একজোড়া আগুন পাখি পর্ব-১৩+১৪

0
29

#একজোড়া_আগুন_পাখি
®অরনীতা তুশ্মি (#তুশকন্যা)

পর্ব→১৩

—“পৃথিবীতে একই রকম মানুষ যেখানে সাত জন রয়েছে সেখানে আমার মতো জামা কি আর কারো হতে পারে না! এমন তো নয় ওই জামা গুলো শুধু আমার জন্যই স্পেশাল ভাবে বানানো হয়েছে যা পৃথিবীর এক পিসই করেই রয়েছে। ”

ইনায়া বোনের গম্ভীর কথাগুলো শুনেও হাসলো,

—“আমি জানি তুমি সহজে স্বীকার করবে না কিন্তু ওই মেয়েটা যে তুমিই তাতে আমি 99.99999% সিওর। একে তো তোমার ঐ জামা গুলো কয়েক মাস আগে আমিই পছন্দ করে কিনে দিয়েছিলাম যা তুমি ভুলে গেলেও আমি কিন্তু ভুলিনি।

আর দ্বিতীয় আমার বোন যদি বোরকা পড়েও থাকে তবুও আমি শত মাইল দূর থেকেও চিনতে পারবো। ”

ইনায়ার ভাব নিয়ে বলা কথাগুলোকে কিছুটা উড়িয়ে দিয়ে আনায়া বললো,

—“তুই সিনেমার মতো অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ছিস। যদি এমনটাই হতো তবে প্রথমবারেই মেয়েটাকে দেখে চেনার কথা ছিলো তোর। তখন না এসে এখন কেনো এসেছিস। ”

—“তুমি আর এই জীবনে শুধরাইলে না! বড় বোন হয়েও এমন মিথ্যা কেউ বলে? ”

আনায়া চোখ ছোট ছোট করে তাকালো অন্যদিকে ইনায়া আবারও বললো,

—“আমি তো তখন বিষয়টিকে পাত্তা দেই নি। কিন্তু এবার পুরোপুরি সিওর। তুমি কি ভুলে গিয়েছো সেদিন রাতে তুমি বাড়ি থেকে ঐ জামাটাই পড়ে গিয়েছিলে। আর সেই কনসার্টেও তুমি ইমন ভাইয়ার সাথে সেই হলুদ জামাটাই পড়ে গিয়েছিলে। এরপরও মিথ্যা বলবে! আর আমি না হয় ছোট মানুষ কম বুঝি! তা তোমার বন্ধু রনক ভাইয়াও তো দেখি সন্দেহ করেছে। এখনও বলবে…..

ইনায়ার কথা শেষ হওয়ার আগেই আনায়া বিরক্তি নিয়ে বললো,

—“আসছে আমার ছোট মানুষ! পুরো দুনিয়াটা ভেজে খেয়ে বেড়াচ্ছেন। ”

ইনায়া হেসে বললো,

—“তার মানে আমি যা বলছি তা সব সত্যি, তাই না!

—“সবই তো বুঝে গিয়েছিস এটাও আবার মুখে বলতে হবে। এখন দয়া করে আমার রুম থেকে যা, আর এতো পাকনামি না করে ঘুমা। আর শুন! ভুলেও এসব কথা যেন কেউ জানতে না পারে। যদি চাস, তোর বোনটা বাকি জীবনটা একটু স্বস্তিতে পার করুক। ”

এবার ইনায়া বোনের বিরক্তর সুরে বলা কথা শুনে কিছুটা আহ্লাদী সুরে বললো,

—“তুমি এমন বলো কেনো! আমি কি কখনো তোমার খারাপ চাইতে পারি। আমি কাউকে কিছু বলবো না যদি………

আনায়া ইনায়ার কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকালো অন্যদিকে ইনায়া মুচকি মুচকি হাসছে। আনায়া তখন ভ্রু উঁচিয়ে বললো,

—“যদি…..? ”

—“যদি তুমি বলো তোমার আর ভিকের মধ্যে কানেকশনটা কি? ”

আনায়া বোনের মুচকি হেসে বলা কথাটা শুনে কপালে ভাজ ফেলিয়ে বললো,

—“এটা না জানলেও চলবে। এখন তুই ঘুমা। ”

—“ও আপু বলো না প্লিজ। আমি প্রমিজ করছি এই বিষয়ে আমি কাউকে বলবো না।”

—“তুমি যেটাই করো না কেনো, আমি তোমাকে কিছুই বলছি না। ”

—“তাহলে আমিও আমার কথা রাখবো না। সবাইকে বলে দেবো ওই মেয়েটা তুমি! ”

আনায়া চোখ ছোট ছোট করে বললো,

—“মীরজাফর! ”

ইনায়া হেসে বললো,

—“ফিমেল ভার্সন! ”

আনায়া এবার হাত ধুয়ে এসে বিছানায় বসে বসে খাবার খেতে লাগলো। এরপর ইনায়াকে জিজ্ঞেস করলো ও খেয়েছে কিনা। ইনায়া খেয়েছে বলার পরও আনায়া আবারও ওকে কয়েক লোকমা খাইয়ে দিতে দিতে বললো,

—“হুম! ওই মেয়েটা আমিই। ”

ইনায়া মুখের খাবার থাকা অবস্থাতেই বললো,

—“সে তো জানি কিন্তু তুমি আমার জামাইকে চ*ড় মেয়েছিলে কেনো। ওর ব্যাথা লাগেনি বুঝি! ”

আনায়ার খাবার চিবুচ্ছে আর এদিকে বোনের এহেন কথা শুনে পুরো মুডের তেরোটা বেজে গিয়েছে। বিরক্তিতে দাঁত কটমট করে বললো,

—“কিসের জামাই! ইচ্ছে তো করছে তোকে চৌদ্দ তলা উপর থেকে নিচে ফেলে দেই। ওকে মে*য়েছি ও কষ্ট পেয়েছে আর সেই রাতে আমার গালে যেভাবে চেপে ধরেছিলো আমি তাতে কষ্ট পাইনি? আরেকটু হলে তো আমার গালের হাড্ডি গুলো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যেত। ”

বোনের কথা শুনে ইনায়া ইনোসেন্ট মুখ করে বললো,

—-“আচ্ছা সরি, তুমি বলো। তুমি ভিকের কাছে কিভাবে পৌঁছালে। আর সেই রাতের ঘটনার পর অনেকে অনেক কিছুই বলছে। সবকিছু মিথ্যা হলেও এটা তো সত্য যে তোমরা দুজন পরিচিত,কিভাবে? ”

আনায়া খেতে খেতে বললো,

—“আমি তোর ভিকে নামক জামাইয়ের পি.এ. এইজন্য। ”

ইনায়া বোনের কথা যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।চোখেমুখ দারুণ ভাবে বিস্মিত হলো। ইনায়া কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকার পর বললো,

—“তুমি কি মজা করছো? ”

—“নাহ! ”

—“কি!!!”

আনায়া বিরক্ত হয়ে বললো,

—“ইরা আস্তে! রাম ছাগলের মতো চেচাচ্ছিস কেনো।”

—-“তারমানে তুমি ওখানেই জব করো। ”

—“হু!”

—“আমাকে আগে বলোনি কেনো! ”

আনায়া নির্বিকারে বললো,

—“এমন ছাগলামি করবি এজন্য! ”

ইনায়া আর এবার বিছানায় স্থির হয়ে বসে থাকতে পারলো না।জোড়ে লাফিয়ে উঠে বিনা আওয়াজে লাফালাফি করতে লাগলো। এদিকে আনায়া বোনের কাজকর্ম দেখে বিরক্তি নিয়েই খাবার খেয়ে যাচ্ছে। ইনায়া কিছুক্ষণ থেমে আনায়ার কাছ থেকে পুরো বিষয়টি জানতে চাইলে আনায়া শুরু থেকে মোটামুটি সব কিছুই ইনায়ার প্রশ্ন অনুযায়ী উত্তর দিলো। সবকিছু শুনে ইনায়া প্রচন্ড বিস্মিত হয়ে বললো,

—“ছিহ!তোমরা কত বড় মিথ্যাবাদী। ইমন ভাইও এতোদিন ভিকের পিএ ছিলো আর তুমিও……তুমি তো আমার বোন। আমাকে মিথ্যা বলার কি দরকার ছিলো। আমিই এতোই খারাপ।”

—“নাহ! তুমি ধোঁয়া তুলসি পাতা। আর আমি তোকে মিথ্যা কখন বললাম। তুই তো আমার জব নিয়ে এর আগে কখনো কিছু জিজ্ঞেসই করিসনি।”

ইনায়া নিজের ভুল বুঝতে পেরে জিহ্বায় হালকা কা*মড় দিয়ে হঠাৎ কি যেন ভেবে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। তা দেখে আনায়া কপাল কুঁচকে ওর দিকে তাকাতেই ইনায়া পেছন থেকে এসে ওর গলা জরিয়ে ধরে আহ্লাদী সুরে বললো,

—“আপু! ও আপু……..

—“এখন আবার কি চাস! এসব কি শুরু করলি। ”

—“শোনো না! ”

—“আগে সামনে এসে চুপচাপ বসে বলতে থাক, তারপর তোর কথা শুনছি।

আনায়ার কথামতো ইনায়া তাই করে। এরপর বোনের কাছে একটু এগিয়ে গিয়ে মাথাটা নিচু করে ধীরে সুস্থে বললো,

—“তুমি না আমার বড় বোন আর তুমি তো জানই আমি ভিকের কত্ত বড় ফ্যান। প্লিজ,প্লিজ যাস্ট একবার ভিকের সাথে দেখা করিয়ে দেও। প্রমিজ করছি ইহজন্মে আর তোমার কাছে কিছু চাইবো না। তোমার দাসী হয়ে থাকবো, যা বলবে তাই শুনবো।প্রমিজ করছি, একদম পাক্কা প্রমিজ। ”

অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরও যখন আনায়ার কাছ থেকে কোনো উত্তর এলো না তখন ইনায়া মাথা উঁচু করতেই আনায়ার চেহারা দেখে ভরকে গেলো। তার বোনের চোখমুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না ও কি বলবে বা করতে চাইছে। কিন্তু মস্তিষ্কে কোনো কিছুর একটা সংকেত পেতেই দুই হাত দিয়ে নিজের গালদুটো চেপে ধরে ঢোক গিললো।

____________________

রাতের আধারে রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর সেন্ট পিটার্সবুগের রাস্তায় ব্লাক কালারের রোলস রয়েস ফ্যান্টম কারটা সাই-সাই করে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। তার পেছনে আরো ৪-৫টা বিলাসবহুল গাড়ি সমান তালে সামনের প্রথম গাড়িটাকে অনুসরণ করে চলেছে।

রোলস রয়েসের ভেতরে পেছনের সিটে কালো লেদার জ্যাকেট, প্যান্ট আর জুতা পড়ে পায়ের উপর পা তুলে নির্বিকারে বসে রইছে কেনীথ। চুলগুলো হালকা কার্ল ব্রাশ করে হাফ মেসি বান করা সঙ্গে চোখে কালো গ্লাসেস। এয়ারপোর্ট থেকে সম্পূর্ণ যাত্রা পথের এই বিলাসবহুল আয়োজন মূলত তার জন্যই করা হয়েছে।। হঠাৎ এতোগুলো বছর পর এই দেশে আসাটা কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় নয় বরং তার পরবর্তী পরিকল্পনা পূরনের উদ্দেশ্যই কেনীথ এই বিদেশের মাটিতে পা রেখেছে।

বাংলাদেশ থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গ-এর সময়ের ব্যবধান ৩ ঘন্টা পিছিয়ে। বর্তমানে এই শহরে আটটা বাজে যা বাংলাদেশী সময়ে রাত দশটা।

কেনীথ এয়ারপোর্টে পা রাখার আগেই তার শুভাকাঙ্ক্ষী তার জন্য এত্তসবের আয়ােজন করে রেখেছে। নিসন্দেহে বলা যায় এই শুভাকাঙ্ক্ষী একাকিত্বের প্রেমিক কেনীথের বড়ই আপন কেউই। শুধু সে নয় বরং আরো একজন হয়েছে যে এতোবছর পর কেনীথের রাশিয়ায় আসার খবর পেয়েই প্রাসাদ সমতুল্য বাড়িটাতে মনের আনন্দে সেজেগুজে লাফিয়ে, গান গেয়ে বেড়াচ্ছে।


He is a bad boy with a tainted heart
And even I know this ain’t smart
But mama I’m in love with a criminal
And this type of love isn’t rational, it’s physical

Mama please don’t cry, I will be alright
All reason aside I just can’t deny, I love the guy

বিশাল বড় এরিয়া জুড়ে এক রাজকীয় প্রাসাদ সমতুল্য বিলাসবহুল বাড়ি। আশেপাশে রাতের আধারকে আলোকিত করতে নানা রংএর লাইট জ্বালিয়ে রাখা। চারপাশে কয়েকশত প্রজাতির নানা মাধুর্যপূর্ণ ফুলের গাছ। তবে গোলাপ ফুলের পরিসংখ্যানটা যেন একটু বেশি। নিশ্চিত এই বাড়ির বিশেষ এক অতন্ত্য সৌখিন ব্যক্তির সান্নিধ্যেই এই ফুল- প্রকৃতির অপরুপ সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে।

বিশাল বড় এরিয়া ঘুরে বাড়ির সদর দরজার দিকে এগোতে এগোতেই কেনীথের কানে হঠাৎ দূর থেকে আসা মনোমুগ্ধকর কন্ঠে গাইতে থাকা গানের স্বর ভেসে আসতে লাগলো। কেনীথের বুঝতে বাকি রইলো না গানটা কে গাইছে। কিন্তু সে একবারও জানালার গ্লাস নামিয়ে বাহিরে তাকিয়ে সেই গানের কন্ঠস্বরের মালিককে খোঁজার বিন্দু পরিমাণও আগ্রহ দেখালো না বরং সেভাবেই নির্বিকারে চুপচাপ বসে রইলো। অথচ যত বাড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছে ততই তার কানে গানের প্রতিটা শব্দ প্রতিনিয়ত কর্ণে প্রবেশ করছে।

He is a villain by the devil’s law
He is a killer just for fun, fun, fun, fun
That man’s a snitch and unpredictable
He’s got no conscience, he got none, none, none, none

All I know, should’ve let go, but no
‘Cause he’s a bad boy with a tainted heart
And even I know this ain’t smart
But mama I’m in love with a criminal……..

—————-
—————-
And he’s got my name
Tattooed on his arm his lucky charm
So I guess it’s okay he’s with me
And I hear people talk
Trying to make remarks keep us apart
But I don’t even hear
I don’t care
‘Cause mama I’m in love with a criminal
And this type of love isn’t rational, it’s ….

ঠিক বিশাল বড় সোনালী রংএর সদর দরজার সামনে কেনীথের গাড়িটা সহ বাকি গাড়ি গুলোও থেমে গেলো। আর মূহুর্তেই কিছু কালো রংএর ফর্মাল ড্রেসআপে ভূষিত একজন লোক এসে গাড়ির দরজা খুলে দিলো অন্যদিকে বাকি লোকগুলো গিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে সদর দরজা পর্যন্ত লাইন ধরে কেনীথের জন্য পথ তৈরি করে দিলো।

কেনীথ গাড়ি থেকে নেমে নিচে পা রাখতেই খেয়াল করলো তার পায়ের নিচে লাল গালিচা বিছিয়ে রাখা একদম সদর দরজার ভেতর পর্যন্ত। এটা দেখে কেনীথের মাঝে কোনো হেলদোল হলো না।বরং ছোট করে এক দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। তবে এর মাঝে সে এটাও খেয়াল করেছে। তার গাড়িটা বাড়ির সামনে আসতেই সেই সুমধুর কন্ঠস্বরে গাওয়া গান সম্পূর্ণ না হয়েই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কেনীথ নিজের কালো গ্লাসেস্ টা না খুলেই মাথাটা হালকা উপরে তুলে ছাঁদের দিকে তাকাতেই ছাঁদের মৃদু আলোয় থাকা এক ঝাপসা ছায়া মূহুর্তেই সরে গিয়ে কেনীথের চোখের আড়াল হলো।

কেনীথ সেদিকে বেশিক্ষণ না তাকিয়ে থেকে সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। বাড়ির দিকে কিছুরা এগিয়ে যেতেই চোখে পড়লো ষাটোর্ধ এক ফর্সা নারী। যার পড়নে বড় এক সাদা রংএর গাউন। গলায় মূল্যবান প্লাটিনাম আর ডায়মন্ডের কারুকার্য শোভিত লকেট স্ট্রিং সাথে হালকা একটা স্কার্ফ জড়ানো। চুলগুলো হালকা বাদামী বর্ণের যা এমনিতেই কার্ল ব্রাশ করে খুলে রাখা।

কেনীথ সেই নারীটির কাছে যেতেই তিনি কেনীথকে উচ্ছ্বাসের সহিত জড়িয়ে ধরলেন। তার মতো এক শক্তপোক্ত কঠিন হৃদয়ের নারীর চোখেও আজ জল টলমল করছে তা শুধু এতোবছর পর কেনীথের একবার মুখদর্শন করে। সেই শুধু জানে এটা তার কত প্রতীক্ষা আর প্রত্যাশার ফল।

নারীটি কিছুটা কান্নারত সুরে কেনীথকে রাশিয়ান ভাষায় বলতে লাগলো,

“Ty vspomnil(a) spustya stol’ko vremeni? Ne pomnite nashi slova ni razu? /”টি ভস্পোমনিল(আ)/ভস্পোমনিলা স্পুস্ত্যা স্তোল’কো ভ্রেমেনি? নে পম্নিতি নাশি স্লোভা নিই রাজু?”

(কতগুলো বছর পর তোমাকে দেখার সৌভাগ্য হলো। আমাদের কথা কি তোমার একবারও মনে পড়ে না!)

উত্তরে কেনীথ শুধু নির্বিকারে বললো,

“Ty pozval, i ya prishol” / “টি পজভাল, ইয়া প্রিশোল। ”

(তুমি ডেকেছিলে, তাই এসেছি।)

কেনীথের কথা শুনে তিনি আর কিছুই বললেন না। বরং নিজেকে শক্ত করে রাশিয়ান ভাষাতেই বললো,

—“ভেতরে এসো! ”

এই নারীটির নাম কাতেরিনা লুসিয়া। সম্পর্কে তিনি কেনীথের নানী। কেনীথ বাংলা, ইংরেজি, রাশিয়ান ভাষা সহ আরো কয়েক ধরনের ভাষা জানলেও লুসিয়া দুই একটা শব্দের অর্থ ব্যতীত বাংলা জানে না। যেকারণে পুরো সময়টাই কেনীথ আর লুসিয়াস সংলাপ রাশিয়ান ভাষাতেই হয়ে থাকে।

লুসিয়ার কথা মতো কেনীথ ভেতরে প্রবেশ করতেই সে আশেপাশে না তাকিয়ে সোজা জিজ্ঞেস করলো,

—“আগে ফ্রেস হয়ে আসি! তারপর কথা হচ্ছে। ”

লুসিয়াও মুচকি হেসে বললো,

—“ঠিক আছে! ”

প্রশস্ত সম্পূর্ণ ফ্লোর চকচকে মার্বেল পাথরে মোড়া, যা গাঢ় স্বর্ণালী এবং র/ক্ত লাল রঙের মিশ্রণে তৈরি। চারপাশের দেওয়াল গুলোতে নান্দনিক শিল্পকর্ম এবং আধুনিক বিমূর্ত পেইন্টিং সুন্দর ভাবে সাজিয়ে রাখা। প্রধান লিভিং রুমে বিভিন্ন ধরনের মডার্ন অ্যাকসেন্ট ফার্নিচার, সুদূরপ্রসারী লাইটিং সিস্টেম এবং ডিজাইন বস্তু এই বাড়ির অভ্যন্তরীণ স্টাইলকে একটি আধুনিক ও সুকণ্ঠ অভিজ্ঞতায় পরিণত করেছে। এছাড়া বাড়ির ঠিক মাঝখানে লাল-সোনালী আর সাদা- গাঢ়া লাল রংএর আবরণের আচ্ছাদিত বিশাল এক সিঁড়ি।

এতো কিছুর পরও কেনীথের এই পরিবেশটা মোটেও পছন্দ হলো না। যে মানুষটা সবসময় কালো আঁধারে থাকতেই বেশি ভালোবাসে সে কিভাবে এইসব রংচঙে আলোকে ভালোবাসবে। তবে একটা সময় এই বাড়িটাও তার পছন্দ মতই সাজানো ছিলো যা এখন আর আগের মতো কোনো অংশেই নেই। আর এসব কার কল্যানে করা হয়েছে তা কেনীথের ভালো করেই জানা।

কেনীথ সিঁড়ির কাছ গিয়ে উপরে উঠতে গিয়েও আবার থেমে যায়। এবং পিছনে ফিরে লুসিয়াকে বলতে লাগে,

—“বাবুশকা! আমার রুমের চাবি……!”

(রাশিয়ান ভাষায় বাবুশকা অর্থ নানী অথবা দাদী)
কেনীথের কথা শেষ হওয়ার আগেই পেছন থেকে কেউ সুমধুর কন্ঠে বললো,

—“চাবির কি প্রয়োজন। আমি তো তোমার রুম নিজ হাতে গুছিয়ে রেখেছি!”

কথা শোনা মাত্রই কেনীথ পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলো অল্প বয়সী এক যুবতী মেয়ে সিঁড়ির উপর প্রান্তে মুখে এক প্রানবন্ত বিস্তৃত হাসি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইছে। পরনে বড়সর গাঢ় লাল রং-এর প্লেইন গাউন। তবে কোনো আলাদা স্কার্ফ পড়া নেই। মাথার গাঢ় লাল টুকটুকে প্রাকৃতিক হালকা কার্লি চুলগুলো সুন্দর ভাবে চিরুনি করে খুলে রাখা। গায়ের রং ধবধবে ফর্সা। মিথলজির সেই সবচেয়ে সুন্দরী রাজকুমারীর চেয়ে কোনো অংশে কম নয় বরং তার চেয়ে আরো বেশি।

কেনীথ ভালো করে খেয়াল করলো মেয়েটির হাতে একগুচ্ছ র/ক্ত লাল রাঙ্গা গোলাপ। দেখে মনে হচ্ছে এগুলো এই বাড়ির বাগানেরই।

কেনীথ মেয়েটির কথায় পাত্তা না দিয়ে আবারও সামনে ঘুরে লুসিয়াকে বললো,

—“আমি বলেছিলাম আমার রুমে যেন কেউ কখনো না যায়। তবে…….

কেনীথের এই কথাটাই যেন সেই প্রানবন্ত হাসিটাকে মূহুর্তেই নিভিয়ে দিলো। এদিকে লুসিয়া একবার পেছনে থাকা মেয়েটাকে দেখে অপ্রস্তুত সুরে কেনীথকে বলতে লাগলো,,

—“আ….তুমি প্রায় অনেক বছর ধরেই এই বাড়িতে আসোনি। নিয়মিত পরিচর্যা না করলে তো রুম আর রুম থাকবে না, পুরো ভুতের ঘরে…….

কেনীথ কিছুটা গম্ভীর সুরে বললো,

—“যাই হোক না কেনো, তা পরবর্তী আমি বুঝে নিতাম!”

কেনীথ কথাটুকু বলে আর একমুহূর্তেও দেরী না করে সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে গেলো। অথচ শেষ প্রান্তে তার জন্য শত প্রতীক্ষা প্রত্যাশায় সেজেগুজে একগুচ্ছ গোলাপ নিজ হাতে সাজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে সে আর একটিবারও ফিরে তাকানোরও প্রয়োজন মনে করলো না।

কেনীথ চলে যেতেই মেয়েটি লুসিয়ার দিকে তাকিয়ে কিছুটা ছলছলে চোখেই মুচকি হাসি হাসলো। ওদিকে লুসিয়ারও বুঝতে বাকি রইলোনা মেয়েটা আবারও অনেকটা কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু সে আর কি করবে। জোর করে তো কিছু হয় না। তার মতো রাশিয়ার এক নামকরা মাফিয়াও তার নাতী কেনীথের কাছে নির্বাক।

কেনীথ হলো লুসিয়ার একমাত্র মেয়ের একমাত্র ছেলে। এই অদ্ভুত নামটা মূলত সেই দিয়েছিলো। লুসিয়ার স্বামী একজন রাশিয়ার নাম করা মাফিয়া ছিলো কিন্তু অনেক বছর আগেই প্রকৃতির নিয়ম অনুসারেই তাকে পরলোকগমন করতে হয়। এরপর তার স্বামীর বিশাল এই মাফিয়ার সাম্রাজ্যকে আরো প্রশস্ত করে তোলে লুসিয়া নিজেই। কারণ সে কোনো সাধারণ ঘরের মেয়ে নয় বরং সে নিজেও এক মাফিয়ার মেয়ে।

অন্যদিকে সেই গাঢ় লাল রাঙ্গা চুলের রাজকীয় কন্যা হলো লুসিয়ার একমাত্র ছেলের একমাত্র কন্যা। মেয়েটির নাম আলেসিয়া ম্যারিনা রোজ । কিন্তু মেয়েটা রোজ নামে কাউকেই ডাকতে দেয় না। তাকে এই নামে ডাকার অনুমতি শুধু সে একজনকেই দিয়েছে আর আজ সেই ব্যক্তিই কিনা এতোগুলা বছর পর তাকে দর্শন দিয়েও অবজ্ঞা করলো। এই নিয়ে রোজ অনেকটা কষ্ট পেলেও নিজেকে সামলে নিয়েছে। এতোবছর পর যে কেনীথের দর্শন পেয়েছে এটাই তো অনেক।

রোজের মা কোনো রাশিয়ান নয় বরং স্কটল্যান্ডের এক অপরুপ সুন্দরী ছিলো সঙ্গে একটি সাধারণ ঘরের মেয়ে। কিন্তু রোজের বাবার সেই সাধারণ মেয়েকেই ভালোবাসে এবং পরবর্তীতে বিয়ে করে ফেলে। তবে এই ভালোবাসা আর দীর্ঘস্থায়ী হয় না। রোজের জন্মের পর থেকেই ওর মা অসুস্থ হয়ে যায় এবং কিছু মাস পর সেও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে।

এই মা হারা মেয়েটার কপালে বাবার আদরটাও বেশিদিন জোটেনি। শ*ত্রুপক্ষের কু*নীতির চক্রান্তে তাকেও অল্প বয়সে জীবন ত্যাগ করতে হয়। এরপর বাকি জীবনটা দাদী লুসিয়ার কাছেই বড় হয়। তবে সে আর সবার কিংবা পারিবারিক লোকদের মতো কোনো কঠিন অথবা বি**ষাক্ত হৃদয়ের মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারেনি।

প্রচন্ড নরম মনের মেয়ে সে। রা*গারা*গি চেঁ*চামে*চি কোনো কিছুই তার মাঝে ফুটে ওঠে না। সবসময় চেষ্টা করে নিজেকে প্রানবন্ত আর হাসিখুশি রাখার। দিন রাতের বেশির ভাগ সময়ই চলে যায় নিজ হাতে গড়ে তোলা বিশাল ফুলের বাগান, বাগানে বেড়াতে আসা পাখি আর প্রজাতির সাথে গান গেয়ে। কেনীথের গান গাওয়াটা দেখেই রোজ নিজেও গানের প্রতি আরো বেশি আকৃষ্ট হয়েছে।

তার জীবনে কেনীথের আগমন ছিলো ক্ষনিকের জন্য। যদিও সময়টা কয়েক বছরের তবুও রোজের কাছে সময়টা ক্ষনিকেরই। এই পুরো সময়টাতে সে কেনীথের উপর প্রচন্ড রকমের আসক্ত হয়ে পড়ে। যার রেশ কেনীথের চলে যাওয়াতে কমেনি বরং আরো শতগুণ বেড়ে গিয়েছে।

কাল রাতে শুধু একবার শুনেছে কেনীথ এখানে আসছে আর এতেই বেচারীর খাওয়া দাওয়া, ঘুম সব উড়ে গিয়েছে। সারারাত উত্তেজনায় পাগলের মতো করে আর ঘুমটা আসনি। কেনীথের রুম থেকে শুরু করে, ওর জানামতে কেনীথের সকল পছন্দের খাবার নিজ হাতে বানিয়েছে। তার জীবনের সবটা জুড়ে শুধু কেনীথই। কিন্তু কেনীথ তাকে কখনো তার মতো করে দেখবে কিনা এই নিয়ে তার মনে প্রগাঢ় সংশয়।

কেনীথ তো তাকে ছোট থেকে নিজের মামাতো বোন ব্যতীত অন্যকিছু হিসেবে কখনোই হয়তো ভাবেনি। কিন্তু সে যদি শেষমেষ কেনীথকে না পায় তো সে কি করে বাঁচবে।

এমনটা নয় যে সে কেনীথ আর তার পরিবার সম্পর্কে কিছুই জানে না।সে জানে, সে রাশিয়ার এক বড় মাফিয়া পরিবারের মেয়ে অন্যদিকে সে যাকে নিজের মন দিয়ে বসে রেখেছে সে শুধু একজন রকস্টার নয় বরং সেও এই মাফিয়াদের চেয়ে আরো বেশি ভ*য়ংকর।
এই বিষয়গুলো যেহেতু তার পছন্দ নয় তাই সে কখনোই না তার পরিবারের কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করেনি। না নিজেকে এসবের মাঝে জড়িয়েছে। সে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে নিজেকে এসব থেকে দূরে রাখার অন্যদিকে লুসিয়াও নিজের নাতনীর ইচ্ছে পূরণে কোনো বাঁধা দেয়নি।

রোজকে একটি স্বাভাবিক মেয়ে হিসেবেই বাঁচতে দিয়েছে যদি তা এই বিশাল বড় প্রাচীরে ঘেরা এক বন্দী রাজকন্যার মতো করে। কারণ তার মতো মেয়ের এই প্রাচীরের বাহিরে যাওয়া মানে শত্রুর কুনজরে মূহুর্তেই শেষ হয়ে যাওয়া। যা লুসিয়া কখনো হতে দিবে না।এজন্য তাদের পেশাগত কর্মকাণ্ডের কোনো বিষয়ও কখনো রোজকে জানানো হয় না।আর আজ যে কেনীথ ঠিক কোন উদ্দেশ্যে এখানে এসেছে তাও রোজকে জানানো হয়নি।

কেনীথ রুমে ঢুকেই কিছুক্ষণ আশপাশটা তাকিয়ে দেখে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। যা ভেবেছিলো তাই, সে যেভাবে এই ঘর সাজিয়ে গিয়েছিলো তার ছিটেফোঁটার আবরণও আর এখানে নেই। শেষে তার ঘরটাকেও ছাড়েনি।

বাড়ির মতো পুরো রুম রোজ নিজের ইচ্ছে মতো একদম গাঢ় স্বর্ণালি আর গাঢ় লাল রং-এর সাজিয়েছে। সাথে লাল আর কালো রংএর গোলাপ ফুল গুচ্ছ বানিয়ে ফুলদানি গুলো একদম পূর্ণ করে সাজিয়ে রেখেছে। আবার বারান্দাতেও গোলাপের গাছ নজরে আসছে।

কেনীথেরও রোজের মতো র/ক্ত লাল রং টা বেশি পছন্দ করলেও সে সবসময় সাদামাটা পছন্দ করে আর তার পছন্দের কালারে কালোটাই মূখ্য। এদিকে রোজের সাথে পুরোটা মিললেও সে কালো নয় বরং সোনালীটাকে লালের সাথে বেছে নিয়েছে। এই কালার কম্বিনেশনটা তার একটু নয় বরং অনেক বেশি পছন্দের। সবসময় সাদামাটা গাউন আর সাজসজ্জাতে থাকলেও তার মাঝে এক আভিজাত্যর ঝলক সবসময় বিরাজ করে।

কেনীথ বিষয়টিকে বেশি পাত্তা দিলো না।যেহেতু কাজ শেষ হলেই চলে যাবে তাই এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। কেনীথ দেরী না করে সোজা বাথরুমে চলে গেলো সাথে মনে মনে ভাবতে লাগলো, ভাগ্যক্রমে লালের সাথে কালো গোলাপও যে রেখেছে তাই অনেক।

___________________

ধান্দাতে জামা কাপড় না নিয়েই রুমে ঢুকে গিয়েছে বিধায় শুধু টাওয়াল পেঁচিয়ে রুমে আসতে হলো কেনীথকে। রুমে ঢুকে কাবার্ড খুলে টিশার্ট বের করতে গিয়ে হঠাৎ চমকে উঠলো কারো চিৎকারের আওয়াজ শুনে।

ত্বরিৎ ভ্রু কুঁচকে পেছনে তাকিয়ে দেখলো বারান্দার দরজার কাছে রোজ দুহাত তুলে খিঁচে নিয়ে, চোখমুখ কুঁচকে বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে।
এটা দেখে কেনীথ বিরক্তি নিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই রোজ বলতে লাগলো,

—“ইহ…..!!!তোমার লজ্জা বলতে কিছু নেই!”

কেনীথ কিছু বললো না বরং চোখমুখ স্বাভাবিক করে গম্ভীর কন্ঠে বললো,

—“এখানে কি করছিস তুই।”

রোজ চোখমুখ কুঁচকে থাকা অবস্থাতেই বললো,

—“তুৃমি জামা পড়ো আগে!”

কেনীথ ধমক দিয়ে বললো,

—“তুই রুম থেকে বের হ আগে। ”

—” তুমি না সরলে এখন রুম থেকে বের হতে গেলে সমস্যা হবে। আর আমার তোমার সাথে কিছু কথা আছে। প্লিজ তাড়াতাড়ি জামা কাপড় পড়ো। ”

কেনীথ চরম বিরক্তি নিয়ে বললো,

—“তাহলে উল্টো ঘোর গাধী! ”

—“হা….ওহ হ্যাঁ!”

কেনীথের কথার অর্থ বুঝতেই রোজ চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেই উল্টো ঘুরলো। তবে কেনীথ কালো প্যান্ট পড়ে যেই না কালো টিশার্টটা পড়তে যাবে ওমনিই উল্টো দিকে ঘুরে থাকা রোজ বলতে লাগলো,

—“ওয়েট! ওয়েট! তুমি টিশার্টটা পড়ো না! ”

কেনীথ ভ্রু কুঁচকে বললো,

—“কেনো তুই দেখবি! ”

রোজ চোখমুখ আরেকটু কুঁচকে বললো,

—“ছিহ!! আমি এমন না। ”

—“তাহলে কি চাস। ”

—“কিছু না! তুমি ওই বেডে রাখা টিশার্টটা পড়ো, প্লিজ। ”

কেনীথ ভ্রু কুঁচকে বেডের কাছে গিয়ে দেখলো লাল রং-এর একটা সিল্কের টিশার্ট সাথে সোনালী কারুকার্য করা। জিনিসটা হাতে নিয়েই কেনীথের চোখমুখ প্রচণ্ড ভাবে কুঁচকে গিয়ে বললো,

—“এটা কি! ”

এদিকে রোজা খুশি মনে বলতে লাগলো,

—“এটা আমি তোমার জন্য পছন্দ করেছি। সুন্দর না! ড্রেসটা এমনিতেই নরমাল ছিলো। পরে আমি সোনালী সুতো দিয়ে কাজ করে দিয়েছি। ”

উল্টো দিকে ঘুরে থাকা রোজের দিকে কেনীথ বিস্মিত চোখে তাকালো। তবে কোনো আওয়াজও করলো না।এদিকে কিছুক্ষণ সময় হওয়ার পরও যখন রোজ দেখলো যে কেনীথ কিছু বলছে না তখন যেই না পিছনে ঘুরতে গিয়েছে ওমনি মুখের উপর কিছু পড়তেই চমকে উঠলো। জিনিসটা মুখ থেকে সরিয়েই হাতে নিয়ে দেখলো তার পছন্দের সেই টিশার্ট। আর ওদিকে কেনীথ কালো প্যান্ট আর টিশার্ট পড়ে, পকেটে দুহাত গুঁজে সটানভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

রোজ হঠাৎ বুঝতে পারলো না কি হলো! তবে কিছুটা মনে মনে আন্দাজ করলো কেনীথের হয়তো জামাটা পছন্দ হয়নি। রোজ কিছু বলতে যাবে তার আগেই কেনীথ বললো,

—“তুই এটা কোথায় পেয়েছিস!”

—“আ…….

—“তুই আদোও জানিস এটা টিশার্ট নাকি অন্যকিছু! ”

রোজ এবার কিছুটা অবাক হয়ে জিনিসটা হাতে নিয়ে ঘুড়িয়ে পেছিয়ে দেখার পর বললো,

—“এটা টিশার্ট না! আমার তো দেখে টিশার্ট-এর মতোই লাগছিলো। এটা টিশার্ট না হলে এটা কি? ”

—“এটা একটা অসম্পূর্ণ ট্রেডিশনাল ড্রেস। যেটাকে তুই আলট্রা ডিজাইন করে বিয়ের ড্রেস বানিয়ে ফেলেছিস। আর যাই হোক, তুই এটা ভাবলি কি করে যে আমি এটা পড়তে যাবো। তোর চয়েস এতো খারাপ হয়েছে জানা ছিলো না।”

এবার আর রোজ মন খারাপ না করে নিজেকেই মনে মনে বকাবকি করতে লাগলো। না জেনে এতো বড় গাধামী!

কেনীথ আর কিছুই বললো না। সে রুম থেকে বের হতে নিলে রোজ তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নিজের হাতে বানানো গোলাপ ফুলের তোড়াটা এনে কেনীথের সামনে এসে দাঁড়ালো। তখন ভয়ে আর মন খারাপ হয়ে যাওয়ায় জিনিসটা দিতে পারেনি। এবার একবার ঢোক গিলে বিস্তৃত হেসে ফুলের তোড়াটা কেনীথের দিকে এগিয়ে দিলো,

—-“অপ্পা! ইট’স ফর ইউ।

কেনীথ ফুলের তোড়াটা না নিয়ে কপাল কুঁচকে কিছুটা তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,

—“অপ…পা! রুশ, স্কটস,গ্যালিক,ইংলিশ ছেড়ে এখন কোরিয়ান? ”

কেনীথের কথা শুনে রোজ মুচকি হেসে বললো,

—“আমার আর কাজ কি! নতুন কিছু ট্রাই করছি। ইউ নো হোয়াট! আমি বাংলাও কিন্তু অনেক কিছুই পারি।আ….. লাইক, ভাইয়া! ইট’স ফর ইউ। ”

বলেই ফুলের তোড়াটা আবারও কেনীথের দিকে এগিয়ে দিলো। এদিকে কেনীথ ওর কার্যকলাপ শেষে শুধু একটা বাঁকা মুচকি হাসলো। আর এই হাসিই যেন রোজের মনে আবারও নতুন প্রত্যাশার জন্ম দিতে লাগলো। সে লুসিয়ার কাছে কেনীথের সম্পর্কে এটা ওটা জিজ্ঞেস করে জেনেছে যে কেনীথ নাকি আগের মতো কথা বলে না। এই নিয়ে তার অনেক মন খারাপও হয়েছে। যে মানুষটার সাথে নানা গল্প আড্ডা দিয়েই তার দিন কাটতো সেই এখন নাকি কথাই বলে না।তাহলে এই মানুষটার সাথে বাকি জীবনটা সে কি বোবার মতো কাটাবে!

এদিকে রোজের ভেতরে জমতে থাকা আশ্বাসের অর্ধেকটা ভাঙ্গলো যখন কেনীথ বললো,

—“আলেসিয়া!তুই……

মূহুর্তেই রোজের মুখখানা থমথমে হয়ে গেলো। ত্বরিত কেনীথের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,

—“ওয়েট! এটা কি বলে ডাকলে আমায়? ”

মেয়েটার চোখে কন্ঠস্বর একদম কাটকাট হয়ে গিয়েছে। এতোটুকু বলতেই যেন প্রচন্ড কষ্ট হয়েছে তার। কেনীথ জানে সে কি করেছে তাই নির্বিকারে বললো,

—” সবাই যা বলে তাই! ”

মূহুর্তেই মেয়েটার কষ্টের পাশাপাশি যেন রাগও হতে লাগলো। কিন্তু সহজে রে*গে যাওয়ার মেয়ে তো সে নয়। তবে কেনীথ যা করেছে তাতে তো তার ভয়ংকর রাগ হচ্ছে যদিও তা কেনীথের সামনে প্রকাশ করার সাহস হবে কিনা জানা নেই।

ফর্সা ত্বকের রাগ আর কষ্টে মিশ্রিত লাল হয়ে যাওয়া মুখটায় ততক্ষণে বলতে লাগলো,

—“সবাই আর তুমি যে এক নও তা কিন্তু তুমি ভালো করেই জানো। আমাকে রোজ বলে ডাকার অধিকার শুধু আমি তোমাকে দিয়েছি কারণ আমার এই নামটা তুমি রেখেছিলে। বাগানের এতো ফুলের মধ্যে বেশিরভাগই গোলাপ আর এর কারণটাও তুৃমি। ”

—“কারণটা আমি হই কি করে।আমি কি কখনো বলেছিলাম এসব করার জন্য! ”

রোজ নিজের রাগ কন্ট্রোল করে বললো,

—“মজা করছো আমার সাথে! ভুলে গিয়েছো তুমি,ব্লা*ড রোজ তোমার বেশি পছন্দ, তুমিই আমাকে বাগানে এসব গাছ লাগানো শিখিয়েছিলে। এতোগুলো বছর শুধু তোমার স্মৃতিতেই আমি এসব করেছি। ”

কেনীথ মৃদু বাঁকা হেসে বললো,

—“সেসব ছোটবেলার ঘটনা ছোটবেলাতেই শেষ হয়ে গিয়েছে। এখনও ওসব নিয়ে মাতামাতি করলে সেটাকে বাচ্চামো বলে।”

—“আমার এসব করা তোমার বাচ্চামো মনে হয়!”

এবার রোজের চোখে পানি চকচক করছে। ফর্সা নাকটা লাল হয়ে গিয়েছে। অথচ কেনীথের এসব নিয়ে কোনো হেলদোল হলো না বরং নির্বিকারে বলতে লাগলো,

—-“আলেসিয়া! তুই বড় হচ্ছিস,যথেষ্ট বুদ্ধি হয়েছে। সঙ্গে এই পরিবারের সত্য পরিচয়টাও নিজের মধ্যে কখনো গড়ে তুলতে চাস নি। সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকতে চেয়েছিস এসব থেকে। এতে কেউ তোকে কখনো কোনো বাঁধাও দেয়নি। কিন্তু এছাড়াও তুই যেটা এতো বছর ধরে তীব্র প্রতীক্ষায় চেয়ে আসছিস তা কখনোই সম্ভব নয়। কারণ আমি চাই না এমন কিছু হোক।”

—“কেনো সম্ভব নয়! তোমার আমার ধর্ম ভিন্ন তাই। তোমার ধর্ম ভিন্ন হলেও তো তুমি কোনো ধর্মেই মানো না। মানলে কি আর সবার মতো অন্যায় করতে। এরপরও যদি বলো তবে আমি তোমার কথা মতো সব কিছু করবো।”

—“ব্রেইন লেসের মতো কথা বলিস না। কেনো সম্ভব নয় তার উত্তর তুই জানিস।”

রোজ ঠোঁট কামড়ে নিজের কান্না আর রাগকে আঁটকে কিছুক্ষণ কেনীথের দিকে তাকিয়ে রইলো। এরপর নিজেকে স্বাভাবিক করে ঠোঁট ভিজিয়ে কিছুটা জিজ্ঞেসা সূচক ভাবে বলতে লাগলো,

—” নিশ্চয় তার জন্যই আমি যা চাইছি তা কখনোই সম্ভব নয়। তাকে তুমি খুঁজে নিয়েছো, তাই না? ”

কেনীথ শুধু মুচকি হাসলো।

—“আমি তাকে খুঁজতে যাইনি, সে নিজেই আমার কাছে নিজেকে ধরা দিয়েছে।

এবার রোজও মুচকি হাসলো। গলায় মনে হয় অনবরত কাঁ*টা বিঁধ*ছে। নিজের উপর অনেকটা তাচ্ছিল্য করেই বললো,

—“লাকি গার্ল! লাস্ট একটা কোশ্চেন জিজ্ঞেস করবো, প্লিজ উত্তরটা দিও। তুমি… তুমি তাকে ভালোবাসো, তাই না! প্রচন্ড রকমের ভালোবাসো…….

এইটুকু বলেই আর বাকিটা বলার সামর্থ্য তার হলো না। ভেতর থেকে গলা সম্পূর্ণ চেপে ধরছে,কষ্ট দানাগুলো যেন এখন তার গলার স্বরকেও কেঁড়ে নিয়েছে।

অন্যদিকে কেনীথ ওর অবস্থায় একটু নিজের সত্তা থেকে নড়চড় হলো না।অকপটে বলতে লাগলো,

—“ইউ নো হোয়াট! আ’ম এ হার্ট লেস পারসোন। এন্ড শি ইজ নট আ লাকি গার্ল; কজ শি ইজ দ্য মোস্ট আনলাকি গার্ল ইন দ্য ইউনিভার্স।

রোজ হয়তো কেনীথের কথার অর্থটা এই মূহুর্তে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। সে এই মূহুর্তে এসব ছেড়ে কেনীথকে অকপটে জিজ্ঞেস করলো,

—“তবে কেনো এসেছো এখানে? আমাকে আবারও কষ্ট দিতে। তুমি না এলে তো নিজেকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে নিতে পারতাম। তবে কেনো এলে আমায় কষ্ট দিতে। ”

—“আলেসিয়া! সুখ, কষ্ট, লাভ, হোয়াট এভার! এসব অনুভতি প্রকাশিত হয় হৃদয় থেকে।তেমনি কাউকে কষ্ট দিতে হলেও হৃদয়ের প্রয়োজন। যার হৃদয় বহু আগেই কুৎ*সিত কালো আধারে ঢেকে গিয়ে বিষা*ক্ততা, পৈশা*চিকতা, হিং*স্রতায় পরিণত হয়েছে তার মাঝে থেকে এসব অনুভূতি প্রকাশ কিভাবে ঘটবে!

হৃদয় হতে হয় তোর মতো। যে লালকে ভালোবাসে কেননা সে লাল রং-কে বোঝে ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে।
যে কালো দুনিয়া থেকে সরে গিয়ে সুন্দর সব স্বর্ণালি অনুভূতি দিয়ে নিজের জগৎ সাজিয়েছে। এতো সুন্দর একটা সুসজ্জিত জগৎ-এ এমন কালো কুৎসিত হৃদয়ের মানুষের প্রবেশ মানেই ধ্বং*সয*জ্ঞ!

মূহুর্তেই সব সুন্দর সুন্দর অনুভূতির ধ্বং*স হয়ে তা স্বর্গ হতে নর*কে পরিণত হবে। তুই চাস তোর সাথে ঠিক এমন কিছুই হোক!”

কেনীথের কথাগুলো শুধু পলকহীন ভাবে রোজ শুনে গেলো তবে কিছুই বললো না।অন্যদিকে কেনীথ আবারও বললো,

—“তুই লাল আর স্বর্ণালিকে ভালোবাসিস নিজের স্নিগ্ধ অনুভুতি গুলোকে সোনার মতো উজ্জ্বল মূল্যবান ধাতু দিয়ে আবৃতর লক্ষে। তুই জানিস তোর অনুভূতির মূল্য সবকিছুর উর্ধ্বে। আর আমি লাল-কালো ভালোবাসি কারণ লাল মানে আমার কাছে প্র*লয়, ধ্বং*সযজ্ঞের, হিং*স্রতা আর তীব্র ক*ষ্টের পরিনাম র*ক্ত হিসেবে। যে রক্তে গা ভাগিয়ে আমি শান্তি পাই সেখানে তোর মতো স্নিগ্ধ অনুভুতির অধিকারী মানুষেরা ঘৃণায় নাক ছিটকায়।
আর এমন পি*শাচের কালো আধার ব্যতীত অন্যকিছু ভালোবাসবে না এমনটাই স্বাভাবিক।
আমি তোকে শুধু এতোটুকুই বুঝাতে চেয়েছি যে তুই আর আমি এক নই। আমি তোকে শুধু বোন হিসেবে দেখেছি আর ভবিষ্যতেও দেখবো। যত তাড়াতাড়ি নিজেকে বিষয়টি বুঝাতে পারবি ততই সেটা তোর জন্য মঙ্গল হবে।”

—“যদি তুমি হার্ট লেসই হও তবে আমাকে এতো সুন্দর করে এক্সপ্লেইন কেনো করতে যাচ্ছো।হার্ট লেসরা তো তাদের সব কথাতেই কষ্ট দেয়। এদের কোনো সাহিত্যেক জ্ঞান থাকে না।আবেগ, অনুভুতি কিছুই থাকে না।তবে তুমি কিভাবে এতোকিছু জানো বলো! হার্ট লেসরা কখোনো অন্যের মন রাখতে জানে না। তারা শুধু কষ্টই দিতে পারে। কে তার ভাই, বোন, আত্নীয় এসব তারা দেখে না। তবে তুমি কেনো আমাকে সরাসরি কষ্ট না দিয়ে নিজের বোন বলে ছাড় দিচ্ছো। এখনোও বলবে তুমি হার্ট লেস।

কেনীথ আবারও বাঁকা হেসে বললো,

—“অতিরিক্ত উত্তেজনা ভালো না।তুই বলছিস আমার কথায় তুই কষ্ট পাচ্ছিস না অথচ আমি তোকে রোজ না ডেকে আলেসিয়া বলে ডেকেছি আর এই সামান্য কথাতেই এতোটা কষ্ট পেয়েছিস যে এখন কি থেকে কি বলছিস তা নিজেও জানিস না।যদি এই কষ্টের পরিমাণটা আরেকটু বাড়িয়ে দেই তবে বাঁচতে পারবি না তো! ”

এবার মাথা নিচু করে পুরোটা শুনেই রোজ মাথা উঁচু করলো। ফোলা ফোলা ভেজালো চোখে তীক্ষ্ণ কন্ঠে কেনীথকে বললো,

—“চলে যাও তুমি! আর কখনো আসবে না এখানে। আর কখনো দেখতে চাইনা তোমার মুখ। আমি ম*রে গেলেও তুমি আসবে না, কখনো না! ”

কেনীথ রোজের দিকে তাকিয়ে ওর তীব্র কষ্টে জড়ানো কথাগুলো শুনে মুচকি হেসে বললো,

—“কাজে এসেছিলাম, কাজ শেষ হলে চলে যাবো। ভবিষ্যতে একেবারেই যে এখানে আসা হবে না, এমন নিশ্চিয়তা দিতে পারছি না। প্রয়োজন পড়লে আবার আসবো তবে তুই না চাইলে তোর সাথে আমার দেখা আর কখনো হবে না।”

রোজ আর কিছু বললো না ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ছলছল করে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কেনীথ মুচকি হেসে ওর হাত থেকে ফুলের তোড়াটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দেখার পর তা সামনের এক ফাঁকা ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখলো। এটা দেখে যেন রোজ বাদ বাকিটুকুও ভেঙ্গে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। অন্যদিকে কেনীথ রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে লাগলো এবং যেতে যেতেই বলতে থাকলো,

—“কেউ যদি আমার জন্য নিজের মূল্যবান জীবন শেষ করে দিতে চায় তবে আমি কিন্তু কষ্ট পাবো না।”

#চলবে

#একজোড়া_আগুন_পাখি
®অরনীতা তুশ্মি (#তুশকন্যা)

পর্ব→১৪

(প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য)

—“এইসময় কোথায় যাচ্ছো! খাবার খাবে না?”

বাড়ি থেকে বের হতে নিলেই হঠাৎ পেছন থেকে লুসিয়ার কন্ঠস্বর শুনে কেনীথের পা জোড়া থেমে যায়। কেনীথ পিছনে ফিরে তাকিয়ে বললো,

—“কাজ ফেলে রেখে লাভ নেই। খাবারে মিষ্টি রেখো! এসে মিষ্টি মুখ করতে হবে। ”

কথা শেষ করে কেনীথ আর এক মূহুর্তেও দাঁড়ানোর প্রয়োজন মনে করলো না।ত্বরিত বাড়ি থেকে বের হতে নিলে পিছন থেকে আবারও আতং*কিত সুরে লুসিয়া বললো,

—“একা যাবে নাকি! আমি লোক পাঠাচ্ছি তুমি…….! ”

—“নে নুজনো (প্রয়োজন নেই) ”

পিছনে না ফিরেই যেতে যেতে কেনীথ তীক্ষ্ণ কন্ঠে কথাটা বলেই সে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলো। এদিকে পিছনে স্তব্ধ পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা লুসিয়া কেনীথের যাওয়ার পানে চেয়ে শুধু এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এছাড়া আর তার করারও বা কি রয়েছে। কেনীথ যা ভাববে তাই করবে সেখানে তার মতো নামকরা মাফিয়ার কথাও মূল্যহীন। লুসিয়া পরবর্তীতে নিজের উপর তাচ্ছিল্যের সুরে হেসে মনে মনে বললো,

—“এতো বড় মাফিয়া হয়ে লাভটা কি হলো! এই নাতীকেই তো আজ পর্যন্ত ঠিক করতে পারলি না।ঠিক করা তো না হয় পরের কথা, ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে সাধারণ কথাটাও বলতে পারিস না!”

লুসিয়ার মনে যথেষ্ট চিন্তা হচ্ছে কেনীথকে নিয়ে পরবর্তীতেই আবার ভাবছে, ও পারবে! নিশ্চিত ও পারবে! কিন্তু একা যাওয়াতে মনে মধ্যে ক্ষুদ্র ভয়ভীতি বারবার জেগে উঠছে। যতই সে একজন কঠিন আর পাষাণ হৃদয়ের মানুষ হোক না কেনো, দিনশেষে তার একমাত্র নাতী আর নাতনির কাছে সে আর সকল দাদী নানীর মতোই।

কেনীথ সবসময় তার ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলেও রোজের প্রতি লুসিয়া অনেক বেশি অবসেসড। তার এতো চিন্তা থাকতো না যদি রোজ তার মতো হতো। কিন্তু এমনটা তো হয়নি। মেয়েটা অনেক বেশি নরম হৃদয়ের। ওর জীবনের বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যটাও খুব সাধারণ অথচ ও প্রতিনিয়ত বেড়ে উঠছে চারপাশের মারা*ত্মক সব বিপদের মাঝে। হঠাৎ রোজের কথা মাথায় আসতেই লুসিয়া চমকে উঠলো। এতক্ষণে তো মেয়েটা নিচে চলে আসতো তবে আসলো না কেনো। তার হঠাৎ কিছু ঠিক মনে হচ্ছে না। কেনীথের সাথে আবার কোনো…….
লুসিয়া আর একমুহূর্ত দেরী না করে উপরে গিয়ে রোজের রুমে তাকে খুঁজতে লাগলো। তবে সেখানে গিয়ে না পাওয়ায় সন্দেহ হলো নিশ্চিত কেনীথের রুমে রয়েছে।

কেনীথের রুমে গিয়ে প্রথমে কোথাও নজরে না এলেও পরবর্তীতে যা দেখলো তাতে তিনি চমকে উঠলেন। বারান্দা থেকে অনবরত ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ আসছে। লুসিয়ার আর বুঝতে বাকি রইলো না কি হয়েছে।

তাড়াতাড়ি বারান্দায় গিয়ে দেখলো রোজ দেওয়ালের সাথে পিছ ঠেকিয়ে হাঁটুতে হাত দিয়ে ঢেকে মুখ গুঁজে অনবরত ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। তবে এরচেয়ে বেশি বিস্মিত হলো যখন আশেপাশে পুরো বারান্দাটায় একবার চোখ বুলিয়ে দেখলো। পুরো বারান্দা জুরে সাজিয়ে রাখা কালো আর লাল গোলাপ গুলো আর এখন একটাও আস্ত নেই। গাছ থেকে সবগুলো গোলাপ কলি সহ ছিঁড়ে পাপড়িগুলোকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ভাবে বারান্দার ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয়েছে।

প্রিয়ে নাতনিকে এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে তার মতো কঠিন হৃদয়ের মানুষটার মনের ভেতরে উদ্বেগের সঞ্চার হলো। যে নাতনী নিজের হাতে এই গাছগুলোকে পরিচর্যায় বড় করেছে। বাড়ির সার্ভেন্টেদেরও কখনো তার কাজে সাহায্য করতে দেয়নি সেই কিনা শেষে এগুলোর এই অবস্থা করেছে। হুট করেই মনে হলো কেনীথকে ডেকে এনে কোনো ভুল করেনি তো! কেনীথ নিশ্চয় এমন কিছু বলেছে যাতে মেয়েটা যেন তেন নয় বরং প্রচন্ড রকমের কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু কেনীথকে না এনেও কি উপায় ছিলো। রোজের জন্যই তো তাকে আনা। রোজ যত বড় হচ্ছে শ*ত্রুপক্ষ ততই রোজকে লুসিয়ার দূর্বলতা ভেবে তার সাম্রাজ্য শেষ করতেই রোজের ক্ষ*তির পূর্বপরিকল্পিত ভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

লুসিয়া আর এসব না ভেবে রোজের কাছে দু হাঁটু গেঁড়ে বসে ওকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে মৃদু স্বরে বলতে লাগলো,

—“মোয়া দরোগায়া ভনুচকা! (আমার প্রিয় নাতনী) ; কেনীথ তোমায় কি বলেছে। ”

রোজ কোনো উত্তর দিলো না। সে ওভাবেই মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। রোজকে দেখে মুহূর্তেই লুসিয়ার চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো। তবে নিজেকে সামলে নিয়ে আবারও বলতে লাগলো,

—“এভাবে কেনো কাঁদছো। তুমি জানো তুমি এভাবে কাঁদলে আমার কষ্ট হয় তবুও কেনো কষ্ট দিচ্ছো আমায়! ”

এবারও রোজ কিছু বললো না।
—“রোজ…..!!!”

এবার রোজ ত্বরিত মাথা তুলে লুসিয়ার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলতে লাগলো,

—“ডাকবে না আমায় এই নামে! আমার নাম রোজ না! শুনেছো তুমি! আমার নাম রোজ না! চাইনা আমার এই কু*ৎসিত নাম। এখন থেকে আমার আশেপাশে আর কোনো গোলাপ দেখতে চাইনা। আমি ঘৃণা করি এসব। আই যাস্ট হেইট রোজ!!!”

এটুকু বলে রোজ আর কিছু বলতে পারলো না। সোজা লুসিয়াকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। রোজের এমন অবস্থা দেখে লুসিয়ার গলা কাঁটা বিঁধে যাওয়ার মতো অবস্থা। চোখে পানি ছলছল করছে অথচ সে কাঁদতে পারছে না।এই মেয়েটাকে সে ছোট্ট দেখে নানা বিপদের মাঝেও আগলে রেখেছে আর আজ ………লুসিয়ার কেনো যেনো বারবার মনে হচ্ছে রোজের এই অবস্থার জন্য কোনো না কোনা ভাবে সেই দায়ী।

—-“ভানুচকা! মোয়া ভানুচকা! কি বলেছে কেনীথ! বলো আমায়া। ”

রোজ লুসিয়ার কাছে কাঁধে মুখ গুঁজে থাকা অবস্থাতে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলো,

—“ওকে খুঁজে পেয়েছে। তুমি বলেছিলে ও কখনোই কেনীথের লাইফের ফিরে আসবে না। কিন্তু ওকে কেনীথ খুঁজে নিয়েছে। কেনো এতোদিন মিথ্যা বলেছিলে, তুমি মিথ্যা না বললে তো আমি এই আশা কখনোই করতাম না।দেখতাম না কেনীথকে নিয়ে সপ্ন। সবাই ধোঁকা দিয়েছে। সবাই আমার সাথে মিথ্যে খেলা খেলেছে। আমার চাই না এমন জীবন। কেনীথ আমাকে শুধু তার বোনের নজরেই দেখে ও কখনো আমাকে ভালোবাসেনি। কেনীথ শুধু ওকেই ভালোবাসে আমাকে না!”

রোজ কথা শেষ করে আবারও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। অন্যদিকে লুসিয়া রোজের কথায় চমকে উঠলো। রোজকে দু হাত দিয়ে সোজা করে ওর কান্নারত লাল হয়ে যাওয়া ফর্সা ত্বক আর ফোলা ফোলা রক্তিম চোখের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত সুরে বললো,

—“তুমি কার কথা বলছো! তুমি যা বলছো..……..এসব কি কেনীথ তোমায় নিজে বলেছে। ”

রোজের গাল চোখের অশ্রুতে সম্পূর্ণরূপে সিক্ত। লাল ঠোঁটটা বারবার কেঁপে উঠছে। লুসিয়ার কথা শুনে ঠোঁট চেপে ধরে শুধু মাথা ঝাঁকালো। তার এই স্বীকারোক্তিতে রোজ ভেবেছিলো লুসিয়া খুশি হবে কিন্তু এমন কিছুই হলো না।লুসিয়া চোখমুখ আরো ভীতিকরে রুপান্তর হলো। রোজ নিজের কান্নাকে কিছুটা থামিয়ে বললো,

—“তোমার তো খুশি হওয়ার কথা। খুশি হওনি তুমি! দেখো বাবুশকা, মেয়েটা কত লাকি তাই না! ও কেনীথকে পাবে আর আমি…….. চিরকাল শুধু কষ্টই পাবো!”

লুসিয়া কিছু নিয়ে চিন্তিত ছিলো এবার রোজের কথা শুনে চিন্তিত শুরে বললো,

—“প্রে করো রোজ, মেয়েটার জন্য প্রে করো। তুমি যা বলছো তাই যদি সত্যি হয় তবে ওই মেয়েটা পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের অধিকারী হতে চলেছে। আর এখন যার জন্য তুমি কেঁদে কেঁদে এই বেহাল দশা করেছো সে শুধু তোমার কাজিন কিংবা অসম্পূর্ণ ভালোবাসা নয়! সে যে কতটা ভয়ং*কর আর মারা*ত্মক তা তোমার চিন্তা ভাবনার জগতের চেয়ে বহু দূরে। ”

রোজ লুসিয়ার কথাগুলো এবার মনোযোগ দিয়ে শুনো তার দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটাকে নিয়ে এমন কথা তো কেনীথও বলেছিলো। এসবের মানে কি! কেনীথ তাহলে ওই মেয়েটাকে ভালোবাসে না! ও কি কেনীথের শত্রু! কিন্তু তা কি করে হয় কেনীথ আর ওর তো……….
ও কিভাবে কেনীথের শত্রু হতে পারে। এতো প্রশ্নের মাঝেও রোজ এসবের উত্তর না খুঁজে হঠাৎ মনে মনে অন্য সিন্ধান্ত নিলো। যদি কেনীথ আর ওই মেয়ের মাঝে কিছু নাই হয় তবে কেনীথকে তার নিজের করেই ছাড়বে আর তা যেকোনো মূল্যে। কিন্তু যদি কেনীথ সত্যি সত্যিই ওই মেয়ের হয়ে যায় তবে তাদের মাঝে সে কখনোই বাঁধা হবে না।কিন্তু কেনীথকে সে মৃত্যুর পরও কখনো ভুলতে পারবে না। রোজ এতোটুকু বিশ্বাস করে যে কাউকে ভালোবাসলে পৃথিবীর যেকোনো পরিস্থিতি, পদ্ধতি কিংবা পরিণতির পরও ভালোবাসা যায়।

এরই মাঝে হঠাৎ একজন কালো পোশাক পড়া লোক রুমে এসে নক করলে সে শব্দ লুসিয়া শুনে তাকে ভেতরে আসার পারমিশন দেয়। সেই মূহুর্তেই লোকটি বারান্দায় এসে লুসিয়ার দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে কুর্নিশ করে বলতে থাকে,

—“বস! একটি বিষয় জানানোর ছিলো! ”

—“হুম! ”

—“কেনীথ স্যার Custom Glock 17 এর দুটি গান নিয়ে গিয়েছেন। ”

লুসিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো,

—“এগুলো ছাড়া সেফটির জন্য আর কিছু নেই নি! ”

—“নো বস! তবে কিছু অদ্ভুত জিনিস নিয়ে গিয়েছে। একটা সিসার বল নিয়ে গিয়েছে। আই ডোন্ট নো! এসব দিয়ে তিনি কি করবেন।

লুসিয়ার চোখমুখ আরেকটু কুঁচকে বললো,

—“ও করতে চাইছে টা কি! ”

________________________

সের্গেইভিচ নিকিতা রাশিয়ার নামকরা আরো এক বড় মাফিয়া। সঙ্গে কাতেরিনা লুসিয়ার সবচেয়ে বড় শ*ত্রুর মধ্যে একজন। নিকিতার সাথে লুসিয়াদের শ*ত্রুতা বহু পুরুনো। শুধু তাই নয় বরং এই সের্গেইভিচ নিকিতাদের বড় এক স্ব*রযন্ত্রের কারণেই রোজের বাবাকে নিজের জীবন ত্যাগ করতে হয়ছিলো। আর এই ঘটনার পর তাদের শ*ত্রুতা যে আরো বেশি পরিপক্ব হয়ে উঠেছে।

আর এবার তাদের নজর গিয়েছে রোজের উপর। তাদের জানা মতে পৃথিবীতে এখন লুসিয়ার দূর্বলতা হিসেবে রোজই রয়েছে আর রোজকে কোনো ভাবে হাতে পেয়ে গেলে লুসিয়াকে শেষ করা বা হাতের খেলা হয়ে যাবে।

রাশিয়ার মাটিতে বিশাল বড় এড়িয়া আরো এক রাজকীয় আধুনিক স্টাইলের বাড়ি। চারপাশে কালো পোশাক আর রাইফেল হাতে বিশাল নিরাপত্তা কর্মীর টহল। দীর্ঘ এক রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছাতে হবে এই বাড়ির দোরগোড়ায়।

কেনীথ নির্বিকারে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। একটা সময় পর বাড়ির সামনে আসতেই গার্ডরা সব এসে ওখানেই আঁটকে দিলো। কেনীথও থেমে গেলো। বাঁকা হেসে গাড়ি থেকে বের হয়ে পরনের কালো লেদার জ্যাকেটটা কিছুটা স্টাইলের সাথে ঠিক করে সামনের দিকে এগোতে নিলেই কয়েকজন লোক এসে কেনীথের পরিচয় জানতে চাইলে সে লুসিয়ার লোক বলে নিজের পরিচয় দেয়। এরপর বডি চেক করে দুজন লোক এগিয়ে এলে কেনীথ বাঁধা দিয়ে নিজের জ্যাকেট থেকে দুটো গান বের করে দেখায়।

কিন্তু লোকদুটো তা নিতে চাইলে কেনীথে না দিয়ে তাদের দিকে ভ্রু উঁচিয়ে বাঁকা হাসে। তা দেখেই আর কেউ তাকে বাঁধা না দিয়ে ভেতরের যাওয়ার পারমিশন দেয় তবে কেনীথের পেছনে আরো চারটি লোক রাইফেল হাতে পেছনে পেছনে যেতে লাগে। বিষয়টি বুঝতে পেরে কেনীথ আবারও বাঁকা হাসলো।

ধীরে ধীরে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই সোফায় পায়ের উপর পা তুলে কালো লাক্সারিয়াস সুট পড়ে ড্রিংকসে্ মেতে থাকা সের্গেইভিচ নিকিতাকে দেখে কেনীথ মুচকি হাসলো। এদিকে লোকটির নজর কেনীথের দিকে পড়তেই মধ্যবয়সী লোকটি কপাল কুঁচকে তাকালো।

কেনীথ ধীরে ধীরে ঠিক মুখ বরাবর সোফাটায় হেলান দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে গিয়ে বসে পড়লো। এদিকে তার পেছনে নিকিতার চারজন গার্ড তো রাইফেলের ট্রিগারে ধরেই রেখেছে। এদিকে ওদিক মনে হলেই সোজা কেনীথের মাথায়….!

নিকিতার এমন জিজ্ঞাসা সূচক চেহারা দেখে পেছন থেকে একজন লোক তাকে জানালো কেনীথ লুসিয়ার লোক। এটা শুনে লোকটি হেসে বললো,

—“আর কেউ আসেনি! এ একা এসেছে নাকি! ”

এটা শুনে কেনীথের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা লোক গুলো বললো,

—জ্বী বস! ”

এটা শুনে যেন লোকটির আরো হাসি পেলো। কেনীথকে তাচ্ছিল্যের সুরে জিজ্ঞেস করলো,

—“কি রে, একা এসেছিস নাকি! মরণের ভয় নেই নাকি তোর! তোর ম্যাডামের কি লোকজন সব কমে গিয়েছে যে আমার এরিয়ায় একাই চলে এসেছিস। ”

কেনীথ কিছুই বললো না বরং একই ভাবে বাঁকা মুচকি হেসে নিকিতাকে দেখে চলেছে। এদিকে নিকিতা কোনো উত্তর না পেয়ে কিছুটা কপাল কুঁচকে কেনীথকে দেখতে লাগলো। এরপর ম*দের গ্লাসে একবার চুমুক দিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে বললো,

—“ভাবসাব তো ভালোই দেখছি! একা যখন এসেছিস তাহলে ছোট খাটো খেলোয়াড় তো তুই না। নিশ্চিত লুসিয়ার অতি বিশস্ত কেউই হবি! তোর চেহেরাটা নতুন, কোথা থেকে আনিয়েছে তোকে? নাকি পুরাতন খেলোয়াড় ;এতোদিন গর্তে ছিলি! ”

কথা শেষ করেই আবারও লোকটি জোরে জোর হাসতে লাগলো। নেশার মাত্রাটা একটু বেড়ে গিয়েছে বিধায় উল্টোপাল্টা বকে যাচ্ছে। কিন্তু এবারও কেনীথ কি বললো না বিধায় লোকটির এবার কিছুটা রাগ হলো। কিছুটা মেজাজ দেখিয়ে ভদকার গ্লাসটা কাঁচের টেবিলের উপর শব্দ করে রেখে সামনের দিকে ঝুঁকে বললো,

—“ফাজলামি করতে এসেছিস! কথা বলিস না কেনো। লুসিয়া কোন উদ্দেশ্য পাঠিয়েছে তোকে বল! ”

এরপর সাথে সাথেই বললো,

—“এর কাছে কোন অ*স্ত্র পেয়েছিস!

—“জ্বী বস! এর কাছে গান….

কথা শেষ করার আগেই কেনীথ কিছু না বলে জ্যাকেট থেকে গানটা বের করে টেবিলের উপর রাখলো। তখনই লোকটি তা দেখে তাচ্ছিল্যের সাথে হেঁসে বললো,

—“এটা কি! তুই কি এটা দিয়ে আমাকে মা*রতে এসেছিস নাকি! ”

কেনীথ এবারও কিছু না বকে লোকটির দিকে হাসি মুখেই তাকিয়ে রইলো। এবার লোকটি নিজের কন্ঠ স্বরকে কিছুটা তীক্ষ্ণ করে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বললো,

—“কে রে তুই! তোর নাম কি! ”

কেনীথ মুচকি হেসে বললো,

—“ভিকে! আ’ম ভিকে, দ্যাটস মিন ভাম্পায়ার কেনীথ! ”

এটা শোনা মাত্রই আশেপাশের সার্গেইভিচ নিকিতার মাঝে তো কোনো হেলদোল হলো না কারণ সে এই নামের সাথে এই প্রথমবার পরিচিত কিন্তু চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় শ’খানের লোকগুলো নিজেদের রাইফেল মূহুর্তেই হাত থেকে ফেলে দিয়ে হাঁটু গেড়ে নিচের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে পড়লো। হঠাৎ এমনটা হওয়ায় নিকিতার নেশাগ্রস্ত মস্তিষ্ক চমকে উঠলো। সে ত্বরিত দাঁড়িয়ে আশেপাশে তাকিয়ে জোরে জোরে চেঁচিয়ে বললো,

—-“এসব হচ্ছেটা কি!

যেসকল সোলজার কিংবা বডিগার্ড নিজেদের আত্মসমর্পণ করেছে তারা ব্যতীত আরো কিছু লোক হয়েছে যারা একই ভাবে স্থির রয়েছে। একদিকে কেনীথের পেছনে রাইফেল হাতে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা লোক অন্যদিকে নিকিতার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা আন্ডারবস, ক্যাপো আর অ্যাসোসিয়েট সহ তার আরো কিছু বিশস্ত বডিগার্ড তার প্রটেকশনের জন্য সজাগ হয়ে দাঁড়িয়ে।

নিকিতা নিজের কর্মীদের এই হাল দেখে সম্পূর্ণ বিস্মিত অন্যদিকে কেনীথের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা তার লোকেরা এখনো কিছু করছে না বিধায় সে রেগে গিয়ে হুং*কার দিয়ে তাদের উদ্দেশ্য বললো,

—-“মাথা খারাপ নাকি, এখনো একে শুট করা হচ্ছে না কেনো! ”

তার এই হুংকারে কেনীথের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর মাঝে কোনো হেলদোল হলো না।তারা অকপটে একই ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। যেন তাদের করার কিছুই নেই৷

এদিকে নিকিতার পাগল প্রায় অবস্থা। সে এগুলোকে বাস্তবতা নাকি নেশার ঘোর ভাববে তাই বুঝে উঠতে পারছে না। তার এতোগুলা কর্মী সবাই কেনো এমন বিহেভ করছে! এদের হয়েছেটা কি! তার কিছুই জানা নেই নিকিতার।

এদিকে নিকিতা রেগে পেছনের আশেপাশে তাকিয়ে বললো,

—“আমার মাথা দেখছিস তোরা! একে শুট করছিস না কেনো! এই আমাদের শ*ত্রু,মেরে ফেল একে। ”

নিকিতার কথা শুনে তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা চারজন বডিগার্ড কেনীথের দিকে রাইফেল তাঁক করলো অন্যদিকে আন্ডারবস, অ্যাসোসিয়েট তার প্যান্টেলওন নিজেদের গান ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে কেনীথের দিকে তাক করতেই নিকিতার মুখে হাসি ফুটলো। বেচারা তো ভেবেছিলো এরাও না আবার তার সাথে কোনো গেম খেলে বসে।

তবে তার এই হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।কেনীথ পুরো সময়টা নির্বিকারে বসে রইলেও যখনই নিকিতার লোকগুলো তার দিকে নিজেদের গান তাক করতেই মূহুর্তেই কেনীথ নিজের গান দুটো টেবিলের উপর থেকে নিয়ে অকপটে একেরপর এক ট্রিগারে চাপ দিয়ে নিজের টার্গেট মতো নিকিতার লোকদের দিকে গুলি ছুঁড়েছে।
আর অদ্ভুত বিষয় হলো প্রত্যেকটি গুলি হয় ঠিক মাথায় লেগেছে নয়তো সোজা বুকে। বেঁচে থাকার শেষ আশ্বাসও যেন না থাকে তাই হয়তো এমন নিশানা। যা কোনো সুদক্ষ স্নাইপার দ্বারাই সম্ভব।

কেনীথের লাইফস্টাইল, চিন্তাভাবনা বরাবরই অন্যদের চেয়ে আলাদা আর অদ্ভুত। সে কখনো নিদিষ্ট একটা প্রফেশনে নিজেকে জড়ায়নি। সে চাইলে তার পারিবারিক পেশা অনুযায়ী একজন দক্ষ মাফিয়া হয়ে গড়ে উঠতে পারতো কিংবা সাধারণ মানুষ হয়েই বাকিটা জীবন কাঁটাতে পারতো কিন্তু সে তা করেনি। তার মনের ইচ্ছেতে যখন যা প্রয়োজনে হয়েছে তখন সে তাই শিখেছে নয়তো করেছে। কখনো সুদক্ষ স্নাইপার, কেমিস্ট, কখনো কিংবা মাফিয়া না হয়েও মাফিয়ার চেয়ে দক্ষ আর চতুর।

আশেপাশে সবাই যখন নিকিতার হাতের বাহিরে৷ তখন নিজের বাঁচার শেষ আশাটুকুও শেষ হয়ে গেলো যখন নিজের বিশস্ত লোকেদের নিজের সামনেই শেষ হতে দেখলো। তবে পেছনে তাকিয়ে একজনকে দেখে তার মনে আবারও আশার আলো দেখা দিলো। কেনীথ সবাইকে মা*রলেও নিকিতার ক্যাপোকে সে কিছুই করেনি। লোকটি নির্বিকার দাঁড়িয়ে রইছে। ক্যাপো হলো মাফিয়াদের এমন একটি পদ যা সকল গার্ড কিংবা সোলজারকে নিয়ন্ত্রণ করে।

নিকিতা তার ক্যাপোর কাছে গিয়ে পাগলের মতো উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলো,

—“এসব কি হচ্ছে! তুমি কিছু করছো না কেনো। এরা সবাই কেনো আমার কথা অমান্য করছে। তুমি এদের বলো ওকে শেষ দিতে। তুমি কেনো ওদের আদেশ করছো না! প্লিজ এভাবে চুপ থেকো না, প্লিজ কিছু করো! তুমি কিছু বুঝতে পারছো না, ও আমাদের দুজনকেও মেরে ফেলবে! ”

কিন্তু লোকটি মুচকি হেসে নিকিতার দিকে তাকিয়ে বললো,

—“সরি ব্রো! আই কান্ট হেল্প ইউ। ”

এটা শুনে যেন লোকটি বিস্মিত হলো। তার সাথে হচ্ছে টা কি! যে লোকটা তাকে সবসময় বস বলে ডাকে সে কেনো এমন বিহেভ করছে। কিছুই মাথায় ঢুকছে না। সবাই কেনো তার সাথে এমন ব্যবহার করছে। এরা তো তার লোক।

এরই মাঝে সেই লোকটি নিকিতার কাছে আরেকটু এগিয়ে এসে মুখের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসয়ে বলতে লাগলো,

—“আমার সামনেই আমার প্রিয়তমাকে ছিঁড়েখুঁড়ে শেষ করেছিলি তুই। কি ভেবেছিলি আমি সেসব ভুলে যাবো!”

এই বলেই বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকা নিকিতার মাথায় গানের নিচের অংশ দিয়ে সজোরে আঘাত করতেই সে মূহুর্তেই সেন্সলেস হয়ে মাটিতে পড়ে যায়।

এরপর সোফায় বসে পায়ের উপর পা তুলে গান হাতে নিয়ে দেখতে থাকা কেনীথের দিকে তাকাতেই সেও তাকালো এরপর দুজনেই বাঁকা হাসতেই কেনীথ তাকে একটি সিসার ছোট বল ছুঁড়ে মারতেই সে তা মূহুর্তেই ক্যাচ ধরলো। অন্যদিকে কেনীথ নির্বিকারে তাকে বললো,

—“এটাকে গলানোর ব্যবস্থা করো! আজ সব কর্মের ফল পাবে ও! ”

_______________________________

বাড়ির কিচেনে ছোট ডাইনিং টেবিলের উপর হাত পা বেঁধে শুয়ে রাখা হয়েছে নিকিতাকে। চারপাশে চকচকে আলো দিয়ে সজ্জিত বাড়িটার কিচেন এরিয়ায় অনেকগুলো আলো বন্ধ করে কিছুটা অন্ধকার রুপ দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ পরিবেশটাকে। বলতে গেলে ডাইনিং টেবিলের আশেপাশে কয়েকটা লাইট ব্যতীত বাকি সব লাইট বন্ধ করা।

অন্যদিকে বাড়ির সব গার্ডদের দুরে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা। আজ কেনীথের পৈ*শাচিকতার সাক্ষী সকলে হতে চলেছে।

—“বস! উঠুন, দেরী হয়ে যাচ্ছে তো। ”

হঠাৎ কারো কন্ঠ স্বর শুনে নিকিতার জ্ঞান ফিরতে লাগলো। আওয়াজটা সে ধ্যানের মধ্যে অনেকবারই শুনছিলো একটা পর্যায়ে তার মস্তিষ্ক সক্রিয় হলে নড়াচড়া করতে গিয়ে বুঝতে পারে তাকে বেঁধে আটকে রাখা হয়েছে। ত্বরিত আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো তার একপাশে কেনীথ আর অন্যদিকে তার ক্যাপো দাঁড়িয়ে রইছে।

ওদের দু’জনকে দেখেই নিকিতা আ*তংকিত হয়ে নড়েচড়ার পাশাপাশি চি*ৎকার করতে চাইলে তা আর হয়ে উঠলো না। আওয়াজ করতে গিয়ে তার মনে হলো তার মুখও শক্ত স্কচটেপ দিয়ে আটকানো। লোকটার দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগলো আ*তংকে। তার আস্তানাতেই অন্য কেউ এসে তাকে শেষ করে যাবে আর সে কিছুই করতে পারবে না এর চেয়ে দুভার্গ্য আর কি হয়!

নিকিতার ছটফট দেখে কেনীথ মুচকি হাসলো। এবং পাশে থাকা ক্যাপোকে বললো,

—“লাল হয়েছে তো! ”

ক্যাপো রোমান নির্বিকারে উত্তর দিলো

—“হুম!”

কিন্তু সে জানে না এটা দিয়ে কেনীথ কি করবে।

—“তাহলে আর দেরী কিসের নিয়ে এসো! ”

কেনীথ আর রোমান দুজনের হাতেই থার্মাল গ্লাভস আর মুখে মাক্স পড়া। কেনীথ তাকে সিসার বলটা দেওয়ার পর রোমান তা গলানোর পূর্ণ ব্যবস্থা করে ফেলেছে। যেহেতু সিসাকে লাল লাভার মতো তৈরি করতে অতিরিক্ত তাপ চাই সেহেতু বলটিকে গলাতে কিছু অতিরিক্ত যন্ত্রেরও ব্যবস্থা করেছে।

কেনীথের হাতে রোমান গলানো লাভার কাস্ট আয়ারনের পাত্রটা দিতেই দিতেই কেনীথ তা খুব সাবধানে গ্রিপিং টুলস দিয়ে জিনসটাকে নাড়িয়ে দেখতে লাগলো। একদম লাল লাভার মতো টগবগে। কেনীথ সেটা নিয়ে নিকিতার কাছে কাছে গিয়ে কিছুটা ব্যঙ্গ করে বললো,

—“সার্গেই…ভিচ নিক্কিতা!

তো নিকি! জীবনের শেষ সময়ে কেমন অনুভূতি হচ্ছে?”

তার এই কথা শুনে নিকিতার ছটফট যেনো আরো বেড়ে গেলো অন্যদিকে রোমানের মাঝে কিছুটা ভীতি সৃষ্টি হচ্ছে কেনীথের পরবর্তী কার্যক্রমের কথা চিন্তা করে। তাই কিছুটা নিজেকে তটস্থ করে কেনীথের উদ্দেশ্যে বললো,

—“স্যার! আপনি এটা দিয়ে কি করবেন। ”

কেনীথ রোমানের কথা শুনে নিকিতার দিক থেকে নজর সরিয়ে রোমানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো এরপর অকপটে বললো,

—“তুমি চাইলে এখান থেকে যেতে পারো! এখন যা হবে তা তোমার সহ্য না-ও হতে পারে। ”

রোমান কিছু বললো না।সে যদিও কিছুটা ভীত কিন্তু সে নিকিতার ক*রুণ মৃ*ত্যুটা নিজ চোখে দেখতে চায়। যত হৃদয়বিদা*রক কিংবা লো*মহর্ষক হোক না কেনো সে কিছুতেই এখান থেকে সরবে না। আজ থেকে কিছু বছর আগেই এই নিকিতাই তার একমাত্র প্রিয়তমা স্ত্রীকে তার চোখের সামনে শেষ করেছে আর সে তখন কিছুই করতে পারেনি শুধু আজকের দিনের অপেক্ষায়।

রোমান একই ভাবে স্থায়ী হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো বিধায় কেনীথ ওকে দেখে মুচকি হাসলো। যতই রোমান নিজেকে শক্ত রাখুক। সে যা করতে চলেছে তা কখনোই সে এভাবে স্থায়ী হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে পারবে না। শুধু সে কেনো, এই বাড়িতে থাকা প্রত্যেকটা মানুষ সহ সকল জড়বস্তু গুলোও আজ নিজ চোখে না হলেও নিকিতার মর্মা*ন্তিক মৃ*ত্যুর আত্নচিৎকারে লোম*হর্ষক ভাবে শিহরিত হবে।

কেনীথ আর বেশি দেরী করতে চাইলো না। নিকিতার মুখ থেকে স্কচটেপটা উঠয়ে নিতেই নিকিতা অনুরোধ করে নিজের জান ভিক্ষা চাইতে লাগলো। কিন্তু কেনীথের মতো এক হৃদয়বিহীন ব্যক্তির কাছে এসবের কোনো মূল্য নেই। কেনীথ নিকিতার অনুরোধ দেখে মুচকি হেসে বললো,

—“কিছু বছর আগে ঠিক এভাবেই হয়তো আন্দ্রে নিকোলাই নামের কেউ নিজের জীবনের ভিক্ষা চেয়ে আকুতি মিনতি করেছিলো কিন্তু…… তুই সেইদিন আর তাকে বাঁচতে দিসনি। গুনে গুনে বিশটা গু*লি করে তার বুক ঝাঁঝড়া করে দিয়েছিলি। মনে আছে সেই কথা নাকি ভুলি গিয়েছিস।
একমিনিট তুই জানিস আমি কেনো তার কথা বলছি! কারণ সে শুধু কাতেরিনা লুসিয়ার ছেলেই ছিলো না বরং আমার একমাত্র মামাও ছিলো। তার সাথে তুই যা করেছিস আজ ঠিক তোর সাথেও তাই হবে।

কিন্তু এছাড়া তোর সাথে আরেকটি বোঝাপড়া বাকি রয়েছে। তুই এবার বাবুশকাকে শেষ করার জন্য তার দূর্বলতার দিকে নজর দিয়েছিস। তুই রোজকে নিজের টার্গেট বানিয়ে নিজের মৃ*ত্যু নিজেই ডেকে এনেছিস। তোর বোকামির জন্যই আজ তোর করুন মৃ*ত্যুর সাক্ষী এই পুরো বাড়িটার একেকটা মানুষ সহ ইট, পাথরগুলোও হয়ে থাকবে।

এই বলেই কেনীথ যা করলো তা দেখার শক্তি কিংবা মস্তিকের সবলতা রোমানের হলো না। সে নিকিতার আত্মচিৎকারে মূহুর্তেই নিজের চোখ বন্ধ করে হাত দিয়ে দু কান চেপে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো।

অথচ কেনীথ হাসি মুখে নির্বিকারে প্রথমে নিকিতার একচোখে গরম সিসার লাভা ঢেলে তার হৃদয়বিদারক লো*মহর্ষক চিৎকার আর গলা কা**টা মুরগীর মতো ছটফাটানি উপভোগ করতে লাগলো। এ যেন এক পৈ*শাচিক আনন্দ।

অথচ নিকিতার এমন করুন দশা দেখে শুধু রোমান নয় দূরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেকটি বডিগার্ড আর সোলজারদেরও ঠিক একই অবস্থা। তাদের হাঁটু সহ সারা শরীর ক্রমশে কাপছে আর নিকিতার একেকটা চিৎ*কার লোম*হর্ষক ভাবে সারা শরীরে শিহরণ জাগাচ্ছে।
রোমানের সত*র্কতা অনুযায়ী তারা প্র্যত্যেকেই জানতো কেনীথ অত্যন্ত বিপ*দজন*ক আর ভ*য়ংক*র কিন্তু সে যে এমন পি*শাচের কিংবা ন*রপশু কিংবা জা*নো*য়ারের চেয়ে নিষ্ঠুর হৃদয়রের তা তাদের জানা ছিলো না।

অথচ এদিকে কেনীথ শান্ত হলো না। সে আবারও ঠিক একই ভাবে দ্বিতীয় চোখেও সিসার লাল লাভা ঢেলে দিতেই আবারও সেই একই ঘটনা। হৃদ*য়বিদা*রক চিৎ*কারে এখন প্রত্যেকের হয়তো শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।

একটা পর্যায়ে নিকিতা ছটফট করতে করতেই টেবিল থেকে উল্টো দিক হয়ে সোজা নিচে পড়তে গেলো। কিন্তু এখনো ওর দেহ থেকে প্রাণটা চলে যায় নি। কেনীথ ওর এহেন অবস্থায় আবারও হাসলো।

এরপর ওর কাছে গিয়ে শক্ত বুট জুটো পড়া পা দিয়ে তাকে ঢেলে উল্টে দিলো। নিকিতার চেহারাটা সম্পূর্ণ ভ*য়ংক*র আর বি*ভৎ*স হয়ে গিয়েছে। বিশেষত চোখের অংশের দিকে কোনো সাধারণ মানুষের তাকানোর মানসিক ক্ষমতা নেই কিন্তু কেনীথের যেন এসব দেখে শান্তি হলো।
নিকিতা চোখে কিছু দেখতে না পেলেও তার শ্রবণ শক্তি এখন কিছুটা সক্রিয় তবে মস্তিষ্ক যেন ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে।

কেনীথ সটানভাবে দাঁড়িয়ে গ্লাভস আর মাক্সটা খুলে জ্যাকেট থেকে গান দুটো বের করলো। এরপর তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,

—“গুনে গুনে বিশটা তাই না! ”

এটা বলতে দেরী নেই আর হিং*স্র কেনীথের অনবরত ট্রিগারে চাপ দিতে দেরী নেই। একের পর এক গুলি ছুঁড়ে নিকিতার বুকটাকে ঝাঁঝড়া করার খেলায় মেতে উঠলো। অথচ তার এই শুট করার শব্দ যতদূর পৌঁছাচ্ছে ততোদূর যেন এক লো*মহর্ষক রোমাঞ্চকর উত্তেজনা সৃষ্টি করছে। অথচ কেনীথ অকপটে দুটো গানের ট্রিগার চেপে গুনে গুনে দশ বার করে মোট বিশবার শুট করার পরই ক্ষান্ত হলো।

_________________

কেনীথ বাড়িতে ফিরতেই লুসিয়া তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,

—“তুমি ঠিক আছো! কিছু হয়নি তো। ”

কেনীথ লুসিয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। লুসিয়া ওর হাসি দেখে জিজ্ঞেস করলো,

—“কি করেছো তুমি! ওখানকার কি খবর। ”

কেনীথ একটা ব্লাক ফাইল লুসিয়ার হাতে দিয়ে বললো,

—“কর্মের ফল ভোগ করেছে! ”

এরপর যেতে যেতে বললো,

—“খাবার রেডি আছে তো! খিদে পেয়েছে, ফ্রেস হয়ে খাবার খাবো।……… ওহ! মিষ্টির ব্যবস্থা করো, মিষ্টি মুখ করতে চেয়েছিলাম। ”

কেনীথের এমন অকপটে বলা কথাগুলো শুনে লুসিয়া চিন্তিত স্বরে পেছন থেকে জিজ্ঞেস করলো,

—“তুমি কি ওকে………! ”

কেনীথ পিছনের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বললো,

—“আজ হোক বা কাল! একদিন না একদিন তো সবাইকে ম*রতে হবে। আর শ*ত্রুকে বাঁচিয়ে রাখার তো কোনো প্রশ্নই নেই! ”

কেনীথ কথা বলা শেষ করে চলে গেলেও লুসিয়া দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। তার মস্তিষ্কে অনেক কিছুই চলছে কিন্তু কেনীথ…….. কিছুই বলার নেই ওর সম্পর্কে!
লুসিয়া শুধু ফাইলটা আর রোজের বিষয়টিকে নিয়ে নিকিতার সাথে বোঝাপড়া করতে বলেছিলো কিন্তু কেনীথ তো তাকে পুরো শেষ করেই দিয়ে এসেছে। বিষয়টি কিছুটা অবিশ্বাস্য ঠেকলেও লুসিয়া মনে মনে খুশিই হলো এতোদিনে শ*ত্রু আর তার ছেলের খু*নির প*তনের খবর শুনে। কিন্তু যখন সে এটা জানবে যে নিকিতার মৃত্যু ঠিক কিভাবে হয়েছে তা জানার পর হয়তো সে কেনীথকে নিয়ে আবারও প্রচন্ড বিস্মিত হবে। তার নাতী যে সম্পূর্ণ পি*শাচে পরিণত হয়েছে এটা হয়তো এবার সে পুরোপুরি জেনে যাবে।

______________________

খাবার টেবিলে বসে লুসিয়া আর কেনীথ খাবার খাচ্ছিলো। বিশাল বড় টেবিলের সম্পূর্ণ জায়গা জুরে সাজিয়েগুছিয়ে নানা পদের খাবার। কেনীথ আর লুসিয়া অল্প কিছু খাবার নিয়েই নিজেদের খাবার খেতে শুরু করেছে। কেনীথ একবার খেয়াল করে দেখলো সবগুলো খাবারই তার পছন্দের। আগে যখন রাশিয়াতে থাকতো তখন সে এসব খাবারই বেশি পছন্দ করতো। যেমন: চেরনিকা, তুরোন,ক্যাসিয়েনকী, বোর্ষ্চ, খলাবি, পেলমেনি, নাচিনকি ইত্যাদি। খেতে খেতেই হঠাৎ কেনীথ লুসিয়াকে জিজ্ঞেস করলো,

—“এতো সব খাবার তুমি বানিয়েছো নাকি! খাবারের টেস্ট তো সব তোমার হাতের রান্নার মতোই লাগছে! ”

লুসিয়া কেনীথের কথা শুনে মুচকি হাসলো। যতটা হতাশ সে কেনীথকে নিয়ে হয়েছিলো কেনীথের এই কথাটা শোনার পর মনে হলো কেনীথ তাহলে তাকে পুরোপুরি হতাশ করেনি। লুসিয়া কেনীথের কথা উত্তরে বললো,

—“এসব আমি বানাইনি! আলেসিয়া বানিয়েছে। শুধু তোমার জন্যই এতো খাটাখাটুনি করেছে। ”

রোজের কথা শুনেই কেনীথ থম মেরে গেলো। মুখ ফসকে এ কথাটা বলে যেন ভুল করে ফেলেছে। এজন্যই এখানে সে বেশিক্ষণ থাকতে চায় না। আর এতোবছর পর এসে নতুন করে আর কোনো ভুলও করতে চায় না। আপাতত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে যেতে পারলেই হলো।

কেনীথ চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে বিঁধায় লুসিয়া আবারও কিছুটা হতাশ হয়ে বললো,

—“কেনীথ! তুমি জানো আলেসিয়া তোমার জন্য কতটা অবসেসড। আমি জানি ও যা চাইছে তা তুমি কখনোই তা করবে না কিন্তু প্লিজ যাওয়ার আগে আর ওকে কষ্ট দিও না। ও হৃদয়ের দিক থেকে আমাদের মতো না, ও প্রচন্ড দূর্বল। তোমার সামন্য কথাতেই মেয়েটা প্রচন্ড কষ্ট পেয়ে ভেঙ্গে গিয়েছে। ”

এতোকিছু শোনার পর কেনীথ কিছুই বলছে না দেখে লুসিয়া শান্ত কন্ঠ অনুরোধ সরূপ বললো,

—“কেনীথ! লাস্ট একটা রিকোয়েস্ট করছি। মেয়েটা খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বেশি কিছু না, প্লিজ ওকে খাওয়ানোর ব্যবস্থাটা করো। না খেয়ে থাকলে মেয়েটা একদম অসুস্থ হয়ে যাবে। ”

লুসিয়ার কথা শুনে কেনীথ তার দিকে তাকালো। লুসিয়ার এমন অনুরোধে কেনীথ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,

—“ওকে!”

_______________________

খাবার সাজানো প্লেট নিয়ে রোজের রুমের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর দরজায় নক করতেই বুঝলো দরজা খোলা। একবার আলেসিয়া নামে ডাকার পরও কোনো আওয়াজ এলো না। কেনীথ দরজায় হালকা ধাক্কা দিয়ে রুমের ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখলো পড়ার টেবিলে উপর বসে রোজ কিছু লেখালেখি করছে।

এসে যেমন পরিপাটি রোজকে কেনীথ দেখতে পেয়েছিলো এখন আর তেমন নেই। তাকে দেখে মনে হচ্ছে উষ্কখুষ্ক এলোমেলো চুলে টেবিলে বসে কিছু লেখতে না বরং যু*দ্ধ করছে। কেনীথ ধীরে ধীরে রোজের কাছে গিয়ে পেছন থেকে দাঁড়িয়ে ওর কার্যকলাপ দেখতে লাগলো,।

টেবিলের উপর গোলাপের পাপড়িগুলোকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলে রেখেছে আর কিছু সাদা কাগজে অনবরত “Kenneth+Rose” লিখছে আর কাটছে। নিজের মন আর মস্তিষ্কের সাথে যেন এক বড়সড় যু*দ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এসব দেখে কেনীথের মাঝে কোনো করুনা না হলেও সে মুচকি হাসলো। এই লোকটা ভারী অদ্ভুত! মানুষকে কষ্ট দেওয়াটাই হয়তো এর কাজ।

—“আলেসিয়া! ”

কোনো সারা শব্দ করলো না রোজ। একই ভাবে নিজের কাজ করতে লাগলো। কেনীথ আবারও ডাকলো,

—“আলেসিয়া! ”

এবারও একই ঘটনা। কেনীথ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,

—“রোজ! ”

এবার রোজ ত্বরিত কেনীথের দিকে ফিরে তাকালো। কেনীথ ওর চেহারা দেখে কিছুটা অবাক হলেও তার মুখের কোনো পরিবর্তন করলো না। চোখমুখ কেঁদে কেঁদে লাল বানিয়ে ফুলিয়ে ফেলেছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে সিক্ত চেহারায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে। একটা মেয়ে এই কিছু মূহুর্তেই এতোটা বি*ধ্বস্ত রুপে কিভাবে পরিণত হতে পারে! এতে কেনীথের করুনা হলো না বরং রোজকে তাচ্ছিল্যের সাথে সম্পূর্ণ একজন ব্রেইনলেস ভাবলো। শুধুমাত্র তার জন্য এতো পাগলামির কোনো অর্থই নেই কেনীথের কাছে। এগুলো তার কাছে শুধু আবেগের বশে করা বোকামি করা।

—“এসব পাগলামো কেনো করছিস! ”

—“কেনো এসেছো এখানে! ”

রোজের অকপটে বলা কথা শুনে কেনীথও নির্বিকারে বললো,

—” অনেক রাত হয়েছে, খাবার খেয়ে নে! ”

রোজ কেনীথের কথায় তাচ্ছিল্যের সাথে মৃদু হাসলো।

—“আমি না খেলে কি হবে! ”

—“অসুস্থ হয়ে যাবি! ”

—“তুমি তো হার্টলেস, এতে তোমার কি! ”

কেনীথ ছোট করে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে অকপটে বললো,

—“তোর শরীর! তুই না খেলে তুই নিজে অসুস্থ হবি! এতে আবার আমার কি হতে পারে! ”

রোজের মেজাজ খারাপ হলো। কিছুটা তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,

—“তবে এখানে কি ড্রামা করতে এসেছো! তোমাকে এখানে আসতে কে বলেছে। বলেছি না আমার সামনে আসবে না। ”

কেনীথ প্লেটটা টেবিলের উপর রেখে বললো,

—“বাবুশকা রিকোয়েস্ট করেছিলো তাই এসেছি। তুই যখন চাস না আমি আর তোর সামনে আসি তবে আর আসবো না। খাবারটা খেয়ে নিস!”

কথাটা বলেই কেনীথ রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে নিলেই আচমকা বিকট শব্দে পিছন ফিরে তাকালো। নম্র মেয়েকে হঠাৎ ফুঁসতে থাকা হিং*স্র সাপের মতো আচরণ করতে দেখে কেনীথের আর কিছুই বলার নেই।

কেনীথ ফিরে আসতে নিলেই রোজ বসা থেকে দাঁড়িয়ে খাবারের প্লেটটা নিয়ে সজোড়ে ফ্লোরে ফেলে দেওয়াতে তা বিকট শব্দে রুপ নিয়েছে। আর এখন সে টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে কেনীথের দিকে ক্ষি*প্ত চোখে তাকিয়ে।

কেনীথ জানতো এমন কিছুই হবে তবে যাওয়ার আগে লুসিয়ার রিকোয়েস্ট রাখাটাও রোজের জন্য প্রয়োজন ছিলো। তার এতোটুকু সাক্ষাৎতে রোজকে আরেকটু ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম কেনীথ। কেনীথ রোজকে আরেকটু কষ্ট দিতে বললো,

—“ভালো থাকিস! কাল ভোরের ফ্ল্যাটে চলে যাচ্ছি৷ আই প্রমিজ, আর কখনো তোর সামনে আসবো না।”

কথাটা বলেই কেনীথ রুম থেকে বেড়িয়ে পড়তে উদ্বেগ হলো।
এদিকে রোজ কেনীথর যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেঁপে কেঁপে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,

—“ভালো থাকিস, হাহ!!! ভালো আর থাকতে দিলে কই আমায়! সম্পূর্ণরুপে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছো আমায়।”

কিছুটা আস্তে কথাটা বলার পর কেনীথকে শোনানোর জন্য জোর আওয়াজে বললো,

—“যত যাই করো না কেনো! তোমায় আমি কখনো ভুলবো না। তুমি অন্য কারো হয়ে গেলেও না! শুনেছো তুমি! তুমি আমার অসম্পূর্ণ ভালোবাসা হলেও আমি তোমাকেই ভালোবাসি! ”

যেতে যেতে কেনীথ রোজের কথার প্রতিটা শব্দ শুনতে পেলেও তার মাঝে কোনো হেলদোল হলো না। সে অকপটে সমান পায়ের তালে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। আর কেনীথ চলে যেতেই রোজ ফ্লোরে বসে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।

_______________

কেনীথ সিঁড়ির কাছে আসতেই লুসিয়া ওকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—“খেয়েছে! ”

কেনীথ কিছু বললো না তাই লুসিয়া কপাল কুঁচকে রোজের রুমের দিকে নিজের কর্ণকে দৃঢ় করতেই রোজের কান্নার আওয়াজ পেলো। তা দেখে কেনীথের দিকে তাকাতেই কেনীথ নির্বিকারে বললো,

—” এইটুকু প্রয়োজন ছিলো। নাহলে ফিউচারে ওর এক্সপেকটেশন আরো বেড়েই চলতো। ”

কেনীথকে লুসিয়া বলেছিলো ওকে খাওয়ানোর জন্য এদিকে এই ছেলে গিয়ে ওকে আরো কষ্ট দিয়ে এসেছে। সত্যিই সম্পূর্ণ হার্টলেসে পরিণত হয়েছে। লুসিয়ার রাগও হচ্ছে আবার তার চোখে পানিও চিকচিক করছে।

—-” কবে যাচ্ছো তুমি! ”

লুসিয়ার কথা শুনে কেনীথ হাসলো। লুসিয়া আর তার মাঝে মুখের শব্দের চেয়ে চোখ আর মনের কথাটাই বেশি হয়। কিন্তু লুসিয়া কেনীথের মস্তিষ্কের খবর কখনোই জানতে পারেনি।

—“ভোরের ফ্লাইটেই চলে যাবো। ”

যদিও লুসিয়ার এই প্রশ্নটা করতে যথেষ্ট খারাপ লাগছিলো কিন্তু কেনীথ যা পরিস্থিতি তৈরি করেছে তাতে ওর চলে যাওয়াটাই উত্তম।

কেনীথ আর দাঁড়ানো না বরং সেখান থেকে চলে আসতে নিলে লুসিয়া পেছন থেকে বললো,

—“যাই করো না কেনো! ওই মেয়েটার কিছু করো না। ওর কিন্তু কোনো দোষ নেই। ”

লুসিয়ার কথা শুনে কেনীথ পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে মুচকি হেঁসে বললো,

—“কি আর করার! আমাদের ভাগ্যে যা রয়েছে তাই-ই তো হবে! ”

#চলবে