🔴একজন মায়াবতী (পর্ব :৪, ৫)🔴
– হুমায়ূন আহমেদ
‘উড কিং’-এর মালিক বদরুল আলম, মনজুরের মেজো মামা। ‘উড কিং’ ছাড়াও ঢাকা শহরে তাঁর আরো দুটি ফার্নিচারের দোকান আছে। মূল কারখানা মালিবাগে। কারখানার সঙ্গে তার হেড অফিস।
এই মুহূর্তে তিনি মালিবাগের হেড অফিসে বসে আছেন। চায়ের কাপে মুড়ি ভিজিয়ে চামচ দিয়ে তুলে তুলে খাচ্ছেন। তাঁর সামনে কারখানার ম্যানেজার ইয়াসিন মোল্লা। ইয়াসিন মোল্লার হাতে গোটা দশেক রসিদ। একটু দূরে কান ধরে ‘উড কিং ফার্নিচারের সৰ্বকনিষ্ঠ কর্মচারী নসু। মিয়া দাঁড়িয়ে আছে। তার বয়স এগার। সে এক টিন তাৰ্পিন তেল পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। বদরুল আলম চা-পর্ব শেষ করেইনসুর শাস্তির ব্যবস্থা করবেন। নসুকে আসন্ন শাস্তির আশঙ্কাতে খুব উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে না।
বদরুল আলমের বয়স একষট্টি। শক্ত-সমর্থ চেহারার বেঁটেখাটাে মানুষ। তিনি ধমক না দিয়ে কোনো কথা বলতে পারেন না। কিছুদিন হলো আলসার ধরা পড়েছে। আলসারের চিকিৎসা হিসাবে সারাক্ষণ কিছু না কিছু খাচ্ছেন। চায়ে মুড়ি ভিজিয়ে খাওয়া সেই চিকিৎসারই অঙ্গ।
মনজুর ঘরে ঢুকে মামার দিকে তাকিয়ে হাসল। বদরুল আলম সেই হাসির দিকে কোনোরকম গুরুত্ব দিলেন না। এটাও তাঁর স্বভাবের অংশ। যে-কোনো আগন্তুককে প্রথমে কিছুক্ষণ তিনি অগ্রাহ্য করেন। ভাব করেন যেন দেখতে পান নি।
মনজুর পাশের চেয়ারে বসল। মামার দৃষ্টি আকর্ষণের কোনাে চেষ্টা করল না। কারণ সে জানে চেষ্টা করে লাভ হবে না।
ম্যানেজার ইয়াসিন মোল্লা ক্ষীণ গলায় বলল, স্যার, নসুর শাস্তির ব্যাপারটা শেষ করে দেন। ,
বদরুল আলম কড়া গলায় বললেন, শেষ করাকরি আবার কী? তাৰ্পিন তেলের টিনটিা উদ্ধার হয়েছে?
জ্বি স্যার।
তাহলে ঐ টিন থেকে বড় চামচে দুই চামচ তেল খাইয়ে দাও। এটাই ওর শাস্তি।
শাস্তির এই ব্যবস্থায় নসুকে খুব আনন্দিত মনে হলো। সে ফিক করে হেসেও ফেলল। ইয়াসিন মোল্লাকে দেখে মনে হচ্ছে শাস্তির এই ধারাটি তার পছন্দ না। সে বিরস গলায় বলল, স্যার রসিদগুলো একটু দেখবেন? দুই হাজার সিএফটি কাঠ …
বদরুল আলম। শুকনো গলায় বললেন, সব কিছু যদি আমি দেখি তাহলে আপনি আছেন কী জন্যে? এখন যান। নসুকে নিয়ে যান। শান্তি দেন।
তেল সত্যি সত্যি খাওয়াব?
অবশ্যই খাওয়াবেন। দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যান।
ঘর খালি হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে বদরুল আলম বললেন, আমার এই ম্যানেজার বিরাট চোর। থিফ নাম্বার ওয়ান।
মনজুর বলল, থিফ নাম্বার ওয়ান হলে বিদায় করে দেন না কেন? চোর পোষার দরকার কী?
দরকার আছে। পোষা চোর কী করে চুরি করে সেই কায়দা-কানুন জানা থাকে। ম্যানেজার ব্যাটা চুরি করামাত্র ধরে ফেলি। নতুন একজনকে নিলে তার চুরির কায়দাকানুন ধরতে ধরতে এক বৎসর চলে যাবে। এক বৎসরে সে দোকান ফাঁক করে দেবে, বুঝলি?
হ্যাঁ বুঝলাম।
কিছুই বুঝিাস নাই। ম্যানেজার রসিদগুলো নিয়ে ঘুরঘুর করছে। কেন করছে? কারণ চুরি আছে। ওর মধ্যে। বিরাট ঘাপলা। আমি তাকে কী বললাম? বললাম–আমি কিছু দেখতে পারব না–সে নিজে যেন দেখে। এখন সে নিশ্চিন্ত হয়ে চুরি করবে। আগের মতো সাবধান থাকবে না। ধরা পড়ে যাবে, ক্যাঁক করে ঘাড় চেপে ধারব। বুঝলি?
বুঝলাম।
কিছুই বুঝিস নাই। আমার কাছে কী ব্যাপার?
তোমাকে দেখতে এলাম।
ঠাট্টা করছিস নাকি?
ঠাট্টা করব কেন? মাসে এক বার তোমাকে দেখতে আসি না?
বদরুল আলম চােখ বন্ধ করে খানিকক্ষণ চিন্তা করলেন। মনজুর সত্যি কথাই বলছে। সে মাসে একবার আসে। প্রতি মাসের শেষের দিকে। ঘণ্টা খানেক থাকে।
কেন আসিস আমার কাছে?
তোমাকে দেখতে আসি।
কেন?
কী যন্ত্রণা, এত জেরা করছি কেন?
বদরুল আলম চোখ থেকে চশমা খুলে খানিকক্ষণ মনজুরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। চশমা খুলে তিনি প্রায় কিছুই দেখেন না। তবু কাউকে বিশেষভাবে দেখার প্রয়োজন হলে চশমা খুলে ফেলেন।
তোর কি শরীর খারাপ নাকি?
হুঁ।
সমস্যা কী?
শরীরের রক্ত ঠিকমতো পরিষ্কার হচ্ছে না।
কালোজাম খা। কালোজামে রক্ত পরিষ্কার হয়।
মনজুর হাসতে হাসতে বলল, শীতকালে কালোজাম পাব কোথায়? তাছাড়া কালোজামের স্টেজ পার হয়ে গেছে। কিডনি যেটা ছিল সেটাও যাই-যাই করছে।
কী বলছিস তুই!
সত্যি। আমি এখন কিডনির সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
ইয়ারকি করছিস নাকি?
ইয়ারকি করছি না। দুজন বড় ডাক্তার তাই বললেন।
বড় ডাক্তাররা কিছুই জানে না। ছােট ডাক্তারদের কাছে যা।
ছোট ডাক্তারদের কাছে যাব?
হ্যাঁ। ওরা যত্ন করা দেখবে। এই পাড়ায় একজন এল.এম.এফ ডাক্তার আছে। ভূপতি বাবু ভালাে। তার কাছে যাবি? ‘আমি নিয়ে যাব। আমার সঙ্গে খুব ভালাে খাতির।
না।
ছোট বলে অবহেলা করিস না। ছোট কাঁচামরিচের ঝাল বেশি।
ঝাল পচা আদারও বেশি। তাই বলে পচা অাদা কোনো কাজের জিনিস না।
বদরুল আলম দ্রুত চিন্তা করতে লাগলেন, পচা আদার কোনো ব্যবহার মনে পড়ে কিনা। মনে পড়ল না।
তোমার কাছে একটা কাজে এসেছি মামা।
টাকা-পয়সার কোনো ব্যাপার না হলে বল। টাকা-পয়সা ছাড়া সব পাবি।
টাকা-পয়সা কি তোমার নেই?
আছে। দেয়া যাবে না। টাকা ব্যবসায় খাটে। ব্যাংকে ফেলে রাখি না।
ব্যাংকে কিছু তো আছে?
তা আছে।
সেখান থেকে এক লাখ দেয়া যাবে?
এত লাগবে কেন?
কিডনি কিনতে হবে। লাখ খানিক টাকা লাগবে কিনতে। অপারেশন করাতে দেশের বাইরে যেতে হবে। সব মিলিয়ে দরকার তিন থেকে চার লাখ টাকা।
বদরুল আলম টেবিলে রাখা চশমা চোখে পরলেন। সহজ স্বাভাবিক গলায় বললেন, তুই কি জনে জনে ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছিস?
হ্যাঁ।
কোনো লাভ নাই–অন্য পথ ধর।
অন্য কী পথ ধরব?
তা আমি কী বলব। ভেবে-চিন্তে বার করা। তুই গরিব মানুষ, বাঁধাবি গরিবের অসুখ–দাস্ত, খোস-পাঁচড়া, হাম, জলবসন্ত, তা না… চা খাবি?
না।
খা। চা খা। ফ্রেশ মুড়ি আছে, খেজুর গুড় দিয়ে খা।
মনজুর উঠে দাঁড়াল।
বদরুল আলম বললেন, তুই কি রাগ করে চলে যাচ্ছিস নাকি? রাগ নিয়ে যাওয়া ঠিক না। তুই ঝগড়া করি আমার সঙ্গে। চিৎকার, চেঁচামেচি করা। তাহলে তোর মনটা হালকা হবে। তুই রোগী মানুষ, মনটা হালকা থাকা দরকার।
আমার মন হালকাই আছে।
আরে সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছিস?
হ্যাঁ।
বোস বোস। চা খেয়ে তারপর যা। সিগারেটখোররা বিনা সিগারেটে চা খেতে পারে না। এই জন্যে মুরুব্বিদের সামনে তারা চা খায় না। যা, তোকে সিগারেটের অনুমতি দিলাম। এখন চা খাবি তো? নাকি এখনো না!
মনজুর বসল।
বদরুল আলম গলার স্বর নিচু করে বললেন, মনটা খুবই খারাপ। তোর অসুখবিসুখের জন্যে না। অসুখ-বিসুখ তো মানুষের জীবনে আছেই। এই দেখ না বুড়ো বয়সে আমার হয়ে গেল আলসার।
মন খারাপ কী জন্যে?
আমার ছেলেমেয়েদের ব্যবহারে মনটা খারাপ। তারা এখন লায়েক হয়ে গেছে। সমাজে পজিশন হয়েছে। আমি যে একজন কাঠমিন্ত্রি এই জন্যে তারা লজ্জিত। আমাকে লোকজনের সামনে কীভাবে পরিচয় করিয়ে দেয় জানিস? বলে–ইনি আমার ফাদার। ব্যবসা করেন। টিম্বর মার্চেন্ট। আমি তখন কী করি জানিস? আমি গভীর হয়ে বলি–না রে ভাই। আমি কোনো টিম্বার মার্চেন্ট না। আমি একজন কাঠমিস্ত্রি।
তুমি তো সত্যি কাঠমিস্ত্রি না।
না তোকে বলল কে? কাঠের কাজ আমি করি না? এখনো করি।
চা এসে গেছে। মনজুর সিগারেট ধরিয়েছে। বদরুল আলম খেজুর গুড় দিয়ে মুড়ি চিবুচ্ছেন। ম্যানেজার ইয়াসিন মোল্লা একটু আগে এসে বলে গেছে–নস মিয়ার শান্তি দেয়া হয়েছে। তার্পিন তেল খাওয়ানো হয়েছে। সে এখন বমি করছে। বদরুল আলম বলেছেন–করুক। তুমি ফট করে ঘরে ঢুকবে না। কথা বলছি। এর মধ্যে একবার টেলিফোন এসেছে। বদরুল আলম রিসিভার তুলে রেখেছেন। এখন তাঁর টেলিফোনে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। মনজুরের সঙ্গে সুখ-দুঃখের কথা বলতে ভালো লাগছে। ছেলেটা ভালো। কোনো কথা বললে মন দিয়ে শোনে–দশজনের কাছে গিয়ে বলে না।
মনজুর।
জ্বি।
আমার সর্বকনিষ্ঠ পুত্রের কাণ্ডকারখানা শুনিবি?
বল।
বিয়ে করার পর মনে করছে–আহা কী করলাম। রাজকন্যা পেয়ে গেলাম। চোখেমুখে সব সময় ‘সখী ধর ধর’ ভাব। মুখে হাসি লেগেই আছে। কী মধুর হাসি। এখন কথা বলে শান্তিনিকেতনী ভাষায়–এলুম, গেলুম এইসব। ব্যাটা রবিঠাকুর হয়ে গেছে!
অসুবিধা কী?
অসুবিধা আছে। সবটা না শুনলে বুঝবি না।— গত বৃহস্পতিবার সকালে বারান্দায় এসে দেখি মতিন নেইল কাটার দিয়ে তার বৌয়ের পায়ের নখ কেটে দিচ্ছে। আমি না-দেখার ভান করে ঘরে ঢুকে গেলাম। তোর মামিকে বললাম— এই কুলাঙ্গারের মুখ দেখতে চাই না। লাথি দিয়ে একে ঘর থেকে বের করে দাও। একে আমি ত্যাজ্যপুত্ৰ করলাম।
নখ কাটা এমন কী অপরাধ?
বৌয়ের পায়ের নখ কেটে দেয়া অপরাধ না? তুই কখনো বৌমার পায়ের নখ কেটে দিয়েছিস?
না।
তাহলে?
আমি কি আদর্শ মানব? আমি যা করব সেটাই ঠিক, অন্যেরটা ঠিক না?
বদরুল আলম বিরক্ত গলায় বললেন, তুই আদর্শ মানব হবি কেন? তুই হচ্ছিাস গাধা-মানব। এখন কথা হলো, গাধা-মানব হয়ে তুই যে কাজটা করছিস না সেই কাজটা আমার কুলাঙ্গার করছে–বৌয়ের পায়ের নখ কেটে দিচ্ছে। তাও কোনো রাখঢাক নেই। বারান্দায় বসে কাটছে। হারামজাদা।
মতিনের বৌকে তো তুমি পছন্দ করা। কর না?
অবশ্যই করি। ও ভালো মেয়ে। ভেরি গুড গার্ল। আমার কুলাঙ্গারটা মেয়েটার মাথা খাচ্ছে। একদিন কী হবে জানিস? এই মেয়ে নেইল কাটার নিয়ে আমার কাছে এসে বলবে, বাবা আমার পায়ের নখগুলি একটু কেটে দিন তো।
মনজুর হেসে ফেলল। বদরুল আলম রাগী গলায় বললেন, হাসছিস কেন? হাসবি না। হাসি-তামাশা এখন আমার সহ্য হয় না। হাসি শুনলেই ব্লাডপ্রেসার বেড়ে যায়।
উঠি মামা?
আচ্ছা যা। কোনো চিন্তা করিস না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখা। গড অলমাইটি ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই।
মনজুর রাস্তায় এসেই রিকশা নিয়ে নিল। আগে হাঁটতে ভালো লাগত। এখন আর লাগে না। কয়েক পা এগোলেই ক্লান্তিতে হাত-পা এলিয়ে আসে। কয়েকবার সে রিকশাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আজ যে রকম ক্লান্ত লাগছে তাতে মনে হয়–রিকশায় উঠা মাত্রই ঘুমিয়ে পড়তে হবে।
রিকশাওয়ালা বলল, কই যাইবেন সাব?
মনজুর কিছু বলল না। কোথায় যাবে এখনো সে ঠিক করে নি। অফিসে যাওয়া যেত কিন্তু আজ অফিস বন্ধ। তাদের অফিস হচ্ছে একমাত্র অফিস যা সপ্তাহে দুদিন বন্ধ থাকে–শুক্রবার এবং রোববার। আফসার সাহেব তার সব কর্মচারীকে বলে দিয়েছেনদুদিন বন্ধ দিচ্ছি। এই কারণে যাতে বাকি পাঁচদিন আপনারা দশটা-পাঁচটা অফিস করেন এবং মন দিয়ে করেন।
আজ রোববার।
সব জায়গায় কাজকর্ম হচ্ছে। তাদের অফিস বন্ধ। নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকা যেত। শরীরের ক্লান্তি তাতে হয়তো খানিকটা কীটত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অফিস যেদিন থাকে সেদিনই শুধু ঘরে শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। অফিস বন্ধের দিন ইচ্ছে করে বাইরে বেরিয়ে পড়তে। আজ যেমন করছে। অবশ্যি যাবার মতো জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। ট্রেনে করে গ্রামের দিকে গেলে কেমন হয়? পছন্দ হয় এমন কোনো স্টেশনে নেমে পড়া। বিকেলের দিকে ফিরে আসা।
সাব যাইবেন কই?
সামনে।
রিকশাওয়ালা রিকশা টেনে নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তেমন উৎসাহ পাচ্ছে না। বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছে।
স্যারের শইল কি খারাপ?
হুঁ।
কী হইছে?
কিডনি নষ্ট–বেশিদিন বাঁচব না।
না বাঁচাই ভালো। বাঁইচ্যা লাভ কী কন? চাউলের কেজি হইল তের টাকা। গরিবের খানা যে আটা হেইডাও এগার টেকা কেজি।
খুবই সত্যি কথা–দেখি তুমি কমলাপুরের দিকে যাও তো।
রেল ইস্টিশন?
হুঁ।
ঘুম আসছে। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। মনজুর শক্ত করে রিকশার হুড চেপে ধরল। ঘুম হচ্ছে অনেকটা মৃত্যুর মতো। মৃত মানুষের শরীর যেমন শক্ত হয়ে যায়-ঘুমন্ত মানুষদের বেলায়ও তাই হয়। শরীর খানিকটা হলেও শক্ত হয়। ঘুমিয়ে পড়লেও হুড ধরা থাকবে। বাকুনি খেয়ে রিকশা থেকে পড়ে যাবার সম্ভাবনা কমে যাবে। অক্ষত অবস্থায় কমলাপুর রেল স্টেশনে পৌঁছানো যেতেও পারে।
অবশ্যি পৌঁছালেও যে শেষ পর্যন্ত কোথাও যাওয়া যাবে তা মনে হয় না। ইচ্ছা মরে যাবে। মানুষের কোনো ইচ্ছাই দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
কিছুদিন ধরে মনজুরের ইচ্ছা করছে অচেনা একজনের সঙ্গে দীর্ঘ সময় গল্প করা; যে তাকে চেনে না। কিন্তু না চিনলেও যে গল্প শুনবে আগ্রহ নিয়ে। প্রয়োজনে আগ্রহ নিয়ে গল্প শোনার জন্যে কিছু টাকা-পয়সাও দেয়া যেতে পারে। সমস্যা হলো, কেউ গল্প শুনতে চায় না ; সবাই বলতে চায়। সবার পেটে অসংখ্য গল্প।
মেজো মামার সঙ্গে আরো খানিকক্ষণ থাকলে তিনি মতিনের নতুন কিছু গল্প শুনাতেন। গল্প বলতে পারার আনন্দের জন্যে মেজো মামার মতো মানুষও তাকে সিগারেট খাবার অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন।
স্যার নামেন। কমলাপুর আসছে।
মনজুরের নামতে ইচ্ছা করল না। কেমন যেন মাথাটা ঘুরাচ্ছে। বমি-বমি লাগছে। ঝকঝকে রোদ। সেই রোদ এমন কড়া যে চোখে লাগছে। খুবই তীক্ষ কোনো সুচ দিয়ে রোদের ছবি কেউ যেন চোখের ভেতর আঁকছে।
সাব নামেন।
ভাই শোন, এখানে নামিব না। তুমি আমাকে আমার বাসায় নিয়ে যাও। ভাড়া নিয়ে চিন্তা করবে না। যা ভাড়া হয় তার সঙ্গে পাঁচ টাকা ধরে দেব বকশিশ।
বাসা কোনহানে?
বলছি–তুমি চালাতে শুরু কর, তারপর বলছি।
টাইট হইয়া বহেন।
বসেছি। টাইট হয়ে বসেছি। তুমি আস্তে চালাও।
রিকশাওয়ালা খুবই ধীরগতিতে রিকশা চালাচ্ছে। সে বুঝতে পারছে রিকশার প্যাসেঞ্জার ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমিয়ে পড়লে ভালাে কথা— অজ্ঞান না হয়ে পড়লেই হয়। রিকশাওয়ালা পথের পাশে গজিয়ে-ওঠা একটা চায়ের স্টলের কাছে এনে রিকশা থামাল। প্যাসেঞ্জার খানিকক্ষণ ঘুমােক। এই ফাঁকে সে টেস্ট দিয়ে এক কাপ চা খেয়ে নিবে। ভাড়া হিসাবে বাড়তি কিছু টাকা পাওয়া যাবে। একটা টাকা চা-টােষ্টের জন্যে খরচ করা যায়। সে চায়ের কাপ নিয়ে উবু হয়ে বসেছে, এমন সময় হৈহৈ শব্দ উঠল। ঘুমন্ত প্যাসেঞ্জার গড়িয়ে রিকশা থেকে পড়ে গেছে। পড়ে গিয়েও তার ঘুম ভাঙছে না। তার মানে ঘুম নালোকটা হয় অজ্ঞান হয়ে গেছে, নয় মারা গেছে।
লোকজন লোকটাকে ধরাধরি করে তুলছে। তুলতে থাকুক, এই ফাঁকে সে দ্রুত চা-টা শেষ করতে চায়। চা-টা মজা হয়েছে। দ্রুত চা খেতে গিয়ে রিকশাওয়ালা মুখ পুড়িয়ে ফেলল।
পর্ব ৪ শেষ 📌
🔴পর্ব :৫🔴
স্যার আপনি কেমন আছেন?
মনজুর জবাব দিল না। জবাব না দেয়ার দুটি কারণের একটি হচ্ছে প্ৰশ্নকর্তার গলার স্বর সে চিনতে পারছে না। অচেনা একজনের প্রশ্নের জবাব দেয়ার তেমন প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয় কারণ–কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। সমস্ত শরীর জুড়ে আরামদায়ক আলস্য। তন্দ্ৰা ভাব। প্ৰচণ্ড ঘুম আসার আগের অবস্থা। একটা কোলবালিশ জড়িয়ে পাশ ফিরে ঘুমাতে পারলে হত। শীত শীত লাগছে। গায়ের উপর কম্বল দেয়া আছে কি? সম্ভবত আছে। তবে সেই কম্বল খুব ঠাণ্ডা। মনে হচ্ছে রাবারের কম্বল।
স্যার আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন? আমি জাহানারা। এখন আপনার শরীর কেমন?
চোখ না মেলেই বলল, শরীর ভালো।
আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন?
মনজুর বিরক্ত হচ্ছে। এটা কী ধরনের প্রশ্ন? তাকে চিনতে পারা না-পারায় কী যায় আসে? কিছুই যায় আসে না। তবে সে চিনতে পারছে। মনজুর তাকাল। না। তাকানোই ভালো ছিল। তীব্র আলো ধক করে চোখে লাগল। প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গেই মাথায় ভোতা যন্ত্রণা শুরু হলো। ডান হাত অসাড় হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। হাতে কি স্যালাইন দেয়া হচ্ছে? এটা হাসপাতাল, না ক্লিনিক? পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বলে মনে হচ্ছে। হাসপাতাল না হওয়ারই কথা।
স্যার, আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন?
কেমন আছ জাহানারা?
জ্বি স্যার ভালো।
এটা কি কোনো ক্লিনিক?
জ্বি না–মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।।
ও আচ্ছ।
আপনি যে হাসপাতালে সেটা জানতাম না। বারটার সময় হাসপাতাল থেকে টেলিফোন করল অফিসে। আপনার মানিব্যাগে ভিজিটিং কার্ড ছিল। আপনি স্যার পুরো একুশ ঘণ্টা অজ্ঞান ছিলেন।
ও আচ্ছা।
টেলিফোন ধরেছিলেন চিত্ত বাবু। তিনি কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। আমাকে বললেন, জাহানারা, হাসপাতাল থেকে টেলিফোন এসেছে। কী বলছে কিছুই বুঝতেছি। না। তুমি ম্যাসেজটা রেখে দাও তো, আমি তখন …
জাহানারা হড়বড় করে কথা বলে যাচ্ছে।
মনজুর স্বপ্নেও ভাবে নি, এই মেয়ে এত কথা বলতে পারে। এতদিন পর্যন্ত তার ধারণা ছিল, এই মেয়ে শুধু প্রশ্ন করলেই জবাব দেয়। নিজ থেকে কথা বলে না। এখন মনে হচ্ছে মেইল ট্রেন। দাঁড়ি-কমা ছাড়া কথা বলে যাচ্ছে। মেয়েটা বোধহয় ভয় পেয়েছে। যেসব মানুষ এমনিতে কম কথা বলে তারা ভয় পেলে প্রচুর কথা বলে।
স্যার, আপনার এখন কেমন লাগছে?
ঘুম পাচ্ছে।
ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছি। ডায়ালাইসিস করা হবে। রক্তে টক্সিক মেটেরিয়াল বেশি হয়ে গেছে। এগুলো ডায়ালাইসিস করে সরাবে। তখন ভালো লাগবে।
আচ্ছা, তুমি তাহলে এখন যাও। আমি খানিকক্ষণ। ঘুমােব।
আমার স্যার এখন যাওয়ার কোনো তাড়া নেই। আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। আপনার আখীয়াজন কাকে কাকে খবর দিতে হবে, বলুন, আমি খবর দিয়ে দিব।
কাউকে খবর দিতে হবে না।
ভাবি? ভাবিকে খবর দিব না?
দাও–টেলিফোন নাম্বার হলো…
উনার টেলিফোন নাম্বার আমি জানি। গত মঙ্গলবারের আগের মঙ্গলবার আপনার খোজে টেলিফোন করেছিলেন–তখন উনি তাঁর নাম্বার বললেন। আমি আমার নোট বইয়ে উনার নাম্বার লিখে রেখেছি…
মনজুর অসম্ভব বিরক্ত হচ্ছে।
এত কথা বলছে কেন এই মেয়ে? কে তাকে এখানে আসতে বলেছে? মনজুর মনে মনে বলল, ‘মাই ডিয়ার ইয়াং লেডি, ইউ হ্যাভ নো বিজনেস হিয়ার।’ কেন মাথার কাছে দাঁড়িয়ে বকবক করছ? কে তোমার বকবকানি শুনতে চাচ্ছে? তুমি দয়া করে বিদেয় হও। আমাকে ঘুমাতে দাও। ঘুম পাচ্ছে।
আরাম করে একটা ঘুম দিতে পারলে শরীর ঝরঝরে হয়ে যেত। এই মেয়ে তা হতে দেবে না। মানুষ ভিন্ন পরিবেশে সম্পূর্ণ ভিন্ন আচরণ করে। অফিসে এই মেয়ে একটা কথাও বলে না। হাসপাতালে দাঁড়ি-কমা ছাড়া কথা বলে। বাসায় সে কী করে?
স্যার, ঘুমিয়ে পড়েছেন?
মনজুর জবাব দিল না। চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল। যাতে ঘুমিয়ে পড়ছে মনে করে মেয়েটা তাকে মুক্তি দেয়।
স্যার, এখন ঘুমাবেন না। ডাক্তার সাহেব আসছেন। উনার সঙ্গে কথা বলে তারপর ঘুমান। আপনাকে কি আরেকটা বালিশ দিতে বলব? এদের বালিশগুলো খুব পাতলা।
ডাক্তার সাহেব বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। মনজুরের টেম্পারেচার চার্ট দেখছেন। ডাক্তার ভদ্রলোক খুব রোগা। তাঁকে সরলরেখার মতো লাগছে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নার্সটি বেশ গোলগােল। মনজুরের মনে হলো–নার্সিটিকে ‘০’এর মতো দেখাচ্ছে। ডাক্তার যদি ইংরেজি এক হয় তাহলে এই দুজনে মিলে হল দশ।… এইসব কী সে ভাবছে? তার কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেল? ডাক্তার নিচু হয়ে মনজুরের কপালে হাত রাখলেন। অন্তরঙ্গ গলায় বললেন, কেমন আছেন?
ভালো।
শরীর কি খুব দুর্বল লাগছে? বমি ভাব আছে?
আছে।
মাথা ঘুরছে?
না–তবে মাথার ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
এ ছাড়া আর কোনো অসুবিধা আছে?
আছে। আপনাকে গোপনে বলতে চাই। অন্যদের যেতে বলুন।
ডাক্তারকে কিছু বলতে হলো না। সবাই দূরে সরে গেল। মনজুর গলার স্বর নিচু করে বলল, ঐ যে প্রিন্টের শাড়ি-পরা মেয়েটাকে দেখছেন–তাকে যেতে বলুন। সে আমাকে বড় বিরক্ত করছে। ঘুমাতে দিচ্ছে না।
তাকে সরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করছি। এটাই কি আপনার গোপন কথা না। আরো কিছু বলবেন?
না, আর কিছু বলব না। আমার অবস্থাটা কী–জানতে পারি?
টেস্ট প্ৰায় সবই করা হয়েছে। আপনার কিডনি ভালো কাজ করছে না। তবে এই মুহুর্তে চিন্তার কিছু নেই। ডায়ালাইসিস করলেই আরাম বােধ করবেন। ইতিমধ্যে কিডনি ট্রান্সপ্লেন্টের ব্যবস্থা করতে হবে। আপনি চেষ্টা করে দেখুন কোনো ডোনার পাওয়া যায় কিনা। আপন ভাইবোন হলে ভালো হয়। না পাওয়া গেলে রক্ত-সম্পর্ক আছে এমন কেউ। সন্ধ্যাবেলা ডক্টর ইমতিয়াজ আসবেন। উনি সব বুঝিয়ে বলবেন। আপনি এখন রেস্ট নিন। চুপচাপ শুয়ে থাকুন। ঘুমাবার চেষ্টা করুন। যে-কোনো অসুখেই বিশ্রাম চমৎকার মেডিসিন।
ডাক্তারের কথা শেষ হবার আগেই মনজুর ঘুমিয়ে পড়ল। এমন ঘুম যা মানুষকে আরো ক্লান্ত করে দেয়। কারণ সে ঘুমাচ্ছে অথচ আশপাশের সমস্ত শব্দ শুনছে। পাশের বেডের রোগী কাশছে। এই শব্দও ঘুমের মধ্যে শুনতে পাচ্ছে। নার্স এসে কাকে যেন ধমকাচ্ছে–সেই ধমকের প্রতিটি শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঘুমন্ত মানুষের ঘাণশক্তি কাজ করে না-তার কাজ করছে। ঘর মুছে যখন ফিনাইল দেয়া হলো–সে ঘুমের মধ্যে ফিনাইলের কড়া গন্ধ পেল।
মনজুরের ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার আগে আগে। বিছানার কাছে দুটি ডাব হাতে কুদ্দুস মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে অপরাধী-অপরাধী ভাব। কুদ্দুস অস্পষ্ট স্বরে বলল, স্যারের শরীরটা এখন কেমন?
শরীর ভালো।
দুইডা ডাব আনলাম স্যার। আমার নিজের গাছের ডাব।
বেডের নিচে রেখে দাও।
কেটে দেই স্যার? এখন একটা খান?
এখন খেতে ইচ্ছা করছে না।
না খেলে তো স্যার শরীরে বলা হবে না।
বল না হলেও কিছু করার নাই। তুমি এখন আমার সামনে থেকে যাও। কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।
ঐ দিনের ঘটনার জন্যে আমি মাফ চাই স্যার।
আচ্ছা ঠিক আছে।
আপনি মাফ না দিলে…
মাফ না দিলে কী?
কুদ্দুস মাথা চুলকাচ্ছে–কথা পাচ্ছে না। আগে ভালোমতো রিহার্সেল দিয়ে আসে নি। কুদ্দুসের উচিত ছিল কী কথাবার্তা বলবে সব ঠিক করে আসা। তা করে নি। অবশ্যি অনেক সময় ঠিক করে এলেও বলার সময় সব এলোমেলো হয়ে যায়। এই ব্যাপারটা তার বেলায় অসংখ্যবার ঘটেছে। ভেবেচিন্তে ঠিক করে রাখা কথা একটাও সে কোনো দিন বলতে পারে নি।
কুদ্দুস তুমি এখন যাও। কথা বলা আমার নিষেধ আছে।
জ্বি আচ্ছা।
অফিসেও সবাইকে বলবে–তারা যেন না। আসে।
আচ্ছা স্যার বলব।
থ্যাংকস। তোমার ডাব আমি এক সময় খাব।
কুদ্দুস মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, স্যার শুনলাম আপনার একটা কিডনি দরকার?
ঠিকই শুনেছ। তুমি কি দিতে চাও?
কুদ্দুস হ্যাঁ-না কিছুই বলল না।
মনজুর সহজ স্বাভাবিক গলায় বলল, দিতে চাইলে পরে এ নিয়ে কথা বলব। এখন যাও।
ডাব দুইটা মনে করে খাবেন স্যার।
বললাম তো খাব।
নিজের গাছের ডাব। বাবা নিজ হাতে গাছ পুঁতেছিলেন।
মনজুর মৃদু গলায় বলল, যাত্রাবাড়ির ঐ বাড়ি কি তোমাব নিজের?
জ্বি না, ভাড়া বাড়ি।
কবে এসেছ ঐ বাড়িতে?
দুই বছর আগে। শ্রাবণ মাসে।
দুই বছর আগে পোঁতা গাছে ডাব হয়ে গেল?
কুদ্দুস ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে। মনজুর বড়ই বিরক্ত বোধ করছে। এ ভালোমতো মিথ্যা বলাও শিখে নি। জেরায় টিকতে পারে না। সামান্য বুদ্ধি থাকলে বলত–দেশের বাড়ির ডাব। বাবা দেশ থেকে নিয়ে এসেছেন। তা না বলে কেমন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মনজুর চোখ বন্ধ করে পাশ ফিরল। কুদ্দুস ক্ষীণ গলায় বলল, স্যার আমি যাই?
আচ্ছা যাও।
কুদ্দুস যাই বলেও অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।
মনজুর চোখ বন্ধ করেও তা বুঝতে পারছে। অসুখের সময় মানুষের ইন্দ্ৰিয় তীক্ষ্ণ হয়। মনজুর চোখ মেলল কুদ্দুস চলে যাবার পর। প্রথমেই চোখে পড়ল বিছানার পাশের একগাদা ম্যাগাজিন। কয়েকটা কবিতায় বই। কবিতার বইগুলোতে মীরার নাম লেখা। নিশ্চয়ই জাহানারার কাণ্ড। অফিসে তার ঘরের শেলফ থেকে নিয়ে এসেছে। জাহানারার হয়তো ধারণা মনজুর কবিতার পোকা। মনে করাই স্বাভাবিক। সে অনেক বার মনজুরের হাতে কবিতার বই দেখেছে। সে জানেও না মনজুর এইসব বই মুখের সামনে ধরে পাতা ওল্টানো ছাড়া কিছুই করে না। দু একবার যে পড়ার চেষ্টা করে নি তা না। চেষ্টা করেছে–ভালো লাগে নি।
ডান হাতে এখনো স্যালাইনের সুচ বিঁধে আছে। মনজুর বাঁ হাতে একটা কবিতার বই টেনে নিল।
সমুদ্রের জলে আমি থুতু ফেলেছিলাম
কেউ দেখে নি, কেউ টের পায় নি
প্ৰবল ঢেউয়ের মাথায় ফেনার মধ্যে
মিশে গিয়েছিল আমার থুতু
তবু আমার লজ্জা হয়, এতদিন পর আমি শুনতে পাই
সমুদ্রের অভিশাপ।
মনজুর খানিকটা হকচকিয়ে গেল। তার নিজের সঙ্গে কবিতার মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। মীরাকে নিয়ে সে-কক্সবাজার গিয়েছিল। সমুদ্রের মতো এত সুন্দর জিনিস। অথচ সে কিনা। থুতু ফেলল সমুদ্রে। মীরা ভ্রু কুঁচকে বলল, আশ্চর্য! তুমি সমুদ্রে থুতু ফেললে। ছিঃ! সে নিজেও হকচকিয়ে গেল। মীরা বলল, এত বিশাল একটা জিনিসের গায়ে তুমি থুতু ফেলতে পারলে?
মনজুর হালকা গলায় বলল, সমুদ্র তো আমাদের দেবতা না মীরা। ওর গায়ে থুতু ফেললে কিছু যায় আসে না।
অবশ্যই সমুদ্রের কিছু যায় আসে না। সমুদ্রের কথা আমি ভাবছি না। আমি তোমার কথা ভাবছি। তুমি কোন মানসিকতায় এটা পারলে?
মুখে থুতু এসেছিল–ফেলে দিয়েছি। এর বেশি কিছু না। মীরা পুরো বিকেলটা কাটাল চুপচাপ। যেন বড় ধরনের আঘাত পেয়েছে।
তলপেটে ব্যথা হচ্ছে।
তীব্ৰ ব্যথা না–এক ধরনের আরামদায়ক ব্যথা। যে ব্যথায় শরীরে ঝিমঝিম ভাব হয়। কড়া ঘুমের ওষুধ খাবার পর শরীরে যেমন আবেশের সৃষ্টি হয়–ব্যথাটা ঠিক সে রকম আবেশ তৈরি করছে। কবিতার বইয়ের পাতা ওল্টাতে ভালো লাগছে না। ক্ষুধা বোধ হচ্ছে—বমি বমি ভাবটা যাচ্ছে না।
রাতের খাবার নিয়ে এল সন্ধ্যা মিলানোর আগেই। ভাত, মাছ, সবজি। তবে কিছু কিছু রোগীর জন্যে অন্য ধরনের খাবারও আছে। যেমন তার জন্যে এসেছে দু স্নাইস রুটি, এক বাটি দুধ এবং একটা কলা।
মনজুর আধখান কলা খেল। তার পাশের বেডের রোগী বলল, ভাইজান কলাডা ফালাইয়েন না। রাইখ্যা দেন। রাইতে ক্ষিধা চাপলে খাইবেন। এরা রাইতে কোনো খাওন দেয় না। ক্ষিধায় কষ্ট হয়।
মনজুর বলল, আপনার নাম কী?
রোগী এই প্রশ্নের জবাব দিল না। পাশ ফিরে কম্বল দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। যেন একটা জরুরি খবর দেয়ার প্রয়োজন ছিল, সে দিয়েছে। তার আর কিছু বলার নেই।
স্যার আপনার জন্য খাবার এনেছি।
ছোট্ট টিফিন ক্যারিয়ার হাতে জাহানারা দাঁড়িয়ে আছে। জাহানারার পাশে রোগা পনের-ষোল বছরের একটা ছেলে। সে দেখতে অবিকল জাহানারার মতো। তবে মনে হচ্ছে খুব লাজুক। একবারও মুখ তুলে তাকায় নি।
স্যার ও আমার ছোট ভাই–ফরিদ। এইবার ম্যাট্রিক দিবে। ওকে নিয়ে এসেছি। ও আপনার সঙ্গে থাকবে।
আমার সঙ্গে থাকবে কেন?
যদি কখনো কিছু দরকার হয়।
কোনো কিছু দরকার হবে না। আর দরকার হলে কত লোকজন আছে।
স্যার, ও বারান্দায় হাঁটাহঁটি করবে। মাঝে মাঝে আপনাকে দেখে যাবে।
মনজুর বিরক্ত গলায় বলল, জাহানারা তুমি যন্ত্রণা করছি কেন? ওকে নিয়ে তুমি যাও তো। আর শোন, রাতের খাবার আমি খেয়ে নিয়েছি। খাবারও নিয়ে যাও। এক্ষুণি।
জাহানারার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। তার ভাই ভীত চোখে তাকাচ্ছে বোনের দিকে। জাহানারার চোখ তখন জলে ভিজে উঠল। সে প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলল, ফরিদ আয়।
দুই ভাইবোন ক্লান্ত পায়ে এগোচ্ছে বারান্দার দিকে। ফরিদ ফিসফিস করে বলল, আপা এত লোকজনের সামনে কাঁদছ? সবাই তাকিয়ে আছে তোমার দিকে! জাহানারা বলল, থাকুক।
ফরিদ বলল, আপা চল বাসায় চলে যাই।
জাহানারা বলল, না।
আমরা তাহলে কী করব?
এখানে থাকব। বারান্দায় হাঁটাহাটি করব।
ফরিদ তার বোনের দিকে তাকাল, কিছু বলল না। বড় বোনকে সে খুব ভয় পায়।
হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে হয় না। কিন্তু জাহানারা দাঁড়িয়ে আছে। সে ঘর থেকে যেতে পারছে না। এই মানুষটা তার জন্যে যা করেছে তার কিছুই সে ফেরত দিতে পারছে না। কিন্তু সে ফেরত দিতে চাচ্ছে। সে ইচ্ছাটাও এই মানুষটা জানতে পারছে না।
এই মানুষটা তাকে এবং তার পরিবারকে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়েছে।। সে সময় কী ভয়াবহ অবস্থা! খবরের কাগজে যেখানে যা দেখেছে সে অ্যাপ্লিকেশন করে দিচ্ছে। ফ্যামিল প্ল্যানিং-এর কর্মী, সেলসম্যান, টেলিফোন অপারেটর, ফুলের দোকানের কর্মচারী, বিউটি পার্লারের বিউটিশিয়ান। যোগ্যতা আছে কিনা তা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। অ্যাপ্লিকেশন করা এবং সন্ধ্যায় মন খারাপ করে মার সঙ্গে বসে থাকা এই ছিল কাজ। মা কাঁদতেন নিঃশব্দে এবং এক সময় বলতেন, এখন কী হবে রে?
জাহানারা বলত, জানি না মা।
দেশের বাড়িতে যাবি? তোর এক চাচা আছেন। উনি কি আর ফেলে দেবেন? যাবি দেশের বাড়িতে?
জানি না মা।
তুই বল–এখন কী করব?
আল্লাহু আল্লাহ করা। এ ছাড়া কী আর করবে।
এই রকম অবস্থায় সে ইন্টারভু্য দিতে এল থ্রী পি-তে। থ্রী পি-র মালিক নিজেই আছেন ইন্টারভ্যু বোর্ডে। তাঁর সঙ্গে আরো তিনজন। সেই তিনজনের একজন মনজুর সাহেব।
বড় সাহেব বললে, আপনার টাইপিং স্পিড কত?
জাহানারা ক্ষীণ স্বরে বলল, টাইপ জানি না। স্যার।
তিনি অত্যন্ত বিরক্ত গলায় বললেন, চাওয়া হয়েছে টাইপিষ্ট আর আপনি টাইপ না জেনেই দরখাস্ত করেছেন?
স্যার আমি শিখে নেব।
ডিয়ার ইয়াং লেডি, এটা তো টাইপ শেখার স্কুল নয়। আচ্ছ আপনি যান। নেক্সট।
তেতাল্লিশ জন ইন্টারভ্যু দিচ্ছে। তাদের সবারই নিশ্চয়ই চাকরি প্রয়োজন। কিন্তু তার মতো কি প্রয়োজন? না, তার মতো প্রয়োজন কারোরই নেই। জাহানারা বাড়ি চলে গেল না। সারাদিন বসে রইল। ইন্টারভ্যু শেষ হবার পর আরেকবার সে যাবে। দরকার হলে চিৎকার করে কাঁদবে।
তার প্রয়োজন হলো না। মনজুর বের হয়ে এসে তাকে দেখে বলল, আপনার তো ইন্টারভ্যু হয়ে গেছে, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? জাহানারা প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলল, স্যার আপনার সঙ্গে কি আমি একটু কথা বলতে পারি?
বলুন।
স্যার আমি এক রাতের মধ্যে টাইপ শিখব।
আপনার কি চাকরিটা খুব বেশি দরকার?
জ্বি।
বসুন এখানে। দুপুরে কিছু খেয়েছেন?
জাহানারা জবাব দিল না।
মনজুর খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে কনফারেনস রুমে ঢুকে গেল। বেরিয়ে এল আধঘণ্টা পর। হাতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। বাড়ি ভাড়া, মেডিক্যাল অ্যালাউন্স সব মিলিয়ে তিন হাজার দুশ টাকা। অকল্পনীয় ব্যাপার।
মনজুর বলল, তোমার বয়স খুবই কম। আমি তুমি করে বললে আশা করি রাগ করবে না। এই নাও অ্যাপিয়েন্টমেন্ট লেটার। এস আমার সঙ্গে চা খাও।
জাহানারা কোনো কথা না বলে পেছনে পেছনে এল। তার খুব ইচ্ছা করছে। চিৎকার করে বলে–থ্যাংক ইউ স্যার। থ্যাংক ইউ। সে বলতে পারল না। তার গলা ভার ভার হয়ে আসছে। চোখ জ্বালা করছে।
বস জাহানারা।
জাহানারা বসল। মনজুর বলল, আমি ধার হিসেবে তোমাকে এখন কিছু টাকা দেব যা তুমি মাসে মাসে আমাকে শোধ করবে। দেব?
জাহানারা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
জাহানারার মা মানত করেছিলেন–মেয়ের চাকরি হলে একশ রাকাত নামাজ পড়বেন। সেই একশ রাকাত নামাজ শেষ হতে রাত চারটা বেজে গেল। জাহানারা তখনো জেগে। বারান্দায় অন্ধকারে চুপচাপ বসে আছে।
মা বারান্দায় এসে বললেন, পৃথিবীতে মানুষ এখনো আছে। এই রকম মানুষ বেশি। থাকার দরকার নেই। কিছু হয়। একবার কি তুই উনাকে এই বাসায় নিয়ে আসবি? শুধু দেখব। উনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।
জাহানারা কিছু বলল না।
তার তখনো পুরো ব্যাপারটা বিশ্বাস হচ্ছে না। শুধু মনে হচ্ছে স্বপ্ন। পুরোটাই স্বপ্ন। এসব জিনিস বাস্তবে কখনো ঘটে না। স্বপ্লেই ঘটে।
পর্ব ৫ শেষ 📌