একগুচ্ছ শুকতারা পর্ব-৪৭+৪৮

0
191

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

৪৭.
আবহাওয়ার বদল ঠান্ডা চোখে দেখছেন আমিন শিকদার। এই তো সারা সকাল খরখরে রোদ ছিল। রোদের তাপে চামড়া পুড়ে যাওয়ার জোগাড় হচ্ছিল। আর এখন কেমন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছে! অদ্ভূত ব্যাপার-স্যাপার! আবহাওয়ার মন-মেজাজের মতো আমিন সাহেবের মন-মেজাজও তেমন ভালো নেই। ইদানীং সে কেমন যেন হয়ে গেছে। কোনো কিছুই তাকে আকর্ষণ করে না। দুনিয়াবি কিছুই তাকে খুশি করতে পারেনা। সেদিন অফিসে তার ম্যানেজার তাকে নতুন প্রজেক্টের ব্যাপারে বলল। সেই প্রজেক্টটা নিয়ে কাজ করলে মাসে ভালোই একটা লাভের অংশ আসতো। তবে সে তা করল না। কেন করল না জানেনা। মন টানল না, আগ্রহ পেল না, করল না। ব্যাস! আসলে মনের ওপর কারোর জোর চলেনা।
আমিন সাহেব জানালায় এসে দাঁড়ালেন। এখন কেমন যেন হঠাৎ হঠাৎ করেই ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। শৈশব, কৈশোর, যৌবনকালের স্মৃতি সব এসে তার মস্তিষ্কে আন্দোলন করে। নিজেকে ভীষণ একা একা লাগে। কিন্তু সে কী একা? না তো। সে মোটেও একা নয়। এই তো পেছনেই তার স্ত্রী শুয়ে আছে। হয়তো ঘুমিয়েও পরেছে। স্ত্রী আছে, তিন ছেলে আছে। একা কোথায়?
তবে আসলেই কী তারা আছে? আগের কথায় একটু ভুল হলো। তার স্ত্রী নয়, এটা তার দ্বিতীয় স্ত্রী। তিন ছেলে নয়, তার সন্তান দুই মেয়ে এক ছেলে। আমিন সাহেব হঠাৎ করেই ভীষণ অস্থিরতা অনুভব করলেন। মাথার ভেতর সব কেমন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাচ্ছে। কিছুর হিসাবই সে মিলাতে পারছেনা। সে মানতে চাইছে তার সবকিছু আছে, অথচ কোথাও থেকে চিৎকার ভেসে আসছে যে, নেইইই! তার কিছুই নেই।
আমিন শিকদার তার কেনা শখের ইজিচেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিল। চোখ বন্ধ করার সাথে সাথে ভেসে উঠল তাহিরা আর তার যৌবনকালের প্রেমের কিছু মূহুর্ত। আমিন সাহেব স্বস্তি পেলেন না। আজকাল তাহিরা, মা, বিভা, শ্রুতি, হামিম সবাই বড্ড জ্বালাতন করছে। তার মাথায় পোকার মতো গিজগিজ করছে। একটু একটু করে তার মাথায় কামড় বসাচ্ছে আর ভাবনার অভ্যন্তরীণে প্রবেশ করছে। আমিন শিকদার এইবার একটা ভয়ংকর কাজ করলেন। উঠে গিয়ে আলমারি বের করলেন। এখানে একটা পুরোনো অ্যালবাম আছে। তাহিরা বানিয়েছিল শখ করে। সে আর ফেলেনি। রেখে দিয়েছে যত্ন করে। কারণ তাহিরার সাথে তার তেমন ঝগড়া বিবাদও হয়নি যে ফেলে দিবে। সে তো ভেবেছিল সে তার দুই স্ত্রীকে নিয়েই থাকবে।
অ্যালবাম বের করতেই তাহিরার হাসিমুখের একটি ছবি ভেসে উঠল চোখের সামনে। তাহিরার কোলে শ্রুতি। পাশে বসা বিভাকে তাহিরা এক হাত দিয়ে জড়িয়ে আছে। আমিন সাহেবের হঠাৎ করে মনে হলো, এই পৃথিবীতে এই তিনজনের সৌন্দর্যের কাছে সকল সৌন্দর্য হেরে যাবে নিঃসন্দেহে।

.
সিজারের পাঁচ দিনের মাথায় রিলিজ দেওয়ার কথা থাকলেও বিভাকে রিলিজ দেওয়া হলো চারদিনের বেলাতেই। এ’কদিন মাহাথিরই ছিলো বিভার কাছে। কখনো হাসিনা, কখনো শ্রুতি খাবার নিয়ে এসেছে। পার্থিবের চলাচল তো ছিলোই।
বিভাকে ধীরেসুস্থে বাসায় আনা হলো। সাথে এসেছিল শ্রুতি-পার্থিব। শ্রুতি নিজ দায়িত্বে দুপুর এবং রাতের খাবার রান্না করল হাসিনার সাহায্যে। সবাই দুপুরের খাবার খেয়ে বিভা এবং বাবুর সাথে সময় কাটাতে কাটাতেই পার করে দিল দিনটা। পার্থিবকে অবশ্য কাজের তাড়নায় আগেই চলে যেতে হলো। সন্ধ্যাবেলায় শ্রুতিও চলে গেল। এরমধ্যে মাহাথিরও বেশ কয়েকদিনের ছুটি পেয়ে গেছে। ছুটি পেয়ে সে অন্যরকম এক স্বস্তি অনুভব করল। বিভা পুরোপুরি সুস্থ নয়। এই সময়ে তাকে সাহায্য করতে পারবে, নিজের সন্তানের সাথে সময় কাটাতে পারবে – এর থেকে স্বস্তির আর কী হতে পারে! তবে এখনো সে ততোটাও খুশি নয়। কারণ বিভা। বিভা এখনো তাকে মেনেছে কিনা, তার অভিমান ভেঙেছে কিনা এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত সে। এই চারদিন বিভার সাথে প্রয়োজন ব্যতীত তেমন কথা হয়নি। টুকটাক যা হওয়ার তাই হয়েছে। তবে কথা মাহাথিরই বলেনি। সাহস হয়ে ওঠেনি। বিভার অসুস্থতা, মারা যাওয়ার কথা, অবিশ্বাস, কাটা পেট – সব ভাবতেই তার বুকের মাঝে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। বিভার সকল ব্যথা নিজের মধ্যে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা বিভাকে দেখে মাহাথির যে মনে মনে কতোটা ভেঙে পড়েছে তা কী বিভা জানে? বিভার অসুস্থতা মাহাথিরকে যে কতোটা পুড়িয়েছে তা কী বিভা জানে? মাহাথির যে বিভার চোখে চোখ রাখতে পারেনা তা কী বিভা জানে? বিভা যদি এখনো তাকে বিশ্বাস না করে, তার ভালোবাসায় বিশ্বাস না করে? ভাবতেই তার চারপাশটা অসহ্য যন্ত্রণায় ছেয়ে গেল।

মাহাথির ঘরে ঢুকতেই দেখল তার ছোট্ট মাহতিম ঘুমিয়ে আছে। বিভা মাঝে। মাহতিম বিভার এক পাশে। ছেলের দিকেই চেয়ে আছে বিভা। বিভা মাহাথিরকে দেখেও তেমন কিছু বলল না। সে বসে ছিল। শুতে চেষ্টা করল। মাহাথির তা বুঝতে পেরে এসে বিভাকে ধরে শুইয়ে দিল। বিভা মাহাথিরের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। কী অবস্থা হয়েছে মানুষটার! এলোমেলো রুক্ষ চুলগুলো কিছুটা বেড়েছে। সাথে গালের চাপ দাঁড়িগুলো আরোও কিছুটা বড় হয়ে মুখের গাম্ভীর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। আগে ঘুরতো নির্লিপ্ত মুখভঙ্গি নিয়ে, এখন ঘুরে গাম্ভীর্যের আবরণ পরে।

মাহাথির বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। বিভা কিঞ্চিৎ অবাক হলেও তেমন কিছু বললনা। পাশে তাকাল নিজের ছেলের দিকে। অন্যপাশের কোলবালিশ আরোও কিছুটা ঠেসে দিল বাচ্চার গায়ের সাথে। এরপর বুকের ওপর আলতো হাত দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল। বেশকিছুক্ষণ বাদে বিভা অনুভব করল মাহাথির তার পাশে শুয়েছে। বিভা সোজা হয়ে শুয়ে আছে। মাহাথির তার গা ঘেষে শুয়ে বলল,
‘ বিভা! ঘুমিয়েছো?’

বিভা ভাবল উত্তর দিবেনা। তবুও বলল,
‘ না।’

‘ আমি তোমার পেটের ওপরে হাত রাখি একটু? জোরে ধরবনা।’

মাহাথিরের এমন অনুরোধ বিভা আশা করেনি। চোখ বন্ধ করেই বলল, ‘ ধরুন।’
মাহাথির সাথে যাথে হাত বাড়িয়ে বিভাকে আগলে নিল। গলায় মুখ গুঁজে জড়িয়ে রইল। তলপেটের ক্ষতের দিকেও খেয়াল রাখল। বিভা চোখ পিটপিট করে চেয়ে রইল ফ্যানের দিকে। কী হচ্ছে তার মাথায় ঢুকছেনা। কিছুক্ষণ বাদেই বিভা তার গলা ভেজা ভেজা অনুভব করল। ব্যাপারটা তার বোধগম্য হতেই মধ্যম আওয়াজে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ মাহথির! এই মাহথির!’

মাহাথির উত্তর দিলনা। নিজের মুখ আরোও গুঁজে দিল গলায়। বিভা উদগ্রীব কণ্ঠে বলল, ‘ মাহথির! মাথা তুলুন। আপনি কী কাঁদছেন?’
মাহাথিরের কোনোরকম প্রতিক্রিয়া না পেয়ে হাত উঠিয়ে মাহাথিরের মুখ সরাতে চাইল। কোনোরকমে সরিয়ে দিয়ে বিভা দেখল মাহাথিরের মুখের অবস্থা নাজেহাল। চোখের পানির ছাপ স্পষ্ট দু’গালে, কান্নার কারণে চোখ লালাভ বর্ণ ধারণ করেছে, নাকও সামান্য লাল হয়ে আছে। মাহাথিরের এমন অবস্থা দেখে বিভার বুকটা ধ্বক করে উঠল। বিভা উতলা কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
‘ আপনি কাঁদছেন কেন?’

মাহাথির কিছু না বলেই উঠে যেতে চাইল। তার আগেই বিভা অন্য হাত মাহাথিরের গালে রেখে আটকে ফেলল। আদর করে প্রশ্ন করল,
‘ কী হয়েছে মাহাথির? আমাকে বলুন। কাঁদছেন কেন আপনি?’

বিভার ভালো কথাতেও মাহাথিরের ভেতর জেদ চাপল। বলল, ‘ আমার আরোও দশটা বউ আছে। ওদের খুঁজে পাচ্ছিনা। তাই কাঁদছি।’
বিভা ভ্রু কুঁচকে নিল। মাহাথির প্রথমে রাগ করে জেদ থেকে বললেও এবার নমনীয় হয়ে গেল। ভাবল এইবার সে বলবেই মনের কথা। বলল,
‘ তোমার জন্য কাঁদছি, বিভা। আর কার জন্য কাঁদব? তুমি কেন বোঝোনা আমাকে? কেন আগেরমতো ভালোবাসোনা? তুমি আমার ভালোবাসাকেও বিশ্বাস করোনা। ওটিতে ঢোকার আগে কীসব আজেবাজে কথা বললে! তুমি জানোনা তোমার কথায় আমার খারাপ লাগতে পারে? কষ্ট হতে পারে? তুমি ছাড়া এই দুনিয়ায় কে আছে আমার? তবুও তুমি আমার সাথে এমন করো। আমার ভালো লাগেনা বিভা। তুমি জানোনা আমি কয়দিন কীভাবে ছিলাম! প্রথমে তো ওটি, পরে এমন কাঁটা পেট, তাজা ঘা। সব মিলিয়ে আমার কেমন লেগেছে আমিই জানি।’

বিভার মনে হলো কোনো বাচ্চা তাকে অভিযোগ করছে। লোকটার কথায় এতো মায়া লাগে কেন? মায়াবতীর কোনো পুরুষবাচক শব্দ নেই কেন? শব্দ থাকলে ভালো হতো। এই মানুষটাকে নিঃসন্দেহে দেওয়া যেত। মানুষটার কথা প্রথমে অবাক হয়ে শুনলেও পরে মুচকি হাসল বিভা। পাশের হাত বাড়িয়ে গালে দিল। বলল, ‘ খুব ভালোবাসেন?’

‘ মোটেও ভালোবাসিনা।’

বিভা আবারো হাসল। মাহাথির নিজ থেকে বলল, ‘ কী করলে আমার ভালোবাসায় বিশ্বাস করবে বিভা? তোমার অবিশ্বাস আমি মানতে পারিনা।’

‘ এক শর্তে বিশ্বাস করতে পারি।’

‘ কী শর্ত?’

‘ আপনাকে সারাজীবন বসে বসে আমাকে অনেক ভালোবেসে অভিমান ভাঙাতে হবে। এরপর চাইলে আমার অভিমান ভাঙতেও পারে আবার নাও পারে। সেটা আপনার ভালোবাসার ওপর ডিপেন্ড করবে।’

মাহাথির বিভার কথার মাঝের লুকায়িত অর্থ বের করে নিল। মন্থর কণ্ঠে বলল,
‘ সারাজীবন ভালোবাসবো।’

বিভা এইবার নড়েচড়ে দু’হাত দিয়ে মাহাথিরের চোখের পানি মুছে দিল। মাথা এগিয়ে নিয়ে কপালে চুমু খেল। বিভার এমন আদুরে কাজে মাহাথিরের ভেতর ছেয়ে গেল আলাদা প্রশান্তি। বিভা হাসি হাসি মুখে বলল,
‘ শুধু শুধু এতো কষ্ট করলেন। এইভাবে কেউ কাঁদে?’

‘ কেন?’

‘ আপনার এতো কান্নাকাটির কোনো প্রয়োজন ছিলনা জনাব। আমার অভিমান তো সেই কবেই ভেঙে গেছিল।’ প্রফুল্ল কণ্ঠ বিভার।

‘ তাহলে এতোদিন আমার সাথে ভালোভাবে কথা বলোনি কেন?’

‘ এমনি। অভিমানের নাটক করেছি যাতে বেশি বেশি ভালোবাসেন।’

মাহাথির ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল বিভার দিকে। বিভা হেসে মুখ ফিরিয়ে নিল। মাহাথির বিভার গলায় নিজের মুখ আড়াল করল। বিভা ভালোলাগায় চোখ বন্ধ করে নিল। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। তার একপাশে স্বামী, অন্যপাশে সন্তান। এইতো! তার জীবন পরিপূর্ণ। সে সুখী। সুখী হতে জীবনে আর কী লাগে!

.
চোখের পলকে পেরিয়ে গেছে দেড় মাস। ভোরবেলা। সূয্যিমামা উঁকিঝুঁকি দিতে চাইছে। নির্মল আলোয় আচ্ছাদিত চারপাশ।
হঠাৎ বাচ্চার কান্না কানে আসতেই মাহাথির উঠে পড়ল। ঘাড় উঁচু করে দেখল চার হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদছে মাহতিম। বিভার ঘুম ভাঙবে ভাঙবে ভাব। ঔষধের প্রভাবে তার ঘুম পূর্বের তুলনায় গাঢ় হয়েছে। মাহাথির তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল। ওপরপাশ দিয়ে গিয়ে বাচ্চাকে তুলে নিলে কোলে।
বুকে জড়িয়ে হাঁটতে লাগল সারা ঘর। কান্না থামছেনা। ক্ষুধা লাগল নাকি? কিন্তু বিভা তো ঘুমোচ্ছে। কী করবে ভেবে পেলনা। মাঝরাতেও একবার উঠেছিল মাহতিম। বিভা তো তখন খাওয়ালো। আবার এতো তাড়াতাড়ি ক্ষুধা লাগবে? বাচ্চাকে দু’হাতে তুলে মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে খেলতে লাগল মাহাথির। কখনো কখনোবা মুখভঙ্গি বিকৃত করে হাসাতে চাইল। কেউ জেগে থাকলে সে অবশ্যই এইসব করতে পারতো না। তার এমন ব্যবহার শুধুমাত্র তার ছেলের জন্য। হাজারকিছু করেও ছেলের মুখে হাসি ফুটল না। লাভ বলতে কান্না থামল। তবে মুখে হাসি ফুটল না। মাহাথির ভীষণভাবে ভ্রু কুঁচকে তাকাল মাহতিমের দিকে। ধিমে কণ্ঠে বলল,
‘ বাবা! তুমিও কী তোমার বাবার মতো হবে নাকি? মোটেও কিন্তু বাবার মতো হইয়োনা। তাহলে বউকে সহজে নিজের মনের কথা বলতে পারবেনা। আর বউ যদি তোমার মায়ের মতো শয়/তান মহিলা হয়, তাহলে তো হলোই। বাবা! তোমাকে ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে দিব। ঠিকাছে?’

বলেই হাঁটতে লাগল মাহাথির। আবার থেমে গেল। ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ আব্বু মজা করেছি। তোমার আম্মু খারাপ নয়। সে ভীষণ ভালো। তোমার আব্বু তোমার আম্মুকে পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে। বুঝেছো আব্বু?’

বলেই মাহতিমের গলায় নাক দিয়ে গুতো দিলো মাহথির। বাবার কথা বুঝল নাকি সুড়সুড়ি লাগল কে জানে! মাহাথিরকে অবাক করে দিয়ে খিলখিল করে হাসল বাচ্চাটা। দাঁতবিহীন হাসি। শুধু মাড়ি দেখা যাচ্ছে। মাহথির নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল নিজের সন্তানের দিকে। হাসি দেখে মনে হচ্ছে যেন মুক্তো ঝড়ছে! হাসিটা এতো সুন্দর লাগছে কেন? নিজের সন্তানের এমন হাসিতে মাহাথিরের বুকটা ভরে উঠল। পরমূহুর্তেই ভাবল, এতোক্ষণ এতোকিছু করেও হাসাতে পারল না। আর এখন নাকি একাই হাসছে। অদ্ভূত! মাহথির নরম গালে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। মাহতিমকে সযত্নে বুকে আগলে নিল। ওমনি মাহতিম নিজের ধারালো নখ দিয়ে খামচি বসালো বাবার উন্মুক্ত বাহুতে। সেদিকে একবার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে মুখের সম্মুখে আনল নিজের ছেলেকে। গম্ভীরমুখে বলল,

‘ ভয় পেয়োনা। আমি নিজের প্রমিস এর কথা ভুলিনি। আমার মনে আছে আমাদের ডিলের কথা। তুমি দুনিয়াতে এসে তোমার আম্মুকে ভালো বানিয়ে দিয়েছো। বিনিময়ে আমি তোমাকে মারব না। তোমার আম্মুকেও মারতে দেব না। খুশিতো?’

মাহতিম তার বুড়ো আঙুল মুখে পুর‍তে চাইল। মাহাথির তা হতে দিল না। হাত সরাতে সরাতে বলল, ‘ বাবার ডিল মেনে নিয়ে বুদ্ধিমানের কাজ করেছো। তবে ডিলটা যেহেতু দেড়িতে মেনেছো, সেহেতু মায়ের বকা থেকে আমি বাঁচাতে পারব না। এটা তোমার শাস্তি। ওকে?’
মাহাথিরের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে মাহতিম তার কোল থেকে উল্টে যেতে চাইল। মাহাথির দ্রুত আগলে নিল। হঠাৎ করে এমন নড়চড়ে কিছুটা ভড়কে গেছে সে। এতোক্ষণ তো শান্তই ছিল। এমন বলটে যেতে চাইছে কেন হঠাৎ করে? ঘাড় এদিক-ওদিক নিয়ে নড়চড় শুরু করে দিল মাহতিম। নিজের দেড় মাসের বাচ্চার এমন কুস্তিগিরি দেখে মাহাথির ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল।

.
বিছানায় শুয়ে আছে আমিন শিকদার। নড়চড় করার শক্তি নেই। মুখ ভীষণ তেঁতো হয়ে আছে। শরীরের উত্তাপে মাঝেমধ্যে অক্ষিকোটর থেকেও পানি নির্গত হচ্ছে। তবুও কিছু করার নেই। গত সাতদিন যাবত তার এই অবস্থাই। ডাক্তার এসেছিল। বলেছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। তবে হাসপাতালে যাওয়ার মতো আক্রান্ত নয়। তাই বাড়িতেই সেবা নেওয়া হচ্ছে। পাশেই শাহিনা বসা। কিছুক্ষণ আগে জলপট্টি দিয়ে দিল। এখন বসে আছে বিরসমুখে।
শাহিনা বলল,
‘ ব্যবসা-বাড়ি নিয়ে কিছু ভাবলে?’

‘ কী ভাবব?’ আমিন সাহেব জানেন শাহিনার কথার অর্থ। তবুও জিগ্যেস করল।

শাহিনা বলল, ‘ কাগজ-পত্র ঠিকঠাক করে তিনজনের নামে লিখে দিলে ভালো হয়না?’

আমিন সাহেব ভীষণ রেগে গেলেন কথাটায়। তবে ঝগড়া করার মন-মানসিকতা নেই। শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ সুস্থ হয়ে নেই। ভাবা যাবে।’

শাহিনা হয়তো পছন্দ করল না আমিন সাহেবের কথা। মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে ঘর থেকে প্রস্থান করলেন। আমিন সাহেব চোখ বন্ধ করল। তার স্ত্রী, তিন সৎ পুত্র সবাই ধরেই নিয়েছে সে মারা যাবে। তাইতো এমন তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে সবকিছু লিখিয়ে নেওয়ার। এইতো সেদিন সুস্থ অবস্থায় থাকতে একবার কীভাবে যেন সম্পত্তির কথা উঠল। কথায় কথায় আমিন সাহেব রেগে বলে উঠলেন,
‘ আমার ব্যবসা-বাণিজ্যর ভাগ আমি কাউকে দিব না। আর সম্পত্তি ভাগাভাগি তো দূরের বিষয়।’

আমিন সাহেবের কথাটা শেষও হতে পারেনি। ওমনি তার সৎ মেজ ছেলে এসে তার কলার ধরে হুংকার দিয়ে উঠল,
‘ দিবা না মানে কী?’

এমনিতেই কিছুক্ষণ ধরে বাকবিতন্ডায় মাথা খারাপ ছিল। তার উপর আমিন সাহেবের এমন কথা মেনে নিতে পারেনি ঐ ছেলেটা।
তবে ঘটনার আকস্মিকতায় আমিন সাহেব কান্ডজ্ঞানহীন হয়ে পড়ল। বাকিরা এসে সেই ছেলেকে ছাড়িয়ে নিতেই আমিন সাহেব সোফায় বসল। কেমন অনুভব হলো তার তা সে বুঝল না। ছেলেক শান্ত করে শাহিনা এগিয়ে এলেন। বলল, ‘ শুধু শুধুই রাগারাগি করছো তুমি। কেন ছেলেটাকে ওভাবে রাগিয়ে দিলে? আমাদের সবকিছু তো ওদেরই। তাইনা? ওদের জিনিস ওদের দিবেনা?’
এর পরিবর্তে আমিন সাহেবের কিছু বলার ছিল না।
আজও নেই। কী বলবে তিনি? বুকের ভেতর কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মা মারা যাওয়াতে সে কষ্ট পেয়েছিলেন। তবে ভেঙে পড়ার মতো কষ্ট নয়। আজ মাকে ভীষণ মনে পড়ছে। সবাইকেই মনে পড়ছে। তার বাড়িতে এতো মানুষ! তাও তিনি মানুষের অভাববোধ করছে। মনে হচ্ছে নেই। কোথাও কেউ নেই। হঠাৎ করেই আসাদ সাহেবের একটা কথা মনে পড়ল। সে বলেছিল, মৃত্যুর সময় আমরা আপনজনের হাত খুঁজি। সেও কী তবে আপনজনদের হাত খুঁজছে? আমিন শিকদার চোখ বন্ধ করল। বন্ধ চোখ বেয়ে বের হলো অনর্গল অশ্রুকণা। এই অশ্রুকণা কীসের তা আমিন সাহেব তা জানেনা। দুঃখের নাকি জ্বরের….

.
দেড়/দুই মাসে বিভা বলতে গেলে কিছুটা সুস্থই। এখন টুকটাক কাজ করা শুরু করে দিয়েছে সে। যদিও হাসিনা বেগম তাকে করতে দেয়না, তবুও করে। বিভা খাটে সব জামা-কাপড় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখে ভাঁজ করছে। আলমারি এলোমেলো। বাচ্চাকে দাদার কাছে দিয়ে এসেছে। তার সন্তানের সবচেয়ে ভালো গুণ হলো সবার কাছেই থাকে। কাঁদেনা তেমন। শুধু ক্ষুধা লাগলে দিন-দুনিয়া ভুলে যায় বাপের মতো। বিভা মিটমিটিয়ে হাসতে হাসতে হাতের কাজ করছে।
তখন মাহাথির এলো। ঘরের অবস্থা দেখে হঠাৎ করেই মুখটা শুকিয়ে গেল। বিভা পা ঝুলিয়ে বসে ছিল। মাহাথির ধীরে ধীরে হেঁটে এসে হাঁটু গেড়ে বসল বিভার সামনে। ঠান্ডা আওয়াজে বলল,
‘ এখনো অভিমান মনে পুষে রেখেছো?’

বিভা বুঝতে চেষ্টা করল তার স্বামীর কথা। বুঝল না। মাহাথির বলল, ‘ আমি নিজের হাতে কাপড়গুলো রাখলাম। তাও বের করে নিয়েছো?’

এবার বিভা বুঝল আসল কাহিনী। ভ্রু কুঁচকে মাহাথিরের মাথায় টোকা দিল,
‘ বউকে ভালোবেসে বুদ্ধি কী বস্তায় ভরে ফেলে দিয়েছেন মাহতিমের আব্বু?’

বিভার এমন নতুন ডাকে অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করলেও পাত্তা দিল মাহাথির। শান্তকণ্ঠে বলল,
‘ তুমি জামাকাপড় কেন বের করেছো তাহলে? আমার ওপর রাগ করেই তো।’

‘ আপনার যে একটা সন্তান আছে তা কী ভুলে গেছেন?’

‘ ভুলব কেন?’

‘ আপনার হাব-ভাবে তাই মনে হচ্ছে।’

‘ পরিষ্কার করে বলো বিভা। রাগ হচ্ছে আমার।’

‘ এ আর নতুন কী! করুন রাগ।’
মাহাথিরের মুখ মলিন। বিভা আর বিষয়টাকে বাড়তে দিল না। উঠতে উঠতে বলল, ‘ আপনার ছেলের কাপড়-চোপড় কী রশিতে রশিতে ঘুরবে? নাকি চেয়ারে, এখানে-সেখানে পড়ে থাকবে? ওর কাপড়চোপড় রাখার জায়গা বানাচ্ছিলাম।’

‘ মিথ্যা কথা! এই বলে তুমি নিজের কাপড় সরাতে চাইছো।’ একগুঁয়ে কণ্ঠে বলল মাহাথির।

বিভার এখন কপাল চাপড়াতে মন চাইছে। আলমারির দরজা ভালোমতো খুলে হাত দিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে মাহাথিরকে বলল,
‘ এই যে আপনার কাপড়-চোপড় রাখার জায়গা। আর এই যে আমার কাপড় চোপড় রাখার জায়গা। আর এই মাঝখানে থাকবে বাবুর কাপড়। মাথায় ঢুকেছে? ছোট ছোট জিনিস খুঁজে পাওয়া যায়না। তাই এইভাবে গুছিয়ে রাখছি। নাকি গুছাতেও পারবনা?’

মাহাথির ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ তোমার দোষ। আমাকে আগে বললেই বুঝে নিতাম।’

বিভা বাঁকা চোখে চেয়ে কাজে মন দিল। মাহাথির এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘ বাবুর জন্য ছোট ওয়ারড্রব অর্ডার করি?’

বিভা রাগী স্বরে বলল, ‘ মোটেও না মাহথির। মোটেও এইসব কিছু করবেন না। ধীরে ধীরে সব হবে। এতো তাড়াহুড়ো করে করার কোনো প্রয়োজন নেই।’

‘ তুমি আমাকে ধমক দিচ্ছো?’

‘ দিচ্ছি। কী করবেন? মারবেন?’
বিভার একরোখা কণ্ঠে মাহাথির বিভার গাল চেপে ধরল। নিজের মুখ সামনে নিয়ে বলল,
‘ মারব কেন? ভালোবাসব।’

.
দরজা খুলেই চেঁচিয়ে উঠল শ্রুতি,
‘ আমি এসে গেছিই পার্থিববব।’

আলোচনার মাঝে হঠাৎ এমন কথায় থেমে গেল সবাই। শব্দের উৎস খুঁজতে পিছনে ঘুরতেই চোখ পড়ল এক রমণীকে। পার্থিব স্বাভাবিক ভাবে তাকিয়ে আছে গোলফ্রক পরিহিত, হিজাব বাঁধা, হিজাবের নিচে পেছনে থেকে ওড়না নিয়ে আসা শ্রুতির দিকে। শ্রুতির মুখ ইতোমধ্যে শুকিয়ে কাঠ। পার্থিবের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। বাকিদের দ্বিধাপূর্ণ দৃষ্টি দেখে পার্থিব উঠে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বলল, ‘ মিট মায় ওয়াইফ শ্রুতি শিকদার।’

শ্রুতি আরেকটু ঘাবড়ে গেল। সে জানতো না পার্থিব কাজ করছে। প্রতিদিন তো এই টাইমে লাঞ্চ আওয়ার থাকে। তবে আজ কী হলো! পার্থিব হাসিমুখে অনুরোধ স্বরে বলল, ‘ শ্রুতি! আপনি কী একটু বাহিরে বসবেন? আমার কাজ পনেরো মিনিটেই শেষ হয়ে যাবে।’
শ্রুতি দ্রুত মাথা নেড়ে উলটো ঘুরল। পিছন ঘুরতে ঘুরতে শুনতে পেল পার্থিবের কথা,
‘ একচুয়েলি আমার ওয়াইফ জানতো না আমার এক্সট্রা মিটিং এর কথা। আ’ম সো সরি।’

‘ ইটস ওকে। ইটস নট আ বিগ ডিল। লেটস কন্টিনিউ…..?’

‘ শিওর।’

শ্রুতি ওয়েটিং রুমে বসে রইল। বিশ মিনিট পর পার্থিব বেরিয়ে এলো। শ্রুতির সামনে এসে বলল, ‘ সরি। পাঁচ মিনিট লেট হলো।’
শ্রুতি এতোক্ষণ ভয়ে ছিল যে পার্থিব নিশ্চিত তাকে বকা দিবে। অথচ পার্থিব এসে কিনা আদুরে স্বরে কথা বলছে! বকা না খেয়ে শ্রুতির সাহস বাড়ল। পার্থিবের এই অতিরিক্ত ভদ্রগিরি বাড়ি মেরে ছুটাতে ইচ্ছে হলো। এতোই যখন ভদ্র তখন বলতে পারল না কেন যে আজকে তার এক্সট্রা মিটিং আছে? অসভ্য! ভেবেই শুকনো মুখে আগে আগে চলল শ্রুতি।

পার্থিবের কেবিনে গিয়ে বসল দু’জনে। শ্রুতির রাগ দেখে বলল,
‘ আপনি আবার রেগে গেলেন কেন?’

‘ আপনি আমাকে বললেন না কেন যে আপনার কাজ আছে?’

‘ আমি কী জানতাম যে আপনি আসবেন?’ পার্থিবের সরল কণ্ঠ।

‘ ও! এরমানে আমার আসাও ভুল হয়েছে?’

‘ না আমি সেটা…..’

‘ থাকেন আপনি। চলে যাচ্ছি আমি।’

শ্রুতি উঠতে গেলেই পার্থিব কবজি আটকে ধরল। অসহায় মুখে বলল,
‘ সরি। ভুল হয়েছে। প্লিজ যাবেন না।’

‘ ঠিকাছে ঠিকাছে। এতো করে যখন বলেছেন, যাচ্ছিনা। এইভাবে ভুলগুলো মেনে নিলেই তো হয়। নিন, এখন খাওয়া শুরু করুন।’ শ্রুতির রাগী কণ্ঠ।
পার্থিবের হেসে ফেলল। শ্রুতি খাবার সামনে রেখে আগ্রহী কণ্ঠে বলল,
‘ মোরগ-পোলাও। আমি রেঁধেছি।’

‘ আমার জন্য?’ হাসিমুখে বলল পার্থিব।

‘ না। আমার অসভ্য জামাইয়ের জন্য।’

‘ নিন। তাহলে অসভ্য জামাইয়ের হাতে খেয়ে তাকে ধন্য করুন।’
শ্রুতি খুশিমনে পার্থিবের হাতে খেতে লাগল। পার্থিব শ্রুতিকে জ্বালানোর জন্য ফের প্রশ্ন করল,
‘ বললেন না তো না বলে এসেছেন কেন?’

শ্রুতি মধ্যম আওয়াজে ধমকে উঠল,
‘ আমি কী করব আমার আপনাকে ছাড়া ভালো না লাগলে? তাইতো এসে পড়েছি।’

পার্থিব হাসিমুখে শ্রুতির দিকে মুখ এগিয়ে বলল,
‘ প্লিজ এইভাবে প্রতিদিন চলে আসবেন। তাহলে আমার সকাল-রাতের সাথে দুপুরটাও সুন্দর হয়ে যাবে।’
_______
চলবে~
শব্দসংখ্যা – ২৬৭৬
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

৪৮.( অর্ধাংশ)
আমরা জীবনকে উপভোগ করতে শিখিনি। বর্তমানে বসে অতীত নিয়ে আফসোস করি, ভবিষ্যতের চিন্তায় ডুবে থাকি। বর্তমানটাকে কখনো উপভোগ করিনা। অথচ এই বর্তমান সময়ই ভবিষ্যতের সোনালী অতীত। প্রকৃতপক্ষে, জীবনের সকল মূহুর্তই আলাদা ধরনের সৌন্দর্য নিয়ে আসে। তাই আমাদের উচিত প্রতিটা মূহুর্তকে নিজের মাঝে ধারণ করা যাতে পরে আফসোসের সুযোগ না থাকে।

নিজের আড়াই মাসের সন্তানকে কোলে নিয়ে বসে আছে বিভা। সারাদিন দাদীর কোলে, দাদার কোলে ঘোরে তার রাজপুত্র। এছাড়া শ্রুতি, পার্থিব, হামিমের আসা-যাওয়া তো আছেই। আর বাপ বাসায় থাকলে তো কথাই নেই। এতোকিছুর মাঝে নিজের বাবাটাকে নিজেই কাছে পায়না; শুধু খাওয়ানোর মূহুর্ত ছাড়া।
বিভা তাকাল মাহতিমের দিকে। মাহতিম বিভার গলায় নিজের টসটসে গালের ভার দিয়ে রাজকীয় নিদ্রায় মগ্ন। বিভা হাসিমুখে চেয়ে রইল নিজের কলিজার টুকরার দিকে। না টুকরা নয়, পুরো কলিজাটাই। কী সুন্দর করেই না শ্বাস নিচ্ছে বাচ্চাটা! বাচ্চার শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজেও বুঝি হৃদয়ে এতো প্রশান্তি মেলে? বিভা তার মাহতিম বাবার মাথায় নিজের গাল ঠেকিয়ে দিল। মাথার মাঝে ছোট্ট করে একটা চুমু খেল। বাচ্চাটা ঘুমিয়ে গেছে সেই কখন! তবুও শুইয়ে দিতে মন চাচ্ছে না। এই যে গালটা তার বুকের সাথে লাগিয়ে ঘুমিয়ে আছে, এই ছোঁয়াতে কতো যে শান্তি তা বিভা কাউকে বোঝাতে পারবেনা। এই নির্মল ছোঁয়ার লোভেই তো সে খাটে শুয়াচ্ছে না।
মাহথির ঘরে ঢুকেই বিভার আসন পাতা কোলে মাথা রাখল। মাহাথিরের এমন কান্ডে বিভা মাহাথিরের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। এরপর বলল,
‘ আপনার কী মন খারাপ?’

মাহাথির শুয়ে থাকা অবস্থাতেই বিভার দিকে মুখ ঘুরিয়ে ‘হ্যাঁ’ বোধক মাথা নাড়ল। বিভা হাসিমুখে কিছুটা মলিনস্বরে বলল,
‘ মন খারাপ কেন আপনার?’
‘ কারণ তুমি।’
‘ আমিই?’
‘ তুমি আমাকে আগের মতো ভালোবাসোনা বিভা।’ শান্তভাবে বলল মাহাথির।
বিভা কপালে ভাঁজ ফেলল,
‘ আপনার এমন কেন মনে হলো?’
মাহাথির ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ কারণ তুমি এমন করছো তাই। সারাদিন শুধু মাহতিম, মাহতিম। মাহতিম কে পেয়ে মাহথিরকে ভুলে গেছো। ভুলে যেয়োনা আমি মাহতিমের আব্বু। সবার আগে আমার যত্ন বেশি বেশি করা উচিত তোমার।’
বিভা মাথানিচু করে মাহাথিরের কপালে দু’টো চুমু খেল। হেসে বলল,
‘ দিনদিন পাগল হচ্ছেন আপনি।’
মাহাথির কিছু বললনা। মাথাটা কোলে ভালোমতো রেখে কোমড় জড়িয়ে রইল।

বেশ কিছুক্ষণ বাদে ঠান্ডা কণ্ঠে মাহাথির প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘ আমাকে প্রতি তোমার অভিযোগ হয়না?’

মাহাথিরের এমন প্রশ্নে বিভার মুখটা মলিন হয়ে এলো। বলল,
‘ এমন করে বলছেন কেন?’

‘ হওয়া স্বাভাবিক। কারণ আমি তো তোমার সাথে এতো বেশি দুর্ব্যবহার করেছি যে আমার নিজের মনে পড়লেই নিজের কাছে ছোট হয়ে যাই।’

বিভা মাহাথিরের কথার মাঝেই মাহতিমকে বিছানায় শুইয়ে দিল। বসে থাকা অবস্থাতেই কোলে থাকা মাহাথিরের মুখকে দু’হাতে ধরে একে একে চুমু খেল সারা মুখমণ্ডলের প্রতি অংশে। ধীরে ধীরে বলল,

‘ আমি আপনাকে ভালোবাসি মাহথির। আপনার ভালো খারাপ মিলিয়েই আপনাকে ভালোবাসি। আপনার গুণকে যেমন ভালোবাসি, দোষকেও ভালোবাসি। ভালোবাসায়, সম্পর্কে একটু বাঁধা-বিপত্তি থাকা ভালো। এতে সম্পর্ক মজবুত হয়।

আর কখনো নিজেকে এভাবে দোষারোপ করবেন না। নিজের কাছে নিজে ছোটও হবেন না। আপনি দোষ করলে, আমিও আপনাকে শাস্তি দিয়েছি। আপনাকে কষ্ট দিয়েছি। তবুও তো আপনি আমাকে আগলে রেখেছেন। তাইনা? ভালোবেসে নিজের বউ এর অভিমান ভাঙিয়েছেন। আর কী চাই? আমি তো আপনাকে পেয়ে আল্লাহর কাছে সবসময় শুকরিয়া আদায় করি। এমনি এমনি করি নাকি?
তবে হ্যাঁ ইদানীং কিন্তু আবার কম ভালোবাসা শুরু করেছেন আপনি।’

বিভা প্রথম কথাগুলো বেশ গুরুতর ভঙ্গিতে বললেও শেষ বাক্যটি বলল কপট অভিমানী, রাগী গলায়।

মাহাথির আরোও গভীরভাবে জড়িয়ে নিয়ে চোখ তুলে শান্ত গলায় বলল,
‘ মাহতিমের বোন আনার ব্যবস্থা করলে চলবে?’

বিভার চোখ বড় হয়ে গেল। কোল থেকে মাথা নামিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘ মোটেও চলবেনা। আগে একজনকে সামলান। এরপর অন্যজনের চিন্তা কল্পনায় আনেন।’

বিভা উঠে গেল। বলল, ‘ রাতের রান্না করতে গেলাম আমি। আপনি বাবুর পাশে শুয়ে থাকেন।’

মাহাথির হতাশার শ্বাস ফেলে ছেলের দিকে চাইল। এক আঙুলে গাল নাড়িয়ে দিল। এরপর কপালে চুমু খেয়ে গোল পেটে চুমু খেল। মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ মা-বাচ্চা মিলে আমাকে পাগল করে দিচ্ছো তোমরা। কাজ-বাজ ফেলে সারাদিন তোমাদের কাছে থাকতে মন চায়।’

মাহাথির ছেলের ছোট মুখের কাছে নিজের মাথাটা আরেকটু বাড়াল। তার ছেলে যেন ভীষণ মনোযোগ দিয়ে শুনছে, এমন ভঙ্গিতে বলল, ‘ বুঝেছো আব্বু! চাকরিটা ছেড়ে দিব। এরপর তিনজন মিলে রাস্তায় ভিক্ষা করব। এতে করে তোমাদের সারাদিন চোখের সামনে দেখতেও পাব, আবার আয়-রোজগারেরও একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বুদ্ধিটা কেমন লাগল বাবা?’
মাহাথির জানে তার ছেলে ঘুমিয়ে। তবুও এমনভাবে প্রশ্ন করল যেন এখনি মাহতিম প্রফুল্লকণ্ঠে বলে উঠবে, ‘ বুদ্ধিটা চমৎকার লেগেছে আব্বু।’
মাহাথির ছেলের পেটে কিছুক্ষণ হাত বুলাল। গায়ের উপর এক হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করল। সে তার ছেলের সাথে ভীষণ আজগুবি কথা বলে। এমন আজগুবি কথা অন্যদের সাথে সে বলতে পারেনা। অন্যদের বেলায় আজগুবি দূর, প্রয়োজনীয় কথাই বেরোয় না মুখ দিয়ে। না আজগুবি নয়! আজগুবি হবে কেন? সে তার ছেলের সাথে অবশ্যই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ আলাপ করে। মাহাথির ভাবল, এইভাবে এতোক্ষণ একা একা কথা বলা ঠিক হলোনা। বাচ্চাটা জেগে থাকা অবস্থায় বলা উচিত ছিল। তখন ওর অঙ্গভঙ্গি, হাত-পা ছোঁড়া থেকে উত্তর খুঁজে নেওয়া যেত যে বাবার আইডিয়া তার পছন্দ হয়েছে কিনা।

.
কাজের চাপে মাঝখানে চার দিন শ্রুতিকে নিয়ে বিভার বাড়িতে যেতে পারেনি পার্থিব। শ্রুতিও একা যেতে পারেনি শাশুড়ির অসুস্থতায়। মাহতিমকে না দেখে পার্থিবকে পাগল করে তুলেছে শ্রুতি। পার্থিবও নিজের বউ এর আবদার ফেলার মতো পুরুষ নয়। তাই আজ সকাল-সকালই বেরিয়ে পড়তে চাইছে দু’জনে। সাথে হামিমও যাবে। অগত্যা তৈরি হয়ে নিচে নেমে এলো তিনজন। হামিম এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। হাঁটাচলায় মোটেও অসুবিধা হয়না। এছাড়া সে স্কুলেও ভর্তি হয়েছে। পার্থিব নিজ দায়িত্বে করিয়েছে। স্কুলে ভর্তির সময় ছোট-খাটো প্রশ্ন-উত্তর পর্ব চললে হামিম ভালোই উত্তর দেয়। তার উত্তর সাপেক্ষে তাকে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করানো হয়েছে; যদিওবা তার বয়স অনুযায়ী তাকে ক্লাস টু কিংবা থ্রি তে ভর্তি করানো উচিত ছিল। তবুও সে যেহেতু সব একটু কম বোঝে তাই ক্লাস ওয়ানেই ভর্তি হয়েছে।

শ্রুতি নিচে নামতেই তানহা এগিয়ে এলো। তানহা বেগম কিছু বলবে তার আগেই শ্রুতি উদগ্রীব হলো, ‘ জ্বর সেরেছে মা?’

তানহা বেগম সরল কণ্ঠে বলল, ‘ আমার পুত্রবধূর এমন যত্ন-আত্তিতে না সেরে পারে? জ্বরও তোমাকে ভয় পেয়েছে।’

শ্রুতি হেসে ফেলল। তানহা বললেন,
‘ মা, তোমার বাবা ফোন করেছিল। ফোন করে বলল তোমরা বাসায় কি-না। আমি বলেছি তোমরা বিভার বাসায় যাচ্ছো। এরপর শুধু ওহ বলে রেখে দিল।’

শ্রুতি শুনে তেমন প্রতিক্রিয়া দিল না। কথাটাকে ঝেড়ে ফেলার মত বলল, ‘ বাদ দিন, মা। দিয়েছে এমনিই। আমরা তাহলে যাই?’

‘ পার্থিব, হামিম কই?’

‘ ওরা আসছে। গেলাম হ্যাঁ? সাবধানে থাকবেন। যা কাজ আছে দ্রুত শেষ করে রেস্ট নিন।’

তানহা বেগম হাসিমুখে বিদায় জানাল শ্রুতিকে।

শুক্রবার হওয়ায় মাহথির আজ বাসায়। সবাই মিলে একসাথে দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করল। তবে হাসিনা-সিদ্দীক সাহেব আজ বাড়িতে নেই। ঢাকায় এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে গেছে। মাহাথির দিয়ে এসেছে দু’জনকে। আজ হয়তোবা থাকবে। নয়তো মাহাথির গিয়েই নিয়ে আসবে।
সবার খোশগল্পের মাঝে সবচেয়ে ছোট সদস্য একটা ভয়ংকর কাজ ঘটিয়ে ফেলল। সে তার ছোটআব্বুর কোলে নির্দ্বিধায় মূত্র ত্যাগ করে বসল। ব্যাপারটা পার্থিবের বোধগম্য হতেই বাচ্চাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। ওমনি পার্থিবের অবস্থা সকলের চোখে ধরা পড়ল। শ্রুতি তার স্বামীর অবস্থায় হেসে ফেলল। হাসিমুখে ব্যঙ্গ করে বলল, ‘ একদম ঠিক হয়েছে। এটা হলো আমার থেকে কেড়ে নেওয়ার ফল।’

পার্থিবও হাসিমুখে উত্তর দিল,
‘ সমস্যা নেই। ওর ছোটআব্বু লাগি আমি। এতোটুকু করার অধিকার তো ওর আছেই।’

হাসিমুখে শ্রুতি বড় করে শ্বাস ফেলল। এই মানুষটাকে রাগানো তার কাজ নয়। রাগ জিনিসটা কী তা হয়তো জানেই না সে।
পার্থিবের অবস্থায় বিভা একটু ভড়কে গিয়ে মাহাথিরকে কোলে নিতে বলল বাচ্চাটাকে। তবে মাহাথিরের মাঝে তেমন হেলদোল লক্ষ্য করা গেল না। তার হাবভাবে প্রকাশ পাচ্ছে, মূত্র ত্যাগ খুবই সামান্য একটি বিষয়। এটা নিয়ে এতো হাউকাউ করার অর্থ হয়না। মাহাথির দাঁড়িয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ‘ চলো, একটা ড্রেস দেই। এইটা তো ভিজে গেল।’
পার্থিবের থেকে মাহতিমকে নিজের কোলে নিয়ে ঘরের দিকে পা বাড়াল দু’ভায়রা ভাই।
.

বিভা-শ্রুতি হতভম্ব মুখে তাকিয়ে আছে আমিন সাহেবের দিকে। সন্ধ্যাবেলায় সবাই মিলে হালকা নাস্তার পাশাপাশি ফানি মুভি দেখছিল। ঠিক তখনি বেল বাজে। শ্রুতি গিয়ে দরজা খুলে দেখে আমিন শিকদারকে। শ্রুতি বিভিন্ন প্রশ্ন ছুঁড়ে যে, এখানে কেন এসেছে, কী চায় সে। সেগুলোর একটি প্রশ্নের উত্তরও আমিন সাহেব দেয়না। হাসিমুখে বলে, ‘ ভেতরে ঢুকে বাকি আলাপ করি?’
শ্রুতি কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারেনা। এরপর ভেতরে ঢুকলে তাকে দেখে সবাই ভীষণ অবাক হয়। আমিন সাহেব কারোর ধার ধারলেন না। সে নিজের মতোই সোফায় গিয়ে আয়েশ করে বসলেন। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো, সে এই বাড়ির ভীষণ কাছের কেউ। প্রতিনিয়তই যেন এই বাড়িতে তার আনাগোনা আছে।

আমিন সাহেবকে শান্তিতে বসতে দেওয়া হলোনা। শ্রুতি-বিভা নানা প্রশ্ন শুরু করল। তবে আমিন সাহেব তার কোনো উত্তর দিল না। শান্তভঙ্গিতে মাথা নিচু করে রইল। বিভা-শ্রুতি দু’জনেই ভালোভাবে লক্ষ্য করল আমিন সাহেবকে। আগের তুলনায় বেশ রোগা হয়েছে। মুখে মলিনতা। আগে চালচলনে যেমন তার ব্যক্তিত্ব পরিস্ফুটিত হতো, আজ তেমন কোনো ব্যাপার নেই। কেমন যেন খাপছাড়া, অগোছালো ভাব ভেসে উঠছে। বেশকিছুক্ষণ বাদে মাথা তুলল আমিন সাহেব। বলল, ‘ আমাকে এতো প্রশ্ন করছিস কেন তোরা? এই বাড়িতে আসতে পারিনা আমি?’

প্রশ্নটা ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে বলল আমিন শিকদার। যথাসাধ্য চেষ্টা করল অস্বস্তি প্রকাশ না করে আন্তরিকতা প্রকাশ করতে। তবে সক্ষম হলো কিনা কে জানে! আসলে দূরত্ব এতো বেড়ে গেছে যে স্বাভাবিক কথা বলতেও লজ্জারা এসে জেকে ধরছে।

আমিন শিকদারের এমন কথা শুনে কেউ তেমন প্রতিক্রিয়া দিল না। বিভা-শ্রুতি তাদের বাবার পরবর্তী কাজের অপেক্ষায়। পার্থিব-মাহাথির আমিন শিকদারকে নিয়ে কিছু ভাবলোই না। এখানে তাদের কিছু বলা মানায় না। তাই দু’জনে নিরব থাকাকেই বাঞ্ছনীয় মনে করল। এছাড়া আমিন সাহেবকে দেখে হামিমেরও তেমন কোনো বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।

নিরবতায়ই পার হলো বেশকিছু মূহুর্ত। এরপর সবাইকে অবাকের সর্বোচ্চ চূড়ায় বসিয়ে আমিন সাহেব বলতে লাগল ভীষণ আবেগঘন কথা। তার কথা শুরু হলো নিজের জীবন থেকে। শেষ হলো নিজের সকল অন্যায়ের স্বীকারোক্তি দিয়ে। তার কথার সারমর্ম এই যে — সে তাহিরা, বিভা, শ্রুতি, হামিম, নিজের মা সকলের সাথেই ভীষণ অন্যায় করেছে। হাসিনার ঘরের ছেলেদের নিজের ছেলের মতো ভেবে আরোও বেশি ভুল করেছে। ঘোর অন্যায় করেছে।

আমিন সাহেবের কথার মাধ্যমে প্রকাশ পেল তার অভ্যন্তরীণ যন্ত্রণা এবং অপরাধবোধ। অস্বস্তিকে দূরে ঠেলে নিজের মনের সকল কথা প্রকাশ করে নিজেকে হালকা করল সে।
বিভা, শ্রুতি নির্লিপ্ত মুখে চেয়ে রইল তার দিকে। আমিন সাহেব জানেন কেউ তাকে মূল্য দেবে না। তাই সেই আশা না করেই তিনি নিজের মনের সকল কথা উগড়ে দিতে চাইল। এতে অন্তত নিজেকে হালকা করে বাসায় ফেরা যাবে। নয়তো এতো এতো দোষ, অপরাধ, অন্যায়ের স্মৃতির যন্ত্রণায় হয়তো তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবেনা। আমিন সাহেব ভাবল, পরে যা হবে দেখা যাবে। এই মূহুর্তে তার মন হালকা করা জরুরি। ধীরভাবে বলল,

‘ আমি বুঝতে পারছি যে এই সময়ে এসে এসব কথা তোমাদের কাছে নিছকই হাস্যকর লাগছে। লাগাও স্বাভাবিক। তবে আজ আমি নিজের কাছেই হেরে যাওয়া এক ব্যর্থ মানুষ। আমি এখন প্রতিনিয়ত নিজের অপরাধবোধে ভুগি। নিজের অন্যায়গুলো প্রতি মূহুর্তে ভেসে ওঠে চোখের সামনে। কিন্তু কিছু করতে পারিনা। আসলে কাজই করেছি এমন! তার শাস্তিই দিচ্ছে আল্লাহ।’ নিজের প্রতি নিজেই তাচ্ছিল্য করে উঠল আমিন সাহেব।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে লাগল,
‘ জীবনের এই পর্যায়ে এসে খুব আফসোস হচ্ছে। মনে হচ্ছে এতোদিন মরীচিকার পিছনে ছুটে নিজের সুখে মোড়ানো জীবনকে আমি পায়ে পিষেছি। আমার ভরা সংসারকে ভরাডুবি করেছি। এসব ভাবলেই বুকে ভীষণ যন্ত্রণা হয়। নিজের গায়ে থুথু ছেটাতে ইচ্ছে করে। গুমরে গুমরে মরি। তবে সেসব কাউকে বলতে পারিনা। তাই লাজ-লজ্জার কথা ভুলে এসেছি তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইতে। বিভা মা, শ্রুতি মা আমাকে ক্ষমা করো তোমরা। জীবনে যা করেছি তা হয়তো ক্ষমার যোগ্য নয়, তবুও…..’

‘ আর কিছু বলার আছে আপনার?’ বিভা ঠান্ডা গলায় শুধাল। আমিন সাহেব মনের দুর্বলতা আর প্রকাশ করল না। বলল,
‘ বিভা তুই…..’

‘ আর কিছু বলার আছে?’

আমিন সাহেব মাথা নিচু করে বলল,
‘ নেই।’

‘ ঠিক আছে। টেবিলে খাবার দিচ্ছি আমি। খাবার খেয়ে চলে যান তাহলে।’ স্বাভাবিকভাবে বলল বিভা।

আমিন সাহেব চোখ তুলে তাকাল। অপমানজনক একটা কথা কতো সুন্দর করেই না বলে দিল তার বড় মেয়ে। অবশ্য সেও তো বলতো। বিভাকে বলত, শ্রুতিকে বলত। তাহিরাকে বলত। তাহিরাকে শাহিনার সাথে তুলনা করে পৈশাচিক আনন্দ পেত। আমিন সাহেব তো সম্মান পাওয়ার মতো কোনো কাজ করেনি। কারোর সাথেই করেনি। তাহলে আজ এসব ভাবছে কেন? তার মাথাটা নিচু হয়ে গেল আপনা আপনি।
শ্রুতি মাথা নিচু করে আছে। আজ আমিন শিকদারকে দেখে তার রাগ লাগছে না, অসহ্যও লাগছে না। বরং অন্যরকম এক খুশি লাগছে। আমিন শিকদারের এই অনুশোচনায় তৃপ্তি পাচ্ছে সে। নিজের মৃত মায়ের কথা ভেবে তৃপ্তিতে বুক ভরে উঠছে। মনে হচ্ছে, এইতো তার মায়ের বিচার হলো। প্রকৃতি বিচার করল। আমিন শিকদারের নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার চেয়ে বড় বিচার আর কী হতে পারে? তাও যেন মনটা শান্ত হচ্ছেনা। আমিন শিকদারের চোখের ভাসা পানি মানতে কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে, তার বাবা এমন না হলেও তো পারত। এতো এতো অন্যায় না করলেও তো পারত। তাহলে নিশ্চয়ই আজ ছেলেমেয়েদের সামনে মাথানিচু করে থাকতে হতোনা?

বিভা ভীষণ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে রান্নাঘর থেকে একটা বোল এনে টেবিলে রাখল। আমিন সাহেব উঠে দাঁড়াল। ভীষণ অসহায় হয়ে বলল, ‘ আমি কিছু খাবনা। আমি চলে যাচ্ছি।’
এমন কথায় শ্রুতির বুকটা ধ্বক করে উঠল। সে অনুভব করল, এতোকাল যাবত যে বাবাকে সে ঘৃণা করে এসেছে, আজ তার জন্যই চোখ ভরে উঠছে।
বিভা তখনো নিশ্চুপ, নির্বিকার। তার কোনো হেলদোল নেই।

আমিন সাহেব মাহতিমকে দেখে বলল,
‘ আমি একটু কোলে নেই আমার নানাভাইকে?’
বিভা হাসল সামান্য। বলল, ‘ ও আপনার কোনো নানাভাই নয় আমিন শিকদার। ও আপনার জন্য জাস্ট সাধারণ একটা বাচ্চা। আর ওর সাথে আপনার কোনো লেনদেন নেই। তাই কোলে না নিলে খুশি হব।’

এমন কথার উত্তর কী দিতে হয়, তা আমিন শিকদারের জানা নেই। তার বড় মেয়ের এমন কাঠিন্যে নিজেকে অনেক তুচ্ছ কেউ মনে হচ্ছে। এতোই তুচ্ছ যে, নিজের নাতিকে কোলে নেওয়ার অধিকারও তার নেই। নিজের প্রতিই নিজের ভীষণ হাসি পাচ্ছে আজ। আমিন সাহেব ভাবলেন চলে যাবেন। তাই কৃত্রিম হাসিমুখে নিম্নস্বরে বলল,
‘ ঠিকাছে, তোমাদের আর বিরক্ত করছি না। চলে যাচ্ছি আমি।’
আমিন সাহেবের চোখে পড়ল হামিমকে। চলে যেতে নিয়েও গেলেন না। গত দুই/এক মাসে অনেককিছুই শুনেছিল সে। বিভার সন্তান হওয়া, হামিমের অপারেশন হওয়া। তবুও চক্ষুলজ্জায় আসতে পারেনি। আমিন সাহেব ভীষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করল নিজের ছেলেকে। এই তো তার ছেলে। হামিম। সেই হামিম যার জন্মের পর সে কোলে নিলেও, আদর করলেও তেমনভাবে কাছে টানেনি কখনো। তাহিরার মৃত্যু, শাহিনাকে বিয়ে – সবকিছুর ঝামেলায় ছেলেকে ভুলেই গেছিল সে। আর যখন এক বছর বাদে সে নিশ্চিত হলো, তার ছেলে শারীরিক প্রতিবন্ধী, পায়ে সমস্যা, হাঁটতে পারবেনা। তখন যেন আরোও ভালোভাবে মন উঠে গেল ছেলের উপর থেকে। তার উপর তখন সে সদ্য দ্বিতীয় বিবাহ করেছে!

স্নেহপূর্ণ কণ্ঠে হাত বাড়িয়ে আমিন ডাকল,
‘ হামিম, এদিকে আসো।’
হামিম গোল গোল চোখে চেয়ে রইল। আমিন সাহেব আবারো ডাকল, ‘ হামিম, এদিকে আসো। মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেই।’
হামিম গেল না। সে পার্থিব আর মাহাথিরের মাঝে ছিল। দুই হাত দিয়ে মাহাথির এবং পার্থিবের এক বাহু করে দু’বাহু টেনে ধরল। দু’হাতের আড়ালে নিজেকে লুকাতে চাইল। যে কেউ দেখলেই বুঝবে যে হামিম আমিন শিকদারের কাছে যেতে ইচ্ছুক নয়। আমিন সাহেবও বুঝল। তা দেখে হাপ ছাড়ল। এইসবই তো হওয়ার ছিল। সে নিজেই সবাইকে দূরে সরিয়েছে। তাহলে আজ তাদের সান্নিধ্য কেন চাইছে?

আমিন সাহেব দরজার দিকে গেলে বিভা ডাকল, ‘ দাঁড়ান, আমিন শিকদার।’

আমিন ঘুরল। বিভা বলল, ‘ আপনার জন্য একটা জিনিস রেখে দিয়েছি। নিয়ে যান।’

বলেই বিভা নিজের ঘরে চলে গেল। ফিরে এলো কিছুক্ষণ পরই। হাতে ছোট একটা শপিং ব্যাগ। বিভা বাড়িয়ে দিল আমিন শিকদারের দিকে। হাসিমুখে বলল,
‘ এই নিন। আপনার জন্য সামান্য উপহার। অনেকদিন যাবত রেখে দিয়েছিলাম নিজের কাছে। আমি জানতাম এমন এক দিন অবশ্যই আসবে। আজ এসেছে। আপনি নিয়ে যান।’

‘ কী আছে এতে?’

‘ আপনার জন্য তেমন বিশেষ কিছু নয়। আমার মায়ের ডায়েরির কিছু পাতা।’

আমিন সাহেবের দৃষ্টি বুঝে বিভা নিজেই বলল, ‘ আমার মায়ের ডায়েরি আমার জন্য ভীষণ মূল্যবান। ডায়েরি ভর্তি আছে আমার মায়ের মূল্যবান অনুভূতি। সেই মূল্যবান অনুভূতির মধ্যে আপনার জন্য লেখা অনুভূতি পড়তে আমার ভালো লাগেনা আমিন শিকদার। তাই সেই পেজ আমি ছিঁড়ে ফেলেছি। ছিঁড়ে রেখে দিয়েছিলাম আপনার জন্য। আজ মনে হচ্ছে এই পাতাগুলো আপনাকে দেওয়ার সঠিক সময়। তাই দিচ্ছি। নিয়ে যান।’

আমিন শিকদার হাত বাড়িয়ে নিল। এতোকিছুর মাঝে বার বার বিভার বলা
‘আমিন শিকদার’ সম্বোধনে ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে গেল। আব্বু ডাক শোনার জন্য ভেতরটা হাহাকারে ছেয়ে গেল। ছোটবেলায় কতো সুন্দর করেই না ডাকত দু’জনে। নিশ্চুপে চলে যেতে নিয়েও গেল না সে । মলিন কণ্ঠে বলল,
‘ বাবা হিসেবে শেষ একটা আবদার করি? আমাকে একবার আব্বু বলে ডাকবি তোরা?’

বিভা যেন বুঝেনি এমন ভাবে বলল,
‘ কাকে ডাকতে বলছেন? আমাকে, শ্রুতিকে, হামিমকে?’

______
চলবে~
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

৪৮. (বাকি অংশ)
আমিন শিকদার হাত বাড়িয়ে নিল। এতোকিছুর মাঝে বার বার বিভার বলা
‘আমিন শিকদার’ সম্বোধনে ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে গেল। আব্বু ডাক শোনার জন্য ভেতরটা হাহাকারে ছেয়ে গেল। ছোটবেলায় কতো সুন্দর করেই না ডাকত দু’জনে। নিশ্চুপে চলে যেতে নিয়েও গেল না সে । মলিন কণ্ঠে বলল,
‘ বাবা হিসেবে শেষ একটা আবদার করি? আমাকে একবার আব্বু বলে ডাকবি তোরা?’

বিভা যেন বুঝেনি এমন ভাবে বলল,
‘ কাকে ডাকতে বলছেন? আমাকে, শ্রুতিকে, হামিমকে?’

আমিন সাহেব পলক ফেলতে লাগল। বিভা রহস্য করে বলল, ‘ আমাদের তো বাবা নেই আমিন শিকদার। তাহলে বাবা ডাকব কাকে? আমাদের বাবা নেই। এক রাতে আমি, শ্রুতি, আম্মু আমরা সবাই মিলে আমাদের বাবাকে খুন করে ফেলেছি। এরপর তাকে দাফনও দিয়ে দিয়েছি রাতের অন্ধকারে। বাবা মারা গেছে অনে….ক বছর হয়। আমরা সত্যিটা মেনে নিয়েছি। আপনিও মেনে নিন। আর ওইযে দেখেন হামিম। আপনার থেকে লুকাতে চাইছে। হামিমও আপনাকে বাবা বলে ডাকবেনা। কারণ ওর দুনিয়া জুড়ে কোথাও আপনি নেই আমিন শিকদার। আমি থাকতে দেইনি।’ ধীরকণ্ঠে নিজের কথা শেষ করল বিভা।

আমিন শিকদার চারপাশ ভুলে নিজের মেয়ের কথা শুনল। কেমন ভয়ংকরভাবে ধীরকণ্ঠে কথাগুলো বলছে বিভা! কণ্ঠে নিস্তব্ধতার সাথে যেন ঘৃণা ঝরে পড়ছে। এমনভাবে বলছে যেন সত্যি সত্যিই সে আমিন শিকদারকে নিজের হাতে খুন করেছে। হ্যাঁ খুন তো করেছেই। বাস্তবিকভাবে না হলেও অদৃশ্যভাবে।

বিভা তাচ্ছিল্য হাসল নিজের বাবার নিচু মাথা, মলিন, অসহায় মুখ দেখে। ধীরকণ্ঠে কিছুটা উপহাস মিলিয়ে শুধাল,
‘ আজ খুব বাবা ডাক শুনতে ইচ্ছে করছে?’

এইবার আমিন শিকদারের চোখ গলিয়ে পড়ে গেল উত্তপ্ত এক অশ্রুকণা। বিভা এগিয়ে গিয়ে হাত টেনে আনল শ্রুতির। বলতে লাগল,
‘ দেখেন তো চিনেন কিনা। আপনার ছোট মেয়ে। শ্রুতি। চিনতে পারছেন আমিন শিকদার? ছোট থাকতে আপনার পিছন পিছন ঘুরত। আপনার পাঞ্জাবি, জামা সব ধরে টানাটানি করত কোলে ওঠার জন্য। দিনের চব্বিশ ঘন্টায় চব্বিশ হাজারবার আব্বু আব্বু করার জন্য আমি নিজেই ওকে একদিন খুব ধমকেছিলাম বিরক্তিতে। ও আপনার একটু ভালোবাসা, আদর চাইত। কিন্তু কই আপনি তো করেননি। আপনার চোখে ছিল ও খুবই তুচ্ছ একটা বস্তুর মতো। কারণ ও মেয়ে, তার উপর দ্বিতীয় মেয়ে। আবার কালো। কালো রঙ তো আপনার চোখের বিষ। একারণেই তো এতোকিছুর পরেও ওর দিকে আপনি ফিরেও তাকাননি। সবসময় ব্যস্ততা দেখাতেন। আম্মুকে সামলাতে বলতেন ওকে। ঠিক বললাম না? মনে পড়ে সব?’

বিভা হেসে ফেলল নিজের কথায়। বলতে লাগল, ‘ কতোবছর পেরিয়ে গেছে। অথচ আজও দেখুন শ্রুতি নিজেকে সামলাতে পারেনা। এই দেখুন ওর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। দেখুন….
কেন পড়ছে বলুন তো? আপনার জন্য। আপনার কষ্ট দেখে।
ও সবসময় চাইতো একটা সুন্দর পরিবার। যেখানে ও সবাইকে ভালোবাসবে, সবাই ওকে ভালোবাসবে। তাইতো ছোট থেকেই এমন অবুঝ ছিল। ধীরে ধীরে বড় হয়ে যখন বুঝল এসব কিছু হবেনা তখন থেকে নিজের মধ্যে কঠিন হতে চাইল। কিন্তু পারল না। সেই দুর্বলই রয়ে গেল। আপনার উপর রাগ, ঘৃণা, বিরক্তি থেকে একটু চিৎকার-চেঁচামেচি করত এই যা। কিন্তু উপরে উপরে হাজার শক্ত থাকলেও ভিতরে ছিল শুধুই দুর্বলতা। তাইতো এখনো আপনার জন্য ওর চোখে পানি। কিন্তু ওর দুর্বলতা আপনি কখনো দেখেননি আমিন শিকদার। সারাজীবন শুধু ওকে খারাপ কথা শুনিয়েছেন। ওকে হারাতে চেয়েছেন। ও মায়ের কথা শুনলে কাঁদে, একারণে আপনি ওর সাথে না পারলে সবসময় নিজের মৃত স্ত্রীকে টেনে এনেছেন। নিজের মেয়েকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবেছেন। আমার কথা, হামিমের কথা নাহয় বাদ’ই দিলাম। এতোসব কিছুর পরে আব্বু ডাক শুনতে চাওয়া আমার কাছে নিছকই কোনো মজার কথা ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছেনা।’

আমিন শিকদার লক্ষ্য করলেন তার শরীর কাঁপছে। এতোদিন নিজের মধ্যে অনুশোচনা থাকলেও, নিজের মেয়ের মুখ থেকে আসা এমন কঠিন কথা তাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। ভেতরের সবকিছু যেন ভীষণ আওয়াজ তুলে ভেঙে পড়ছে।

বিভা ভীষণ ক্লান্ত গলায় বলল,
‘ আমরা আপনাকে বাবা ডাকবনা আমিন শিকদার। কখনো, কোনোদিনো ডাকবনা। আমার শ্বশুর আছে। যাকে আমি আব্বা বলি। সে আমাকে ভীষণ স্নেহ করে। শ্রুতির শ্বশুর তো ওকে নিজের মেয়ের মতো আদর করে। বাবা যেমন তার আদরের কন্যাকে চোখে হারায় ঠিক সেভাবেই শ্রুতিকেও আংকেল চোখে হারায়। শ্রুতি ভীষণ সুন্দর করে তাকে বাবা বলে ডাকে। শুধু এখানেই থেমে নেই। সৃষ্টিকর্তাও হয়তো আমাদের বাবার অভাব বুঝেছিল। তাইতো আমার কোলজুড়ে আমাকে একটা বাবা দিয়েছে। আমাদের অনেক বাবা আছে আমিন শিকদার। এতো এতো ভাবার ভীড়ে কোথাও আপনি নেই। আমাদের আপনাকে চাইনা। একটুওনা চাইনা।’

আমিন শিকদার নিজের মেয়ের দিকে চেয়ে রইলেন। বিভার কাঁপা ঠোঁটের কথা, চোখ থেকে পড়া বড় বড় অশ্রুকণা দেখে মনে হলো এই দুনিয়ায় তার থেকে নিকৃষ্ট কোনো মানুষ নেই। হতে পারেনা।

বিভা আবারো বলতে শুরু করল,
‘ আমরা আপনাকে ছাড়া অনেক ভালো আছি আমিন শিকদার। অনেক ভালো আছি। আমাদের যখন আপনার সবচেয়ে প্রয়োজন ছিল তখন আমরা আপনাকে পাইনি। এখন আল্লাহ আমাদের অনেক ভালো রেখেছে। তবে আমরা ভালো থাকলেও ভালো ছিলনা আমাদের মা। আজ আপনাকে দেখে আমার একটুও খারাপ লাগছেনা বিশ্বাস করুন। কারণ আমার মা যতো কষ্ট, যন্ত্রণা সহ্য করে এই দুনিয়া ত্যাগ করেছে তার একাংশও আপনি এখনো অনুভব করেননি। আমি এখনো চোখ বন্ধ করলে আমার মায়ের চিৎকার শুনি। হাহাকার ভরা মুখ ভেসে ওঠে চোখের সামনে। তার দিনগুলো কেমন যন্তণাময়, দুর্বিষহ কাটত তা যদি আপনি জানতেন!

তবে আমি খুশি আমার মা মারা যাওয়াতে। এমনিতেও বেঁচে থেকে আপনার দ্বিতীয় সংসার দেখে আমার মা মারা যেত নিঃসন্দেহে। তার থেকে ভালো আল্লাহই নিয়ে গেছেন। ভালোই করেছে। আমি আসলে এই ভেবেই খুশি যে, আমার মায়ের মৃত্যুর উছিলাও আপনি নন।’

বিভা থামল। নিজের ছেলেকে এনে তুলে দিল আমিন সাহেবের কোলে। বলল,
‘ এতো অনুরোধের মাঝে এই অনুরোধটা রাখলাম শুধু। তবে প্রথম এবং শেষবারের মতো।’

আমিন শিকদার দু’হাতে নিজের নাতিকে আদর করল। কপালে চুমু খেল, মাথায় হাত বুলাল। নিষ্পাপ মুখটা দেখে তার চোখ ভরে উঠল। দু’চোখ বেয়ে পানি একাই গড়িয়ে পড়তে লাগল। বিভা নিয়ে নিল নিজের ছেলেকে। বলল,
‘ আপনাকে কখনো অভিশাপ দেইনি। সবসময় চেয়েছি ভালো থাকুন। আজও চাইছি। আপনি ভালো থাকুন। অনেক ভালো থাকুন। পৃথিবীর সব সুখ, খুশি আপনার হোক। আপনার মনের শান্তির জন্য বলছি, আমরা কেউ আপনার উপর রেগে নেই। ক্ষমা করে দিয়েছি অনেক আগেই। ভালো থাকবেন আপনি। নিজের স্ত্রী, তিন ছেলেকে নিয়ে অনেক ভালো থাকবেন।’

বিভার চোখে পানি নেই। স্বাভাবিক মুখ। নরম গলায় শেষ করল নিজের কথা। আমিন সাহেব শ্রুতির দিকে তাকাল। সাথে সাথে শ্রুতি চোখ নামিয়ে নিল। গালে এখনো পানির ছাপ। আমিন সাহেব সময় নষ্ট করল না। নিজের স্ত্রীর মৃত অনুভূতি নিয়ে উদ্যত হলো চলে যেতে। যেতে যেতে ভাবল আগে সে এবং সবাই বলত তার ছোটমেয়ে ভীষণ কঠিন। এর কারণ শ্রুতির ব্যবহার। তবে আজ সে বুঝতে পারল শ্রুতি আসলেই ভীষণ দুর্বল। অন্যদিকে বিভা। বিভা ভীষণ কঠোর একজন মেয়ে। মুখে কঠিন কঠিন কথা, চিৎকার করলেই কেউ আসলে কঠিন মনের হয়না, যদিনা তার মন কঠিন হয়। তার বড় মেয়ে ভীষণ কঠিন। তার নিরব আচরণই যেন তার কাঠিন্যকে আরোও গাঢ় করে তোলে।

সিড়ি দিয়ে নামছে আমিন শিকদার। বিভার বলা শেষ কথাগুলো কানে বাজছে। নির্মম হলেও বাস্তব, বিভার বলা একটি দোয়াও আর কাজে আসবেনা। কক্ষনো না। সে আর সুখী হবেনা। হতে পারবেনা। সে জানে, তার বাকি জীবন যাবে এই নিদারুণ অনুশোচনা, যন্ত্রণা, হাহাকারে।

বাসার নিচে নামতেই আবারো তিন ছেলেমেয়ের মুখ ভেসে উঠল। ইচ্ছে করল বিভার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে, শ্রুতির চোখের পানি মুছিয়ে দিতে, হামিমকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করতে। কিন্তু কিছুই সম্ভব নয়। কক্ষনো সম্ভব নয়। আচ্ছা, সে পিতা হয়ে ওদের সাথে এমন কীভাবে করেছে? সে তো ওদের জন্মদাতা। সে কী পারতোনা সারাটাজীবন ওদের ভরসার স্থান হয়ে থাকতে?

.
বিভার নির্নিমেষ দৃষ্টি অন্তরীক্ষে। উদাসমুখে চেয়ে আছে সে। জীবনের হিসাব-নিকাশে সব কেমন গোলমাল পেকে যাচ্ছে। সেকি অন্যায় করল আমিন শিকদারের সাথে? একটা মানুষ নিজের ভুল বুঝলে উচিত তাকে ক্ষমা করে দেওয়া। বিভা দিলনা কেন? এতো পাষাণ সে কবে হলো?

পাশেই কারোর উপস্থিতিতে বুঝল মাহাথির এসেছে। মাহাথির বিভার দিকে তাকাল। শান্তকণ্ঠে বলল, ‘ মন খারাপ?’
‘ না।’

মাহাথির জানে বিভার মন খারাপ। ভয়ঙ্কর মন খারাপ। সে বিভাকে নিজের দিকে ফিরাল। বলল,
‘ কষ্টকে চেপে রেখোনা বিভা।’

বিভা মাহাথিরের কথার লুকানো অর্থ ধরে নিল। আস্তে করে এগিয়ে সে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা ঠেকিয়ে দিল। মাহাথির শক্ত করে আগলে নিল তাকে। মাহাথির জানে বিভা কাঁদছে। কান্নার প্রথমদিকে বিভা শান্ত থাকলেও ধীরে ধীরে তার শরীরের কাঁপন বৃদ্ধি পেল। মাহাথির ভীষণ যত্ন নিয়ে হাত বুলাতে লাগল নিজের স্ত্রীর মাথায়। সাথে ভাবল এই মেয়ে যেমন শান্ত, তার রাগ, অভিমান, কষ্ট — সবই তেমন শান্ত।

.
আমিন সাহেব বসে আছেন তাহিরা বেগমের ঘরে। ঘরের আবহে তেমন পরিবর্তন নেই। ধুলোয় নাক জ্বলে যাওয়ার মতো অবস্থা, তবুও আমিন সাহেব আলাদা ধরনের আত্মিক প্রশান্তি পাচ্ছে। সেই প্রশান্তি থেকেই এই রুমে বসে আছেন তিনি। গতকালের ঘটনা তার উপর কেমন প্রভাব ফেলছে তা বলা যাচ্ছেনা। সে নির্বিকার। বিভার বলা সূক্ষ্ম তীরের মতো কথা, শ্রুতির মলিন মুখ, হামিমের দ্বিধাপূর্ণ দৃষ্টি সব মিলিয়ে সে কেমন অনুভব করছে তা সে জানেনা। আমিন সাহেবের মনে হলো মাহাথির, পার্থিব তাদের চোখেও ছিল তার প্রতি অনীহা। কই সদ্য পরিচিত পার্থিবের চোখেমুখে যে বিনয় ঝরতো কাল তো সেই বিনয় ছিলনা? দৃষ্টিতে অবজ্ঞা, ঘৃণা কিছুই ছিলনা। কোথায় যেন ফাঁকা ফাঁকা। মাহাথিরকে নিয়ে সে আর কী ভাববে! ছেলেটার সাথে তেমন পরিচয় নেই। পার্থিব-শ্রুতির বিয়ে ঠিক করার সময় মনে হলো বিভাকে বিয়ে দেওয়া উচিত। তার কিছুদিন বাদেই হাসিনা প্রস্তাব নিয়ে এলেন। প্রস্তাবে নাকচ করার কোনো কারণ ছিলনা। একপ্রকার অবহেলা করেই ঠিক করে ফেললেন বড় কন্যার বিবাহ। বিবাহের পর থেকে সে যখন মাহাথিরকে দেখতো, সুযোগ খুঁজতো ছোট করার। তবে আজ কেন মনে হচ্ছে সে নিজেই মাহাথিরের কাছে ছোট হয়ে গেছে? কোথাও কারো চোখে তার জন্য মায়া নেই, ভালোবাসা নেই, আকুলতা নেই। কেন নেই? থাকতে কী পারতো না? আমিন সাহেব ঘরের চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকালেন। তার তাকানো দেখে মনে হলো ঘরটায় হয়তো খন্ড খন্ড ভালোবাসার অংশ থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু নেই।

আমিন সাহেব অজানা বুক ব্যথায় চেয়ারে বসতে পারলেন না। মেঝেতে বসলেন। তার হাতে ডায়েরির পাতাগুলো। কোথায় থেকে শুরু করবে বুঝতে পারছেনা। সে জানতো তাহিরার ব্যক্তিগত ডায়েরি আছে। তবে সে কারোর ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো পছন্দ করতো না , বিধায় কখনো পড়া হয়নি। আমিন সাহেব অজানা এক ভয়ে পাতাগুলো পড়া শুরু করল না। নাহ! মন মানছে না। পড়া উচিত। তার মারা যাওয়ার আগে একটু পড়ে যাওয়া উচিত। আমিন সাহেব পড়া শুরু করল। পাতা উলটিয়ে উলটিয়ে ভীষণ মনোযোগ নিয়ে পড়ছে সে। তার আর তাহিরার প্রেমজীবনের শুরু থেকে বিবাহজীবনের সবকিছু পূঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করা। আমিন সাহেব তাহিরার কিশোরী হৃদয়ের অনুভূতি পড়তে শুরু করল। পড়ার সময় মনে হলো সে সেই মূহুর্তে ফিরে গেছে। এইতো তাহিরা সদ্য কলেজে পা দেওয়া কিশোরী। আর সে অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্র। দুজনের প্রেমের মূহুর্ত, ভালোবাসার কথা সব চোখের সামনে, কানে বাজতে লাগল। আমিন সাহেব অনেকদিন পর ভীষণ মনোযোগের সাথে কিছু পড়ছে। পড়তে পড়তে সে অনুভব করল তার ভালোবাসার কাহিনী শেষ। আর নেই। তাহিরার স্বচ্ছ, সুন্দর, পবিত্র সব অনুভূতি শেষ। এরপর থেকে একটু একটু আমিন সাহেবের প্রতি আসা নেতিবাচক চিন্তা, কথা, সন্দেহ লেখা। সে ভীষণ আফসোস করল। তাদের ভালোবাসার মূহুর্ত এতো কম কেন লিখেছে তাহিরা? আরেকটু লিখতে পারতো। তার তো পড়তে ভালো লাগছিল।

‘ তুমি এই রুমে কী করছো?’

শাহিনার কণ্ঠে চোখ তুলে তাকাল। তেমন বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া নেই আমিন সাহেবের। সাধারণভাবে বলল,
‘ ভালো লাগছে না। তাই বসে আছি।’

‘ বসে আছো! এই ধুলোর স্তূপে?’

‘ হ্যাঁ। একটু একা থাকতে দিবে?’ স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর।
শাহিনা কিছু বলতে গিয়েও বলল না। চলে গেল সে।

আমিন সাহেব থম ধরে পড়ে রইলেন। ফোনে এলার্ম বাজল। আমিন সাহেব তাকিয়ে দেখলেন রাত এগারোটা বাজে। এই সময়ে সে ঔষধ খায় দু’টো। তবে এখন উঠতে ইচ্ছে করছেনা। ঔষধ খেয়েই বা কী হবে! ঔষধ! আমিন সাহেবের মনে পড়ল তাহিরা ভীষণ যত্ন নিয়ে তাকে ঔষধ খাওয়াত। তার ফোনে যে এলার্ম বাজছে, এই বুদ্ধিটা তাহিরার ছিল। তাহিরা নিজেই নিজের ফোনে এলার্ম দিয়ে রাখতো। কারণ সে নিজেও তো মানুষ; যদি ভুলে যায়! তখন? তাহিরা চলে যাওয়ার পর থেকে আমিন শিকদার নিজেই নিজের কাজের দায়িত্ব তুলে নিয়েছে।
আমিন সাহেব ফোন দেখলেন আবারো। সে এই ঘরে এসেছিল সন্ধ্যা নয়টার আশ-পাশে। এতো তাড়াতাড়ি ২ ঘন্টা পার হয়ে গেলো! সে জানতেও পারল না? এতোই মগ্ন ছিল বুঝি!
আমিন সাহেব তার মনে সাহস সঞ্চার করলেন। নিজেকে নিয়ে ভালোবাসা পড়তে পারলে, নিজেকে নিয়ে ঘৃণাও পড়তে পারা উচিত। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে পাতা উলটিয়ে পড়া শুরু করল –

| অনেকদিন যাবত ধরে আমিনের ব্যবহারে পরিবর্তন লক্ষ্য করলেও তাকে কখনো সন্দেহ করতে ইচ্ছে হয়নি। মনে হয়েছে, সবাই তো এক না। সবার ভালোবাসাও এক না। তাই হয়তো আমিন একটু অন্যরকম। আমিনের অন্যরকম স্বভাব নিয়েই আমি তাকে ভালোবেসেছি। নিজের মনকে মানাতে চেষ্টা করেছি যে, আমিন ভালো। সে আমাকেই ভালোবাসে। আমি তার দুই সন্তানের মা। তার আরেক সন্তান আমার পেটে। তাহলে সে আমাকে ভালোবাসবে না কেন? কিন্তু আমি বুঝলাম, ভালোবাসা ছাড়াও সন্তান পেটে থাকতে পারে। কাউকে উজাড় করে ভালোবাসার খুব সুন্দর শাস্তি আমি পেলাম।|

আমিন সাহেব পাতা উলটাল,

| নিজেকে ভীষণ নোংরা লাগে আজকাল। মনে হয় এই জগতে আমার থেকে তুচ্ছ কিছু নেই। আয়নার সামনে নিজের চোখে চোখ মেলাতে পারিনা। অসহ্য যন্ত্রণায় বুক ভরে ওঠে। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটার মতো যন্ত্রণা হয়। মনে হয় ভেতরটা কেউ খুবলে খাচ্ছে। আমিন কেন ওই মহিলাকে ভালোবাসল? তার মধ্যে কী এমন ছিল? আমিন আমাকে বলত, আমিও তেমন হয়ে যেতাম। তবুও ও আমাকে ভালোবাসতো। ও কী জানেনা ওর এমন ব্যবহার আমার মানতে কতো কষ্ট হয়? আমি মরে যাই ভেতরে ভেতরে। সবাই আমাকে বলত, আমি ভীষণ ভাগ্যবান। কিন্তু আমার আজ সবাইকে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, ওই মহিলা ভীষণ ভাগ্যবান। তাইতো সে আমার স্বামীর ভালোবাসা পেল।|

| হামিম পেটে দুইমাসে থাকাকালীন আমিনের সম্পর্কের কথা আমি জানি। আজ পাঁচমাসে পড়লাম। গত তিন মাস যাবত ধরে আমি চেষ্টা করলাম আমিনের মন জুগিয়ে চলার, আমার মাঝে কীসের কমতি তা জানার, ও কীভাবে খুশি হবে তার খেয়াল শুরু থেকেই রেখেছি তবে এখন আরোও ভালোকরে রাখার চেষ্টা করি। যদি অন্তত তার মন ফেরে। আজ দুপুরে পেটে ব্যথা ভীষণ বেড়েছিল। তবুও ওর প্রিয় খাবার রান্না করেছি। ফোন করে বললাম বাসায় তাড়াতাড়ি ফিরতে। বিভা, শ্রুতিকে নিজের হাতে খাওয়িয়ে ঘুম বানালাম। আমি অপেক্ষা করলাম ওর জন্য। আম্মা বলল আমিন আসবেনা। আমি মানলাম না। যতোই অন্য সম্পর্কে জড়াক, যত যাই করুক, আমার ওপর নিশ্চয়ই তার একটু মায়া আছে। সে আসবে। মায়া থেকেই আসবে আমি জানি। আমি তার জন্য অপেক্ষা করলাম। তিনটা থেকে পাঁচটা বাজল। ক্ষুধায় আমার পেট চোঁ চোঁ করছে তখন। তাও খেলাম না। সবসময় ওর সাথে বসে ওর প্রিয় খাবার খেয়েছি। তাই আজ একা খেতে মন সায় দিল না। ভীষণ মায়া হলো মানুষটার জন্য। অবশেষে আর না পেরে ফোন করলাম। বললাম, আমার উপর দয়া করে হলেও রাতে আগে এসো কেমন? ভীষণ কষ্ট করে খাবারগুলো বানিয়েছি। শরীরটা ভালো যায়না আমিন। হতেও তো পারে আমি আর তোমার জন্য রাঁধলাম না। তাই আজ একটু আগে এসো। একসাথে বসে খাব। তোমার জন্য অপেক্ষা করছি আমি। ফোন রাখার পর দেখি আম্মা আমার দিকে টলটলে চোখে তাকিয়ে আছে। সে আমাকে জড়িয়ে ধরে ভীষণ কাঁদল। তবে আমি কাঁদলাম না। আমিন ঘরে এলো রাত সাড়ে এগারোটায়। এসেই ভীষণ ক্লান্ত হয়ে ঘুমাল। বুঝলাম খেয়ে এসে। আমি তখনো খাইনি। আমি ঘরে গিয়ে বিভা, শ্রুতির কপালে চুমু খেয়ে শুয়ে পড়লাম। আর অনুভব করলাম, আমার প্রতি দয়াটাও আমিনের বেঁচে নেই।|

| এখন আর ওর জন্য কাঁদিনা। হাজার কষ্টেও কাঁদিনা। আমি কাঁদলে আমার দুই মেয়েও আমার সাথে কাঁদে। ওদের চোখের পানি আমার সহ্য হয়না। বুকটা দুমড়েমুচড়ে যায়। শ্রুতিটার পাগলামিও ধীরে ধীরে কমে এসেছে। আগে কতো পাগলামি করতো বাবাকে নিয়ে। কিন্তু এখন তেমন পাগলামি করেনা। আর বিভা তো আমার বুঝদার মেয়ে। হে আল্লাহ, পৃথিবীর সব কান্না আমার হোক, তবুও আমার সন্তানেরা ভালো থাকুক, হাসিমুখে থাকুক। ওদের তুমি দেখে রেখ।|

আমিন সাহেব আর পড়তে পারলেন না। চোখের পানিতে লেখা দেখা যাচ্ছেনা। থেকে থেকে কাঁদছেন তিনি। নিজের অন্যায়গুলো তাকে বাঁচতেও দিচ্ছেনা, মরতেও দিচ্ছেনা। কেমন ছটফট লাগছে! আমিন সাহেব ফুঁপিয়ে উঠল। তাহিরার একটা ছবি বের করে কান্নার মাঝেই বলতে লাগল, আমার তোমাকে ভালোবাসা উচিত ছিল। অনেক ভালোবাসা উচিত ছিল। আমি তোমাকে ভালোবাসিনি তাহিরা। ভালোবাসলে এমন করতে পারতাম না।

তার অস্বাভাবিক কান্নার আওয়াজে ঘর ভরে উঠল। পঞ্চাশ বছর বয়সী আমিন সাহেবের মনে হলো তার পুরো জীবনটাই সে মিথ্যা করে রেখেছে। আফসোসে তার দমবন্ধ হয়ে এলো। উঠে বসে নিজেকে শান্ত করতে চেষ্টা করল। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। শ্বাস নেওয়া যাচ্ছেনা। বেশ কিছুক্ষণ পর আমিন শিকদার শান্ত হলো। ঠায় পড়ে রইল মেঝেতে।
আমিন সাহেবের হঠাৎ করে মনে হলো, তার ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে। তাহিরার হাতের রান্না খাওয়ার ক্ষুধা। সেদিনের পর আর তাহিরা তার জন্য কখনো রান্না করে বলেনি, আমি অপেক্ষা করছি। কেন আসেনি সেদিন সে? কেন আসল না? সে আসলেই তো দু’জনে একসাথে বসে খাওয়া যেত। পঞ্চাশোর্ধ আমিন শিকদারের মনে হলো আল্লাহ যদি তাকে আরেকটা সুযোগ দিত, আরেকবার তাকে অতীতে নিয়ে যেত। তবে সে তাহিরাকে ভালোবাসতো। ভীষণভাবে ভালোবেসে আগলে রাখল।

আমিন সাহেব পড়বেনা পড়বেন করেও কাগজগুলো উঠাল। বিভা কাগজগুলো ছিঁড়ে সাজিয়ে পিন করে দিয়েছে। এইসব কাগজগুলোতে আছে তাকে নিয়ে অনুভূতি। সে উলটিয়ে উলটিয়ে একদম শেষ পাতায় গেল। মাঝের গুলো পড়ার সাহস তার নেই। তবুও উলটানোর সময় মাঝের এক পৃষ্ঠার দেখতে পেল তাহিরার আফসোসের কথা। আফসোসের একটিতে লেখা তাদের পরিচয় বাইশ বছরের। আসলে কথাটা ভুল লিখেছে তাহিরা। তারা তিন বছর প্রেম করেছে। তাহলে তাদের পরিচয় ছিল পঁচিশ বছরের। আমিন সাহেব শেষ পৃষ্ঠায় গিয়ে থামল। তবে সে শেষ পাতাও পড়ল না। শুধু চোখ বুলিয়ে নিচে তাকাল। দেখতে পেল তাকে নিয়ে সর্বশেষ অনুভূতি হিসেবে দু’টো গানের লাইন লেখা –

ঘর বান্ধিলাম প্রাণ বন্ধের সনে
কতো কথা ছিল মনেগো….
______
চলবে~
শব্দসংখ্যা – ২৬২০
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান