একজোড়া আগুন পাখি পর্ব-০৩

0
2

#একজোড়া_আগুন_পাখি
®অরনীতা তুশ্মি (#তুশকন্যা)

পর্ব→৩

নয়টা বেজে গিয়েছে সেই কখন! ভিকের অফিস রুমের সামনে দাড়িয়ে আছে আনায়া। ভিকের দরজার সামনে বড় করে কাঠের উপর সোনালী রংএর কারুকাজ করে লেখা “V.K.”

তার নিচে লেখা “Vampire Kenneth”

আনায়া বিষয়টি দেখে তাচ্ছিল্যের সুরে বাঁকা হেসে মনে মনে বললো,

—“মানুষ নাকি মানুষের মতো মানুষ হতে চায়! আর এনাকে দেখো, মানুষ হয়ে ভ্যাম্পায়ার হতে চায়! র*ক্ত চো*ষা বাদুড় কোথাকার! ”

যদিও আনায়া ঠিক করেছিলো ভিকে কে নিয়ে আর কোনো বাঁকা কথা বলবে না। তবে নিজের রাগও আর কন্ট্রোল হচ্ছে না। সেই কখন থেকে তাকে বাহিরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে তাও কোনো কারণ ছাড়া। ইমন যাওয়ার আগে বলেছিলো, এই কেনীথের বাচ্চার কোনো কাজ না থাকলেও বাহিরে দাঁড় করিয়ে রাখবে। সে যতক্ষণ না বলবে তার আগে আর আনায়ার ভেতরে প্রবেশ করা নিষেধ। কেনীথের ইচ্ছে হলেই তবেই সে ইমনকে বলবে আর তারপর ইমন এসে তাকে ভেতরে যাওয়ার জন্য বলবে।
আনায়া ব্যঙ্গ করে চোখ ছোট ছোট করে বলল,

—“এ্যা……..হ! ঢং দেখলে বাঁচি না। সা*লার চাকরিই করবো না।

আনায়া বিরক্ত হচ্ছিলো বিধায় আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। বিশাল বড় একটা এরিয়া নিয়ে অফিসটা তৈরি। আশেপাশে নানান মানুষ হাঁটা চলা করছে। কিছু জায়গা পর পর বড় বড় স্টুডিও রুমও দেখা যাচ্ছে। সাথে বিভিন্ন মিউজিকাল ইন্সট্রুমেন্ট বাজিয়ে অনেকে প্রাকটিসও করছে। সাউন্ড প্রুফ কাঁচের রুম গুলোর দিকে তাকিয়ে ভেতরের মানুষগুলোর কাজকর্মই মন দিয়ে দেখছিলো আনায়া। এমনই সময় হঠাৎ ভিকের রুম থেকে ইমন বের হয়ে এলো আর তাকে ভিকের রুমে যেতে বলে সে আগে আগেই আবারও ভিকের রুমে চলে গেলো।

আনায়ার মাঝে কিছুটা ভয় কাজ করলেও নিজেকে খুব তাড়াতাড়ি স্ট্রং করে অধিক আত্নবিশ্বাসী হয়ে দরজা ঠেলে কেনীথের রুমে প্রবেশ করলো।

প্রথমের রুমের ডিজাইনটা দেখেই কিছুটা আঁতকে উঠলো। চারপাশের সম্পূর্ণ দেওয়ালটা ডার্ক রেড, ব্লাক আর খুব অল্প পরিমান হোয়াইট কালারের কম্বিনেশনে পেইন্ট করা। সাথে দেওয়ার মাঝে কেমন ব্লা’ডের বিভিন্ন শেইপের ডিজাইন করে আর্ট করা। আবার দেওয়ালের বিভিন্ন জায়গায় ভ্যাম্পায়ারের বিভিন্ন ছোটখাটো অঙ্গের স্টিকার লাগানো, যেমন র’ক্ত লাগা ভ্যাম্পায়ারের সেই বড় বড় দাঁত। আবার সাথে অনেক গিটারের স্টিকারও লাগানো।

রুমের একপাশে অবশ্য বিশাল বড় বারান্দা রয়েছে। বারান্দার দেওয়ালটা কাঁচের হওয়া সেখান দিয়ে যেন রুমে আলো প্রবেশ না করতে পারে সেজন্য ব্লা’ডের ডিজাইন করা সাদা পর্দা দিয়ে ঢেকেও রাখা হয়েছে।

আবার রুমের ভেতরে সাদা আর লাল রংএর কম্বিনেশন করে লাইট জ্বালিয়ে রেখেছে। আনায়ার ব্যাখ্যা মতে জায়গাটাকে কেউ যদি বেশি জঙ্গল মনে করে তাহলে ভুল হবে। এতোকিছু দিয়ে পুরো হল রুমের সমান জায়গাটাকে এমন ভাবে গোছানে হয়েছে যে পুরো রুমটায় একটা হাই স্টান্ডার লেভেলের ভাইভ আসছে।

তবে আনায়ার কাছে রুমটা মোটেও কোনো রকস্টারের অফিস রুম বলে মনে হলো না বরং তার কাছে মনে হলো এটা গান গাইতে পারা এক র*ক্ত চোষা বাদুড় কিংবা পিশা*চের রুম।

তবে তার এই বেখেয়ালি ভাবে চারপাশ দেখতে থাকা অবস্থাতেই তার চোখ সামনে বসে থাকা গম্ভীর মানুষটা আর তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা যেন কিনা সেই কখন থেকে ইশারা করে ডাকছে অথচ সে তাদের দেখতেই পেলো না।

আনায়া যে এভাবে হারিয়ে যাবে সেটা ঠিক ইমন ভাবতে পারেনি। ওকে দেখে অবশ্য এটা মনে হচ্ছে না যে এই রুমটা খুব কৌতূহল নিয়ে খুশি মনে দেখছে! তাকে দেখে মনে হচ্ছে এই চারপাশটা দেখে সে সত্যিই প্রচন্ড বিরক্ত।

এদিকে ইমন ভিকের পাশে দাঁড়িয়ে ওকে ডাকার সাহসও পাচ্ছে না। তবুও কোনো উপায় না পেয়ে একটা তার মতে এক দুঃসাহস করে ফেললো। খুক খুক করে দুইবার কাশি দিয়ে আনায়াকে তার দিকে খেয়াল করানোর চেষ্টা করলো।

ইমন ভেবেছিলো আনায়া হয়তো ফিরেও তাকাবে না। কিন্তু তার ভাগ্য ভালো আনায়া কাশির আওয়াজ শুনেই হুট করেই তাদের দিকে চোখ দুটো বড় বড় করে তার দিকে তাকালো। আনায়ার জিজ্ঞাসা সূচক চাহনি দেখে ইমন চোখের ইশারায় পাশে বসে থাকা ভিকের দিকে তাকাতে বললো।

কিন্তু আনায়া চেয়ারে বসে থাকা লোকটিকে দেখেই তার সব কনফিডেন্স উড়ে ভ*স্ম হয়ে গেলো। হঠাৎ করেই তার কেনো যেন কান্না করতে ইচ্ছে হলো।

পায়ের উপর পা তুলে খুব স্টাইল নিয়ে বসে রইছে ডার্ক ব্লাক এন্ড রেডের কম্বিনেশনর একটা হাফ হাতা টিশার্ট পড়া অত্যাধিক সুদর্শন যুবক। নিচে হয়তো ব্লাক কালারের ডেনিম পড়া। বামহাতে পড়া কালো রংএর ব্রেসলেট। যেটা কিনা সাদা টেবিলের উপর কুনুই পর্যন্ত এলিয়ে রেখেছে। আর চেয়ারটা কিছুটা বাঁকা করে, মাথা কিছুটা নিচু করে অন্য হাতটা দিয়ে অনবরত কালো অ্যাপেলের ফোনটায় স্ক্রল করে যাচ্ছে।

গালে খুব নিখুঁত ভাবে আকাঁ ছোট ছোট চাপ দাঁড়ি। এমনিতেই অত্যন্ত ফর্সা ত্বক তার মাঝে এমন আকর্ষণীয় চাঁপ দাঁড়ি!

ডার্ক কফি ব্রাউন কালারের হালকা কার্লি বড় বড় চুল গুলোর কয়েকটা নিয়ে এলোমেলো করে মেসি বান করা। চুল গুলো খুব বেশি বড় না হওয়ায় হাফ মেসি বানটা অনেকটা এলোমেলোই হয়েছে। আবার কয়েকটা চুল সামনের দিকে এলোমেলো হয়ে চোখের উপর পড়ে রইছে। আনায়ার মনে হলো এই লোকটা হয়তো নিজের চুল গুলোকে এলোমেলো করে রাখতেই বেশি পছন্দ করে। নাহলে এতো সুন্দর চুলগুলো কেউ এমন করে রাখে নাকি।

এমনিতে চেহারাটা তো পুরো মাশাল্লাহ। কই হিরোদের মতো সেজেগুজে পরিপাটি হয়ে থাকবে তা না কিসব এলোমেলো আর অদ্ভুত সব রুচি লোকটার। আবার এককানে ছোট দুলও পরা। এগুলো কেমন রুচি আবার! একে দেখলে যে কেউ বলবে ইনি নিজকে জোর করে ঠেলে ঢুলে ভিলেন বানানোর প্রচেষ্টা রয়েছেন।

আবার আনায়া আরেকটু ভেবে দেখলো, রকস্টারা মনে একটু এমনই হয়। খুব বেশি খারাপও লাগছে না। এরপর আনায়ার চোখ পড়লো কালচে হাফ হাতা টিশার্টের কারণে অধিকাংশ বের হয়ে থাকা ফর্সা পেশিবহুল মাসেলস্ আর টিশার্টের আদলে ঢাকা চেস্টের দিকে। এমন জীম ফোলা ফোলা বডি দেখে কলিজার পানি শুকিয়ে গেলো যেন তার।

এখানে অন্য কেউ মেয়ে থাকলে হয়তো তার মাঝে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি প্রবল আকর্ষণের অনুভুতি তৈরি হতো হবে আনায়ার মাঝে তেমন কোনো অনুভুতিই তৈরি হলো না।তার স্ট্রেসের কারণ হলো সেই এমন বডি বিল্ডারের মতো মানুষটাকেই কিনা থা*প্পড় মেরেছে। যদি বাই এনি চান্স তিনি তার দিকে তখন তাকিয়ে না থেকে দুই-চারটা…. না! না! দুই চারটা কেনো! একটাই থা*প্পড়ই যথেষ্ট ছিলো আনায়াকে থেকে সোজা আলু ভর্তা বানানোর জন্য।

যদি কোনে ভাবে সে যদি আমায় চিনে যায়। তাহলে কি প্রতি’শোধ নেবে না তো! ”

আনায়ার চিন্তা ভাবনার মাঝেই ইমন আবারও কিছুটা কেশে বললো,

—“মিস আনায়া প্লিজ ইন্ট্রোডিউস ইওর সেলফ!

আনায়া আবারও ধ্যান ফিরতেই তাড়াহুড়ো করে বলতে লাগলো,

“ওহ! হ্যালো স্যার! আ’ম আনা….”

বাকিটুকু আর তার বলা হলো না। তার আগেই মাথা নিচু থাকা অবস্থাতেই ফোনে স্ক্রল করতে করতে বললো,

“বাংলা!”

আনায়া তখনি চুপ হয়ে গিয়েছে। এরপর বিষয়টি আরেকটু বোঝার জন্য ইমনের দিকে তাকাতেই সে বললো,

“ইংরেজিতে বলার প্রয়োজন নেই, বাংলাতেই বলতে পারো! ”

আনায়া মাথা কিছুটা কাত করে এরপর বলতে লাগলো,

“আমি আনায়া শিকদার ত…….!”

বাকিটুকুও আর আনায়া বলে শেষ করতে পারলো না।নাহ!এবার তার কথা আটকে যাওয়ার কারণ ভিকে কিংবা ইমনের কথার কোনে বাঁধা নয় বরং ভিকের লাল লাল চোখে ভ*য়ংকর চাহনি! কেনীথে চোখ এই মূহুর্তে একদমই শান্ত তবে এই চোখজোড়াই যেন আনায়ার কাছে তার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর মনে হলো। একদম সেই মিথলজির আগুন পাখি কিংবা ফিনিক্স পাখির মতো। চোখ জোরা কি৷ শীতল অথচ সেই চোখের চাহনি আনায়ার গায়ে বি*ষাক্ত তীরের মতো বিঁধলো। আনায়া আরেকটু ভালো করে তাকাতেই দেখলো কেনীথের চোখের মনি খুব মৃদু পরিমাণ লাল লাল!আচ্ছা উনি কি লেন্স পড়েছেন, তবে দেখেতো মনে হচ্ছে না।

আনায়ার এই হুটহাট ধ্যানে পরার মাঝেই কেনীথ বসা থেকে সোজা দাঁড়িয়ে পড়লো। এরপর একদম শিরদাঁড়া টানটান করে ইমনের উদ্দেশ্য বললো,

—“আমি বাহিরে যাচ্ছি, তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসছি। ”

এরপর আনায়া কিংবা আশেপাশের দিকে না তাকিয়েই বড় বড় পা ফেলে রুম থেকে প্রস্তান করলো।

এদিকে হঠাৎ অপরিচিত কন্ঠ শুনে আনায়াও নিজের ধ্যান থেকে অনেক আগেই ফিরে এসেছে। এই প্রথমই হয়তো কেনীথের স্বাভাবিক গলার আওয়াজ শুনতে পেলো সে। চোখ জোড়ার মতো শান্তশিষ্ট গলার আওয়াজটাও যে কতটা গম্ভীর আর ভ*য়ংকর হতে পারে তা এই কেনীথকে দেখে বোঝা যাচ্ছে। আনায়া কেনীথের দিকে তাকিয়ে কথা গুলো মনে মনে ভাবলেও কেনীথ ভুলেও একবারও আনায়ার দিকে ফিরে তাকালো না।
বড় বড় পা ফেলে গটগট করে রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেলো।

কেনীথ চলে যেতেই বোকার মতো কেনীথের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকা আনায়ার কাছে দৌড়ে এতো ইমন। এসেই করুন সুরে জিজ্ঞেস করলো,

“আনায়া কি হয়েছে তোমার! এমন উদ্ভট কাজকর্ম কেনো করছো। চাকরিটা কি করার ইচ্ছে নেই তোমার! নাহলে তুমি বলে দেও বোন, আমি অন্য কাউকে খুঁজে বের করছি। ”

ইমনের কথায় এবার আনায়ার মনে সন্দেহ জাগলো। এই ইমন ভাই নিজের চাকরি ছেড়ে দিচ্ছে ভালো কথা কিন্তু তাকে কিংবা অন্য কাউকে এই পি.এ. বানানোর জন্য এতো অস্থির কেনো। নাকি এতেও কোনো অন্য কাহিনি রয়েছে। পরক্ষণেই ভাবলো,কিসের কাহিনি! ইমন ভাই নিশ্চয় তার খারাপ চাইবে না।

“ভাইয়া সরি একটু ওনার ওমন চেহারা দেখে হাইপার হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিলো আমাকে কাঁচ্চা চি*বিয়ে খাবে।”

আনায়ার কথায় ইমন দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মুচকি হাসলো।

—“আনায়া এভাবে ভয় পেলে চলবে না। আচ্ছা যাই হোক,আমি এখন আসছি। ”

ইমন কথা বলা শেষ করে রুম থেকে বেড়োতে গেলেই ইমন খেয়াল করলো আনায়াও তার পিছে পিছে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। যা দেখে ইমন আবার ও তাড়াহুড়ো করে বললো,

—“আরে আরে তুমি কোথায় যাচ্ছো!”

—“আপনি নাকি বাহিরে যাবেন, তাহলে আমি এখানে থেকে কি করবো! ”

—“তোমাকে এখানেই থাকতে হবে, তুমি শুনলে না ভিকে কি বললো! একটু পরে সে আবার আসবে। হয়তো তোমাকে আরো কিছু জিজ্ঞেস করবে। তাই ওই সোফাতেই বসে থাকো যতক্ষণ না আমরা ফিরে আসছি। আর নেক্সট টাইম স্যার যদি কিছু জিজ্ঞেস করে, তখন যেন আবার উল্টো পাল্টা কিছু বলো না,সাবধান! ”

ইমন দূরে থাকা একটা সোফার দিকে ইশারা করে কথা শেষ করলো। এরপর সেও রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেলো।

আর আনায়াও মাথাটা কাত করে সম্মতি জানি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

____________________

সোফার একপাশে চুপ করে বসে, বারবার বাটন ফোনটায় সময় দেখছে আনায়া।প্রায় আধ ঘন্টা হতে চললো অথচ ইমন কিংবা ভিকে;কারোরই আসার কোনো খবর নেই। আবার তাকে এটাও বলে গিয়েছে সে যেনো কোথাও না যায়। আনায়া মনে মনে প্রচন্ড বিরক্ত, তার বিরক্তির ছাপ চোখ মুখেও প্রকাশ পাচ্ছে।

সেই কখন থেকে সোফায় বসে থেকে পুরো রুমটার আনাচে কানাচে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেও একটা জিনিসের প্রতি আনায়ার চোখ বারবার আটকে যাচ্ছে। একটা জিনিস বললে ভুল হবে, তার থেকে অনেকটা দূরে থাকা এওয়ার্ড সেল্ফটার প্রত্যেকটা জিনিস গুলোকে কাছ থেকে দেখার ভীষণ ইচ্ছে জেগেছে তার মাঝে। কিন্তু সাহস হচ্ছে না কাছ থেকে জিনিসগুলো দেখার। মনে মাঝে হঠাৎ কেনো যেন এক অজানা ভয় কাজ করছে।
কেউ দেখে বলবে, এই আনায়াই কি সে আনায়া যে কিনা ভয় কি জিনিস সেটাই জানে না! কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ইচ্ছে যার মনের মাঝে একবার জেগে উঠলে সে ইচ্ছে পূরনে পরিণতি কি হবে তা না ভাবা মেয়েটাই এখন এই ছোট্ট বিষয়টিকে নিয়ে ভয় পাচ্ছে!

তবুও আনায়ার মন মানছে না! বসে থাকতে থাকতেই বেচারী ছটফট করে যাচ্ছে। একটু পর পর কপাল কুঁচকে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। মেয়েটা মাঝে দুই রকমের বৈশিষ্ট্যের দেখা মেলে। এক হলো প্রচন্ড দায়িত্ববান আর দুই হলো তার ছেলেমানুষী। তার বাড়িতে বলতে গেলে বর্তমান কর্তী মূলত সে নিজেই । না চাইতেই ছেলেমানুষীর বয়সটাতেই তার উপর পরে গিয়েছে বিশাল দায়িত্বের বোঝা। সে হিসেবে চাইলেও তার ছেলেমানুষী গুলো কখনো সবার সামনে প্রকাশ করা হয়না তার। এইজন্য তার এই ছেলেমানুষী বৈশিষ্ট্যটা সবার অজানা। তার খুব কাছের মানুষগুলোর সাথেই একটু বেশি বক বক করতে থাকে এই আরকি!

আনায়া আর ধৈর্য নিয়ে বসে থাকতে পারলো। সটানভাবে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লো। একটু এওয়ার্ড পিসগুলো কাছ থেকেই তো দেখতে চাইছে। ও কি ওগুলো ছুঁবে নাকি!

এই চিন্তাভাবনা নিয়েই সোজা চলে গেলো বিশাল বড় সেল্ফের দিকে। গিয়ে দেখলো, একটা না, দুইটা না! প্রায় শ’খানেক……. না! না! এর চেয়েও বেশি এওয়ার্ড ট্রফি সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা। আনায়া চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো, জিনিসগুলো দেখতে অনেক বেশি সুন্দর মনে হলো তার। তবে একটা এওয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে চোখ আঁটকে গেলো। খুব বেশি বড় নয়,মাঝারি সাইজের একটা সুন্দর কালচে লাল রংএর গিটারটাকে হালকা করে বাকিয়ে একটা কাঠের ছোট সার্ফেসের উপর রেখে ট্রফিটা তৈরি করা হয়েছে। দেখতো অসম্ভব কিউট। আবার কাঠের মাঝে সোনালী বর্ণে ভিকের নামও লেখা। সাথে বাকি লেখাগুলো পড়তেই বুঝতে পারলো এটা একটা বেস্ট ইন্টারন্যাশনাল রকস্টার এওয়ার্ড। আনায়া ভেবেই পায় না, সে যাকে কথায় কথায় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে অথচ সে মানুষটার কত নামডাক! শুধু সে গাধী নিজেই তাকে চেনে না।

তবে এইমূহুর্তে হুট করেই আনায়ার ওটা ছুয়ে দেখতে ইচ্ছে হলো। হালকা করে মাথাটা নিচু করে তর্জনী আঙ্গুলটা দিয়ে হালকা করে ছুঁয়ে দিতে লাগলো। আনায়ার মুখে অনবদ্য এক হাসি। দুইগালে ছোট বড় মিলিয়ে দুটো টোলের দেখা মিলেছে। তার চুলগুলো কোমড় পর্যন্ত ছড়িয়ে রইছে।

কয়েক মূহুর্ত অতিক্রম হয়নি আর এতেই এক অনাকাঙ্ক্ষিত কান্ড ঘটিয়ে ফেললো। এরও অবশ্য যথেষ্ট কারণ হয়েছে। আনায়া খুব ধীরে ধীরেই তর্জনী দিয়ে জিনিসটা পর্যবেক্ষণ করছিলো আর ঠিক ওই মূহুর্তেই পেছন থেকে একটা গম্ভীর আওয়াজ শুনতে পেলো।

—“হেই ইউ,ওখানে…….. ”

কথাটা এইটুকুই ছিলো। আনায়া পেছন ফিরে দেখলো বড় বড় পা ফেলে কেনীথ তার কাছ আসছে। এটা দেখে যতটা না আ’তংকিত হলো তার চেয়ে বেশি আ’তংকিত হলো যখন তার খেয়াল হলো তার পায়ের কাছে সেই সুন্দর গিটার এওয়ার্ডটারই মাথার কাছে একপাশ ভেঙ্গে গিয়ে ছোট বড় দুটো টুকরো দুই দিকে ছড়িয়ে আছে। যেটা কিনা সে পিছন ঘুরতে গিয়ে হাতের ছোঁয়া লেগে পড়ে গিয়ছে।

এদিকে কেনীথও তার থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আনায়ার মনে হলো, হাফ হাতা কালচে টিশার্ট জন্য বেড়িয়ে থাকা জীম করা ফর্সা মাসেল গুলো মনে হয় রাগের কারণে আরো ফুলে উঠেছে । ফর্সা হাতের আদলে থাকা নীল বর্ণের শিরা গুলো হাতের মাঝে নানা দেশের মানচিত্র একে রেখেছে। এগুলো মোটেও তার কাছে সুদর্শন পুরুষের বৈশিষ্ট্য মনে হচ্ছে না বরং এগুলো তাকে ভ*স্ম করার ইঙ্গিত মনে হচ্ছে।

অথচ কেনীথের চোখ মুখ একদম শান্ত তবে তার প্রতিদিনের রুপের মতোই। একটা আগাম ঝড়ের আভাস দেওয়া মতো নিস্তব্ধ গম্ভীর চেহারা নিয়েই সে সবসময় চলাফেরা করে। তবে আনায়ার কাছে কেনীথের সব বৈশিষ্ট্যই আ*তংক সৃষ্টি করার মতো।

আনায়ার কলিজা শুকিয়ে কাঠ। বেচারীর নিশ্বাস নিতেও এখন কষ্ট হচ্ছে। এরই মাঝে আবার কেনীথ আরো কয়েক পা তার দিকে এগিয়ে এলো। আনায়া বুঝতে পারছে না সে কি করবে আবার এটাও মনে হচ্ছে এবার মনে হয় কেনীথ নিজের প্রতি*শোধটা নিয়েই হিবে। তবে তার ভাবনা অনুযায়ী তেমন কিছুই হলো না।

আনায়ার মুখের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকা কেনীথ হুট করেই হাটু গেঁড়ে আনায়ার পায়ের পাশ থেকে ভাঙ্গা গিটারের বড় অংশটুকু হাতে তুলে নিলো। কিন্তু এদিকে আনায়া হঠাৎ করেই কেনীথ কে তার পাশের কাছে বসে হাত দিতে দেখায় কিছুটা লাফিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো।

কেনীথ জিনিসটা একহাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আনায়াকে একবার দেখলো। এরপর কিছুক্ষণ জিনিসটাকে কাছে নিয়ে দেখতে লাগলো। মায়াও লোকটার কার্যকলাপ দেখে যাচ্ছে।

কেনীথ জিনিসটাকে দেখতে দেখতেই হুট করেই খুব জোরে পাশের দেওয়ালের দিকে ছুঁড়ে মার*লো।মূহুর্তেই ভয়ং*কর শব্দ তুলে জিনিসটার যতটুকু অবশিষ্ট ছিলো তা ভেঙ্গে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। এমন কাজে আনায়াও হঠাৎ চমকে উঠলো।

পুরো কাজটি কেনীথ আশেপাশে না তাকিয়েই করেছে। কারণ তার নজর ছিলো সোজা আনায়া দিকে। আনায়ার বিস্ময়ের মাঝে কেনীথ প্যান্টের পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে, ঘাড় বাঁকিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া অংশগুলো দেখতে দেখতেই বললো,

“যে অল্প আঘাতেই ভেঙ্গে পরে, তার সাথে ভিকের নাম জড়িত থাকার কোনো যোগ্যতা নেই! ”

এরপর আনায়ার দিকে তাকিয়ে আশ্চর্যপূর্ণ বাঁকা হেসে রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেলো।

ভিকে কি বললো না বললো তাতে আনায়ার কোনো ভাবনা চিন্তা নেই। ভিকের কথাটা অনেকটা তার মাথার উপর দিয়েই গেলো। কথাটা তাকে বললো নাকি ঐ ট্রফিটাকে বললো কে জানে!

তবে ভিকে চলে যাওয়ার সাথে সাথেই আনায়া করুন চোখ মুখ বানিয়ে বিড়বিড় করে বললো,

—“জিনিটা তার পছন্দ না আমাকে বললেই তো হতো। আমি টুকরো দুটোকে জোরা লাগিয়ে নিজের কাছেই রেখে দিতাম। এভাবে ওটাকে গুঁড়ো গুঁড়ো বানিয়ে আমার মনটাকেও যে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিলো। ইশ…..ওটা তো আমার পছন্দ হয়েছিলো। ”

পরক্ষনেই নিজের আক্ষেপকে চাপা দিয়ে বললো,

—“তোকে যে দুইটা থা*প্পড় বসায় নি, এটাই তো অনেক। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় কর গাধী!”

#চলবে