান জুড়ে লালাভ তীক্ষ্ণ রশ্মি বিরাজ করে, রাতের আঁধারেই সেই আসমান জুড়ে থাকে লক্ষকোটি নক্ষত্র। দেখা যায় উজ্জ্বল একটি উপগ্রহকে। যার পরিচিতি চাঁদ, চন্দ্র, বিধু, নিশাপতি, নিশাকর, রজনীকান্ত, ইন্দু, সুধাংশসহ আরোও কতো নামে যে আছে কে জানে!
নিশাকরের হলদেটে আলো বারান্দার দরজা গলিয়ে রুমে প্রবেশ করছে। সেদিকেই একমনে তাকিয়ে আছে মাহাথির। ঘুম আসছেনা। তখন অনেক কষ্টে হামিমকে থামিয়ে ঘুম পারিয়ে রেখে এসেছে।
মাহাথিরের মনে হলো এখন তাকে যদি কেউ যত্ন নিয়ে ঘুম পারাতো তাহলে বোধয় ঘুম চোখে ধরা দিত। উঁহু। কথাটা ভুল হলো। যে কেউ নয়। কেবল বিভা। বিভা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেই তার ঘুম হবে। কিন্তু বিভা কী তা করবে? মাহাথির পাশ ফিরল। বিভা ওদিক হয়ে ঘুমিয়ে আছে। মাহাথির বিভার হাত টেনে ধীরে ধীরে সোজা করল। দৃষ্টি নিল পেটের দিকে। স্বাভাবিক এর তুলনায় হালকা ফুলে আছে পেট। মাহাথিরের কাছে বিভার ফোলা পেটটাও ভীষণ ভালো লাগল। তবে সে আগে কেন লক্ষ্য করল না? তাহলে তার বাচ্চার খবর সে আগে জানতে পারতো। অন্যের মুখ থেকে জানতে হতোনা। অন্যদের ওপর ভীষণ হিংসা হচ্ছে। তার বাচ্চার খবর কিনা সে শোনে অন্যদের মুখ থেকে? ভ্রু কুঁচকে বিভার দিকে তাকাল। সব দোষ এর। অসভ্য মেয়ে একটা। বিভার দিকে তাকিয়েই নিজের মন পরিবর্তন করল মাহাথির। না, বিভা অসভ্য নয়। ও ওর সন্তানের মা। এইবার মাহাথির বিভাকে আবারো বকার চেষ্টা করল। মনে মনে ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, মাহাথিরের সন্তানের মা একটা! মাহাথির আনমনে মলিন হেসে দিল। কী যে বলছে সে এইসব! পাগল-টাগল হয়ে গেল নাকি? মাহাথির এগিয়ে গিয়ে বিভার পেটে মাথা রাখল। একবার তাকিয়ে দেখে নিল বিভার মুখ। ঘুমোচ্ছে। ঘুমোক বা জেগে উঠুক, তার কী! সে তো এখানেই শোবে। মাহাথির বিভার পেটে চুমু খেল। মিনমিন কণ্ঠে বলল, ‘ তুমি অন্তত বাবার ওপর রাগ করোনা।’

বিভা হাত মাহাথিরের চুলে রাখতে গিয়েও থেমে গেল। এমনিতেই ঘুম পাতলা তার। তার ওপর তখন মাহাথির যেভাবে টেনেছে যে কারোর ঘুম ভেঙে যাবে। বিভার চোখ বন্ধ করে রাখতে গিয়েও পারল না। পিটপিট করে চেয়ে রইল সিলিং ফ্যানের দিকে। ঘুমের ভাণ ধরা এতো কঠিন! বাবাগো! বিভা লক্ষ্য করল না, তার অবচেতনেই তার মুখে হাসি ফুটেছে।
_______
চলবে~

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

৪১.
মাহাথির তার জীবনে খুব বেশি লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়েনি। তবে আজ তার লজ্জা লাগছে। ভীষণ রকমের লজ্জায়, অস্বস্তিতে উশখুশ করছে সে। চাপা স্বভাবের হওয়ায় আগে এইভাবে কোথাও আসা হয়নি। তাই স্বস্তি পাচ্ছেনা। মনে হলো সে এখানে আগ বাড়িয়ে না এলেও পারতো। আবার মনে হলো, না! এসেছে ভালো করেছে। তার সন্তান হবে এইটাতো খুশির খবর। খুশির খবরে লজ্জা কীসের? সে তো এসেছে নিজের উৎফুল্লতা, খুশিকে ভাগ করতে। আত্মীয় বাড়ি বলতে তো এইটাই। তবে বিভাকে বলেনি যে সে এসেছে। জানলে নিশ্চয়ই খুশি হবে মেয়েটা।

পার্থিব-শ্রুতিও মাহাথিরকে সকাল সকাল আশা করেনি। বাড়ির ড্রইংরুমে বসে আছে সবাই। সামনের টেবিলে সাত-আট কেজি মিষ্টি। তানহা, রুমা, আসাদ, নিয়াজ, হিমেল, হিয়া সবাই ভীষণ খুশি হয়েছে মাহাথিরের এমন আন্তরিকতায়। অভিনন্দন জানিয়েছে মাহাথিরকে। মাহাথির এসেছে অনেকক্ষণ হয়। এখ যাওয়ার সময়। সে উঠে দাঁড়াল। বিনয়ী হয়ে বলল, ‘ এখন যেতে হবে আমার। সকাল সকাল সর্বপ্রথম আপনাদের বাড়িতেই এসেছি। এখন অফিসে যাব। নয়তো সমস্যায় পড়তে হবে।’

মাহাথিরের এমন কথায় কেউ তাকে আর বারণ করল না। মাহাথির তার বাসায় সবাইকে যাওয়ার নিমন্ত্রণ জানাল। তানহা বেগম এগিয়ে এসে আদর কণ্ঠে বলল, ‘ আবার এসো বাবা কেমন? বিভাকে নিয়ে এসো। ওকে সাবধানে থাকতে বলো। বেশি কাজ করতে দিও না। আল্লাহ তোমাদের সংসারে রহমত দিক।’
মাহাথির ভদ্রভাবে বিদায় নিল। যাওয়ার আগে পার্থিব-শ্রুতির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ তোমরা চলে এসো। বিভা খুশি হবে।’

পার্থিব হাসির সাথে মাথা নেড়ে সায় জানাল। শ্রুতি বলে বসল, ‘ আমরা তো আজই যাব।’
মাহাথির সুন্দর হেসে বলল, ‘ এসো। খুশি হবো আমি।’

.
আজ অনেক দিন পর পার্থিব-শ্রুতি এলো। পার্থিব-শ্রুতি দু’জনে এসেছে। শ্রুতি দৌড়ে ওপরে উঠতে গেলে প্লাজুতে বেঝে পড়ে যেতে নিল। পার্থিব তড়িঘড়ি করে হাতের কবজি ধরে শাসালো, ‘ আস্তে শ্রুতি!’
পার্থিব শ্রুতির হাত ছাড়ল না। গাড়ি থেকে কিছু ফল-মিষ্টসহ ব্যাগ একহাতে বের করে অন্যহাতে শ্রুতির হাত ধরে বলল, ‘ চলুন।’

‘ এতোকিছু কেন এনেছো পার্থিব? কী দরকার ছিল?’ বিভার এমন কথায় পার্থিব বলল, ‘ অবশ্যই দরকার ছিল, আপা। আফটার অল ছোটআব্বু হচ্ছি। মিষ্টি খাওয়াব না? তবে আপনি এখনো আমাকে কংগ্রেস জানাননি। আপনি কী আমার ছোটআব্বু হওয়ার সংবাদে খুশি নন?’
পার্থিবের এমন কথায় সবাই সুন্দরকরে হেসে ফেলল। মাহাথিরও আছে বাসায়। আজ সে অফিস থেকে দ্রুতই ছুটি নিয়ে চলে এসেছে। পার্থিব বলল, ‘ আপনারা এখানে থাকুন। আমি ঘর থেকে হামিমকে নিয়ে আসি। বেচারা একা কী যে করছে!’

পার্থিব ঘরে ঢুকে দেখল হামিম বিছানায় বসে আছে। চারপাশে হাতি, ঘোড়া, মাছ সব ছড়ানো। পার্থিব সামনে এগিয়ে বলল,
‘ দিনকাল কেমন চলছে হামিম শিকদার?’
হামিম চোখ তুলে তাকাল। শান্তকণ্ঠে বলল,
‘ তুমি এতোদিন কই ছিলে?’
‘ ছিলাম কোথাও। বুকে এখনো ব্যথা করে? খারাপ লাগে? পায়ের অবস্থা কী?’
‘ না ব্যথা করেনা কোথাও। আমি একদম ভালো আছি।’
‘ গুড। চলেন। বাইরে যাই।’
হামিম দুই হাত বাড়িয়ে দিল। পার্থিব বুঝে হাসিমুখে কোলে তুলে নিল তার আটবছরের একমাত্র শালাকে। শরীরের দিক থেকে মাঝারি গড়নের হামিম। কোলে ওঠে একহাতে গলা আগলে ধরল নিজের ছোট দুলাভাইয়ের।

পার্থিব হামিমকে এনে বসাল সোফায়। হামিমের পাশেই মাহাথির। পার্থিবও বসল পাশের সিংগেল সোফায়।
শ্রুতি তার আপার দিকে তাকাল। একহাতে জড়িয়ে ধরে আছে বিভাকে। বলল,
‘ আমি যে কতো খুশি তোকে বোঝাতে পারব না, আপা। আজ আম্মুর কথা ভীষণ মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে আম্মু থাকলে কতো খুশি হতো। তোকে কতো আদর দিতো! দাদীও দেখতি কতো খুশি হতো। কিন্তু কেউ নেই।’
বিভার হাসিমুখ মলিন হলো। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মন খারাপ তো তারও হচ্ছে। তবে সেও যদি এখন মন খারাপ করে তাহলে শ্রুতির আরোও মন খারাপ হবে। শ্রুতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল বিভা। ভীষণ যত্ন, অভিজ্ঞ কণ্ঠে বলল, ‘ আম্মু, দাদী থাকলে তো কতোকিছুই হতো শ্রুতি। কিন্তু নেই। কী করার! আমরা যারা আছি তাদের নিয়েই চলতে হবে। যারা নেই তাদের কথা ভেবে জীবন থামিয়ে দিলে চলবে? তুই আছিস, হামিম আছে, বাকিসবাই আছে। এভাবে মন খারাপ করেনা। হুম?’
শ্রুতি তার আপার কথা মেনে নিয়ে বিভার কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে রাখল।

সবাই নিজেদের মতো গল্প করতে লাগল। শ্রুতি হঠাৎ করে বলল, ‘ আপা, নাম ঠিক করেছিস? তুই ছেলে হলে খুশি হবি নাকি মেয়ে হলে?’
মাহাথিরও তাকাল বিভার দিকে। বিভা কিছু বলতে নিবে তার আগেই হামিম বাঁধা দিয়ে দিল, ‘ ছেলে-মেয়ে কিছু হবেনা। মুরগি হবে আপোর পেটে।’
কেউ কিছুই বুঝল না। হামিম নিজের মতো খেলনা নাড়াতে নাড়াতে মাহাথিরের দিকে তাকাল। বলল, ‘ তুমি না বলেছিলে সকাল হলে আমার পেটে হাতি দিবে। কোথায়? দাও?’
‘ তোমার পেটে হাতি দিবে মানে?’ শ্রুতির প্রশ্নে মাহাথির উঠে পড়ল। সাথে সাথে দুই হাত দিয়ে হামিমকে এক কোলে তুলে নিল। হালকা ভড়কে যাওয়া কণ্ঠে বলল,
‘ কিছু না। কিছু না। বলেছিলাম খেলনা কিনে দিব তাই কাঁদছে। তোমরা থাকো আমি আর হামিম বাইরে থেকে ঘুরে আসি। পার্থিব, যাবে তুমি?’
পার্থিবও জড় বস্তুর মতো মাথা নাড়ল। বলল, ‘ চলেন ভাইয়া। ঘুরে আসি।’
মাহাথির মাথা নেড়ে হামিমকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। পিছু পিছু গেল পার্থিবও। কেউই বুঝল না ব্যাপারটা ঘোরার নয়। মাহাথির নিজের ইজ্জত বাঁচানোর চেষ্টা করেছে মাত্র।

.
পার্থিব-শ্রুতি চলে গেছে অনেকক্ষণ হয়। এসেছিল দুপুরের দিকে। গেল রাত সাড়ে ৯ টার দিকে। যাওয়ার সময় হামিমকেও নিয়ে গেছে। বিভা নিজেই এখন অসুস্থ। সেখানে হামিমকে খাওয়ানো, গোসল করানো, ঔষধ দেওয়া, পায়ের ব্যায়াম করানো ওর ওপর জুলুম হয়ে যাবে। তাছাড়া ছিল তো অনেকদিন। এখন নাহয় শ্রুতি-পার্থিবের কাছেই থাকুক।
মাহাথির এসে বসল বিভার পাশে। বিভার হাতে হাত রেখে ইতস্ততভাবে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল,
‘ তুমি খুশি তো বিভা?’
‘ বুঝতে পারছিনা খুশি কিনা। হয়তো খুশি। হয়তো না।’
মাহাথির আশাহত হলো। বিভার চুলে হাত বুলিয়ে বলল, ‘ আমার রাগ বাচ্চার ওপর দেখাচ্ছো?’
‘ আপনার ওপর কোনো রাগ নেই আমার।’
‘ রাগ না থাকলেও অভিমান আছে।’
‘ কিছুই নেই মাহথির।’
মাহাথির হাঁটু গেড়ে নিচে বসল। বিভার দুই হাত মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘ প্লিজ এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিওনা। আই এম সরি। আমার করা সব কাজের জন্য ক্ষমা চাচ্ছি আমি। প্লিজ ক্ষমা করে দাও।’
‘ করলাম ক্ষমা। এইবার উঠুন।’
‘ না, তুমি করোনি ক্ষমা। বিভা প্লিজ! আমি বুঝতে পেরেছি আমার অন্যায়টা। এইভাবে নিজেকে দূরে রেখে শাস্তি দিওনা।’
‘ ভালো লাগছেনা মাহাথির। আমি ঘুমাব।’

মাহাথিরের রাগ হচ্ছে, জেদ চাপছে। অনেক কষ্টে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখছে। জানেনা নিজেকে আদৌও ঠিক রাখতে পারবে কিনা। তবে সে দোষও কম করেনি। আট মাসের প্রতিটা দিন একটা মানুষকে সে অবহেলা, অপমান করেছে। তার কোনো শাস্তি হবেনা? তার শাস্তি তো পাবেই সে। মাহাথির হাপ ছেড়ে উঠে পড়ল। বিভার গায়ে কাঁথা জড়িয়ে কপালে চুমু খেল। বিভাকে অবাক করে দিয়ে ঠোঁটেও চুমু খেয়ে সরে এলো। বলল, ‘ আমি জানি তুমি খুশি বিভা। তোমার মুখ একটু হলেও পড়তে পারি আমি। তোমার মুখের উজ্জ্বলতা তোমার খুশির প্রমাণ। আমিও খুশি। অনেক খুশি। অথচ নিজের খুশিটা প্রকাশ করতে পারছিনা। জানিনা কীভাবে প্রকাশ করতে হয়। তোমাকে থ্যাংকিউ এতো সুন্দর অনুভূতির সাথে আমাকে পরিচয় করানোর জন্য। তোমাকে থ্যাংকিউ আমার বুকের সূক্ষ্ম ব্যথার কারণ হওয়ার জন্য।’

.
পেরিয়ে গেছে দেড়মাসের মতো। কিছুদিন পরই বিভার ছয়মাস পড়বে। আগের তুলনায় স্বাস্থ্য ভারী হয়েছে। গালের মাংস বৃদ্ধি পেয়েছে। এক নতুন বিভার সৃষ্টি হয়েছে। যেখানে আছে নারীত্বের সৌন্দর্য, মাতৃত্বের সৌন্দর্য।

‘ মাহাথির বাবা হবে’ – তিন শব্দের কথাটা হালকা মনে হলেও এর মাঝে লুকিয়ে আছে বহু দায়িত্ব, কর্তব্য, অধিকার, ভালোবাসা, শাসনের সংমিশ্রণ। যার প্রকাশ ঘটবে তার সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পরে। তবে ভূমিষ্ট হওয়ার আগে কোনো দায়িত্ব নেই – ব্যাপারটা তেমনও নয়। তাইতো তার মধ্যে এসেছে বিশাল পরিবর্তন। সে এখন প্রতিদিন সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে ওঠে। ঘুম থেকে ওঠেই সে নিজে ঘর-বাড়ি ঝাড়ু দেয়। নিজে হাতে লাঠি জাতীয় বস্তু দিয়ে ঘর মোছা দিয়ে এরপর মায়ের হাতের রান্না করা খাবার খেয়ে অফিসে যায়। বিভার পাঁচমাস সম্পূর্ণ হওয়ার পর থেকেই তাকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেয়না মাহাথির। হাসিনাও নিজের ছেলের কথাই মান্য করে বিভার থেকে রান্নার দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে।
মাহাথির ঘর-বাড়ি ঝাড়ু দিচ্ছে ব্যাপারটা প্রথম প্রথম তার কাছে লজ্জা না লাগলেও অস্বস্তি লাগতো। কারণ মা কিংবা বিভা দেখে ফেলে যদি লজ্জা দেয় তখন কী হবে? তাই সে সকাল পাঁচটার এলার্ম দিয়ে সকাল সকাল উঠে পড়তো যাতে কারো চোখে তার কাজ না পড়ে। তবে এতো সকালে উঠা সম্ভব হয়ে ওঠেনা। তাইতো একটু পরে উঠেই নিজের কাজ সম্পূর্ণ করে সে। কাজটা সে করে ভীষণ ভালোবেসে। বিভা ঘর ঝাড়ু-মোছা দিতে গেলে উপুর হয়ে দিতে হবে। কোমরে চাপ পড়বে। কষ্ট হবে। কী দরকার? এর থেকে সেই নাহয় একটু কষ্ট করুক। তাছাড়া মধ্যবিত্ত পরিবার তার। শুধু শুধু এই কাজের জন্য কাজের বুয়া রাখলে দুই হাজার টাকা দিতে হবে। দুই হাজার টাকা কী কম? আম্মা যে করবে তাতেও মন সায় দেয়না। সব মিলিয়ে দায়িত্বটা নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছে সে। এছাড়া বিভার দেখভাল করা তো আছেই।

মাহাথির অফিসে বসে ভাবল আর একমাস পরেই সে ছুটির আবেদন করবে। তখন বিভার সাড়ে সাত/ আটমাস হবে। তখন মাহাথিরকে বিভার বেশি প্রয়োজন পড়বে। মাহাথির আনাসের টেবিলের দিকে তাকাল। আনাস বেশ দীর্ঘ একটা ছুটি কাটাচ্ছে। অবশ্য ঘুষ দিয়ে হলে সেও দীর্ঘ ছুটি কাটাতে পারবে। আনাসের মেয়ে হয়েছে জানা গেছে। মাহাথিরও তার সংবাদ জানালে আনাস অনেক খুশি হয়। অভিনন্দন জানায়। আরোও জানিয়েছে আনাসের বউ সুস্থ হলেই একবার বাসায় এসে দেখা করে যাবে।

মাহাথির বিভাকে কল করল।
‘ হ্যালো।’
‘ খেয়েছো তুমি?’
‘ হ্যাঁ খেলাম মাত্র ।’
‘ আমিও খেয়ে নিয়েছি। সাবধানে থেকো কেমন? কিছু লাগলে আম্মাকে বোলো। পাকনামি করার দরকার নেই। আর ভুলেও কিন্তু আমার রাগ বাচ্চার ওপর দেখাবা না। ওর সাথে সবসময় হাসিখুশি থাকবা। নয়তো ভয় পাবে ও।’
বিভা ভ্রু কুঁচকে মাহাথিরের কথা শুনল। মাহাথির প্রায়ই এখন এমন উল্টোপাল্টা কথা বলে যার কোনো ভিত্তি’ই বিভা খুঁজে পায়না। অথচ মাহাথির এমন কণ্ঠে বলে মনে হয় যেন বাচ্চা বিভার পেটে নয়, পেট থেকে বেরিয়ে এসেছে কোলে।
‘ আচ্ছা।’
‘ কিছু খেতে ইচ্ছে করে? আসার সময় নিয়ে আসব?’
‘ না।’
‘ সাবধানে থেকো।’
বিভা ইতস্তত করে বলল, ‘ আমার জামাকাপড়….’
শেষ করতে পারল না কথাটা। তার আগেই মাহাথির বলল, ‘ আমি ধুঁয়েছি। কোনো সমস্যা?’
মাহাথিরের এমন গম্ভীর, শান্ত কথার পিছে কিছু বলতে পারল না বিভা। উত্তর দিল,
‘ না।’
‘ গুড। ঘুমাও। আমি আসলে ব্যায়াম করবে। এখন রাখি ফোন। কাজ আছে অনেক।’

বিভা তাকিয়ে রইল ফোনের দিকে। অদ্ভূত লোক! নিজে থেকেই ফোন দিবে, ফোন দিয়ে জ্ঞান ঝাড়বে, এরপর কাজ দেখিয়ে রেখে দিবে। কোনো মানে হয় এসবের! বিভা নিজের পেটের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ তোমার আব্বুকে বলো ভালো হতে। বুঝেছো? নয়তো এই খারাপ লোকের সংসার আমি করবনা।’ অজানা রাগে শরীর রি রি করে উঠল বিভার।

.
গভীর রাত। থেকে থেকে কুকুরের কর্কশ কণ্ঠের ডাক শোনা যাচ্ছে।
বিভার ঘুম হঠাৎ করেই ভেঙে গেল। শরীরে যন্ত্রণা অনুভব করে উঠে বসল নিজ থেকে। পিঠে ব্যথা হচ্ছে। পিঠের যন্ত্রণা ক্রমশ নিচের দিকে যাচ্ছে। শরীর অবশ হয়ে আসছে। বিভা জানে ছয়মাসে এমন হয়। স্বাভাবিক। তবুও যেন সহ্য হচ্ছেনা। মুখ থেকে ব্যথার অস্পষ্ট আওয়াজ বের হতে লাগল। মাহাথির শুয়ে ছিল বিভার দিকে ঘুরেই। বিভার পেটে হাত রেখে। ঘুমের মধ্যে মাহাথিরের কেমন যেন লাগল। হাত দিয়ে বিভাকে পেল না। কানে গেল অস্পষ্ট আওয়াজ। চোখ খুলে বিভাকে এইভাবে বসে থাকতে দেখে ঘুম চোখ থেকে একদম সড়ে গেল। উঠে বসল মাহাথির। বিভার চোখের পানি তার চিন্তা বাড়িয়ে দিল। উদ্বিগ্ন, উতলা কণ্ঠে বলল,
‘ কী হয়েছে বিভা? কোথায় যন্ত্রণা হচ্ছে?’

বিভা মাহাথিরকে বলতে চাইল না। হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলে মাহাথির আবারো প্রশ্ন করল। বিভা উত্তর না দিয়ে কুঁকড়ে গেল। মাহাথির এবার নিজের রাগ সামলাতে পারল না, চেষ্টাও করল না। ধমক দিল,
‘ রাগ তুলোনা বিভা। আমাকে বলো কোথায় কষ্ট হচ্ছে? না বললে বুঝব কীভাবে?’
ধমক খেয়ে ভীষণ মন খারাপ হলো বিভার। হঠাৎ করেই। মিনমিন কণ্ঠে বলল, ‘ পিঠে।’
মাহাথির তাড়াতাড়ি বিভার পিঠে মালিশ করতে লাগল। হাত দিয়ে মালিশ করে দিতে থাকল। এতে যদি যন্ত্রণা কমে। মিনিট পনেরো পরে বিভার কান্না থামল। মাহাথির তবুও চিন্তামুক্ত হতে পারল না। গুগলে সার্চ করলো এমন ব্যাথায় করণীয় কী। সমাধান পেয়ে সেই মোতাবেক বিভার পায়ের নিচে বালিশ রেখে দিল। বিভাকে শুতে বললে বিভা শুলো না। কাতর কণ্ঠে বলল,
‘ শুলে বেশি ব্যথা করবে।’
মাহাথির আর জোড় করল না। নিজে বিভার পেছনে গিয়ে বিভাকে টেনে নিল বুকে। অর্ধশোয়া হয়ে রইল বিভাকে নিয়ে। বিভাকে প্রশ্ন করল, ‘ এভাবে কষ্ট হচ্ছে?’
বিভা ‘না’ বোধক উত্তর দিল। ভীষণ আরামে সে পরে রইল স্বামীর বুকে। মাহাথির বিভাকে এক হাতে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। এভাবেই পার হয়ে গেল বাকি রাত।
______
চলবে~
শব্দসংখ্যা – ১৭৯৬
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

৪২.
মাঝেমধ্যে নিজেদের কিছু কাজে নিজের কাছেই নিজেকে বড্ড বোকা মনে হয়। মনে হয় যে, এই বোকামোটা আমি করলাম কীভাবে? এইটা তো খুব সাধারণ একটা বিষয়। আমি আগে কেন বুঝতে পারলাম না? বিভার ভাবনাতেও নিজের প্রতি অনুভূতিটা কিছুটা এরকমই। অলস সময়ে সে নিজেকে নিয়ে ভাবনায় মত্ত ছিল। তখন হঠাৎ করেই মনে হলো প্রেগন্যান্সির ব্যাপারে তার এমন খামখেয়ালি করা উচিত হয়নি। চারমাস পেরিয়ে গেছে অথচ সে জানলোই না যে, সে প্রেগন্যান্ট? সাধারণ লক্ষণ থেকেও তো বুঝা যায়। মেয়েদের শরীরে অতি সাধারণ কিছু ব্যাপার ঘটে থাকে প্রতি মাসে। বিভা সেখান থেকেও বুঝতে পারল না? এরকম না বুঝতে পারার চক্করে পরে যদি বাচ্চাটার কোনো ক্ষতি হয়ে যেত? নিজের অবচেতনেই বুকটা ধ্বক করে উঠল। হাতটা পেটে রেখে ভাবল – সৃষ্টিকর্তা যা করেন ভালোর জন্যই করেন; তাইতো বিভা সময় থাকতে জেনে গিয়েছে। বাচ্চাটার খেয়াল রাখতে পারছে।

বিভা সামনে তাকিয়ে দেখল মাহাথির ছোট কাঠের টেবিলের ওপর প্লেট রেখে, নিজে চেয়ারে বসে ভীষণ মনোযোগের সাথে আপেল ছুলছে। যেন এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে নেই। কপালের ভাঁজে কী লোকটাকে বেশি সুন্দর লাগছে? বিভা নিজের লাগায় লাগাম টানল। কিছুক্ষণ বাদেই মাহাথির উঠে এলো প্লেট নিয়ে। বিভার সামনে রেখে বলল,
‘ আপাতত এটা খেয়ে নাও নাস্তা হিসেবে। কিছুক্ষণ পর আবার অন্য কিছু কেটে দিব।’

বিভা আচানক প্রশ্ন করে বসল,
‘ এতো কষ্ট কেন করছেন?’

মাহাথির বিভার চোখে চোখ রেখে উত্তর দিল, ‘ কোথায় কষ্ট করছি?’

‘ এই যে অফিস থেকে এসে রেস্ট নেওয়া বাদ দিয়ে গোসল সেরেই ফল কাটতে বসেছেন। এইটা কষ্ট না? আগে তো অফিস থেকে ফিরে টুকটাক খাবার খেয়ে রেস্ট করতেন। এমন পরিবর্তনের কারণ কী? এতো পরিবর্তন কেন হলেন?’

‘ পরিবর্তন তো তুমিও হয়েছো বিভা। আমি কিছু বলেছি সেই নিয়ে? আমি তোমার পরিবর্তনকে এক্সেপ্ট করে নিয়েছি। তুমি কেন করছোনা?’

বিভা দমল না। ব্যাকুল কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
‘ কী জন্য পরিবর্তন হলেন মাহথির? আমি তো সুন্দর হয়ে যাইনি। এমনও নয় রুপ-লাবণ্য বেড়ে গিয়েছে। উলটো আগে কালো ছিলাম, এখন মোটা হয়ে গেছি। গাল ফুলে গেছে। চুল পরছে। আরোও জঘন্য হয়ে যাচ্ছি। কালো আমিকেই আপনি মানতে পারতেন না, তাহলে এই আমিকে মানার চেষ্টা কেন করছেন?’

মাহাথির নিশ্চুপ হয়ে চেয়ে রইল বিভার দিকে। এই প্রশ্নের উত্তর সে কী দেবে? সে এতো জঘন্যরকমের কাজ করেছে কীভাবে? বিভা বুঝি সারাজীবনই ওর করা নোংরা কাজগুলো নিয়ে ওকে ঠেস দিবে? কেন দিবে? বিভা কী বোঝেনা এতে ও নিজের কাছে নিজে কতোটা ছোট হয়ে যায়। কষ্ট দেওয়ার কী আর কোনো উপায় ছিলনা? মাহথির কেন গায়ের রঙ নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা উপায়টাই বেছে নিয়েছিল? মাহাথিরের মনে হলো সে যদি অতীতে গিয়ে নিজের করা ঘৃণ্য কাজ মুছে দিয়ে আসতে পারতো তবে বেশ হতো। সাথে বিভার মাথায় ঘোরা মূহুর্ত গুলোও মুছে দিতো। একদম অস্তিত্ব বিলীন যাকে বলে। মাহথিরের মনে হলো, পেন্সিল ভীষণ ভাগ্যবান একটি বস্তু। কারণ তার ভুল মোছার জন্য রাবার আছে। অথচ মানুষের ভুল মোছার জন্য এই এতোবড় পৃথিবীতে কিছুই নেই।
মাহাথির বিভা পাশে বসল। হাত উঠিয়ে বিভার বেরিয়ে পরা চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বলল,
‘ এখন আমি হাজার কিছু বললেও আমার বলে দেওয়া কথা ফিরিয়ে নিতে পারবনা। আর না ফিরিয়ে নিতে পারব তোমার পাওয়া কষ্টগুলো। তবুও এতোটুকু বলতে পারি, তুমি যেমন তেমনভাবেই তোমাকে ভালোবাসি বিভা। এই মোটা হয়ে যাওয়া, চুল পড়া তোমাকে আরোও সুন্দর করে দিচ্ছে। তোমাকে জঘন্য নয়, তোমার মধ্যে আমার সন্তানের মা, মা ভাব নিয়ে আসছে।’

বুক উঁচু করে বড় এক শ্বাস ছাড়ল মাহাথির। সাথে বলল, ‘ অনুভূতি খুব অদ্ভূত একটা ব্যাপার, বিভা। আগে অনুভূতি ছিলনা তাই তুমি রুপ-লাবণ্যে পরিপূর্ণ থাকলেও হয়তো তোমাকে মানতে পারতাম না। অন্য দোষ খুঁজে নিতাম। এখন অনুভূতি আছে। তাই এখন তুমি যেমনই হও না কেন তুমিই আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর নারী, আমার বউ, আমার মাহতিমের আম্মু।’

বিভা এতোক্ষণ যাবত মাহাথিরের হাতের দিকে তাকিয়ে ছিল। মাহাথিরের এমন কথায় চোখ তুলে মাহাথিরের চোখের মণিতে নিজের দৃষ্টি রাখল। বিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। মাথাটা ঘুরিয়ে উঠল। কেমন যেন গভীর চোখ মানুষটার। দৃষ্টিতে তাকালে মনে হয় সে হারিয়ে যাচ্ছে কোথাও। বিভা মাথা নিচু করে ফেলল।
মাহাথির বিছানা থেকে প্লেট তুলে বিভার হাতে দিয়ে বলল, ‘ খেয়ে নাও, নয়তো জোড় করে খাওয়াব।’

বিভা আপেলের দিকে তাকিয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে নিজের মুখ লটকে ফেলল। আপেলের চামড়ার সাথে মাংসও অর্ধেক ফেলে দিয়েছে এই লোক। বিভা বলল,
‘ আপনাকে আপেল ছুলতে কে বলেছিল? এমনিতেই খেতাম আমি। আপেলের চামড়ার সাথে আপেলের মাংসও ফেলে দিয়েছেন।’

মাহাথির আশ্চর্য হলো। বলল,
‘ তুমিই তো বললে আপেলের চামড়ার কারণে তোমার আপেল খেতে ভালো লাগেনা, তাই তো আমি পঁচিশ মিনিট লাগিয়ে ছুললাম দুইটা আপেল।’

‘ আমি বলেছি তাই আপনাকে ছুলতে হবে?’

মাহাথির হতবাক হয়ে চেয়ে রইল। বলার মতো কিছু পেলনা। মেয়েলী এমন সমস্যার সাথে সে পরিচিত নয়। ইদানীং মেয়েটা প্রায় সবসময়ই রণচণ্ডীরুপ ধারণ করে থাকে। মাহাথির যে কাজ সচরাচর করেনা, তাই করল। বলল, ‘ সরি। ছুলে ভুল হয়েছে।’

‘ সরি বলার মতো কী হলো এখানে? শুধু শুধু সরি কেন বলছেন আপনি? আমি বলেছি সরি বলতে? সরি শব্দটা এতোই সস্তা লাগে?’

মাহাথির এবার পলক ঝাপটে পরিস্থিতি বুঝতে চেষ্টা করল। হয়তো বুঝল না। বিভাকে বলল, ‘ আচ্ছা সরি। মানে.. সরি না। আরেহ! শুনো, রাগ করোনা তুমি। আমি ড্রইংরুম থেকে ল্যাপটপ আনতে যাচ্ছি। তুমি শান্তিতে খাও। আমি তোমাকে ডিস্টার্ব করবনা। একটু কাজ সেড়ে আসছি।’

মাহাথির উঠে পড়ল। দরজার সামনে গিয়ে বলল, ‘ আমি ল্যাপটপ টা নিয়ে ঘরেই ফিরব। তাই বেশি খুশি হওয়ার দরকার নেই। এসে যাতে দেখি খাওয়া স্টার্ট করেছো।’
মাহাথির চলে গেল। বিভা ভ্রু কুঁচকে মুখ লটকে আপেল মুখে পুরলো। ইদানীং ঝগড়া করার জন্য, কামড় দেওয়ার জন্য উশখুশ করে সে, দাঁত রি রি করে। নিজের উপর নিজেরই বিরক্তি চলে আসে। বিভা আপেল খেতে থাকল। হঠাৎ করেই মাথায় কিছুক্ষণ আগের মূহুর্ত ঘুরতেই মন খারাপ, বিরক্তি উড়ে গিয়ে সুন্দর অনুভূতিরা ভেসে উঠল। পানিতে থাকা স্বচ্ছ রঙের হাঁসের মতো ডানা ঝাপটাতে লাগল তার খুশিরা। তবে খুশি প্রকাশ করা যাবেনা। মাহাথির যখন তখন চলে আসতে পারে। বিভা হাঁটু উঁচু করে তাতে মুখ গুঁজল। মুখ গুঁজতেই ঠোঁট জুড়ে হাসি খেলে গেল। নিজমনেই উচ্চারণ করল, ‘ মাহতিম। আমার বাচ্চা।’
বিভার হাসি আরোও প্রসারিত হলো। চারপাশটা রঙিন হয়ে উঠল মূহুর্তের মধ্যে। তবে হঠাৎ করেই অন্য চিন্তা চলে এলো মস্তিষ্কে। ভ্রুতে ভাঁজ ফেলে ভাবল মাহাথির ছেলের নামই কেন ভেবেছে? মেয়েও তো হতে পারে। মেয়ের নাম ভাবেনি কেন? মেয়ে হলে কী রাখবে?
বিভা একটা অবুঝের মতো ভাবনা ভেবে ফেলল। সে ভাবল মেয়ে হলেও নাম রাখবে মাহতিম। ইউনিক নেম হবে। নামটা তার বেশ মনে ধরেছে। মেয়ের চিন্তায় আর আগালো না বিভা। আপাতত ছেলেকে নিয়েই ভাবল সে। বিভার ছেলে মাহতিম। উঁহু! বেশি ভালো শুনালো না। মাহথিরের ছেলে মাহতিম। ভাবতেই বিভার বুক বেয়ে নেমে গেল সুখের ঢল।

.
শ্রুতি রুমে এসে মুখ লটকে বলল, ‘ এখনো শেষ হয়নি কাজ?’
কণ্ঠে ঝরছে কাজের প্রতি একরাশ বিরক্তি। পার্থিব চোখ তুলে চেয়ে বলল, ‘ এখন কাজের একটু চাপ যাচ্ছে শ্রুতি। এই প্রজেক্ট টা কমপ্লিট হলে আবার সব স্বাভাবিক নিয়মে চলবে।’
শ্রুতি পাশে এসে বসল। পার্থিব শ্রুতিকে বলল, ‘ হামিম ঘুমিয়েছে?’
‘ হুম। ঘুমিয়েছে।’
‘ পায়ের অবস্থা কেমন? সকালবেলা ব্যায়াম করিয়েছিলাম। এরপর হাঁটার চেষ্টা করেছিল?’
‘ করেছিল। রক্তনালিতে টান লাগে। ব্যথা পায়।’
‘ চিন্তা করবেন না। ঠিক হয়ে যাবে। ব্যায়াম করতে করতে ঠিক হবে। মাত্রই অপারেশন হলো।’

এরপর চলল কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। শ্রুতি উশখুশ করে নিজের মনের চিন্তা মুখে এনে ফেলল, ‘ পার্থিব! আপনি কাজ করুন। আমি আপনাকে খাইয়ে দেই?’
পার্থিব নিজের হাত থামিয়ে চোখ তুলে চাইল। মুখভঙ্গির অর্থ – ‘সূর্য আজ কোনদিকে উঠল’ ধরনের। শ্রুতি ক্রুদ্ধ হয়ে বলল,
‘ এমন করে তাকিয়ে আছেন কেন? খাবেন নাকি খাবেননা?’

‘ অফার মিস করে লস করতে চাইছিনা।’

শ্রুতি মুখ কুঁচকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে উঠে গেল। শ্রুতির এমন মুখভঙ্গির সাথে পার্থিব পরিচিত। হেসে ফেলল।
পার্থিবকে চমকের ওপর রেখে সত্যিই শ্রুতি খাবার এনে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে লাগল। খাওয়ার সময় শ্রুতির মনে হলো খাইয়ে দেয়াও একটা আর্ট যা সবাই পারেনা। এই যেমন সে পারেনা। ছোটবেলায় তার আম্মু, বড়বেলায় দাদী, বিভা কতো সুন্দর করেই না তাকে খাইয়ে দিত। অথচ সে পার্থিবকে খাইয়ে দিতে গিয়ে ভাত মুখে ঢোকানোর বদলে আয়োজন করে আবার প্লেটেই ফেলে দিচ্ছে। শ্রুতি প্লেট রেখে বলল,
‘ আপনি নিজের হাতে খান।’
পার্থিব উতলা কণ্ঠে বলল, ‘ কেন? কী হলো?’
‘ আমি খাওয়াতে পারছিনা। সব বাইরে পরে যাচ্ছে পার্থিব।’ রাগ, হতাশায় গর্জে উঠল শ্রুতি। পার্থিব শ্বাস ফেলল। এই মেয়েটা এতো অধৈর্য! পার্থিব খাবারের প্লেট আবারো শ্রুতির হাতে দিয়ে বলল,
‘ এতো উল্টোপাল্টা কথা শুনছি না আমি। খাইয়ে দিন চুপচাপ। আপনার হাতে খেতে ভালো লাগছে আমার।’

‘ পারছিনা তো।’ শ্রুতির কণ্ঠ এমন যেন কেঁদে ফেলবে।

‘ আরেহ বাবা এখানে তো কোনো প্রতিযোগিতা চলছেনা। আর আমি কী আপনাকে কিছু বলেছি? বলেন, বলেছি আমি? চুপচাপ খাওয়ান। নয়তো ভীষণ রাগ করব আমি। আপনি চান আমি রাগ করি?’
পার্থিবের এমন কথায় শ্রুতি দমে গেল। শিশুদের মতো দুইপাশে মাথা নাড়ল। পার্থিব গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘ তবে খাইয়ে দিন।’
শ্রুতি খাওয়াতে লাগল। মুখটা চুপসে আছে। পার্থিব মুচকি হেসে কাজ করতে লাগল। সে রাগ করবে শুনলে শ্রুতি এখন তেমন অবাদ্ধতা করেনা। ব্যাপারটা উপভোগ করে পার্থিব। নিজের প্রতি শ্রুতির অনুভূতি দেখতে ভালো লাগে। নিজের প্রতি ভালোবাসা দেখতে কে না ভালোবাসে।

শ্রুতি পার্থিবকে খাওয়ানো শেষ করল। খাওয়ার মাঝে সে নিজেও খেয়ে নিল। পার্থিবকে আরেকটু অবাকের উচ্চধাপে বসিয়ে নিজের হাতে ঠোঁট মুছিয়ে দিল। পাশে বসে পানি খাওয়াতে গেলেই পার্থিবের মাথায় চাপল শ্রুতিকে একটু বিরক্ত করা যাক। পার্থিব শ্রুতির হাতে পানি খেল। খাওয়া শেষে শ্রুতির ওড়নায় নিজের ঠোঁট মুছল। মূহুর্তটা এতো সুন্দর, তৃপ্তিদায়ক লাগলো নিজের কাছে যা ভাষাতীত। এরপর পার্থিব মুচকি হেসে বলল,
‘ আপনাকে অনেক কষ্ট করতে হলো শ্রুতি। আপনার এতো কষ্ট দেখে ভীষণ খারাপ লাগছে।’
শ্রুতি তাকিয়ে আছে যার অর্থ হঠাৎ কী শুরু করল আবার লোকটা? পার্থিব বলল,
‘ আমার আরেকটা বউ থাকলে আপনাকে এতো কষ্ট করতে হতোনা। আপনি খাইয়ে দিতেন, আরেকজন পানি খাইয়ে দিত। এতে আপনারও কষ্ট কমতো। আমিও উপভোগ করতাম দু’বউ এর যত্ন।’

‘আমার আরেকটা বউ’ – শব্দগুলো বিষের মতো বাজল শ্রুতির কানে। তবুও বলল,
‘ কে বলেছে যত্ন করতো? সব বউএরা যত্ন করেনা। সেই বউ এসে আপনার এমন বজ্জাতগিরি দেখে আপনাকে শলা দিয়ে পিটাতো। অসভ্য লোক।’

শ্রুতি জানে পার্থিব মজা করছে, তবুও মজাকে মজা হিসেবে নিতে পারল না সে। রেগে উঠল। পার্থিব আগুনে ঘি ঢেলে বলল,
‘ এরেঞ্জ ম্যারেজ করলে পিটালেও পিটাতে পারে। উদাহরণস্বরূপ আপনাকে এরেঞ্জ ম্যারেজে বিয়ে করেছি। সারাদিন তিতা করলার মতো ব্যবহার পাই….’
শ্রুতি পার্থিবকে শেষ করতে না দিয়েই অবাক হয়ে বলে উঠল, ‘ এতোক্ষণ ভরে আমি খাওয়ালাম কাকে?’

‘ একদিন খাওয়ালে বুঝি সারাবছরের ব্যবহার মিথ্যা হয়ে যায়? হু… যা বলছিলাম। বিয়ে করব লাভ ম্যারেজ। দেখেশুনে। একদম লাভিং, কেয়ারিং একটা বউ। কেমন হবে?’

শ্রুতি এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। সামনের বোতল তুলে মুখ লাগাতে লাগল যেন সে খুব ব্যস্ত। পার্থিব মুখ এগিয়ে বলল, ‘ বললেন না তো শ্রুতি কেমন হবে?’
‘ ভালো হবে।’ থম ধরা কণ্ঠে বলল।

পার্থিব সিরিয়াস হয়ে কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,
‘ শ্রুতি, আপনার জন্য চকলেট এনেছিলাম। ওই যে ওই ব্যাগে আছে। বের করে খেয়ে ফেলুন। নয়তো গলে যাবে।’
শ্রুতি বোতল নিয়ে উঠে দাঁড়াল। পার্থিবের চকলেট আনা তো দূর। পার্থিবের দিকে তাকালো না পর্যন্ত। হনহন করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। পার্থিব নিজেই বোকা হয়ে গেল। বোকা চোখে চেয়ে রইল শ্রুতির যাওয়ার পানে।

.
পেরিয়ে গেছে আরোও কিছুদিন। আজ মাহাথির বিভাকে নিয়ে হাসপাতালে যাবে চেকাপ করাতে। বিভা ঢিলেঢালা জামা পড়ে তৈরি হয়ে নিল।
মাহাথির ড্রইংরুমেই বসা ছিল। বিভা বের হতেই দু’জনে বেরিয়ে পড়ল। হাসিনা বার বার বলল, বিভাকে সাবধানে নিয়ে যেতে।

সিড়িতে দিয়ে নামার সময় মাহাথির বিভার হাত ধরে রাখল। ভীষণ শক্ত করে। বিভা ছাড়াতে চাইলেও বিশেষ লাভ হলোনা। বিভা বাইরে আসতেই সামনে একটা মাইক্রো দেখে তার থেকে দূরে গিয়ে দাঁড়াল। যার অর্থ মাহাথির গাড়ি ঠিক করলে উঠবে। মাহাথির বিভার হাত টেনে বলল,
‘ বিভা ওদিকে যাচ্ছো কেন? আসো। গাড়িতে ঢোকো।’
বিভা হালকা ভাঁজ ফেলল কপালে। বলল,
‘ কোথায় গাড়ি?’
মাহাথির সামনের গাড়িটা দেখিয়ে বলল,
‘ এইযে। তোমার সামনেই তো। আসো।’

বিভা হতবিহ্বল হয়ে পড়ল। ব্যাপারটা বুঝে আসতেই আচম্বিত প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, ‘ আপনি উবার কেন ডেকেছেন?’
বিভার কণ্ঠ শুনে মনে হলো মাহাথির মারাত্মক কোনো অপরাধ করে ফেলেছে যার জন্য সে এইভাবে কৈফিয়ত চাচ্ছে। মাহাথির চাইল না নিজের যত্নের কথা প্রকাশ করতে। শান্তকণ্ঠে বলল, ‘ বিভা চুপচাপ আসো। এতো প্রশ্ন ভালো নয়।’

‘ আগে বলুন আপনি উবার কেন ডেকেছেন?’
বিভার জেদী কণ্ঠে মাহাথির দমে গেল। বুঝল উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত এই মেয়ে নড়বেনা।

বলল, ‘ তোমার এই অবস্থায় রিকশা, সিএঞ্জি সেফ না বিভা। ঝাঁকিতে কষ্ট হবে। তাই উবার….’

‘ তাই বলে উবার ডাকবেন? টাকা বেশি হয়ে গেছে? চলে যেতাম বাসে। এখন যে একশো টাকার ভাড়া পাঁচশো যাবে?’

বিভার এমন কথায় মাহাথির চুপ করে তাকিয়ে রইল বিভার দিকে। যতোদূর সে জানে আমিন শিকদার ভালো না হলেও বিভা, শ্রুতি, হামিম বেশ আরাম-আয়েশে মানুষ হয়েছে। এসি বাড়ি, এসি গাড়িতে বেড়ে ওঠা ওদের। সেখানে সে এইসব কিছুই দিতে পারেনি বিভাকে। উলটো তার বাড়ি এসে বিভা নিজে থেকে কাজ করে কষ্ট করে। আর আজ যখন সুবিধার জন্য উবার ডাকল তাও মেয়েটা মানতে চাইছেনা। স্বামীর টাকার হিসাব করছে। মেয়েরা বুঝি এমনই হয়? উঁহু সব মেয়ে এমন হয়না। যারা আদর্শ মেয়ে, বউ তারাই কেবল এমন হয়। স্বামীর অবস্থাকে সম্মান করে। স্বামীর ইনকামে সন্তুষ্ট থাকে। মাহাথির নিজে বিভার থেকে বিভার অজান্তেই এমন সম্মান পেয়ে আপ্লূত হলো। বিভার প্রতিও তার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল বহুগুণ।
তবুও এই মূহুর্তে সেই ঠিক। বিভার কথায় নাচলে হবেনা। তাই বিভাকে জোড় করে গাড়িতে উঠিয়ে দিল মাহাথির। বিভা থম ধরে, মুখ কুঁচকে বাইরে তাকিয়ে রইল। তাকাবে না সে মাহাথিরের দিকে।

গাড়ির ভেতর বসে বসে ঢাকার জ্যামকে কয়েক দফায় গালি দিয়ে দিল মাহাথির। হসপিটাল টা এমনিতেই কিছুটা দূরে তার উপর এই জ্যাম। আদৌও আজকে পৌঁছতে পারবে কিনা কে জানে! বিভার মুখ দেখার চেষ্টা করল। মেয়েটা কাঁধে ঘুমিয়ে আছে। এসির মধ্যেও কপালে ঘাম দেখে ভীষণ মায়া হলো। মাহাথির নিজের টিস্যু দিয়ে মুছে দিতে লাগল কপাল।
বিভা পিটপিট করে চোখ খুলে নিজের অবস্থান বুঝল। বুঝতেই বিদ্যুৎবেগে সড়ে গেল। মাহাথির বিভার দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করল যে কি হলো। বিভা বসে হাত দিয়ে গলা, মুখের ঘাম মোছার চেষ্টা করল। ভীষণ গরম লাগছে তার। বিভা মাথা হেলিয়ে দিল জানালায়।

মাহাথির বলল, ‘ কাঁধে মাথা রেখে শোও। আরাম পাবে।’

‘ আপনার কাঁধে আমি মাথা রাখব না মাহথির।’

‘ কেন?’

‘ এমনিতেই। কোনো কারণ নেই। আমার ভালো লাগেনা।’

মাহাথির আহত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল বিভার দিকে। চাইলেই সে জোড় করতে পারে। তবে করছেনা। করলে বিভা বিরক্ত হবে। আর সেটা দেখে মাহাথিরের ক্ষত-বিক্ষত মন আরোও ক্ষত-বিক্ষত হবে। মাহাথিরের মনে পড়ল, বাসে বিভা একবার তার কাঁধে মাথা রেখেছিল বলে সে সরিয়ে দিয়েছিল। আর আজ কিনা, বিভার মাথা নিজের কাঁধে রাখানোর জন্য মনটা আনচান করছে। সময় আসলে সবকিছুই মানুষকে ফিরিয়ে দেয়। অবহেলা, ভালোবাসা সব। সময় কারোর ঋণ রাখেনা। মাহাথির মাথা নিচু করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বিভার মলিন মুখের দিকে চেয়ে ভাবল – এই অভিমানের অন্ত কোথায়?
_______
চলবে~
শব্দসংখ্যা – ২২৪৭
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান