#একজোড়া_আগুন_পাখি
®অরনীতা তুশ্মি (#তুশকন্যা)
পর্ব→০৬
আনায়া নিজের কেবিনে বসে শুধু ছটফট করে যাচ্ছে। বুঝতে পারছে না সে কি করবে। একে তো ভিকের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে কিছুই জানতেও পারলো না। আর এখন মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্নে মাথা নষ্ট হওয়ার উপক্রম। নিজের ব্যর্থতায় মনে মনে নিজেকে হাজারটা গালা*গালি দিয়েও শান্ত হচ্ছে না সে।
একবার রোলিং চেয়ারে বসে ফ্যানের মতো ঘুরছে তো একবার টেবিলে উপর বসে ভাবুক চিত্তে পা দুলিয়ে যাচ্ছে। আনায়া বাড়ির বড় মেয়ে হলেও ইনায়ার মতো ততটা ম্যাচিউর যে সে নয় তা সে নিজেও জানে। তবে এটা সবার মাঝে থাকলে ততটা প্রকাশ না পেলেও আনায়া যখন একা থাকে তখনই ওর বাচ্চা সুলভ আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। যা বর্তমানে তারমাঝে ঘটছে।
আনায়া নিজের চিন্তাভাবনার পাশাপাশি একটা বিষয় নিয়ে যেমন খুশিও হচ্ছে তেমন বিরক্তও হচ্ছে। তার কাছে একবার মনে হচ্ছে ভিকের পিএ-র চাকরিটা তার জন্য একদম পারফেক্ট হয়েছে। প্রতিমাসে এতোগুলা করে টাকা স্যালারি পাবে অথচ এখানে তার কোনো কাজই নেই। লাইফটাই পুরো প্যারাহীন চিলমুডে চলে গিয়েছে। তার মাথাতেও আসেনি যে এমন একটা জবে কোনো কাজকর্ম ছাড়াই এতো গুলো টাকা স্যালারি পাওয়া যায়।
তবে এই বিষয় নিয়ে যতটা খুশি হচ্ছে তেমনি তার মতো একটু এক্সট্রোভার্ট মেয়ের জন্য বিষয়টি অনেক বোরিং। এখন পর্যন্ত আশেপাশে কথা বলে সময় পার করার মতো কাউকে সে পায়নি। সবাই সবার কোনো না কোনো কাজে ব্যস্থ। এভাবে কেউ কাজ ছাড়া চুপচাপ হয়ে বাঁচতে পারে নাকি! আর তার মনেও হয় না এখানে তাকে আদোও কিছু করতে দেওয়া হবে। ভিকে না হয় মানুষ নয়,সে দিনের বেলাকেও রাত বানিয়ে দিব্বি ঘন্টার পর ঘন্টা সময় পার করে। কিন্তু সে তো জলজ্যান্ত মানুষ! এমন জং ধরে যাওয়া যন্ত্রের মতো পড়ে থাকলে হবে নাকি। এরচেয়ে ভালো হয় না, তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিক!
পরক্ষোণেই বিড়বিড় করে বললো,
—“চুপ কর গাধী! এখানে তোর কাজ কি সেটা বুঝতে পারছিস না ভালো কথা কিন্তু অফিসে বসে না থেকে বাড়ি গিয়ে ঘুমালে কি তোর শ্বশুর এসে মাস শেষ স্যালারি দিয়ে যাবে! এরচেয়ে ভালো হবে বাহিরে গিয়ে ঘুরে আসি। কথা বলার মতো কাউকে না কাউকে তো পেয়েই যাবো। ”
এই ভাবনাতেই আনন্দিত চিত্তে ধপ করে টেবিল থেকে নেমে বাহিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রুম থেকে বেড়িয়ে পড়লো।
____________
বদ্ধ রুমটাকে খানিকটা অন্ধকার বানিয়ে নিজের ডেস্কের উল্টোদিকে চেয়ারে বসে নির্বিকারে তার মুখোমুখি সামনের দেওয়ালে রাখা একটা বড় কাঁচের ওয়ালমেটের দিকে নির্বিকারে তাকিয়ে রয়েছে কেনীথ। জিনিসটা কেনীথ যেখানে বসে থাকে তার ঠিক পেছনেই দেওয়ালে লাগানো। জিনিসটাকে আর পাঁচটা ওয়ালমেট হিসেবে বলা যাবে না। দেখতে অন্য সব ওয়ালমেটের মতো উপরিভাগ কাঁচের হলেও ভেতরে কোনো দৃশ্য কিংবা কোনো কারুকাজের ছোঁয়া নেই। জিনিসটা সম্পূর্ণ লাল আর কালো রংএর মিশ্রণের কাঁচেট আয়তাকার সমতল বস্তু। তবে বিষয়টি আর সবার নজরে এলেও এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। ভিকে যেমন অস্বাভাবিক তেমনি তার পছন্দগুলোও যে অস্বাভাবিক হবে এটাই তো স্বাভাবিক,তাই নয় কি!
কিন্তু এই জিনিসটার মাঝেও যে ভিকে একখানা রহস্য ঢুকিয়ে রেখেছে। ভিকের চোখে একখানা কালো রংএর চশমা। এই চশমাটা দেখতে অবশ্য অস্বাভাবিক নয় বরং অন্য সকল স্বাভাবিক চশমার মতোই। তবুও এর একটা বিশেষত্ব রয়েছে সাথে কানেকশন রয়েছে ওই অদ্ভুত দেখতে ওয়ালমেটের সাথে। মূলত এই চশমা পড়েই ওই ওয়ালমেটের দিকে তাকিয়ে ভিকে স্টুডিও কিংবা তার প্রয়োজনীয় আরো সকল কিছুর ভিডিও সে নিজের কেবিনে বসে দেখে থাকে।
অন্যসকলে যদি ওয়ালমেটটাকে খালি চোখে দেখে তবে সে কিছুই বুঝতে পারবে না কিংবা তার কাছে বিষয়টি সাধারণই মনে হবে। কারণ ভিকের পরণের চশমা ছাড়া ওই ওয়ালমেটের ভেতরে চলতে থাকা কার্যক্রম কেউই দেখতে পারবে না। আর জিনিসটি মূলত কোনো ওয়ালমেট নয় বরং ওটি একটি মনিটর স্কিন। যাতে বেশির ভাগ সময় কেনীথ অফিসের সিসিটিভির ফুটেজ দেখতে থাকে।
অনেকে হয়তো ভাবতেই পারে নিজের অফিসের সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে এতো কলাকৌশলের কি প্রয়োজন। সত্যি তাই! কিন্তু এটা কেনীথের আপন মনের এক আজব কৌশল। এই পুরো অফিসের প্রত্যেকেই জানে অফিস কিংবা স্টুডিওর কেবিন গুলো বাদে প্রত্যেকটি জায়গাতে সিসিটিভি লাগানো রয়েছে। আর সেগুলোর পর্যবেক্ষণ করার জন্য আলাদা রুমে অনেক গুলো মনিটরের সামনে নিযুক্ত রয়েছে আলাদা কর্মী। যেমনটা আর সকল অফিস গুলোতেই হয়ে থাকে। কিন্তু তাদের আরো একটি ধারনা হলো এসব ফুটেজ হয়তো কেনীথ কখনোই দেখে না কিংবা খুব প্রয়োজন ছাড়া দেখতেও যাবে না। এককথায় কেনীথ পুরো অফিসটাকে স্বাধীন বানিয়ে ফেললেও প্রত্যেকের মাঝে এক মন্ত্রও ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, যা কিছু হয়ে যাক না কেনো কেনীথের অগোচরে কিছু করা যাবে না। তাহলেই ঘোর বিপ*দ! অল্প কিছুদিনের অভিজ্ঞতায় প্রত্যেকেই অনুধাবন করেছে যে তারা নিয়ম ব্যতীত কেনীথের অগোচরে যখনই কিছু করতে গিয়েছে তখনই কিভাবে যেন কেনীথ তা সঙ্গে সঙ্গে জেনে গিয়েছে।
অথচ কেনীথ নিজের বদ্ধ রুম বসে নিজের ইচ্ছে মতো সারাক্ষণ এসব নজরদারি করে কিংবা তার পরবর্তী ফাঁদের জাল বুনতে থাকে। এই মূহুর্তেও আনায়ার কোনো কার্যক্রমই আর তার নজরের অগোচর হলো না। আর খুব মনোযোগের সঙ্গেই আনায়ার প্রত্যেকটি কার্যকলাপ লক্ষ করলো সে।পরিশেষে শুধু একখানা বাঁকা হাসি দিয়েই নিজের পর্যবেক্ষণের সমাপ্তি ঘটালো।
______________
বিকেল বেলায় ইনায়া বাড়ি থেকে বেড়িছে নিজের ছোট্ট গ্যাং-টার সাথে দেখা করতে। আজ তাদের ছোটখাটো একটা গোল মিটিং বসবে। তাদের এলাকার বড় মাঠটায় সেটা সম্পূর্ণ তাদের নিজেদের দখলে থাকে সেটা নাকি শহরের একদল কলেজ পড়ুয়া ছেলেটা এসেছে দখলে নিতে। রোজ বিকেল করে নাকি সেই ছেলেগুলো এসে মাঠে ফুটবল, ক্রিকেট খেলে অথচ তাদের এলাকার বাচ্চা কাচ্চা গুলো গেলে সেখানে আর ঢুকতে দেয় না। ইনায়ার মতে এসব ঘোর অন্যায়। তাদের জিনিসে অন্য কেউ দখল করে আবার তাদেরই সেখানে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না এই অন্যায় কিভাবে মানা যায়। এটার যথাযথ বিচার করতে হবে।
তাই আজ মাঠের কাছেই তাদের গ্যাং এর গোল মিটিং বসছে। আর এই গ্যাং এর লিডার হলো ইনায়া নিজেই। আর এই গ্যাং-এর অবশ্য একটা নামও রয়েছে তা হলো ” ভিকু”। এই নামের উদ্দেশ্য হলো এই গ্যাং এর প্রত্যেকেটা সদস্যই ভিকের অনেক বড় ফ্যান। এককথায় কেনীথের নাম শুনতেই এরা উষ্ঠা খেয়ে পড়ে। সে কারণেই ভিকের নামের উদ্দেশ্য আরেটু মনমতো করে নাম রেখেছে”ভিকু” এছাড়া তাদের বেশির ভাগ আলোচনা যেমন কেনীথকে নিয়েই হয় তবে তেমনি অন্যায় হলে কেনীথের মতো তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বড় ছোট দেখার সময় তাদের নেই, এককথায় কেনীথ যেমন নিজের শুক্রকে মারতে দ্বিধাবোধ করে না তেমনই তারাও অন্যয়ের সাথে লড়তে বিন্দু পরিমাণ আপোষ করতে রাজি নয়।
আবার এই গ্যাং এর সদস্য গুলোও আনায়ার সমবয়সী কিংবা তার চেয়ে কেউ কয়েকবছরের ছোট তো কেউ বড়। সঙ্গে তার সমবয়সী কয়েকটা ছেলেও রয়েছে। তবে এখানে মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের সংখ্যাটাই বেশি। এই কারণেই ইনায়াকে এলাকার লোকেরা সুনজরে একটু কমই দেখে। সবার কাছে ইনায়া মানেই দেখতে মাশাআল্লাহ আর আচার-আচরণে পুরো ধানিলঙ্কা।
তবে বড়দের কাছে ইনায়া খুব একটা পছন্দের না হলেও তার সমবয়সী কিংবা ছোটদের কাছে সে নিত্যন্তই অনেক পছন্দনীয় ব্যক্তি। আর বড়দের অপছন্দের বিষয় নিয়ে ইনায়ারও কখনো কিছু যায় আসে না। তার কথা একটাই, যাদেরটা খায় বা পড়ে না তাদের কথা শুনে কেনো নাচতে হবে! তার সাথে হোক কিংবা যার সাথেই হোক, অন্যায় হলে তার সাথেসাথে প্রতিবাদ করতে হবে। চুপ করে সহ্য করার মেয়ে তো সে নয়। কিংবা একটাও তাদের গ্যাং এর মূল নীতি নয়।
_________________
মাঠের মাঝে খুব জোরালো ভাবে ফুটবল খেলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। একদল আর্জেন্টিনার জার্সি তো আরেকদল ব্রাজিলে জার্সি পড়ে মাঠের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তবে মাঠের এক কোণায় গাছের নিচে চুপ করে মনমরা হয়ে বসে রইছে অতি সুদর্শন এক যুবক। বয়স তার আঠারোয় পৌঁছিয়েছে কিনা সন্দেহ আছে। ফর্সা চেহারা সাথে মাথায় এক খাঁচা ঝাকরা সিল্কি চুল। দেখতে আধুনিক যুগের টম বয় যাকে বলা হয় আরকি। পরণে কালো প্যান্ট আর ব্রাজিলের জার্সি।
তবে তার এমন মনমরা হয়ে বসে থাকাটা তার বন্ধু মহলের কারোরই পছন্দ হচ্ছে না। তবে তার মন খারাপও যে যথেষ্ট কারণ রয়েছে সেটাও তো তার বন্ধুরা জানে। এতে অবশ্য তাদের মনটাও কিছুটা খারাপ। কিন্তু এভাবে খেলতে এসে মনমরা হয়ে বসে থাকার তো কোনো মানে নেই তাই না!
বিষয়টি নিয়ে কেউ বিরক্ত নয় বরং তাদেরও আফসোস হচ্ছে, ওমটা না হলেও পারতো। এরই মাঝে শ্যাম বর্ণের একটি ছেলে এসে তার পাশে বসলো আর বললো,
—“রোহান! এভাবে প্লিজ মনমরা হয়ে বসে থাকিস না। রেহান ভাইয়ার এক্সিডেন্টের খবর শুনে আমরা সবাই অনেক কষ্ট পেয়েছি। রেহান ভাই তো সত্যিই অনেক ভালো মানুষ আমরা সকলেই জানি। তুই চিন্তা করিস না, ভাইয়া খুব তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবে। ”
এরই মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা আরো দুটো ছেলে এসে রোহানকে বলতে লাগলো,
–“কিন্তু দোস্ত তুই এভাবে মনখারাপ করে প্লিজ বসে থাকিস না। ”
–“আমরা তোকে এই অবস্তায় দেখে আরো বেশি কষ্ট পাচ্ছি! ”
—“তুই প্লিজ আমাদের সাথে খেল! তুই না খেললে আমরা কখনোই জিততে পারবো না। প্লিজ, তুই পারবি আমাদের টিমকে জেতাতে। ”
–“দোস্ত চল না খেলা স্টার্ট করি! আজ জিততে না পারলে ওই টিম সারাজীবন আমাদের ক্ষেপাবে! এমনিতেই তো সেভেন আপ, সেভেন আপ করতে থাকে এবার না জিততে পারলে আরো কি কি বলা স্টার্ট করবে কে জানে। ”
অনেকক্ষণ ধরে বন্ধুদের কথাবার্তা গুলো শোনার পর রোহান কোনো উওর দিলো না বরং বন্ধুদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এরপর বলতে শুরু করলো,
—“ঠিক আছে! আমি একটু টিউবওয়েল থেকে হাতমুখ ধুরে ফ্রেশ হয়ে আসছি। ”
রোহানের সম্মতিতে প্রত্যেকেই উচ্ছাসে লাফিয়ে উঠলো। অন্যদিকে রোহানও হাতমুখ ধোঁয়ার উদ্দেশ্যে মাঠ থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত টিউবওয়েলর কাছে যেতে লাগলো। সাথে মনে মনে মাঝে নানান চলতে লাগলো নানা প্রশ্ন, নানা চিন্তা। সব চিন্তা তার বড় ভাই রেহানকে নিয়েই। বড় ভাইয়ের এমন এক্সিডেন্ট কিছুতেই সে সহ তার পরিবার মানতে পারছে না।
এমনকি তার ভাইয়ের এক্সিডেন্টের কথা এখন পর্যন্ত তার মা এখনোও শোনেনি। সে এই খবর জানতে পারলে পরিস্থিতি আরো কোনদিকে যাবে কে জানে। বড় ছেলের শোকে মা নিজেই অসুস্থ হয়ে যাবে নয়তো ছেলের কাছে যাওয়ার জন্য পাগলামি করবে। রেহানের এই বিষয়টি ইমন, সে আর তার বাবা জানে। আপাতত আর কেউই এই বিষয়ে অবগত নয়। অন্য দিকে বাড়ি থেকে আসার আগেই ইমন তাকে বলেছিলো রেহান নাকি আগের থেকে কিছুটা সুস্থ। সে যেন বেশি চিন্তা না করে অথচ তার চিন্তার পাহার যেন কমছেই না।
প্রথমে তো খেলার জন্য আসতেই চাইছিলো না কিন্তু বন্ধুদের জোরাজোরিতে না এসেও পারলো না।
রোহান নিজের ভাবুক মস্তিক নিয়ে এগোতে এগোতেই হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা লেগে তার ধ্যান ফেরে। সামনে তাকিয়ে দেখে এক অল্পবয়সী মেয়ে ঘাসের উপর পড়ে রয়েছে। হঠাৎ করেই কি হলো তা বুঝে ওঠার আগেই মেয়েটি তড়িৎ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রোহানের মুখোমুখি হলো। আর কিছুক্ষণ রোহানের দিকে বিরক্তিকর চেহারা নিয়ে তাকিয়ে থাকার পর তা ধীরে ধীরে রাগা*ন্বিত চেহারায় পরিণত হলো। তবে রোহান কি বলবে বুঝতে পারছে না।
অন্যদিকে মেয়েটা রাগান্বিত সুরে বলতে লাগলো,
—“এই যে হ্যালো! কথা বলতে পারেন না? ”
রোহান কিছু না বলে মেয়েটির কথায় কপাল কুঁচকাতেই মেয়েটি তা দেখে আবারও বলতে লাগলো,
—“কথা বলতে না পারলে হ্যাঁ না ইশারায় কিছু তো বলুন। তবে অভিনয় করলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু। আমাকে ধাক্কা মেরে…..
ইনায়ার কথা শেষ হওয়ার আগেই রোহান বললো,
—“কথা বলতে পারি আমি! ”
রোহানের সামন্য কথাটাও ইনায়ার কাছে হাস্যকর মনে হলো। মূহুর্তেই নিজের রাগা*ন্বিত চেহারাটাকে গায়েব করে মুচকি হেসে কিছুটা তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
—“বাপ রে, কথাও বলতে পারেন দেখছি! ”
রোহান আবারও নিজের ভ্রু কুঁচকালো। মেয়েটির কথাবার্তা তার কেনো যেন পছন্দ হচ্ছে না। সে একটু চঞ্চল স্বভাবের ছেলে হলে এই মেয়েটা তার অদ্ভুত লাগছে। কেমন যেন মা*স্তান টাইপের ভাব অথচ চেহারা কি সুন্দর। খুব বেমানান লাগছে তাকে।
এদিকে রোহানের ভ্রু কুঁচকানো দেখে ইনায়া বুকে হাত গুঁজে ভাব নিয়ে বলতে লাগলো,
—“আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলেন কেনো এটা বলেন। মেয়ে দেখেই ধাক্কা মারতে ইচ্ছে করে নাকি ভূল করে মা*রলে তো নিশ্চয় সরি বলতেন তা তো বললেন না। ”
ইনায়া কথা শুনে রোহান মনে মনে ভাবলো সে তো নিজের ইচ্ছে মতোই হাঁটছিলো তাহলে সে কখন ধাক্কা মারলো।
—“আমি ধাক্কা মেরেছি নাকি! ”
ইনায়া অবাকের সুরে বললো,
—“আপনার মাথায়া সমস্যা আছে নাকি! থাকলে বলতে পারেন, পাগল ভেবে মাফ করে দেবো। ”
এবার রোহানের সব চিন্তা ভাবনা উবে গিয়ে মেজাজ খারাপ হলো। মনে মনে ভাবলো এই মেয়ে বেশি কথা বলে। এই ভেবে ইনায়ার দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকাতেই ইনায়া আবারও বললো,
—” ধাক্কাটা আপনিই মেরেছেন! আমি ধাক্কা দিলে মাটিতে নিশ্চয় আপনি পড়ে থাকতেন আমি নয়!”
ইনায়ার কথা রোহানের মস্তিষ্কে পৌঁছেতেই রোহান নরম সুরে বললো,
—” ওহ, তাহলে সরি! ”
ইনায়া চোখ কুঁচকে রোহানের কাছে মুখটা কিছুটা এগিয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ দেখে আর মাথাটা পেছনে নিয়ে এসে বললো,
—“ইট’স ওক..কে! আপনাকে দেখে পাগল তো মনে হচ্ছে না তবে…… উম……নেক্সট টাইম ভুল করলে নিজের দোস ঢাকার চেষ্টা না করে সরাসরি সরি বলে দিবেন । নিজের ভুল স্বীকার করা খারাপ কিছু না। আর নেক্সট টাইম যদি কখনো মনে হয় আপনি এসব ইচ্ছে করেন তাহলে একেবারে উত্তম মধ্যম দিয়ে ছাড়বো। এখন আসি তবে, ভালো থাকবেন। ”
ইনায়ার শেষের কথায় স্পষ্ট হুমকি শুনে রোহান মুচকি হেসে কেশে উঠলো।
—“আহ…মিস!আমি আমার বয়সে হয়তো বড় হবো! ”
—“তো!!! বড় ছোট কিছু মানবো না, অন্যায় করলে আর কেউ ছেড়ে দিলেও এই ইরা ছাড়বে না,হু!
ইনায়া হুমকি স্বরুপ কথা শেষ করে চলে যেতে লাগলেই পেছন থেকে রোহান বিড়বিড় করে বললো,
—“মারা*ত্মক ! তবে পিচ্চির নাম চেহারা দুটোই সুন্দর, ইরা!
এই বলেই মুচকি হাসলো রোহান। তবে তার হাসি কিংবা বিড়বিড় করে বলা কোনে কথাই ইনায়ার শোনার সময় হলো না। সে চললো তার গুরুত্বপূর্ণ গোল মিটিং বসালে।
_____________
মূহুর্তেই আবারও চেনা পরিচিত এক বড় যু*দ্ধ হয়ে গেলো। ইনায়া নিজের গোল মিটিং শেষ করে দলবল নিয়ে রোহানদের চলন্ত খেলার মাঝে গিয়ে খেলা থামিয়ে দেয়। ইনায়ারা প্রথমে ভালো করে বললেও রোহনাের কিছু বন্ধু তাদের কথা মানতে নারাজ। তারা এখান থেকে কিছুই তেই সরবে না। অন্য দিকে ইনায়াও শপথ নিয়েছে এদের এখান থেকে না সরিয়ে যাবে না। নিজেদের অধিকার নিজেদেরই বুঝে নিতে হবে।
এক কথায় দুই কথায় দুই দলের মাঝে কথা কাটাকাটি, ঝগ*ড়া থেকে শুরু করে তা এক পর্যায়ে ইটপাটকের ছোড়াছুড়িতে রুপান্তর হয়। কেউ মাথায় আঘাত পায় তো কেউ হাতে পায়ে। তবে থামতে কেউ রাজি নয়। এক পর্যায়ে এলাকার লোকজন এসে দুপক্ষকে থামিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় আর এই বিষয়ে পরবর্তী সিন্ধান্ত কাল হবে তা জানিয়ে দেওয়া হয়। একদিকে ইনায়ার গ্যাং এর মাঝে চলেছে অসমাপ্ত যুদ্ধের জল*ন্ত আ*গুন অন্যদিকে আজকের অসমাপ্ত ম্যাচের জন্য রোহানের প্রত্যেকটা বন্ধুই রে*গে আ*গুন হয়ে গিয়েছে। তবে রোহানের মাঝে কোনো হেলদোল নেই। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার নজর ছিলো ইনায়ার উপর। তার কাছে ইনায়া মেয়েটা একটা বিস্ময়কর বিষয় হিসেবে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটা অদ্ভুত! সত্যিই অদ্ভুত! এক অদ্ভুত সুন্দর!
____________________
আনায়া নিজের রুম থেকে বেড়িয়ে অফিসের আশপাশটা ধীরে ধীরে ঘুরে ঘুরে দেখছিলো। উদ্দেশ্য তার কারো সাথে বন্ধুত্ব তৈরি করে কথা গল্প আলাপের চেয়ে চেষ্টা হলেও নিজের রুম থেকে বের হওয়ার পর আর মনে হচ্ছে না এমন কিছু হবে আজ। আনায়া হতাশ হয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সবাই সবার কাজে প্রচন্ড ব্যস্থ। দুনিয়া উল্টে গেলেও তাদের কাজ ছাড়া যাবে না।
তার সাথে কথা বলার বিন্দু পরিমাণ সময় কারো হবে কিনা সন্দেহ আছে।
আনায়া মনে মনে কয়েকবার রেহানের কথা ভাবলো। একটু আগে ইমোনের কাছ থেকে খবর নিয়েছে যে ইমন আগের থেকে অনেকটা সুস্থ। আশা করা যায় খুব তাড়াতাড়িই ও সুস্থ হয়ে যাবে।খবরটা শোনা মাত্রই সে যতটা খুশি হয়ে ছিলো এখন ঠিক ততটাই মন খারাপ হচ্ছে এমন একটা পরিবেশে এসে সে পড়ে গিয়েছে ভেবে। তবে মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিলো, ”
“ফ্যামিলির জন্য জীবনে আরো অনেক বেশি স্যাক্রিফাইস করতে হবে সেখানে এ আর এমন কি! নিজেকে মানিয়ে নে আনায়া।”
মনে মনে কথাটুকু বলে আনায়া মুচকি হেসে নিজের কেবিনে ফিরে যেতে চাইলেই পেছন থেকে একটা পুরুষ নালী কন্ঠঃস্বর ভেসে এলো।
—“মিস আনায়া!
আনায়া পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখলো একটা সুদর্শন পুরুষের পাশাপাশি তার চেয়ে হয়তো কিছুটা বয়সে বড় একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে রইছে। দু’জনের হাতেই ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ। ছেলেটির মুখে মুচকি হাসি থাকতেও মেয়েটা কেমন গম্ভীর চোখে আনায়াকে দেখছে না।
আনায়া মুচকি হেসে ছেলেটির উদ্দেশ্য বললো,
—“জ্বি! আপনি? ”
—“যাক ভুল বলিনি! আমি আয়াশ আর ও রুহি!আ……তুমি কফি নিবে, তোমার জন্যই এনেছি! ”
হুট করে আনায়াকে ছেলেটি তুমি বলায় আনায়া কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেও বিষয়টিকে স্বাভাবিক ভেবেই আনায়া কফির কাপটা হাতে নিলো। এরই মাঝে আয়াশ আবারও বলতে লাগলো,
—“বয়সে ছোট হবে তাি তুমিই বললাম, কিছু মনে করো না। তবে এই বয়সে ভিকে স্যারের পি.এ. হয়েছো, সত্যিই কংগ্রাচুলেশনস! ”
—“থ্যাংইউ! ”
আনায়া মুচকি হেসে কথা শেষ করার সাথে সাথেই কফি খেতে থাকা রুহি প্রচন্ড তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
—“যোগ্যতায় তো আর হতো পারেনি! নিশ্চয় ইমন ভাই-ই কোনো ব্যবস্থা করে ওকে এই পজিশনে বসিয়েছে। যোগ্য জায়গায় অযোগ্য লোক। ”
রুহি এমন কথা শুনে আনায়া কিছুটা অবাক হলো। অপরিচিত ব্যাক্তির মুখে এমন কথা তো মানায় না। এই মেয়েটাকে তার প্রথমেই মনে হয়েছিলো মেয়েটা একটু অদ্ভুত। তবে তার সাথে এমন বিহেভ করার মানে কি!
আসলে ভিকের পি.এ. যে আনায়া হয়েছে এটা শোনার পর থেকেই তার আনায়াকে সহ্য হচ্ছে না। সে আনায়ার পূর্ব পরিচিত নয় তবে ভিকের পি.এ. হওয়ার তীব্র ইচ্ছে রুহির ছিলো। ভিকের প্রতি অন্যান্য মেয়ের প্রতি রুহিরও যথেষ্ট ফিলিংস্ কাজ করে এমনকি তার ভিকে কে নিয়ে পাগলামি করতে গিয়ে স্বয়ং ভিকেট কাছ থেকে একবার ওয়ার্নিং-ও পেয়েছে সে।
অন্য দিকে আনায়ার প্রতি রাগের আরেকটা কারণ হলো এতোদিন পর্যন্ত ভিকের সব পি.এ. ছেলেরা হলেও এই প্রথম কোনো মেয়ে আনায়ার পি.এ. হয়েছে তাও আবার রুহির চিন্তা মতে আনায়ার মতো একজন এই বিষয়ে স্কিললেস মেয়ে। এটা নিশ্চয় তার কাছে সহজে মেনে নেওয়ার মতো কিছু নয়।
তবে তার পছন্দ করা কিংবা ফিলিংস্ টা একপাক্ষিক নয় বরং যে কোনো সুদর্শনের প্রতিই তার মন আঁটকে যায়। যেমন এই মূহুর্তে আয়াশের আনায়ার সাথে কথা বলা কোনো কিছুই তার পছন্দ হচ্ছে না।
অন্যদিকে রুহির স্বভাব সম্পের্ক আয়াশও জানে এমনকি স্টুডিওর কম বেশি প্রত্যেকই জানে রুহি কোন স্বভাবের মেয়ে। তাই বিষয়টি ঘুরিয়ে দিতেই আয়াশ আনায়ার সাথে নানা বিষয়ে গল্প আলাপ করতে লাগলো। আনায়ার কাছেও বিষয়টি ভালো লাগলো। সাথে আয়াশকেও তার যথেষ্ট ফ্রেন্ডলি আর ভদ্র মনে হলো।
এরই মাঝে চুপচাপ কফি খেতে খেতে রুহি এক শয়তানি করতে গিয়ে তাতে নিজেই পড়ে গেলো। দু’জনের গল্প আলাপ তার সহ্য হচ্ছিলো না বিধায় এখানে থাকাটাও সে অহেতুক মনে করছিলো। তাই যাওয়ার আগে ভুল বশত আনায়াকে ল্যাং করে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করতেই ভুলবশত আনায়া পড়ে না গিয়ে আনায়ার হাতের আধাখানা কফিটুকু রুহির জামার একপাশে পড়ে যায়।
কফি ততটা গরম ছিলো না তবে ড্রেস নষ্ট হয়ে যাওয়ায় রুহি অনেক বেশি রেগে যায়। সাথে পরিস্থিতিও নেয় এক ভিন্ন রুপ। অন্যদিকে আনায়া বুঝতেই পারলো না তার সাথে এই মূহুর্তে হলো টা কি!
রুহি চোখ গরম করে রেগেমেগে আনায়াকে বললো,
—” হোয়াট দ্যা হেল! এই মেয়ে চোখে দেখো না! চোখ অন্ধ নাকি? এটা কি করতে তুমি! ”
আনায়া বুঝতে পারছে না সে কি বলবে। সে তো প্রথম থেকেই এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে ছিলো উল্টো তো এই রুহি তাকে ধাক্কা দিয়েছে এমনটাই মনে হলো। আনায়ার কিছু বলছে না দেখে রুহি আবারও কিছু বলতে গেলে পাশ থেকে আয়াশ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলো,
—“চুপ থাক রুহি! এটা যাস্ট একটা এক্সিডেন্ট। ও তোকে ইচ্ছে করে মারতে যাবে নাকি। বিষয়টিকে নিয়ে আর সিন ক্রিয়েট করিস না। ”
আয়াশের কথা শুনে রুহি আরো বেশি রেগে গিয়ে বলতে লাগলো,
—“আমি সিন ক্রিয়েট করছি!… আমি! শোন আয়াশ! তোদের অলওয়েজ মনে হয় সব দোষ আমারই। আর কারো দোষ থাকতেই পারে না। আর তা নাহলে, এখন আমার সাইট না নিয়ে এই দুইদিনের এই অসভ্য মেয়েটার সাইট নিচ্ছিস।”
আয়াশ অবাক হচ্ছে রুহির পাগলামো দেখে। কি পরিস্থিতিটাকে ও কি বানিয়ে ফেলছে। রুহির কন্ঠ স্বর সামান্য উচ্চ থাকলেও তা আশপাশের লোকজন জড় করার মতো না। আর আয়াশ ধীরে ধীরেই কথা বলছে।
—“রুহি তুই এসব কি শুরু করলি! ”
রুহি আর এবার আয়াশকে রেখে আনায়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কিছু বাজে কথা বলার প্রস্তুতি নিলো।
—“এই মেয়ে সত্যি করে বল তো! তুমি কাজটা ইচ্ছে করে করেছো তাই না! করবেই তো, কিসব কমনসেন্স ছাড়া রাস্তার লোকজন এসে স্টুডিওতে জুটেছে। তোমার কাজকর্ম নিয়েও তো তোমার বিন্দু পরিমাণ ধারনা নেই তাই না! এই অফিসের জন্য সম্পূর্ণ ইউজলেস তুমি। তোমার লজ্জা থাকলে তো এই মূহুর্তেই এই জব ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু তুমি তো তা করবে না। তোমার ফ্যামিলি তো তোমাকে সেই শিক্ষাটাই দেয়নি। নিশ্চয় বাবা-মায়ে সঠিক শিক্ষা……
রুহির কথা শুরু হতেই আনায়ার কপালে ক্রমান্বয়ে ভাজ পড়তে থাকলো। প্রথমে ভেবেছিলো কিছুই বলবে না কিন্তু যখন ফ্যামিলি, বাবা মা নিয়ে কথা বলতে লাগলো তখন আর আনায়া চুপ রইলো না। খানিকটা ঝাঁঝালো মিশ্রিত স্বাভাবিক কন্ঠই বলতে লাগলো,
—“দেখুন মিস রুহি! আপনার সাথে আমার পারসোনাল কোনো সম্পর্ক নেই, রাইট! তাহলে আমি কেনো আপানার সাথে এমনটা করতে যাবো। আর প্লিজ এভাবে বাবা মা ফ্যামিলি নিয়ে কথা বলবেনা না, এতে আমার নয় বরং আপনার সঠিক পরিচয়টি প্রকাশ পাচ্ছে। আশা করি বুঝতে পেরেছেন। আর আমার মনে হয় আপনি চলে যাওয়ার সময় হয়তো বেখেয়ালিতে আমায় ধাক্কা মেরেছেন আর ভুলবশত আমার হাত থেকে কফি টুকু আপনার গায়ে লেগে গিয়েছে। এজন্য আপনি চাইলে সরি বলতেই পারি। আ’ম রিয়েলি সরি! ”
—“দেখেছিস আয়াশ, দেখেছিস। ও এখন বলতে চাইছে ধাক্কা আমি মেরেছি। ইচ্ছে তো করছে একটা কষিয়ে থাপ্প*ড়……
রুহির কথা শেষ হওয়ার আগেই পাশ থেকে এবার ধমকের সুরে ভারিক্কি কন্ঠ আয়াশ বললো,
—“রুহি যাস্ট শার্ট আপ! অনেক হয়েছে। তুই ভুলে যাস না আনায়া বর্তমানে ভিকের পি.এ.। আর তুই এটা কেনো ভুলে যাচ্ছিস তুই এই মূহুর্তে কোথায় আছিস। এই জায়গায় এসব লেইম সিন ক্রিয়েট করে নিজের বিপদ ডেকে আনতে চাচ্ছিস নাকি। ভিকে স্যার যদি……
আয়াশ আর নিজের কথাটুকু সম্পূর্ণ করতে পারলো না। তার আগেই তার চোখ পড় কিছুটা দূর থেকে তাদের দিকে আগমনরত ভিকের দিকে। আয়াশ বিস্মিত কন্ঠ নিন্মস্বরে রুহিকে বললো,
—“রুহি! ভিকে…..”
আয়াশের কথা শুনে রুহি আর আনায়া দুজনেই পিছনে তাকালো। রুহি ভুত দেখার মতো চমকে উঠে নিমিষেই আয়াশকে ঘেঁষে ওর পাশে দাঁড়িয়ে পড়লো আর আনায়া তার ভ্রু কুঁচকে একবার ভিকে কে তো একবার রুহি কে দেখতে দেখলো।
রুহি আর আয়াশ ভেবেছিলো আজই হয়তো রুহির কাহিনি শেষ হয়ে যাবে কিন্তু পরিশেষে এমন কিছুই হলো না। ভিকে যেই পশ স্টাইলে এ্যাটিটউট নিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসছিলো ঠিক সেভাবেই তাদের পাশ কাটিয়ে সামনের দিকে চলে গেলো। একবার ভুলেও দেখলো না তার পাশে তিনতিনটে মানুষ আদোও আছে কিনা। এবারের মতো বেঁচে গিয়েছে ভেবে রুহি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সেই জায়গা ত্যাগ করতেই আয়াশ আনায়ার উদ্দেশ্যে বললো,
—“আনায়া ওর এসব পাগলামো প্লিজ মাথায় নিও না। ও দিন দিন পুরো পাগল হয়ে যাচ্ছে। ”
এছাড়া সৌজন্যে মূলক আরো কিছু কৈফিয়ত আনায়াকে শোনাতে লাগলো। আনায়াও আর বিষয়টিকে মাথায় রাখলো না। কাজে এসেছে আর ছোট খাটো এমন ঘটনা ঘটবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু এতে মন খারাপ করে নিজের মুড নষ্ট করার কি দরকার।
____________________________
গভীর রাত! বিশাল বড় টিভি স্কিনে আঁটকে রইছে একজোড়া চোখ। সোফার উপর পায়ে পা তুলে কিছুক্ষণ পরপর আয়েশি ভঙ্গিতে মুখ হা করে তাতে পপকর্ন ছুড়ছে কেনীথ। মনে হচ্ছে খুব চমৎকার কোনো মুভি চলছে তার টিভির পর্দায়। সাথে আজ তার মনমেজাজও যেন একদম ফুরফুরে। এমন মূহুর্ত অবশ্য কেনীথের মাঝে কিছু বিশেষ সময়েই দেখা মেলে। আজও হয়তো তেমনই কিছু!
তবে অদ্ভুত বিষয় হলো টিভির পর্দায় কোনো চমৎকার মুভির প্রদর্শন হচ্ছে না বরং তাতে একজন সুশ্রী মহিলা সাংবাদিক সংবাদ পাঠ করতে ব্যস্থ। আচ্ছা কেনীথ কি সেই সুশ্রী মেয়েটিকে দেখছে! না… না…কেনীথ তো তেমন নয়। সে তো মেয়েটির মুখ থেকে সংবাদ পাঠ শুনতেই আগ্রহী।
টিভির সেই সুশ্রী মেয়েটি চিন্তিত ভঙ্গিতে বলছে দেশের এক বিখ্যাত নামীদামী শিল্পপতির নিখোঁজের খবর। গত মাসেই নাকি তিনি নিজ কাজের উদ্দেশ্যে দেশের বাহিরে গিয়েছিলেন। লোকটির পরিবারের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি এখনো দেশে ফেরেনি অথচ খবর মিলেছে তিনি গত চারদিন আগেই দেশে এসেছেন অথচ চিরুনী চালনি দিয়েও তার খোঁজ মিলছে না। তিনি এখন উধাও। দেশের মানুষের কাছে তিনি অনেক ভদ্র আর সৎ লোক হিসেবে পরিচত হলেও এবার মিলেছে ভিন্ন তথ্য।
ধারনা করা হচ্ছে তিনি চারদিন আগে যখন দেশে ফিরেছে ঠিক সেই রাতেই তাকে গায়েব করা হয়েচে শহরের দূরের এক জঙ্গলের পথ থেকে। তার লাইসেন্স করা গাড়িটা সেখানেই পাওয়া গিয়েছে সাথে তার প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস পত্র আর বিদেশ ফেরত জামাকাপড়ের ব্যাগ।
তবে এসবের মাঝে সবচেয়ে গূরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এসবের পাশাপাশি একটা ছোট কালো সুটকেস পাওয়া গিয়েছে। যাতে সাদ্দাম শেখ নামক সেই বিজনেস ম্যানের সারাজীবনের সকল কূটনৈতিক কাজের প্রমাণ খুব সুন্দর সজ্জিত ভাবে রেখে দেওয়া হয়েছে। তার করা ন্যাশনাল কিংবা ইন্টারন্যাশনাল সকল অনৈতিক কাজকর্ম সাথে ড্রাগস্ ও অ*স্ত্র চোরাচালানের পাশাপাশি নারী ব্যবসারও স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। প্রত্যেকের ধারণা বলতে গিয়েছে এসব দেখে। তারা ভাবতেও পারছে না তার মতো লোক বহু বছর ধরে এসব কাজ করে যাচ্ছে।
তবে তার গায়েব হওয়ার পেছনে এটা তো নিশ্চিত যে কোনো সুকৌশল সম্পন্ন তারই কোনো শ*ত্রু এই কাজ করেছে। কারণ সুটকেস থেকে শুরু করে তার গাড়ির আশেপাশে কিংবা সম্পূর্ণ জায়গাতেই আগুন্তকঃ এর খোঁজ মিলবে এমন কোনো প্রমান পাওয়া যায় নি। এছাড়া ঘটনাটি যে জায়গায় হয়েছে তা সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত আর জঙ্গল এরিয়ার রাস্তায়। ওমন জায়গায় ওতো রাতে সাদ্দাম শেখ কোন কাজে গিয়েছিলো তা তো জানা যায়নি তবে আগুন্তকঃ এর দেখা মিলবে এমন কোনো সিসিটিভি কিংবা লোক সমাজের অস্তিত্ব সে জায়গায় নেই।
সুটকেস কিংবা গাড়ির কোনো অংশে সাদ্দাম ব্যাতীত পাওয়া যায়নি অন্য কোনো আগুন্তকঃ এর ফিঙ্গার প্রিন্ট। কাঁচা রাস্তায় নেই কোনো গাড়ির টায়ারের ছাপ। আর ছিলো কিনা তাও বোঝা যাচ্ছে না কেনো রাস্তা মাঝে একে রাখা হয়েছে নানা রকমের চিত্র কর্ম। এছাড়া কাজটি একজন নাকি বহু জনে করেছে তা বলাও মুশকিল। পুলিশের মাথা ঘুরপাক খাচ্ছে এই কেসের সমাধান করতে। কারণ পুলিশের কাছে কিছুদিন পরপর দেশের নামি-দামি ব্যাক্তিগণের নিখোঁজ হওয়া আর তাঁদের অনৈতিক কাজকর্মের প্রমাণ একটা কালো রংএর সুটকেসে রেখে যাওয়া কোনো নতুন কিছু না। কিছুদিন পরপরই এই ঘটনা ঘটছে অথচ পুলিশ কিছুই করতে পারছে না। আগুন্তকঃ এর খোঁজ ফিলবে এমন কোনো ক্লু না পেয়ে বরাবরের মতো তারা আবারও হতাশ।
শুধু ক্লু হিসেবে আগুন্তকঃ ফেলে যাচ্ছে তার একটা জিনিস তা হলো সেই সুটকেস যেটাও কিনা কোনো ব্র্যান্ড ছাড়া একটি প্রডাক্ট।
সর্বশেষে সম্পূর্ণ সংবাদ পাঠ শেষ হলে কেনীথ উঠে দাঁড়ালো। এরপর এগোতে লাগলো তার বিশাল বড় বাড়ির একপাশের দেওয়ালের দিকে। দেওয়ালের সাথে লাগানো না রকমের ইউনিক আর এক্সপেন্সিভ শোপিস আর ইউনিক কিছু ওয়ালমেটে। তবে দেওয়ালের একপাশটাকে দেখে মনে হচ্ছে জায়গাটায় বেশি সময় পার হয়নি নতুন করে রং করা হয়েছে। শুধু রং নয় বরং মনে হচ্ছে খুব নিখুঁত করে প্লাস্টার করে তাতে সুন্দর করে রংএর প্রলেপ দেওয়া হয়েচে। কেনীথের পরনে শুধু একটি কালো টাউজার। বিস্তৃত খালি বুক। সাথে চুলগুলো ঘাড় পর্যন্ত এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। মুখের কোণায় বাঁকা হাসি। কিছুক্ষণ দেওয়ার সেই পাশটার দিকে তাকিয়ে থাকার পর তার বাঁকা হাসি খানা আরো অনেকটা বিস্তৃত হলো। আর পরক্ষণেই হুট করেই কেনীথ হালকা করে দেওয়ালের সাথে ঠোঁট লাগিয়ে চুম্বুন করে সেই জায়গা প্রস্থান করলো।
কেনীথের বিলাসবহুল বাড়ি খানা শহরের কোনো নামি-দামি ভিআইপি এরিয়ায় নয় যেমনটা তর স্টুডিও। ভিকের বাড়ি আসলে কোথায় তা কেউ জানে না। শহরের একটা নামি-দামি ভিআইপি ফ্ল্যাট তার নামে রয়েছে আর সবাই জানে সে সেখানেই হয়তো তাকে। তার এই বাড়ির খবর তার ইন্ডাস্ট্রির বড় মাপের লোকজন জানলেও এই বাড়িতে আসার সাহস কেউ করবে না। তারা সবাই জানে এই বাড়িটি কেনীথের হলেও এখানে সে কিংবা কেউ থাকে না আর এখানকার এক বড় শক্তিশালী ক্ষমতার জন্য এই বাড়িতে ভিন্ন কারো আসার কোনো ক্ষমতা কিংবা পারমিশন নেই।
বাড়িটি শহর থেকে অনেকটা দূরে এক নির্জন এলাকায় অবস্থিত। বাড়ির আশপাশে লোকজনের চলাচল খুবই ক্ষীণ। কেনীথের বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে দূরে জনবসতির আস্তানা। খুব প্রয়োজন ছাড়া কেনীথের বাড়ির রাস্তায় কেউ আসা-যাওয়া করে না। তবে বাড়িটা প্রত্যেকেরই কাছে খুবই আকর্ষণীয়। দেখতে অসাধারণ আধুনিক কারুকার্যে ঘেরা। এমন জায়গায় বিশাল বড় এড়িয়া এমন বাড়ি সত্যিই দূর্লভ। তবে এই এতো বাড়িটার দেখাশোনার জন্য নেই কোনো গার্ড। সম্পূর্ণ বাড়ির উঁচু প্রাচীর গুলোতে ব্যবস্থা করা হয়েছে ইলেকট্রিক শক্ এর।
এমনিতেই সাধারণ প্রাচীরের চেয়ে এই বাড়ির প্রাচীর তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি উঁচু। আর কেউ কষ্ট করে যদি এই প্রাচীর টপকে বাড়ির ভেতরে যাওয়ার চিন্তা করে তবে তা আর সম্ভব হবে না। তার আগেই ইলেকট্রিক শক্ খেয়ে আধমরা হয়ে নিচে পড়ে রইবে।
এমনিতেও এই উঁচু প্রাচীরেরে দরূনে বাহির থেকে লোকজন বাড়ির উঁচু মাথা টুকু ছাড়া কখনোই কিছু দেখতে পারেনি। বাড়ির ভেতরে কি রয়েছে তা দেখার সৌভাগ্য মনে হয় কেনীথ বাদে আর কারোরই নেই। আর এই বাড়িতে কখন কি ঘটে তার খবরও সকলের কাছে অজানা।
কেনীথ নিজের বাড়ির এক বিশেষ স্থানের দিকে এগোতে লাগলো। সে যতই সামনের দিকে এগোচ্ছে ততই অন্তত ভয়ংকর আর হিং*স্র কন্ঠ স্বর ভেসে আসছে। একটা সময় পর কেনীথ বিশেষ স্থানে পৌঁছাতেই দুটো হিং*স্র কুকুর তার দিকে এগিয়ে এলো। তাদের হাতে পাশে মোটামোটা লোহার শিকল বাঁধা। দেখতেও দানব আকৃতির বিশাল বড় বড়। সাথে প্রচন্ড ক্ষুদার্থও।
কেনীথে ওদেরকে দেখে মুচকি হাসলো। এই কুকুর দুটো দেশীয় কোনো কুকুর নয়। কেনীথ বিদেশ থেকে এই দুজনকে নিয়ে এসেছে প্রায় কয়েক বছর হলো। তখন থেকেই এরা দুজন কেনীথের কুক*র্মের সঙ্গি। কেনীথ হেসে বলতে লাগলো,
—“ক্ষিদে পেয়েছে! ওয়েট কর, খাবার এখনই নিয়ে আসছি। ”
এই বলেই কেনীথ পাশেই রান্নাঘরে চলে গেলো। দুটো বিশাল ফ্রিজের মাঝ থেকে একটি ফ্রিজ খুলে সেখান থেকে খানিকটা মাংস বের করলো। এরপর সেগুলোকে স্টেক রাখার মতো খুব যত্ন সহকারে রেখে সেগুলো কুকুর দুটোর সামনে খেতে দিলো। মূহুর্তেই হিং*স্র জানোয়ারের মতো খাবারে উপর দুমড়ে পড়লো কুকুর দুটো।
আর কেনীথ আয়েশি ভঙ্গিতে রকিং চেয়ারে বসে ওদের খাওয়া দেখতে দেখতেই কুকুর দুটোর উদ্দেশ্যে বাকাঁ হেসে বললো,
—“আরেকটু কষ্ট কর! খুব তাড়াতাড়ি নতুন শিকার আসছে। একদম কচি ফ্রেস মাংস! ”
#চলবে