🔴একজন মায়াবতী (পর্ব :৮, ৯)🔴
– হুমায়ূন আহমেদ
ছদিন পর মনজুর অফিসে এসেছে
ছদিন পর মনজুর অফিসে এসেছে।
তাকে দেখে মনে হচ্ছে না। সে অসুস্থ। বরং চকলেট রঙের শার্টে তাকে অন্যদিনের চেয়ে হাসিখুশি লাগছে। অনেকদিন পর ক্লিন শেভ করলে গালে এক ধরনের আভা দেখা যায়, তাও দেখা যাচ্ছে।
কুদ্দুস বিক্ষিত হয় বলল, স্যার আপনে অফিসে আইলেন?
মনজুর বলল, আসা কি নিষেধ নাকি?
কুদ্দুস দাঁত বের করে হাসল। অফিসের অন্য কেউ হাসল না। কনসট্রাকশন উল্লে মানেজার পরিমল বাবু বললেন, শুনেছিলাম। আপনি গুরুতর অসুস্থ, তা বােধহয় মিথ্যা।
মনজুর হ্যাঁ-না কিছু বলল না। পরিমল বাবু মানুষটিকে সে পছন্দ করে না। কেন করে না তাও জানে না। এমনিতে পরিমল বাবু নিতান্তই ভদ্রলোক, পরোপকারী। অফিসের কাজেও অত্যন্ত দক্ষ। তিনি খুব অল্প সংখ্যক কৰ্মচারীদের একজন যিনি দশটাপাঁচটা অফিস করেন এবং চেয়ারের পেছনে কোট বুলিয়ে বাড়ি চলে যান না।
পরিমল বাবু বললেন, মনজুর সাহেব অফিসে আপনার সমস্যা কী বলুন তো?
মনজুর বিস্মিত হয়ে বলল, আমি তো কোনো সমস্যার কথা জানি না।
না, মানে পে-স্লিপ দেখছিলাম, লক্ষ করলাম পে-স্লপে আপনার নাম নেই। এ মাসে বেতন হয় নি।
ও আচ্ছা।
আপনি ক্যাশিয়ার সাহেবের সঙ্গে একটু কথা বলে দেখুন তো ব্যাপারটা কী? আমি নিজেই জিজ্ঞেস করতাম, তারপর ভাবলাম, আমি বাইরের লোক, আই মিন আমি ইন্ভল্ভড নই। যার সমস্যা তাকেই প্ৰথমে খোঁজ নিতে হবে। আপনি ক্যাশিয়ারকে জিজ্ঞেস করুন।
মনজুর বলল, মনে হয় চাকরি চলে গেছে।
চাকরি চলে গেছে মানে? এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আপনি জন্মলগ্ন থেকে আছেন। বলতে গেলে এই প্রতিষ্ঠান আপনার নিজের হাতে তৈরি। সেখানে বিনা নোটিশে চাকুরি চলে যাবে? আপনি এক্ষুণি ক্যাশিয়ার সাহেবের সঙ্গে কথা বলুন।
আচ্ছা বলব।
স্যারও অফিসে আছেন। উনার সঙ্গে কথা বলে দেখুন কী ব্যাপার। আপনার মতো মানুষের হুট করে চাকরি চলে যাওয়া তো ভয়াবহ কথা। আপনারই যদি এই ব্যাপার হয় তাহলে আমাদের কী হবে?
মনজুর ক্যাশিয়ার সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে গেল না। ক্যাশিয়ার সাহেব নিজেই এলেন। বেশ খানিকক্ষণ শরীরের খোঁজখবর নিয়ে বললেন, আপনি কি খবর কিছু শুনেছেন?
কোন খবরের কথা বলছেন?
আপনার পে-স্লিপের ব্যাপার।
শুনলাম।
আমি যথারীতি সব পে-স্লিপ বড় সাহেবের কাছে পাঠিয়েছি। বড় সাহেব সব পে-স্লিপেই সই করলেন, আপনারটায় করলেন না।
মনজুর উদাস গলায় বলল, না করলে কী আর করা।
আপনি স্যারের সঙ্গে দেখা করুন। আমরা সবাই এই ব্যাপারে আপসেট। আমার তো মনটাই খারাপ হয়ে গেছে। আপনি অসুস্থ মানুষ। এখন টাকা দরকার। আমি বড় সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম। উনি বললেন…
ক্যাশিয়ার সাহেব কথা শেষ করলেন না। অস্বস্তি নিয়ে চুপ করে গেলেন। মনজুরও কিছু জিজ্ঞেস করল না। বেশি জানা ভালো না। জানলে মন খারাপ হবে।
মনজুরকে বড় সাহেবের ঘরে নিজ থেকে যেতে হলো না। বড় সাহেবই তাঁকে ডেকে পাঠালেন। মনজুর ঘরে ঢোকামাত্র নুরুল আফসার বললেন, তোর শরীর কেমন?
মনজুর বলল, ভালো না। মারা যাচ্ছি বলে মনে হয়।
কবে নাগাদ মারা যাচ্ছিস।
সম্ভবত মাস ছয়েক টিকিব।
কিডনি বদলে ফেল।
চেষ্টা করছি।
পাচ্ছিস না?
না।
এই দরিদ্র দেশে কিডনি পাবি না একটা কথা হলো? পাঁচশ টাকা দিয়ে এই দেশে মানুষ খুন করা যায়। তুই কিডনি চেয়ে বিজ্ঞাপন দে, লিখে দে কুড়ি হাজার টাকা নগদ দেয়া হবে; দেখবি পাঁচশ এপ্লিকেশন পড়ে গেছে। নে সিগারেট নে।
মনজুর সিগারেট ধরাল।
চা খাবি মনজুর?
না।
খা এক কাপ আমার সঙ্গে। মুখ অন্ধকার করে বসে আছিস কেন? ইজ এনিথিং রং?
না।
ভালো করে চিন্তাভাবনা কর; তারপর বল–ইজ এনিথিং রং?
না।
ভেরি গুড়। তোর বেতন এ মাসে হয় নি সেটা দেখেছিস?
শুনলাম।
কিছু বলতে চাস?
না।
এক অক্ষরে সব কথার উত্তর দিচ্ছিস-ব্যাপার কী? তুই কি কোনো কারণে আমার উপর রেগে আছিস?
না। রেগে নেই।
তাহলে এমন মুখ গোমড়া করে আছিস কেন? একটা রসিকতা শুনবি–শোন, রিডার্স ডাইজেস্টে পড়লাম। এক ভদ্রলোক মৃত্যুর সময় বললেন, সবাই বলে পরকালে টাকা পয়সা কোনো কাজে লাগে না। কথাটা আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না। আমি মৃত্যুর পর সঙ্গে করে পঞ্চাশ হাজার ডলার নিয়ে যেতে চাই। ভদ্রলোক নগদ পঞ্চাশ হাজার ডলার তাঁর স্ত্রীকে দিয়ে বললেন, আমার কফিনে এই টাকাটা দিয়ে দিও। ভুল হয় না যেন। তাঁর স্ত্রী করলেন কী–নগদ ডলার রেখে দিয়ে পঞ্চাশ হাজার ডলারের একটা চেক দিয়ে দিলেন। হা-হা-হা।
নুরুল আফসার সমস্ত শরীর দুলিয়ে হাসতে লাগলেন। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বললেন, তুই হাসলি না, ব্যাপার কী? যাকে বলছি সেই হাসছে। হা-হা-হা। শুধু পলিন হাসে নি। সে চোখ গোল গোল করে বলেছে–What is so funny about it? ভালো কথা, পলিন তার তিন কন্যা নিয়ে আমেরিকা চলে যাবে বলে কথা হচ্ছে। যাকে বলে পুরোপুরি চলে যাওয়া।
তুই? তুই একা থাকবি?
না। আমিও চলে যাব।
মনজুর তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল। বোঝার চেষ্টা করল ব্যাপারটা রসিকতা কিনা। রসিকতা বলে মনে হচ্ছে না। নুরুল আফসার বললেন, পলিন কিছুতেই নিজেকে এডজাস্ট করতে পারছে না। বাচ্চাগুলোও পারছে না। গত চার মাস ধরে এই নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। ঝগড়া চলছে, মনকষাকষি চলছে। এখন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি।
ফার্মের কী হবে?
একটা কিছু নিশ্চয়ই হবে। নে আরেকটা সিগারেট নে। সিগারেটের সঙ্গে এক টোঁক হুইঙ্কি খাবি? আছে এখানে। সমানে হুইঙ্কি খেয়ে যাচ্ছি। বাসায় খাই। অফিসে এসেও খাই।
নুরুল আফসার ড্রয়ার খুলে হুইস্কির বোতল বের করলেন, গ্লাসে ঢালতে ঢালতে বললেন, খাবি?
না।
আমি পুরোপুরি এলকোহলিক হয়ে গেছি। আমার আগে এলকোহলিক হয়েছে পলিন। আমেরিকায় পৌঁছেই এর চিকিৎসা করাতে হবে। পলিন এলকোহল ছাড়া কোনো তরল পদার্থই খাচ্ছে না। গত দুমাসে সে এক চামচ বিশুদ্ধ পানি খেয়েছে কিনা আমি জানি না।
আগে তো কিছু বলিস নি।
কেন বলব? মীরা যে তোকে লাথি মেরে চলে গেল তুই কি আমাকে বলেছিস?
লাথি মেরে চলে যায় নি।
ঐ একই হলো।
নুরুল আফসার গ্লাসে অনেকখানি হুইঙ্কি ঢাললেন। পানি মেশালেন না। ঢেলে দিলেন গলায়। তাঁর মুখ বিকৃত হলো না। তবে মুহূর্তের মধ্যেই চােখ টকটকে লাল হয়ে গেল। তিনি শীতল গলায় বললেন, মনজুর তোকে একটা কথা বলব, মন দিয়ে শোন।
শুনছি।
এই ফার্ম ছেড়ে যাওয়া আমার জন্যে কী রকম কষ্টের তা নিশ্চয়ই তুই জানিস। জানিস না?
জানি।
পলিনকে ছেড়ে দেয়াও আমার পক্ষে অসম্ভব। ওকে পাগলের মতো ভালবাসি। তাছাড়া ও গেলে আমার বাচ্চাগুলোও যাবে। যাবে না?
হ্যাঁ যাবে।
কাজেই ওকে খুন করার একটা সূক্ষ্ম পরিকল্পনা আমার আছে। ওর হুইঙ্কির সঙ্গে খানিকটা আর্সেনিক মিশিয়ে দিলেই হলো। আর্সেনিক জোগাড় করেছি। একটা শুভদিন দেখে জিনিসটা মেশানো হবে। বারই ফেব্রুয়ারি হচ্ছে খুব শুভদিন–ওর জন্মদিন।
তোর নেশা হয়ে গেছে বলে আমার ধারণা।
নেশা হয় নি। যা বলছি সুস্থ মাথায় বলছি। আজই তো বার তারিখ, তাই না?
হ্যাঁ।
তুই কি সত্যি খাবি না? খা একটু আমার সঙ্গে। মন্দ হচ্ছে এমন এক তরল পদার্থ যা কখনো একা খাওয়া যায় না। তাছাড়া জিনিসটা কিডনির জন্যে ভালো। সত্যি ভালো।
মনজুর চুপ করে রইল।
নুরুল আফসার বললেন, না খেলে চুপচাপ বসে থাকবি না। চলে যা। আর পলিনকে খুন করা সম্পর্কে যা বললাম। সবই রসিকতা। নেশা হলেই বলি। নেশা হয়েছে–তোকে বলেছি। নেশা কেটে গেলে সব ভুলে যাব। তবে মনটা খারাপ। খুবই খারাপ। এত কষ্ট করে ফার্মটা তৈরি করেছি–সব জলে ভেসে যাবে। কাঁদতে ইচ্ছা হয়। নেশা খুব বেশি হলে কাদি। মুশকিল হচ্ছে নেশা আগের মতো হয় না। আমি পুরো বোতল শেষ করে ফেলব। কিন্তু তেমন নেশা হবে না। যা তুই যা। Leave me alone.
মনজুর বেরিয়ে এল।
জাহানারা হাতে টাইপ করা একটা কাগজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ অসম্ভব মলিন। মনে হচ্ছে টাইপ করতে করতে সে খানিকটা কাঁদছে। তার চোখের কাজল লেপ্টে গেছে। আজকালকার মেয়েরা চোখে কাজল দেয় বলে মনজুরের ধারণা ছিল না। এই মেয়েটা দেয়। মীরাও দিত। মীরার সঙ্গে কি এই মেয়েটির কোনো মিল আছে? না। কোনো মিল নেই। দুজন সম্পূর্ণ দুরকম।
জাহানারা বলল, স্যার আপনার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি।
মনজুর বলল, টাইপ হয়ে গেছে?
জ্বি।
ইত্তেফাকে পাঠিয়ে দাও। বল পরপর তিনদিন ছাপাতে।
আপনি কি দেখে দেবেন না?
না।
স্যার একটু দেখে দেন।
মনজুর দ্রুত চোখ বুলাল—
কিডনি প্রয়োজন
একটি কিডনি কিনতে চাই। কেউ আগ্রহী হলে
অতি সত্বর যোগাযোগ করতে অনুরোধ করা হচ্ছে।
ঠিকানা দেয়া আছে, উড কিং-এর। কেয়ার অফ বদরুল আলম। মনজুরের মনে পড়ল–মামাকে এ ব্যাপারে কিছুই জানানো হয় নি। বিজ্ঞাপনটা ছাপা হবার আগেই জানানো উচিত।
জাহানারা বলল, স্যার আপনি কি কিছুক্ষণ অফিসে থাকবেন না চলে যাবেন?
আছি কিছুক্ষণ।
আপনার শরীর কেমন?
ভালো। বেশ ভালো।
জাহানারা খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, স্যার আপনি কি একদিন আমাদের বাসায় আসবেন?
আসব। অবশ্যই আসব।
জাহানারা মনে মনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। এর আগেও এই মানুষটিকে সে কয়েকবার তাদের বাসায় যেতে বলেছে। প্রতিবারেই মনজুরের উত্তর ছিল–যাব। অবশ্যই যাব। কোন যাব না? অথচ কোনো বারই জিজ্ঞেস করে নি–ঠিকানা কী? এবারো জিজ্ঞেস করলেন না। আসলে উনি যাবেন না। কোনোদিনও না।
জাহানারা ক্ষীণ স্বরে বলল, স্যার আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
জিজ্ঞেস কর।
অফিসে সবাই বলাবলি করছে আপনার চাকরি নেই। কথাটা কি সত্যি?
জানি না। সত্যি হতেও পারে।
আপনি বড় সাহেবকে কিছু জিজ্ঞেস করেন নি?
না। তবে সত্যি হওয়া সম্ভব–অনেকদিন ধরেই দেখছি আমার টেবিলে কোনো ফাইল নেই। অফিসে আমি অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছি। আমাকে ছাড়াই সব কাজ চলছে এবং খুব ভালোভাবে চলছে। আমাদের বড় সাহেবকে আমি খুব ভাল করে চিনি। সে কখনো অপ্রয়োজনীয় মানুষজন রাখবে না। তার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলেও না। ফার্মকে বড় করতে হলে কিছু কঠিন নিয়মকানুনের দরকার হয়।
মনজুর নিজের অফিসে ঢুকে গেল।
খুব ক্লান্ত লাগছে। ঘুম পাচ্ছে। টেবিলে কোনো ফাইলপত্র নেই। ইজিচেয়ারে শুয়ে খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে থাকা যায়। মনজুর ইজিচেয়ারে কত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল।
জাহানারা পেছনে পেছনে আসছিল। ঘুমন্ত মনজুরকে দেখে তার মনটা অসম্ভব খারাপ হলো। কী অসুস্থ একটা মানুষ! শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়েছে। মাথা কাত হয়ে আছে। কেমন অসহায় ভঙ্গি! একটা বালিশ থাকলে মাথার নিচে দিয়ে দেয়া যেত।
পর্ব ৮ শেষ 📌
🔴পর্ব :৯🔴
জাহানারা মাছ কুটছিল।
ঘরে ছাই নেই। ছোট ছোট মাছ, কুটিতে এমন অসুবিধা হচ্ছে পিছলে পিছলে যাচ্ছে। একটা ঠিকা-ঝি আছে; সে মাসের গোড়ায় পলিথিনের ব্যাগে এক ব্যাগ ছাই দিয়ে যায়। এক ব্যাগ ছাইয়ের দাম দুটাকা। এই মাসে তার ছাই রাখা হয় নি। এক ব্যাগ ছাইয়ের জন্যে সে চাইল পাঁচ টাকা। জাহানারা বলল, এক ধাক্কায় আড়াইগুণ দাম বেড়ে গেল, ব্যাপারটা কী?
ঠিকা-ঝি গভীর গলায় বলল–সব জিনিসের দাম বাড়তাছে আফা। আর এই ছাই হইল আসল। আমার কাছে নকলের কারবার নাই।
জাহানারা বিরক্ত গলায় বলল, ছাইয়ের আবার আসল-নকল কী? যাও নিয়ে যাও—ছাই লাগবে না।
না লাগলে নাই—ধমক দেন ক্যান?
ধমক দিলাম কোথায়? খামাখা তর্ক না করে কাজ শেষ কর।
হিসাব মিটাইয়া দেন আফা–আফনাগো বাড়ি কাম করুম না। আফনেরা মানুষ বালা না।
ঝি চলে গেলে মহা সমস্যা জেনেও জাহানারা হিসাব মিটিয়ে দিল। বুড়ি ছাইয়ের ব্যাগ হাতে মুখ অন্ধকার করে চলে গেল। এখন মনে হচ্ছে পাঁচ টাকা দিয়ে এক ব্যাগ আসল ছাই কেনাই ভালো ছিল। ছাই থাকত, কাজের লোকও থাকত।
দরজার কড়া নড়ছে। জাহানারাকেই উঠতে হবে। ঘরে আর কেউ নেই। মার দাঁতে যন্ত্রণা, ফরিদ মাকে নিয়ে গেছে মেডিক্যাল কলেজে। দুপুরের আগে ফিরতে পারবে না। এর মধ্যেই রান্না শেষ করে রাখতে হবে। তারা ফিরে এলে তবেই জাহানারা অফিসে যাবে। সমস্যা হবে না সে বলে এসেছে। তবু খারাপ লাগে।
জাহানারা দরজা খুলে হকচকিয়ে গেল। মনজুর দাঁড়িয়ে আছে। জাহানারার ইচ্ছা করল। আনন্দে চিৎকার করে উঠতে। এরকম অদ্ভুত ইচ্ছার জন্যে পরমুহুর্তেই লজ্জায় প্রায় নীল হয়ে গেল।
মনজুর বলল, তোমাদের বাসা খুঁজতে খুব যন্ত্রণা হয়েছে। এখানে বাসার নাম্বারের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। কেমন আছ জাহানারা?
জ্বি স্যার ভালো।
আসতে বলেছিলে–আসলাম। তোমার মা ভালো আছেন?
জ্বি স্যার আসুন–ভেতরে আসুন।
জাহানারা লক্ষ করল সে ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না। তার শরীর কাঁপছে। কেন এরকম হচ্ছে? এরকম হচ্ছে কেন?
কোনো সাড়াশব্দ নেই, তুমি কি বাসায় একা?
জ্বি স্যার। আমার মা গেছেন দাঁত তুলতে। ফরিদ মাকে নিয়ে গেছে। আপনি বসুন।
তোমার মার সঙ্গে দেখা করার জন্যেই এসেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম তুমি অফিসে থাকবে, আমি তোমার মার সঙ্গে দেখা করে চলে যাব।
মা এসে পড়বেন। আপনি বসুন।
মনজুর বসল। জাহানারার কান্না পাচ্ছে। বসার ঘরটা ফরিদ কী করে রেখেছে! এলোমেলো হয়ে আছে বিছানার চাদর। বসার ঘরে ফরিদের খাট না রাখাই উচিত ছিল। বসার ঘরটা থাকবে সুন্দর, গোছানো।
জাহানারা বিছানার চাদর ঠিক করতে গিয়ে হাতের ময়লায় মাখামাখি করে ফেলল। মাছ কুটিতে কুটতে সে উঠে এসেছে, তার মনেই নেই। হাত ধোয়া হয় নি।
জাহানারা!
জ্বি।
আমাকে ঠাণ্ডা এক গ্রাস পানি দিতে পারবে?
স্যার, এক্ষুণি আনছি।
ঘরের গ্লাসগুলো এত বাজে! কী ক্ষতি ছিল একটা সুন্দর গ্লাস যদি ঘরে থাকত? রমিজদের বাসা থেকে একটা গ্লাস নিয়ে আসবে? তার সঙ্গে ফ্রিজের এক বোতল ঠাণ্ডা পানি? ওরা আবার কিছু মনে করবে না তো? করুক মনে। কিছু যায় আসে না। ভালো চায়ের কাপও একটা আনতে হবে। জাহানারা ঠিক করে ফেলল, এবারের বেতন পেয়ে সে আর কিছু করুক বা না করুক, চমৎকার একটা গ্লাস কিনবে, একটা চায়ের কাপ কিনবে। আচ্ছা, স্যারকে কি সে দুপুরে খেতে বলবে? বললেই কি উনি খাবেন? যদি খেতে রাজি হন-কী দিয়ে সে খাওয়াবে?
জাহানারা বারান্দায় এসে দেখল বিড়াল মহানন্দে মাছ খাচ্ছে। খাক, যা ইচ্ছে করুক। তার ভালো লাগছে না। জ্বর-জুর লাগছে। জাহানারা পাশের বাসা থেকে পানির বোতল এবং গ্লাস আনতে গেল।
ঘরে কিছু নেই। শুধু এক গ্লাস পানি কি কাউকে দেয়া যায়? পানির গ্লাস টেবিলে রাখতে রাখতে জাহানারা নিজের অজান্তেই বলে ফেলল, স্যার আমাদের সঙ্গে চারটা ভাত থাবেন?
মনজুর বিস্মিত হয়ে বলল, ভাত?
খেলে খুব খুশি হব স্যার। আর এর মধ্যে মা এসে যাবেন।
আচ্ছা ঠিক আছে। ভাত খাব। কী রান্না?
জাহানারার মুখ শুকিয়ে গেল। কিছুই তো রান্না নেই। সে কী খাওয়াবে? কেন সে ভাত খাওয়ার কথা বলতে গেল? কেন সে এতবড় বোকামি করল? ফরিদ এলে তাকে রিকশা করে কাচাবাজারে পাঠালে সে কি মাছ-মাংস কিছু আনতে পারবে না? না হয় আজ একটু দেরি করেই খাওয়া হবে।
কী রান্না তা তো বললে না?
এখনো কিছু রান্না হয় নি। স্যার।
তাহলে বরং এক কাজ করি। অন্য একদিন এসে খেয়ে যাব। আজ থাক। শরীরটাও ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে জ্বর আসছে।
জাহানারার চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছা করছে, স্যার আপনি যেতে পারবেন না। আপনাকে থাকতে হবে। আমি নিজের হাতে রান্না করে আপনাকে খাওয়াব। শুধু একদিন, শুধু এক বার। মানুষ হবার অনেক যন্ত্রণার একটি হচ্ছে–যা বলতে প্ৰাণ কাঁদে তা কখনো বলা হয় না।
মনজুর বলল, উঠি কেমন? আরেকদিন এসে তোমার মা’র সঙ্গে দেখা করব।
পর্ব ৯ শেষ 📌