একজোড়া আগুন পাখি পর্ব-১১+১২

0
28

#একজোড়া_আগুন_পাখি
®অরনীতা তুশ্মি (#তুশকন্যা)

পর্ব→১১

চারপাশে যখন ঘুটঘুটে অন্ধকার তখন সেই রহস্যময় মানবের উদ্ভট এক কথা শুনে আনায়া পুরো থ!
কেনীথের কথাটা আনায়ার কাছে উদ্ভটই লেগেছে। সামান্য একটা বিষয়ে এই ধরনের ভাষা ব্যবহার করা কি খুব দরকার। এমনটা মনে হওয়ারও অবশ্য কারণ আছে, আনায়ার ছোট খাটো বিষয়ে স্ল্যাং ইউজ করাটা মোটেও পছন্দ নয়। কিন্তু বর্তমানে এসব নিয়ে ভাবার পরিস্থিতি গড়ে ওঠেনি।

আনায়া গাড়ি থেকে নেমেই বুঝতে পারলো সে কোনো বড় পাহাড়ের সড়কের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার জানা মতে কনসার্ট শহরে হওয়ার কথা তবে এইখানে আসার কারণটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।
এরপর যখন কেনীথের আওয়াজ অনুসরণ করে তার দিকে তাকালো, তখন আরেকটু আঁ*তকে উঠলো। এই লোকটাকে তার মন প্রাণ থেকে পাগল মনে হয়। রাস্তার এক শেষ প্রান্তের একদম কিনারায় সটানভাবে প্যান্টের পকেটে হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো কেনীথ। আনায়া গাড়ি থেকে বের হয়েছে তা বুঝতেই ঘাড় বেঁকিয়ে উল্টো ঘুরেছে। আশেপাশে বাতাসের যে তীব্র খেলা শুরু হয়েছে তাতে যদি ভুলেও নিজের ব্যালেন্স হারায় তো সোজা নিচে।

কতফুট উঁচুতে এই রাস্তা তা আনায়ার ধারনা না থাকলেও এতোটুকু আন্দাজ করা যায় যে এখান থেকে একবার কেউ নিচে পড়ে গেলে তার নাম নিশানও হয়তো কেউ খুঁজে পাবে না। একদিকে কেনীথকে ওতো কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এসব উল্টোপাল্টা চিন্তা করতেই আনায়ার গলা শুকিয়ে গেলো। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিশ্বাস নেওয়াও কিছুক্ষণ বন্ধ করে দিলো।

এরই মাঝে কেনীথ বড় বড় পা ফেলে আনায়ার ঠিক মুখ বরাবর এসে দাঁড়ালো। আনায়ার ফোনটা এমন ভাবে ধরা যে নিচ থেকে ফোনের ফ্ল্যাশ লাইটের আলোর প্রতিফলনে কেনীথের শান্তশিষ্ট গম্ভীর চেহারাটাও ভয়ং/কর সুদর্শন কোনো দা*নব মনে হচ্ছে। বেচারী আনায়া এখনো নিজের নিশ্বাস আঁটকে কেনীথের মুখের দিকে ভীতু চোখে তাকিয়ে রয়েছে।

এদিকে কেনীথ কিছুক্ষণ আনায়ার দিকে একনজরে তাকিয়ে থাকার পর নির্বিকার বললো,

—“নিশ্বাস নে গাধী! ”

কথাটা বলেই কেনীথ এক হাত প্যান্টের পকেট থেকে বের করে কালো চশমাটা পড়তে পড়তেই, বড়বড় পা ফেলে গাড়িতে গিয়ে বসলো।

এদিকে আনায়ার মস্তিষ্কে কেনীথের কথাটুকু বোধগম্য হতেই আনায়া ত্বরিত আঁটকে রাখা দম ছেড়ে স্বাভাবিক ভাবে নিশ্বাস নিতে লাগলো। এরপর কয়েকবার চোখের পাপড়ি ঝাপটিয়ে আশেপাশে তাকাতেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে আর বেশিক্ষণ একা থাকার সাহস জুটলো না।দ্রুত গতিতে গিয়ে গাড়িতে বসলো।

অন্যদিকে কেনীথ আনায়ার গাড়িতে বসার সাথে সাথেই একমুহূর্তও দেরী না করে ত্বরিত গাড়ি স্টার্ট দিলো। প্রথমদিকে সেই প্রথম বারের মতোই স্পিডে গাড়ি চালাতে লাগলো। এদিকে আনায়া মনে মনে নানান বিষয়ে ভাবছে। একদিকে তো এখানে কেনো এসেছে,এটা কোন রাস্তা, এমন ঘুটঘুটে অন্ধকার কেনো, কোনো জনবসতি কিংবা অন্যান্য গাড়ির চলাচল আবার লাইটের ব্যবস্থা নেই কেনো আর কনসার্ট স্পটে পৌঁছাতে কতক্ষণ লাগবে ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে জানার ইচ্ছে থাকলেও এতোকিছুর উত্তর আদোও কেনীথ দেবে কিনা সেই বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে অন্যদিকে তার এতো প্রশ্ন শুনে তাকে এখানেই ফেলে যাবে না তারও বা গ্যারান্টি কি!

কিন্তু এসব ছাড়াও আনায়া যে বিষয়টি নিয়ে ভাবছে তা হলো কেনীথ তাকে গাধী বলে সম্মোধন করেছে । আনায়া বুঝে উঠতে পারছে না একটা মানুষ সবাইকে তুই করে বলে তাই তাকেও বলেছে, এটা মানা যায় কিন্তু সরাসরি গাধী! কেমন অদ্ভুত না!

এই বিষয়টি নিয়ে আনায়া কিছুক্ষণ ভাবার পর মুচকি হাসলো। বিষয়টিকে সে নেগেটিভ ভাবে না নিয়ে পজিটিভ ভাবে চিন্তা ভাবনা শুরু করলো। মনে মনে ভাবতে লাগলো কেনীথ হয়তো তাকে বর্তমানে ছোট বোন হিসেবেই ট্রিট করছে।আবার মনে হচ্ছে তার হুস ফেরার পর এসির পাওয়ার যতটা বেশি ছিলো এখন ততটা নেই। হয়তো কেনীথ ভুলেই তখন বেশি পাওয়ার দিয়ে দিয়েছিলো।

কেনীথকে বড় ভাই হিসেবে ধরলে এসব নিয়ে এতো মাথা ঘামানোর কিছু নেই। ইমন আর কেনীথ দু’জনেই তো আনায়ার কাছে সমান, তবে এতো ভাবনারই বা কি আছে! লোকটা এমনিতে অদ্ভুত হলেও বড় ভাই হিসেবে মন্দ নয়।

যদি এমনটা হয়, তবে আনায়া আর রেহানের বিয়েতে যদি তাকে ইনভাইট করা হয় তবে হয়তো কেনীথ না করবে না। ছোট বোনের বিয়ে ভেবে, আসলে আসতেও পারে। আনায়া ভাবতে ভাবতে যে তার চিন্তা ভাবনা কতদূর চলে গিয়েছে, তা নিয়ে হয়তো তার নিজেরেও কোনো হুস নেই। কিন্তু তার এই চিন্তার ভাবনা কেটে গেলো কেনীথের পরবর্তী কার্যক্রমে।

এবার কেনীথ এতো দ্রুত স্পিডে গাড়ি চালাতে লাগলো যে আনায়া আর নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারলো না। হঠাৎ এমন পরিবর্তনের মানে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো। মনে মনে ভাবলো কেনীথ আবার তার মনের কথা শুনে ফেলেছে নাকি। শুনতে পেলেও তাতে দোষ করার মতো কি আছে! আবার নিজের চিন্তা ভাবনা দেখে নিজেকেই গালাগালি করলো। সে মনে মনে কথা বললে সে কথা কেনীথ কি করে শুনতে পাবে!
আনায়া চোখ মুখ যতটা পারলো স্বাভাবিক রেখে ঠোঁট চেপে, দাঁত খিঁচে তার নিজের জামার একটা অংশ খাঁম/চে ধরলো। এবার মনে হচ্ছে কেনীথ গাড়ি চালাচ্ছে না বরং সত্যি সত্যি উড়াতে চলেছে। হঠাৎ এতো স্পিড বাড়িয়ে দেওয়ার কারণ আনায়া ঠিক বুঝতে পারলো না। কিছু বলে যে থামাবে সে পরিস্থিতি কিংবা সাহসও নেই।

_________________

স্টেজের সামনে দর্শকের উপচে পড়া ভিড় । সবার মাঝেই টানটান উত্তেজনার ঝলক। অন্ধকারে স্টেজের লাল-কালো স্পট, মুভিং হেড, স্ট্রোব, লেজার, পার লাইট সহ নানা ধরনের লাইট গুলো সমানতালে জ্বলে নিভে উঠছে। একদিকে গিটার, পিয়ানো, ড্রামের শূন্য অবস্থা অন্যদিকে কেনীথের তীব্র অপেক্ষায় হুইস্কার আর আনন্দ উল্লাসের আদান-প্রদানে উত্তে*জিত দর্শকগণ। সবমিলিয়ে সার্বজনীন উন্মাদনায় একটি তীব্র আকাঙ্ক্ষায় জেগে ওঠা কনসার্ট শুরুর প্রাক-আবহ তৈরি হয়েছে।

কনসার্ট স্টেজ থেকে কিছুটা কাছেই রাইজিং লাউঞ্জ/ লজে অর্থাৎ আর্টিস্ট রুমে বসে আরাম আয়েশ করতে ব্যস্থ কেনীথ। রুমের সোফায় একদম স্টেজ পপারেল স্টাইলে সেজেগুজে তৈরি। সোফায় বসে পায়ের উপর পা তুলে একহাত দিয়ে রুবিক্স কিউবের সেম কালারের স্লট মেলাতে ব্যস্থ।

আনায়া জানে না, কেনীথ এই রুবিক্স কিউবটা কোথায় পেলো কিন্তু অন্যান্য দিনের মতো যে ফোনের মাঝো ডুবে নেই তাই অনেক। কিন্তু সে শুরু রুমের মধ্যে ঘুরাঘুরি করছে আর একটু পর পর বাহিরে কনসার্ট স্টেজ আর লোকজনের দিকে উঁকি দিচ্ছে। কনসার্ট এর সময় সেই কখন হয়ে গিয়েছে অথচ এই কেনীথের মাঝো কোনো হেলদোলও। নির্বিকারে নিজের কাজে ব্যস্থ।

পরনে শুধু কালো আর লালের কম্বিনেশনের জ্যাকেট যার চেইন অর্ধেকটা খোলা রাখায় বলিষ্ঠ উদম বুকের অনেকটাই দৃশ্যমান। সাথে কালো রংএর স্কিনি ডেনিম আর জুতা। আর আনায়ার কথা অনুযায়ী তার চুলগুলো তেমনই যেমনটা সচারাচর দেখা যায়। সঙ্গে শুধু কালো রংএর সেই চিরচেনা একটা ব্রেসলেট।

তবে আনায়ার ড্রেসআপে কোনো পরিবর্তন নেই। সে যেভাবে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলো ঠিক সেভাবেই আছে। আনায়া আর কেনীথ কনসার্টএর নিদিষ্ট সময়সীমার অনেক আগেই চলে এসেছে। এখানে পৌঁছানোর পর অনেকেই আনায়াকে জিজ্ঞেস করেছে তারা এতো তাড়াতাড়ি পৌঁছালো কি করে। আনায়া সেভাবে কোনো উত্তর দিতে না পারলেও এতোটুকু বুঝেছে যে কেনীথ তাড়াতাড়ি পৌঁছানোট জন্য সেই পাহাড়ি রাস্তাটাই হয়তো বেছে নিয়েছে। এছাড়া তো আর কোনো কারণ থাকার কথা নয়।

কিন্তু বাহিরে মানুষের এতো আয়োজন উত্তেজনা আর কেনীথের প্রতি এতো তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকার পরও এই লোক কিভাবে এতো নিরদ্বিধায় বসে রইছে কে জানে। বিষয়টি আনায়ার মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। এর আগের বার যংন কনসার্টে এসেছিলো, সেইবারের মতো কি এবারও ওতো দেরী করবে। এমনিতেই মাঝ রাত, কেনীথ যত দেরী করবে কনসার্ট শেষ হতেও তো তত দেরী হবে । তার এতো হাসফাস করতে আর ভালো লাগছে না, আবার কেনীথকে যে কিছু বলবে সেই সাহসও হচ্ছে না। মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন খুব বিরক্ত করছে। সেটাই চিন্তায় ব্যস্থ যে এই লোকটার সাথে ইমন ভাই এতোদিন কাজ করার পরও এতো হাসিখুশি কি করে থাকতো। এ তো পুরো টেনশনের আস্তানা।

রুমের মধ্যে কিছুক্ষণ পায়চারি করার পর একবার বাহিরে উঁকি দিয়ে ধীরে ধীর কেনীথের কাছে গেলো এরপর স্বাভাবিক গলায় বলতে লাগলো,

—“ভাইয়া বলছিলাম….

আনায়া কথা শুরু করতে না করতেই কেনীথ ত্বরিত রুবিক্স কিউব ঘোরানো বন্ধ করে আনায়া দিয়ে আকস্মিক ভাবে তাকালো। হঠাৎ কেনীথের ওভাবে তাকানো দেখে আনায়া আকস্মিক চমকে উঠতেই মনে পড়লো এই মূহুর্তে সে কেনীথকে কি বলতে চেয়ে কি বলে ফেলেছে! ত্বরিত ঢোক গিলে ঠোঁট ভিজিয়ে বলতে লাগলো,

—“সরি! সরি স্যার!…. স্যার বলছিলাম যে কনসার্ট এর সময় তো হয়ে গিয়েছে। সবাই আপনার জন্য ওয়েট করছে, আপনি যাবেন না! ”

কেনীথ একই ভাবে আনায়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার মুখের ভঙ্গিমা দেখে কিছুই আন্দাজ করা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ একই ভাবে তাকিয়ে থাকার পর সে আবারও নিচের দিকে তাকিয়ে রুবিক্স কিউব ঘোরাতে লাগলো আর নির্বিকারে বললো,

—“যখন আমার মুড হবে তখন যাবো! ”

এটা শুনে আনায়া আবারও থ! এই লোকটাকে তার মাঝমাঝে…..না!না! বেশির ভাগ সময়ই তার সহ্য হয় না। যতসব উদ্ভট মন মর্জি।

আনায়া কেনীথের দিকে কিছুক্ষণ একনজরে তাকিয়ে ওর কার্যকলাপ দেখলো আর নিজের রাগগুলোর বহিঃপ্রকাশ ঘটার আগেই চাপা দিলো। যে রাগের যথার্থ কোনো ফল নেই সেই রাগের বহিঃপ্রকাশেরও কোনো মানে নেই। একটা সময় আনায়া সেখান থেকে সরে এসে দরজায় একবাহু হেলান দিয়ে বুকে হাত দুহাত গুজে বাহিরের মানুষের কার্যকলাপ দেখতে লাগলো।

এতো এতো মানুষের এতো সোরগোল আনায়ার ঠিক ভালো লাগছে না। তার মন পড়ে আছে রেহানের ভাবনায়। রেহানের সাথে সেই কখন থেকে কথাই হয়নি। এখন ফোন দিলে পাবে কি না কে জানে। আবার আশেপাশের যে পরিস্থিতি তাতে ঠিকভাবে কথাও বলা যাবে না।

এরই মাঝে হঠাৎ কেনীথ তার পাশ কাটিয়ে বাহিরে যাওয়ার সময় আনায়া হালকা চমকে গিয়ে পড়ে যেতে লাগলে ত্বরিত নিজেকে সামলে নেয়। অন্যদিকে কেনীথ কয়েক কদম এগিয়ে পিছন ফিরে আনায়ার দিকে তাকিয়ে বললো,

—“স্টেজের ওদিকে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। লজের আশেপাশেই থাকবি, আর ভেতরে হয়তো ফ্রুটস রাখা আছে। বসে বসে খেয়ে নিস সব, নাহলে অপুষ্টিকর রোগীর মতো উঠতে বসতে এভাবে উল্টে পড়বি! ”

কেনীথ কথাগুলো বলে চলে যেতে একমুহূর্তও দেরী না করলেও আনায়া ওর কথা শুনে পুরো তব্দা খেয়ে গেলো। একে তো সে নাকি ভিকের পিএ আবার বলছে সে নাকি স্টেজের আশেপাশেও না যায়। অন্যদিকে ওসব কি বললো। হালকা ব্যালেন্স হারিয়েছে দেখে এতো বড় অপমান।

বেচারী আনায়ার কষ্টে পুরো কান্না পাচ্ছে। সে যথেষ্ট খাওয়াদাওয়া করে। বড় ভাই বানিয়েছে দেখে এভাবে ঠেস মেরে কথা বলার কি ছিলো। কিন্তু সে করবেও বা কি! খালি মনে মনে ভাই মানলেই তো হবে না, কেনীথ যে তার বস এটাও তো মাথায় রাখতে হবে। এছাড়া তার মনের আক্ষেপ-দুঃখের মাঝে কেনীথ অলরেডি স্টেজে পৌঁছে গিয়েছে আর ওদিকে দর্শক যেন গলা কাঁ*টা মুরগীর মতো লাফাচ্ছে। আনায়া এই কথাটা অবশ্য নিজের রাগ ঝাড়তেই বলে ফেললো। আনায়া দর্শকদের উদ্দেশ্যে বিড়বিড় করে বললো,

—“আরে ছাগলের দল! ওটা মানুষ, কোনো মৎস্যপুরুষ না! এমন গলা কাঁ*টা মুরগীর মতো লাফানোর কি আছে? ”

_________________
সুরের ঝংকার বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। স্টেজের রংবেরঙের এর আলো ছরিয়ে চারপাশ মুখরিত। দর্শকের উত্তেজনা যেন ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে, কেনীথের প্রতি প্রত্যেকের প্রগাঢ় ভক্তি ভালোবাসার অনুভূতির রেশ ছড়িয়ে দিচ্ছে। গানের তালেতে সবাই একসাথে নাচছে, হাত তুলছে, শিশ বাজাচ্ছে আর প্রত্যেকে কেনীথের গিটারের সুর আর গানের মাদকতার এক অদ্ভুত অবস্থায় ডুবে যাচ্ছে। পুরো পরিবেশটাই এক বড়সড় অনুভূতির উৎসব, যেখানে সঙ্গীত, আলো আর মানুষের মিলনে সৃষ্টি হচ্ছে সঙ্গীতের এক নতুন জাদুর মেলা।

নিভা ছিল মনের আগুন……
কে দিলাই জ্বালাইয়ারে…..
ভ্রমর কইও গিয়া…

বরাবরের মতোই এবারও কেনীথ নিজের পছন্দের গান দিয়েই কনসার্ট শুরু করলো। এই গানটা আনায়ারও বেশ পছন্দ হওয়ায় সে দূর থেকেই গানটা মনের আনন্দে উপভোগ করলো। এরপর কেনীথ একে একে আরো কিছু গান গাইলো। দর্শনজনতাও প্রচন্ড উত্তেজনা আর আনন্দ সেসব গান উপভোগ করলো। কিন্তু সবার মাঝে একটা প্রশ্ন থেকেই গেলো এই কেনীথ আজ কোনো গন্ডগোল কিংবা এখনো মা*রামা*রি করেনি! এসবের সাথে তো প্রত্যেকই অভস্ত আর আজ এমনটা না হওয়ার প্রত্যকেই অবাক। সবাই ভাবছে আজ এমন কি হলো যার কারণে কেনীথের আজ এমন পরিবর্তন। তবে এতে কেউ আফসোস নয় বরং খুশিই হয়েছে। নাহলে এতো প্রতীক্ষার মতো কেনীথ স্টেজে এসেই কিছুক্ষণ না যেতেই এসব গন্ডগোল শুরু করে দেয়। এরপরের কাহিনি তো সবারই জানা। কিছুক্ষণ হাঙ্গামা হওয়ার পর কনসার্ট শেষ আর কেনীথের কনসার্ট অসম্পূর্ণই থেকে যায়। তবে এতো সুন্দর পরিবেশটা হয়তো বেশিক্ষণ স্থায়ী হওয়ার নয়।

কিছুক্ষণ আগে রেহান আনায়াকে ফোন করায় দুজনের বেশ প্রফুল্ল চিত্তেই একে অপরের সাথে ফোনে কথা বলে চলেছে। এর মাঝে রেহান আনায়াকে গান শুনতে স্টেজের কাছে যেতে বললে আনায়াও ধান্দাতেই স্টেজের অনেকটা কাছে চলে যায়। কিন্তু তার এদিকে ধ্যানও নেই যেই এই ভরা কনসার্টের মাঝে কয়েক জোড়া চোখ তার দিকে কু নজরে তাকিয়ে রইছে।

এই কয়েক জোড়া চোখ তো কেবল তাকিয়েছে তার দিকে কিন্তু এক জোড়া চোখ যে সেই কখন থেকে তাকে লক্ষ করে যাচ্ছে তা হয়তো আনায়ার ধারণারও বাহিরে।

আনায়া দেখতে শুনতে প্রচন্ড মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে। কথা কথায় মৃদু হাসিতে তার গালে ফুটে ওঠা ছোট বড় টোলের প্রেমে পড়বে না এমন লোক কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। ফিটফাট করে বাঁধা উঁচু খোঁপাটাও এলোমেলো হয়ে গিয়ে যেন তার মাধুর্যকে আরো বৃদ্ধি করেছে।

স্বাভাবিক ভাবেই এই পরিপূর্ণ মাধুর্যকে কোনো কু*চরিত্রবান লোকেরা সুদৃষ্টির সঙ্গে দেখবে না। তাদের কাছে এসব মানেই হলো এক তীব্র লালসার আস্তানা।

এমনিতেই পুরো এরিয়ার লাইটিং সিস্টেমটা গাঢ় লালের মধ্যে রাখা হয়েছে আর আনায়া যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখানে আলোও তেমনটা নাই বললে চলে।

অন্যদিকে কয়েকটা আনায়ার থেকে কিছুটা বয়সের বড় হবে এমন কয়েকজন ছেলে অনেকক্ষণ থেকে তাকে নিয়ে কু*রুচিপূর্ণ মন্তব্য করে যাচ্ছে। যেটা আনায়ার চোখে না পড়লেও কেনীথের নজর এড়িয়ে যায়নি। গান গাইতে গাইতে কিছুক্ষণ সেসব স্বাভাবিক ভাবে সহ্য করলেও যখন লোকগুলো আনায়ার দিকে এগোতে লাগলো তখনই কেনীথ আর স্বাভাবিক থাকতে পারলো না।
———–
———–
Cross my heart and hope to die
Welcome to my darkside
Ooh, to my da-da-darkside
Ooh, to my da-da-dark…side…….

কেনীথ ডার্ক সাইড গানটা গাইছিলো। আশেপাশে তার সুরের প্রতিধ্বনি সবাইকে বিমোহিত করছিলো আর এক ভীতিকর পরিবেশ বিরাজ করছিলো।
কিন্তু একটা সময় পর তার সহ্যের ক্ষমতা ভেঙ্গে গেলে তার সামনে থাকা স্টান্ড মাইক্রোফোনটা শক্ত করে ধরলো পাশাপাশি গায়ে ঝুলিয়ে রাখা গিটারের মাথার কাছে শক্ত করে চেপে ধরলো। ধীরে ধীরে তার কন্ঠস্বরও কঠোর হতে লাগলো। এদিকে দর্শক জনতা কেনীথের হঠাৎ এই পরিবর্তনের কারণ ঠিকভাবে বুঝে ওঠার আগেই কেনীথের গান থেমে গেলো আর সে আকস্মিক গিটারটা খুলে ফেলে ফ্লোরে আঁচ*ড়ে ফেললো।

হঠাৎ সব কিছু থমকে যাওয়ায় প্রত্যেকের মতোই আনায়াও বিস্মিত হয়ে নিজের ফোনে কথা বলা স্টপ করে দিলো। এদিকে সবার মধ্যেই পিনপতন নিরবতা। হঠাৎ এমন আবার কি হলো আর এই মূহুর্তে কেনীথই বা কার সাথে কি করতে চাইছে।

সবার মতই সেই ছেলেগুলোও হয়তো বুঝতে পারলো না তাদের সাথে কি হতে চলেছে। কেনীথ এক লাফে স্টেজ থেকে নেমের সোজা তাদের কাছে এলো আর তারা কিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই কেনীথ নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ছেলেগুলোকে মা*রতে লাগলো।যদিও একটা মানুষের পক্ষে ৪-৫ টা ছেলেকে একসাথে মা/রা অসম্ভব প্রায় হলেও কেনীথের জন্য এটি তেমন অস্বাভাবিক কিছু নয়।

একটা ছেলেকে মে*রে নাক মুখ ফাটিয়ে দেওয়ায় সে এখন মাটিতে শুয়ে কাটাচ্ছে। আরেকজন আবার উল্টো করে শুইয়ে মাটিতে আর তার ঘারের কাছে পায়ের সর্বোচ্চ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে কেনীথ। শক্ত বুট জুতোই ছেলেটার জান যায় অবস্থা।
তাকে আধমরা বানিয়ে ছেড়ে দিয়েই অন্যদিকে আরেকটা ছেলেকে শুইয়ে দিয়ে তার পা দিয়ে ছেলটার উরুতে চেপে ধরে আছে। আপাতত তার হাত দিয়ে যে ছেলেটার কলার চেপে রেখছে তাকে যথাযথ উত্তম-মধ্যমও দেওয়ার পর বাকি দুটোকে দিবে।

শুধু মাত্র একটা ছেলেই পেছনে থাকায় সে ভীরের মধ্যে লুকিয়ে গিয়েছে কিন্তু বাকি চারজন এখন মা*রের উত্তম-মধ্যম জ্ঞান লাভ করছে বিখ্যাত রকস্টার নামক ম*নস্টার কেনীথের থেকে।

আনায়া গলা শুকিয়ে আসছে। চারপাশে এতো র*ক্তের ছড়াছড়ি তার সহ্য হচ্ছে না। সে বারবার বিস্মিত হচ্ছে আশেপাশের এতো এতো দর্শককে দেখে। কেউই কেনীথকে আটকাচ্ছে না, যে যার মতো বিষয়টিকে নিজেদের ক্যামেরা বন্দী করছে নয়তো দেখে মনে হচ্ছে উপভোগ করছে।আর এই কেনীথকে তো মনে হচ্ছে লোকগুলোকে একদম জানে মে*রে সে শান্ত হবে। চোখ মুখ লাল,পূর্ণ লাল চোখের মণি সহ পুরো চোখ দুটোও এখন পূর্ণাঙ্গ লাল হয়ে গিয়েছে। হাতের মাসেলস্ গুলো অতি*রিক্ত রাগের দরূন প্রচন্ড রকম ফুলে উঠছে।

আনায়ার আর সহ্য হলো না এসব আর সবার মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখার। কিন্তু কি করবে তাও তো বুঝে উঠতে পারছে না।এর আগের বার বেহুশের মতো যা করেছিলো এবার তো তা মোটেও করা যাবে না।কি এতো র*ক্তের ছ*ড়াছড়ি দেখে আনায়া না চাইতেও দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই মূহুর্তে নিজের দূর্বলতা প্রকাশেরও কোনো মানে নেই। কষ্ট করে হলেও নিজের দূর্বলতার বিষয়টি তাকে সহ্য করতে হবে।

আনায়া কেনীথের থেকে কিছুটা পিছনে অন্ধকারের দিকে ছিলো, যে কারনে তার দিকে নজর পড়ার আর কারো সময় হয় নি। এদিকে কেনীথ তো সেই কখন থেকে একটা ছেলেকে ধরে মুখের মধ্যে ঘু*ষি মে*রে যাচ্ছে।বেচারার চোখ মুখ,নাক ফেটে গলগল করে র*ক্ত ঝড়ছে।

আনায়া তাড়াতাড়ি করে কেনীথের কাছে গেলো সেই লোকটাকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে। প্রথমেই গিয়ে কেনীথের একবাহু ধরে আটকাতে গেলেই কেনীথ ওকে দেখে লোকটাকে ঘু*ষি মা*রতে গিয়েও থেমে যায়।

আশপাশের কয়েকজনই হঠাৎ একটা মেয়েকে কেনীথকে আটকাচ্ছে দেখে অবাক হয় আর তার চেয়ে বেশি অবাক হয় যখন দেখলো কেনীথ নিজেও এর কোনো প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে থেমে গিয়েছে। সবার মতো আনায়াও ভেবেছিলো সব হয়তো এবার স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। কেনীথ হয়তো আর কিছু করবে না।কিন্তু সবার চিন্তা ভাবনাকেই কেনীথ ভুল প্রমান করে পরবর্তীতে যা করলো তা সবার মতো আনায়াও প্রস্তুত ছিলো না।

কেনীথ ছেলেগুলোকে ছেড়ে দিয়ে আনায়ার দিকে ঘুরলো। এরপর মুহুর্তেই তার বলিষ্ঠ দেহ দিয়ে ঢেকে আনায়াকো সবার দৃষ্টি থেকে আড়াল করে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আনায়ার গাল চেপে ধরলো। এরপর শক্ত করে ওর বাহু ধরে ধীরে ধীরে পেছনে থাকা কেনীথের ছবি টাঙ্গানো বড় বোর্ডটার সাথে জোরে চেপে ধরলো।

এদিকে আনায়ার গালের হাড়গুলো মনে হয় ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম। কেনীথের সর্বোচ্চ শক্তির সাথে তার মতো মেয়ের পেরে ওঠা কখনোই সম্ভব নয়। কেনীথ যেন তাকে নিজের বলিষ্ঠ দেহ দিয়ে সম্পূর্ণ আবদ্ধ করে ফেলেছে। কিঞ্চিৎ নড়াচড়া করারও উপায় রাখেনি। কেনীথ আর তার মাঝে পার্থক্যের পরিমানটা নেই বললেই চলে। কেনীথ আর তার চোখ একে অন্যের দিকে তীব্র চাহনি নিয়ে দেখছে। একজনের চোখে তীব্র ক্ষো*ভ তো একজনের চোখ স্রোতহীন শান্ত নদীর জলের মতো। একটা সময় গালের অসহনীয় ব্যথায় বেচারী আর সহ্য করতে না পারে আনায়ার চোখ বেয়ে আপনা-আপনি কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। এটা দেখে কেনীথের মন গললো কিনা জানা যেই তবে তীব্র আ*ক্রোশের সঙ্গে হিঁসহিঁসিয়ে বলতে লাগলো,

—“বলেছিলাম না আমি! লজের কাছেই থাকবি, স্টেজের আশেপাশেও আসবি না! তবে কেনো এসেছিস এখানে? ”

#চলবে

#একজোড়া_আগুন_পাখি
®অরনীতা তুশ্মি (#তুশকন্যা)

পর্ব→১২

“বলেছিলাম না আমি! লজের কাছেই থাকবি, স্টেজের আশেপাশেও আসবি না! তবে কেনো এসেছিস এখানে? ”

আনায়ার প্রচন্ড রকমের কষ্ট হচ্ছে। চোখ বেয়ে না চাইতেও অঝোরে পানি ঝড়ছে। গালের হাড়গুলো মনে হয় এবার সত্যিই ভেঙ্গে গুড়ো হয়ে যাবে। সাথে সে বিস্মিত হচ্ছে এই ভেবে যে একটা লোকও কেনীথকে আটকাতে তার কাছে আসছে না। আনায়ার চোখের মণি এদিক ওদিক নড়াচড়া করছে দেখে কেনীথ আনায়ার আরেকটু কাছে নিজের মুখটা নিয়ে হিসহিসিয়ে বললো,

—“আশেপাশে তাকিয়ে লাভ নেই! আমি চাইলে তোকে এখানেই শেষ করে ফেলতে পারি, কিন্তু আমার থেকে তোকে বাঁচানোর মতো সাহস কারো নেই! ”

এইটুকু বলেই কেনীথ আনায়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আনায়াকে ছেড়ে দিলো। কিন্তু ওর সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো না।এখনো তাকে তার বলিষ্ঠ দেহ দিয়ে সবার থেকে আড়াল করে রেখেছে।
অন্যদিকে আনায়ার নজর কেনীথ থেকে সরতেই চলে গেলো দূরে কৌতুহল নিয়ে আর সবার মতো তাদের দিকে তাকিয়ে থাকা রনক আর শিখার দিকে। এরপর আরেকটু খেয়াল করতেই দেখলো ওদের দুজনের সাথে তার পুরো ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই আছে।

আনায়া নিজের ব্যাথাকে ভুলে গিয়ে দুশ্চিন্তা করতে লাগলো তাকে আবার তাদের ফ্রেন্ডরা চিনে ফেলেনি তো। আর নিজের বোকামির জন্য প্রচন্ড আফসোস হচ্ছে। কেনীথের কথা মনে না থাকলেও ওর ফ্রেন্ডরাও যে এখানে থাকবে এই বিষয়টা তো মাথায় রাখা উচিত ছিলো। এখন ওকে চিনে না ফেললেই হলো।

এদিকে কেনীথ যখন আনায়াকে অন্যকিছু ভাবতে দেখলো তখন কিছুটা কপাল কুঁচকে পেছন দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে গেলেই আনায়া তাড়াহুড়ো নিজের ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে নেয়। যে কারণে কেনীথ পুরোপুরি পিছনে না তাকিয়ে আবারও আনায়ার দিকে তাকিয়ে হিসহিসিয়ে কিছু বলতে চেয়েও আর বললো না।বরং তার হাতটা শক্ত করে ধরে নিয়ে কনসার্ট এরিয়া ছেড়ে গিয়ে ওর গাড়ির কাঁছে যেতে লাগলো।

কেনীথের বড় বড় পায়ের কদমের সাথে তাল মিলাতে না পারলেও আনায়া যথাসাধ্য চেষ্টা করছে নিজের জর্জেট ওড়নাটা দিয়ে সম্পূর্ণ মুখটা ঢেকে রাখার। তাকে দূর থেকে তার ফ্রেন্ডরা ঠিক ভাবে চিন্তে না পারলেও এতো এতো মিডিয়ার ক্যামেয়ায় যদি সে একবার বন্দী হয়ে যায় তবে তাকে আর চিন্তে কারো বাকি রইবে না।

এছাড়া কেনীথের আশেপাশে তার নিরাপত্তার জন্য সকল কর্মী ঘেরাও করে কেনীথের যাওয়ার পথ তৈরি করে দিচ্ছে। সম্পূর্ণ রাস্তাটা আনায়া নিজের ওড়নার নিচ থেকে বারবার খেয়াল করছিলো তার বন্ধুদের। আর তখনই বুঝতে পারলো সবার নজর তাদের দিকে থাকলেও রনক খুব অদ্ভুত ভাবে তার ঢেকে রাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে রইছে।

আড় চোখে তাকিয়ে এটা দেখার পর আনায়া দ্রুত কেনীথের পায়ের সাথে পা মিলিয়ে ওর একপাশের বাহু ঘেঁসে যেতে লাগলো। কিন্তু এ নিয়ে কেনীথের মাঝে কোনো হেলদোল নেই। সে শিরদাঁড়া সোজা করে নির্বিকার যে হেঁটে চলেছে তো চলেছেই।

_________________

গাড়িতে একপ্রকার ছুঁড়ে ফেললো আনায়াকে। আনায়া নিজেকে ব্যালেন্স করে ঠিকঠাক ভাবে বসার আগেই ডাইভিং সিটে বসে সজোরে দরজা লাগিয়ে দিলো। এদিকে আবার আনায়া বসতে না বসতেই পাশ থেকে কেনীথ এসে আনায়ার সিট বেল্টটা একটানে লাগিয়ে দিয়ে আবারও নিজের যথাযথ স্টানে ঠিকভাবে বসতে না বসতেই সজোরে গাড়ি স্টার্ট দিলো।

কেনীথ নিজের কাজকর্ম করতে একটুও দ্বিধাবোধ না করলেও আনায়া বেচারীর সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাওয়ার উপক্রম। একদিকে মুখের ব্যথা আর চোখের পানিই ঠিকমতো মুছেনি। আর তার আগেই যখন কেনীথ ওভাবে তার উপর দিয়ে হাত এগিয়ে সিট বেল্টটা টেনে লাগিয়ে দিলো তখন ক্ষনিকের জন্য নিমিষেই আবারও তার দম বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।

এতোকিছুর মাঝেও আনায়া বুঝতে পারছে না কেনীথের এতোটা রিয়েক্ট করার কারণ কি! শুধু তার কথা না শুনে ভুলে স্টেজের কাছে গিয়েছিলো এইজন্যই এতোকিছু! কই তার ইমন ভাইয়ের সময় তো এমন কিছু ছিলো না।ই তখন তো নাকি ইমন ভাইকে তার আশেপাশেও প্রয়োজন ছাড়া যেতে নিষেধ করতো। আর গতবার যখন ইমনের সাথে কনসার্টে এতো পুরো সময়টা তো সে ইমনের সাথে কনসার্টেই ছিলো। তবে এখন তার সাথে এসব করার মানে কি!
শুধু তার পিএ হয়ে কথার অমান্য করা!, সে মেয়ে এইজন্য নাকি অন্যকিছু!

আনায়া এই প্রশ্নের উওর জানে না।এবং পরবর্তীতে কি ডিসিশন নিবে নে তাও বুঝে উঠতে পারছে না।আপাতত গালে তীব্র ব্যথা থাকা সত্বেও তা নিয়ে আর তার চোখে পানি না পড়লেও পূর্ববর্তী সময়ে চোখের পানি ফেলায় গাল ভিজে পুরো একাকার। মূহুর্তেই আনায়া একবার হালকা কাঁধ বাঁকিয়ে কেনীথকে দেখার পর ওড়না দিয়ে গালটা মুছে নিলো।

এদিকে কেনীথের মনে হয় সর্বোচ্চ স্পিডে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এবার আর আনায়ার মাঝে কোনো ভয়ভীতি নেই। সে নির্বিকারে নিজের সিটে বসে থেকেই কেনীথের সাথে আবারও এক মারা*ত্মক কার রাইডিং এর সঙ্গী হলো।

________________

ভোররাত আর নিস্তব্ধ পাহাড়ি রাস্তা। আশেপাশ সাদা কালো মেঘের আড়ালে ঢাকা। রাস্তার ঠিক শেষ প্রান্তে গিয়ে আবারও কেনীথ গাড়ি থামিয়েছে। আনায়ার গাড়ির ভেতর চুপটি করে বসে রইছে অন্যদিকে কেনীথ রাস্তার শেষ প্রান্তে গিয়ে নিষ্প্রাণ দেহের মতো দাঁড়িয়ে রইছে। তার সামনে অন্ধকার মেঘ ব্যতীত কিছু নেই। সূর্যোদয় হতো হয়তো আরো অনেক দেরী। তবে কেনীথ পাহাড়ের চুড়ায় থেকেও এই মাধুর্যপূর্ণ সূর্যোদয়ের দৃশ্য উপভোগ করার জন্য অপেক্ষা করবে না।কারণ আলো জিনিসটা কেনীথের সবচেয়ে অপছন্দনীয় বিষয়বস্তুর একটি।

অন্যদিকে আনায়ার এসব জিনিস খুব পছন্দের।আর কেনীথও তাকে কিছুই বলেনি। সে চাইলেই গাড়িতে বসে না থেকে বাহিরে যেতে পারে কিন্তু সে এমন কিছুই করবে না। আনায়া খুব গভীর ভাবে কেনীথের কাজকর্ম নিয়ে চিন্তা করছে। এই লোকটিকে তার আর পাঁচটা লোকের মতো কখনোই মনে হয়নি কারণ সে একজন উদ্ভট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রকস্টার। কিন্তু এখন তার কেনীথকে নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে। এই লোককে তার সাইকোপ্যাথও বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। তবে তার ভাবার বিষয় হলো সে কেনীথের সাথে তার এই জবটা আদোও কন্টিনিউ করবে কিনা!

মাসখানেকও হয়নি। স্যালারিও পেতে এখনও অনেক দেরী। এই মাঝ পথে চাকরি ছাড়লে সারামাস চলবে কিভাবে। তার টিউশনি গুলোও তো সব ছেড়ে দিয়েছে আবার এই কেনীথের এই পিএর জবটা করার মূল উদ্দেশ্য ছিলো তারেকের ঠিকঠাক চিকিৎসা করানো। যত তাড়াতাড়ি অপারেশনের টাকা জোগাড় করতে পারবে তত তাড়াতাড়ি তার বাবা সুস্থ হতে পারবে। কিন্তু…….

কিছুক্ষণ ভাবার পর নিজেকেই অনেকটা বাধ্য হয়েই বোঝালো। এই চাকরিটা তার জন্য না হলেও তার বাবার জীবনের জন্য প্রয়োজন। আর সে তার বাবাকে বাঁচাতে এতোকিছু সেক্রিফাইস করতে পারলে আজ এতোটুকু বিষয় সহ্য করতে পারবে না! অবশ্যই পারবে আর পারতেই হবে।

কিন্তু আনায়া এও ডিসিশন নিলো যে এর পাশাপাশি সে অন্য কোনো অপশনেরও খোঁজ করবে। আর যাই হোক, বেশিদিন এই কেনীথের সাথে কাজ করলে ভবিষ্যতে হয়তো আরো অনেক কিছুই সহ্য করতে হতে পারে। ততদিন পর্যন্ত জেনে বুঝে এখানে থাকার কোনো মানেই নেই।

নিস্তব্ধ আনায়ার ভাবনা চিন্তার মাঝে কেনীথ ফিরে এসে গাড়িতে বসলো এরপর নিদিষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশ্যে আবারও ফুল স্পিডে গাড়ি স্টার্ট দিলো। এবং পুরো দীর্ঘ পথ অতিক্রমের মাঝে কেউ কারো সাথে টু শব্দ করাটাও প্রয়োজন মনে করলো না সাথে কেউ কারো দিকে ফিরেও তাকালো না।

____________________

সেই ঘটনার প্রায় দুদিন হতে চললো। মাঝে একদিন শুক্রবার থাকায় সেদিন সবকিছুই বন্ধ ছিলো। সেই রাতে কেনীথ আনায়াকে তার বাড়ির ঠিক সামনে পৌঁছে দিয়েছিলো। ভোর সকাল থাকায় এলাকার কিছু মুরব্বি ব্যতীত আর কারো চোখেই এলাকায় কেনীথের এই নতুন চকচকে গাড়ি নজরে আসনি। এছাড়া কেনীথ শুধু আনায়ার বাড়ির সামনেই গাড়ি থামিয়েছিলো। নিচে নামার প্রয়োজন তো সে কখনোই মনে করবে না। তাই কেনীথকে কেউ দেখেওনি।

আবার ভাগ্যক্রমে সেই গাড়ি থেকে আনায়াকে বের হতেও কেউ দেখে ফেলেনি। দেখে ফেললে হয়তো এই দুদিনে যা তা কান্ড হয়ে যেত।

এছাড়া কেনীথকে নিয়ে তার আরেকটি বিষয়েও ভুল ভাঙ্গে। কেনীথের সেই ব্যবহারটাকে সে যা তা ভাবলেও পরে যখন নিউজে জানতে পারলো কেনীথের কনসার্টে কয়েকজন ছেলে কুনজরে একটা মেয়েকে দেখছিলো আর তা দেখেই নাকি কেনীথ সেই ছেলোগুলোকে মারধর করে। এছাড়া মিডিয়া আর কোনো কারণ খুঁজে পাইনি কিংবা আলাদা কোনো বিষয় নিয়েও তারা সন্দেহ করতে পারছে না।কিন্তু তাদের প্রশ্ন সেই মেয়েটি কে! কেনীথের গত কনসার্টেও এমন একটি মেয়ে নিয়ে ঘটনা ঘটে যা আগে কখনো ঘটেনি। আর সেই মেয়ের রহস্য কিংবা পরিচয় এখনো মিডিয়া খুঁজে বের করতে না পারেনি আর তার আগেই নতুন এক মেয়েকে ঘিরে এতো বড় ঘটনা ঘটে গেলো।

বহু ক্যামেরায় ছবি আর ভিডিওকে একসাথে করেও মেয়েটির সঠিক ফুটেজ কেউ বের করতে পারেনি। তার খুব অন্ধকারে থাকা ঝাপসা কিছু ছবি ছাড়া তেমন কিছুই নেই। আর সবাই সেই ছবি নিয়েই আদা-জল খেয়ে নেমে পড়েছে মেয়েটির খোঁজ করতে।

এই নিউজটা দেখার পর আনায়া সম্পূর্ণ বিস্মিত আর চমকে গিয়েছিলো। সে তো জানতোও না ছেলেগুলো তাকে কু-নজরে দেখছিলো আবার কেনীথ যা করেছে তার হিসাবটা পুরোপুরি পরিষ্কার করতে চাইলেও সবসময় মনে হচ্ছে কেনীথের এতো বেশি পসেসিভনেস কি তার ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্বাভাবিক নাকি অন্যকিছু। আবার অন্যকিছু হওয়ারও তো কারণ দেখছে না। কেনীথ আর তার পরিচয় তো মাত্র কিছুদিনের। এই মূহুর্তে তার ইমনকে খুব প্রয়োজন ছিলো কিন্তু সে তো নাকি শহরের বাহিরে।

আবার এতসব টেনশন রেখে দিলেও এই মিডিয়াকে নিয়ে তার প্রচন্ড টেনশন হচ্ছে। তাকে আবার এরা খুঁজে না ফেলে। তবে একটা বিষয়ে চিন্তা নেই যে তারা কেনীথের অফিসে গিয়ে এই বিষয়ে কিছু জানতে পারবে কারণ কেনীথ তার অফিসের সব এমপ্লয়িদের পরিচয় কখনোই মিডিয়ায় প্রকাশ করে না। যদি কেউ নিজ ইচ্ছেয় বলতে চায় তো তবে সে বিষয় একান্তই তার ব্যক্তিগত কিন্তু এই নিয়ে পরবর্তীতে কোনো প্রবলেম ফেস করতে কেনীথ কিংবা কেনীথের অফিস রাজি নয়। যা অফিসের রুলস্ এ সুনির্দিষ্ট ভাবে বলা হয়েছে।

আনায়া নিজের সব টেনশন ঝেড়ে ফেলে আপাতত এখন ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। কনসার্ট ছিলো বৃহস্পতিবার রাতে, মাঝে একদিন শুক্রবার থাকলেও কেনীথ শনিবারও অফিস বন্ধ রেখেছিলো। কারো কাজ থাকলে এমনিতে সে অফিসে যেতে পারে কিন্তু বন্ধ থাকলে না গেলেও চলে। আর আনায়ার জানা মতে অফিসে তার কাজকর্ম নেই বললেই চলে।

আজ রবিবার সকাল সকাল নিজেদের সব কাজকর্ম শেষে সবকিছু ফরিদাকে বুঝিয়ে দিয়ে আনায়া আর ইনায়া মিলে ভার্সিটি আর স্কুলের উদ্দেশ্যে বেড়িয়েছে।

আনায়া ভার্সিটিতে ঢুকতেই দেখলো সেই চিরচেনা কাহিনি। তার ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই বড় গাছের নিচে গোল হয়ে বসে সেই চিরচেনা বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করছে। আনায়া এবার এদের এসব দেখে বিরক্ত কম কিছুটা চিন্তিত হলো বেশি।তবে নিজেকে সর্বোচ্চ স্বাভাবিক রেখে ওদের কাছে গিয়ে বসতেই প্রত্যেকেই তাদের কনসার্টের এক্সপিরিয়েন্স সম্পর্কে গল্প শোনাতে লাগলো। তবে তার গল্পের মূল কাহিনিই ছিলো কেনীথের মারামারি আর ওই মুখ ঢাকা মেয়েটা!

একটা সময় হাসতে হাসতে আলো বলেই ফেললো,

—“জানিস আনায়া! ওই মেয়েটাকে দেখলে তুই চমকে উঠবি। পুরো তোর মতোই দেখতে। আমরা তো কিছুক্ষণের জন্য ভেবেই নিয়েছিলাম ওটা তুই! ”

এটা শুনতেই যেন আনায়া কলিজার পানি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। যা শটা পাচ্ছিলো ঠিক তাই হয়েছে। আনায়া ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড ঘাবড়ে গেলেও নিজেকে সর্বোচ্চ স্বাভাবিক রেখে বলতে লাগলো,

—“তোরা ঔ মেয়েটাকে দেখেছিস নাকি! ”

—“আরে নাহ! কিভাবে দেখবো। মেয়েটা প্রথমে অন্ধকার ছিলো আর পরে মুখ ঢেকে নিয়েছিলো। মিডিয়া তো হুমড়ি খেয়ে ওই মেয়েকে খুঁজে বের করতে নেমেছে। আমার মনে হয় ওই মেয়েটার মাঝে রহস্য আছে। সবাই ভাবছে ভি.কে. কে সেদিন চ*ড় মারা মেয়েটা আর এই কনসার্টের মেয়েটা একজনই। ”

এর মধ্যে শিখা বললো,

—“আমার মনে হয় ওই মেয়েটা আর ভিকের মধ্যে কিছু চলছে নাহলে দেখলি কিভাবে শুধু কুনজরে চেয়েছিলো বলে ভিকে ছেলেগুলোকে কি ধোলাইটাই না দিলো। অ্যা…….আমার ভিকে, আমার জানটাও এখন তলে তলে টেম্পু চালনো শিখে গিয়েছে। তবে ওই মেয়েটা যদি আনায়া হতো তাহলে কিন্তু মন্দ হতো না। জামাই না হোক, দুলাভাই তো হতো! ”

এটা শুনতে না শুনতেই আনায়ার প্রচন্ড রকমের কাশি হতে লাগলো। পাশ থেকে সায়েম পানির বোতল এগিয়ে দিলে সাথে সাথে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,

—“মাথা খারাপ নাকি! এসব কোন ধরনের কথা। ”

শিখা মজার ছলে কথাটা বললেও এরপর ও সহ সাবা আর রনক বাদে বাকি সবাই কিছুটা হেসে ফেললো। তারপর শিখা আবারও বললো,

—“আরে আমি তো মজা করছিলাম। এতো সিরিয়াস হওয়ার কি আছে। তুই আর রেহান ভাইয়ার মধ্যে কিছু না থাকলে আমি দান দোয়া করে হলেও প্রার্থনা করতাম যেন তোর আর ভিকে বর বউ হয়ে যাস। ওমন একটা দুলাভাই পাওয়া কম কথা নাকি! অবশ্য রেহান ভাইয়াও কম কিসে। ”

এবার তাজিম বললো,

—“মুখে লাগাম দে রে শিখা! এসব কথা যদি রেহান ভাইয়ার কানে যায় তবে তোকে আর আনায়াকে বুড়িগঙ্গার কালা পানিতে চুবিয়ে মারবে। ”

—-“ইহ! আমাকে কেনো চুবাতে যাবে। বাসর যদি বউয়ের সাথে করতে পারে তবে বুড়িগঙ্গার পানিতে না হয় তার বউকেই চুবাবে। ”

এসব কথা শুনে আনায়া বিরক্তির সাথে বললো,

—“ইশ! চুপ কর ছাগলের দল!এটা ভার্সিটি , কিসব আজেবাজে কথা শুরু করেছিস।

আনায়ার কথা শেষ হতে না হতেই একই ভঙ্গিমায় সাবা বললো,

—“যাস্ট স্টপ ইট! আনায়া আর ভিকে? যাস্ট ইম্পসিবল। তোদের জোকস্ ও কত লেইম। ”

সাবার এমন কথা শুনে তাজিম বললো,

—“কেনো তোর ভিকে কি কোনো মানুষ কে বিয়ে না করে গরু ছাগল কিংবা এলিয়েনকে বিয়ে করবে। ”

—“তুই নিজের চিন্তা কর তাজিম। ”

তাজিম খুব ভালো করেই বুঝলো এই সাবা কেনো তাকে এটা বললো। সাবা যা চায় তা তার পক্ষে কখনোই সম্ভব না। ওমন একটা উড়নচণ্ডী মেয়ের সাথে ও…এমনটা যেন স্বপ্নেও না হয়। ”

এদিকে পরিস্থিতি যেন বেগতিক না হয় সেজন্য আনায়া তাড়াতাড়ি করে বললো,

—“সাবা তো ভুল কিছু বলেনি। তোদের মজা করার বিষয়টিও অনেক বাজে পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এক জীবনে একজনকেই ভালোবেসেছি আর সে হলো রেহান। এখন বিয়ে করলে তো রেহানকেই করবো আর না করতে পারলে সারাজীবনের জন্য দেবদাস-এর ফিমেল ভার্সন হয়ে যাবো। ”

ওর এই কথা শুনতেই সবাই জোরে “ও………” শব্দে আওয়াজ করতে লাগলো। তখনই আনায়া মুচকি হেসে বললো,

—“অনেক হয়েছে, এবার ক্লাসে চল নাহলে স্যার যখন পানিশমেন্ট দিবে তখন এভাবেই ও….. করে চিল্লাতে হবে। ”

ওর কথাগুনে সবাই হাসলেও আজ প্রথম থেকেই রনকের কোনো পরিবর্তন নেই৷ সে প্রথম থেকেই আনায়াকে নিয়ে খুব গভীর চিন্তা ভাবনা করছে। সবাই গাছের নিচ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ক্লাসরুমের দিকে যেতে লাগলো। সামনে থাকা প্রত্যেকেই কিছুটা এগিয়ে গেলে তখনই পেছন থেকে রনক আনায়াকে ডাক দিলো।

—“আনায়া! ”

আনায়া স্বাভাবিক ভাবে বললো,

—“কিছু বলবি! ”

—“একটা সত্যি করে কথা বলতো! ”

আনায়ার চোখমুখ মূহুর্তেই চুপসে গেলো তবুও নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো।

—“হুম, বল! ”

—“ওই কনসার্টে যে মেয়েটা, তুই ছিলি তাই না? ”

—“……….

—“কি হলো বল! ”

—“তুই পাগল! আমার অফিসে কাজ থাকতে আমি ওই কনসার্টে….. তোদের আসলেই মাথায় সমস্যা আছে। আমার যাওয়ার হলে তো তোদের সাথেই যেতাম তাই না? ”

রনক কিছু বললো না বরং কিছুক্ষণ আনায়ার দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে থেকে পরক্ষণেই মুচকি হেসে বললো,

—“আচ্ছা বাদ দে! চল ক্লাসে চল। নাহলে স্যার আবার বকাবকি করবে। ”

—“হুম!”

______________________

দুপুরবেলায় স্কুল ছুটির পর প্রতিদিনের মতোই ইনায়া বাড়িতে ফিরছিলো তবে আজ সে স্কুল ছুটির প্রায় আধঘন্টা পর বাড়ির দিকে যাচ্ছে। অন্যান্য দিকে মতো আজ তার মাঝে কোনো প্রফুল্লতা নেই। খুব গভীর চিন্তা ভাবনায় মগ্ন সে। নিজের হিসেবে পুরোপুরি মেলাতে পারেনি তবে তার প্রশ্নের উওর পেতে হলে তাকে তার বোনের সাথে কথা বলতে হবে।

রাস্তার একপাশ দিয়ে ইনায়া বাড়ি ফিরছিলো এমন সময় হঠাৎ পিছন থেকে এক পরিচয় কন্ঠ স্বর শুনতেই তার পা জোড়া থেমে গেলো। ইনায়া পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলো রোহান কলেজ ড্রেস পড়া এবং তার দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু সে এবার একা নয় বরং তার এলাকার এক পরিচিত আপুকেও সে দেখতে পেলো। ইনায়ার এক ব্যাচ সিনিয়র, এবার এসএসসি দেবে। মেয়েটার নাম মিতু আর দেখতে শুনতেও যথেষ্ট ভালো হলেও তার ব্যবহার ইনায়ার কখনোই ভালো লাগেনি। মেয়েটার সাথে যতবারই ইনায়ার দেখা কিংবা কথা হয়েছে ততবারই মিতুকে ইনায়ার প্রচন্ড ন্যাকা স্বভাবের মনে হয়েছে। এমনিতে তো চরিত্রটা ঠিক আছে কিন্তু এই ধারণা ইনায়ার ভুল হতে পারে। কারণ মেয়েটাকে যেহেতু তার পছন্দ নয় তাই সে কখনোই মিতুর বিষয়ে ঘাটাঘাটি করতে যায়নি। কিন্তু হঠাৎ মিতু আর রোহান একসাথে এই জায়গায় থাকার কারণটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না।

এরই মাঝে তার দুজন চলে এলে রোহান বললো,

—“কি গো ইরাবতী ! বাড়ি যাচ্ছো নাকি। ”

ইনায়া ছোট করে উত্তর দিলো,

—“হুম! ”

তবে এটা বলেই ইনায়া চলে যেতে লাগলে রোহান বললো,

—“আরে কই যাও! আমাকে দেখলেই চলে যাওয়ার জন্য এতো তাড়াহুড়ো করো কেনো। ”

এরই মাঝে পাশ থেকে মিতু রোহনের উদ্দেশ্যে বললো,

—“তুমি ওকে চেনো! ”

—“হ্যাঁ,চিনি তো। ও ইরাবতী,তুমিও চেনো নাকি! ”

—“রোহান এটা আমাদের এলাকা আর আমি ওকে চিনবো না। ওকে এই এলাকার সবাই চেনে। এই বয়সে ওর এতো ইগো, এ্যাটিটিউট কি আর বলবো। সঙ্গে প্রচন্ড বেয়াদবও!”

মিতুর কথা শুনে রোহান তব্দা খেয়ে গেলো অন্যদিকে ইনায়ার চোখ মুখ স্বাভাবিক কিন্তু তাতে প্রচন্ড বিরক্তর ছাপ।

এরই মাঝে মিতু রোহানের বাহুতে হাত পেঁচিয়ে আহ্লাদী সুরে বললো,

—“আচ্ছা তুমি ওকে ইরাবতী বলছো কেনো বলোতো! কই কখনো তো আমায়কে এসব নামে ডাকো না! ”

মিতুকে এমন করতে দেখে ইমন কিছুটা বিব্রত হয়ে বলতে লাগলো,

—“কি করছো মিতু! এটা পাব্লিক প্লেস, কেউ দেখে ফেললে আমার তেরোটা বেজে যাবে।”

এবার এদের কাজকর্ম দেখে ইনায়া বাঁকা মুচকি হেসে তাচ্ছিল্যের সুরে বলতে লাগলো,

—-“আশেপাশে এতো হুর-পরী থাকতে শেষে এই মৃগীকৃমি! রুচির দুর্ভিক্ষ, বেস্ট অফ লাক! ”

এই কথা বলা মাত্রই ইনায়া সামনে ঘুরে বাড়ির উদ্দেশ্য যেতে লাগলো আর পেছনে রোহান পুরো স্তব্ধ চোখে ইনায়ার যাওয়া দেখছে। কিন্তু তার পাশে থাকা মিতু অবাক সুরে চেচামেচি করে রোহানের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো,

—“রোহান! ও…ও..এটা কি বললো। ও আমাকে মৃগী.. কৃমি!, ছিহ!!! তুমি কিছু বলছো না কেনো….রোহান….

ইনায়া এসব শুনতে শুনতেই সামনে এগোতে লাগলো। একটা সময় তার বাঁকা হাসি থেমে গিয়ে তাচ্ছিল্যে বিড়বিড় করে বললো,

—“রোহান আহমেদ! হাহ….!!!”

___________________

আজ ভার্সিটি থেকে অফিসে গিয়ে কিছুটা অবাক হলো। অফিসে আজ কেনীথ আসেনি। অথচ তাকে অফিস থেকে ভার্সিটি টাইমে ফোন করে জানানো হয়েছে ও যেন আজ দুপুরেই অফিসে চলে আসে। কেনীথ নাকি তার জন্য অনেকগুলো কাজ দিয়েছে সেগুলো আজই শেষ করে হবে।

আনায়া সে কথামতো ভার্সিটি থেকেই অফিসে চলে যায় আর বাড়িতে ফোন করে ফরিদাকে জানিয়ে দেয় এই বিষয়ে। অন্যদিকে সে ভেবেছিলো তার কাজকর্ম বলতে তো তেমন কিছুই নেই সঙ্গে কেনীথও আজ আসেনি তবে কি এমন আর কাজ করতে হবে। কিন্তু অফিসে যাওয়ার পরই তার পুরো চিন্তা ভাবনায় ছাই পড়ে গিয়েছে।

এতগুলো অগোছালো কাজকর্ম আর ফাইল ঠিক করতে গিয়ে সে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে কেনীথ আর যাই হোক, তাকে বসিয়ে বসিয়ে মাস শেষে ওতোগুলো টাকা দিচ্ছে না। এজন্য মনে মনে বিরক্তি নিয়ে বললো,

” বেটায় দশ দিনের কাজ একদিনেই পুষিয়ে নেবে। আচ্ছা, এমনটা কি তার বউদের সাথেও করবে নাকি! ছিঃ ছিঃ,কোথায় থেকে কোথায় চলে গিয়েছি। এসব কি চিন্তা ভাবনা। ”

নিজের উপর এই নিয়ে কিছুটা বিরক্ত হয়েই আনায় নিজের সব কাজ শেষ করেছে আর সর্বশেষে কেনীথকে একজন তার ছেঁড়া বড় ভাই হিসেবে বিবেচনায় রেখেছে।

_______________

কপাল করে আজ ভার্সিটিতে যাওয়ার আগে গোসলটা সেরে গিয়েছিলো তবে এতোরাতে বাড়ি ফিরে আরেকবার গোসল না করলে আর তার আর রাতে ঘুম হবে না। আজ দশটার দিকেই বাড়ি ফিরেছে আনায়া আর এসেই দেখলো তার বাড়ি একদম নিস্তব্ধ ঘুমের আসরে পরিণত হয়েছে। তার বাড়িতে কেউ বেশি একটা রাত জাগে না। তারেক তো সন্ধ্যা রাতেই ঘুমিয়ে পড়ে আর ইনায়া পড়াশোনা শেষ করে দশটা কিংবা এগারোটায়।

আনায়া মনে হলো আজ হয়তো ইনায়াও তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে। আনায়া একবার বাবা আর বোনের রুমে যেতে চেয়েও আর তার শরীরে কুলালো না। কান্ত শরীর নিয়ে আগে নিজের রুমে গিয়ে সরাসরি গোসল করতে বাথরুমে চলে গেলো।

একটা লম্বা সাওয়ার নিতে নিতে পানিতে ভিজতে থাকা তার গলার চকচকে লকেটটার দিকে বারবার তাকিয়ে দেখতে লাগলো। জিনিসটাকে কেনো যেন তার প্রচন্ড অদ্ভুত লাগছে। এটা পড়ার পর থেকে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে যদিও এটাকে সে নিজের অতিরিক্ত ভাবনা বলেই চালিয়ে দিচ্ছে।

আনায়া গোসল শেষে রুমে আসতেই কিছুটা অবাক সুরে বললো,

—“ইরা! তুই ঘুমাসনি? ”

ইনায়া গম্ভীর স্বরে খাবারের প্লেট আর পানির গ্লাসটা ছোট টেবিলে রাখতে রাখতেই বললো,

—“ঘুমালে নিশ্চয় তোমার সাথে থাকতাম না! ”

আনায়া ভ্রু কুঁচকে মনে মনে বললো,
—“এর আবার কি হয়েছে! ”

এরই মাঝে ইনায়া বিছানায় বসে পড়ে নির্বিকারে বলতে লাগলো,

—“খাবারটা তাড়াতাড়ি খেয়ে নেও! ”

আনায়া ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে আনায়ার সামনে গিয়ে চুল মুছতে লাগলো এরপর মুচকি হেসে বললো,

—“আমার উপর রেগে আছিস? ”

ইনায়া কিছু বললো না। আনায়া পিছনে ফিরে বললো,

—“কিছু বলবো! ”

—“হুম! ”

—“তাহলে বল! এই না শোন… তুই যদি এখন উল্টো পাল্টা কিছু বলতে এসেছিস তাহলে আজ আর সম্ভব না আমি অনেক ক্লান্ত…. প্লিজ কালকে……

—“তোমার ভার্সিটি ফ্রেন্ড রনক ভাইয়া এসেছিলো! ”

আনায়া ভ্রু কুঁচকে ইনায়ার দিকে তাকালো তখনই ইনায়া নির্বিকারে বলতে লাগলো,

—“বিকেলের দিকে এসেছিলো। এসে জিজ্ঞেস করলো গত বৃহস্পতিবার তুমি কোথায় ছিলে। ”

আনায়া তাড়াহুড়ো করে ইনায়ার কাছে এসে বললো,

—“তুই কি বলেছিস! ”

আনায়া গম্ভীর মুখে বললো,

—“তুমি ঠিক কোথায় গিয়েছিলে তা তো আর বলে যাও নি কিন্তু আমি বলেছি তুমি বাড়িতেই ছিলে। ”

আনায়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে চেয়েও আর ফেলতে পারলো না।উল্টো ইনায়াকে বললো,

—“মিথ্যা কেনো বলেছিস। ”

ইনায়া বোনের দিকে গম্ভীর চাহুনিতে তাকিয়ে বললো,

—“তুমি কিসের জব করো আপু! ”

আনায়া উত্তর না দিয়ে বোনের গম্ভীর চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলো। এরপর কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললো,

—“ওটা তোর না জানলেও চলবে। যা ঘুমাতে যা! ”

ইনায়া বাঁকা হেসে বললো,

—“জানার তো প্রয়োজন আছে, আমার বোন এতোরাত করে কি কাজ করে বাড়ি ফেরে তা জানতে হবে না বুঝি!”

আনায়া চোখ ছোট ছোট করে বললো,
—“কি বলতে চাইছিস, সরাসরি বল!

ফর্সা মুখের ইনায়া আবারও বাঁকা হেসে বললো,

—“কিছুদিন আগে ভিকের কনসার্টে ওকে চ*ড় মা*রা মেয়েটা আর গত কনসার্টে যে মেয়েটাকে নিয়ে ভিকে এতো ঝামেলা করলো সেই মেয়েটার মধ্যে কোনো কানেকশন রয়েছে। না মানে দুজনেরই পরনের ড্রেসগুলো আমার প্রাণপ্রিয় বড় বোনেরও রয়েছে!”

#চলবে