একগুচ্ছ শুকতারা পর্ব-৬+৭

0
156

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

৬.
মাহাব বিরস মুখে বসে আছে৷ গায়ে অফিসের পোশাক৷ তার মুখ দেখে যে কেউই তার ভিতরের অপ্রসন্নতাকে আঁচ করতে পারবে৷ গত ১০ মিনিট ধরে বিছানায় বসে আছে সে। উদ্দেশ্য বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুবে। অথচ বাথরুমের দরজা খোলার নাম’ই নেই৷ নিশ্চয়ই ওই মেয়েটাই বাথরুমে ঢুকে বসে আছে। কি করছে সে? বাথরুমে কী সংসার পাতার স্বপ্ন দেখছে নাকি। যত্তসব!
মাহাব ছেলেটা তিরিক্ষি স্বভাবের৷ দিনের প্রায় শতভাগ সময়ে তার মন-মেজাজ খারাপ থাকে৷ কেবলমাত্র প্রিয় মানুষদের বেলায় তার ব্যবহার আলাদা৷ কিন্তু তার প্রিয় মানুষের তালিকা সীমিত। তার প্রিয় মানুষ মানে তার আম্মা, আব্বা, ইশিতা আপা, নাহিদ ভাইয়া আর আনাস৷
এখন কপালে জুটেছে আরেক ঝামেলা। ধৈর্য ক্ষমতার বিনাশ ঘটিয়ে যেই না উঠতে যাবে ওমনি ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো অর্ধভেজা গায়ের এক শ্যামাঙ্গিনী।
বিভা দ্বিধা মিশ্রিত দৃষ্টি দিল৷ মাহাব সেদিকে নজর দিল না৷ চলল নিজের কাজে৷ বিভা তার হাতের গামছা মেলে দিল বারান্দায়৷ তার মনটা কেমন যেন করছে। বিভা বুঝতে পারছে এই সম্পর্কে লোকটা খুশি নয়৷ কিন্তু কেন? সম্পর্কে খুশি নয় সেটা হয়তো তার স্বামী তাকে সরাসরি বলেনি, তবে বিভা বুঝে নিয়েছে৷ এতোটুকু তো জ্ঞান তার আছেই৷

‘শুনো…?’

বিভা পেছনে ফিরল৷ মাহাব দাঁড়ানো৷ কিন্তু মাহাব নাকি মাহাথির? বিভা কি একবার জিজ্ঞেস করবে?

‘তুমি দয়াকরে এই ওয়াশরুম টা ব্যবহার করবে না৷ আমার পছন্দ না এইসব৷ বাড়িতে আরেকটা ঘর আছে৷ সেই ওয়াশরুমটা ব্যবহার করতে পারো৷’
বলেই চলে গেল নাম না জানা তার স্বামী৷ বিভা শ্বাস ফেলল৷ তার স্বামীর যে তাকে পছন্দ হয়নি সে সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হলো৷ পছন্দ হয়নি? নাকি অনেক মানুষ আছে যারা নিজেদের জিনিস কাউকে ব্যবহার করতে দেয়না, সেই ধাঁচের লোক তার স্বামী? বিভা মাথা ঘামাল না৷ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

.
বিভা আর তার শ্বাশুড়ি হাসিনা কাজ করছেন রান্নাঘরে৷ বিভা কাজ করছে বললে ভুল হবে৷ সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে৷ বাড়ির চিন্তা তো আছেই, তবে এইভাবে চুপচাপ দাঁড়ানো দৃষ্টিকটু লাগছে। হাসিনা মরিচ কাটছে। বিভা এগিয়ে এলো, ‘দিন আমি করছি।’

‘কী দরকার কও? আমি যতোদিন আছি বাড়িতে আমি করুমু৷ কোনো সমস্যা নাই৷ আমি গেরামে গেলেই এই বাড়ি তুমার। সংসার তুমার৷ তখন তুমার যা করতে মন চায়, কইরো৷’

বিভা ভ্রু কুঞ্চিত করলো৷ হাসিনার দিকে তাকাল৷ সে গ্রামে চলে যাবে মানে? তবে কী তারা গ্রামে থাকে? নিজের মনের প্রশ্নটুকু করেই ফেলল বিভা, ‘আপনারা কি গ্রামে থাকেন?’

‘হ, বউ৷ গেরামে থাকি। মাঝেমধ্যি আসি এই বাড়িত। পোলাডারে দেখতে আসি৷ তয়, একলা আসি না৷ মাহাথির আব্বায় লইয়া আসে৷ প্রতিমাসে৷’

‘ও আচ্ছা৷ আচ্ছা, উনার নামটা আসলে কী? না মানে… যতোদূর জানি উনার নাম মাহাব৷ কিন্তু আপনি উনাকে ‘মাহাথির’ বলেন৷ কোনটা আসল?’ দ্বিধান্বীত কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল বিভা৷

‘ওর নাম হইলো গিয়া মাহাব মোহাম্মদ।’

‘তাহলে মাহাথির…?’

হাসিনা হাসল৷ সেই সাথে উত্তর দিল, ‘মাহাথির হইলো ওর ডাক নাম৷ আমরা কই৷ আমরা বলতে আমি আর ওর আব্বায়৷’

বিভা আশ্বস্ত হলো৷ এই তবে কাহিনী! হটাৎ তার মনটা খুশি হয়ে গেল৷ সে জেনেছে কাল সে এবং তার স্বামী তাদের বাড়িতে যাবে৷ সে তার বোন এবং ভাইকে দেখতে পাবে৷ ভাবতেই খুশিতে গলা ধরে এলো বিভার৷ সে এই বাড়িতে আছে এক রাত দুই দিন৷ অথচ মনে হচ্ছে শতজুগ পরে সে তার বাড়ি ফিরবে৷ বিভার খুশি তার মুখশ্রীতেও প্রকাশ পেল৷

.
সকালের আবহাওয়াটা সুন্দর৷ ভীষণ সুন্দর৷ কেমন গাত্র শীতল করা আবহাওয়া৷ মনটাকে নিমিষেই ফুরফুরে করে তোলে৷ শ্রুতি প্রতি সকালবেলা এই সময়টায় ভাবে। তার জীবনের ভাবনা ভাবে৷ নিজের জীবনে হিসাব-নিকাশের সমাধান করতে বসে৷ অথচ কোনোবারেই সমাধানে আসতে পারে না৷
এই যে আজকে সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠে, চুপচাপ নিচে নেমে এলো। এগারো তলা বিল্ডিং এর আশেপাশে সেম ডিজাইনের কতোগুলো বিল্ডিং। রঙ ও এক। বিল্ডিংগুলো সব নির্দিষ্ট ব্যাসার্ধের দূরত্ব মেনে অবস্থিত৷ যেন মনে হচ্ছে ইট পাথরের বিল্ডিং দিয়ে কেউ বৃত্ত এঁকেছে৷ বিল্ডিং এর মধ্যবর্তী জায়গায় একই রকমে বৃত্ত আকারের মাঠ৷ আর সরু গোলাকার রাস্তা৷ আর মাঠের তার চারপাশে নানান ফুল৷ শ্রুতি নির্বিকার চিত্তে সব দেখছে। দৃশ্যটা উপভৌগ্য। অথচ শ্রুতির নিকট পানসে৷ তাদের বিল্ডিং এর পাশেই আলাদা একটি জায়গা৷ যেখানে একটি বেঞ্চ রাখা। আর তার পাশেই নাম না জানা সুন্দর একটি ফুল গাছ। শ্রুতি এইবার অন্য বিল্ডিং গুলোর দিকে তাকাল৷ নাহহ! অন্যদিকের গুলোতে নেই৷ শুধু এদিকেই। শ্রুতি এগিয়ে গেল৷ বেঞ্চে বসল৷ বেঞ্চ’র জায়গাটা এমনভাবে যে কোনো মানুষ মাঠে এলে কিংবা বিল্ডিং এর নিচে দাঁড়ালেও শ্রুতিকে দেখতে পাবে না৷
আজকে সে বাসায় যাবে৷ ভেবেই খুশি হলো৷ কিন্থ খুশির রেশ মুখে ফুটল না৷

‘তুমি এখানে?’’

শ্রুতি তাকাল৷ তার শ্বশুর আসাদুজ্জামান। আসাদ এগিয়ে এলো৷ গম্ভীর মুখে বলল, ‘তুমি এখানে?’
শ্রুতি দৃষ্টি নত করল৷ কী বলবে ভেবে পেল না৷ লোকটাকে রাগী মনে হচ্ছে। আসাদ গলা খাঁকারি দিলেন৷ সে স্বল্পভাষী মানুষ৷ অযথা কথা পছন্দ করেন না এবং বলেনও না৷ তবুও তার জানতে ইচ্ছে তার পুত্রবধূর কোনো সমস্যা হচ্ছে কি-না৷ মেয়েটা সুবিধা-অসুবিধা দেখা বাবা হিসেবে তার দায়িত্ব৷ সে কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে বলল, ‘সমস্যা হলে জানাবে। আমাকে না জানালেও, বাকিদের জানাবে৷ কোনোপ্রকার দ্বিধায় ভুগবে না৷ নিজের বাড়িতে দ্বিধা নিয়ে থাকা উচিত না৷ নিজের বাড়িতে রাজত্ব করতে হয়৷’

শ্রুতি তার যাওয়ার পানে অবিশ্বাস্য দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল৷ সে বুঝে পায়না সবাই তার সাথে এতো ভালো ব্যবহারের নাটক কেন করছে? নাটক নাকি সত্যিই তারা এমনি? শ্রুতি শ্বাস ফেলল৷ একটা সময় ছিল, যখন শ্রুতিকে ভালোবেসে কেউ একটা কথা বললেই সে মোমের ন্যায় গলে যেত। অথচ এখন সবার সবকিছু অভিনয় লাগে৷

.
বিভা-মাহাথির, শ্রুতি-পার্থিব দাঁড়িয়ে আছে খাবার টেবিলের সামনে৷ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারা আয়োজন দেখছে৷ বহু পদের খাবার টেবিলে আসন পেতে বসেছে৷ শ্রুতি বাড়িতে ঢোকার আধাঘন্টার মাঝেই বিভা উপস্থিত৷ তারা তাদের সুখ-দুঃখের গল্প ইতিমধ্যে শেষ করে হামিমকে খাইয়ে এসেছে দুজনে৷ হামিম প্রথমে রাগ করে থাকলেও পরে আর রাগ করতে পারেনি তার প্রানপ্রিয় আপাদের ওপর৷ এখন সবার খাওয়ার পালা৷ শ্রুতি অবাক হয়ে লক্ষ্য করছে তার বাবা আমিন তার বড় বোনের স্বামীর থেকে তার স্বামী পার্থিবকে বেশি যত্ন-আত্মি করছে৷ এর কারণ কী? আমিন তার নিজের পছন্দ করা পাত্রকেই দাম দিচ্ছে না? অবাক করা বিষয়!
আমিন নিজের পাশে পার্থিবকে বসালো৷ যত্নের কোনো ত্রুটি সে রাখবে না৷ মাহাথিরকেও যত্ন করা হলো৷ শাহিনা এবং বিভার দাদী করলো৷ তবে পার্থিবের মতো না৷ ব্যাপারটা শ্রুতির ভালো লাগল না৷ নিশ্চয়ই এর মাঝেও কোনো কারণ আছে। তার এই নিচু শ্রেনীর পরিবার স্বার্থ এবং কারণ ছাড়া কোনো কিছুই করে না৷ কিচ্ছু না।

.
আজ আকাশে অর্ধেক চাঁদ উঠেছে৷ আর বাকি অর্ধেক কই? ছোটবেলায় পার্থিবকে তার নানী বলেছিল, ‘পিষ্যাষ আসমানের চাঁদ খাইয়া ফালায়৷ আস্তে আস্তে খায়৷ যখন পুরাডা খাইয়া ফালায় তখন আসমানে চাঁদ থাকে না। অমাবস্যা আসে৷ তখন রাত-বিরাইতে বাইরে থাকন ঠিক না৷ সয়তানে ধরে।’
পার্থিব হাসল৷ পিশা চ নাকি আকাশের চাঁদ খেয়ে নেয়! একটা বৈজ্ঞানিক বিষয়কে তার নানি কি না কি বানিয়ে দিয়েছে৷ অথচ ছোটবেলায় দিব্যি এই ধরনের কথা সে বিশ্বাস করত৷ মজা পেত৷ হাস্যকর….!
হটাৎ পার্থিবের আজ দুপুরের ঘটনা মাথায় এলো৷ আজ দুপুরে কথাবার্তার পর শ্রুতি যখন তার ছোট ভাইয়ের খোঁজে গেল, সেও গেল পিছু পিছু৷ পার্থিব গিয়ে দেখল, শ্রুতি একটা আট/নয় বছরের ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। ছেলেটার চোখের কার্নিশ বেয়ে ঝরছে অশ্রুকণা৷ ছেলেটার মাথাটা তুলনামূলক একটু বড়। একটা পা ভীষণ রকমের চিকন। এই ছেলেটা-ই কী তাহলে শ্রুতির ভাই? আচ্ছা বাচ্চাটা কী বিশেষ ভাবে কোনো শারীরিক অথবা মানসিক রোগে আক্রান্ত? ছেলেটাকে এর আগেও কোথাও দেখেছে সে। কিন্তু কোথায়? এখন বিষয়টা মনে করা দরকার৷ অথচ মনে পড়ছে না৷ মনে পড়বে এমন একটা সময়ে যখন মনে করার কোনো প্রয়োজনীয়তা-ই থাকবে না৷ যেমন, অফিসের কাজ করতে বসেছি৷ কোন কম্পানির কাজ করছি এটা মনে করতে গিয়ে মনে পড়ে যাবে বাচ্চাটাকে কোথায় দেখেছি কিংবা গোসল করার সময় সাবান মাখতে যাব তখন হটাৎ করেই মনে পড়বে আরেহহ! বাচ্চাটাকে তো এখানে দেখেছি অমুকের সাথে….। অসহ্যকর….. !

.
বিভা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে৷ হিমশীতল আবহাওয়া শরীর মন জুড়িয়ে যাচ্ছে৷ রাত বেশ অনেক হয়েছে অথচ ঘুমুতে যেতে ইচ্ছে করছে না। যাবে কি যাবেনা তাই নিয়ে দ্বিধাবোধ করছে সে। ঘুমুতে গেল, দেখা যাবে গতকালের মতো কাহিনী ঘটে বসে আছে৷
সে বিছানায় শুয়ে হাত নড়াচড়া করছে। ওমনি মাহাথির উঠে বসলো। গম্ভীরমুখে ঠান্ডা কণ্ঠে বলে উঠবে, ‘বিভা, আমার এতোদিনের ব্যবহারে তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ যে, আমি তোমাকে পছন্দ করতে পারছি না৷ তবুও কেন তুমি আমার আশেপাশে ঘুরাঘুরি করছো বলো তো? তুমি কী চাও যেই মানুষটা তোমাকে পছন্দ করে না তার সাথে তোমার শরীর স্পর্শ করুক?’
এই কথা পিঠে আর কিছু বলার থাকে না৷ মাহাথির তাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বিছানায় শুতে মানা করল সাথে উত্তমরূপে অপমান-ও করল৷ বিভা উঠে যাওয়ার উচিত ছিল অথচ সে উঠল না৷ শুয়েই রইল৷ মাহাথিরকে অবাক করে দিয়ে ৫ কি ১০ মিনিটের মাথায় গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেল৷
আজও কী এমন কিছুই ঘটবে? নাকি কালকের থেকেও বাজে কিছু ঘটবে?
বিভা আজ ঠিক করেছে মাহাথিরকে কিছু প্রশ্ন করবে৷ প্রশ্নগুলো এরুপ- আমার মধ্যে কী কোনো সমস্যা আছে? আমাকে অপছন্দ করার কারণ? মাহাথির নিশ্চিত তখন বলবে, আমি কাউকে ভালোবাসি৷ আমি তাকে ঠকিয়ে তোমাকে ভালোবাসতে পারিনা৷ তোমাকে পরিবারের পছন্দে বিয়ে করেছি আমি। আর কিছুনা৷
বিভা মনে মনে ঠিক করলো মাহাথির এর মুখে এই কথা শোনামাত্রই সে এক বালতি গোবর মাহাথির এর মাথায় ছুড়ে মারবে৷ কিন্তু গোবর পাবে কোথায়? তাদের বাড়ির আশপাশে গরুর খামার থাকলে হতো৷ প্রয়োজনে মাহাথিরকেও সেখানে ভর্তি করা যেত৷ আর তখন সে তার স্বভাবতই গম্ভীরস্বরে ডাকত, ‘হাম্বায়ায়ায়া! হাম্বায়ায়ায়া!’
____________
চলবে~
#শারমিন_ইরান
#একগুচ্ছ_শুকতারা
শব্দসংখ্যা- ১৩৯০

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

৭.
নিকষ কালো অন্ধকারে আচ্ছাদিত চারিপাশ৷ দূরে কৃত্রিম আলোর ঘনঘাটা। একটার পর একটা দাঁড়িয়ে আছে ইট-পাথরের দালান৷ হাতের দুই আঙ্গুলের ফাঁকে সিগারেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাহাথির৷ সেকেন্ডের ব্যবধানেই ক্ষতিকর বস্তুটিতে টান দিয়ে ক্ষতিকর ধোঁয়ার মুখরিত করলো চারিপাশ। দৃশ্যটা অসহনীয়!
বিভার মন খারাপ হলো৷ সে ছাদে এসে এই দৃশ্য দেখবে ভাবেনি৷ এমনকি কল্পনাও করেনি কোনোদিন যে মাহাথির সিগারেট খাবে। আচ্ছা ছেলেদের সিগারেট খাওয়া কেন এতো জরুরী? কেউ কেউ বলে, দুঃখ ভুলতে! তাদের কী এমন দুঃখ যে সেই দুঃখ সিগারেট খেলেই ভুলে থাকা যায়! বিভা সামনে এগুবে নাকি বুঝতে পারল না৷

‘আপনি সিগারেট খান?’
‘আমি সিগারেট খাই। অনেক আগে থেকেই খাই৷’
‘ওহ৷ ভালো৷’
বিভার ‘ভালো’ কথাটা নিতান্তই দুঃখের বহিঃপ্রকাশ। এটা তার স্বভাব। সে কিছুতে দুঃখ পেলে, মনঃক্ষুণ্ন হলে বলে ‘ভালো’। কিন্তু ব্যাপারটা মাহাথির বুঝতে পারল না৷ অবশ্য বোঝার চেষ্টা করলে না বুঝবে৷

‘ঘুমাওনি কেন? এখন এটা বলো না আমার জন্য অপেক্ষা করছো। কিংবা আমার সাথে একান্ত সময় কাটাতে চাইছ।’

‘চাইলেও বা কী? কাটাবেন না আমার সাথে সময়?’ বেহায়ার মতো বিভা বলে বসল। বলার পর নিজেরই হালকা লজ্জাবোধ হলো৷

মাহাথির হাসল৷ তবে হাসিতে শব্দ হলো না৷ ঘুরে তাকাল বিভার দিকে৷ কমলা রঙের সুতির শাড়ি পরা বিভা। পার্থিব বিরক্ত হলো৷ কমলা রঙটা তার অপছন্দ৷ সেই সাথে বিভাকেও সে যথেষ্ট অপছন্দ করে৷ দু’টো অপছন্দ মিলে অপছন্দ স্কয়ার৷ আর তার থেকেও বড় কথা রঙ-টাতে বিভাকে মোটেও মানাচ্ছে না৷

‘কি হলো? বললেন না যে?’

‘তুমি বড্ড বোকা বিভা।’

‘আপনি আমাকে পছন্দ করেন না৷ তাই না মাহাথির?’

‘যদিও আগেই বলেছি তাও যখন জিগ্যেস করছো আবার বলছি৷ তবে সত্য বলব নাকি মিথ্যা?’

‘মিথ্যা কেন বলবেন? সত্য বলুন৷’

‘কষ্ট পেয়ো না৷ তুমিই বলেছ সত্য বলতে। বলছি। আসলে আমি কালো মানুষদের পছন্দ করি না৷ তাদের দেখলে আমার খারাপ লাগে৷ মনে হয় তারা যেমন কালো, তাদের ভেতরটাও ঠিক একই রকম কালো৷’

মাহাথির তাকালো বিভার দিকে৷ বিভা হেসে তাকিয়ে আছে৷ কেমন যেন অন্যরকম একটা হাসি৷ মাহাথির বলল, ‘কষ্ট পেলে? তুমি কিন্তু বলেছিলে তুমি কষ্ট পাবে না৷ তাই বলেছি।’

‘আমি কষ্ট পাই নি৷’ হাসিমুখের কথাটা বলল বিভা৷ মাহাথির বেশি কিছু ভাবল না৷ নিচে নেমে গেল৷

বিভা গিয়ে দাঁড়াল মাহাথির এর স্থানে৷ সে অনুভূতিশুন্য! কেমন যেন লাগল মাহাথির এর কথাগুলো৷ মাহাথির এর ব্যবহারে বিভার মনে হলো বিভার গায়ের রঙ নিয়ে সে উপহাস করে গেল। সত্যিই কী তাই? বিভা আকাশের দিকে তাকালো৷ আকাশে অর্ধেক চাঁদ৷ বিভার মনে হলো চাঁদের মাঝে কেউ হাসছে৷ আচ্ছা, তার মা হাসছে না তো? হাসতেও তো পারে৷
বিভা চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইল৷ বলল, ‘আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি আম্মু।’

.
পার্থিব ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে হামিম এর দিকে৷ পার্থিব বিছানায় বসা৷ হামিম টেবিলে মাথা রেখে কিছু আঁকছে৷ সেদিকে পার্থিবের দৃষ্টি নয়। পার্থিব এর দৃষ্টি হামিমের দিকে৷ সে হামিমকে কোথায় দেখেছে তা সে মনে করতে পেরেছে। ঘুমুতে যাওয়ার আগে পার্থিব পানি খায়৷ কাল রুমে পানি ছিল না৷ সে পানি খাওয়ার জন্য নিচে গেল৷ ফ্রিজ খুলে পানির বোতল বের করে গ্লাসে ঢালার সময় হঠাৎ করে তার একটা ঘটনা মনে পড়ল৷
সে তখন দ্বিতীয়বার এর মতো আমিন সাহেবের সাথে শ্রুতিদের বাড়িতে এসেছিল। উদ্দেশ্য শ্রুতিকে দেখা৷ আমিন সাহেব যখন পার্থিবকে প্রস্তাব দেয় তার পরিবার রাজি হয়৷ পার্থিব নিজেরও শ্রুতির ছবি ভালো লাগে৷ সেজন্যই শ্রুতিকে সামনাসামনি দেখার ইচ্ছে থেকেই বাড়িতে এসে দেখে যেত৷ প্রথমবার যেদিন দেখেছিল সেবার শ্রুতিকে বিভা খাইয়ে দিচ্ছিল টেবিলে বসে৷ আর শ্রুতি হাসছিল আর খাচ্ছিল৷ দৃশ্যটা সুন্দর ছিল৷ পার্থিব সেই দৃশ্যের সাথে প্রভা-প্রত্যাশার মিল পেয়েছিল৷ যদিও দু’জন সারাদিন ঝগড়ায় মেতে থাকে৷ তবুও…
তো দ্বিতীয়বার যে বার এসেছিল সেই বারো কাকতালীয় ভাবে শ্রুতিকে পার্থিব টেবিলেই বসা দেখেছিল৷ তবে বিভার সাথে নয়৷ একটা ছোট ছেলের সাথে৷ যাকে শ্রুতি সযত্নে খাইয়ে দিচ্ছিল৷ পার্থিব নিজের কৌতূহল থেকে জিজ্ঞেস করল,
‘ছেলেটা কে আংকেল?’
আমিন সাহেব হালকা থতমত খেলেন৷ কী বলবেন বুঝলেন না৷ বললেন, ‘ছেলেটার কথা বলছ? আমার কাজের লোক আছে শহিদ৷ শহিদের ছেলে এই বাচ্চাটা৷ শ্রুতি খুব আদর করে৷ গরিবের প্রতি ওর খুব দয়া৷ অবশ্য আমরা সবাই করি৷’
কথাটার পেছনে শুধু হামিমকে আড়াল করার উদ্দেশ্য ছিল না৷ সেই সাথে ছিল শ্রুতির প্রতি পার্থিবকে মুগ্ধ করানোর একটা প্রচেষ্টা। কিন্তু পার্থিব সেদিন শ্রুতির প্রতি মুগ্ধ হয়েছিল কি-না কে জানে৷ তবে ওর ওই ছোট বাচ্চাটাকে আদর করার একটা ইচ্ছে তো জেগেছিল-ই৷ বাচ্চাটা দেখতে খুব নিষ্পাপ৷ খুব বেশি….

শ্রুতি ঘরে ঢুকল হরলিক্স এর গ্লাস নিয়ে৷ হাতে হয়তো কিছু ঔষধ-ও আছে৷ সে হাসিমুখে হামিমের দিকে তাকাল৷ এরপরই তাকাল ক্রিম কালারের পাঞ্জাবি পরিহিত তার স্বামীর দিকে৷ পার্থিবের মুখের ভঙ্গি শ্রুতির পছন্দ হলো না৷ লোকটা কী হামিমকে ঘৃণা করছে? ভাবতেই চোয়াল শক্ত হলো শ্রুতির৷ বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেল৷ পার্থিবের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি করলো তুখোড়,তীক্ষ্ণ।
‘আপনার বুঝি ওকে দেখতে ঘেন্না লাগছে?’

হামিম তাকাল তার আপার দিকে৷ তার সামনে যে অচেনা এক মানুষ তাতে তার ভ্রুক্ষেপ নেই৷ সে আবার নিজের কাজে মন দিল৷
শ্রুতির কথায় পার্থিব হতভম্ব,নির্বাক! কী বলছে কী শ্রুতি! সে কেন বাচ্চাটাকে ঘৃণা করবে!
পার্থিব কী বলবে ভেবে পেল না৷ এমন একটা কথার পিঠে কোনো কথা বলা যায় না৷ সে চুপ রইল৷ কিন্তু এটা বুঝতে পারলো যে তার গুণধর স্ত্রী’র তিলকে তাল করার আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা রয়েছে। শ্রুতি এতোক্ষণে হামিমকে খাইয়ে চলে গেছে। সে শ্বাস ফেলল৷

.
পার্থিব সেই কখন থেকে শ্রুতির জন্য অপেক্ষা করছে৷ কিন্তু অপেক্ষার অবসান আর ঘটছে না৷ কোথায় সে? রাত ১১ টা ৪৭ মিনিট৷ ঘুমুবে না না-কি! পার্থিব নিজের মুঠোফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো৷ তার বউটাকে নিয়ে আর পারা যায় না৷

শ্রুতি রুমে ঢুকল৷ পার্থিবকে দেখে ভাবান্তর হলো না৷ নিজের মাথার আউলা-ঝাউলা চুল নামক কাকের বাসাকে ঠিক করতে ব্যস্ত হলো৷ মানুষের চুল কী সুন্দর হয়! পাতলা, ঝলমলে। অথচ তার টা দেখ। মোটা মোটা চুল৷ ছেড়ে রাখলে হিন্দুদের দেবীদের মতো ফুলে থাকে৷ কিন্তু মানুষ তার চুল দেখেই বলে, মাশা-আল্লাহ কী ঘন চুল!
শ্রুতি বিছানায় এসে বসতেই পার্থিব উঠে দাঁড়াল৷ শ্রুতি এক পলক তাকিয়ে নিজের কাজে মন দিল৷ দায়সারাভাবে বলল, ‘আপনার এই নিত্যনতুন রঙ-ঢঙ এর মানে আমি বুঝি না৷ কোথায় যাচ্ছেন আপনি? এইখানে কী আপনার বাসার মতো নিচে আলাদা বিছানা আছে যে ঘুমাবেন? আর আমি কী আপনাকে একবার-ও বলেছি আপনি বিছানায় ঘুমালে আমার সমস্যা? নিজের এই সাধুরূপ থেকে বেরিয়ে আসুন৷’

পার্থিব শান্ত চোখে তাকিয়ে রইল৷ মেয়েটা সবসময় রাগ করানো কথা বলে৷ অযথাই। সব মেয়ের’ই বিয়ের পর হটাৎ করে কোনো পুরুষের সাথে ঘুমাতে খারাপ লাগবে৷ হ্যাঁ, তারমানে এই নয় যে স্বামীদের অন্য কোথাও ঘুমুতে হবে৷ কিন্তু শ্রুতি যেহেতু নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে করেছে, সেহেতু তাকে সময় দেওয়াই যায়৷ আর চেয়েও বড় বিষয় – নাতো তাদের সম্পর্ক অন্যদের মতো স্বাভাবিক, আর না শ্রুতির মানসিকতা। সে পুরুষ ঘৃণা করে। অগাধ ঘৃণা নিয়ে সংসার হয়না। তাই সর্বপ্রথম ছেলেদের প্রতি ভুল ধারণা ভাঙানো স্বামী হিসেবে তার প্রধান দায়িত্ব। আর মেয়েটা কী না কী বলছে৷ উফফফ!

‘শ্রুতি,আমি আপনাকে সময় দিতে চাই৷ আপনাকে কোনো জোরজবরদস্তির সম্পর্কে আমি রাখতে চাই না৷ আমাদের সম্পর্ক হবে সুন্দর৷ বিশ্বাসের, ভালোবাসার, আত্মার। আমি আপনার মেহমান বউ থেকে আপন বউ হওয়ার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করব, শ্রুতি।’
শ্রুতি তাকাল৷ মনের মধ্যে কেমন যেন করে উঠল৷ সত্যিই তো! স্বামী-স্ত্রী বিষয়টা কতো সুন্দর৷ অথচ সে পার্থিবের সাথে কেমন ব্যবহার করে! ভালো করে দু’টো কথা পর্যন্ত বলে না৷
শ্রুতি ভাবলো সত্যিই তো তাদের জীবনও সুন্দর হতে পারে৷ কিন্তু নাহহ! যতোই সে উপরে উপরে নিজেকে শক্ত দেখাক না কেন, কষ্ট পেতে ভয় করে৷ ধোঁকা খেতে ঘৃণা হয়৷ সে কালো৷ কালো মানুষকে কেউ পছন্দ করে না৷ তাহলে পার্থিব কেন করবে? যদি সেও শ্রুতিকে রেখে পরকীয়া করে। করবেনা যে এর কী নিশ্চয়তা? তখন? ভীষণ কষ্ট হবে শ্রুতির৷ ভীষণ৷ যতই থাক নিজের প্রতি এক আকাশ সমান অবজ্ঞা, তবুও স্বামীর প্রতারণা তাকে শেষ করে দেবে৷ এর থেকে ভালো স্বামীকে ভালোই না বাসুক৷ তাহলে কোনো কষ্টই থাকবে না৷
বড্ড আফসোস হয়৷ যদি সে ফর্সা হতো! নিজের চারিপাশের সবাই ফর্সা৷ শুধু সে কালো৷ কিন্তু কেন? তাকেও আল্লাহ ফর্সা বানাত৷ কী হতো বানালে? ওহহ! সব কষ্ট তো শুধু তার ভাগেই। ফর্সা বানালে সে কষ্ট পেত কী করে? এই কালো হওয়া থেকেই তো তার জীবনের সকল সমস্যার শুরু।

শ্রুতি লক্ষ্য করল পার্থিব নিচে ঘুমিয়ে আছে৷ শ্রুতি বিরক্ত হলো। বলার পরেও এমন ঢং এর মানে হয়না৷ রাগ দেখিয়ে শ্রুতি নিজেও শুয়ে পড়ল৷

‘শ্রুতি, হামিম কি সত্যিই আপনার ভাই?’

পার্থিবের করা হটাৎ প্রশ্নে শ্রুতি আশ্চর্য হলো৷ এমন প্রশ্নের মানে কী! আর হামিম ভাই হবে না-ই বা কেন?
‘হামিম আমার আপন ভাই৷’ নিজের তেজপূর্ণ এতোটুকু কথাতেই যেন প্রকাশ পেল হামিম তারই ভাই৷ তাও অতি আদরের, স্নেহের৷

‘আপনার এমন প্রশ্নের মানে কী? নাকি আপনি ভাবছেন স্বাভাবিক মানুষের ভাই প্রতিবন্ধী হতে পারে না?’

‘সবসময় ভুল ভাববেন না, শ্রুতি৷ রাগ হয় আমার৷ আর রেগে গেলে আমি কিন্তু সুবিধার নই। আপাতত আপনাকে অসুবিধা দিতে চাইছি না, তাই রাগলাম না৷’ পার্থিবের কণ্ঠটা প্রয়োজনের তুলনায় অধিক গম্ভীর শুনালো৷ শ্রুতি তোয়াক্কা না করে উল্টো প্রশ্ন ছুড়ল,
‘আমার প্রশ্নের উত্তর দিন৷ হটাৎ এই প্রশ্ন কেন করলেন আপনি?’

‘আসলে…..’পার্থিব বলবে কি-না ভেবে পেল না৷

‘আসল-নকল কী?’

‘আসলে আব্বু আমাকে একবার বলছিলেন যে, হামিম এই বাড়ির কাজের লোকের
ছেলে৷ কাজের লোকের নাম সম্ভবত শহিদ৷ তাই প্রশ্নটা করলাম৷’

কথাটা শুনা মাত্রই তড়িৎবেগে শ্রুতি উঠে বসল৷ পার্থিবের দিকে মুখ এগিয়ে নিল৷ নিজের বিস্ময়ের মাত্রা আরো বাড়িয়ে নিল খানিকটা৷ বলল, ‘এইসব কী বলছেন আপনি? আর আব্বু মানে কে? আমিন শিকদার?’

অন্ধকারেও শ্রুতির প্রতিক্রিয়া বুঝতে অসুবিধা হলো না পার্থিবের৷ সাথে শ্রুতির ‘আমিন শিকদার’’ বলাটা অদ্ভুত লাগল। এইভাবে নাম না ধরে ডেকে ‘আমার আব্বু’ শব্দটাও ব্যবহার করা যেত৷ ভাবল না বেশি৷ উত্তর দিল, ‘হুম৷’

শ্রুতি ঠাস করে বিছানায় গলে পড়ল৷ বুকের ভিতর কেমন ব্যথা হচ্ছে৷ তার বাবার কাজকর্ম সম্পর্কে সে অবগত। তবুও এতো কষ্ট কেন?
শ্রুতির অনুভব করল তার চোখের পাশ থেকে ঠান্ডা কিছু গড়িয়ে কানের দিকে চলে গেল৷

.
চারদিকে রোদের ঝলমলে আলোতে মুখরিত পরিবেশ৷ রোদটাকে ঠান্ডা রোদ বলা যেতে পারে৷ কারণ এই রোদে গরম লাগে না৷ বরং প্রকৃতি আলোকিত হয় ঝলমলে রঙ-এ৷ উমমম…তাহলে রোদটার নাম আলোরোদ-ও রাখা যেতে পারে৷ কিংবা ঝলমলে রোদ..
ঝলমলে রোদের আলো কাঁচ ভেদ করে খানিকটা এসে পড়েছে বসার রুমের সোফায়, শো কেসে, মেঝেতে। বসার রুমেই উপস্থিত আছে সকলে৷ বিভা-মাহাথির, শ্রুতি-পার্থিব, হামিম, দাদি। শাহিনা আর আমিন শিকদারকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না৷

দাদি গল্প করছেন তার নাত জামাইদের সাথে৷ দু’জন নাত জামাই’ই তার বেশ ভালো৷ যদিও বড়টা একটু চুপচাপ। তবুও তার সাথে স্বাভাবিক কথা তো বলছে৷ এতেই হবে৷
কোথাও যেন ফাঁকা ফাঁকা অনুভব করল সে৷ তাহিরা থাকলে তাহিরার চঞ্চলতাতেই যেন ভরে থাকত বাড়িটা৷ মেয়েটা ছিল লাখে এক৷ না না। ভুল হলো৷ কোটিতে এক। যেমন সুন্দর মুখ তেমন সুন্দর ব্যবহার৷ ব্যবহার’ই যেন তার সৌন্দর্য বাড়িতে তুলতো হাজারগুণ৷ আম্মা আম্মা করেই যেন ভরিয়ে রাখতো পুরোটা বাড়ি৷ বউটার রান্নার হাতও ছিল বেশ। কতো পদের রান্না করতো! কারোর বাড়ির কিছু মজা লাগলে নিজ গরজে সেই রান্না শিখে নিত৷ আশেপাশের মানুষজন বলত, ‘বিভা-শ্রুতির হলো সোনার কপাল৷ ওদের মায়ের রান্না খেয়েই ওদের শ্বশুরবাড়ির লোকজন পাগল হবে৷ তাহিরার মেয়ের জামাইরাও ভাগ্য করে শ্বাশুড়ি পাবে৷’
কই পেল না তো। তার আগেই তো চলে গেল বউটা। আমিনা নিশ্চিত আজ তাহিরা থাকলে দুই জামাইয়ের আথিতেয়তার কমতি থাকত না৷ যদিও এখনও করা হচ্ছে৷ তবুও তো তা স্বার্থে। স্বার্থ আর ভালোবাসায় যে বিস্তার তফাৎ।

আমিনা মাহাথির আর পার্থিব এর দিকে তাকাল৷ হটাৎ করেই দুটো ছেলেকে তার ভারি নিষ্পাপ মনে হলো৷ অসহায় লাগল৷ আমিনার বলতে ইচ্ছে হলো, ‘বাপজানেরা, তোমাগো পোড়া কপাল৷ তুমরা আমার বউ এর আদর পাও নাই৷ পোড়া কপাল নিয়া জন্মাইছো৷’
শ্বাশুড়ির ভালোবাসা না পেলে পোড়া কপাল হয়না৷ কিন্তু আমিনার কাছে মনে হলো তাদের কপাল আসলেই পোড়া৷ বড্ড পোড়া!

পার্থিবের বাবা ফোন দিয়েছে। একদম কাছেই বসার কারণে শ্রুতি শুনতে পারছে প্রায় সব কথা-ই৷ যদিও ইচ্ছে নেই তবুও বসে বসে শুনছে সে। সাধারণ কথাবার্তা চলছে দুইজনের মধ্যে৷ হটাৎ একটা কথায় থমকে গেল শ্রুতি। তার শ্বশুর গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করেছেন,
‘সকালের খাওয়া দাওয়া হয়েছে? তুমি, শ্রুতি খেয়েছো? আর কবে আসবে দুজনে? বাড়িটা ভালো লাগছে না৷’

প্রশ্ন করা মাত্রই পার্থিব একবার তাকাল শ্রুতির দিকে৷ এরপর বাবার সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল৷ অন্যদিকে কথাটা শুনে যেন শ্রুতি কান্ডজ্ঞানহীন হয়ে পড়ল৷ নিজের বাবা তো কোনোদিন খেয়েছে কী না সে খোঁজ তো দূরে থাক দেখতেও আসত না বেঁচে আছি না মরে গেছি। অন্যদিকে তার শ্বশুর!
মানুষগুলো হয়তো সত্যিই ভালো৷ তবুও, সে নিজেতো ভালো না৷ তাই সে অতো ভালো মানুষদের যোগ্য না। সে যখন ঠিক করেছে নিজের শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে আসবে৷ এর মানে আসবেই৷

.
নীল আকাশ রুপান্তরিত হয়েছে কালো আকাশে৷ সেই কালো আকাশের বুকে জায়গা করে নিয়েছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নক্ষত্রমন্ডলী। জ্বলজ্বল করছে তারা৷
আকাশের তারা গুণার ব্যর্থ চেষ্টায় নিয়োজিত পার্থিব। পার্থিব তারা দেখে৷ যেদিন থেকে দেখেছে শ্রুতি তারা পছন্দ করে, সেদিন থেকে সে নিজেও দেখে৷ এবং অদ্ভুতভাবে তার নিজেরও তারা পছন্দ হতে শুরু করেছে৷ অবশ্য তারা দেখার সাথে সাথে সে কিছু হিসাব নিকাশও করছে৷ এই যেমন এটা বুঝতে পেরেছে যে, শ্রুতি আর আমিন সাহেবের সম্পর্ক টা স্বাভাবিক নয়৷ বিস্তর কোনো ঝামেলা আছে৷ উফফ তার বিবাহিত জীবনটা প্যাঁচে ভরা। কি আর করা!
পার্থিব পিছনে ঘুরলো৷ বিছানায় কাথা দিয়ে মুখ ঢেকে শুয়ে আছে শ্রুতি৷ আজ তাদের শেষ দিন এই বাড়িতে৷ কাল তারা ফিরে যাবে৷ ৩ দিন তারা থেকেছে এই বাড়িতে। ভালো লেগেছে৷ মাহাথির ভাইয়ার সাথে ওইভাবে কথা না হলেও কথা হয়েছে৷ ভাইয়াটা একটু গম্ভীর। তার আশেপাশের বেশিরভাগ মানুষই গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। এই যেমন তার বাবা আগে থেকেই গম্ভীর৷ এই যে মাহাথির ভাই, সেও গম্ভীর। সবশেষে তার বউ৷ গম্ভীর রাণী।

পার্থিব এগিয়ে গেল রুমের দিকে৷ একপলক শ্রুতির দিকে তাকিয়ে নিজের ব্যাগ থেকে কিছু একটা বস্তু বের করলো৷ বস্তুটি হাতে এগিয়ে এলো৷ রুমের লাইট জ্বালালো সন্তপর্ণে। শ্রুতি ঘুমিয়ে আছে৷ শ্যামবর্ণা দুটো হাত বাহিরে বের করা৷ পার্থিবের ইচ্ছে হলো একটা কাজ করতে৷ সময় নিল না৷ আলগোছে হাতটা ধরে চুমু খেল সে৷ এরপর নিজের হাতের দুটো চুড়ি পরিয়ে দিল সাবধানে৷ হাতটা এতোদিন ফাঁকা ছিল৷ এখন বউ বউ লাগছে৷ যে কেউ দেখলে বলবে শ্যামবর্ণ হাতে চুড়িগুলো মানাচ্ছে না৷ অথচ পার্থিবের কাছে মনে হলো চুড়িগুলো তার স্ত্রীর জন্যই বানানো হয়েছে৷ ঘুমের মাঝেই হাতটা টেনে নিল শ্রুতি। ক্ষীণ নড়াচড়া শেষে গভীর ঘুমে মগ্ন হলো সে৷ পার্থিব হাসল৷ শ্রুতির সামনের কিছু চুল বেরিয়ে আছে। পার্থিব স্নেহের সাথে চুল সরিয়ে মাথায় হাত বুলালো। পার্থিবের খুব হাসি পেল৷ ইসসস! তার বউটা কত্তো রাগী একটা মেয়ে! পার্থিব হাসল। সেই সাথে বিড়বিড়ালো,
‘আমার শান্ত রাজ্যের রাগী রাণী।’

__________
~চলবে
#শারমিন_ইরান
#একগুচ্ছ_শুকতারা
শব্দসংখ্যা – ২০৯৮