একজোড়া আগুন পাখি পর্ব-১৭+১৮

0
52

#একজোড়া_আগুন_পাখি
®অরনীতা তুশ্মি (#তুশকন্যা)

পর্ব→১৭

—“ভিকে!!”

হঠাৎ এক অল্পবয়সী কন্ঠস্বর শুনে কেনীথ কিঞ্চিৎ কপাল কুঁচকে পেছনে তাকালো। তাকিয়েই এক হাসোজ্জল মুখে তার দিকে তাকিয়ে থাকা অল্পবয়সী মেয়েকে দেখলো। ত্বরিত মনে করতে চাইলো মেয়েটাকে কি তার পরিচত?

এরই মাঝে সাদা গাউন পড়া মেয়েটা বিস্মিত চেহারা নিয়ে তার দিকে এগিয়ে এলো। কেনীথও কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে অকপটে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো,

—“তুমি কে? ”

সাধারনত কেনীথ এমন কাউকে তার আশেপাশে দেখলে পাত্তা দেয় না। হয়তো বা অন্য কেউ হলে এতোক্ষণে তাকেও পাত্তা না দিয়ে নিজের কাজে চলে যেতো। কিন্তু এবার এমন কিছুই না করে আগ্রহ নিয়ে মেয়েটির নাম জিজ্ঞেস করতেই মেয়েটি মুচকি হেসে বললো,

—“আমি ইনায়া! ইনায়া শিকদার ইরা। ”

কেনীথ কিছু মূহুর্ত একনাগাড়ে ইনায়াকে দেখে কিঞ্চিৎ মুচকি হাসলো। এরপর ইনায়া উদ্দেশ্যে বললো,

—“তুমি এখানে….কিভাবে? ”

যদিও এর উত্তরটা কেনীথের জানা তবে তার উদ্দেশ্য কিছু ভিন্ন।

—“তোমার পি.এ. আ..আপনার পি.এ……

—“ইট’স ওকে, তুমি করেই বলতে পারো। ”

ইনায়া খুশি হয়ে মুচকি হেসে ফেললো।

—“তোমার পি.এ. আনায়া শিকদারের ছোট বোন আমি। ”

—“ওহ! বোনের সাথে বেড়াতে এসেছো? ”

—“হুম আবার না। আমি তোমার অন্নেক বড় ফ্যান। আর আমি তোমার সাথেই দেখা করতে এসেছি। এটা আমার লাইফের ড্রিম ছিলো যা আজ পুরন হয়ে গিয়েছে, ইয়াহু!!”

বলেই খুশিতে চোখ মুখ কিঞ্চিৎ খিঁচে ফেললো।

ইনায়া রুম থেকে বেড়িয়ে আশেপাশে আস্তে আস্তে হাটাহাটি করে চারপাশ দেখছিলো। এরই মাঝে কেনীথ অফিসে এসে নিজের কেবিনের দিকে যেতে নিলে হঠাৎ ইনায়ার নজরে পড়ে কেনীথ। আর মূহুর্তেই পেছন থেকে আন্দাজে চিনতে পেরে কেনীথকে ডাক দেয়।

এরপর কেনীথ ওকে নিজের কেবিনে নিয়ে এসে স্টাফকে ডেকে কিছু চকলেটের ব্যবস্থা করতে বলে। এরপর ওর থেকে ধীরে ধীরে অনেক কিছুই শুনতে থাকে। বিশেষ করে আনায়া আর তার বাবার সম্পর্কে। ইনায়া তো এমন সঙ্গ পেয়ে দিন দুনিয়া ভুলে যাওয়ার মতো অবস্থা। কেনীথ এক লাইন জিজ্ঞেস করলে ইনায়া দশ লাইন বলে দিয়েছে।

কেনীথ একপর্যায়ে নানান জিজ্ঞেসা করতে গিয়ে আনায়া আর রেহানের সম্পর্কেও অনেক কিছু জানিয়ে দেয়। বিশেষ করে সকাল বেলায় রেহানের পাঠানো আইফোন সঙ্গে ফুলের তোড়া। আবার আনায়ার প্রতি রেহানের কেয়ারিং বিহেভিয়ার। মোটামুটি সবকিছুই বলেছে কেনীথকে। যদিও এসব জানার পর কেনীথের মাথায় অনেক কিছুই চলছিলো কিন্তু এখনই সে কোনো পদক্ষেপ নিতে চাইনি। কিন্তু শেষমেশ হয়তো ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে আনায়ার সাথে ওমন অপ্রত্যাশিত কাজ করে নিজের রাগ ঝেড়ে দেয়।

_______________

আনায়া ধীরে ধীরে চোখ খুলে আশপাশ দেখতে চাইলো। হঠাৎ ওমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা আর র*ক্ত দেখে তার মস্তিষ্ক আর সক্রিয় থাকতে পারেনি। মূহুর্তেই নিজের আঙ্গুলের ডগার র*ক্ত দেখতে দেখতে মাথা ঘুরে সেন্সলেস হয়ে যায়।

আনায়া সেন্সলেস হয়ে ফ্লোরে পড়ে যেতে নিলেই কেনীথ কিছুটা অবাক হয়ে আনায়াকে ধরে টান দিতে নিলেই আনায়া ওর বুকের উপর পড়ে যায়।

কেনীথ ভেবেছিলো আনায়া হয়তো অনেকটাই বিস্মিত হবে। এরপর হয়তো যেকোনো একটা পদক্ষেপ নিবে নয়তো শক্-ড হয়ে কিছুই করবে না।কিন্তু এভাবে সেন্সলেস হয়ে যাওয়াতে কেনীথ কিঞ্চিৎ কপাল কুঁচকে ভাবতে লাগলো হঠাৎ এমনটা হওয়ার কারণ কি? ও কি একটু বেশিই শকড হয়ে গিয়েছে।

পরক্ষণেই কেনীথের কিছু একটা মনে পড়ে মুচকি হেসে বলিষ্ঠ হাতে নিজের সাথে আগলে রাখা আনায়ার অচেতন চেহারা দিকে তাকিয়ে বললো,

—“হোয়াট আ কম্বিনেশন আমাদের! আমি যেটাকে ভালোবাসি, ও সেটাকেই ভয় পায়!…. হিমোফোবিয়া। ”

শেষের শব্দটি বিড়বিড় করে বলে আবারও কিঞ্চিৎ ঠোঁট কামড়ে কেনীথ হাসলো। আনায়ার যে হিমোফোবিয়া আছে সেটা কেনীথের জানা ছিলো কিন্তু বিষয়টি তটটা গুরুতর আর অনেকদিনের পুরনো বিষয় হওয়ায় কেনীথের সেভাবে খেয়াল ছিলো না।

কেনীথ আর দেরী না করে আনায়া পাঁজাকোলে নিয়ে রুমে থাকা সোফায় উপর শুইয়ে দিলো। এরপর কেবিনের ভেতরেই থাকা ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এসে আনায়ার মুখের কাছে হাঁটু গেড়ে বসলো।

এরপর অল্প করে তুলো নিয়ে তাতে হালকা মেডিসিন লাগিয়ে আনায়া ঠোঁটের বাম অংশে বিচ্ছিরী ভাবে কেটে যাওয়া জায়গাটায় লেগে থাকা রক্ত ধীর ধীরে পরিষ্কার করতে লাগলো।

জায়গাটা ভালোভাবে পরিষ্কার করতেই কেনীথ খেয়াল করলো গোলাপি ঠোঁটের প্রায় অর্ধেকটা কেমন যেন কালচে বর্ণের হয়ে যাচ্ছে। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বুড়ো আঙুল দিয়ে ধীরে ধীরে ক্ষত জায়গাটায় বুলিয়ে দিতে লাগলো। আর অপলক ভাবে একবার আনায়ার অচেতন চেহারাকে দেখছে তো একবার তার ঠোঁটকে। এভাবেই কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর কেনীথ মৃদুস্বরে বললো,

—“এসব কিছু তুই নিজেই নিজের ভাগ্যে টেনে এনেছিস। নয়তো আমি তো সবকিছুই ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু এবার আর তেমন কিছুই হচ্ছে না, ভুল যখন করেই ফেলেছিস তার ফলাফল তো এখন সারাজীবন ভোগ করতেই হবে।”

______________

প্রায় অনেকক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর আনায়া জ্ঞান ফিরলে, সে ধীরে ধীরে চোখ খুলে তার সামনে কেনীথের চেহারা স্পষ্ট হতে নিলে আনায়া পূর্ববর্তী ঘটনা গুলো মনে করতে চাইলো।
কিছুক্ষণ আগে ঠিক কি হয়েছিলো তা মস্তিষ্কে নাড়াচাড়া দিতেই আনায়া ত্বরিত চমকে বসে পড়লো।

অন্যদিকে কেনীথ নির্বিকারভাবে ওভাবেই হাঁটু গেড়ে বসে বসে আনায়াকে দেখছিলো। কিন্তু আনায়া জ্ঞান ফিরে চমকে উঠে বসলেও কেনীথের মাঝে নড়চড় হলো না। সে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকা আনায়ার দিকে নির্বিকারে তাকিয়ে রইলো।

এদিকে আনায়া একটু আগের ঘটনাটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য দ্রুত নিজের ঠোঁটে হাত দিতেই ব্যাথার চোটে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো। এরপর দ্রুত কেনীথের নিস্তব্ধ চেহারার দিকে ভয়ার্ত আর রাগী কন্ঠে বলতে লাগলো,

—“কে আপনি! এমনটা কেনো করলেন আমার সাথে। আপনি… আপনি এতোটা জঘন্য কাজ…… কিভাবে করলেন আপনি আমার সাথে। কোন সাহসে আপনি এই কাজ করলেন। আমি জানতাম আপনি সবার থেকে আলাদা, স্বাভাবিক নন আপনি। এইজন্য আপনার সব কাজকেই নিজের বড় ভাইয়ের মতো ভেবেছি তবে এটা কেমন অসভ্যতা ছিলো। ”

আনায়া শেষের কথাগুলো কিছুটা চেঁচিয়ে রাগান্বিত সুরে বললো। যেন ভেতরে ভেতরে তার রাগ ক্রমান্বয়ে বেড়ে উঠছে।
কেনীথ আনায়ার এহেন অবস্থা দেখে কিঞ্চিৎ হেসে বললো,

—“একটু আস্তে, চেচামেচি আমার পছন্দ নয়। ”

আনায়া যেন নিজের রাগান্বিত কন্ঠস্বরকে আরেকটু কঠোর করে রাগে ফুঁসতে লাগলো। সঙ্গে রাগের দরূন দাঁত খিঁচে বললো,

—“আপনি যেটা করেছেন, এরপরও আপনি বলছেন চেচামেচি আপনারা পছন্দ নয়। এটা তো যাস্ট কিছুই নয়। সরুন আপনি আমার সামনে থেকে, আমাকে যেতে দিন নয়তো আমি চিল্লিয়ে চিল্লায়ে সবাইকে জানিয়ে দেবো যে আপনি কত বড় মুখোশধারী জানো*য়ার। ”

আনায়ার কথা শুনে কেনীথ হেসে বললো,

—-“পুরো অফিসের প্রত্যেকটা রুমই সাউন্ড প্রুফ আর এই রুমের দরজাও কিন্তু লাগানো ।”

আনায়া এটা শুনতেই নিজেকে তটস্থ করলো। নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে বললো,

—” কেনো এমন অসভ্যতা করলেন। কোন অধিকারে করলেন এমন কাজ। নিজেকে এক নিকৃষ্ট মানবের পরিচয় দিতে? ”

—“উহু!আমি কিছুই করতে চাইনি, তুই নিজে বাধ্য করেছিস আমায়। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে সবকিছুর জন্য তুই নিজেই দায়ী। আর অধিকারের কথা বললে সেটা আমার আছে। আমি চাইলে……

কেনীথের বাকি কথাটুকু সম্পূর্ণ করার আর সুযোগ হলো না। তার আগেই শক্তপোক্ত এক চড়ের আঘাত এসে তার গালের উপর পড়লো। সেই সঙ্গেই কেনীথ চোখমুখ শক্ত করে আনায়ার দিকে তাকালো।

অন্যদিকে আনায়া নিজের এই কাজে একটুও বিস্মিত নয়। অন্যান্য সময়ের মতো হলে হয়তো তার মাঝে আতংক কাজ করতো, তেমন কোনো কিছুরই আভাস আর এখন নেই। আনায়ার চোখমুখও শক্তপোক্ত করে রাগান্বিত চোখে কেনীথকে দেখে যাচ্ছে।

তখনই কেনীথ অকপটে বলতে লাগলো,

—“হিসেব অনুযায়ী এই চড়টা আমার দেওয়ার কথা ছিলো কিন্তু এই নিয়ে তুই দুই বার ঠিক একই ভুল করলি। ”

কেনীথের কথায় হঠাৎ আনায়ার সেইদিন কনসার্টের রাতে কেনীথকে চ*ড় মারার কথাটা মনে পড়লো। কিন্তু সে যেমনটা ভেবে রেখেছিলো বিষয়টি যেদিন কেনীথ জানতে পারবে সেই মেয়েটা আসালে সে; সেদিন নিশ্চয় কেনীথ কি করবে এই ভেবেই নিজের বারো তেরোটা বেজে যাবে। অথচ এই মূহুর্তে তার কিছুই মনে হচ্ছে না।উল্টো ক্ষেপে গিয়ে বললো,

—“আপনি এতোটা খারাপ? সেই ঘটনারই শোধ নিলেন আজ, তাই না। আর কি বললেন আপনি, আমি ভুল করেছি? আমি মোটেও কোনো ভুল করিনি। সেদিনও আমি ঠিক করেছিলাম আর আজও আমি ঠিক করেছি। কারণ এসব আপনার প্রাপ্য ছিলো। ”

কেনীথ আনায়ার কথা শুনে মুচকি হেসে বললো,

—“আমি মোটেও সেই ঘটনার শোধ নেইনি। আমি যদি সত্যিই কিছু করতে চাইতাম তবে আজ তুই এখানে জ্যান্ত থাকতে পারতি না। তখনই বলেছিলাম, এটা যাস্ট তোর বার্ডে গিফট ছিলো। প্রেমিক, আশিকদের মতো বার্থডেতে ফোন, জুয়েলারি, ফ্লাওয়ার দেওয়ার মতো নরমাল জিনিস তুই কখনো আমার কাছে পাবি না। কেনীথ মানেই অবশ্যই সেটা ইউনিকই হবে।”

আনায়া কেনীথের কথাগুলোকে নিজের মস্তিষ্কে বিশ্লেষণ করতে চাইলো। তার শুধু এটাই মনে হচ্ছে এই ভিকে মোটেও কোনো স্বাভাবিক লোক নয়।এর নিশ্চয় কোনো আলাদা উদ্দেশ্য রয়েছে। তাই অনেকটাই নিজের কন্ঠস্বরকে কঠোর করে বললো,

—“কি চাই আপনার? আপনি ঠিক কোন উদ্দেশ্যে আমার জীবনে এসেছেন বলবেন, প্লিজ?

কেনীথ এবার হাঁটু গেড়ে বসা থেকে উঠে দাড়ালো। এরপর তার কেটে যাওয়া হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো জায়গাটা পরিষ্কার করা হয়নি সঙ্গে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা র*ক্তগুলো অনেকটা শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে।

তার দিকে শক্ত চোখে তাকিয়ে সোফায় বসে থাকা আনায়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো কেনীথ। এরপর তার সেই কাটা হাতটাকেই আনায়ার দিকে এগিয়ে আনায়ার কাঁধের পাশে সোফায় হাতের ভর দিয়ে আনায়ার দিকে নিজেকে অগ্রসর করলো। একটা সময় পর আনায়ার কঠোর চেহারার ঠিক সামনাসামনি নিজের মুখটাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে অকপটে বলতে লাগলো,

—“চাই তো আমি অনেক কিছুই কিন্তু আমি যা যা চাই তা কি তুই দিতে পারবি?”

আনায়া উত্তরে কিছুই বললো না। বরং চোখমুখ শক্ত করে একই ভাবে কেনীথের দিকে তাকিয়ে রইলো। কেনীথ আজ তার এতো কাছে থাকার পরও তার মাঝে কোনো সংকোচ কিংবা ভয়ের বিন্দুমাত্র আভাস নেই। শুধু তার সামনে থাকা লোকটির প্রতি প্রতিনিয়ত তীব্র ঘৃণা, রাগ আর ক্ষোভ জন্মাচ্ছে। এরই মাঝে কেনীথও নিজের চোখমুখ শক্ত করে গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললো,

—“পারবি না তো! জানি তো, তুই কিছুই ফিরিয়ে দিতে পারবি না।কারণ তুই তো শুধু কেঁড়ে নিতে জানিস। আমার সর্বস্ব কেঁড়ে নেওয়ার পেছনে শুধু তুই-ই দায়ী। ”

যদিও আনায়া এই কথার অর্থ বুঝলো না। আর সে বুঝতেও চাইলো না।এই লোকটিকে তার যাস্ট অসহ্য লাগছে। মনে হচ্ছে একে শেষ করে দিতে পারলেই শান্তি। আনায়া চোখমুখ খানিকটা খিঁচে কেনীথকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। কারণ তার সামান্য ধাক্কায় কেনীথের কিছুই হলো না।

কেনীথ যেহেতু আনায়াকে এক হাতের সাহায্যে আবদ্ধ করে রেখেছিলো তাই, আনায়া অন্যপাশ দিয়ে সহজেই বসা থেকে উঠে এসে বেড়িয়ে এলো। কেনীথ চাইলে অবশ্য আনায়াকে সহজেই আটকাতে পারতো কিন্তু এমনটা সে করলো না।বরং কেনীথও সোজা হয়ে দাড়িয়ে পকেটে হাত গুঁজে আনায়ার দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে রইলো।

এদিকে আনায়া প্রথমে আর এক মূহুর্তেও দেরী না করে রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে চাইলেও পুনোরায় ফিরে এসে কেনীথের সামনে এসে দাঁড়াতেই কেনীথ মুচকি হেসে বললো,

—“কি হলো, আরো কিছু চাই নাকি?”

আনায়া ঠিকই কেনীথের কথার উদ্দেশ্য বুঝলো তবে সেটাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে অকপটে বলতে লাগলো,

—“আমি রিজাইন করতে চাই। আর এক মূহুর্তেও এখানে থাকার ইচ্ছে নেই আমার।”

কেনীথ আনায়ার কথা শুনে আবারও মুচকি হাসলো। এরপর ঘাড়টাকে কিঞ্চিৎ কাত করে বলতে লাগলো,

—“তারা মাই ব্লাড, এভাবে বোকার মতো কথা বলতে নেই। বাড়িতে অসুস্থ বাবা, ছোট বোন রয়েছে। এখন এই জবটা ছেড়ে দিলে তাদের যথাযথ দেখভাল করবি কিভাবে?
আর তোর সো কল্ড ইমন ভাই নিশ্চয় তোকে জয়েনিং লেটারটা পড়িয়েই সাইন করিয়েছিলো। যদি এমনটা হয় তবে, তোর তো জানার কথা যে এই অফিসের যেকোনো সেক্টর থেকে কেউ ছ’মাসের আগে রিজাইন করতে পারবে না সঙ্গে স্বইচ্ছায় রিজাইন করতে হলে তার পরিবর্তে অন্যকাউকে সেই পজিশনে বসিয়ে যেতে হবে। আর এসব কেউ না মানলে তাকে অর্ধশত কোটি টাকা নয়তো পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হবে।”

আনায়া কেনীথের এসব কথায় এবার প্রায় অনেকটাই বিস্মিত হয়ে বললো,

—“এগুলো আবার কেমন নিয়ম ? এসবের মানেই বা কি? আমি এসব মানি না। আমাকে তো এসব আগে কেউই বলেনি তবে এগুলো…….

এটুকু বলেই আনায়া থেমে গিয়ে অফিসের প্রথম দিনের কথা ভাবতে লাগলো। সেইদিন ইমন তাকে দিয়ে অনেকগুলো ফাইলে সাইন করিয়ে নিয়েছিলো কিন্তু এইসব বিষয়ে তো কিছুই বলেনি। আনায়া চোখেমুখে যেমন বিস্ময় তেমনি ও হঠাৎ অনেকটাই ঘাবড়ে গিয়েছে। যা দেখে কেনীথ ওর দিকে কিছুদূর অগ্রসর হয়ে দুজনেট মাঝে খানিকটা দূরত্ব কমিয়ে মুচকি হেসে বললো,

—“এসব হলো ধোঁকা! তোর সো কোল্ড ইমন ভাই তোকে এখানে ফাঁসিয়ে দিয়ে নিজে কেটে পড়েছে। ওকে খুব বেশি চালাক তো বলবো না তবে তুই যে মস্ত বড় গাধী এটা সিওর।

তোর আশেপাশের সবাই তোকে ধোঁকা দিয়েছে রে তারা। মনে হয় তোর জীবনের ব্যাড টাইম চলছে ;যা তোর বাকি পুরো জীবনটাতেও একই ভাবে চলতে থাকবে।”

কথা শেষ করে কেনীথ মজার সঙ্গে সহানুভূতি সূচকে আনায়ার দিকে চেয়ে মুচকি হাসলো।
অন্যদিকে আনায়ার গলায় কাটার মতো বিঁধছে। মাথার মধ্যে অনেক কিছুই ঘুরপাক খাচ্ছে কিন্তু এই মূহুর্তে এই কেনীথ নামক খারাপ লোকটির সামনে মোটেও দূর্বল হওয়া যাবে না। আনায়া তীক্ষ্ণ কন্ঠে কেনীথের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো,

—“আমার কপালে কি আছে না আছে সেটা আপনার ভাবতে হবে না। আর আমার বাড়িতে যে অসুস্থ বাবা রয়েছে এটা নিশ্চয় ইনায়া বলেছে, ওকে তো আমি পরে দেখে নেবো। তার আগে আপনি আমাকে এটা বলুন যে আপনি আমার এই নাম কি জানেন। আমি তার মানে ভুল ছিলাম না, সেদিন সত্যিই আপনি আমাকে তারা নামেই ডেকে ছিলেন।
এই নাম শুধু আমার ফ্যামিলির কিছু মানুষ ছাড়া কেউই জানে না। এমনকি ইনায়াও পর্যন্ত জানে না। তাহলে বলুন আপনি কিভাবে জানেন আমার এই নাম? ”

কেনীথ আনায়ার দিকে আরো কিছুটা এগিয়ে এলো। এবার আনায়া আর তার মাঝের দূরত্বটা অনেকটাই ক্ষীণ। কেনীথ আনায়ার রাগে লাল হয়ে যাওয়া ফর্সা গালের দিকে চেয়ে রইলো। এরপর অমায়িক মুচকি হেসে বললো,

—“আমি কি সেই ফ্যামিলি মেম্বারদের মধ্যে কেউ হতে পারি না? ”

কেনীথ কথা বলতে বলতেই আনায়া গালে নিজের হাত ছোঁয়াতে চাইলে আনায়া কেনীথের কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে কেনীথের থেকে দূরে পেছনের দিকে সরে গেলো। কেনীথও নিজের হাত গুটিয়ে নিলো মুচকি হেসে।

এদিকে আনায়ার আর কোনো কিছু শোনার ইচ্ছে নেই। প্রচন্ড রকমের ঘৃনা হচ্ছে কেনীথের উপর। সে সব কিছু সহ্য করতে রাজি ছিলো কিন্তু এমন নোংরামো সে কোনো কিছুতেই আর সহ্য করতে পারবে না।

আনায়া কেনীথের হাসোজ্জল চেহারার দিকে কটমট করে ঘৃণার দৃষ্টিতে ক্ষণিকের জন্য তাকিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য অগ্রসর হলে তা দেখে কেনীথ মুচকি হেসে বললো,

—“তারা মাই ব্লাড! একটু সময়টাও তো দেখ, এতো রাতে একা একা কিভাবে যাবি।”

আনায়া কেনীথের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললো,

—“আমি জাহান্নামে যাই তাতে আপনার কি? আপনাকে তো আমি পরে অবশ্যই দেখে নেবো।”

—” অফিসের সবাইকে এগারোটা মধ্যে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। আর বারোটা বাজতে এখনও আরেকটু সময় আছে, চাইলে দেখে নিতে পারিস। জন্মদিনের জন্য তো এটুকু ছাড় দিতেই পারি। ”

বলেই কেনীথ আপনার দিকে একচোখ মেরে ইশারা করলো। আনায়া যেন কেনীথের কথার উদ্দেশ্য আর এসব দেখে আরেক দফায় রেগে গেলো।

—“এতো হাইপার হওয়ায় কিছু নেই। আমি বাড়ির সামনে পৌঁছে দিয়ে আসছি, দুইতিন দিন একটু ভেবেচিন্তে রেস্ট নিয়ে আবার কাজে চলে আসিস। এছাড়া তোর আর কিছু করারও নেই।”

—“আপনাকে বলে দিতে হবে না আমি কি করবো আর না করবো। আর আমি একাই যেতে পারবো,আপনার মতো নিকৃষ্ট মানবের সাহায্যের কোনো প্রয়োজন নেই। ”

—“তবে কি তোর সো কল্ড ইমন ভাইকে ডাকবি? যে তোকে এমন এক জায়গায় ফাঁসিয়ে দিয়েছে। নাকি পুরো রাস্তায় একা একাই যাবি। দেখিস কিন্তু, রাস্তায় যেন আবার আলতু ফালতু লোকের খপ্পরে না পড়ে যাস। কেনীথ কিন্তু আবার তখন হিরোদের মতো মাঝ রাস্তায় গিয়ে ফাইট করে, ওদের থেকে তোকে বাঁচাতে যাবে না।”

—“আর যাই হোক, ওরা আপনার চেয়ে ভালোই হবে। ”

কেনীথ আনায়ার কথা শুনে হেসে ফেললো।

—“সিরিয়াসলি! আমি তো তেমন কিছুই করলাম না তার আগেই আমাকে ওদের চেয়ে নিন্মস্তরে বসিয়ে দিলি। এক্সপেরিয়েন্স আছে নাকি?
অবশ্য থাকতেও পারে। তোর আশিকের সাথে ভিডিও স্ক্রিনে কিসমিস খেতে খারাপ লাগে না কিন্তু আমি কিছু করলেই খারাপ হয়ে যাই। বাহ, ব্যাপারটা ফিল্মের হিরো আর ভিলেনের মতো হয়ে গেলো, তাই না? ”

আনায়া আর কিছুই বললো না।নিজেকে সর্বোচ্চ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো। সঙ্গে কেনীথের কথা শুনে সেই রাতের কথা মনে পড়ে গেলো। যেদিন ইমন আর আনায়া মাঝ পথ অতিক্রমের পর গাড়িতে হুট করেই কেনীথকে দেখেছিলো। তার মানে সে যখন ভিডিও কলে কথা বলছিলো তখন কেনীথ সবকিছুই পেছন থেকে দেখেছিলো। এই লোকের সাথে আর কথা বাড়ানোর মতো বিন্দুমাত্র আগ্রহ আর নেই। প্রচন্ড রকমের ঘৃণা হচ্ছে কেনীথের উপর। একটা মানুষ এতোটা জঘন্য হয়েও কিভাবে এভাবে মুখোশধারী হয়ে সবার আইডল হয়ে যায় তা আনায়া ভেবে কুল পায় না।

আনায়া কেনীথকে অনেকটা অগ্রাহ্য করে রুম থেকে আবারও বেড়িয়ে যেতে অগ্রসর হলে পেছন থেকে কেনীথের আরো কিছু কথা শুনে আনায়া থমকে পিছনে তাকালো।

—-“আপাতত আর জেদ করিস না। তোর নিজের সাথে কিছু না হলেও পরবর্তীতে আবার যেন মিঃ রেহানের সাথে কিছু না হয়ে যায়। বেচারা এমনিতেই একটা বড়সড় এক্সিডেন্ট থেকে প্রাণ নিয়ে বেঁচে গিয়েছে । নেক্সট টাইম কিন্তু এমনটা নাও হতে পারে। দেখা গেলো, এবার সোজাসাপটা উপরে… চলে…..

কেনীথ আনায়া বিস্মিত চেহারা দেখে এতোটুকু বলেই থেমে গেলো। ও খুব ভালো করেই জানতো এমনটাই হবে। এদিকে মুহূর্তেই আনায়া ফিরে এসে কেনীথের একদম মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ কেনীথের বাঁকা হাসোজ্জল মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর, দাঁতমুখ খিঁচিয়ে কেনীথের কালো টিশার্টের গলার কাছের অংশ গুলো দু-হাত দিয়ে জোরে হাতের মুঠো করে টেনে ধরলো। এরপর তীব্র রাগান্বিত তীক্ষ্ণ আর বিস্মিত কন্ঠে বলতে লাগলো,

—“রেহানের এক্সিডেন্ট তার মানে…… পুরোটাই আপনার জন্য হয়েছে। ওটা যাস্ট এক্সিডেন্ট নয় বরং আপনার নোংরা পরিকল্পনা! ”

কেনীথ আনায়ার কাঁদো কাঁদো রাগী চেহারা দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। সঙ্গে সঙ্গেই তার একহাত দিয়ে আনায়ার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে নিজের কাছে টেনে, একবারে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে মুচকি হেসে বলতে লাগলো,

—“হুম তো! পরপুরুষের সাথে এতো মেলামেশা সহ্য হচ্ছিলো না। তাই একটুও ট্রেইলার দেখিয়েছি, তুই চাইলে পুরো পিকচারটাও রেডি করে ফেলতে পারি।”

আনায়া এটা শুনে আর কিছুই বললো না। সে কেনীথের দিকে স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে। কেনীথের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার মতোও চিন্তাভাবনা তার মাথায় আসছে না।
তার এক চেহারায় একইসাথে রাগ, ক্ষো*ভ, ভয়, বিস্ময়,আ*তংক সবকিছু বিরাজ করছে। আনায়া সত্যিই বুঝতে পারছে না সে ঠিক কি করবে। এটা সে কোন জাহান্নামে পড়ে গেলো সে নিজেও জানে না।তার মস্তিষ্কে এখন আর কিছু ভাবারও সামর্থ হারিয়ে ফেলছে। তবে এতটুকু ঠিকই বুঝতে পারছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে মুক্তি পেতে হবে নয়তো তার জীবনের পাশাপাশি তার পরিবারও ছারখার করে দেবে এই লোক।

________________

সাই-সাই করে গাড়ি ছুটে চলেছে। আর সেই গাড়ির মাঝে নির্বিকারে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে কেনীথ। তার পাশেই আঁটসাঁট হয়ে বসে রইছে আনায়া। চোখেমুখে নানান চিন্তার ছাপ সঙ্গে পাশে থাকা লোকটির প্রতি প্রচন্ড ঘৃণা আর ক্ষো*ভ যেন প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে।

নিজের ভাগ্যের প্রতিও তার প্রচন্ড তাচ্ছিল্য করতে ইচ্ছে হচ্ছে। তার জীবনটা এমন না হয়ে আর পাঁচটা স্বাভাবিক মেয়ের মতো হতে পারতো না! অল্প বয়সেই মাকে হারিয়েছে আবার বাবাও বেশিদিন না যেতেই এতো অসুস্থ হয়ে পড়লো। সঙ্গে ছোট বোনটাকেও ঠিকভাবে মানুষ করার দায়িত্ব। এসব নিয়ে আগে কখনো আফসোস করতে ইচ্ছে না হলেও এখন প্রচুর আফসোস হচ্ছে নিজের ভাগ্য নিয়ে।

ছোট খাটো বিষয়গুলোতেই সে নিজের সুখ শান্তি খুঁজে নিতে চাইতো। সবার মুখে হাসি ফুটাতে পারলেই সেটা তার জীবনের সার্থকতা হয়ে যেত। কখনোই নিজের দুঃখ, কষ্ট, অনুভূতিকে প্রাধান্য দেয়নি। অথচ এত সেক্রিফাইসের পর তার কপালে এসব জুটলো। আর কত সহ্য করবে এসব। নিজের জীবনটাকেই তার অসহ্য লাগছে।

আনায়া চোখে মুখে যেমন রাগের ছাপ রয়েছে তেমনি তাচ্ছিল্য আর কষ্টেরও। চোখে পানি ছলছল করছে। তবুও চোখ হতে পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই রাগ নিয়ে ত্বরিত তা হাতের তালু দিয়ে মুছে ফেলছে।

এরই মাঝে কেনীথ একহাত দিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করতে করতেই অন্যহাত দিয়ে গাড়ির গ্লাভ বক্স থেকে কালো রংএর মাক্স বের করে আনায়ার সামনে ধরলো। আনায়া কেনীথের হাতের দিকে তাকিয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকালো। তখনই কেনীথ মুচকি হেসে বললো,

—“ঠোঁটের ক্ষতটা একটু বেশিই। কয়েকদিন হয়তো লাগবে পুরোপুরি ঠিক হতে। ততদিন পর্যন্ত এটা দিয়েই কাজ চালিয়ে নিস।”

আনায়ার চোখে যতটুকু পানি ছিলো ততটুকুও যেন এবার গায়েব হয়ে গেলো। চোখমুখ রাগে লাল হয়ে গেলো সঙ্গে কটমট করে কিছুক্ষণ কেনীথের দিকে তাকিয়ে থাকার পর ওর হাত থেকে মাক্সটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিলো। অন্যদিকে কেনীথ একহাতে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে মুচকি হেসে বললো,

—“আই লাইক দ্যাট! সত্যি বলছি, তোর প্রতি আমার ইন্টারেস্ট কোনো কালেই খুব একটা ছিলো না। কিন্তু তোর এই তেজ…….উফ!!! লাইক অ্যা ফায়ার বার্ড…আমার আগুন পাখি!….পুরো মা*রাত্মক ঘায়েল করার মতো।”

সামনের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলেই পাশে তাকিয়ে আনায়ার দিকে এক চোখ মারলো। এদিকে আনায়া কিছুটা স্তব্ধ চোখে কেনীথকে দেখার পর নির্বিকার কেনীথের উদ্দ্যেশে বললো,

—“কবে থেকে পিছু নিয়েছেন আমার? কই আমি তো আপনাকে আগে থেকে কখনো চিনতাম না তবে আপনি কিভাবে চেনেন আমায়?”

কেনীথ এবার গম্ভীর সুরে বললো,

—“তুই আমাকে কি চিনবি! তুই তো নিজেই নিজেকে এখনো পুরোপুরি চিনতে পারিসনি। শুধু এতোটুকুই বলবো তুই নিজেকে যতটুকু চিনিস তার চেয়ে বহুগুণ বেশি আমি তোকে চিনি। ”

___________________

আনায়াকে দেখতে অনেকটাই বিধ্বস্ত লাগছে। মুখে কালো মাক্স সঙ্গে এলোমেলো হয়ে থাকা মেসি বান। বাড়িতে ঢুকে আজ আর নিজের রুমে যায়নি। আজ ইচ্ছে করেই জামা কাপড় নিয়ে দ্বিতীয় তলার ফাঁকা রুমে চলে গিয়েছে। শিকদার বাড়িতে উপর তলায় সাধারণ তাদের তেমন যাওয়া আসা থাকে না।

ওই রহস্যময় ঘরটি ব্যাতীত বাকি ঘর গুলো সাধারণ ভাবে পরিষ্কার করে সাজিয়েগুছিয়ে রাখা থাকে। যে কেউ চাইলেই মনের ইচ্ছেতেই সেসব রুমে থাকতে পারে। এমনিতেই রাতের বেলায় বাড়িতে তেমন লাইট জ্বালিয়ে রাখা হয় না বিধায় অনেকটা অন্ধকার থাকে চারপাশ। সেই সঙ্গে উপর তলায় পুরো করিডরে একটি লাইট ব্যতীত অন্য কোনো আলোর ব্যবস্থা রাতের বেলায় নেই। যে কারণে উপর তলাটা আরো বেশি অন্ধকার।

আনায়া উপরের তলায় একটি রুমকে কিছুটা নিজের মতোই সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছে। মাঝেমধ্যে মন ভালো না থাকলে সেই রুমে গিয়েই থাকে। সব রুমের মাঝে ঐ রুমটা বেছে নেওয়ার কারণ, রুমের বড় জানালাটা দিয়ে প্রচুর আলো বাতাসের প্রবেশ ঘটে। এছাড়া জায়গাটা নিরিবিলি আর রাতের বেলায় পূর্ণ চাঁদ কিংবা আকাশ দেখার সুযোগ থাকায় বেশ শান্তিও লাগে।

আনায়া যথারীতি সেই রুমের উদ্দেশ্য অগ্রসর হতে নিলেই রুমের ঠিক দরজার কাছে এসে তার পা জোড়া থেমে যায়। পেছন থেকে হঠাৎ ইনায়ার কন্ঠস্বর শুনে পেছনে ফিরে তাকালো।

—“আপু হঠাৎ তুমি আজ এখানে থাকবে নাকি?………আ….তুমি আজ মাক্স পড়ে আছো কেনো। তোমাকে এমন কেনো দেখাচ্ছে…. কিছু হয়েছে…..

আনায়া বিধ্বস্ত সুরে বললো,
—“ইনায়া পড়ে কথা বলবো।”

এই বলেই সামনে ফিরে রুমের দিকে যেতে নিলে ইনায়া বললো,

—“আপু তোমার জামার পেছনে এসব কি? দেখে তো লাল র*ক্তের মতোই….তোমার কিছু হয়নি তো….?”

ইনার কথা শুনে আনায়ার মনে পড়লো কেনীথ তার কাটা হাতে কোমড় পেঁচিয়ে ধরেছিলো, তখনই হয়তো র*ক্ত লেগে গিয়েছে। তার ঠোঁটেরও কয়েক ফোঁটা রক্ত তার সাদা জামার লেগে গিয়েছে। কিন্তু সেটা সামান্য হওয়ায় হয়তো তেমন নজরে আসেনি। কিন্তু হঠাৎ আবারও কেনীথের কথা মাথায় আসতেই আনায়ার মেজাজ বিগড়ে গেলো। পিছনে ফিরে ক্ষিপ্ত সুরে ইনায়াকে বললো,

—“কিচ্ছু হয়নি আমার, বেঁচে আছি আমি। আর আমাকে শান্তিতে বাঁচতে দে। রাতের বেলায় কোনো সিনক্রিয়েট করতে চাচ্ছি না। বাবাকে তুই আর ফরিদা খালা কিছুদিন দেখে রাখিস। আর আমাকে কিছুদিন সব কিছু থেকে মুক্তি দে। আমার আর এসব ভালো লাগে না। সহ্য হয় না আমার এসব। ”

তার আওয়াজ যেন তারেকের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটায় সেজন্য যথেষ্ট নিচু আওয়াজেই কথা গুলো বললো। কিন্তু এই কথা যথেষ্ট তীক্ষ্ণ আর ঝাঁঝালো ছিলো। অন্যদিকে ইনায়া বোনের এমব ব্যবহারে কষ্ট পায়নি বরং সে বিস্মিত নিজের বোনকে এই রুপে দেখে। তার বোন সহজে কখনো এমন আচরণ করে না।

—“আপু… তুমি… কি হয়েছে প্লিজ বলো না।”

আনায়া আবারও ক্ষিপ্ত সুরে বললো,

—“বললাম তো কিছুই হয়নি! যা গিয়ে ঘুৃমিয়ে পড়!”

আনায়ার আর বিন্দু মাত্র অপেক্ষা না করে ত্বরিত রুমের দরজা খুলে সজোরে ইনায়ার মুখের সামনে দরজা লাগিয়ে দিলো। অন্যদিকে ইনায়া স্তব্ধ চোখে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো।

__________________

চাতক প্রায় অহর্নিশি………..
চেয়ে আছে কালো শশী
হব বলে চরণদাসী
হব বলে চরণদাসী…….

ঐ প্রেম যে করে সে জানে……
ঐ প্রেম যে করে সে জানে
আমার মনের মানুষের সনে
আমার মনের মানুষের সনে…..

————-
————

মেঘের বিদ্যুৎ মেঘে যেমন
লুকালে না পায় অন্বেষণ……..

ঐ রূপ হেরি এ দর্পণে
ঐ রূপ হেরি এ দর্পণে……..
আমার মনের মানুষের সনে
আমার মনের মানুষের সনে……….

মিলন হবে কত দিনে
মিলন হবে কত দিনে
আমার মনের মানুষের সনে…….

ফোনে গান চালু করে রেখে, বিছানার আঁটসাঁট হয়ে অনবরত চোখের পানি ফেলছে আনায়া। আজ সারারাত আদোও ঘুমাবে কিনা তা জানা নেই। সেই কখন থেকে যে কেঁদে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই।

গোসলের সময় পুরো সময়টা একই ভাবে কেঁদে কেঁদে কাটিয়ে দিয়েছে। ইচ্ছে তো করছে তার চিৎকার করে কাঁদতে কিন্তু সেই উপায়ও তো তার নেই। বাড়ির বড় মেয়ের পাশাপাশি একদম কর্তার মতোই তার দায়িত্ব। এমন মানুষদের কখনো নিজের কষ্ট অন্যের সামনে প্রকাশ করতে নেই।

পুরো সময়টা সে রেহানকেই মনে করে ফুপিয়েই কেঁদে গিয়েছে।খুব ইচ্ছে করছে নিজের পাশে রেহানকে কাছে পাওয়ার। কিন্তু এটাও তো সম্ভব নয়। তার ফুপিয়ে কাঁদার আওয়াজ যেন বাহিরে না যায় সেজন্য অল্প আওয়াজে গানিও চালাচ্ছে।ইনায়া অবশ্য কয়েকবার তাকে ডেকেছিলো কিন্তু আনায়া ভেতর থেকে কোনো রেসপন্স করেনি। ইনায়াও আর উপায় না পেয়ে তাকে বিরক্ত করতে চাইনি। এই সময়টায় একা ছেড়ে দেওয়াটাই ভালো হবে মনে করেছেন।

আনায়া ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই রেহানকে নিয়ে ভাবছিলো। ঠিক ঐ মূহুর্তে তার রেহানের চিঠির কথা মাথায় এলো। চিঠিটা সে ফোনের পেছনে ব্যাক কভারের মাঝে রেখে দিয়েছিলো। তড়িঘড়ি করে চোখের পানি মুছে নিয়ে চিঠিটা বের করলো। এরপর সেটা খুলে সম্পূর্ণটা বিড়বিড় করে পড়তে লগলো,

প্রিয় হবু বউ পাখি,

তোমার এই প্রেমিক পুরুষ কিন্তু আর দশটা প্রেমিক পুরুষের মতো সাজিয়ে গুছিয়ে কিছু লিখতে পারে না।তাই ভুল ত্রুটি গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখো।

এইসব চিঠি কিংবা প্রেমপত্রে নিজের অনুভূতির প্রকাশ আমার কাছে একেবারেই নতুন। কখনো ভাবিনি আমার জীবনেও এক স্নিগ্ধ প্রণয়নের আগমন ঘটবে। এক স্নিগ্ধ অমায়িক টোল পড়া হাসির মায়া জড়াবো। প্রেমে পড়তে বাধ্য হবো আমার জীবনে শীতের সকালের মতো আগমন হওয়া স্নিগ্ধ রুপের এক অতিথি পাখির। যার আগমন ক্ষনিকের জন্য থমকে দিয়েছিলো আমার সর্বস্বকে। যার রেশ আজও কাটেনি।

মনে পরে ভার্সিটির সেই নবীন বরণের কথা? শত মেয়ের প্রপোজ রিজেক্ট করে, তাদের মনকে চুরমার করে ফেলা; কোনোদিন মেয়েদের দিকে ফিরেও তাকিয়ে না দেখা ছেলেটাকে কি এমন জাদু যে করলে, সোজা একদেখাতেই তোমার জন্য পাগল হয়ে গেলো। রাতের ঘুম, দিনের প্রতিটা ক্ষণে ,আমার চিন্তা-চেতনা, মনে, এককথায় আমার সর্বস্বে নিজের আধিপত্য বিরাজ করে তোমার জন্য এক অগোছালো প্রেমিক পুরুষ বানিয়ে দিলে আমায়। এর উত্তর তো তুমিই ভালো জানো।

তোমার চিরচেনা হাসোজ্জল মুখ আজও আমার চিত্তে সম্পূর্ণ দৃশ্যমান। যদিও আমাদের মধ্যে এখন অনেকটাই দূরত্ব, তবুও আমার হৃদয়ের প্রতিটি ধ্বনি যেন তোমার কাছেই পৌঁছে যাচ্ছে। প্রতিদিন, প্রতিরাত, প্রতিক্ষণে তুমি আমার চিন্তায়,চেতনায়, স্বপ্নে চিত্তে সর্বস্বে বিরাজমান।

বিদেশের এই অচেনা শহরে বসে, যখন আমি অপরুপ সব প্রকৃতির মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চাই; কিন্তু আমি পারি না। তখনও আমার মন তোমার কাছে ফিরে আসে। তুমি মানো আর না মানো, আমার চিত্ত জুরে প্রতিনিয়ত শুধু তোমারই বিচরণ ঘটে । তুমিই যে আমার জীবনের সঙ্গী হবে , সে কথাই প্রতিনিয়ত আমার মনকে প্রফুল্লতায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

আর এই ভাবনা আমাকে সব কষ্ট ও ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়। তোমার স্মৃতিতেই আমি দিনরাত অনুভূতিতে ভাসি। তোমার মিষ্টি হাসি, তোমার কোমল স্পর্শ, এবং তোমার স্নেহময় কথা—সবকিছু যেন আমার সঙ্গে প্রতিটি মুহূর্তে রয়ে গেছে।

এই দূরত্ব আমাদের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করে তুলছে, কারণ আমি জানি তুমি আমার জীবনের অমূল্য অংশ। যদি কখনও মনে হয় যে আমি তোমার কাছ থেকে দূরে, মনে রেখো যে আমার হৃদয় সব সময় তোমার সঙ্গে রয়েছে।

প্রতিটি নতুন দিন আমাকে তোমার কাছে ফিরে আসার আরও একটি কারণ দেয়। আমি আশা করি, খুব শীঘ্রই এই দূরত্ব দূর হয়ে আমাদের মধুর মিলনের দিন আসবে। আমার সমস্ত প্রেম,প্রশ্রয়,অনুভূতি সবই তোমার জন্য।

সর্বশেষে তোমার এই জন্মদিন নামক বিশেষদিনে এই কামনা করছি যে সারাটা জীবন এভাবেই হাসিখুশি থাকো। তোমার ঐ প্রফুল্ল চিত্তের অন্তরালে আমায় একটু জায়গা দিও। জীবনের সকল সুখ দুঃখ গুলো প্রয়োজনে আমার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিও। আর তোমার এই অগোছালো প্রেমিক পুরুষটাকে একটু নিজ হাতে গুছিয়ে নিও। কেননা তোমার এই প্রেমিক পুরুষটা কিন্তু বড্ড অগোছালো। ঠিকভাবে গুছিয়ে নিতে না পারলে কিন্তু সারাজীবন বহু কষ্ট সহ্য করতে হবে। এই কষ্ট ঠিক কোন কষ্ট, আশাকরি আর আলাদাভাবে বুঝিয়ে বলতে হবে না।

যাইহোক, মনের গভীর থেকে এক বিশেষ মানুষের জন্য লেখা জীবনের প্রথম চিঠি। যে চিঠির সবটুকুতেই তোমার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আর ভালবাসার অনুভূতিগুলো থেকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি। সর্বশেষে আমার আর একটিই চাওয়া, আজীবন আমার জীবনে তুমি সেই শীতের সকালের অমায়িক শুভ্র প্রণয়ের অতিথি পাখি হয়েই থেকো। তোমার সময় ফুরিয়ে গেলে কখনো আবার আমায় ছেড়ে চলে যেও না।

ইতি
তোমার অগোছালো প্রেমিক পুরুষ।

#চলবে

#একজোড়া_আগুন_পাখি
®অরনীতা তুশ্মি (#তুশকন্যা)

পর্ব→১৮

পুরো চিঠিটি পড়ার সময় অঝোরে আনায়া চোখের জল ফেলেছে। সর্বশেষে ছেড়ে যাওয়ার কথা শুনে শব্দহীন ভাবে হাও মাও করে কাঁদার চেষ্টা করছে। এই অগোছালো প্রেমিক পুরুষকে সে কিভাবে ছেড়ে যাবে। সে তো এটা কল্পনাতেও কখনো ভাবতে পারে না। জীবনের অর্ধেকটাই তো শুধু তার জন্যই উৎসর্গ করা। তবে কিভাবে…….

আনায়া আর বেশি ভাবতে পারলো না। কেঁদে কেঁদে চেহারার বেহাল অবস্থা করেছে। গোসলের সময় ক্ষত ঠোঁটে জেদ করে বেশি ঘষামাজা করায় জায়গাটার ক্ষতটা আরো বেড়ে গিয়েছে। কেনীথের অনাগত ছোঁয়ায় প্রচন্ড ব্যাথাকেও আনায়া ভুলে গিয়ে আরো নিজেকে কষ্ট দিতে চেয়েছে।

আজও তার কাছে কিছু বছর আগে সেই ভার্সিটির নবীন বরণে রেহানের সাথে হওয়া প্রথম সাক্ষাৎ এখনো চোখের সামনে দৃশ্যমান। সময়টা তখন শীতকাল। সকাল সকাল ভার্সিটির নবীন বরণে খুব সাধারণ সাজগোছ করে পৌঁছে গিয়েছিলো। পরণে ছিলো আনায়ার মায়ের সাদা রংএর জামদানী শাড়ি। শাড়িতে যেমন খুব সাদামাটা কাজ, তেমনই আনায়ার সাদামাটা সাজ। বড় বড় চুল গুলো ছিলো খোলা। সঙ্গে প্রথমদিন ভার্সিটিতে যাওয়ায় ছিলো প্রচুর নার্ভাস। আর এই আঁটসাঁট হয়ে ভার্সিটিতে ঘুরাঘুরি করতে থাকা মেয়েটাকে চোখে পড়ে ভার্সিটির ক্রাশ বয় নামক সিনিয়রের।

এক নজরে দেখেই যতটা না ফিদা হয়েছিলো তার চেয়ে বেশি পাগল হয়েছিলো আনায়ার সেই হাসি মায়ায় পড়ে। এরপর যে ছেলেটা কোনো শত মেয়ের প্রপোজ রিজেক্ট করার রেকর্ড করেছিলো সে নিজেই আনায়ার পিছে পাগলের মতো ঘুরতে লাগলো ওকে মানানোর জন্য।

আনায়া প্রথমের দিকে এসবে কখনো যেতে চায়নি কিন্তু একটা সময় পর রেহানের এতোসব পাগলামি দেখে আর নিজেকে আটকাতে পারেনি। ওদের সম্পর্কটা খুব বেশি মাখোমাখো ছিলো না। সবসময় ওদের মাঝে একটা দূরত্ব বজায় থাকতো যেটা তারা বিয়ের পরই পুষিয়ে নিতে চেয়েছিলো। অথচ এই সাদামাটা জুটিটাই ভার্সিটিতে লাভ বার্ড নামে পরিচিত।

আনায়া এবার চিঠিটা রেখে দিয়ে কোনোকিছু না ভেবে সরাসরি রেহানকে ফোন করলো। এদিকে রেহান দুপুরের গোসল শেষে এইমাত্র রুমে এসেছে তখনই আনায়ার ফোন দেখে কিছুটা চমকে গেলো। বাংলাদেশে রাত তো এখন প্রায় অনেক। তবে এতো রাতে….. রেহান আর দেরী না করে দ্রুত আনায়ার ফোন রিসিভ করলো,

—“আনায়া! এতো রাতে কোনো সমস্যা……..

—“আমার তোমাকে চাই! আমার এসব আর ভালো লাগছে না।হয় তুমি আমার কাছে চলে এসো নয়তো আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও। ”

আনায়া এমন কন্ঠস্বরে আর আবদারে রেহান কিছুটা হেসে ফেললো,

—“আমাকে মিস করছিলে নাকি! তা এতো রাতে বুঝি আমার বউজানের মন গলে যায়। এখন থেকে তো ঠিক এই সময়েই তোমাকে ফোন করতে হবে। নাহলে দিনের……

—“রেহান আমি মজা করার মুডে নেই। আমার এসব কিছু অসহ্য লাগছে। এতো দায়িত্ব, এতো স্যাক্রিফাইস করার পরও আমার সাথেই কেনো এমন হচ্ছে। আমি তো সবার সুখের কথা চিন্তা করি তবুও কেউ কেনো বুঝতে চাইছে না আমি ভালো নেই, শান্তিতে নেই আমি । আমার আর এসব ভালো লাগে না।অস্তির লাগে আমার জীবন। নিজেকে অসহ্য লাগে আমার। ”

এবার রেহানের চেহারার রং কিছুটা পাল্টালো। আনায়ার কথাবার্তা আর স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। রেহান কপাল কুঁচকে অস্থির হয়ে বললো,

—“আনায়া তুমি কাঁদছো?…..আনায়া কি হয়েছে বলো আমায়। প্লিজ বলো, এভাবে আমার টেনশন বাড়িও না। তুমি জানো এখন আমার আর এখানে মন টিকবে না। প্লিজ বলো না কি হয়েছে, নয়তো আমি নিজেই টেনশনে পাগল হয়ে যাবো। ”

আনায়া রেহানের কথা শুনে এবার নিজেকে কিছুটা তটস্থ করলো। তার এই জীবনে সে করবে টা কি? এই রেহান তো আরেক পাগল, সবকিছু বলে দিলে তো আবার না জানি কোন পাগলামি করে বসে। দেখা যাবে সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে তার সামনে হাজির। আনায়া আর নিজের আবেগকে বেশি প্রশ্রয় দিলো না কিন্তু নিজেকে সবসময় থামিয়ে রাখতেও তার মন চাইছে না।

—“কিছু হয়নি, তোমাকে অনেক বেশি মিস করছিলাম। তাই একটু পাগলামি করে ফেলেছি। ”

রেহান আনায়ার স্বাভাবিক কথাগুলোও স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারলো না।

—“তুমি মিথ্যা বলছো, কি হয়েছে সত্যি করে বলো।”

আনায়া রেহানের কথার কোনো উত্তর দিলো না।সে ভাবছে সবকিছু রেহানকে ঠিক এই মূহুর্তে বলে দেওয়া ঠিক হবে কিনা। যদি সবকিছু বলে দেয় তবে রেহান কি ওকে ভুল বুঝবে। আনায়ার জানা নেই তবে রেহান নিশ্চয় তাকে ভুল বুঝবে না।কিন্তু এটা মোটেও সঠিক পরিস্থিতি নয়, এসব বলার জন্য। আনায়ার মাথাব্যথা যেন এসব চিন্তায় আরো বেড়ে গেলো। কোনোকিছু আর বুঝতে না পেরে বিরক্তিতে ফোনটাই বন্ধ করে রেখে দিলো। আর এদিকে রেহান আনায়ার অসম্পূর্ণ কথায় আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না। আনায়া পরমুহূর্তে আর ফোন ধরলো না দেখে চিন্তা তরতর করে বেড়ে চললো। দূরের দেশের দূরের শহরে বসে মাথাটা তার নানান চিন্তায় পুরো গুলিয়ে গেলো।

_______________

সেই ঘটনার প্রায় সাতদিন হতে চললো। এরমাঝে আনায়া একবারও অফিসে যায়নি সঙ্গে কেনীথের সাথে তার কোনো দেখা সাক্ষাৎও হয়নি। শুধু তাই নয়, নিজের যাবতীয় কাজকর্ম থেকেও অনেকটা গুটিয়ে নিয়ে ঘরবন্দী হয়ে আছে। প্রয়োজনেই শুধু নিজের রুম থেকে বের হয়। এদিকে তারেক কোনো কিছু সন্দেহ না করে, যেন আবার টেনশন না করে তাই মাঝেমধ্যে নিচে গিয়ে বাবার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করে আসে।

তবে এর মাঝে আবার নতুন কান্ড করেছে সে। ঠোঁটের ক্ষতটা অনেক বেশি থাকায় সবসময়ই মাক্স পড়ে থাকতো। কিন্তু এমনি এমনি তো আর বাড়ির ভেতরে মাক্স পড়ে থাকা যায় না। সেজন্য সেইদিনই ভোর রাতে গিয়ে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা বরফ বের করে গণহারে খেয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই ছিলো হালকা ঠান্ডা লেগে গেলেই হবে। যাতে সবাইকে বলতে পারে তার ঠান্ডা লেগেছে তাই মাক্স পড়ে থাকে।

কিন্তু পরবতীতে বিষয়টি হলো তার ধারনার উল্টো। একটু আকটু ঠান্ডা থেকে সোজা তিনদিন একটানা জ্বর, কাশি, সর্দি লাগিয়ে বেহাল অবস্থা করেছে। আজ ঠোঁটের ক্ষত আর তার অসুস্থতা অনেকটাই কমে গিয়েছে। ঠোঁটে হালকা একটু দাগ এখনো স্পষ্ট তবে বিষয়টিকে সহজেই কেউ বুঝে উঠতে পারবে না।

আনায়া এই কয়েকদিন আর ভার্সিটিতে যায়নি। রাতের বেলায় চেয়ার টেবিলে বসে বসে পড়ালেখা করতে বসেছিলো কিন্তু কোনো মতেই পড়াশোনায় মন বসছে না। এদিকে এই কয়েকদিন ইচ্ছে করেই রেহানের সাথেও কোনো যোগাযোগ করেনি কারণ সে জানে, রেহান তার সাথে কথা বলতে না পেরে নিশ্চয় ইনায়ার কাছ থেকে সকল ইনফরমেশন নেওয়ার ট্রাই করেছে। এই কারণে ইনায়ার শত রিকুয়েষ্টেও সে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কোনো কথা বলেনি।

আনায়া ডেস্কের উপর মাথা দিয়ে আবোল তাবোল বলে যাচ্ছে। বিরবির করে কখনো সবাইকে, নয়তো কখনো নিজেকে গালাগালি করে যাচ্ছে। একটা সময় বিরক্তি নিয়ে বিরবির করে বললো,

—“উফ!!! বাবা যদি ফ্রিজটাকেও বাড়ি থেকে সরিয়ে দিতো তবে না ওমন আজব বুদ্ধি মাথায় আসতো না আজ আমার এমন অবস্থা হতো।”

আনায়া এমনিতে জ্বরের সমস্যা না থাকলেও হালকা ঠান্ডা আর কাশিতে প্রচন্ড বিরক্ত সে। আর আনায়াদের বাড়িতে একসময় সব ধরনেরই জিনিসপত্র ছিলো। কিন্তু কয়েকবছর আগে তারেকে বাজে স্বভাব মূলত জুয়ার খেলায় বাড়ির অর্ধেকের চেয়ে বেশি জিনিস সে ক্রমে ক্রমে শেষ করেছে। এখন যা যা আছে তা এক সময়ের লেটেস্ট মডেলের জিনিসপত্র হলেও এই সময়ে ওসব জিনিস বড্ড বেমানান সঙ্গে অনেক পুরোনো হয়ে গিয়েছে। কিছু কিছু জিনিস পত্র হয়েছে অকেজো। এই কারণেই আক্ষেপে তার বাবার প্রতি অমন কথা বললো৷

_______________

রাত তো অনেক গভীর কিন্তু আনায়ার চোখে ঘুম নেই। তবে অতিরিক্ত চিন্তার ফলে হঠাৎ মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গিয়েছে। আনায়া যেন এতে আরেকটু বিরক্ত হলো। একবার ফোন স্ক্রিনে সময়টা দেখে মাথা থেকে হাত নামিয়ে বাথরুম যাওয়ার উদ্দেশ্যে চেয়ারে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। রাত প্রায় সারে বারোটা। এই সময় হঠাৎ কেনো যেন গোসল করতে ইচ্ছে হলো। যদিও আজ তেমন গরম পড়েনি তাই তবুও আনায়ার অস্থির লাগছে।

কিন্তু সে তার সিন্ধান্ত পাল্টে ফেললো। একে তো তার ঠান্ডা কমেইনি ঠিকমত এখন যদি আবার এতো রাতে গোসল করে তো আবার অসুখ তাকে কঠিন ভাবে ধরে বসবে। এই ভেবে যাস্ট চোখে মুখে হালকা পানি দিতে বাথরুমে চলে গেলো।

__________

রুমের দরজা খানা বন্ধ রইলেও জালানাটা সম্পূর্ণ খোলা। এই রুমের জানালার একটি বিশেষজ্ঞ হলো রুমের সবচেয়ে বড় জানালায় কোনো গ্রিল নেই। যেটাই আনায়া একদম খুলে রেখে দিয়েছে বাহির থেকে যেন বাতাস প্রবেশ করতে পারে তাই। আনায়া যেহেতু কিছুদিন ধরেই উপর তলাতেই রইছে তাই জানালায় শুধু একটা সাদা পর্দা লাগিয়ে রেখেছে।

আনায়া চোখেমুখে পানি দিতে গিয়ে আবার মাথাতেও কিছুক্ষণ পানি ঢালে। যেকারণে বাথরুমে তার প্রায় অনেকক্ষণ সময়ই লেগে যায়। এরপর ভেজা চুলগুলো টাওয়াল দিয়ে পেঁচিয়ে রুমে এসে চুলগুলোকে ঠিকমতো না শুকিয়েই ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে থাকে।

প্রথমে জানালাটা খোলা রাখতে চেয়েছিলো পরবর্তীতে ভাবলো শুধু শুধু এই জালানা খুলে রেগে লাভ নেই। বিপদ আপদ কখন হয় কে জানে। এই ভেবে জালানা বন্ধ করে রুমের লাইটটা বন্ধ করে দিয়ে সোজা বিছানায় শুয়ে পড়লো।

—“আ….না….য়া! ”

বিছানায় শুয়ে যেই না একটু চোখ বন্ধ করেছে ওমনি এক গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনে তার চোখজোড়া বিস্মিত রুপে খুলে গেলো। নিজেকে বুঝাতে চাইলো সে যা শুনলো এটা তার ভ্রম নাকি সত্যি। কিছুক্ষণ স্তব্ধ চোখে অন্ধকারে চোখ খুলে রাখার পর আবারও নিজের চোখজোড়া বন্ধ করতেই শুনতে পেলো,

—-“আ….না…য়া!!!

খাটের পাশে রাখা ছোট্ট একটা টেবিল ল্যাম্পটা ত্বরিত জ্বালিয়ে দিলো। মূহুর্তেই চারপাশে খুব সামান্য আলোয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আলোকিত হলো। হঠাৎ আনায়ার গলা শুকিয়ে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি করে বিছানা থেকে নেমে ফোনের ফ্ল্যাশ লাইটটা অন করে রুমের ভেতর ধীরে ধীরে হাটতে লাগলো আর ভাবতে লাগলো আওয়াজটা ঠিক কোথায় থেকে এসেছে।

—“রুমে কি কেউ আছে? ”

আনায়া প্রথমে কাঁপা কাঁপা সুরে বলার পর ভাবলো রুমে ইনায়া এসেছে কিনা। কিন্তু ও কিভাবে আসবে, দরজা জানালা তো সব বন্ধ। আনায়া কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। পরক্ষণেই মনে হলো আগে রুমের লাইটটা অন করাটা জরুরি।

মনের মধ্যে এমনিতেই হুট করে ভয়ের আভাস ঢুকে গিয়েছে। আর দেরী না করে আগে লাইট জ্বালানোটা বেশি জরুরি। আনায়া তাড়াহুড়ো করে সুইচবোর্ডের কাছে যেতে নিলেই হঠাৎ পেছন থেকে এক শক্তপোক্ত হাত তার কোমড় কেউ জড়িয়ে ধরতেই আনায়ার দম বন্ধ হয়ে গেলো।

মূহুর্তেই খানিকটা কাঁপতে শুরু করলো। আর যখনই কোনো এক অনাকাঙ্ক্ষিত নিশ্বাস তার ঘাড়ের কাছে ক্রমাগত অগ্রসর হতে নিলো ; তা অনুভব করেই আনায়া চিৎকারের জন্য প্রস্তুতি নিলো। কিন্তু তা আর সম্ভব হলো না, বরং এর আগেই তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি একহাতে আনায়ার মুখ শক্ত করে চেপে ধরলো।

এরপর আনায়া ঘাড়ের কাছে নিজের চোয়াল রেখে মুখটা আনায়ার কানের কাছে নিয়ে হাস্কি কন্ঠেস্বরে কেউ ফিসফিস করে বলে উঠলো,

—“তুমি যে এতোটা ভীতু তা জানতাম না বউপাখি!”

হঠাৎ পরিচিত কন্ঠস্বরে আনায়ার টনক নড়ে উঠলো। চোখেমুখে তার বিস্মিয়। আদোও সে যা ভাবছে তা কি সত্যিই?

আনায়া শুকিয় যাওয়া কাঠকাঠ গলায় কিছু বলতে চাইলে দেখলো কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। তার আগেই তার পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে রাখা ব্যক্তিটি আনায়ার মুখ থেকে হাত সরিয়ে আবারও ফিসফিস করে ইনোসেন্ট সুরে বললো,

—“এতো রাগ কেউ করে নাকি? পুরো সপ্তাহ ধরে একবারও যোগাযোগ করোনি। আমার কি অবস্থা করেছো তা তুমি জানো?

এবার আনায়ার মুখ ফসকে অস্পষ্ট সুরে বেড়িয়ে এলো,

—“রেহান……!”

—“হুম! শুধু আমার বউ পাখির রাগ ভাঙ্গাতে ওতো দূর হতে চলে এসেছি।…. আচ্ছা, তুমি কি অন্য কাউকে আশা করছিলে?”

আনায়া কেশে উঠলো, ত্বরিত পিছনে ঘুরে তাকানোর জন্য নড়েচড়ে উঠলে রেহান আর বাঁধা দিলো না। তবে আনায়া তার দিকে ফিরতেই সে এবার দুইহাত দিয়ে আনায়ার কোমড় পেঁচিয়ে ধরলো।

কফি কালাদের টিশার্টের উপর ওফ হোয়াইট কালারের গেঞ্জি। সঙ্গে কালো রংএর প্যান্ট। চুল গুলো এলোমেলো করে ব্যাক ব্রাশ করা। মনে হচ্ছে সুযোগের সঠিক সন্ধান পেয়েই তড়িঘড়ি করে চলে এসেছে।

কিন্তু চোখেমুখে তার অবাধ প্রফুল্লতা। যেন সব সুখ শান্তি এসে তাকে ঘিরে ধরেছে। উঁচালম্বা বলিষ্ঠ দেহের বাঙ্গালী পুরুষের মতো চেহারার গঠন আর ফর্সা তো সে আগে থেকেই ছিলো। কিন্তু এখন যেন, বিদেশের হাওয়ায় আগের চেয়ে যেন আরেকটু ফর্সা হয়ে ফিরেছে।

এমন অপ্রত্যাশিত প্রিয় মানুষকে দেখে আনায়া যেমন বিস্মিত তেমনি তার বাঁধ ভাঙ্গা খুশির দরূন চোখজুরে পানি ছলছল করছে। তখনই রেহান অপ্রস্তুত হয়ে তড়িঘড়ি করে বলতে লাগলো,

—“কাঁদছো নাকি? আমি এসেছি, তুমি খুশি হওনি। নাকি ফিরতে এতো দেরী করে ফেলেছি তাই……সরি, সরি, আমি ফিরতে অনেক দেরী করে ফেলেছি বোধহয়। আমার আরো আগে…”

রেহানের বাকি কথাটুকু আর সম্পূর্ণ হলো না তার আগেই আনায়া তাকে শক্ত করে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো অন্যদিকে কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর রেহানও মুচকি হেসে বললো,

—“মিস করছিলে ঠিক আছে, কিন্তু এভাবে কাঁদে কে শুনি। এসব কান্নাকাটি বাদ দেও, একে তো নিজেই ইচ্ছে করে যোগাযোগ করোনি আর এখন……

আনায়া এবার যেন আরো শক্ত করে চেপে ধরে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো। অনেকক্ষণ হওয়ার পরও যখন আনায় রেহানের কোনো কথাতেই কান্না থামিয়ে মুখ তুলে তার দিকে তাকাতে রাজি হলো না তখন রেহান ফিসফিস করে আনায়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,

—“বউপাখি! তুমি কিন্তু এখনো আমার বউ হওনি। এতো লং ডিস্টেন্সে থাকার পর এখন যদি বিয়ের আগে এসব করে ফেলো তবে বিষয়টি কেমন যেন হয়ে না? ”

রেহানের কথা শুনে আনায়ার যেন এবার ধ্যান ভাঙ্গলো। পাগলের মতো এটা এসব কি করতে গিয়েছে। আনায়া ত্বরিত রেহানের থেকে খানিকটা সরে গিয়ে চোখ মুছে আধ ভেজা সুরে বলতে লাগলো,

—“তুমি… এখানে কবে এসেছো। আমাকে বলোনি কেনো। ”

আনায়ার অবস্থা দেখে রেহান আবারও ওর কাছে গিয়ে দু’হাতে আনায়ার চোখমুখ মুখে দিতে দিতে মুচকি হেসে বললো,

—“বলার সুযোগটা দিয়েছিলে তুমি। ফোন বন্ধ করে বসে আছো। এই কয়েকদিন ইনায়ার কাছ থেকেই যা একটু খোঁজ খবর নিতে পেরেছি। ও যাই হোক, আমি আজই এসেছি। বাড়িতে এসে পৌঁছাতে প্রায় রাত নয়টা বেজে গিয়েছে। কিন্তু আজই মা আর বাড়ি থেকে বের হতে দিতে চাইতো না বিধায় চোরের মতো বাড়ি থেকে পালিয়ে রাতের বেলায় এখানে আসতে হলো।”

আনায়া বিস্মিত নজরে তাকিয়ে বললো,

—“তুমি এতোটা পথ জার্নি করে এসে, বাড়িতে রেস্ট না করে এখানে এসেছো কেনো? ”

—“আবার কেনো? যার জন্য এসেছি তার সাথে দেখা করবো না! এখন এখানে না আসলে এমনিতেও আজ রাতে আর ঘুম হতো না।”

—“কিন্তু তুমি এসেছো কিভাবে? দরজা জানালা তো বন্ধ ছিলো।”

রেহান মুচকি হেসে বললো,

—“তুমি যখন বাথরুমে গিয়েছিলে তখন। আজ ইনায়াকে মইয়ের ব্যবস্থা করে রাখতে বলেছিলাম। তো ও তোমার জানালার পাশে মই রেখে দিয়েছিলো আর বাকি আমাকেই কষ্ট করে আসতে হলো। ”

—“তার মানে ওই অদ্ভুত ভাবে আমার নাম ধরে তুমিই ডাকছিলে? ”

—“ইয়েস ম্যাম, তোমাকে ভয় দেখাতে গিয়ে খাটের নিচে লুকাতে হয়েছে আমায়। আচ্ছা এসব এখন বাদ দেও, আসল কথা বলো। তোমার হঠাৎ এমন চেঞ্জের কারণ কি? ”

আনায়া রেহানের প্রশ্ন শুনে চুপ হয়ে গেলো। ও এখন ওকে কি বলবে। এরই মাঝে রেহান রুমের লাইট অন করে দিয়ে এসে আবারও আনায়ার সামনে এসে দাঁড়ালো। কিন্তু আনায়া কিছু বলার জন্য ঠোঁট ভিজিয়ে নিতে লাগলে রেহান হঠাৎ ওর মুখের কাছে অগ্রসর হয়ে কপাল কুঁচকে বললো,

—“তোমার ঠোঁট এটা কিসের দাগ?”

এই কথা শুনে যেন আনায়ার শ্বাস নেওয়াই বন্ধ হয়ে গেলো। রেহানকে কি সত্যি কথা বলে দেবে। ও তবে কি ভাববে। আচ্ছা রেহানের ভাবার বিষয়টি না হয় বাদ দেওয়া যাক, ও রেহানকে ওসব বলবে কি করে।আনায়া বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য রেহানের থেকে দূরে সরে গিয়ে বিছানায় বসতে বসতে বললো,

—“ওই…টেবিলে বসে মাথা রেখে গড়াগড়ি করে গিয়ে একদিন হুট করে কেটে গিয়েছে।”

এটা শুনে রেহান অবাক সুরে আনায়া পাশে বিছানায় বসে বললো,

—“এ্যাহ….. এটা আবার কেমন কথা।”

রেহানকে এহেন চেহারায় তাকিয়ে থাকতে দেখে আনায়া অপ্রস্তুত সুরে বললো,

—“এটা এমনই কথা! ”

রেহান আনায়ার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পুনোরায় হেসে ফেললো।

—” মানুষ টেবিলে বসে পড়াশোনা করে আর তুমি কি যুদ্ধ করো নাকি।”

পরোক্ষণেই কপাল কুঁচকে বললো,

—“তোমার তো নাকি ঠান্ডা লেগেছে কিন্তু তোমার চুল কেনো ভেজা। ”

কথা বলতে বলতেই রেহান আনায়ার চুল ধরতেই বুঝতে পারলো চুল সত্যি সত্যিই ভেজা। আনায়া অপ্রস্তুত হয়ে বললো,

—“মাথা ব্যাথা করছিলো,চোখমুখে পানি দিতে গিয়ে মাথাতেও পানি ঢেলেছি। ”

—“পানি ঢেলেছো ভালো কথা কিন্তু চুল গুলো না শুকালে মাথা ব্যাথা কমবে নাকি বাড়বে? এমনিতেই ঠান্ডা লেগেছে তার উপর আবার…..এমন পাকনামি করতে কে বলে শুনি?”

এই বলেই কিছুটা বিরক্তি নিয়ে আনায়ার মাথার পেছনে হালকা চর দিতেই আনায়া বললো,

—“রেহান….!”

—“চুপ থাকো তুমি! একমিনিট ওয়েট করো।”

এই বলেই রেহান আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো চেয়ার উপর সাদা টাওয়ালটা আনায়া ছড়িয়ে রেখে দিয়েছে। ত্বরিত তা নিয়ে এসে বিছানায় আনায়ার পেছনে হাঁটু গেড়ে বসলো চুল মুছে দেবে বলে।

—“আরে কি করছো! প্রয়োজন নেই তো, আমি চুল অলরেডি মুছেছি।”

আনায়া মাথা ঘুরিয়ে কথা গুলো বলতে গেলে রেহান দুহাত দিয়ে আনায়ার মাথার দুপাশ ধরে সোজা করে বললো,

—“একদম চুপ! অলওয়েজ পাকনামি তোমার না করলেই নয়। দাঁড়াও না, বিয়েটা যাস্ট একবার করে নেই তারপর তোমাকে কিভাবে ঠিক করতে হয় তা আমার জানা আছে। ”

রেহানের কথা শুনে আনায়া হেসে ফেললো। অন্যদিকে আবার রেহানের কাজেও বাঁধা দিলো না আর রেহানও খুব যত্ন নিয়ে আনায়ার চুল গুলো মুছে দিতে লাগলো।

—“ওহে মিস্টার! এতোদিন পর এসেই সোজা হুমকি ধমকি দিয়ে দিচ্ছেন। তা বিয়ে করতে অনেক দেরী, এতোদিন না হয় আমি অগোছালোই থাকি…. এই, এই চিঠিতে তো বলছিলে অগোছালো তুমি। এখন আমি তুমি দুজনেই যদি অগোছালো হই তবে আমরা একে অপরকে ঠিক করবো কিভাবে?”

—“আরে তাই তো! আমরা নিজেরা ঠিক হতে না পারলে আমাদের ছেলে-মেয়ে গুলোতো আরো বেশি অগোছালো হয়ে যাবে। এরপর ওদের ছেলেমেয়েও এমন হবে। উফ, তাহলে তো মহা মুশকিল।”

আনায়া এবার কপাল কুঁচকে বললো,

—“এ্যাহ! বিয়েই হলো না তার আগেই বাচ্চা কাচ্চা, নাতিপুতিদের কাহিনি শুরু করে দিয়েছে।”

—“হয়নি তো কি হয়েছে। একবার বিয়ে হলে এসব হতে আর কতদিন। এই শুনো, আমি কিন্তু এসবে বেশি দেরী করবো না। ”

রেহানের বলা এহেন সব কথাবার্তা শুনে আনায়ার কাশি উঠে গেলো।

—“কি সব কথাবার্তা, বন্ধ করো এসব। আচ্ছা তুমি এটা বলো, তুমি দেশে এসেছো কি সত্যি শুধু আমার জন্যই,নাকি অন্য কিছু?”

—“তোমার কি মনে হয়? ”

—“আমার তো মনে হয় না, তুমি শুধু আমার রাগ ভাঙ্গাতে আমেরিকা থেকে কাজকর্ম সব ফেলে রেখে বাংলাদেশে এসেছো। আর যদি এমনটা হয় তবে তুমি সত্যিই একটা পাগল। ”

—-“তবে আমি সত্যিই পাগল। আমি আমার বউ পাখির জন্য পাগল।”

আনায়া এবার বিস্মিত চোখে পিছনে ঘুরে তাকিয়ে বললো,

—“তুমি সত্যিই…?”

—“হুম, তবে এছাড়া অবশ্য স্পেশাল একটা কারণ আছে কিন্তু সেটা মূলত তোমার জন্যই।”

আনায়া জিজ্ঞেসা সূচক ভাবে তাকালে রেহান বললো,

—“সেটা না হয় কালই জানতে পারবে!”

________________

পা গুলো ঝুলিয়ে বিছানার দুইপ্রান্তে দুজনে শুয়ে শুনে নানান গল্পগুজব করে যাচ্ছে। সঙ্গে সময়ের কাটাও পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে। একদম মধ্যে রাত যাকে বলে। এরই মাঝে হঠাৎ রেহানের কি যেন মনে পড়ায় চট করে উঠে বসে পড়লো। এটা দেখে আনায়াও ত্বড়ির বসে গিয়ে বললো,

—“কি হয়েছে? ”

রেহান কিছু বললো না বরং নিচে বসে খাটের নিচে উঁকি দিয়ে একটা ছোট শপিং ব্যাগ বের করে আনলো। আনায়া সেটা দেখে কিছু বলতে যাবে তার আগেই রেহান একটি বক্স বের করে তা আনায়ার সামনে খুলে ধরতেই বললো,

—“দেখো তো পছন্দ হয় কিনা? ”

সোনার চেইনের সঙ্গে খুব ছোট সাইজের একটি ঝিনুকে ডিজাইন করা ডায়মন্ডের লকেট। সাধারণ এসব জিনিস দেখতে এমনতেই সুন্দর হয় যা সহজেই যে কারো পছন্দ হয়ে যাবে। আনায়ারও তার ব্যতীক্রম হলো না। তবে কিছুটা বিস্মিত হয়ে রেহানের দিকে তাকিয়ে বললো,

—“এটা…

—-“তোমার জন্য।…বেশি কথা বলবে না, পছন্দ হয়েছে কিনা শুধু এইটুকু বলো।”

আনায়া জানে এখন আর কিছু বলে লাভ নাই, তাই ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,

—“হুম! ”

এটা শুনে রেহান মুচকি হেসে বললো,

—“যাক! তাহলে আমার চয়েস এতোটাও খারাপ না।”

এই বলেই আবারও আনায়ার উদ্দেশ্যে বললো,

—“আমি পড়িয়ে দেবো নাকি… তুমি..!”

আনায়া ত্বরিত বলে উঠলো,

—“তুমি…না মানে তুমিই দেও আরকি!”

রেহান আনায়ার দিকে এক ভ্রু উঁচিয়ে হেসে বললো,

—“ওক্কে মেডাম! ”

এই বলেই নিজ হাতে খুব স্বাভাবিক ভাবেই আনায়ার পেছনে গিয়ে চুল গুলো সরিয়ে চেইনটা পড়িয়ে দিলো। তবে পেছন থেকে আরো একটু চেইনের অংশ দেখে আনায়ার উদ্দেশ্যে বললো,

—“এটা কি? তুমি কি আরো একটা চেইন পড়ে রেখেছো নাকি!”

আনায়ার হঠাৎ স্টার শেইপের সেই চেইনের কথা মনে পড়তেই বললো,

—“ওহ হ্যাঁ,আচ্ছা দাঁড়াও ওটা আমি খুলে ফেলছি।”

আনায়া সেই চেইনটা খুলে ফেলতে চাইলে রেহান তাতে বাঁধা দিয়ে বললো,

—-“আরে দুটোই থাক!খোলার কি প্রয়োজন।”

আনায়া রেহানের দিকে তাকিয়ে বললো,

—“দুটোই রাখবো? কেমন লাগে না?”

—“তোমার অসুবিধা না হলেই হলো। বাকিটা তোমার ইচ্ছে।”

—“আচ্ছা তবে দুটোই থাক!”

______________

এখন সমটা রেহানের যাওয়ার। যদিও তার যেতে মোটেও ইচ্ছে করছে না তবুও এমন ছেলেমানুষী করে লাভ নেই। এমনিতেও আনায়া থাকতে দেবে না সঙ্গে আবার কাল অনেক কাজ। ভোর হওয়ার আগে নিজের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছাতে হবে। তার মা কোনো ভাবো বুঝে গেলে কাহিনি খতম। এমনিতেই বাড়িতে সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই বাড়ি থেকে একপ্রকার পালিয়ে এসেছে আর এখন তার অনেকটা ক্লান্তও লাগছে।

রেহান আনায়া কাছে থেকে সকল বিদায়, কথাবার্তা বলা শেষে জানালা দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে যাবে তার আগেই হুট করে আবার পিছনে ফিরে আনায়ার উদ্দেশ্যে বললো,

—“একটা কথা বলার ছিলো।”

—“সারারাত তো কথাই বললে, আবার কি কথা।”

রেহান হুট করেই আনায়ার হাত দুটো ধরে খানিকটা অপ্রস্তুত সুরে বললো,

—“আমাকে কখনো ছেড়ে যাবে না তো?”

আনায়া রেহানের কথা শুনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে থাকার পর বললো,

—“তুমি এমনটা চিঠিতেও লিখেছিলে। বারবার এমন কেনো বলছো? ”

রেহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনায়ার চোখে চোখ রেখে বললো,

—” আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না আনায়া। তুমি হীনা জীবন আমার কাছে বিষাক্তময়, দমবন্ধকর। এসব আমার ভাবতেই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। তোমার কাছে আমার জীবনের একটাই অনুরোধ, প্লিজ ভুলেও আমাকে ছেড়ে যেও না। তুমি আমার যেভাবে শুধরে যেতে বলবে আমি ঠিক ওভাবেই নিজেকে শুধরে নেবো তবুও তুৃমি…”

আনায়া রেহানকে এমন অস্থির হতে দেখে ত্বরিত নিজের হাত দিয়ে ওর হাতের মুঠো শক্ত করে বললো,

—“রেহান প্লিজ! এমনটা বলে আমাকে কষ্ট দিও না। আমার জীবনের অর্ধেকটা শুধু আমি তোমার জন্যই উৎসর্গ করেছি। তুমি ছাড়া আমার বেঁচে থাকা, না থাকা সমান। তোমাকে ছেড়ে গেলে আমার জীবন এমনিতেই নরকে পরিণত হবে। আমি কোনোদিনও এমন করবো না।”

আনায়ার কথায় রেহান নিজেকে তটস্থ করলো। এমনিতেই আনায়ার চোখে জল ছলছল করছে। কখন যে বর্ষণ হয়ে যায় কে জানে। যাওয়ার আগে এমন সিচুয়েশন ক্রিয়েট করে পুরো গাধামি কাজকর্ম হয়ে গেলো। রেহান ত্বরিত মুচকি হেসে বললো,

—“আরে আমি তো যাস্ট এমনিই বলছিলাম। তুমি থাকো, কাল তোমার জন্য একটা বড় সারপ্রাইজ রয়েছে, রেডি থেকো।”

এই বলেই আর একমুহূর্তও দেরী না করে ত্বরিত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো। পুরোটা সময় আনায়া জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রেহানের কার্যকলাপ দেখলো। একটা সময় পর রেহান যখন বাড়ির সীমান্ত থেকে দাঁড়িয়ে অদৃশ্য হলো তখন আনায়া দীর্ঘ শ্বাস ফেলে জানালাটা বন্ধ ঘুমানোর উদ্দেশ্যে বিছানায় এলো। তবে হুট করেই নিজের পা জোড়া থামিয়ে ওখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। এরপর তার জামার কারণে ঢেকে যাওয়া লকেট দুটোকে একসাথে বের করে কিছুক্ষণ অদ্ভুত নজরে তাকিয়ে থাকার পর অস্ফুট স্বরে বললো,

—“একই গলায় দুটো চেইন একসাথে?”

#চলবে