একজোড়া আগুন পাখি পর্ব-০২

0
1

#একজোড়া_আগুন_পাখি
®অরনীতা তুশ্মি (#তুশকন্যা)

পর্ব→০২ (কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ 🚫)

” তোমাকে V.K. এর P.A. এর জবটা করতে হবে। ”

আনায়া আরেক দফায় বিস্মিত হলো। অনেকটা জোর আওয়াজেই বলে উঠলো,

—“কিহ……!”

তবে আশেপাশে এতো আওয়াজের মাঝে তার আওয়াজ তেমন কোনো প্রভাব সৃষ্টি করলো না।
আনায়া আবারও বললো,

—-“এই……. এনার….পি.এ. হতে হবে। কিন্তু আপনি…..”

—“দেখো আনায়া! তোমার যে সিচুয়েশন তাতে এতো ভালো সেলারির একটা জব হাতছাড়া করা উচিত না।আর তোমার চিন্তা কেনীথ স্যারকে নিয়ে তাই তো! তুমি তো তাকে ঠিক ভাবে চেনোই না, আমার মুখ থেকে কি একটু শুনলে আর নিজে থেকে তাকে কি না কি ভেবে বসলে। তিনি মানুষটা সবার থেকে আলাদা হলেও ঠিক ভাবে তার মন মতো কাজ করতে পারলে কোনো চিন্তার বিষয় নেয়। তুমি শুধু তোমার কাজে ফোকাস করবে আর কিছু না। যদিও আমার ইচ্ছে ছিলো আর কিছুদিন তার সাথে কাজ করার কিন্তু সেটা তো আর হলো কই! ”

তোমাকে আজকের রাতটা সময় দিলাম। ভেবেচিন্তে সকালের মধ্যেই জানিয়ে দিও। আর যেহেতু তিনি রাতের বেলায় কনসার্ট বেশি করে তাই তোমাকেও রাত করে তার সাথেই থাকতে হবে।
এই বিষয়টাও একটু ভাবার আছে। তাই সময় দিচ্ছি, তোমার যেটা ভালো মনে হয় তাই করো।
আর এইজন্যই তোমাক রাতে ওনার সাথে দেখা করতে নিয়ে এসেছিলাম। তিনি কনসার্ট শেষে ভোরের দিকে ঘুমাবেন তারপর সোজা তার দেখা মিলবে কাল দুপুরের দিকে। ”

আনায়া আনমনে ভাবতে বসলো। বাড়িতে তার অসুস্থ বাবা। টিউশনির দশ হাজার টাকা দিয়েই বাবার ঔষধ, চিকিৎসা, তার আর বোনের পড়ালেখা সবকিছু মিলিয়ে হিমশিম খাওয়ার অবস্থা। মাথার উপর ছাঁদ টা ছিলো দেখে এখন নিরাপদে ঘুমাতে পারে কিন্তু সেটাও তো নাকি তাদের না। তাদের কোন যেন আত্নীয়র নামের। যদি কোনো একদিন সেই ব্যাক্তি ফিরে এসে যদি বাড়ি থেকে বের করে দিতে চায় তখন কি করবে তারা!
বাড়িটা অন্য কারো নামে হওয়ার একদিকে ভালোই হয়েছে। নাহলে বাবার বদ অভ্যাসে সেই বাড়ি কবেই বিক্রি করে দিতেন তিনি। এমনটা হলে এখন যে মাথার উপর যে কয়েকদিন ছাঁদ আছে সেটাও বহুদিন আগেই তাদের হারাতে হতো।
এদিকে বাবার অসুস্থতার জন্য স্বাস্থকর ভালো খাবারেরও প্রয়োজনও আছে। আবার ডাক্তার বলছে তার বাবার কিডনিতেও প্রবলেম আছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভালো হসপিটালের টেস্ট করিয়ে অপারেশন করতে হবে। সেখানে তো হিসেব ছাড়া খরচ।

এই কয়েকদিন না হয় রেহানের সাহায্য নিয়েই চলেছে কিন্তু এখন সেও বিদেশে। সবসময় তার কাছ থেকে হেল্প নিতে তারও ভালো লাগে না।খুব করে মনে হচ্ছে, এই জবটা করতে পারলে অর্ধেক সমস্যারই সমাধান হবে। আর ভাইয়া তো ঠিকই বলেছে, কাউকে পুরোপুরি না জেনে তার সম্পর্কে বাজে ধারনা আনাটা ঠিক না।

আর এমনটাও তো না যে তাকে ধরে বেধে কাজটা করে যেতে হবে৷ ভালো না লাগলে ছেড়ে দেবে, সমস্যা কি! ”
কিন্তু প্রশ্ন যে মাথায় আরো একটা ঘুরছে। সে তো এই ইন্ড্রাস্ট্রি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। তাহলে এই পি.এ. এর কাজটা করবে কিভাবে।

—“আচ্ছা ভাইয়া আমি তো এইসব সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না। তাহলে……!”

—“এসব নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।বললাম না ভিকে সবার চেয়ে আলাদা। কাজের ধরন গুলোও সবার চেয়ে আলাদা। কয়েকদিন কাজ করলে এমনিতেই সব শিখে যাবে। শুধু কালকে ভিকে তোমাকে পছন্দ করলে…….
ভ্রমর রে…..
ভাইবে রাধারমণ বলে শোন রে কালিয়া
ভাইবে রাধারমণ বলে শোন রে কালিয়া
নিভা ছিল মনের আগুন কে দিলাই জ্বালাইয়ারে………..

ইমন আর তার কথা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই হুট করেই গানটা থেমে গেলো আর শুধু হলো মানুষের চিল্লাচিল্লি।
যে কারণে এতোক্ষণ ধরে দোয়া করছিলো যেন আজ কোনো কেলেঙ্কারি না হয় কিন্তু ঠিক তাই হলো।
নিচ থেকে কাউকে একজন টেনে নিয়ে স্টেজের উপর তুলে ভিকে তার গিটারটা দিয়ে বেঁধোরে মারছে। অল্প কিছুক্ষণের মাঝেই মারতে মারতে গিটারের অবস্থাই বেহাল হয়ে গিয়েছে আর সেই মার খেতে থাকা মানুষটা আজ বাঁচবে কিনা তা নিয়েও ইমনের মনে সংশয় জেগেছে।

এদিকে এমন দৃশ্য দেখে আনায়া পুরো আঁতকে উঠলো। এ কেমন পৈশাচিক কান্ড! এভাবে কাউকে কেউ কিভাবে মারতে পারে। তার চেয়ে বেশি অবাক হলো যখন দেখলো তাকে আটকানোর জন্য কেউ এগিয়ে যায়নি। সবাই যার যার জায়গায় জড়োসড়ো হয়ে রয়েছে। এতক্ষণ আগে জেকের গান শুনে সবার মাঝে যে উচ্ছাস আনন্দের যে কোলাহল ছিলো তা তো নেই সাথে সবাই যে লোকটিকে মারা জন্য চিল্লাচিল্লি করছিলো সেই আওয়াজও এখন কমতে শুরু করছে। আনায়া মনে হলো কেউই যেন সাহসই পাচ্ছে না তার কাছে গিয়ে আটকানো। আবার দেখলো কেউ কেউ তো মোবাইল হাতে নিয়ে ভিডিও করছে। এই বিষয়টি যেন আনায়ার রাগকে আরও তুঙ্গে উঠিয়ে দিলো।

আনায়া মেয়েটা পরিচিত অথবা বন্ধু বান্ধবীদের সাথে সবসময় ফ্রেন্ডলি। এছাড়া এমনিতে ও সবার সাথেই ফ্রেন্ডলি থাকার চেষ্টা করে আর যে কারণে কথাটাও একটু বেশিই বলে। আর রাগ জিনিসটা সচারাচর তার মাঝে দেখা যায় না কিন্তু যখন সহ্যের সীমার বাঁধ ভেঙ্গে যায় তখন সে ভয়ানক আগুন পাখিতে পরিণত হয়। রাগের মাথায় কি করে না করে তা ভাবা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। সেই মূহুর্তে উদ্দেশ্য তার একটাই, প্রতিপক্ষকে নিজরে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে শেষ করা।

এবার আনায়া যখন ইমনের দিকে তাকিয়ে দেখলো ইমন নির্বিকার ভাবে চেয়ে চেয়ে শুধু ঘটনা টা দেখে যাচ্ছে তখন আনায়া নিজের রাগ কন্ট্রোল করে বললো,

—“ভাইয়া আপনি এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো! ওনাকে গিয়ে ধরুন, নাহলে উনি তো মেরেই ফেলবেন লোকটাকে!”

ইমন আনায়ার দিকে তাকিয়ে নির্বিকার চাহনি নিয়ে বললো,

—“এতে আমি কিছুই করতে পারবো না আনায়া। তুমি সোশ্যাল মিডিয়াতে এক্টিভ নও দেখে এই বিষয়গুলো তোমার কাছে নতুন কিন্তু এখানকার প্রত্যেকেই এগুলোর সাথে আগে থেকেই পরিচিত। কিছুদিন পর পরই ভিকের এসব ভিডিও ভাইরাল হয়। আবার তার ক্ষমতায় থেমেও যায়!”

আনায়া বিস্মিত হয়ে বললো,

—“তাই বলে কি কেউ তাকে থামানোর চেষ্টা করে না! আপনি তো তার পি.এ. অন্তত..

—“ভিকে এমনি এমনি কাউকে মারে না। নিশ্চয় ওই লোকটা ভিকে কে কিছু বলেছে। আর থামানোর কথা বলছো! যতক্ষণ ওই লোকটাকে মারতে মারতে ভিকে নিজে র’ক্তাত হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে কেউ থামাতে পারবে না। এমনি এমনিই তাকে সবাই ভ্যাম্পায়ার নামে ডাকে না! আর কারো এই দুঃসাহসও নেই যে তাকে গিয়ে থামাবে ।”

ইমনের সব কথাই আনায়ার কাছে উদ্ভট লাগলো। সাথে রাগটাও দরদর করে বেড়ে গেলো তুঙ্গে। দাঁত কড়মড় করে ইমনকে বললো,

—“তাহলে আপনার কাজটা কি! ”

ইমন হেঁসে বললো,

–“আমার আর কাজ কি! আজকের কনসার্ট আর এগোবে না, এখানেই শেষ। কিছুক্ষণ পর পুলিশ আসবে, ভিকে তো আরামছে এখান থেকে চলে যাবে মাঝ খান থেকে আমাকে থানায় গিয়ে নানান কাগজ পত্র……….

বাকিটা শোনার মতো ধৈর্য আর আনায়ার হলো না। হুট করেই এক কান্ড করে বসলো। তার গলায় ঝুলানো ওড়নাটা দিয়ে পুরো মুখটা পেচিয়ে শুধু চোখ দুলো খোলা রেখে স্টেজে উঠে পড়লো।

এদিকে ইমন এসব দেখে তো আকাশ থেকে পড়ার মতো অবস্থা। এই মেয়ে আজ নিশ্চিত বড় কোনো কেলেঙ্কারি করে ফেলবে। সে চিল্লাতে চিল্লাতে আনায়াকে থামতে বললেও সে আর থামলো না।

এদিকে বাকি সবার মাঝেই আগ্রহ ঘিরে ধরেছে স্টেজে ওঠা মেয়েটার দিকে। এই মেয়ে কে আর কি করতে চাইছে এটাই সবার আগ্রহের মূল লক্ষ !

অন্যদিকে কেনীথ মারতে মারতে লোকটাকে আধমরা করে ফেলেছে৷ শরীরে অতিরিক্ত মারের ফলে লোকটার হাত, পা, মুখ সহ বিভিন্ন অংশ বাজে ভাবে যখম হয়ে গিয়েছে। আশপাশ থেকে বিভিন্ন রংএর আলোর কারণে বিষয়টি স্পর্শ বোঝা না গেলেও আনায়ার মতে হলো কিছু ক্ষত স্থান থেকে তরল জাতীয় পদার্থ নিঃসৃত হচ্ছে। আনায়া ধরে নিলো ও গুলো র*ক্তই।

এরপর আর সে সহ্য না করতে পেরে মারতে থাকা ভিকের একটা হাত ধরে টান দিলে প্রথমেই সেই জীম করা বডি আর শক্ত মাসেলস্ এর উপর তার শক্তির কোনো প্রভাবই পড়লো না। না ভিকের কাজে ব্যাঘাত ঘটলো, সে তার মনের ইচ্ছে মতো লোকটাকে মেরেই চলেছে।

আনায়া এবার চোখ মুখ শক্ত করে ভিকে কে জোড়ে হেঁচকা টান দিলো। আর ভিকে আশ্চর্য হলো এই ভেবে যে এই প্রথম কে তার কাজে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে! এমন দুঃসাহস কে দেখালো তা ঠিক ভাবে দেখার আগেই আরো একটি বিস্ময়ের জোয়ার বয়ে গেলো সবার মাঝে। আগামী কয়েকদিনের নিউজের হেডলাইন হবে যে একজন মুখোশধারী মেয়ে কিনা ভিকে কে থা*প্পড় মেরেছে!

আনায়ার রাগের মাথায় কি করেছে তার ধ্যান টুকুও তার মাথায় নেই। তবে ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখা ফর্সা মুখটা যে রাগে লাল হয়ে গিয়েছে তা কারোরই চোখে পড়লো না।

অন্যদিকে একগালে হাত দিয়ে সটানভাবে দাঁড়িয়ে এক আগুন্তকঃ মানবের কিছুটা লাল হয়ে যাওয়া চোখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কেনীথ। তার সাথে কি হলো প্রথমে বুঝতে না পারলেও হুস ফিরতেই ক্রমাগত তার চোখ মুখ রক্তলাল বর্ণের ধারণ করতে লাগলো, সাথে সাথে শক্ত হলো হাতে মুষ্টি এবং ফুলে উঠলো পেশীবহুল হাত গুলো।

অন্যদিকে আনায়া এখানো নিজের করা কাজ নিয়ে অবগত নয়। সেও রাগান্বিত চেহারা নিয়ে ভিকের চোখের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে।

এদিকে তাড়াহুড়ো করে পেছন থেকে ইমন সহ কয়েকজন লোক আসলো।প্রথমে ইমন আনায়াকে টেনে তার এক বন্ধুকে ইশারা দিয়ে ওকে সরিয়ে নিয়ে যেতে বললো। আর বাকি সবাই এখন কেনীথের উপর ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে এক প্রকার কাঁপাকাঁপি করছে। সবার মাঝে একটাই আতংক, এই না জেকে চরের প্রতিশোধ নিতে কোনো এক তান্ডব শুরু করে দেয়৷

কিন্তু তেমন কিছুই হলো না, জেকে এখোনো তার রাগান্বিত চোখে আনায়ার দিকে তাকিয়ে রইছে আর আনায়াও যতক্ষণ দু’জন দুজনকে দেখতে পেলো ঠিক একই ভাবে রাগান্বিত আগুন চোখের চাহনি দিয়ে একে অপরেকে আগুন যুদ্ধের শুরুর ঘোষণা জানালো।

অপর দিকে সবার মনে একই প্রশ্ন রয়ে গেলো,ওড়না দিয়ে মুখ ঢাকা এই দুঃসাহসিক মেয়ে কে! যে কিনা ভিকের কাজে শুধু ব্যঘাত ঘটায়নি বরং তাকে চর মারার মতো ভয়ংকর দুঃসাহস দেখিয়েছে। অথচ বিনিময়ে ভিকে তাকে কিছুই করলো না!

★আনায়া এমন এক আগুন পাখির নাম যে নামের অর্থ সীমাহীন, অনন্ত কিংবা পুনরুজ্জীবন। ★
__________________

বাড়ি ফিরতে ফিরতে আনায়ার রাত আড়াইটা বেজে গিয়েছে। ইমন আর আজ তাকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আসতে পারেন নি। বেচারা এখনও হয়তো ভিকের জন্য পুলিশ স্টেশনে দৌড়া দৌড়ি করছে।
ইমন তার একজন এসিস্ট্যান্টকে আনায়ার সাথে পাঠিয়েছে, তাকে গাড়ি করে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
আনায়া স্টেজে তখন কি কাজ করেছে সেটা তখনও খেয়াল হয়নি। বেচারী নিজের রাগ ফুঁসতে ফুঁসতেই চুপ করে ছিলো। তবে গাড়িতে অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকতে থাকতে তার হুসটা ফিরতে থাকে। তবে সেটা খুব বেশি পরিমাণ নয়।
সে কি করেছে সেটা তার অনুভব হলেও নিজের কাজে জন্য সে একটুকুও অনুতপ্ত নয়। তার মাঝে এখনো রাগে ছড়াছড়ি কিংবা নিজের কাজ নিয়ে সম্পূর্ণ সন্তোষ।
তবে সর্বশেষে মনে হলো কাজটা একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছে। সোজা চ’র মারাটা মোটেও উচিত হয়নি। অন্য কিছু করেও বিষয়টি থামানো যেন।

আনায়া চিন্তাভাবনার মাঝে গাড়ি এসে তাদের বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা লোকটি এই বিষয়ে আনায়াকে অবগত করতে আনায়ার ধ্যান ভাঙ্গলো। সে এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে গাড়ি থেকে বেড়িয়ে লোকটাকে সৌজন্যে মূলক হাসি আর ধন্যবাদ দিতেই লোকটি গাড়ি নিয়ে জায়গাটা প্রস্থান করলো।

আনায়া মুখের নিস্তব্ধতা, ক্লান্তি সাথে তার ভাবুক চিত্ত আর মস্তিষ্কের নানা চিন্তা-দুশ্চিন্তা কিংবা প্রশ্ন তো ঘুরাঘুরি করছেই।

আনায়া একবার বাড়ি বাগানের গেট থেকে দাঁড়িয়ে তার সামনে থাকা বিশাল দোতলার বাড়িটাকে মাথা উঁচু করে দেখতে লাগলো। খুব বেশি বড় বাড়ি হলেও মধ্যেবিত্ত পরিবারের জন্য এ যেন এক প্রাসাদের সমান। আনায়া বিষয়টি ভেবেই হঠাৎ মুচকি হাসলো, তবে সেটা হয়তো তাচ্ছিল্যের হাসি।

তাদের জমিজমা কিংবা সম্পত্তি বলতে এখন আর কিছুই বেঁচে নেই। এই একটা ইট সিমেন্টের বাড়ি আছে, সেটাও নাকি তাদের না।বলা যেতে পারে, তারা এই বাড়ির আশ্রিতা।আনায়ার তাচ্ছিল্যের হাসির কারণ হয়তো এটাই।

তবে আনায়ার আবারও এক দীর্ঘ শ্বাস ফেললো বাড়িটার করুন অবস্থা দেখে। তার জ্ঞান হওয়া পর সে নিজেকে এই বাড়িতেই নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে। তার ছোট বেলা থেকে সবকিছুই এই বাড়িতে। তখন সময়টা অনেক বেশি সুন্দরও ছিলো তার জীবনে।

আর সে এই সময় না ছিলো এই বাড়িটার এতো করুন অবস্থাও! আশপাশে মিলে ছোট একটা বাগানের ঠিক মাঝে বাড়িটির অবস্থান। দোতালার বাড়ির ডিজাইনটাও কিছুটা ইউনিক হলেও বাড়িটা আর আগের মতো নেই। প্রায় কতগুলো বছর হয়েছে গিয়েছে তবুও এই বাড়ির গায়ে নতুন করে কোনো রংএর প্রলেপ পরেনি। করা হয়নি বিভিন্ন জায়গায় ভেঙ্গে যাওয়া অংশের মেরামত। এসব করবেই বা কি করে,বর্তমানে তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা! এর মাঝে বাড়ির মেরামত মানে অনেক খরচ।

আনায়া বাড়ির বাগের দিকে তাকিয়ে দেখে মুচকি হেসে কল্পনা করলো, একসময় এই বাগানে কতরকমের ফুল ফুটতো। কত রংবেরঙের গাছ পালায় পূর্ণ ছিলো এই বাগান। অথচ এখানে এখন ঘাসের অবস্থাও করুন। পানি না পেয়ে সবুজ ঘাস গুলোও কেমন যেন ম*রা ম*রা হয়ে গিয়েছে।

ফুলে কিংবা গাছেরা আন্দলোন করেছিলো তারা আর এই মাটিতে জন্মাবে না আর এই ঘাসেরা তাকে জানাচ্ছে, তারা এই মাটিতে জন্মে মোটোও ভালো নেই। তারাও ছাড়তে চায় এই বাড়ির সঙ্গ।

আনায়া নিজের উল্টো পাল্টা চিন্তেকে একপাশে রেখে বাড়ির দিকে এগোতে লাগলো। বাড়িটা যেমনই হোক না কেনো তার মতে তার পূর্ব পুরুষেরা যথেষ্ট রুচিসম্মত ছিলো বিধায় এমন একটা বাড়ি তৈরি করে গিয়েছে। তবে একটা প্রশ্ন সবসময়ই তাদের মাথায় ঘুরপাক খায়, এই বাড়ি যদি তাদের পূর্ব পুরুষেরাই তৈরি করে দিয়ে যায় তাহলে বাড়িটা তার বাবার নামে না হয়ে অন্য কারো নামে কেনো। তার বাবা এই বাড়ির ছেলে হওয়া সত্ত্বেও, বাড়িটা কিনা কোনো এক আগুন্তকঃ এর। এর পিছনেও কি কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে নাকি!
এই বিষয়ে তার আর ইনায়ার দুজনেরই আগ্রহ থাকলেও কখনো বাবার কাছ থেকে কখনো আর এই বিষয়ে কিছু শোনা হলো না।

আনায়া আর এই মূহুর্তে এই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে বসলো না।চুপচাপ চাবি দিয়ে বাড়ির দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। এরপর দরজা ভালো করে লাগানোর পর, হুট করে কানে কিছু আওয়াজ পৌঁছাতেই সে চমকে উঠলো। তার বাবার রুম থেকে গোঙ্গানির আওয়াজ আসছে। আনায়া তাড়াতাড়ি করে বাবার রুমে পৌঁছেই দেখতে পেলো তার বাবা চোখ মুখ বন্ধ অবস্থায় ছটফট করছে আর মুখ থেকে গোঙানির আওয়াজ আসছে। আনায়া বাবার এমন অবস্থা দেখে অস্থির হয়ে উঠলো। আর বলতে লাগলো,

—“বাবা কি হয়েছে! বাবা চোখ খোলো, প্লিজ চোখ খোলো!”

আনায়ার চোখ মুখে হঠাৎ করেই ভয়ের আভাস দেখা যাচ্ছে। অনেকক্ষণ ডাকাডাকি পর তিনি চোখ খুলে আনায়াকে দেখলেন তবে আনায়ার কেনো যেন মনে হলো তারেক রহমান তাকে ভায় পাচ্ছে। তাই শান্ত কন্ঠে বললো,

—“বাবা! আমি আনায়া, ভয় পেয়ো না। তুমি কি কোনো বাজে সপ্ন দেখেছো। ”

আনায়ার কথা শুনে তারেক শিকদার প্রথমে কিছুটা উত্তেজিত থাকলেও ধীরে ধীরে শান্ত হতো লাগলো। আনায়া মুচকি হেসে বললো,

—“বাবা কিছু খাবে! ক্ষিদে পেয়েছে?”

তারেক শিকদার মাথাটা কিছুটা এদিক ওদিক করে বুঝালো সে কিছু খাবে না। তবে মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে আওয়াজ করলো,

–“প..পা..প!”

আনায়া বুঝে গেলো তার বাবা পানি খেতে চাইছে। কিছুক্ষণের মাঝেই এক গ্লাস পানি এনে বাবাকে খাইয়ে দিলো। এরপর বাবার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে তাকে ঘুম পারিয়ে দিলো।

তারেক শিকদার নিস্তব্ধ হয়ে ঘুমাচ্ছেন। আনায়া তার বাবার মুখের দিকে নির্বিকারভাবে তাকিয়ে রইছে। আজ থেকে কয়েকবছর আগে হঠাৎ করেই তার বাবার সম্পূর্ণ শরীরের দুই তৃতীয়াংশ প্যারালাইজড হয়ে যায়।তখন থেকে তারেক শিকদার বিছানায় পড়া। মাঝে মধ্যে চেয়ারে করে তার মেয়েরা তাকে বাড়ির এদিকে ওদিকে নিয়ে ঘুরাঘুরি করে। তবে তারেক এখনো ঠিকভাবে কথা বলতে পারে না। মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে কোনো আওয়াজ করা, আর আঙ্গুল দিয়ে অথবা চোখের পলক ফেলিয়ে ইশারা করা ছাড়া সে আর তেমন কিছুই করতে পারে না।

তবে আনায়া কিংবা ইনায়া; দুই বোনের কারোরই কখনো তাদের বাবার কথা বুঝতে অসুবিধা হয়না। আগে হতো না এমনটা নয়, তবে সময়ের সাথে তারা এই বিষয়টির সাথে অভ্যস্ত। আনায়ার ছোট বোন ইনায়া এবার ক্লাস টেনে। মেয়েটা স্টুডেন্ট হিসেবে অনেক ভালো সাথে যথেষ্ট দায়িত্বশীল আর অনেকটা চঞ্চল প্রকৃতির। তবে তার একটা সমস্যা হলো সে ঘুমিয়ে পড়লে দুনিয়ার আর কোনো খবর রাখে না। তার ঘুমের মাঝে যদি মহাপ্রলয়ও ঘটে যায় তবে সে টের পাবে কি না আনায়ার সন্দেহ হয়।

আর তার বাবার এই ঘুমের মাঝে হঠাৎ ছটফট করা কিংবা গোঙানির আওয়াজ মাঝে মধ্যেই পাওয়া যায়। আনায়ার বাবার মতে সে দুঃসপ্ন দেখে এমটা করেন। তবে আনায়ার কাছে একটা অদ্ভুত বিষয় হলো তাকে ঘুম থেকে জাগানোর পর কিছুক্ষণ সে আনায়াকে ভয় পাওয়ার মতো বিহেভ করেন সেটা কিনা ইনায়া অথবা বাকিদের ক্ষেত্রে হয় না!

আনায়া আর এসব নিয়ে ভাবলো না! তার চিন্তা ভাবনা এখন ঘুরে গিয়েছে ভিকের পি.এ. এর জবটা নিয়ে। কিছুক্ষণ আগে যে কাজ করেছে আদোও সে এই চাকরি পাবে কিনা কে জানে। তবুও একবার ইমন ভাইয়াকে বলতে হবে। সে লোকটা যেমনই হোক সে উল্টো পাল্টা কিছু না করলে তো ঐ স্টেজের লোকটার মতো করে তাকে মারবে না, তাই না! নিশ্চিত ঐ লোকটা ভিকে কে খারাপ কিছু বলেছে। নাহলে এমন করে কেউ কাউকে কেনো মারতে যাবে।

নিজেকে এতো কিছু বোঝানোর পরও কাজ হলো না। মনে মনে বলতো লাগলো,”এখন এতোই যখন ভিকের গুনগান গাইছিস তাহলো তখন কেনো ওকে চ’র মারতে গিয়েছিলি। এখন আর নিজেকে এসব বুঝিয়ে লাভ নেই। তোর এই চাকরি যে হবে না তা নিশ্চিত। ”

আনায়া দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নিজেকে বললো,

—“আমার কি দোস, তখন ওনাকে না আটকালে তো লোকটা মা*রাই যেত! ”

—“মানুষের চিন্তা না করে এখন নিজের চিন্তা কর! দেখিস, কালকে উনার কাছে জবের জন্য যাওয়ার পর তোর চ*র টা যেন সু’দে আসলে ফেরত না দিয়ে দেয়। ”

নিজের চিন্তাভাবনা শুনে নিজেই একবার ঢোক গিললো।ওমন ফোলা ফোলা জীম করা হাত দিয়ে যদি তোকে একটা চ*র মারে, আনায়া তাহলে তো তুই পুরোই শেষ! একবারে উপরে চলে যাবি, এই জীবনে আর রেহানকে বিয়ে করা হবে না তোর। ”

পরোক্ষনেই আবার ঢোক গিললো হঠাৎ ভিকের র*ক্ত লাল হওয়া চোখ গুলো কল্পনায় ভেসে উঠতেই। তখন খেয়াল ছিলো না ঠিকই কিন্তু এখন বুঝতে পারছে সে কি করছে। হালকা চাপ দাঁড়ি ওয়ালা ফর্সা মুখটা কি ভয়াবহ ভাবেই না লাল হয়ে ছিলো। আর ঐ আগুন চোখ দুটো দিয়ে তো পারলে আমায় কাঁচ্চা চিবিয়ে খেতো৷

নিজের উপর প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বললো,

“উফ, আনায়ার বাচ্চা কি কাজটা নাই করছোস! দুনিয়ার কেউ উনারে থামাতে গেলো না তাহলে তুই কেন ঢং দেখাতে গিয়েছিলি! ইচ্ছে তো করছে নিজের গালেই দশ বারোটা চ*র বসিয়ে দেই। ”

কিছুক্ষণ থম মেরে থাকার পর বললো,

“যথেষ্ট হয়েছে, যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এটা নিয়ে আর প্যানিক করার মানে নেই। আমি আর কখোনো ভ্যাম্পায়ারটার আশেপাশে যাবো না তাহলেই হবে! ”

এরপর নিজেকে আরেকটু বুঝিয়ে এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মুচকি হেসে তার রুমে ঘুমাতে চলে গেলো।

________________

এই মাত্র একটু ঘুমিয়েছে আর ওমনি ফোন কল বাজতে হলো! এতো রাতে আবার কে ফোন দিয়েছে!
আনায়া ফোনের রিংটন শুনে প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে চোখ না খুলেই মাথার আশেপাশে হাতিয়ে আন্দাজে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে অস্ফুট ঘুমন্ত সুরে বললো,

—“কে! এতো রাতে কে ফোন দিয়েছেন!

ফোনের ওপাশ থেকে বিস্মিত সুরে কেউ একজন বললো,

—” আনায়া তুমি এখোনো ঘুমিয়েই আছো!….সরি সরি, আমি মনে হয় একটু বেশি আগেই ফোন দিয়ে ফেলেছি। তবে বিষয়টি আর্জেন্ট। ”

আনায়া এখোনো চোখ খোলেনি। রাতে ঘুমাতে ঘুমাতে তার সকাল চারটা বেজে গিয়েছে। অথচ সে ঘুম থেকে ওঠেই ভোর চারটায়। এমনিতে রাতে ঘুমানোর কোনো ইচ্ছে ছিলো না কিন্তু ক্লান্ত শরীর বিছানা পেতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে কে জানে।

আনায়া ইমনের গলার আওয়াজ চিন্তে পেরে বললো,

—“জ্বী ভাইয়া বলেন সমস্যা নেই! ”

—“ওহ তোমাকে সকাল নয়টার মধ্যেই ভিকের সাথে তার অফিসে দেখা করতে হবে। প্লিজ তাড়াতাড়ি একটু চলে এসো। ”

আনায়া ভুলেই গিয়েছে যে রাতে সে নিজেই বলেছিলো আজ সে ভিকের সাথে দেখা করতে যাবে না।সে এই জবটাই করবে না অথচ সেসব ভুলে গিয়ে ইমনকে বললো,

—“কিন্তু ভাইয়া সে তো অনেক দেরী আছে। এতো রাতে কেনো ফোন দিয়েছেন! ”

ইমন আবারও বিস্মিত হয়ে বললো,

—“একি! তুমি কি আমার সাথে এখনো চোখ বুঝেই কথা বলছো! আনায়া চোখ খুলো, এখন রাত না বরং সকাল আটটা বাজে! ”

ইমনের শেষের কথা গুলো জোরে জোরে বলায় আর সেগুলো আনায়ার মস্তুিষ্কে পৌঁছাতেই সে লাফিয়ে উঠলো। আনায়া আশে পাশে তাকিয়ে দেখলো সূর্যের চমকপ্রদ কিরণ এসে তার জানালা ভেদ করে রুমে প্রবেশ করছে। তবে আবারও একবার ফোনের দিকে সময়টা দেখে নিলো, আটটা সাত বাজে। তার হুস ফিরতেই বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নিচে নেমে অস্থির ভাবে রুমে পায়চারি করতে করতে বললো,

—“এটা কি করে সম্ভব, আমি এতোক্ষণ ঘুমিয়েছি। ও আল্লাহ! সারে আটটা থেকে তো ইরার স্কুল আছে এদিকে বাবার খাবার জন্য রান্না করা…..ওহ সিট, কি করছিস তুই আনায়া। ”

আনায়ার ফোন হাতে থাকলেও ইমন আনায়ার সব কথাই শুনতে পেলো। তাই আনায়াকে বললো,

—“আনায়া!আনায়া! আমার কথা শুনতে পাচ্ছো!”

—“জ্বী জ্বী ভাইয়া বলেন! ”

—“শুনো এতো হাইপার হইয়ো না! ধীরে সুস্থে তোমার কাজ শেষ করো তবে আটটা পয়তাল্লিশেট মধ্যেই সব কাজ করে ফেলো। আমি আটটা পয়তাল্লিশে তোমাকে নিতে যাবো, প্লিজ বোন দেরী করো না!”

এই বলেই ইমন ফোন কেটে দিলো। আনায়ার মাথায় আর কি ঢুকলো জানা নেই তবে এখন তাকে তার সব কাজ করতে হবে তারপর আটটা পয়তাল্লিশের আগেই রেডি হতে হবে।

আনায়া তাড়াহুড়ো করে রুম থেকে বেড়িয়ে দেখলো তার বাবা হুইল চেয়ারে বসা। এবং তাকে ফরিদা খালা খাইয়ে দিচ্ছে। ফরিদা সম্পর্কে আনায়াদের তেমন কিছুই হয় না। অনেক আগে থেকে এই বাড়িতে কাজ করতো সে। সময়ে সাথে সাথে রক্তের সম্পর্ক না থাকা স্বত্তেও তার সাথে এই পরিবারের এক গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এরপর আনায়ারা ছোট কয়েক বছর আগে আনায়াদের মায়ের চলে যাওয়া এরপর তার বাবার এমন অসুস্থতা৷ সবকিছু মিলে এই বাড়ির লোকগুলোর বিশেষ করে আনায়া আর উনায়ার জন্যই তিনি তারেক শিকদারের দেখাশোনা করেন। যাতে বাবার দেখাশোনা করতে গিয়ে দুই বোনের পড়াশোনায় যেন ক্ষতি না হয়।

তিনি প্রতিদিন সকাল করে এসে বিকেলের দিকে চলে যান। এর মাঝো ইনায়া স্কুল থেকে ফেরার পর মহল্লার আরো কিছু বাড়িতে কাজ করে নেন।

আনায়া ফরিদাকে দেখে বললো,

—“খালা তুমি কখন এসেছো! রান্নাও করেছো দেখছি, ইরা! ইরা কোথায় খালা! ”

—“স্কুলে যাবো, খাওয়া দাওয়া শেষ কইরা এখন রেডি হইতে গেছে। তুমি এতো অস্থির হইতেছো কেন! কোনো খানে যাবা?”

—“জ্বী খালা! একজায়গায় যেতে হবে। কিন্তু তুমি আজ আগে এসেছো অথচ আমাকে একবারও ডাক দেওনি। ইরাটাও ডাক দিলো না! ”

এরই মাঝে স্কুল ড্রেস পরিধানরত বড় বড় চুলো দুটো দুই বেশি করা দুধে আলতা বর্ণের এক ধবধবে ফর্সা এক মেয়ে এসে আনায়াকে বললো,

—“সরি আপু, আমিই মানা করেছিলাম খালাকে। তুমি তো দেরী করে কখনো ওঠো না আর রাতে কত দেরী করে ফিরেছো তাও তো জানি না। এইজন্য আর তোমাকে বিরক্ত করিনি। বাট তুমি টেনশন করো না, আমি আর খালা মিলে তোমার সব কাজ করে ফেলেছি। ”

আনায়া বোনকে দেখে কাছে গিয়ে ওর কপালে একটা চুম্বন করতেই ইনায়া চোখ মুখ কুঁচকে বললো,

—“ইয়াক! তুমি মুখ না ধুয়েই আমাকে কিস করলে আপু! ”

আনায়া বোনের কথা শুনে হেসে ফেললো আর ওর মাথায় পেছনে হালকা করে চর বসিয়ে বললো,

—“বেশি পাঁকা হয়ে গিয়েছিস তাই না!

—“দেখতে হবে না, বোনটা কার! আচ্ছা আপু তোমরা থাকো আমি চললাম, এমনিতেই আমার লেট হয়ে গিয়েছে! ”

কথা শেষ হওয়ার আগেই দৌড়ে ইনায়া চলে গেলো সোজা বাড়ির বাহিরে। অল্প বয়সী মেয়ে অথচ রুপ তার অতুলনীয়। আনায়ার চেয়ে ইনায়া অনেকটা বেশিই সুন্দর। তবে ইনায়া শুধু ধবধবে ফর্সা ত্বকেরই অধিকারী নয় বরং পড়ালেখাতেও প্রচন্ড পরিমাণের তুখোড় মেয়েটা। সাথে খেলাধুলা, ঘুরাঘুরি,নিজ ও পরিবারের প্রতি;কাজের প্রতি দায়িত্বশীলতা, অত্যাধিক চঞ্চলতা, সবকিছুতেই মেয়েটা সবার এগিয়ে।

তবে তার কথার তেজও কিন্তু কম না। অল্প বয়স হলেও মাঝেমধ্যে অনেকটা বড়দের মতো কথাবার্তা বলতেও তাকে দেখা যায়। বিশেষ করে আনায়া,বাবা কিংবা তার পরিবার সম্পর্কে কেউ বললে চুপ করে সহ্য করার মেয়ে তো নয়-ই সাথে কোনো একদিন তর্ক করতে গিয়ে মাথা ফাটানোর রেকর্ড আছে তার। স্কুলে পড়াশোনা হোক কিংবা এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিস সব কিছুতেই সে লিডার তো বটেই সাথে মহল্লার তার সমবয়সী ছেলে মেয়েদের নিয়েও নিজের গ্যাং বানিয়ে ফেলেছে। এছাড়া অবশ্য উপায়ও নেই। মানুষ তাকে বাচ্চা হিসেবে ছাড় দিলেও আনায়াকে নিয়ে মানুষের বাজে কথার যেন শেষ নেই।

ইনায়া চলে যেতেই আনায়াও তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে কোনোমতে খাবার খাওয়া শেষ করে, রেডি হতেই ইমন এসে তার বাড়ির সামনে গাড়ি নিয়ে হাজির।

___________________

আনায়া ড্রাইভিং সিটের পাশে বসে আনমনে কিছু ভেবে চলেছে। তার চিন্তা ভাবনা কারন হলো সে আজ এই জবটার জন্য যেতে চাইছিলো না। যেটা কিনা তার এখন মনে পড়লো। এখন কি করবে সেটাও ঠিক বুঝতে পারছে না। একবার নিজেকে বুঝাচ্ছে,আনায়া বাচ্চামো করিস না! এতো হাইপার হওয়ার মতো কিছুই হয়নি। “অথচ আবারও সে হাইপার হয়ে যাচ্ছে।

তার এমন অবস্থা নোটিশ করতেই পাশে বসে গাড়ি চালাতে থাকা ইমন বললো,

—” কি হলো, টেনশন হচ্ছে! ”

আনায়া ইমনের কথা শুনে তার দিকে উদাস মুখে তাকিয়ে বললো,

—“হুম!”

—“আরে এতো চিন্তা করো না! স্যার তোমাকে পছন্দ করলে আর কোনো টেনশন নেই। তবে কালকে যে কাজটা করেছো আমি তো ভেবেছিলাম স্যার তোমাকে খুঁজে বের করে কি না কি করবে! ”

আনায়া আগ্রহ নিয়ে বললো,

—“মানে উনি কি এখনো জানে না যে কালেকে উনাকে চ*রটা আমিই মে*রে ছিলাম!”

—“আমার মনে তো হয়না তিনি কিছু জানেন! জানলে হয়তো তুমি এখানে থাকতে না বরং তোমার নামে কোনো কেস ঝুলিয়ে জেলের ভাত খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতো। আই থিংক তিনি এই বিষয় নিয়ে জানার কোনো চেষ্টা করেনি। নাহলে তোমাকো খুঁজে পাওয়াটা তার কাছে তেমন কোনো ব্যাপার না! ”

ইমনের কথা শুনে আনায়ার গলা এমনিতেই শুকিয়ে গেলো। কয়েকবার ঢোক গিলে চুপ করে বসে রইলো। পাশ থেকে ইমন আবারও বললো,

—“শোনো! আজকে স্যার তোমাকে পছন্দ করলে কাল থেকে আর আমি অফিসে যাচ্ছি না।তোমার সাথে আমার দেখা এই পর্যন্তই। তাই কিছু জিনিস আগেই বলে দিচ্ছি, স্যার যদি যখন যেটা বলবে তখন সেটাই করবে কোনো এক্সট্রা কথা না বলে। বেশি কথা বলা স্যার কিন্তু পছন্দ করে না। আর উনার ল্যাঙ্গুয়েজ কিন্তু অলওয়েজ তুই-ই থাকে।তোমাকে যদি মাঝেমধ্যে তুই করেও সম্মোধন করে তো বিষয়টি নরমাল ভাবে নিও, ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। ”

আনায়া কিছুটা আবাক হয়ে বললো,

—“মানে, বিষয়টি ঠিক বুঝতে পারলাম না!”

–“মানে হলো ভিকে বেশির ভাগ সময়ই তুই করেই সবাইকে সম্মোধন করে। এমনিতে অবশ্য তিনি খুব কম কথা বলেন আর বেশি ভাগ ইংরেজিতেই। বাংলায় যখন কাউকে সম্মোধন করতে হয়ে তখন তুই করেই বলে আরকি!

আনায়া অবাক হয়ে বললো,

—“মানে আপনাকেও!

ইমন হেসে বলল,
“আমি আবার বাদ যাবো কেনো!”

—“আচ্ছা উনি কি বড়দের কেউ এভাবে তুই করে সম্বোধন করে, মানে যদি কোনো কন্সার্ট কিংবা অফিসে যদি কোনো সম্মানিত ব্যাক্তি আসে তখন কি করে! ”

—“ইংরেজিতেই কথা বলে তবে সেটা খুব সীমিত। ক্লাইন্ট কিংবা অন্য যে কেউ,তাদের সাথে কাজ সম্পৃক্ত সব কথা তার পি.এ. কেই করতে হবে। মানে আগে আমি করতার আর এখন তুৃমি। বাট টেনশন করো না, বিষয়টি এতোটাও কঠিন না। তেমার কমিউনিকেশন স্কিল যথেষ্ট ভাল।”

তবে আনায়া বললো,

—“লোকটা হয়তো অনেক অসভ্য আর বেয়াদব! তার ফ্যামিলি ঠিক শিক্ষাটা দিতে পারেনি। ”

—“এই কথা আমার সামনে বলছো ঠিক আছে কিন্তু ভুলেও কেনীথ স্যারের সামনে বলতে যেও না। তাহলে কিন্তু সর্বনাশ। আর আমার যতদূর ধারনা তার ফ্যামিলি বলতে কিছুই নেই। সে একাই থাকে। ”

ইমনের কথা শুনে আনায়া কিছুক্ষণ ইমনের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বললো,

—“এইজন্যই তো এতো অসভ্য হয়ে লোকটা! ”

আনায়ার কথায় ইমন হেঁসে ফেললো।

—-” ভি.কে. সাধারণ সৌজন্যে খুব একটা মেনে চলে না। কারো সাথে ফ্রেন্ডলি কথা বার্তা বলতেও তাকে দেখা যায় না। রকস্টার হিসেবে তিনি ফিকশনের ভাষায় সেই থ্রি ডাইমেনশাল কারেক্টার। তার মাঝে রয়েছে অ্যাটিটিউড, উদ্দামতা, কপটতা,ক্ষ্যাপামি,প্রকাশ্যে ডার্ক ম্যাটার আর সর্বশেষে সবকিছু থেকে আশ্চর্য এক বিচ্ছিন্নতা। তবুও ভক্তরা তাকে অত্যধিক ভালো বাসে। সে যদি সাধারণ গানের সুরকেও ইচ্ছে মতো বেসুরো করে তোলে তবুও সেটা প্রত্যকের মন ছুঁয়ে যায়। তার কনসার্টে মানুষ বেশি একাত্ন্য হয়, বিষয়টা অনেকটা মেসমেরাইজিং! তার ভালো খারাপ কিংবা খাটো সব বিষয়ই দর্শকে আনন্দ দেয়, তার হিডেন পারসোনাল লাইফ নিয়েও মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। কিছুদিন পর পরই তাকে নিয়ে মিডিয়া জগতের রিপোর্টাররা নানান উদ্ভট, বানোয়াট সব নিউজ বানিয়ে তাদের চ্যানেলে চালিয়ে ব্যবসা করে। ভিকের নিউজ মানেই যেন তাদের ব্যবসা আরো রমরমা! তবে এইসব নিয়ে ভিকে কখনো মাথা ঘামায়া না। সে এসব ব্যাপারে একদম নির্বিকার। মিডিয়ার সামনেও খুব একটা ইন্টারভিউ কেউ নিতে পারেনি তার। আর নিজ ইচ্ছেতেই কোনো ইন্টারভিউতে গেলেও তার ইচ্ছে হলে রিপোর্টের প্রশ্নের উওর দেয় আর না হলে নেই। ওদিকে রিপোর্ট যদি প্রশ্ন করতে করতে মরেও যায় সে নির্বিকার চাহনি ছাড়া আর কিছু দেবে না। অনেকটা তাদের অপমান বোধ করাতেই ভিকে হয়তো পছন্দ করে। তবে সে যে সবার থেকে আলাদা এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। সে বেপরোয়া, এরোগেন্ট, ডেস্পারেট আবার কখনো সাইকো! ”

ইমনের প্রত্যেকটা কথাই আনায়া খুব মন দিয়ে শুনলো তবে কিছুই বললো না।

#চলবে